» » আনোয়ারা

বর্ণাকার

আনোয়ারা

আনোয়ারা বাঙ্গালী ঔপন্যাসিক মোহাম্মদ নজিবর রহমান রচিত একটি কালজয়ী সামাজিক উপন্যাস। এটি তার রচিত প্রথম ও সর্বাধিক সার্থক উপন্যাস। এটি ১৯১৪ সালের ১৫ জুলাই (১৩২১ বঙ্গাব্দে) কলকাতা থেকে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। বাঙালি মুসলমান সমাজে মীর মশাররফ হোসেন রচিত “বিষাদ সিন্ধু”র পর এটিই সর্বাধিক পঠিত ও জনপ্রিয় উপন্যাস। ২০১৪ সালে এ উপন্যাসের শতবর্ষ পূর্তি পালন করা হয়। এই উপন্যাসে সপ্তাদশ শতাব্দীতে গ্রামীণ বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের চিত্র ফুটে উঠে।

চরিত্রসমূহ হচ্ছে— আনোয়ারা; হামীদা; নূর ইসলাম; উকিল সাহেব; দাদীমা; গোলাপজান (আনোয়ারার সৎমা); সালেহা; সালেহার মা প্রমুখ।

১৯৫৬ সালে ‘আনোয়ারা’ সম্পর্কে ড. মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (আধুনিক যুগ) এ বলেছেন,

“জনপ্রিয়তা দিয়ে যদি কোন বইয়ের বিচার করতে হয়, তাহলে মোহাম্মদ নজিবর রহমান রচিত ‘আনোয়ারা’র দাবিই সর্বাগ্রে বিবেচ্য। ১৯১১ থেকে ১৪ সালের মধ্যে এ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৪৯ সালে এ বইটির ত্রয়োবিংশতি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এবং এ যাবৎ ‘আনোয়ারা’র দেড়লক্ষ কপি নিঃশেষিত হয়েছে।”

১৯৬১ সালে (বাংলা ১৩৬৮ সনের চৈত্র মাসে) এর সাতাশতম সংস্করণ প্রকাশিত হয় এবং ঐ সময় পর্যন্ত এর সাড়ে পাঁচ লক্ষ কপি বিক্রয় হয় বলে জানা যায়। কলকাতা ও ঢাকা থেকে এ পর্যন্ত এ উপন্যাসের ৬০টিরও বেশি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। ‘আনোয়ারা’ এক সময় পাঠ্য-তালিকাভুক্ত ছিল।

নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন তাঁর উপন্যাসে তাঁর সমকালীন জীবন ও সমাজকে যথাযথভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সে সময়কার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-কল্পনা ও স্খলন-পতনকে তিনি বাস্তবসম্মতভাবে রূপায়িত করতে সচেষ্ট হয়েছেন। তাছাড়া মানবজীবনের কতগুলো চিরায়ত মূল্যবোধ যেমন-প্রেম, ন্যায়পরায়ণতা ও মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ ইত্যাদি তাঁর লেখায় যথাযথভাবে ফুটে উঠেছে। এসব কারণেই তাঁর রচনা সেসময়ে যেমন ব্যাপকভাবে সমাদৃত ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, তেমনি তা চিরকালীন মানুষের কাছেও প্রশংসিত হয়েছে, বিশেষত তাঁর রচিত ‘আনোয়ারা’ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে ক্লাসিক মর্যাদা পেয়েছে।

১৯১৭-১৯১৮ সালের মধ্যে ‘আনোয়ারা’ উপন্যাসের পরিশিষ্ট বা সিকুয়্যাল হিসাবে ‘প্রেমের সমাধি’ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৩ সালে (বাংলা ১৩৭০ বঙ্গাব্দে) এর উনিশতম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। আনোয়ারার মত এটিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

১৯৬৭ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ও সাহিত্যিক জহির রায়হান এ উপন্যাস অবলম্বনে একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। প্রযোজনা করেছেন ইফতেখারুল আলম। চলচ্চিত্রটিতে প্রধান চরিত্রসমূহে অভিনয় করেন রাজ্জাক, সূচন্দা, বেবী জামান, রুবিনা, রানী সরকার, আমজাদ হোসেন প্রমুখ। বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ১৯৮৭ সালে এ উপন্যাসের ধারাবাহিক নাট্যরূপ সম্প্রচার করে।

পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করেছে এই দুই নারী। তাই নিজেরা নারী হয়ে অপর নারীর প্রতি সামান্যতম ভালোবাসা বা করুণা মনে জন্ম নেয়নি। বরং প্রতিনিয়ত কিভাবে আনোয়ারাকে মানসিক অত্যাচার করা যায় সে ব্যাপারে তৎপর থেকেছে।

উপন্যাসে শেষপর্যন্ত গোলাপজান তার লোভ, আক্রোশের জালে বন্দি হয়েছে। অতি লোভে তার ঘড়া পূর্ণ হয়। যদিও গোলাপজান আগের পক্ষের ছেলে বদসার খুনের দায় দিয়েছে স্বামীর ওপর। গোলাপজান চরিত্রের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সমাজে বহুবিবাহের কুফল। অন্যদিকে সংসারে সৎ মায়ের উপস্থিতি সন্তানের জীবনে অভিশাপ হয়ে দেখা দেয় তার চিরন্তন রূপ। জাফর বিশ্বাসের মেয়ে গোলাপজান। বাবা ছিল ডাকতের সর্দার। শেষ জীবনে পুলিশের চেষ্টায় ধরা পড়ে ৮ বছর জেল খাটে। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। বাপের মতো ডাকসাইটে স্বভাব গোলাপজানেরও। যদিও ভাই আজিমুল্লা বাপের পথে পা বাড়ায়নি। কিন্তু গোলাপজান দেখতে সুন্দরী। বিয়ে হওয়ার পর স্বামীর ঘর থেকে পালিয়ে আসে। কিন্তু অজিমুল্লা এবং মায়ের শাসনে খোরশেদের সংসারে টিকে যায়। কিন্তু আনোয়ারার বাপ খোরশেদ স্ত্রীর কাছে সর্বদাই অবহেলিত। মেয়ের প্রতি অত্যাচারেও সে নির্বিকার। নুরল এসলামের হত্যার ষড়যন্ত্র করলেও গোলাপজানের পাপেই সে নিজ সন্তানকে হত্যা করে বসে।

অন্যদিকে আনোয়ারার সৎ শাশুড়ির অত্যাচার অভিশাপ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে কিন্তু আনোয়ারা এখানেও নির্বিকার। দুই মায়ের অত্যাচার নীরবে সয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে ঔপন্যাসিক নারী জীবনে দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার দিকেই ঝুঁকেছেন। তবে উপন্যাসে তিনি সর্বোপরি দেখাতে চেয়েছেন স্বামী-স্ত্রী পরস্পর বোঝাপড়া, ঘরের সুখ বজায় থাকে নারীর ওপর, নারীর কোমল স্বভাবই সর্বত্র জয়ী, সতীত্বের গৌরব, ধর্ম জীবনের মাহাত্ম্য। আনোয়ারার দুঃখী জীবনের মাঝে স্বস্তি যেন এটুকুই নুরল এসলামের মতো পতি তার ভাগ্যে জুটেছে। নারীর অন্তঃপুরে অবস্থান এবং স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসা, বিশ্বাস, আস্থা ও আনুগত্য উপন্যাসটিতে বিশেষভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

আনোয়ারার পতিপরায়ণ স্বভাবই সংসারের সুখ-শান্তি বয়ে আনে সে লক্ষেই এগিয়েছেন লেখক। নারীর গুনেই শুধু অন্তঃপুরের শোভা বৃদ্ধি পায়। আর সে নারী যদি হয় গোলাপজান বা সালেহার মায়ের মতো তবে সংসার চির অশান্তিতে ডুবে যায়। লেখক সর্বোপরি নারীর জীবনের সঠিক দিশা দেখাতে চেয়েছেন আনোয়ারার জীবন রূপায়নের মধ্যে দিয়ে।