নজিবর রহমানের সাহিত্যে সমাজ ও সমকাল
করুণা রাণী সাহা
উনিশ শতকের শেষদিকে মীর মশাররফ হোসেন বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসে মানবতা ও মানবিক প্রত্যয়ের সরনি সৃষ্টি করে বাংলা সাহিত্যের ক্রমপ্রবাহমান ধারার সাথে মুসলিম সাহিত্যিকদের রচনার আত্মিক যোগসূত্র স্থাপন করেছিলেন। বাংলা গদ্যের উৎকৃষ্টতম শিল্পকর্ম উপন্যাস। উপন্যাসের যাত্রা শুরুর কাল থেকেই বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকদের অভিযাত্রা উপন্যাস সাহিত্যের ইতিহাসের সাথে যুক্ত হয়ে এই উৎকৃষ্টতম শিল্প শাখাকে সমৃদ্ধ করেছে। ১৮৬৯ সালে রত্নাবতী প্রকাশ করে মীর মশাররফ হোসেন উপন্যাসের নতুন অঙ্গনে যাত্রা শুরু করেন। উপন্যাসের এই প্রবাহমান ধারায় বিশ শতকের প্রথম দিকে কয়েকজন ঔপন্যাসিকের আবির্ভাব ঘটে, তাঁরা হলেন মোহাম্মদ নজিবর রহমান ও কাজী ইমদাদুল হক (১৮৮২-১৯২৬)। উনিশ শতকের শেষার্ধ ও বিশ শতকের দুই দশক পর্যন্ত বাংলা উপন্যাসে এই তিনজন সার্থক মুসলমান শিল্পী বাংলা উপন্যাসের জীবন সম্পৃক্ত প্রবাহমান ধারার সাথে নিজেদের যুক্ত করে এই ধারাকে সম্প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করেছেন। সেই সূত্র ধরেই বাংলা উপন্যাসের প্রতিষ্ঠার পর্বে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে সামাজিক পটভূমিতে জীবন ঘনিষ্ট কাহিনী রচনা করে গভীরতর সত্যের রূপদান করেছিলেন মোহাম্মদ নজিবর রহমান (১৮৬০-১৯২৩)। তিনি পাঁচটি উপন্যাস রচনা করেন- আনোয়ারা (১৯১৪), প্রেমের সমাধি (১৯১৫), চাঁদ তারা বা হাসান গঙ্গা বহমনি (১৯১৭), গরীবের মেয়ে (১৯২৩), পরিণাম (১৯২৭)।
বিশ শতকের প্রথম প্রথম দিকে বিকাশোন্মুখ মধ্যবিত্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব লেখক নজিবর রহমান। বিশ শতকের প্রথম দ্বিতীয় দশকের গ্রামীণ মধ্যবিত্ত মুসলিম জীবন ও সমাজের আলেখ্য নিয়ে নজিবর রহমান রচনা করেন ‘আনোয়ারা” উপন্যাস। সামাজিক জীবনের বৃত্তি, ধর্মীয় আবেশ ও অনুভূতি মানুষের জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে, কীভাবে নির্মিত হয় জীবনবোধ তারই চিত্ররূপ আনোয়ারা উপন্যাস। গ্রাম্য জীবনের দলাদলি, হীন ষড়যন্ত্র, বংশ গৌরবের অন্তঃসার শূন্যতা, নারী শিক্ষার উপযোগিতা, পেশাগত দ্বন্দ্ব সংঘাতের বর্ণিল বিশ্বস্ত রূপায়ণ রয়েছে এই উপন্যাসে। বংশ সম্পর্কিত অহমিকা প্রসঙ্গে লেখকের মতামত জানা যায় উপন্যাসের এক অংশে— ‘পরদিন রবিবার… বলাই বাহুল্য।’ আনোয়ারা উপন্যাস রচনা করে বিশ শতকের জীবন সম্পৃক্ত সাহিত্যের ধারায় মুসলিম জীবন ও সমাজের প্রবেশাধিকার দিয়েছেন নজিবর রহমান। সহযাত্রী হিন্দু সাহিত্যিকদের মত তিনি মানুষের জীবন ও কর্মধারার স্বীকৃতি দিয়ে নতুন শিল্পের এই ধারায় অবগাহন করেছিলেন। তাঁর প্রয়াসেই সেই সময়ের বাংলার এক শ্রেণির মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, চিন্তা চেতনাকে রূপায়ণ করে মুসলমান সমাজের মানুষের জীবন, জীবনের পিপাসা এবং ভাব-ভাবনাকে ব্যবহার করে ঔপন্যাসিক বাংলা উপন্যাসের দিগন্তকে প্রসারিত করেছেন।
মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের ধারক নজিবর রহমান আনোয়ারা উপন্যাসে আবহমান কাল থেকে সমাজে প্রচলিত বহুবিবাহের কুফল, বংশ গৌরবের অন্তঃসারশূন্যতা, গ্রাম্য দলাদলি, স্বার্থান্ধতা ইত্যাদি ও পাশাপাশি সমাজে শিক্ষার প্রয়োজন, নারী শিক্ষা, স্বামী-স্ত্রীর পারস্পারিক বোঝাপড়া, স্বাধীন ব্যবসা, সতীত্ব, ধর্মজীবনের মাহাত্মের উপর গুরুত্ব আরোপ করে তাঁর আদর্শকে প্রকাশ করেছেন।
উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের প্রথম দিকে সরকারি চাকরি, শিক্ষকতা, ওকালতি ও ব্যবসা বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে সেই সময়ের পূর্ব বাংলা অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে একটি মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজ গড়ে ওঠে। এই মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান শ্রেণির একটি প্রভাবশালী অংশ জমিজমা ও ব্যবসা বাণিজ্য বিশেষত পাট চাষ ও পাট ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত হয়। এতে তাদের আর্থিক স্বাচ্ছন্দের সাথে সাথে সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তিও বেড়ে যায়। নজিবর রহমান আধুনিক সমাজ বিবর্তনের এই প্রাথমিক পর্যায়ের চিত্র ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসে। সমাজ বিবর্তনের সূচনা পর্বের বাস্তব অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছিলেন উত্তর বঙ্গের গ্রামাঞ্চলে পাট ব্যবসার প্রসার পাট ব্যবসা কেন্দ্রিক অর্থনীতির সূচনা। জন্মসূত্রে ও কর্মসূত্রে উত্তরবঙ্গের সিরাজগঞ্জ জেলার হটিকুমরুল ও বেলকুচি উপজেলার ভাঙাবাড়ি গ্রামে কবি রজনীকান্ত সেনের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে শিক্ষকতার সময় তিনি গ্রামীণ সমাজে অবস্থানের সময়ে গ্রাম্য সমাজ জীবনের বিবর্তনকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পান— আর সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে তিনি তাঁর উপন্যাসগুলোতে তুলে ধরেন।
মুসলিম জীবন ও সমাজকে উপন্যাসের উপকরণ করে মানুষের স্বীকৃতিকে তিনি বলিষ্ঠ করে তুলেছেন। তাই সাহিত্যে জীবন ও সমাজের সম্পৃক্ততায় মুসলমানদের প্রয়াস কোন মতেই ন্যূন নয়। উপেক্ষিত প্রামীণ জীবন ও সমাজের চিত্রাঙ্কনে সেই সময়ের মুসলিম সাহিত্যিকেরা এক ভ্রান্ত সত্যের দিক উন্মোচন করেছেন। সেই সময়ের মীর মশাররফ হোসেন, নজিবর রহমান, মোজাম্মেল হক, কাজী ইমদাদুল হক প্রমুখেরা মুসলিম রুচি, শিক্ষা, আভিজাত্য ও সাংস্কৃতিক দিক তুলে ধরে বৃহত্তর জনসমাজকে প্রকটিত করেছিলেন। সেখানে মানুষের স্বার্থান্বেষী চেহারা যেমন আছে তেমনি মানবত্বের শ্রেয় ও প্রেয়ের বিশিষ্টতার দিকটিও প্রকাশ পেয়েছে। আনোয়ারা উপন্যাস সম্পর্কে হাসান হাফিজুর রহমান লিখেছেন- এতে যুগ আলেখ্য আছে কিন্তু যুগ চেতনা বলতে যা বোঝায় তা নেই।
‘আনোয়ারা’ উপন্যাসে লেখক শিক্ষা ও ব্যবসার কারণে গ্রামীণ জীবন থেকে নগরমুখী জীবনায়নের যে চিত্র এঁকেছেন তা ঐতিহাসিক সত্য। দুর্ভিক্ষ, গ্রাম্য মহাজনী তৎপরতার কারণে গ্রামীণ অর্থনৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়লে নবগঠিত শহরাঞ্চলের শিল্পমুখী উত্তরায়ণে মানুষ জীবন ও জীবিকার সন্ধানে শহরমুখী হয়ে রেল ও জাহাজ ঘাটের কুলি, কলকারখানার শ্রমিক, লঞ্চ স্টিমারের সারেং হয়ে শ্রমিক শ্রেণিতে পরিণত হয়, তাতে গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙ্গে শহুরে অর্থনীতির নতুন ধারা গড়ে ওঠে। আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের ফলে মুসলিম সমাজে কৃষি নির্ভরতার পাশাপাশি চাকরি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়, তাতে এক নতুন সমাজের সূচনা হয়। এভাবে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির গোড়াপত্তনের চিত্র পাওয়া যায় আনোয়ারা উপন্যাসে। উপন্যাসের শুরুতেই দেখা যায় আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নুরুল ইসলাম পাট কম্পানির কাজ নিয়ে উত্তরবঙ্গের মধুপুর গ্রামে নৌকা বেঁধেছে। সে সময় উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর পাবনা জেলা পাট ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ছিল, উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে সমকালীন গ্রামীণ জীবনের একটি বিশেষ অঞ্চলের চিত্রকে উপস্থাপন করে গ্রাম বাংলার সামগ্রিক জীবনকে প্রতিফলিত করেছেন। মুসলমান সমাজের শিক্ষিত মানুষ চাকরিকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছিল, সেই বাস্তবতায় দেখিয়েছেন জীবিকার সন্ধানে বি.এ পর্যন্ত পড়া নুরুল ইসলাম ‘বাড়ী হইতে ছয়মাইল পূর্বে বেলগাও-এর জুট কম্পানির অফিসে পঁয়ত্রিশ টাকা বেতনের চাকরি গ্রহণ করেন।’ চাকরির পাশাপাশি স্বাধীন ব্যবসা করে মুসলমানেরা প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠেন, লেখক তা তুলে ধরেন- ‘পাটের ব্যবসায়ের উন্নতির সময় নুরুল ইসলাম এই ব্যবসায় আরম্ভ করিয়াছিলেন, সততায় অভিজ্ঞতায় ও ব্যবসায়ের কল্যাণে তিনি ২/৩ বৎসরে স্বয়ং লক্ষপতি হইয়া উঠিলেন।’
আনোয়ারার সই হামিদার পিতা ফরহাদ হোসেন তালুকদার বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক, হামিদার স্বামী বি.এ পাশ করে কলকাতায় আইন পড়ে পরে ওকালতি পেশা গ্রহণ করে। মেয়েদের শিক্ষায় ইংরেজির প্রচলন না হলেও ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি মেয়েরা যে বাংলা শিক্ষা লাভ করছিল এ উপন্যাসে তারও পরিচয় আছে। আনোয়রা- ‘স্বাস্থ্য বিজ্ঞান, ভূগোল পাঠ, ভারতের ইতিহাস আদ্যান্ত মুখস্থ করিয়া ফেলিয়াছে। চারুপাঠ, সীতার বনবাস, মেঘনাদ বধ কাব্য… প্রভৃতি সাহিত্য পুস্তক সুন্দর রূপে বুঝাইয়া লিখিতে পারে।
আনোয়ারা নব্য বিকশিত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত জীবন ও সমাজের প্রথম শিল্পরূপ। এই উপন্যাসেই প্রথম একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সামগ্রিক রূপ প্রকাশিত হয়। নজিবর রহমান মুসলিম সমাজ জীবনকে উপজীব্য করে উনিশ শতকের উপন্যাসীয় শিল্প আঙ্গিক রীতিতে নিজের আদর্শায়িত চিন্তা ভাবনার প্রতিপলন করে এই উপন্যাস রচনা করেন। এই উপন্যাসে লেখক নজিবর রহমান গ্রামীণ জীবনের বাস্তবতার বিশ্বস্ত রূপায়ণ ঘটিয়ে বিশ শতকের প্রথম দিকের বিকাশোন্মুখ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী জনপ্রিয় লেখকের মর্যাদায় আসীন হন। এ বিষয়ে মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে লিখেছেন— ‘মুসলমান পরিবারের পারিবারিক ব্যবস্থাপনার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র এ গ্রন্থটিতে পাওয়া যায়। মধ্যবিত্ত ধর্মপ্রাণ মুসলমান গৃহের আচার-আচরণ, ঈর্ষা- বিদ্বেষ, অহমিকা ও আকাঙ্ক্ষা এবং ত্যাগ ও বিনয় এ গ্রন্থটিতে অসাধারণ সফলতার সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে।’ এক শ্রেণির মানুষের বংশ সম্পর্কিত অহমিকাবোধ সমাজকে অধঃপতনের চরম পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল, যা ছিল এই সমাজের জন্য দুর্ভাগ্যের অন্যতম কারণ। অহমিকা প্রসঙ্গে উপন্যাসে লেখক লিখেছেন— ‘…নুরুল এসলামের বৈঠকখানায় গ্রামের গণ্যমান্য প্রধান প্ৰধান লোক আসিয়া সমবেত হইতে লাগিলেন। কিছু বেশী বেলা একটা তাজী ঘোড়ায় চড়িয়া গোপীনপুর হইতে নুরুল এসলামের সৎ মার ভাই আলতাফ হোসেন সাহেব আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অবস্থা শোচনীয় হইলেও তাঁহার সম্পদ কালের আমীরী চালচলন কমে নাই। আমাদের অপরিণামদর্শী আভিজাত্যাভিমানী মহাত্মা অনেকেই এই রোগে আক্রান্ত হইয়া অধঃপতনের চরম সোপানে পদার্পণ করিয়াছেন এবং এখনও করিতেছেন।’ শিক্ষিত ও ধনাঢ্য মুসলমান পরিবারের জীবনযাত্রায়ও পরিবর্তন এসেছিল, তার পরিচয়- আনোয়ারা ‘পরদিন স্নানান্তে দ্বিতল বাসগৃহের সেই নির্জন চত্বরে পরমানন্দে সেই রূপার খাটে বসিয়া সোনার আলনায় চুল শুকাইতেছে।’
নিজের মানসিকতার প্রতিফলনে নজিবর রহমান আনোয়ারা ও নুরুল ইসলামের চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। স্বামীর প্রতি আনোয়ারার অরিসীম শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও আস্থা। সে বিবেকবান, নিরহংকার, লোভী, শঠ, ক্ষুদ্র ও নীচ নয়। সংসার জীবনে মানিয়ে নেয়ার প্রবণতা তার আছে। সে নজিবর রহমানের মানসকন্যা। তেমনি নুরুল ইসলাম ধর্মপ্রাণ, সজ্জন ব্যক্তি। তার মধ্যে কর্তব্যবোধ, নিৰ্ভীকতা, আবেগ প্রবণতা, ক্ষমাশীলতা ও সরলতার প্রকাশ আছে।
নজিবর রহমান সমাজের গ্রাম্য দলাদলি, হীন ষড়যন্ত্র, অন্তঃসারশূন্য বংশ গৌরব, সমাজে নারী শিক্ষার প্রয়োজন এবং পেশাগত জীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের স্পষ্ট চিত্র এঁকে সামাজিক জীবনের বৃত্তে ধর্মীয় আবেশ ও অনুভূতির অন্তরঙ্গ প্রকাশ দেখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন ধর্মীয় আবেশ ও অনুভূতি মানুষের জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে, জীবনবোধ কীভাবে নির্মিত হয়। ‘আনোয়ারা’ নজিবর রহমানের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এতে বর্ণিত হয়েছে আনোয়ারা ও নুরুল এসলামের বিড়ম্বিত জীবন এবং তা থেকে উত্তরণের কাহিনী। এরা সেই সময়ের গ্রামীণ মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবার ও সমাজের প্রতিনিধি। এরা মুসলিম গ্রামীণ সমাজের type চরিত্র। সমাজের রূঢ় বাস্তবতাকে চিত্রিত করার ক্ষেত্রে নর-নারীর এমন typ।cal চরিত্র নির্মাণে নজিবর রহমান সার্থক চিত্রকর। মুসলমান সমাজের আশা আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শ রূপায়ণে তিনি বিশ্বস্ত ছিলেন। সামাজিক জীবনের বৃত্তি, ধর্মীয় আবেশ ও অনুভূতি মানুষের জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করে, কীভাবে নির্মিত হয় জীবনবোধ তারই চিত্ররূপ আনোয়ারা উপন্যাস।
আনোয়ারা ও নুরুল এসলামের পূর্বরাগ, বিয়ে, দাম্পত্য জীবনের মাধুর্য, বিমাতার চক্রান্ত, চক্রান্তের শিকার, বিড়ম্বিত জীবন এবং বিড়ম্বনা থেকে উত্তরণ শেষে তাদের দাম্পত্য জীবনের শুভ পরিণতি এ উপন্যাসের বিষয়। এই দুই প্রধান চরিত্র ছাড়া খোরশেদ আলী ভূঞা, গোলাপজান, নবা, গণেশ, ফরমান প্রভৃতি চরিত্র চিত্রণে তাঁর দক্ষতার পরিচয় রয়েছে। খোরশেদ আলীর নৈতিক চরিত্র দুর্বল, স্ত্রী গোলাপজানের প্রতি তার দারুণ দুর্বলতা। স্ত্রীর প্ররোচনায় সে মেয়ে-জামাইকে হত্যার ষড়যন্ত্রে অংশ গ্রহণ করতে পিছপা হয়নি। রূপের মোহ তাকে অমানুষের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। গোলাপজান ধূর্ত, লোভী ও ঈর্ষা-পরায়ণ। আনোয়ারার রূপের সাথে নিজের রূপের তুলনা করে হিংসা করে। টাকা আত্মসাতের জন্য নুরুল ইসলামকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে, এ ব্যাপারে স্বামীকে প্ররোচিত করে। সে একটি প্রাণবন্ত চরিত্র, তার লোভ আছে, আবার দ্বিধা-দ্বন্দ্বও আছে, তবে লোভ ও ঈষারই জয় হয়েছে। নুরুল ইসলামকে হত্যা করতে যেয়ে সে থরথর করে কাঁপতে থাকে, হাত থেকে ছুড়ি পড়ে যায়, লোভের বসে হত্যা করে বসে নিজের ছেলেকে। এভাবে বিকাশ ও বিবর্তনে সে একটি প্রাণবন্ত চরিত্র। তিনি সেই সময়ের নব্য মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিলাসী অপরিমিত ধন- সম্পদের অধিকারী পোষ্যদেরও জীবনচিত্র এঁকেছেন। যারা ইংরেজদের অধীনে নানা বৃত্তি ও ব্যবসার মাধ্যমে প্রচুর অর্থের মালিক পিতাদের আশ্রয়ে অলস জীবন যাপন করে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছিল। খাদেম তাদের একজন— ‘বিলাস-ব্যসন ও ইন্দ্রিয়, সেবা ইহাদের নিত্যনৈমিত্তিক কার্য।’ উনিশ শতকের শুরুতে ইংরেজি শিক্ষা ও সভ্যতার সংস্পর্শে এদেশের কিছু সংখ্যক ধনীর সন্তান, ইয়ং-বেঙ্গলদের এক অংশের মধ্যে যে উচ্ছৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল, সমাজের সেই অবক্ষয়ের দিকটিও লেখকের দৃষ্টি এড়ায়নি। রতীশ, গণেশ, তিলক, ফরমান, নবাবের মত চরিত্রে তা দেখিয়েছেন।
উপন্যাসের চারিত্রিক বৈশিষ্ট আনোয়ারাতে পূর্ণাঙ্গরূপে না থাকলেও আখ্যানভাগ, ঘটনা, চরিত্র-চিত্রণ, পরিবেশ কল্পনা ও ভাষার রূপায়ণে লেখক এখানে চরিত্র ও ঘটনাবলীর বিন্যাসের মধ্য দিয়ে জীবনের প্রবাহকে রূপদান করেছেন। পাত্র-পাত্রীদের কথোপকথনে দেশ-কাল-সমাজের রুচি, আচার-আচরণ ও রীতিনীতির যথার্থতা অনুযায়ী পটভূমি নির্বাচন করে যুগের পরিচিতি তুলে ধরেছেন। লেখক নিজের জীবনের আদর্শকে প্রতিফলিত করে চরিত্রগুলোর জীবন জিজ্ঞাসাকে রূপদান করেছেন। তিনি কাহিনীর বিন্যাসে চরিত্রকে গভীরভাবে বিস্তৃত করে জীবনযুদ্ধে তাদের অবতীর্ণ করিয়ে নর-নারীর ভাগ্যকে পরিবর্তন করার প্রচেষ্টাকে শিল্পরূপ দিয়েছেন।
এই উপন্যাসে সাংসারিক মানুষ হিসেবে চরিত্রগুলোকে চিত্রায়ণ করা হয়েছে। এবং সংসারের সাধারণ মানুষের মত দুঃখ-দুদর্শার মুখোমুখি হয়ে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে জীবন যাপন করে জীবনের বন্ধুর পথ অতিক্রম করে সুখ শান্তির মাধুর্যময় জীবনের সন্ধান পেয়েছে। জীবন যাত্রার কঠিন পরীক্ষায় চরিত্রগুলোর প্রতিকূলতাকে অতিক্রমের উত্তীর্ণতার মধ্যে লেখক ভবিষ্যত সমাজ মানুষের চরিত্র গঠনের দিক নির্দেশের দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন। যে উদ্দেশ্যে লেখক কাহিনী গঠন ও চরিত্র পরিকল্পনায় ধর্মাদর্শকে উপজীব্য করেছিলেন, পরিসমাপ্তিতে বিড়ম্বনাকে অতিক্রম করার সার্থকতার মধ্যে তিনি তাঁর সেই আদর্শের বাস্তব রূপ দিয়েছেন। তাই কাহিনী বিন্যাসে তিনি ধর্মের আদর্শকে আরোপ করলেও চরিত্রগুলো রক্ত-মাংসের মানুষের স্বাভাবিকতাকে হারায়নি। একটা শ্ৰেয়োবোধ চরিত্রের মূল চেতনা হিসেবে ব্যবহার করার ফলে ধর্মের চেয়ে মানবিকতাবোধই তাদের মধ্যে গুরুত্ব পেয়েছে এবং ধর্মের আদর্শের চেয়ে মানবিকতা অনেক বেশি সুস্পষ্ট ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ধর্মীয় আদর্শবাদের দিকে তাদের গন্তব্য হলেও মানুষের স্বাভাবিক গুণ বা বৃত্তিতে চরিত্রগুলো মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজের মানুষের যথার্থ প্রতিনিধি।
আনোয়ারা উপন্যাসে লেখক সমাজ সংস্কারের ভূমিকায় নেমেছিলেন। ডেপুটির স্ত্রী, ডবল এম.এ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নামাজ রোজা সম্পর্কে মনোভাব এ ভাবে— ‘নামাজ-রোজা মানুষের মধ্যে, খোদার প্রতি মন ঠিক রাখাই কথা, উচ্চ শিক্ষার দ্বারা যাহাদের হৃদয় পবিত্র হইয়াছে, তাহাদের স্বতন্ত্র নামাজের প্রয়োজন কি?’ নব্য শিক্ষিতদের মধ্যে ধর্ম বিষয়ে মতান্তর দেখে তিনি বিচলিত হয়েছেন। ইসলাম ধর্মের মাহাত্ম্য ও পাপপূণ্য সম্পর্কে নিজস্ব মতামত, অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। ‘মনে মনে খোদার প্রতি ভক্তি থাকিলে ৫ বার পশ্চিমমুখী হওয়া ও ৩০ দিন রোজা করার আবশ্যক করে না’ নব্য শিক্ষিতদের এ রকম মনোভাবে তিনি বিচলিত ছিলেন। ধর্ম সম্পর্কে আনোয়ার চিন্তা চেতনাই নজিবর রহমানের অন্তরের বিশ্বাস। অর্থাৎ লেখক ধর্মাচার আনোয়ারার ভেতর দিয়ে নিজের ভাবনাকে প্রকাশ করেন।
এই সমাজ সচেতন সংস্কারমুক্ত লেখক ইংরেজি শিক্ষা ও নারী শিক্ষার পক্ষপাতি ছিলেন, মুসলমান মেয়েদের চিকিৎসার ব্যাপারে তিনি উদার ছিলেন। পর্দাপ্রথার চেয়ে জীবন রক্ষাকেই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। সমাজে নারী নির্যাতনের বিষয়টি তাকে আহত করে। সমাজের সব সংস্কার ও কুসংস্কারের কথা চরিত্র ও কাহিনীর প্রসঙ্গে লিখে নজিবর রহমান বিশ শতকের প্রথম দিকের মুসলমান সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন।
লেখক মানুষকে হীন বা ছোট করে আঁকেননি, তাঁর কোন চরিত্রই হতাশাগ্রস্ত, দুর্বল নয়। তারা জীবন যুদ্ধে পরাজিত মানুষ নয়। এ উপন্যাসের নায়ক নুরুল এসলাম ধর্মে কর্মে, জীবন যুদ্ধে, পারিবারিক ও সমাজ জীবনে আদর্শিক ভূমিকা পালন করে সমাজের মানুষকে পথ দেখিয়েছেন। ব্যক্তিকে লেখক সমাজের পটভূমিতে স্থাপন করে মুসলমান সমাজ নিয়ে সামাজিক উপন্যাস রচনার শক্ত ভিত তৈরি করেছেন। বাংলা উপন্যাসে তিনি ধর্ম-নিয়ন্ত্রিত জীবনাচরণকে সমাজের সাথে যুক্ত করে বাঙালির জীবন চেতনার সঙ্গী করে মুসলমান রচিত সাহিত্যাঙ্গনে সামাজিক উপন্যাস রচনার বীজ বপন করেছেন।
‘প্রেমের সমাধী’ নজিবর রহমানের দ্বিতীয় উপন্যাস। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের প্রথম দিকের বাঙালি মুসলমান সমাজের চিত্র অঙ্কনই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ওই সমাজের বাস্তবতার চিত্র এই উপন্যাসেও প্রাধান্য পেয়েছে। আনোয়ায়ার পরিশিষ্ট হিসেবে প্রেমের সমাধি লেখা হলেও দুই উপন্যাসের কাহিনীর মধ্যে কোন সামঞ্জস্য নেই। উপন্যাসে উল্লিখিত সময়ের সমাজচিত্র সম্পর্কে লেখক লিখেছেন— ‘রাজ্যহারা হইরাব পর হইতে মোসলমানদের যে অবনতির যুগ আরম্ভ হয়, আমাদের বর্ণিত সময়টি সেই যুগের অপরাহ্ন কাল।… এই সময় হিন্দুগণ ‘দিল্লীশ্বরো বা জগদীশ্বরো সম্ভাষণ একবারেই ভুলিয়া গিয়াছিল। নানবিধ কারণে এই বিষয়ে পরিবর্তন ঘটিলেও প্রধানতঃ উপযুক্ত শিক্ষাদীক্ষার অভাবেই যে মোসলমানের কোহিনুর সমুজ্জ্বল জাতীয় গৌরব এইরূপ হীনপ্রভা হইয়া পড়িয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই।’
এই উপন্যাসের প্রধান দুটি চরিত্র মরিয়ম ও তার গৃহ শিক্ষক মতিয়র রহমান, পরবর্তীতে তার স্বামী। মতিয়র রহমানের মধ্য দিয়ে লেখক নিজের চিন্তা-চেতনা, উপলব্ধিকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। মতিয়র রহমান সেই সময়ের সংস্কারপন্থী মুসলমান সমাজের প্রতিনিধি। আধুনিক জীবনবোধে উজ্জীবিত মতিয়র রহমান শিক্ষা দিয়ে এদেশের পিছিয়ে পড়া মুসলমান সমাজকে জাগাতে চেয়েছিলেন। এই উপন্যাসে বিভিন্ন বিষয়ে ঔপন্যাসিকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। শুদ্ধ, নিস্কলুষ চরিত্র পৃথিবীর পক্ষে অনুকূল বলে তিনি বিশ্বাস করতেন, জমা-খরচের হিসাব রাখলে অমিতব্যয়িতার সাথে সাথে মানুষের জাগতিক উন্নতি সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন। তিনি নিয়তির উপর বিশ্বাসী ছিলেন। মতিয়রের ভেতর দিয়ে লেখক তাঁর সেই বিশ্বাসকে দেখিয়েছেন— ‘…তবে এ পার্থিব তালার কারিগর অনেকেই হইতে পারে; কিন্তু অদৃষ্ট তালার কারিগর মোটেই একজন।’
প্রেমের সমাধি মুসলিম নির্ভর উপন্যাস হলেও হিন্দু সমাজের চিত্রও এতে আছে। সমাজের উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিচু শ্রেণির হিন্দুদের ঘৃণার চোখে দেখতো, বণ বৈষম্যের কারণে নিচুশ্রেণির হিন্দুরা উঁচু শ্রেণির হিন্দুদের স্কুলে পড়তে পারতো না, এ বাস্তবতাকে লেখক এভাবে তুলে ধরেছেন— ‘কেবল দেবীনগর গ্রামের উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুর বিদ্বেষ-বিষ-ক্লিষ্ট ও অবজ্ঞাত পাঁচ জন সাহা, তিনজন কর্মকার ও দুইজন তেলী স্ব স্ব পুত্রগণকে মতিয়র রহমানের স্কুলে ভর্তি করিয়া দিল।’সমাজে বণবৈষম্য যে কত প্রকট ছিল লেখক তা জানতেন এবং দলিত শ্রেণির অবজ্ঞাকে উপলব্ধি করেছেন।
কাহিনী ও ঘটনা প্রসঙ্গে উপন্যাসে দেখা যায়, বিশ শতকের প্রথম দিকে মুসলমান সমাজের কেউ কেউ ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কেননা সমাজ সংস্কারকরা ঐ সময় ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরও ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। মাহমুদা খাতুনের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন- ‘মরিয়ম আমার নিকট কোরান শরীফ পাঠ করিয়াছে; তাহাকে কেবল একটু বাংলা ভাল করিয়া পড়াইতে হইবে। তোমার চাচাজানের ইচ্ছা, এই সঙ্গে মেয়ে কিছু উর্দু ও ইংরেজি শিখে।’ উচ্চ শিক্ষিত মুসলমানেরা এই সময় সরকারি চাকরি করতে শুরু করেছে, লেখক মাহমুদা খাতুনের স্বামী মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দেখিয়েছেন। তিনি সৎ ও দক্ষ বিচারক ছিলেন। খান বাহাদুর উপাধি দিয়ে ইংরেজ সরকার মুসলমানদের বশীভূত করার চেষ্টা করেছে, সেই প্রসঙ্গে মোয়াজ্জেম হোসেনের খান বাহাদুর উপাধির কথা আছে।
কৃষিনির্ভর এই দেশে অধিকাংশ মানুষই কৃষক, বিশ শতকের সেই কৃষিজীবী সমাজে শিক্ষিত মুসলমানেরা চাকরির পাশাপাশি ব্যবসাও করতে শুরু করে অবস্থার পরিবর্তন আনে। মতিয়র রহমান এভাবে আলীজান ব্যাপারির সাহায্যে ধান, চাল, পাট, তামাকের ব্যবসা করে লক্ষপতি হয়ে যায়। বিশ শতকের শুরু থেকেই শিক্ষিত মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টা ছিল আর্থ-সামাজিক দিক থেকে সমাজের উন্নয়ন— এই মানসিকতায় ঔপন্যাসিক মতিয়র রহমানকে ম্যাজিস্ট্রের চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ দেখিয়েছেন। স্কুল শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করলে খান বাহাদুর সাহেবের বিস্ময় ও অসন্তোষের জবাবে মতিয়র রহমান উত্তর দিয়েছিলেন- ‘আমাদের প্রতিবেশি মোসলমান পল্লীগুলি ঘোর অন্ধকারে আচ্ছন্ন, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রের পদ গ্রহণ করিলে তাহাদের কোন উপকার করিতে পারা যাইবে না মনে করিয়া উহা ত্যাগ করিয়াছি। সেই সময় মুসলমান সমাজের শিক্ষার উদ্যোগকে হিন্দু সমাজ ভাল চোখে দেখেনি, তারা এর বিরুদ্ধাচারণ করতে থাকে, সেই সত্যকে লেখক তুলে ধরেছেন— ‘আমাদের স্কুল ভাঙ্গিয়া হাই স্কুল করিবে একজন মুসলমান ইহাও কি প্রাণে সয়?’
এই উপন্যাসে নজিবর রহমান সতীত্বের মহিমা প্রকাশ করতে যেয়ে অতিপ্রাকৃতের আশ্রয় নিয়েছেন। আল্লার প্রতি বিশ্বাস করে সতী মরিয়ম প্রার্থনা করে তাহমিনার মাজারে ফুল ফুটিয়ে সেই ফুলের নির্যাসে তার অন্ধ-স্বামীকে সুস্থ করে তোলে।
‘চাঁদ তারা বা হাসান গঙ্গা বহমনি’ (১৯১৭) তাঁর ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস। এই উপন্যাসের পটভূমি মুহম্মদ তুঘলকের শাসনামল (১৩২৫-১৩৫১)। খোরসান দেশের জনৈক সন্ত্রান্ত পাঠানের পুত্র চাঁদ ওরফে হাসান তার মা-বাবার মৃত্যুর পর এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে আশয় নিয়ে চাঁদ ঠাকুর মশায়ের নিষ্কর ভূমি চাষ করে হাট-বাজারে ফলমূল বেচে জীবিকা নির্বাহ করে। এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিষক্ষস্ত, সত্যবাদী, কর্তব্যনিষ্ঠ ধর্মের প্রতি অবিচল চাঁদ লেখকের মানসপুত্র। তার গুণের পুরস্কার স্বরূপ বাদশাহ মুহম্মদ বিন তুঘলক তাকে সমগ্র দাক্ষিণাত্যের স্বাধীন সুবেদারির সনদ দান করেন। সেই সাথে মনিবকন্যা তারার প্রেম বার বার নীতিবোধের দোহাই দিয়ে প্রত্যাখ্যান করে, পরে প্রেমের স্বীকৃতি দিয়ে তাকে বিয়ে করে, কিন্তু তার মধ্যে কোন স্বতঃস্ফুর্ততা ছিল না। মনিবকন্যার আত্মহত্যার পাপ থেকে রক্ষার জন্য সে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। চাঁদের চরিত্রের স্বাভাবিক বিকাশ নেই, বরং তারার চরিত্র অনেক বেশি মানবীয়, সে তার কিশোরী মনের গোপন প্রেমে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েও চাঁদের কাছে প্রকাশ করেছে, শেষ পর্যন্ত প্রত্যাখ্যাতের আঘাত সইতে না পেরে আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়।
হিন্দু-মুসলমানের মিলন প্রত্যাশী লেখক উভয় সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির মধ্যে দেশের প্রকৃত মঙ্গল নিহিত রয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন— ‘আমরা চাই প্রত্যেক ধর্ম্মে বাস্তবিক যেটুকু বিধি নিষেধ আছে তাহা মানিয়া চলিয়া হিন্দু-মুসলমান ছাত্র ভাই ভাই গলায় মিশিয়া যাও, …ফলতঃ যখন তোমাতে আমাতে এইরূপ এক হইয়া এক অপূর্ব মনোভাবের সৃষ্টি কবরে তখনই দেশের প্রকৃত মঙ্গল, প্রকৃত উন্নতি হইবে।’ খাজনা দিতে না পারলে প্রজাদের ওপর যে অমানবিক নির্যাতন চালানো হতো, তা লিখেছেন— ‘মহারাজ রঘুনাথের তহশীলদার খোদাবক্স খাজনা দিতে পারেনি বলে মহারাজ তাকে পাথর চাপা দিয়ে হত্যা করে। খাজনা না দেওয়ার কারণে সে সময় ভূস্বামীরা প্রজাকে শিয়াল কুকুরের মুখে ও আগুনে নিক্ষেপ করতেও দ্বিধা করেনি। নজিবর রহমান সে কথা লিখে যেমন সমাজ বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন তেমনি সত্য ও ন্যায় ধর্মের জয়গান গেয়েছেন।
বিশ শতকের প্রথম দশকে বাঙালি মুসলমান সমাজের পরিচিতিমূলক আনোয়ারা উপন্যাস লিখে নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল— এরই ধারাবহিকতায় তিনি প্রেমের সমাধি, গরীবের মেয়ে, পরিণাম, চাঁদ তারা বা হাসনগঙ্গা বহমনি লিখেছিলেন। সাহিত্য প্রসঙ্গ (১৩১১ বাং, ১৯০৪ খ্রিঃ), দুনিয়া আর চাই না (১৯২৩), মেহেরউন্নিসা (১৯২৩) লিখেছিলেন। ইংরেজি শিক্ষা ও স্ত্রী শিক্ষার প্রতি সমর্থনের পরিচয় তার অনেক রচনায় রয়েছে।
মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের ‘গরীবের মেয়ে’ (১৯২৩) একটি আদর্শ প্রণোদিত সামাজিক উপন্যাস। এতে উচ্চশিক্ষিত কোন চরিত্র সৃষ্টি করে আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব চরিত্র সৃষ্টি করা হয়নি। কিংবা পাশ্চাত্যের ছায়া অবলম্বনে কোন চরিত্রের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করা হয়নি। গ্রাম বাংলার দরিদ্র মধ্যবিত্ত গৃহস্থ মেয়েদের সুশিক্ষার পক্ষ নিয়ে বাঙালি মুসলমানের অশিক্ষা এবং এর কারণে বিভিন্ন সামাজিক সমালোচনা এতে রয়েছে। স্ত্রী-শিক্ষার পক্ষপাতি লেখক শিক্ষার আলোকপ্রাপ্ত মেয়েদের ঘর-কন্নার সুখ-শান্তির কথা খুব সাধারণভাবে উল্লেখ করেছেন। উপন্যাস শুরুর আগে কবিতাকারে তিনি উপন্যাসের মুখবদ্ধ লিখে তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির উদ্দেশ্য লিখেছেন—
বিলাসিনী যে রমণী গৃহস্থালী কাজ
সম্পাদন আপন ভাবিয়া না করে
হউক তাহার পতি রাজ অধিরাজ-
অধমা সে নারী সংসার ভিতরে।
আত্মহারা না হইয়া সৌভাগ্য সোহাগে—
পরন্ত যে করে কাম স্বকরে যতনে;
পরিজন প্রীতি হেতু প্রেম অনুরাগে
আদর্শ রমণী সেই যথার্থ ভুবনে।
আদর্শ রমণীর আদর্শায়িত রূপ গড়ে তোলাই ছিল লেখকের উদ্দেশ্য। উনিশ শতকের রেনেসাঁসের যুগে জীবনের দুই তৃতীয়াংশ কাটিয়ে বিশ শতকের দুই দশকের প্রথম ভাগের বিভিন্ন রাজনৈতিক সামাজিক আন্দোলনের স্বাক্ষী ছিলেন লেখক। বিশ শতকের প্রথমে শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করে কর্মকোলাহলের বাইরে সুদূর পল্লিতে বাস করে শিক্ষা বিস্তার ও সাহিত্য রচনার প্রচেষ্টায় জীবন কাটিয়েছেন এই নিভৃতচারী ঔপন্যাসিক। স্বল্প শিক্ষা ও অপর্যাপ্ত কল্পনাশক্তি নিয়ে আধুনিক প্রবাহমান জীবনের ভাবধারাকে তিনি স্পর্শ করতে পারেননি। বিশ শতকের প্রথমাংশে মুসলমান সমাজে ইংরেজি ও স্ত্রী শিক্ষার অনুপ্রবেশ ঘটলেও নজিবর রহমান সাহিত্যের মাধ্যমে সে বিষয়ে সমাজকে কোন নতুন পথ দেখাননি।
সাত বছরের নুরীর গৃহকর্মের বর্ণনা এবং তার জীবন চিত্র নিয়ে গরীবের মেয়ে উপন্যাসের শুরু। নুরী স্কুলে যায় না, তার সমবয়সীদের স্কুলে যাওয়া দেখে সেও আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিন্তু দারিদ্র্যের নির্মমতা তার স্কুলের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পারিবারিক বুদ্ধি কিন্তু গুণে উত্তীর্ণ হয়ে তার স্কুলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়। পাঠশালার শিক্ষয়িত্রীর কাছে তার বাংলা ও ধর্মীয় শিক্ষা দুই-ই চলতে থাকে। দারিদ্র্যের বর্ণনার পৌনঃপনিকতায় একদিকে যেমন হত দারিদ্র্যের কথা লেখক বলেছেন অন্যদিকে তা অতিক্রম করে নুরীর শিক্ষা গ্রহণের প্রসঙ্গে লেখকের নারী শিক্ষার প্রতি সমর্থনের পরিচয় পাওয়া যায়। সেই সময়ে মুসলমান মেয়েদের পড়াশোনার যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল তা খয়রন, মছিরন, সফিয়াদেরসহ বিবাহিত অবিবাহিতাদের স্কুলে অধ্যয়নই তা প্রমাণ করে দেয়। সমাজের দারিদ্র্য ও স্ত্রীশিক্ষার বিষয় উপস্থাপনে লেখক মাঝে মাঝেই অন্য প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছেন, তাতে উপন্যাসের দৃঢ় গাথুনির অঙ্গহানি হয়েছে। নুরীর দৈহিক অবস্থার কথা বলতে দুজন শিক্ষার্থীর কথোপকথন অথবা তার পড়ার জন্য ছাগল পালন, মুরগী পালন ইত্যাদি অপ্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোর প্রয়োগ কাহিনীর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়নি। মাঝে মাঝেই উপন্যাসের প্রসঙ্গ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে লেখক সামাজিক অবস্থাকে তুলে ধরেছেন। অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার কথা, শিক্ষার অনগ্ররসরতায় শিক্ষিত মুসলমান মেয়েদের পাত্রস্থ করার সমস্যা সেই সমাজে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল বলে মেয়েদের শিক্ষার প্রতিও একটা অনীহার ভাব চলে আসে। কাহিনী উপকাহিনীর ভেতর দিয়ে সমাজের বহুবিবাহের আভিজাত্যের গৌরবের কথা উঠে এসেছে। বয়স্ক, তিন সন্তানের পিতা নুরমহম্মদের সাথে নির্বিঘ্নে নুরীর বিয়ের মধ্য দিয়ে সমাজের এক পর্যায়ের চিত্রের সাথে নুরীর জীবনের অন্য এক অধ্যায় উঠে এসেছে। অপ্রধান নারীদের কথোপকথনে বহু বিবাহের বিপক্ষে কোন বিরূপ মতানৈক্য দেখা যায়নি, সতীনের ঘরে বিয়ের মধ্যেও সমাজে কোন প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া ছিল না। বয়স্ক স্বামী, সপত্নী, স্বামীর ধর্মীয় ভাবনা নুরী পুলকিত চিত্তেই গ্রহণ করেছিল। সমাজ তার জন্য যে স্বামী নির্ধারণ করে দিয়েছিল তার জন্য নুরীর কোন অভিযোগ ছিল না, এখানেও সমাজে নারীর অবস্থানের সঠিক চিত্র উঠে এসেছে।
এই উপন্যাসে ধর্মীয় প্রচারণাই যেন লেখকের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। বিয়ের পরপরই নুরীর সাথে তার স্বামীর কথোপকথনে তার মধ্যে ম্যাচুইরিটি লক্ষ্য করা যায়, তার কাব্য গুণ নূর মোহাম্মদকে মোহিত করে। নারী জাতির শিক্ষা বিষয়ক কবিতা নুরীকে দিয়ে বলিয়ে লেখক স্ত্রী-শিক্ষার প্রতি সমর্থনের উদ্দেশ্যকেই প্রকাশ করেছেন। নুরীর দৈহিক রূপ নিয়ে তার স্বামীর বক্তব্যে সে দুঃখ পেয়েছে। নুর মোহাম্মদের স্ত্রীর বাঁদীর প্রয়োজনে নুরীকে বিয়ে করা- এ কথায় নুরীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, তার সরল প্রাণ অপ্রত্যাশিত আঘাতে বিবর্ণ হয়ে গেল। দাম্পত্য জীবনের যে সুখ-স্বপ্ন কিশোরীর মধ্যে জেগে উঠেছিল তা এক মুহূর্তে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। গ্রাম্য এই বালিকার মধ্যে একটা ব্যক্তিত্ববোধ লক্ষ্য করা যায়- ‘… আমি প্রাণান্তেও আপনার বিবির বাঁদী হইতে পারিব না।’ স্বামীর কথার যথাপোযুক্ত উত্তরে সমকালীন নারীর জীবন থেকে তার মধ্যে একটা স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করা যায়। স্বামীর সব কথা মেনে নেওয়ার মধ্যে তার যে সহনশীলতা দেখা যায় তা সমকালীন চিত্র। আবার নুরীর কথাবার্তায় আধুনিক জীবন চেতনার লক্ষণও পরিস্ফুট, সে বি.এ, এম.এ পাশ, চাকরি প্রাপ্তি-এ সবের মধ্যে গৌরব অনুভব করে। স্বাবলম্বন মনুষ্য জীবনকে তেজস্বী ও উন্নত করে বলে সে বিশ্বাস করে, আবার এর বিপরীত চিন্তাও তাকে আচ্ছন্ন করে, সে বলে- ‘পরাধীনতা ও চাকুরী একই কথা। চাকুরীজীবী তার অন্তরের সৎপ্রবৃত্তিগুলির সদ্ব্যবহার করিতে পারে না। সুতরাং উহা ম্রিয়মান অবস্থায় থাকিয়া থাকিয়া শেষে একেবারে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, এইজন্যই প্রায় দেখা যায়, চাকুরীজীবী দ্বারা জগতের বিশেষ কোন মঙ্গল সাধিত হয় না।’ তের বছরের নুরীর এই বক্তব্য লেখকের জীবন-চেতনার ভাষ্য, নিজের উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য নুরীকে দিয়ে বলিয়ে লেখক নিজের মধ্যযুগীয় মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। নুরীকে স্কুলে পাঠাবার স্বামীর ইচ্ছার মধ্যে ঔপন্যাসিকের মধ্যে যেমন আধুনিক মনস্কতার পরিচয় আছে, আবার নুর মোহাম্মদের বিয়ে করবার প্রধান উদ্দেশ্য তার বৃদ্ধা মায়ের প্রাণপণ সেবা- শুশ্রূসা করা— এই দুইয়ের মধ্যে লেখকের মানসিকতার বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। নুরীকে তার স্বামী যে ভাবে ধর্মীয় ও সামাজিক উপদেশ দিয়েছে তাতে তাকে স্বামী নয় ধর্মগুরু মনে হয়েছে। নুরীর কর্তব্য কর্মের যে ফিরিস্তি দেওয়া হয়েছে তাতে সমাজের মেয়েদের একটা ফটোগ্রাফিক চিত্র ফুটে উঠেছে। সনাতন প্রথাকে ঠিক রেখে নারী শিক্ষার আধুনিক ধ্যান ধারণায় লেখক বিশ্বাসী ছিলেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানসিকতা নুর মোহাম্মদের চিঠিপত্রে রয়েছে। উনিশ শতকের মুসলিম চিন্তা চেতনার পরিবর্তিত প্রভাব সাহিত্যের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছিল, তাকে এক শ্রেণির শিক্ষিত মানুষ গ্রহণীয় বলে স্বীকার করেছিলেন। নুরীর স্বামীর ভুদেব মুখোপাধ্যায়ের পারিবারিক প্রবন্ধ পড়ানো একজন আদর্শ নারী গঠনই যে সমাজের সবচে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যকর্ম-লেখকের এই মানসিকতাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নুরীকেও দেখা যায় সেই আদর্শ নারী হওয়ার প্রচেষ্টাতেই সে নিবেদিত, স্বামী-শ্বাশুরির সেবিকা ছাড়া এই নারী চরিত্র অন্য কোথাও তার মহত্মের কথা চিন্তা করেনি। সমাজকে নীতি শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে যেন লেখক নুরীর চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন।
উপন্যাসে পরনিন্দার বিষয়টি নারী সমাজে খুব বেশি এসেছে। বিবাহিত পুরুষের সাথে বিয়ে দেওয়ার আগ্রহের ব্যাপারটিও উপন্যাসে রয়েছে, ছাদেকা নামের জনৈক মেয়ের বিয়ে হয়েছে এক মৌলভির সাথে। নকল গহনা, দিন মজুর বাবার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব না নেওয়া ইত্যাদি কারণে তার মা তার তালাকের চিন্তা করে, বিবাহিত জানা সত্ত্বেও নুর মোহাম্মদের সাথে সাদেকাকে বিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছে। আবার সপত্নী ও তার সন্তাদের বিষয়েও নুরীকে আগ্রহান্বিত দেখা যায়। নারীদের চিন্তা চেতনা ও আচরণকে ভিত্তি করে ঔপন্যাসিক সেই পশ্চাৎপদ মুসলমান সমাজের কথা বলেছেন। লেখক উপলব্ধি করেছিলেন মুসলমান সমাজের কুসংস্কার দূর কবতে শিক্ষার প্রয়োজন, প্ৰয়োজন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা। চরিত্রগুলোর ভেতর সেই মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ দেখিয়েছেন— নুরী তার স্বামীকে মসজিদ নির্মাণের কথা বললে নুর মোহাম্মদ তাতে সম্মত হয়নি। নুরী শিক্ষিত, কাজকর্মে দক্ষ-লেখক তার মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন শিক্ষার ফলেই সে দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন, আর শিক্ষার কারণেই সে সংসারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল। শিক্ষার ফলে তার মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিকাশ হয়, স্বামীর অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বাবার বাড়ি চলে যাওয়ার কথা দৃঢ় ভাবে বলতে পেরেছিল।
নুরীর মধ্যে রসবোধ আছে। জীবন সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা কম বলে স্বামীর বিয়ে নিয়ে সে রসিকতা করতে পেরেছে তার মধ্য জীবন সম্পর্কে ভালবাসা ও ভাল লাগার সুর আছে। ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্য, ‘চারুপাঠ’, ‘সীতার বনবাস’ পড়ে ধীরে ধীরে নুরীর মত মেয়েদের মধ্যে জীবন ও সমাজ সম্পর্কে সচেতনতার সৃষ্টি হয়েছে। নুরীর পাশাপাশি নুর মোহাম্মদের প্রথম স্ত্রী তহুরার কথায় লেখক নারীরূপের এক ভিন্ন রূপের পরিচয় তুলে ধরেছেন। সময়ের সাথে তহুরার স্বভাবের পরিবর্তনের কথা এসেছে, তার নমনীয় স্বভাবে সে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সপত্নী ও শাশুড়ির কথা জানতে চেয়েছে, আগে যা তার স্বভাব বিরুদ্ধ ছিল।
নুরীকে এক আদর্শ নারী হিসেবে গড়ে তোলাই লেখকের উদ্দেশ্য ছিল। তাকে দিয়ে শাশুড়ি, সতীন, স্বামীর সেবা শুশ্রুষা করিয়েছেন, স্কুলের সাথে যুক্ত করিয়েছেন, কেনাকাটায় অভিজ্ঞ দেখিয়েছেন, আর্থিক উন্নয়নের জন্য তুলার চাষ করিয়েছেন, সাংসারিক উন্নতির জন্য পান পেঁপে আদা হলুদ মরিচ সব গাছ লাগনো দেখিয়ে আদর্শ বধূর জীবন চিত্র এঁকেছেন। যুগের প্রয়োজনে লেখক নুরীকে পড়াশোনা জানা শিক্ষিত মেয়ের প্রতিনিধি চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন কিন্তু গল্পের শেষাংশে তার স্বামীর স্কুল প্রতিষ্টার ইচ্ছাকে সে নিরুৎসাহিত করেছে। সুতরাং মানসিকতায় পুরোনো ভাবধারার উন্নয়ন ঘটাতে পারেননি। এখানে লেখকের সমাজ মনস্কার প্রতিফলন ঘটেছে অর্থাৎ সমাজে যা ছিল না তা রচনা করে তিনি সাহিত্যিকের ধর্ম থেকে বিচ্যুত হননি।
ধর্মের নামে মানুষ ঠকিয়ে যারা জীবিকা নির্বাহ করে সেই ধর্ম ব্যবসায়ীদের তিনি ব্যঙ্গ করেছেন এবং তাদের সেই কাজকে ভিক্ষাবৃত্তির সাথে তুলনা করেছেন। সমাজকে তিনি খুব কাছের থেকে দেখেছিলেন তাই সমাজের আশরাফ-আতরাফ সমস্যা, চরকায় সুতা কাটা, ঢেঁকিতে ধান ভানা, খৈল দিয়ে শরীর পরিস্কার করা ও অনেক কুসংস্কার- যেমন বাড়িতে পান গাছ লাগানোকে অমঙ্গল আশঙ্কা করে নুরী শঙ্কিত হয়েছে।
বাঙালি মুসলমানদের উত্তরণের যুগে লেখক আধুনিক মূল্যবোধের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন, আবার নারীর পতিব্রতাকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। এই দুয়ের সমন্বয় ঘটিয়েছেন গরীবের মেয়ে উপন্যাসে।
‘আনোয়ারা’ উপন্যাসের মত পরিণাম উপন্যাসেও নজিবর রহমানের সমাজ ও জীবন অভিজ্ঞতার বাস্তবরূপ প্রকাশ পেয়েছে। স্বদেশী আন্দোলনকে উপলক্ষ্য করে ১৯০৫ সালে বিলাতী পণ্য বর্জন-রহস্য গ্রন্থ লিখে সাহিত্যে নজিবর রহমানের আত্মপ্রকাশ। তিনি রচনার উপজীব্য বিষয় সংগ্রহ করেছেন গ্রামীণ সমাজ পরিবেশ থেকে। আনোয়ারা পরবর্তী উপন্যাসগুলোতে শিল্পের যথাযথ বিকাশ হয়নি। পরিণাম উপন্যাসে দেখা যায় হিন্দু নায়েবের চক্রান্তে মুসলমান জমিদার পরিবারে ভাঙ্গন ও বিবাদ দেখা দিয়েছিল। অন্যদিকে কূপমন্ডুকতাজনিত অন্যান্য সামাজিক গ্লানির উদ্ঘাটনও এখানে রয়েছে। সামন্তবাদী সমাজে তথাকথিত উচ্চ শ্রেণির মানুষের শ্রেণি চরিত্র রূপায়ণে লেখক অমিতব্যয়ী অমিতচারী স্বার্থান্বেষী জমিদারদের বিবাদ, নিজের জমিদারি ও আভিজাত্য বজায় রাখতে লাঠিয়াল প্রতিপালন, লাঠি খেলা, গৃহকর্মীর গর্ভে সন্তান ধারন এবং তার প্রতিপালন এসবের পাশাপাশি আরবি-ফারসি শিক্ষা গ্রহণ, বাংলা শিক্ষার প্রচলন এগুলো দেখিয়েছেন। ধনাঢ্য পরিবারের ছেলে বিলাস ব্যসনে আসক্ত হয়ে দুষ্কর্মে লিপ্ত হয়, সামাজিক এ বিষয়গুলোর যথাযথ চিত্র তুলে ধরেছেন। বংশ মর্যাদার আভিজাত্যতে এই জমিদারেরা প্রাধান্য দিয়েছেন। মদ্যপান, আমোদ-প্রমোদ ও ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়াকে এক বিশেষ শ্রেণির মানুষ আভিজাত্যের লক্ষণ বলে গৌরবান্বিত বোধ করেছেন। সমাজের ভাব-ভাবনাকে ব্যবহার লেখক হিন্দু- মুসলমান নরনারীর প্রেম, বিশ শতকের প্রথম দিকে মুসলমান পরিবারের পর্দা প্রথা উপস্থাপন করে এক শ্রেণির মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চিন্তা চেতনাকে রপায়ণ করে মুসলমান সমাজের মানুষের জীবন, জীবন পিপাসা ও যাপিত জীবনের চিত্র প্রকাশ করেছেন।
গল্পের পটভূমি জমিদারের কাহিনী। জমিদার সৈয়দ আবুল কাশেম চৌধুরীর দুই ছেলে, তাদের বিপরীতধর্মী দু’রকম চরিত্র। কূটবুদ্ধিসম্পন্ন দেওয়ান, প্রজা শোষণ, উৎকোচ গ্রহণ, দেওয়ানের ষড়যন্ত্র, দুই জমিদারের দ্বন্দ্ব, ক্ষয়িষ্ণু জমিদারের বিলাস-ব্যসনে লিপ্ত হওয়া, দাসী স্ত্রীর অর্থ আত্মসাৎ, ম্যাজিস্ট্রেট, দারোগা, পুলিশ কেন্দ্রিক ইংরেজ প্রবর্তিত শাসন ব্যবস্থা ইত্যাদি সেই সময়ের সামাজিক ব্যবস্থাকে বর্ণনা করে লেখক কাহিনীর প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করেছেন। এ উপন্যাস সম্পর্কে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছেন— ‘পরিণাম-এ দেখা যায় হিন্দু নায়েবের চক্রান্তে মুসলমান জমিদার পরিবারে ভাঙন ও বিবাদ ধরল; অন্যপক্ষে কূপমন্ডুকতা-জনিত আমাদের অন্যান্য সামাজিক গ্লানির উদ্ঘাটনও এতে আছে। স্থানে স্থানে লেখকের কল্পনা ঔচিত্য বিরোধী। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন এবং কাফেরের ইসলাম গ্রহণে গ্রন্থ সমাপ্তি।’
পরিণাম একান্তই পারিবারিক উপন্যাস, সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়ে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা সংযোজন করেছেন। সতী-সাধ্বী স্ত্রী-জাতির আদর্শ তুলে ধরাই তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। যুগের প্রেক্ষাপটে চরিত্রের মধ্যে অলৌকিকতার বিশ্বাস দেখিয়েছেন, আবার অলেকিকতার মধ্যেও বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন কিন্তু তার স্থায়িত্ব দিতে পারেননি। উপন্যাসে বারবনিতাদের প্রসঙ্গ আছে, মদ্যপানের মত ব্যভিচারের প্রসঙ্গ অনেকবারই এসেছে। অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ- এ-সবের পরিণাম যে শুভ নয়, উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য তাই। অন্ধ ধর্মবিশ্বাস তাঁর সাহিত্যের ঔচিত্য বোধ ও বাস্তবতাবোধকে অতিক্রম করেছে। এই রচনায় ধর্মকে তিনি নিজের মত ব্যবহার করেছেন যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। গোপী মোহনের জীবনে কৃতকর্মের ফল দেখানো হয়েছে। অলৌকিক বিষয়কে তিনি এমনভাবে দেখিয়েছেন তাতে দেখা যায় পুঁথি সাহিত্যের রেশ থেকে তিনি মুক্ত হতে পারেননি। মিথ্যা আভিজাত্য বিশ শতকের প্রথম দিকের ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদী সমাজের তথাকথিত উচ্চবিত্তের মানুষকে কীভাবে আচ্ছন্ন করেছিল ঘটনা ও চরিত্র তা প্রকাশ পেয়েছে।
পরিণাম উপন্যাসে কোন চরিত্রই পরিপুষ্টি লাভ করেনি তবে দুটি নারী চরিত্র একেবারে মলিন নয়। নুরন্নেহারের মধ্যে আত্মপ্রত্যয় আছে- নিজেকে সে শুধুমাত্র স্বামী আবুওলের সহধর্মিনী ভাবেনি, সহকর্মিনী হিসেবে চিন্তা করেছে। যুদ্ধক্ষেত্র, রাজনীতি, শোকে দুঃখে সে স্বামীর পাশে দাঁড়ানোর যোগ্য মনে করেছে। তার তেজস্বীপূর্ণ কথায় তার নারী সত্তার চেয়ে মানুষ সত্তার বিকাশ ঘটেছে বেশি। নুরন্নেহার হতাশাগ্রস্ত কোন দুর্বল চরিত্র নয়। কুসুম নামে আরেক নারী, প্রবঞ্চক দেওয়ানজী গোপীমোহনের কন্যা। বাবা গোপীমোহনের চক্রান্তের শিকার হয়ে মুসলমান অবৈধ ভূস্বামী ছুরতজামালের অবৈধ গর্ভ ধারণ করে, তার সাথেই তার বিয়ে হয় কিন্তু সুরতজামালের প্রেমাসক্তি বঞ্চিত হয়ে সে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ওঠে, যা একজন নারী চরিত্রের স্বাভাবিক প্ৰতিক্ৰিয়া।
বিশ শতকের প্রথম দিকে নজিবর রহমান সরলীকৃত বক্তৃতায় শিথিল ভাষায় আকরহীন উপন্যাস লিখেছেন, যার সংলাপ নেই বললেই চলে, অধিকাংশই বক্তৃতা। লেখকের নিজের বক্তব্যই তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোকে দিয়ে বলিয়েছেন। উপন্যাসের শিল্পরূপ পরিণামে নেই কিন্তু একশ বছর আগের সমাজ জীবনকে কিছুটা হলেও ধারন করে আছে বলে মূল্যায়নের যোগ্যতা অবশ্যই আছে।
নজিবর রহমানের উপন্যাসে উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের প্রথম দিকের মুসলমান সমাজের চিত্র যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। সমকালীন বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার রূপায়ণ করে বাঙালি মুসলমান সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন। বিশ শতকের বাংলার বহুবিধ সমস্যাকে তুলে ধরে নজিবর রহমান মুসলমান মধ্যবিত্তের গোড়াপত্তনের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। মাঝে মাঝে নীতিকথার ভারে শৈল্পিক মহিমা ক্ষুণ্ন হয়েছে কিন্তু একটি বিশেষ সময়ের সমাজের স্বরূপকে তুলে ধরেছেন বলে তার উপন্যাসের মূল্য অনেক।