প্রথম-পর্ব
প্রথম পরিচ্ছেদ
ভাদ্রমাসের ভোরবেলা। স্বর্গের ঊষা মর্ত্যে নামিয়া ঘরে ঘরে শান্তি বিলাইতেছে; তাহার অমিয় কিরণে মেদিনী-গগন হেমাভ বর্ণে রঞ্জিত হইয়াছে। উত্তর বঙ্গের নিম্ন সমতল গ্রামগুলি সোনার জলে ভাসিতেছে; কর্মজগতে জাগরণের সাড়া পড়িয়াছে; ছোট বড় মহাজনী নৌকাগুলি ধবল-পাখা বিস্তার করিয়া গন্তব্য পথে ঊষা যাত্রা করিয়াছে; পাখিকুল সুমধুর স্বরলহরী তুলিয়া জগৎপতির মঙ্গল গানে তান ধরিয়াছে; ধর্মশীল মুসলমানগণ প্রাভাতিক নামাজ অন্তে মসজিদ হইতে গৃহে ফিরিতেছেন, হিন্দু-পল্লীর শঙ্খ-ঘণ্টার রোল থামিয়া গিয়াছে।
এই সময় মধুপুর গ্রামের একটি চতুর্দশবর্ষীয়া বালিকা তাহাদের খিড়কী-দ্বারে বসিয়া বন্যার জলে ওজু করিতেছিল। তাহার মুখ, হস্তদ্বয়ের অর্ধ ও পদদ্বয়ের গুল্ফমাত্র অনাবৃত এবং সমস্ত দেহ কাল ইঞ্চিপেড়ে ধুতি কাপড়ে আবৃত। গায়ে লালফুলের কাল ডোরাছিটের কোর্তা। দুই হাতে ছয় গাছি চুড়ি। অযত্ন বিন্যস্ত সুদীর্ঘ কেশরাশি আল্ল্গাভাবে খোপা বাঁধা; বালিকার মুখমণ্ডল বিষাদে ভরা!
বালিকা যে স্থানে বসিয়া ওজু করিতেছিল, তাহার সম্মুখ দিয়া উত্তর-দক্ষিণে লম্বা অনতিবিস্তৃত খাল, দক্ষিণমুখে ঢালু বারিরাশি দুকূল প্লাবিত করিয়া স্রোত-বেগে প্রবাহিত হইতেছে। পূর্বপারে একখানি পাসী নৌকা পাট ক্রয়ের নিমিত্ত উত্তর-দক্ষিণ মুখে লাগান রহিয়াছে। একজন যুবক সেই নৌকার ছৈ-মধ্যে বসিয়া স্বাভাবিক মধুর কণ্ঠে কোরান শরীফ পাঠ করিতেছেন। নৌকায় তিনজন মাঝি, একজন যাচনদার, একটি পাচক ও যুবক স্বয়ং ছিলেন। যুবকের আদেশে যাচনদার মাঝিগণ সহ পাটের সন্ধানে ভোরেই পাড়ার উপর নামিয়া পড়িয়াছে।
যুবক নৌকায় বসিয়া কোরান পাঠ করিতেছেন। যুবকের দেহের বর্ণ ও গঠন সুন্দর; নবোদ্ভিন্ন ঘনকৃষ্ণ-গুম্ফ-শ্মশ্রু তাঁহার স্বাভাবিক সৌন্দর্য আরও বাড়াইয়া তুলিয়াছে। যুবকের বয়স ত্রয়োবিংশ বৎসর। মাথায় রুমীটুপী, গায়ে সাদাশার্ট ও পরিধানে রেঙ্গুনের লুঙ্গী। এই সাধারণ পরিচ্ছদেও তাহাকে কোন আমিরের বংশধর বলিয়া মনে হইতেছে।
বালিকা ওজু করিতেছে; কিন্তু সদ্য-ঘটনা-পরম্পরার যুগপৎ ঘাত-প্রতিঘাতে তরঙ্গায়িত হৃদয়ের ভাব যেন তাহার মুখে ক্রীড়া করিতেছে। আবার এই অবস্থায়ও গাঢ় অন্ধকারময় রজনীতে নিবিড় জলদ-জাল-মধ্যবর্তী ক্ষণপ্রভা বিকাশবৎ আশার একটি ক্ষীণোজ্জ্বলরেখা বালিকাকে যেন কোন্ এক সুধাময় শান্তি-রাজ্যের পথ দেখাইয়া দিতেছে।
বালিকা নৌকার উপর কোরান শরীফ পাঠ শুনিয়া মস্তকোত্তোলন করিল। সে মায়ের মুখে শুনিয়াছিল কোরানের মত উত্তম জিনিস আর কিছুই নাই, উহা যে পড়ে বা শুনে তাহার জন্য বেহেস্তের দ্বার উন্মুক্ত। বালিকার দাদিমাও সদা সর্বদা বলেন, কোরান শরীফ-রূপ শরাবন তহুরা পাঠে ও শ্রবণে মানুষের অন্তর্নিহিত অশান্তি-আগুন নিভিয়া যায়। বালিকা জননী ও দাদিমার উপদেশ হৃদয়ে গাঁথিয়া রাখিয়াছে। সে প্রতিদিন প্রাতে কোরান শরীফ পাঠ করে; আজও তজ্জন্য ওজু করিতে বসিয়াছে। কিন্তু নৌকার মধুবর্ষী স্বরে কোরান পাঠ বালিকাকে আত্মহারা করিয়া তুলিল। সে ওজু ভুলিয়া গিয়া অনন্যচিত্তে কোরান শরীফ পাঠ শুনিতে লাগিল।
যুবক কোরান পাঠ শেষ করিয়া দুইহাত তুলিয়া নির্মীলিত-নেত্রে মোনাজাত করিতে লাগিলেন——
“দয়াময়! তোমার পবিত্র নামে আরম্ভ করিতেছি। সমস্ত প্রশংসা তোমার। তুমি অনাদি, অনন্ত, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। তুমি ধৈর্য্য ও ক্ষমার আধার, তুমি অসীম করুণার উৎস। তুমি কোটি বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা ও ত্রাতা। সন্তান জন্মিবার পূর্বেই তোমার দয়ায় মায়ের বুকে তাহার আহারের বন্দোবস্ত হইতেছে। করুণাময়! অগাধ সাগরের তলে, কঠিন পাথরের মধ্যে থাকিয়াও অতি ক্ষুদ্রকীটসকল তোমার কৃপায় আহার পাইয়া সানন্দে বিহার করিতেছে। তাই বলিতেছি, হে প্রভো! তোমা অপেক্ষা আর বড় কে? তোমার চেয়ে আর দয়ালু কে? বিভো! তুমি যে কি তাহা তুমিই জান, তোমাকে জানে বা বুঝে, তোমার অনন্ত বিশ্বে এমন কে আছে? তা নাথ! তুমি যত বড়—যেমনটি হও না কেন, আমাকে তুমি অবহেলা করিতে পার না, আমি তোমার আঠার হাজার আলমের শ্রেষ্ঠতম জীবমধ্যে একজন। আমার গ্রাসাচ্ছাদন তোমাকে যোগাইতে হইবে। আমার আকাঙ্খার বিষয়ও তোমাকে শুনিতে হইবে।
‘দীননাথ। দীনের প্রার্থনা, আমাদের ভব-সমুদ্রের কাণ্ডারী হযরত মোহাম্মদ (দঃ) যিনি তোমারই একত্বের পূর্ণপ্রচারক এবং তাঁহার বংশধর মহাপুরুষেরা সমস্ত মানবজাতির জ্ঞানবর্তিকা। অতএব, সর্বাগ্রে তাহাদের পবিত্র আত্মার উপরে তোমার শুভাশীর্বাদ বর্ষিত হউক। সমস্ত মুসলমান নর-নারীর সুখ-শান্তির নিমিত্ত তোমার বরকতের দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দাও। তোমার দাসগণ ঈমান-ধন হারাইয়া দ্রুতবেগে ধ্বংসের পথে যাইতেছে, তুমি দয়া করিয়া তাহাদিগকে রক্ষা কর। নিজ গুণে ক্ষমা করিয়া তাহাদিগকে গুণবাণ কর। ভ্রাতৃভাবে প্রীতির পবিত্র সূত্রে সমস্ত মানব জাতিকে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হইতে মতি দাও, স্বর্গীয় শোভায় মর্ত্য উদ্ভাসিত হউক।
অনাথনাথ! কৈশোরে মাতৃস্নেহে বঞ্চিত হইয়াছি, এই যৌবনে পিতৃশোকে সংসার অন্ধকার দেখিতেছি। প্রভো! তুমি সকলই জান, দাস অকৃতদার, যদি গোলামকে সংসারী কর, তবে যেন প্রেমের পথে তোমাকে লাভ করিতে পারি। আমিন।”
যুবক বহির্জগৎ ভুলিয়া একাগ্রমনে মোনাজাত করিতেছিলেন। তন্ময়চিত্ততায় তাহার পবিত্র হৃদয়োদ্ভূত ভক্তিবারি নয়নপ্রান্তে বহিয়া গণ্ডস্থল প্লাবিত করিতেছিল।
বালিকা কোরান শরীফ, মোহুলজান্নাত, রাহেনাজাত, পান্দেনামা, গোলেস্তাঁ প্রভৃতি আরবী, পারসিও উর্দু কেতাব তাহার দাদিমার নিকট শিক্ষা করিতেছিল। মোনাজাত আরবি মিশ্রিত উর্দুতে উচ্চারিত হইতেছিল, সুতরাং সে তাহার অর্থ অনেকাংশে বুঝিতে পারিতেছিল। বুঝিয়া শুনিয়া বালিকার চক্ষুও অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল। সে অসহ্য মনোবেদনা ভুলিয়া চিন্তা করিতে লাগিল, “আহা আজ কি শুনিলাম। এমন খোএল্হানে কোরান শরীফ পাঠ ত’ কখনও শুনি নাই, এমন মধুর উচ্চারণও ত’ কখনও শ্রুতিগোচর হয় নাই। কি মধুমাখা মোনাজাত। এমন মধুমাখা সুন্দর মোনাজাত ত’ কখনও শুনি নাই। বুঝি বা কোন ফেরেস্তা মানবমূর্তি পরিগ্রহ করিয়া মধুপুরে আসিয়াছেন, নচেৎ এমন বিশ্বপ্রেমভরা মোনাজাত কি মানবমুখে উচ্চারিত হইতে পারে? মোনাজাতে যেন হৃদয়ের ভাব ফুটিয়া বাহির হইয়াছে।” এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে যখন, “দাস অকৃতদার, যদি গোলামকে সংসারী কর, তবে যেন প্রেমের পথে তোমাকে লাভ করিতে পারি।”— যুবকের মোনাজাতের এই শেষ কথা কয়টি বালিকার কর্ণে প্রবেশ করিল, তখন সহসা অলক্ষিতে তাহার গোলাপ-গ রক্তিমাভ হইয়া উঠিল, স্বেদ-বারিবিন্দু মুখমণ্ডলে ফুটিয়া বাহির হইতে লাগিল। পাঠক, সোনার গাছে মুক্তাফল বুঝি এইরূপেই ফলে। বালিকা এক্ষণি সেই দূর ভবিষ্যৎ আশার আলোকে আপনাকে ডুবাইয়া দিয়া অস্ফুটস্বরে বলিয়া উঠিল, “তবে ইনিই কি—তিনি?”