তিন
সেবার বসন্ত রোগে লোক মরিতে লাগিল খুব বেশি। হরিশকেও রোগে ধরিল। কবিরাজ আসিয়া পরীক্ষা করিয়া মুখ গম্ভীর করিলেন, কহিলেন, মারাত্মক। রক্ষা পাওয়া কঠিন।
রায়বাহাদুর তখন পরলোকে। হরিশের বৃদ্ধা মাতা আছাড় খাইয়া পড়িলেন, নির্মলা ঘর হইতে বাহির হইয়া কহিল, আমি যদি সতী মায়ের সতী কন্যা হই, আমার নোয়া-সিঁদুর ঘুচোবে সাধ্যি কার? তোমরা ওঁকে দেখো, আমি চললুম। এই বলিয়া সে শীতলার মন্দিরে গিয়া হত্যা দিয়া পড়িল। কহিল, উনি বাঁচেন ত আবার বাড়ি ফিরব, নইলে এইখান থেকে ওঁর সঙ্গে যাব।
সাত দিনের মধ্যে দেবতার চরণামৃত ভিন্ন কেহ তাহাকে জল পর্যন্ত খাওয়াইতে পারিল না।
কবিরাজ আসিয়া বলিলেন, মা, তোমার স্বামী আরোগ্য হয়েছেন, এবার তুমি ঘরে চল।
লোকে ভিড় করিয়া দেখিতে আসিল। মেয়েরা পায়ের ধূলা লইল, তাহার মাথায় থাবা থাবা সিঁদুর ঘষিয়া দিল, কহিল, মানুষ ত নয়, যেন সাক্ষাৎ মা—! বৃদ্ধেরা বলিলেন, সাবিত্রীর উপাখ্যান মিথ্যে, না কলিতে ধর্ম গেছে বলেই একেবারে ষোলো আনা গেছে? যমের মুখ থেকে স্বামীকে ফিরিয়ে নিয়ে এলো!
বন্ধুরা লাইব্রেরি-ঘরে বলাবলি করিতে লাগিল, সাধে আর মানুষে স্ত্রীর গোলাম হয় হে! বিয়ে ত আমরাও করেছি, কিন্তু এমন নইলে আর স্ত্রী! এখন বোঝা গেল কেন হরিশ সন্ধ্যার পরে বাইরে থাকত না।
বীরেন উকিল ভদ্রলোক, গত বৎসর ছুটিতে কাশী গিয়া সে সন্ন্যাসীর কাছে মন্ত্র লইয়া আসিয়াছে, টেবিলে প্রচণ্ড করাঘাত করিয়া কহিল, আমি জানতাম হরিশ মরতেই পারে না। সত্যিকার সতীত্ব জিনিসটা কি সোজা ব্যাপার হে? বাড়ি থেকে বলে গেল, যদি সতী মায়ের সতী কন্যা হই ত—উঃ। শরীর শিউরে ওঠে।
তারিণী চাটুয্যের বয়স হইয়াছে, আফিংখোর লোক; একধারে বসিয়া নিবিষ্টচিত্তে তামাক খাইতেছিল, হুঁকাটা বেহারার হাতে দিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, শাস্ত্রমতে সহধর্মিণী কথাটা ভারী শক্ত। আমার দেখ না কেবল মেয়েই সাতটা। বিয়ে দিতে দিতেই ফতুর হয়ে গেলাম।
অনেকদিন পরে ভাল হইয়া আবার যখন হরিশ আদালতে উপস্থিত হইল তখন কত লোকে যে তাহাকে অভিনন্দিত করিল তাহার সংখ্যা নাই।
ব্রজেন্দ্রবাবু সখেদে কহিলেন, ভাই হরিশ, স্ত্রৈণ বলে তোমাকে অনেক লজ্জা দিয়েছি, মাপ ক’রো। লক্ষ কেন, কোটি কোটির মধ্যেও তোমার মত ভাগ্যবান নেই, তুমি ধন্য।
ভক্ত বীরেন বলিল, সীতা-সাবিত্রীর কথা না হয় ছেড়ে দাও, কিন্তু খনা, লীলাবতী, গার্গী আমাদের দেশেই জন্মেছিলেন। ভাই, স্বরাজ-ফরাজ যাই-ই বল, কিছুতেই হবে না মেয়েদের যতদিন না আবার তেমনি তৈরি করতে পারব। আমার ত মনে হয় শীঘ্রই পাবনায় একটা আদর্শ-নারী-শিক্ষা-সমিতি গড়ে তোলা প্রয়োজন; এবং যে আদর্শ মহিলা তার পার্মানেন্ট প্রেসিডেন্ট হবেন তাঁর নাম ত আমরা সবাই জানি।
বৃদ্ধ তারিণী চাটুয্যে বলিলেন, সেই সঙ্গে একটা পণ-প্রথা-নিবারণী সমিতিও হওয়া আবশ্যক। দেশটা ছারখার হয়ে গেল।
ব্রজেন্দ্র কহিলেন, হরিশ, তোমার ত ছেলেবেলায় খাসা লেখার হাত ছিল, তোমার উচিত তোমার এই রিকভারি সম্বন্ধে একটা আর্টিকেল লিখে আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপিয়ে দেওয়া।
হরিশ কোন কথারই জবাব দিতে পারিল না, কৃতজ্ঞতায় তাহার দুই চক্ষু ছলছল করিতে লাগিল।