চার
এ বাড়িতে আসিয়া একটা পুরাতন আরাম-কেদারা যোগাড় হইয়াছিল, বিকালের দিকে তাহারি দুই হাতলে পা ছড়াইয়া দিয়া বিজয় চোখ বুজিয়া চুরুট টানিতেছিল, কানে গেল—বাবুমশাই? চোখ মেলিয়া দেখিল অনতিদূরে দাঁড়াইয়া এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক তাহাকে সসম্মানে সম্বোধন করিতেছে। বিজয় উঠিয়া বসিল। ভদ্রলোকের বয়স ষাটের উপরে গিয়াছে, কিন্তু দিব্য গোলগাল বেঁটেখাটো শক্ত-সমর্থ দেহ। গোঁফ পাকিয়া সাদা হইয়াছে, কিন্তু মাথায় প্রশস্ত টাকের আশেপাশের চুলগুলি ভ্রমর-কৃষ্ণ। সম্মুখের গোটা-কয়েক ছাড়া দাঁতগুলি প্রায় সমস্তই বিদ্যমান। গায়ে তসরের কোট, গরদের চাদর, পায়ে চীনা-বাড়ির বার্নিশ-করা জুতা, ঘড়ির সোনার চেন হইতে সোনা বাঁধানো বাঘের নখ ঝুলিতেছে। পল্লীঅঞ্চলে ভদ্রলোকটিকে অবস্থাপন্ন বলিয়াই মনে হয়। পাশে একটা ভাঙ্গা টুলের উপর বিজয়ের চুরুটের সাজ-সরঞ্জাম থাকিত, সরাইয়া লইয়া তাঁহাকে বসিতে দিল।
ভদ্রলোক বসিয়া বলিলেন, নমস্কার বাবু।
বিজয় কহিল, নমস্কার।
আগন্তুক বলিলেন, আপনারা গ্রামের জমিদার, মহাশয়ের পিতাঠাকুর হচ্ছেন কৃতী ব্যক্তি—লক্ষপতি। নাম করলে সুপ্রভাত হয়—আপনি তাঁরই সুসন্তান। স্ত্রীলোকটিকে দয়া না করলে সে যে ভেসে যায়।
কে স্ত্রীলোক? কত টাকা বাকি?
ভদ্রলোক বলিলেন, টাকার ব্যাপার নয়। স্ত্রীলোকটি হচ্চে ঈশ্বর অমর চাটুয্যের কন্যা— প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি— গগন চাটুয্যের বৈমাত্র ভগিনী। এ তার পৈতৃক গৃহ। সে থাকবে না চলে যাবে,—তার ব্যবস্থাও হয়েছে—কিন্তু আপনি যে তারে ঘাড় ধরে তাড়িয়ে দিচ্চেন, এ কি মশায়ের কর্তব্য?
এই অশিক্ষিত বৃদ্ধের প্রতি ক্রোধ করা চলে না বিজয় মনে মনে বুঝিল, কিন্তু কথা বলার ধরনে জ্বলিয়া গেল। কহিল, আমার কর্তব্য আমি বুঝিব, কিন্তু আপনি কে যে তাঁর হয়ে ওকালতি করতে এসেছেন?
বৃদ্ধ বলিলেন, আমার নাম ত্রিলোচন গাঙ্গুলি, পাশের গ্রাম মসজিদপুরে বাড়ি— সবাই চেনে। আপনার বাপ-মায়ের আশীর্বাদে আমার কাছে গিয়ে হাত পাততে হয় না এমন লোক এদিকে কম। বিশ্বাস না হয় বিনোদ ঘোষকে জিজ্ঞাসা করবেন।
বিজয় কহিল, আমার হাত পাতবার দরকার হলে মশায়ের খোঁজ নেব, কিন্তু যাঁর ওকালতি করতে এসেছেন তাঁর আপনি কে জানতে পারি কি?
ভদ্রলোক রসিকতার ছলে ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন, কুটুম্ব। বোশেখের এই ক’টা দিন বাদে আমি ওঁকে বিবাহ করব।
বিজয় চকিত হইয়া কহিল, আপনি বিবাহ করবেন অনুরাধাকে?
আজ্ঞে হাঁ। আমার স্থির সঙ্কল্প। জ্যৈষ্ঠ ছাড়া আর দিন নেই, নইলে এই মাসেই শুভকর্ম সমাধা হয়ে যেত, থাকতে দেবার কথা আপনাকে আমার বলতেও হ’তো না।
বিজয় কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া প্রশ্ন করিল, বিয়ের ঘটকালি করলে কে? গগন চাটুয্যে?
বৃদ্ধ রোষ-কষায়িত চক্ষে কহিলেন, সে ত ফেরারী আসামী মশাই— প্রজাদের সর্বনাশ করে চম্পট দিয়েচে। এতদিন সেই ত বাধা দিচ্ছিল, নইলে অঘ্রানেই বিবাহ হয়ে যেত। বলে, স্বভাব-কুলীন, আমরা কৃষ্ণের সন্তান—বংশজের ঘরে বোন দেব না। এই ছিল তার বুলি। এখন সে গুমোর রইল কোথায়? বংশজের ঘরে যেচে আসতে হ’লো যে! এখনকার দিনে কুল কে খোঁজে মশাই? টাকাই কুল, টাকাই মান, টাকাই সব,—বলুন ঠিক কিনা?
বিজয় বলিল, হাঁ ঠিক। অনুরাধা স্বীকার করেছেন?
ভদ্রলোক সদম্ভে জানুতে চপেটাঘাত করিয়া কহিলেন, স্বীকার? বলচেন কি মশাই, যাচা-যাচি! শহর থেকে এসে আপনি একটা তাড়া লাগাতেই দু’চোখে অন্ধকার—যাই মা তারা দাঁড়াই কোথা! নইলে আমার ত মতলব ঘুরে গিয়েছিল। ছেলেদের অমত, বৌমাদের অমত, মেয়ে-জামাইরা সব বেঁকে দাঁড়িয়েছিল,—আমিও ভেবেছিলুম দূর হোক গে, দু’সংসার তো হ’লো, আর না। কিন্তু লোক দিয়ে নিজে ডেকে পাঠিয়ে রাধা কেঁদে বললে, গাঙ্গুলি মশাই, পায়ে স্থান দাও। তোমার উঠোন ঝাঁট দিয়ে খাব আমার সেও ভালো।। কি করি, স্বীকার করলুম।
বিজয় নির্বাক হইয়া বসিয়া রহিল।
বৃদ্ধ বলিতে লাগিলেন, বিবাহ এ-বাড়িতেই হবে। দেখতে একটু খারাপ দেখাবে, নইলে আমার বাড়িতেই হতে পারত। গগন চাটুয্যের কে এক পিসি আছে, সে-ই কন্যা সম্প্রদান করবে। এখন কেবল মশাই রাজী হলেই হয়।
বিজয় মুখ তুলিয়া বলিল, রাজী হয়ে আমাকে কি করতে হবে বলুন? তাড়া দেব না—এই ত? বেশ, তাই হবে। এখন আপনি আসুন, নমস্কার।
নমস্কার মশাই, নমস্কার। হবেই ত, হবেই ত। আপনার ঠাকুর হলেন লক্ষপতি! প্রাতঃস্মরণীয় লোক, নাম করলে সুপ্রভাত হয়।
তা হয়, আপনি এখন আসুন।
আসি মশাই আসি—নমস্কার। বলিয়া ত্রিলোচন প্রস্থান করিলেন।
লোকটি চলিয়া গেলে বিজয় চুপ করিয়া বসিয়া নিজেকে বুঝাইতেছিল যে, তাহার মাথাব্যথা করিবার কি আছে? বস্তুতঃ, এ-ছাড়া মেয়েটিরই বা উপায় কি? ব্যাপারটা অভাবিতপূর্বও নয়, সংসারে ঘটে না তাও নয়, তবে তাহার দুশ্চিন্তা কিসের? হঠাৎ বিনোদ ঘোষের কথা মনে পড়িল, সেদিন সে বলিতেছিল, অনুরাধা দাদার সঙ্গে এই বলিয়া ঝগড়া করিয়াছে যে কুলের গৌরব লইয়া সে কি করিবে, সহজে দুটা খাইতে পরিতে যদি পায় সেই যথেষ্ট।
প্রতিবাদে গগন রাগ করিয়া বলিয়াছিল, তুই কি বাপ-পিতাম’র নাম ডোবাতে চাস? অনুরাধা জবাব দিয়াছিল, তুমি তাঁদের বংশধর, নাম বজায় রাখতে পার রেখো, আমি পারব না।
এ কথার বেদনা বিজয় বুঝিল না, নিজেও সে যে কৌলীন্য-সম্মান এতটুকু বিশ্বাস করে তাও না, কিন্তু তবুও তাহার সহানুভূতি গিয়া পড়িল গগনের ‘পরে এবং অনুরাধার তীক্ষ্ণ প্রত্যুত্তর যতই সে মনে মনে তোলাপাড়া করিতে লাগিল ততই তাহাকে লজ্জাহীন, লোভী ও হীন বলিয়া মনে হইতে লাগিল।
এদিকে উঠানে ক্রমশঃ লোক জমিতেছে, এইবার তাহাদিগকে লইয়া কাজ শুরু করিতে হইবে, কিন্তু আজ তাহার কিছুই ভাল লাগিল না। দরোয়ানকে দিয়া তাহাদের বিদায় করিয়া দিল এবং একাকী বসিয়া থাকিতে না পারিয়া কি ভাবিয়া সে একেবারে বাটীর মধ্যে আসিয়া উপস্থিত হইল। রান্নাঘরের সম্মুখের খোলা বারান্দায় মাদুর পাতিয়া অনুরাধা শুইয়া, তাহার দুই পাশে দুই ছেলে কুমার ও সন্তোষ,—মহাভারতের গল্প চলিতেছে। রাত্রের রান্নাটা সে বেলাবেলি সারিয়া লইয়া নিত্যই এমনি ছেলেদের লইয়া সন্ধ্যার পরে গল্প করে, তারপর কুমারকে খাওয়াইয়া বাহিরে তাহার পিতার কাছে পাঠাইয়া দেয়। জ্যোৎস্না রাত্রি, ঘন-পল্লব আমগাছের পাতার ফাঁক দিয়া আসিয়া টুকরা চাঁদের আলো স্থানে স্থানে তাহাদের গায়ের ‘পরে, মুখের ‘পরে পড়িয়াছে।
গাছের ছায়ায় একটা লোককে এদিকে আসিতে দেখিয়া অনুরাধা চকিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কে?
আমি বিজয়।
তিনজনেই শশব্যস্তে উঠিয়া বসিল। সন্তোষ ছোটবাবুকে অত্যন্ত ভয় করে, প্রথম দিনের স্মৃতি সে ভুলে নাই, উসখুস করিয়া উঠিয়া গেল, কুমারও বন্ধুর অনুসরণ করিল।
বিজয় বলিল, ত্রিলোচন গাঙ্গুলিকে আপনি চেনেন? আজ তিনি আমার কাছে এসেছিলেন।
অনুরাধা বিস্মিত হইল, আপনার কাছে? কিন্তু আপনি ত তাঁর খাতক ন’ন।
না। কিন্তু হলে হয়ত আপনার সুবিধে হতো, আমার একদিনের অত্যাচার আপনি আর একদিন শোধ দিতে পারতেন।
অনুরাধা চুপ করিয়া রহিল।
বিজয় বলিল, তিনি জানিয়ে গেলেন, আপনার সঙ্গে তাঁর বিবাহ স্থির হয়েছে। এ কি সত্য?
হাঁ।
আপনি নিজে উপযাচক হয়ে তাকে রাজি করিয়েছেন?
হাঁ তাই।
তাই যদি হয়ে থাকে এ অত্যন্ত লজ্জার কথা। শুধু আপনার নয়, আমারও।
আপনার লজ্জা কিসের?
সেই কথা জানাতেই আমি এসেছি। ত্রিলোচন বলে গেল শুধু আমার তাড়াতেই বিভ্রান্ত হয়ে নাকি আপনি এ প্রস্তাব করেছেন। বলেছেন আপনার দাঁড়াবার স্থান নেই এবং বহু সাধ্যসাধনায় তাকে সম্মত করিয়েছেন, নইলে এ বয়সে বিবাহের ইচ্ছে সে ত্যাগ করেছিল। শুধু আপনার কান্নাকাটিতে দয়া করে ত্রিলোচন রাজী হয়েছে।
হাঁ, এ-সবই সত্যি।
বিজয় কহিল, আমার তাড়া দেওয়া আমি প্রত্যাহার করচি এবং নিজের আচরণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করচি।
অনুরাধা চুপ করিয়া রহিল।
বিজয় বলিল, এবার নিজের তরফ থেকে আপনি প্রস্তাব প্রত্যাহার করুন।
না, সে হয় না। আমি কথা দিয়েছি—সবাই শুনেছে—লোকে তাঁকে উপহাস করবে।
এতে করবে না? বরঞ্চ ঢের বেশি করবে। তার উপযুক্ত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বিবাদ বাধবে, তাদের সংসারে একটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে, আপনার নিজের অশান্তির সীমা থাকবে না, এ-সব কথা কি ভেবে দেখেন নি?
অনুরাধা মৃদুকণ্ঠে বলিল, দেখেচি। আমার বিশ্বাস এ-সব কিছুই হবে না।
শুনিয়া বিজয় অবাক হইয়া গেল, কহিল, সে বৃদ্ধ ক’টা দিন বাঁচবে আশা করেন?
অনুরাধা বলিল, স্বামীর পরমায়ু সংসারে সকল স্ত্রীই বেশি আশা করে। এমনও হতে পারে হাতের নোয়া নিয়ে আমি আগে চলে যাব।
বিজয় এ কথার উত্তর খুঁজিয়া পাইল না, স্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া রহিল। কিছুক্ষণ এমনি নীরবে কাটিলে অনুরাধা বিনীত স্বরে কহিল, আপনি আমাকে চলে যেতে হুকুম করেছেন সত্যি, কিন্তু কোনদিন তার উল্লেখ পর্যন্ত করেন নি। দয়ার যোগ্য নই, তবু যথেষ্ট দয়া করেছেন, মনে মনে আমি যে কত কৃতজ্ঞ তা জানাতে পারিনে।
বিজয়ের কাছে উত্তর না পাইয়া সে বলিতে লাগিল, ভগবান জানেন আপনার বিরুদ্ধে কারো কাছে আমি একটা কথাও বলিনি। বললে আমার অন্যায় হ’তো,আমার মিছে কথা হ’তো। গাঙ্গুলিমশাই যদি কিছু বলে থাকেন সে তাঁর নিজের কথা, আমার নয় তবু তাঁর হয়ে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করি।
বিজয় জিজ্ঞাসা করিল, আপনাদের কবে বিয়ে, তেরই জ্যৈষ্ঠ? তা হলে প্রায় মাস-খানেক বাকি রইল—না?
হাঁ তাই।
এর আর পরিবর্তন নেই বোধ করি?
বোধ হয় নেই। অন্ততঃ, সেই ভরসাই তিনি দিয়ে গেছেন।
বিজয় বহুক্ষণ নীরবে থাকিয়া কহিল, তা হলে আর কিছু আমার বলবার নেই, কিন্তু নিজের ভবিষ্যৎ জীবনটা একবার ভেবে দেখলেন না, আমার এই বড় পরিতাপ।
অনুরাধা বলিল, একবার নয়, একশো-বার ভেবে দেখেছি ছোটবাবু। এই আমার রাত্রি-দিনের চিন্তা। আপনি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার সত্যিই ভাষা খুঁজে পাইনে, কিন্তু আপনি নিজে একবার আমার সব কথা ভেবে দেখুন দিকি। অর্থ নেই, রূপ নেই, গৃহ নেই, অভিভাবকহীন একাকী পল্লীগ্রামের অনাচার অত্যাচার থেকে কোথাও গিয়ে দাঁড়াবার স্থান নেই—বয়স হলো তেইশ-চব্বিশ—ইনি ছাড়া আমাকে কে বিয়ে করতে চাইবে বলুন ত? তখন অন্নের জন্যে কার কাছে গিয়ে হাত পেতে দাঁড়াব? শুনে আপনারই বা কি মনে হবে?
এ সবই সত্য, প্রতিবাদে কিছুই বলিবার নাই। মিনিট দুই-তিন নিরুত্তরে দাঁড়াইয়া বিজয় গভীর অনুতাপের সহিত বলিল, এ সময়ে আপনার কি আমি কোন উপকারই করতে পারিনে? পারলে খুশি হবো।
অনুরাধা কহিল, আপনি আমার অনেক উপকার করেছেন যা কেউ করত না। আপনার আশ্রয়ে আমি নির্ভয়ে আছি,—ছেলে দুটি আমার চন্দ্র-সূয্যি—এই আমার ঢের। আপনার কাছে প্রার্থনা, শুধু মনে মনে আর আমাকে আমার দাদার দোষের ভাগী করে রাখবেন না, আমি জেনে কোন অপরাধ করিনি।
সে আমি জানতে পেরেছি, আপনাকে বলতে হবে না। এই বলিয়া বিজয় ধীরে ধীরে বাহিরে চলিয়া গেল।