বাংলা সাহিত্যের একটি প্রিয়তম নাম সুকান্ত ভট্টাচার্য। বাঙালীর ঘরে ঘরে নিঃসন্দেহে একটি প্রিয়তম গ্রন্থ হবে ‘সুকান্ত-সমগ্র’। সুকান্তর সব লেখা একত্রে পাওয়ার বাসনা আমাদের বহু দিনের এবং বহু জনের। এতদিনে সে আকাঙ্ক্ষা মিটিয়ে সারস্বত লাইব্রেবী আমাদেব ধন্যবাদার্হ হলেন।

আমি জানি, কাজটা সহজ ছিল না। লেখাগুলো ছিল নানা জায়গায় ছডিয়ে ছিটিয়ে। ক্রমে ক্রমে সেসব প্রকাশকের হাতে আসতে সময় লেগেছে। সব যে নিঃশেষে পাওয়া গেছে, আমাদের নজর এড়িয়ে কোথাও যে পড়ে নেই–এখনও খুব জোর করে সে কথা বলা যায় না। সুকান্তর লেখা উদ্ধারের কাজে কত জন যে কতভাবে সাহায্য করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। ‘সুকান্ত-সমগ্র’ আসলে নানা দিক থেকে নানা লোকের সাহায্যের যোগফল।

লেখা পাওয়ার পর দেখা দিয়েছে আরেক সমস্যা।

কোনো কোনো লেখা পাওয়া গেছে ছাপার হরফে, কোনোটা বা হাতের লেখায়। কখনও ছাপানো লেখাকে, কখনও বা পাণ্ডুলিপিকে চূড়ান্ত ব’লে মানতে হয়েছে। কিন্তু ছাপানো লেখা আর তার পাণ্ডুলিপিতে যদি অমিল থাকে? ঢালাওভাবে সেই অসামঞ্জস্যকে ছাপার ভুল বলে মানা হবে? বদলটা প্রেস-কপিতেও হয়ে থাকতে পারে। কাজেই ছাপার হরফে আর পাণ্ডুলিপিতে গরমিল হলে সেটা লেখকের ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত, অভিপ্রেত না অনভিপ্রেত, এ বিষয়ে দ্বিধায় পড়তে হয়। যে পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে, তাও যে লেখাটির প্রাথমিক খসড়া নয়—সেটা যে প্রেস-কপির হুবহু নকল—তাই বা জোর ক’রে কিভাবে বলা যাবে। তাছাড়া লেখার ভুলে পাণ্ডুলিপিতেও অনেক সময় গোলমাল থাকে; বানানের অনিয়ম ছাড়াও যতি চিহ্নের অসতর্কতায় পাঠকের ভুল বুঝবার আশঙ্কা থেকে যায়।

সুতরাং যদ্দৃষ্টং তন্মুদ্রিতং করা সর্বক্ষেত্রে সম্ভব হয় নি। বানানে সমতা আনবার চেষ্টা করতে হয়েছে, যতি চিহ্নের ব্যাপারে জায়গায় জায়গায় হস্তক্ষেপের দরকার হয়েছে এবং মুদ্রিত আর পাণ্ডুলিপিগত অসামঞ্জস্যের ক্ষেত্রে দুটোর একটিকে বেছে নিতে হয়েছে। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভালো, এর কোনোটাই অনড় অচল ব্যবস্থা নয় – পরে প্রয়োজনবোধে রদবদল হ’তে পারে।

এর চেয়েও জটিল আরেকটি সমস্যা আছে। সে সম্বন্ধে আজকের পাঠকদের অবহিত করতে চাই। সমস্যাটি সাধারণভাবে লেখার নির্বাচন সংক্রান্ত।

মাত্র একুশ বছর সুকান্ত পৃথিবীতে বেঁচে ছিল। আবির্ভাবের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্য সুকান্তকে আশ্চর্য প্রতিভা ব’লে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু ঠিক বিকশিত হওয়ার মুখেই সেই আশ্চর্য প্রতিভাকে আমরা হারিয়েছি।

বয়স বাড়লে নিজেদের কম বয়সের লেখা সম্বন্ধে লেখকেরা স্বভাবতই খুব খুঁতখুঁতে হন। অনেকের কাঁচা বয়সের লেখার কথা তো পরে আমরা জানতেও পারি না। অথবা জানলেও, তাদের পাকা হাতের লেখাগুলো সংখ্যায় আর পরিমাণে তাঁদের কাঁচা হাতের লেখাগুলোকে ঢেকে দিতে পারে।

সুকান্ত সেদিক থেকে সত্যিই মন্দভাগ্য। অকালমৃত্যু সুকান্তকে বাংলা সাহিত্যে শুধু বিপুলতর গৌরব লাভের সুযোগ থেকেই বঞ্চিত করে নি সেই সঙ্গে লেখার সংখ্যায় আর পরিমাণে পরিণতির চেয়ে প্রতিশ্রুতির পাল্লাই ভারী করেছে।

বেঁচে থাকলে সুকান্তর কিছু লেখা যে ‘সুকান্ত-সমগ্র’তে স্থান পেত না, তাতে আমার সন্দেহ নেই। বাংলা সাহিত্যে আমি ছিলাম সুকান্তর অগ্রজ; তার কবিমনের অনেক কথাই আমার জানা ছিল। তার কবিতা যখন নতুন মোড় নিচ্ছিল, তখনই দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা তাকে হারিয়েছি। সুকান্তর যে সব কবিতা পড়ে আমরা চমকাই, সুকান্তর পক্ষে সে সবই আরম্ভ মাত্র।

সুকান্তর যখন বালক বয়স, তখন থেকেই তার কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয়।

আমি তখন স্কটিশ চার্চ কলেজে বি-এ পড়ছি। ‘পদাতিক’ বেরিয়ে তখন পুরনো হয়ে গেছে। রাজনীতিতে আপাদমস্তক ডুবে আছি। ক্লাস পালিয়ে বিডন স্ট্রীটের চায়ের দোকানে আমাদের আড্ডা। কলেজের বন্ধু মনোজ একদিন জোর ক’রে আমার হাতে একটা কবিতার খাতা গছিয়ে দিল। প’ড়ে আমি বিশ্বাসই করতে পারি নি কবিতাগুলো সত্যিই তার চৌদ্দ বছর বয়সের খুড়তুতো ভাইয়ের লেখা। শুধু আমি কেন, আমার অন্যান্য বন্ধুরা, এমন কি বুদ্ধদেব বসুও কবিতার সেই খাতা প’ড়ে অবাক না হয়ে পারেন নি।

আমার সন্দেহভঞ্জন করবার জন্যেই বোধহয় মনোজ একদিন কিশোর সুকান্তকে সেই চায়ের দোকানে এনে হাজির করেছিল। সুকান্তর চোখের দিকে তাকিয়ে তার কবিত্বশক্তি সম্বন্ধে সেদিন কেন আমি নিঃসংশয় হয়েছিলাম, সে বিষয়ে কেউ যদি আমাকে জেরা করে আমি সদুত্তর দিতে পারব না।

সে সব কবিতা পরে ‘পূর্বাভাস’-এ ছাপা হয়েছে। তাতে কী এমন ছিল যে, প’ড়ে সেদিন আমরা একেবারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম? আজকের পাঠকেরা আমাদের সেদিনকার বিস্ময়ের কারণটা ধরতে পারবেন না। কারণ, বাংলা কবিতার ধারা তারপর অনেকখানি ব’য়ে এসেছে। কোনো কিশোরের পক্ষে ঐ বয়সে ছন্দে অমন আশ্চর্য দখল, শব্দের অমন লাগসই ব্যবহার সেদিন ছিল অভাবিত। হালে সে জিনিস প্রায় অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।

জীবনের অভিজ্ঞতাকে ক্ষমতায় বেঁধে সুকান্ত যখন কবিতার বিদ্যুৎশক্তিকে কলকারখানায় খেতে খামারে ঘরে ঘরে সবে পৌছে দিতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই মৃত্যু তাকে কেড়ে নিয়ে গেল। আরম্ভেই সমাপ্তির এই শোকে বাংলা সাহিত্য চিরদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলবে।

সুকান্ত বেঁচে থাকতে তার অনুরাগী পাঠকদের মধ্যে আমার চেয়ে কড়া সমালোচক অপর কেউ ছিল কিনা সন্দেহ। এখন ভেবে খারাপ লাগে। সামনাসামনি তাকে কখনো আমি বাহবা দিই নি। তার লেখায় সামান্য ক্রটিও আমি কখনও ক্ষমা করি নি।

এ প্রসঙ্গ তুলছি স্মৃতিচারণার জন্যে নয়। পাঠকেরা পাছে বিচারে ভুল করেন, তার যুগ আর তার বয়স থেকে পাছে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে দেখবার চেষ্টা করেন—সেইজন্যে গোড়াতেই আজকের পাঠকদের খানিকটা হুঁশিয়ার ক’রে দিতে চাই।

খুঁত ধরব জেনেও, নতুন কিছু লিখলেই সুকান্ত আমাকে একবার না শুনিয়ে ছাড়ত না। আমি তখন কবিতা ছেড়ে ‘জনযুদ্ধ’ নিয়ে ডুবে আছি। অফিসে ব’সে কথা বলবারও বেশি সময় পেতাম না। আমাদের অধিকাংশ কথাবার্তা হত সভায় কিংবা মিছিলে যাতায়াতের রাস্তায়। ‘কী নিয়ে লিখব?’—এটা কখনই আমাদের আলোচনার বিষয় হত না। ‘কেমন ক’রে লিখব?’—এই নিয়েই ছিল আমাদের যত মাথাব্যথা।

কিশোর বাহিনীর আন্দোলনে সুকান্তকে টেনে এনেছিল তখনকার ছাত্রনেতা এবং আমাদের বন্ধু অন্নদাশঙ্কর ভট্টাচার্য। রাজনীতিতে শুকনো ভাব তখন অনেকখানি কেটে গিয়ে নাচ গান নাটক আবৃত্তির ভেতর দিয়ে বেশ একটা রসকষ এসেছে। কবিতাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে আমাদের যেমন রাজনীতির আসরে ঢুকতে হয়েছিল, সুকান্তর বেলায় তা হয় নি। সুকান্তর সাহিত্যিক গুণগুলোকে আন্দোলনের কাজে লাগানের ব্যাপারে অন্নদারও যথেষ্ট হাতযশ ছিল। সুকান্তর আগের যুগের লোক ব’লে আমি পার্টিতে এসেছিলাম কবিতা ছেড়ে দিয়ে; আর সুকান্ত এসেছিল কবিতা নিয়ে। ফলে, কবিতাকে সে সহজেই রাজনীতির সঙ্গে মেলাতে পেরেছিল। তার ব্যক্তিত্বে কোনো দ্বিধা ছিল না।

কিন্তু তার মানে এ নয় যে, আঠারো থেকে একুশ বছর বয়সে সুকান্ত যেভাবে লিখেছিল—বেঁচে থাকলে তিরিশ থেকে পয়ত্রিশ বছর বয়সেও সেই একই ভাবে লিখে যেত। সুকান্তকে আমি ছোট থেকে বড় হতে দেখেছি ব’লেই জানি, এক জায়গায় থেকে যাওয়া সুকান্তর পক্ষে অসম্ভব ছিল। ‘পূর্বাভাসে’ আর ‘ঘুম নেই’তে অনেক তফাত। তেমনি সুস্পষ্ট তফাত ‘ছাড়পত্রে’র প্রথম দিকের আর শেষ দিকের লেখায়।

তাছাড়া কবিতা ছেড়ে সুকান্ত পরের জীবনে উপন্যাসে চলে যেত কিনা তাই বা কে বলতে পারে? বেঁচে থাকলে কী হত তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার আজ হয়ত কোনো মানে নেই, কিন্তু কাজে হাত দিয়েই সুকন্তকে চলে যেতে হয়েছে—এ কথা ভুলে গেলে সুকান্তর প্রতি অবিচার করা হবে।

আমি আবার বলছি, ‘সুকান্ত-সমগ্র’তে এমন অনেক লেখা আছে, যে লেখা হয়ত সুকান্তের সাজে না। সুকান্ত দীর্ঘজীবী হলে ছেলে বয়সের সে সব লেখা হয়ত তার বইতে স্থানও পেত না—আমার মতামত চাইলে আমিও ছাপাবার বিরুদ্ধে রায় দিতাম।

কিন্তু সুকান্তর অকালমৃত্যু আমাদেরও হাত বেঁধে দিয়েছে। সুকান্ত বেঁচে থাকলে যে জোর খাটানো যেত, এখন আর সে জোর খাটানো চলে না। ওর ছেলেবেলার লেখায় খোদকারি করেছি, বড় হওয়ার পরেও ওর লেখা নিয়ে খুঁত খুঁঁত করেছি—এই বিশ্বাসে যে, আমরা যাই বলি না কেন মানা না মানার শেষ বিচার ওর হাতে।

এখন সুকান্তর লেখা আর সুকান্তর নয়—দেশের এবং দশের। আমার কিংবা আর কারো একার বিচার সেখানে খাটবে না। কাজেই যে লেখা যেমন তাকে ঠিক সেইভাবেই কালের দরবারে হাজিব করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। ‘সুকান্ত-সমগ্র’র সার্থকতা সেইখানেই।

ভাবতে অবাক লাগে, সুকান্ত বেঁচে থাকলে আজ তার একচল্লিশ বছর বযস হত। কেমন দেখতে হত সুকান্তকে? জীবনে কোন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে সে যেত? তার লেখার ধারা কোন্ পথে বাঁক নিত?

অসুখে পড়বার অল্প কিছুদিন আগে একদিন ওয়েলিংটন স্কোয়ারের এক মিটিঙে যাবার পথে আমার এক সংশযেব জবাবে সুকান্ত বলেছিল: আমার কবিতা পড়ে পাটিব কর্মীরা যদি খুশি হয় তাহলেই আমি খুশি—কেননা এই দলবলই তত বাড়তে বাড়তে একদিন এ দেশের অধিকাংশ হবে।

সেদিন তর্কে আমি ওকে হারাতে চেষ্টা করেছিলাম। আজ আমাকে মানতেই হবে, একদিক থেকে তার কথাটা মিথ্যে নয়। গত কুড়ি বছর ধরে সুকান্তব বই বাংলা দেশের প্রায় ঘরে ঘরে স্থান পেযেছে। পূর্ব পাকিস্তানে তার একটা ছাপা বই থেকে শ’য়ে শ’য়ে হাতে লিখে নকল করে লোকে সযত্নে ঘরে রেখেছে। তার পাঠককুল ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। সুকান্ত মুখে যাই বলুক, আসলে সে শুধু পার্টির কর্মীদের জন্যেই লেখে নি। যে নতুন শক্তি সমাজে সেদিন মাথা তুলেছিল, সুকান্ত তার বুকে সাহস, চোখে অন্তদৃষ্টি আর কণ্ঠে ভাষা জুগিয়েছিল। এ কথাও ঠিক নয়, কাউকে খুশি করার জন্যে সুকান্ত লিখেছিল। তাগিদটা বাইরে থেকে আসে নি, এসেছিল তার নিজের ভেতর থেকে। পাঠকের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আসলে নিজেকেই সে কবিতায় ঢেলে দিয়েছিল।

কী ভাবে বলেছিল সেটাও দেখতে হবে। সুকান্তর আগে আর কেউ ওকথা ওভাবে বলে নি ব’লেই পাঠকেরা কান খাড়া করে তার কথা শুনেছেন। বলবার উদ্দেশ্যটা যাঁদের মনের মত ছিল না, বলবার গুণে তাঁরাও না শুনে পারেন নি।

সুকান্তর মৃত্যুর পর শ্রীযুক্ত জগদীশ ভট্টাচার্য লিখেছিলেন: …যে কবির বাণী শোনবার জন্যে কবিগুরু কান পেতেছিলেন সুকান্ত সেই কবি। শৌখিন মজদুরি নয়, কৃষাণের জীবনের সে ছিল সত্যকার শরিক, কর্মে ও কথায় তাদেরই সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা ছিল তার, মাটির রসে ঋদ্ধ ও পুষ্ট তার দেহমন। মাটির বুক থেকে সে উঠে এসেছিল।

…. ব্যক্তিজীবনে সুকান্ত একটি বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী ছিল।

কিন্তু এই শেষ চার পংক্তিতে (‘আর মনে ক’রো আকাশে আছে এক ধ্রুব নক্ষত্র/ নদীর ধারায় আছে গতির নির্দেশ,/অরণ্যের মর্মরধ্বনিতে আছে আন্দোলনের ভাষা, আর আছে পৃথিবীর চিরকালের আবর্তন’: ঐতিহাসিক, ছাড়পত্র) কবি সুকান্ত যে আদর্শের কথা বলে গেছে তা পৃথিবীর সমস্ত মতবাদের চেয়ে প্রাচীন, সমস্ত আদর্শের চেয়েও বড়। …

‘…তার প্রথম দিকের অনেক রচনাতেই দলীয় শ্লোগান অতি স্পষ্ট ছিল; কিন্তু মনের বালকত্ব উত্তীর্ণ হবার সঙ্গে সঙ্গে তার আত্মবিশ্বাস আত্মপ্রকাশকে অনন্যপরতন্ত্র করে তুলেছিল।…

(কবিকিশোর’: পরিচয় শারদীয়, ১৩৫৪)

এ কিন্তু ভঙ্গি দিয়ে ভোলানো নয়, কবিতার গুণে দূরের মানুষকে কাছে টানা।

সমসাময়িকদের মধ্যে যে কাজ আর কেউ পারে নি, সুকান্ত একা তা করেছে—আধুনিক বাংলা কবিতার দ্বার বহুজনের জন্যে সে খুলে দিয়ে গেছে। কবিতাবিমুখ পাঠকদের কবিতার রাজ্যে জয় ক’রে আনার কৃতিত্ব সুকান্তর। তারই সুফল আজ আমরা ভোগ করছি।

সুকান্তর মৃত্যুর পর সুকান্তকে অনুকরণের একটা যুগ গেছে। কারো কারো এ ধারণাও হয়েছিল যে, রাজনৈতিক আন্দোলনই বুঝি সুকান্তকে তুলে ধরেছিল। সুকান্তর অক্ষম অনুকারকেরা কবিতার ভুষ্টিনাশ করে বক্তব্যকে বুলিসর্বস্ব ক’রে তুললেন। হিতে বিপরীত হল। একটা সময় এল, পাঠকেরা বেঁকে বসল-সেই পাঠকেরাই, যারা এর আগে এবং পরেও সুকান্ত পড়ে তৃপ্তি পেয়েছে।

সুকান্তর সঙ্গে রাজনৈতিক আন্দোলনের তোলাতুলি বা কোলাকুলির সম্পর্ক ছিল না—এটা না বোঝার জন্যেই একদল কবির মধ্যে এক সময় রাজনীতি থেকে আশাভঙ্গজনিত পালাও-পালাও রব উঠেছিল। যে যার নিজের মধ্যে তাঁরা পালিয়ে গেলেন। তাতেও শেষ পর্যন্ত তাকদের মুশকিলের আশান হয় নি।

ভুল হয়েছিল বুঝতে। সুকান্ত রাজনীতির কাধে চড়ে নি। রাজনীতিকে নিজের করে নিয়েছিল। রাজনৈতিক আন্দোলনও সুকান্তকে দিয়েছে তাই সানন্দ স্বীকৃতি। নিজেকে নিঃশর্তে জীবনের হাতে সঁপে দেওয়াতেই স্বতোৎসারিত হতে পেরেছিল সুকান্তর কবিতা।

আজ যাঁরা সুকান্তর কবি প্রতিভাকে এই বলে উড়িয়ে দিতে চান যে, সুকান্তর কবিতায় শ্লোগান ছিল—তাঁদের বলতে চাই, সুকান্তর কবিতায় শ্লোগান নিশ্চয়ই ছিল। কবিতার জাত যাবার ভয়ে শ্লোগানগুলোকে রেখে ঢেকেও সে ব্যবহার করে নি। হাজার হাজার কণ্ঠে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত যে ভাষা হাজার হাজার মানুষের নানা আবেগের তরঙ্গ তুলেছে, তাকে কবিতায় সাদরে গ্রহণ করতে পেরেছিল বলেই সুকান্ত সার্থক কবি। কবিতায় রাজনীতি থাকলেই যাদের কাছে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়, তারা ভুলে যান—অরাজনৈতিক কবিতায়ও জিগির কিছু কম নেই। আসলে অপত্তিটা বোধহয় শ্লোগানে নয়, শ্লোগান বিশেষে-রাজনীতিতে নয়, রাজনীতি বিশেষে। তাঁদের কাছে অনুরোধ, কবিতার দোহাই না তুলে মনের কথাটা খুলে বলুন।

কবিতায় সুকান্তই যে শেষ কথা, তার পথই যে একমাত্র পথ—মতিভ্রম হলে কেউ সে কথা বলবে না। সাহিত্যে অনুকাবকের স্থান নেই, এ তো সবাই জানে। সুকান্তর কবিতা সুকান্তকে ছাড়া আর কাউকেই মানাবে না। সুকান্তর পরবর্তী যে কবি সুকান্ত থেকে তফাত করবে, নিজেকে ছাড়িয়ে নেবে—সে আমাদের প্রশংসা পাবে। কেননা আত্মমর্যাদা না থাকলে অন্যকে মর্যাদা দেওয়া যায় না। সুকান্তকে ছাড়িয়ে যাওয়াই হবে সুকান্তকে সম্মান জানানো।

আমার এ ভূমিকা, বিশেষ করে, সুকান্তর আজকের পাঠকদের জন্যে। আমি সমালোচক নই। বাংলা সাহিত্যে সুকান্তর কী দান, কোথায় তার স্থান—সে সব স্থির করবার জন্যে যোগ্য ব্যক্তিরা আছেন। সুকান্ত-সমগ্র পাঠকদের হাতে ধরিয়ে দিয়েই আমি খালাস।

যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, শেষ করবার আগে সেই কথাতেই আবার ফিরে আসতে চাই। মনে রাখবেন, সুকান্তর বয়স আজ একচল্লিশ নয়। আজও একুশ।

সুকান্তর জন্ম বাংলা ১৩৩৩ সালের ৩০শে শ্রাবণ। সুকান্তর বাবা স্বর্গত নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য। কলকাতায় কালীঘাটে মাতামহের ৪২, মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়িতে সুকান্তর জন্ম। সুকান্তর জীবনের অনেক কথাই সুকান্তর ছোট ভাই অশোক ভট্টাচার্যের লেখা কবি-সুকান্ত পড়ে জেনে নিতে পারবেন। আমি শুধু তার একুশ বছরের জীবনের কয়েকটা দিক মোটা দাগে তুলে ধরতে চাই।

সুকান্তদের পৈতৃক ভিটে ছিল ফরিদপুর জেলায়। সুকান্তর জ্যাঠামশাই ছিলেন সংস্কৃতে পণ্ডিত। বাড়িতে ছিল সংস্কৃত পঠনপাঠনেব আবহাওয়া। পরে এই প্রাচীন পন্থার পাশাপাশি উঠতি বয়সীদের আধুনিক চিন্তা-ভাবনার একটা পরিমণ্ডলও গড়ে ওঠে। সুকান্ত ছেলেবেলায় মা-র মুখে শুনেছে কাশীদাসী মহাভারত আর কৃত্তিবাসী রামায়ণ। সুকান্তর বাবা আর জ্যাঠামশাই অসহায় অবস্থা থেকে নিজেদের পুরুষকারের জোরে বিদেশ বিভুঁইতে এসে বড় হয়েছিলেন। বইয়ের প্রকাশ ব্যবসা ছাড়াও সুকান্তর বাবা আর জ্যাঠামশাইয়ের ছিল যজমানি আর পণ্ডিত বিদায়ের আয়। বেলেঘাটায় নিজেদের বাড়ি ছেড়ে পৃথক হওয়ার আগে পর্যন্ত যৌথ পরিবার স্বচ্ছলভাবেই চলত। সুকান্তর মাতামহ পণ্ডিত বংশের মানুষ হয়েও প্রাচীন সংস্কার থেকে মুক্ত ছিলেন। এরই ভেতর দিয়ে বহু আত্মীয়স্বজনের ভিড়ে হেসে খেলে কেটেছিল সুকান্তর শৈশব। ন-দশ বছর বয়স থেকেই সে ছড়া লিখে বাড়িতে কবি হিসেবে নাম কিনেছিল। লেখার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলত নানারকমের বই পড়া। সুকান্ত ছোট থাকতেই ক্যান্সার রোগে সুকান্তর মা মারা গেলেন। ছেলেবেলা থেকেই সুকান্তর ছিল অন্তর্মুখী মন। ইস্কুলে সুকান্ত বন্ধু হিসেবে পেয়েছিল পরবর্তীকালের যশস্বী কবি অরুণাচল বসুকে। অরুণাচলের মা সরলা বসুর (‘জলবনের কাব্য’র লেখিকা) প্রভাব সুকান্তর জীবনে কম নয়। খেলার মধ্যে তার প্রিয় ছিল ব্যাডমিণ্টন আর দাবা। পরোপকারে ছেলেবেলা থেকেই দল বাঁধায় তার ছিল প্রবল উৎসাহ। শহরে মানুষ হ’লেও সুকান্ত ছিল গাছপালা মাঠ আকাশের ভক্ত।

পরের জীবন মোটামুটি তার কবিতায়ই পাওয়া যাবে। সুকান্তর কবিতা কখনই তার জীবন থেকে আলাদা নয়।

তবু সুকান্তর একটা নতুন দিক ‘সুকান্ত-সমগ্র’তে তার চিঠিপত্রে পাঠকদের কাছে এই প্রথম ধরা পড়বে। যখন তারা পড়বেন:

‘বাস্তবিক, আমি কোথাও চলে যেতে চাই, নিরুদ্দেশ হয়ে মিলিয়ে যেতে চাই…কোনো গহন অরণ্যে কিংবা অন্য যে কোনো নিভৃততম প্রদেশে, যেখানে মানুষ নেই, আছে কেবল সূর্যের আলোর মতো স্পষ্টমনা হিংস্র আর নিরীহ জীবের আর অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ।…

কিংবা।

‘সেখানে আমি ঘন ঘন যেতে লাগলুম।•••ওর আকর্ষণে অবিশ্যি নয়। বাস্তবিক আমাদের সম্পর্ক তখনও অন্য ধরনের ছিল, সম্পূর্ণ অকলঙ্ক, ভাইবোনের মতোই। (পত্রগুচ্ছ)

কিংবা যে চিঠিতে পার্টি সম্পর্কেও সুকান্ত অভিমান প্রকাশ করেছে।

এ কি আমাদের সেই একই সুকান্ত? ‘ছাড়পত্র’ আর ‘ঘুম নেই’-এর?

হ্যাঁ, একই সুকান্ত। কখনও বিষন্ন, কখনও আশায় উন্মুখ। কখনও আঘাতে কাতর, কখনও সাহসে দুর্জয়। কখনও চায় জনতা, কখনও নির্জনতা। কোথাও ভালবাসার কথা মুখ ফুটে বলতেই পারে না, কোথাও ঘৃণায় হুংকার দিয়ে ওঠে।

সুকান্ত কাগজের মানুষ নয়, রক্তমাংসের মানুষ। তার আত্মবিশ্বাস কখনও কখনও অহমিকাকে স্পর্শ করে, তার যুক্তি কখনও কখনও আবেগে ভেঙে পড়ে।

সুকান্ত বড় কবি হলেও বয়স তার একুশ পেরোয় নি। তার বেশীর ভাগ লেখাই আরও কম বয়সের।

‘সুকান্ত-সমগ্র’ সুকান্তর মহৎ সম্ভাবনাকে মনে কবিয়ে দিয়ে বাংলা সাহিত্যে তার অভাববোধকে নিরন্তর জাগিয়ে রাখবে।

আমি মাঝে মাঝে ভাবি, বেঁচে থাকলে এতদিনে সুকান্তর এত বছর বয়স হত। কী লিখত সে? কেমন দেখতে হত?

তখন আমার চোখে তার ছবিটাই বদলে যায়।

৩১ শে শ্রাবণ, ১৩৭৪

সুভাষ মুখোপাধ্যায়