সুকান্তের কবিতা আজও সমান আদরনীয়। এর প্রধান কারণ, কবিতার বিষয়বস্তু, শব্দচয়নে ও ধ্বনিসৌকর্যে তাঁর অসামান্য দক্ষতা, ছন্দ ও মিলের উপরে তাঁর অসামান্য দখল এবং ঘৃণা ও ক্রোধে সংযত অভিব্যক্তি। এই কাব্যিক গুণাবলী তাঁর কবিতাকে অমর করে রেখেছে। শুধু কবিতা নয়, সুকান্তের সমস্ত রচনার পটভূমি এক নির্মম রাক্ষসীবেলা – যুদ্ধের বিভৎসা, মন্বন্তরের ভয়ালতা, সাইরেন, ব্ল্যাক-আউট, বোমা পড়ার আতঙ্ক, কন্ট্রোল দরে খাদ্য-বস্ত্রের লাইন, আর এর প্রতিস্পর্ধী এক আন্দোলন, এক মতাদর্শ : সাম্যবাদ। ফলে তাঁর কাব্য তথা সমগ্র সাহিত্যচর্চা ‘ডিক্লাসমেন্টে’র বার্তাবহ। এটাই তাঁকে করে তুলেছে রবীন্দ্রনাথ-উত্তরকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য স্রষ্টা। তাঁর সমস্ত কবিতা, গীতিগুচ্ছ, পত্রগুচ্ছ, মায় তাঁর ক্ষুদ্র সাহিত্য জীবনের প্রায় সমস্ত লেখা নিয়েই এই ‘সমগ্র’। পাশাপাশি, এই বইটিতে আছে সুকান্ত-পাঠের এক নাতিদীর্ঘ গাইডলাইন; লেখাটি বইটির মুখবন্ধের পরিবর্তে রচিত, যা এই বইয়ের একটি সম্পদ।
অকালমৃত্যু ছিনিয়ে নিলেও আধুনিক বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন পেতে দেরী হয়নি কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের। তরুণ বয়সের ভাবাবেগ-নির্ভর তরল জীবনবীক্ষা তাঁর রচনার প্রধান সম্বল হলেও বাংলা সাহিত্যের বিশেষ সময়ে তাঁর রচনার প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য।
তাঁর জন্ম ১৯২৬ সালের ১৫ই আগষ্ট (৩০শে শ্রাবণ ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ) কলকাতার কালীঘাটে, ৪২নং মহিম হালদার স্ট্রীটের মামার বাড়িতে। তাঁর বাবা নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য, মা সুনীতি দেবী। প্রাথমিক শিক্ষা, ‘কামলাবিদ্যামন্দির’ নামে একটি স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলে। এই স্কুলেরই ক্লাস ফোরের ছাত্ররা ‘সঞ্চয়’ নামের একটা হাতে লেখা পত্রিকা সেইসময় বের করতো। শোনা যায় ‘সঞ্চয়’ নামকরণটাও নাকি সুকান্তরই করা। তিনি একটা মজার গল্প লিখেছিলেন এই পত্রিকায়। তাঁর ঘনিষ্ঠদের দাবী লেখক হিসেবে তাঁর হাতেখড়ি ঐ পত্রিকাতেই হয়েছিল।
১৯৩৮ সালে তাঁর মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তখন তাঁর বয়স মাত্র বারো বছর। সেইসময় তিনি দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন। যখন তিনি সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, সেই সময় সপ্তম শ্রেণি থেকে ‘সপ্তমিকা’ নামে একটি হাতে লেখা পত্রিকা বের করা হয়। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন সুকান্ত স্বয়ং আর সহ-সম্পাদক ছিলেন তাঁরই সহপাঠী বন্ধু অরুণাচল বসু। ১৯৪৪ সালে সুকান্ত ভট্টাচার্য ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। কমিউনিস্ট পার্টি ‘স্বাধীনতা’ নামে একটি বাংলা দৈনিক বের করতে থাকে ১৯৪৫ সালের ২৫শে ডিসেম্বর থেকে। ঐ পত্রিকাতে ‘কিশোর সভা’ নামে ছোটোদের বিভাগ ছিল। এই ‘কিশোর সভা’র সম্পাদক প্রথমে ছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, পরে তার পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সুকান্তকে।
অর্থাভাব, পার্টির কাজ ও নিজের শরীরের প্রতি অবহেলা – সব মিলিয়ে সুকান্তের স্বাস্থ্য ভেঙে গেল। ১৯৪৬ সালের মাঝামাঝি সুকান্ত জ্বরে পড়লেন। বাড়িতেই তাঁর চিকিৎসা চলল, কিন্তু জ্বর সারলো না। তিনি ধীরে ধীরে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। যদিও ঐ বিধ্বস্ত স্বাস্থ্য নিয়েও সাহিত্যচর্চা বন্ধ করেন নি তিনি। ধরা পড়লো ইন্টেস্টিনাল টি বি (পেটের যক্ষা)। মৃত্যুর সাথে চলছিল তাঁর চরম লড়াই শেষ হল ১৯৪৭ সালের ১৩ই মে (২৯শে বৈশাখ ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ)। ঐ সকাল ১০টার সময় তিনি মারা গেলেন। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে শেষ হয়ে গেল এক মহীরূহের সম্ভাবনা। তবু যতটুকু রেখে গেলেন, তা বাংলা সাহিত্যের করুণ অধ্যায়ে লেখা হয়ে রইল।