আজ এক বৎসর হইল, এসিয়ার পূর্ব্ব প্রান্তে যে ভীষণ সমরানল প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিয়াছে, তাহার বিস্তৃত বৃত্তান্ত পাঠক মাত্রেই অবগত আছেন। এই লোকভয়ঙ্কর মহাযুদ্ধ কতদিনে সমাপ্ত হইবে, সৌভাগ্যলক্ষ্মী কাহার প্রতি কিরূপে প্রসন্ন হইবেন, তাহা এক্ষণে নিশ্চয়রূপে প্রকাশ করিতে পারা যায় না। আমেরিকা ও ইয়ুরােপীয় শক্তিপুঞ্জ প্রাচ্য রণরঙ্গভূমে তাণ্ডবনৃত্যে প্রবৃত্ত হইবেন কিনা, তাহাও অধুনা ভবিষ্যৎ গর্ভে নিহিত।

ইহা সত্য যে, কি জলে, কি স্থলে, এ পর্যন্ত যতগুলি ক্ষুদ্র বা বৃহৎ যুদ্ধ সংঘটিত হইয়াছে, তাহার প্রত্যেকটিতে জয়লক্ষ্মী জাপানের প্রতি অনুকম্পা প্রকাশ করিয়াছেন। জাপান সৈনিকের অদ্ভুত কর্ম্মকুশলতা, অসাধারণ কষ্টসহিষ্ণুতা, অপূর্ব্ব স্বদেশহিতৈষীতা দর্শন করিয়া ইউরােপ স্তম্ভিত ও আমেরিকা বিস্মিত হইয়াছে। জাপানী সেনাপতিগণের সৈন্যসঞ্চালন, বৃহৎ কামান পরিচালন ও টর্পেডো ক্ষেপণ প্রভৃতি অবলােকন করিয়া পৃথিবীর সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সেনাপতিরাও বিস্মিত ও মােহিত হইয়াছেন।

লেখক শ্রীউমাকান্ত হাজারী

সকলই সত্য; কিন্তু তথাপিও আশঙ্কা হয়। যে রুষ পৃথিবীর মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা বৃহৎ শক্তি বলিয়া পরিগণিত, ব্রিটিশকেশরী যাহার জন্য ভারতসীমান্তে ব্যতিব্যস্ত, ফরাসিশার্দ্দূল যাহার সহিত মিত্রতা করিয়া গৌরবান্বিত, জর্ম্মণঅহি বর্ত্তমান মুহূর্ত্তে যাহাকে বন্ধু বলিয়া আলিঙ্গন করিতে উদ্যত, মার্কিণনক্র দূরে অবস্থান করিয়াও যাহার নামে কম্পিত, মুসলমান জগতের একছত্রী সম্রাট তুরষ্ক সােলতান যাহার পদানত, সেই মহাকায় ভীম-পরাক্রমশালী রুষঋক্ষের সহিত ক্ষুদ্র দ্বীপবাসী জাপান তরক্ষুর যুদ্ধ! আশঙ্কার কারণ নাই কি?

আমরা জাপানকে প্রাণের অধিক ভালবাসি। জাপানবাসী নরনারিগণকে অতি নিকট আত্মীয় বলিয়া মনে করি। যাঁহারা বলেন, জাপান একদিন নিজ বাহুবলে ইংলণ্ডকে পর্য্যুদস্ত করিয়া সমগ্র ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা প্রদান করিবে, জাপানের কৃপায় বােম্বাই নগরী একদিন বােষ্টন বন্দরে পরিণত হইবে, তাঁহারা হয় ভ্রান্ত, না হয় উন্মাদগ্রস্ত। বাতুলালয়ই তাঁহাদের উপযুক্ত বাসস্থান। জাপানের প্রতি আমাদের ভালবাসা ও সহানুভূতির কারণ অন্যবিধ। জাপান এসিয়াবাসী বলিয়া আমাদের ধর্ম্মভ্রাতা, জাপানবাসীরা ভগবান বুদ্ধদেবের উপাসক বিধায় আমাদের ধর্ম্ম শিষ্য। আমাদের সর্ব্বপ্রধান তীর্থ গয়াধাম, জাপানিগণের অতি প্রিয় ও পরম তীর্থ। জাপানে বিধিমতে সংস্কৃত চর্চ্চা হইয়া থাকে, এক্ষণে বহুতর জাপানী যুবক ভারতে আসিয়া সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করিতেছেন। ইউরােপ বা আমেরিকায় আমাদের স্থান নাই, তথায় আমরা বিতাড়িত, ঘৃণিত ও অপমানিত। অষ্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকায় ভারতবাসী মাত্রেই কুলি বলিয়া অভিহিত। পক্ষান্তরে জাপানের প্রতি গৃহদ্বার আমাদের জন্য উন্মুক্ত, তথায় আমরা ভারতবাসী বলিয়া পূর্ব্বগৌরবে সম্মানিত। মিঃ ওয়াগেল ইংলণ্ডে কাচনির্ম্মাণ কৌশল শিক্ষা করিতে গিয়া যে বিপদে পড়িয়াছিলেন, তাহা আমরা ভুলি নাই; আর আজি ভারতবাসী দলে দলে জাপানে গমন করিয়া নিরুপদ্রপে নানাবিধ শিল্পকলা শিক্ষা করিয়া আসিতেছেন, তাহাও স্বচক্ষে দেখিতেছি। ইহাতেও যদি আমরা জাপানকে ভাল না বাসি, জাপানিগণের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ পােষণ না করি, জাপানবাসীর মঙ্গলের জন্য সর্ব্বমঙ্গলার চরণে প্রার্থনা না করি, তাহা হইলে আমাদের মত কৃতঘ্ন ও নরাধম ধরাতলে আর কোথায় পাওয়া যাইবে?

জাপানবাসিগণের নিকটে আমরা প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে যে সমস্ত উপকার পাইতেছি, একবার তাহারও আলােচনা ও চিন্তা করা কর্ত্তব্য। ইহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, একটী আমাদের মত ক্ষুদ্রকায় অন্নমৎস্যভুক আসিয়িক জাতি গত ৩০ বৎসরের চেষ্টায় যে অনন্যসাধারণ উন্নতিলাভ করিয়াছে, তাহা দিনান্তে চিন্তা করিয়াও আমাদের আশা ও আকাঙ্ক্ষা একটু ঊর্দ্ধে উঠিয়াছে। আমার নিত্যউপবাস-রুগ্ন প্রতিবাসীর পর্ণকুটীর সহসা প্রাসাদে পরিণত ও অতিথি অভ্যাগতের আনন্দ কোলাহলে মুখরিত হইয়া উঠিলে, আমরা যেরূপ যত্ন ও পরিশ্রম সহকারে তাহার কারণ নির্দ্দেশে চেষ্টা করিয়া থাকি, আজ শিক্ষিত ভারতবাসী মাত্রেই সেইরূপ আগ্রহ সহকারে জাপানের অসাধারণ অভ্যুদয়ের কারণ নির্দ্দেশে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। তাহারই ফলে “স্বদেশী সমাজ” প্রভৃতি বিবিধ সাময়িক প্রবন্ধের উদ্ভব হইয়াছে, বিভিন্নমতাবলম্বিগণের মধ্যে সৌভ্রাত্রভাব ও একতার পথ উন্মুক্ত হইয়াছে। আজ ভারতবর্ষের নগরে নগরে, গ্রামে গ্রামে, পল্লীতে পল্লীতে সাধারণ শিক্ষার উপযােগিতা ও বিজ্ঞান শিক্ষার আবশ্যকতা বজ্রনির্ঘোষে ঘােষিত হইতেছে। রাজানুগ্রহের উপর নির্ভর না করিয়া, রাজনৈতিক আন্দোলনে সমস্ত শক্তি অপব্যয় না করিয়া, যাহাতে সমাজের চেষ্টায় দেশের অন্নকষ্ট বিদূরিত হয়, শ্রম ও অধ্যবসায়ের ফল সহজে হস্তগত হয়, স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়, নৈতিক ও দৈহিক বল পরিবর্দ্ধিত হয়, আজ সর্ব্বত্রই তাহার জন্য চেষ্টা হইতেছে। ইহা উন্নতির চিহ্ন, মঙ্গলের লক্ষণ।[১]

কিন্তু হায়! আমাদের অদৃষ্ট ও এসিয়ার বর্তমানাবস্থা স্মরণ করিলে মনে বড় আশঙ্কা হয়। মনে হয়, বুঝি প্রাচ্য গগনের প্রভাত-মার্ত্তণ্ড মধ্যাহ্নের পূর্ব্বেই অস্তমিত হইবে, অষ্টমীর অর্দ্ধ-শশধর অকালেই করাল রাহুর কবলগ্রস্ত হইবে। এসিয়ার, ভারতের, বৌদ্ধধর্ম্মের, আশাভরসা প্রশান্ত মহাসাগরের অতল জলে নিমর্জ্জিত হইবে।

জননী! ইহাই কি সত্য? যে জাপান আত্ম অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, ন্যায্য স্বত্ব রক্ষার জন্য ধর্ম্মযুদ্ধে অগ্রসর হইয়াছে, তাহাকে কি রক্ষা করিবে না?

যেন কোন দেবতা আবির্ভূত হইয়া এই প্রশ্নের উত্তরে আমাদিগকে বলিতেছেন;—“ভয় নাই। পঞ্চকোটী নরনারী যখন একতা-বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া আত্মত্যাগ-ব্রত অবলম্বন করিয়াছে, তখন আর কিসের ভয়? যখন প্রত্যেক জাপানীর হৃদয় স্বদেশানুরাগে পরিপূর্ণ রহিয়াছে, তখন আর কাহাকে ভয়? যাহাদের ধর্ম্মকর্ম্ম, যাগযজ্ঞ, কামমােক্ষ, সমস্তই সম্রাট ও স্বদেশানুরাগের অন্তর্ভূত, পৃথিবীতে তাহাদের পরাজয় নাই। যে জাতির বালক হইতে বৃদ্ধ পর্য্যন্ত, পর্ণকুটীরবাসী কৃষক হইতে প্রাসাদবাসী সম্রাট পর্য্যন্ত, বালিকা হইতে বৃদ্ধা পর্য্যন্ত সকলেই একস্বরে “স্বদেশ” “স্বদেশ” বলিয়া চীৎকার করিতেছে, সে জাতির জন্য আশঙ্কা নাই।”

আমরা বঙ্গদেশবাসী ভীরুঅপবাদগ্রস্থ বাঙ্গালী; একতা, আত্মত্যাগ, স্বদেশানুরাগ প্রভৃতি শব্দের প্রকৃত অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারি না। আমাদের প্রধান ভরসা ইংলণ্ড ও আমেরিকা। পঞ্চবার্ষিক সন্ধি অনুসারে ইংলণ্ড কিছুতেই রুষকে ম্যানচুরিয়া গ্রাস করিতে দিবেন না। আমেরিকা কোন ক্রমেই প্রশান্ত মহাসাগরে রুষাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হইতে দিবেন না। পৃথিবীর এই দুই মহাশক্তির স্বার্থের সহিত জাপানের স্বার্থ অভিন্ন, ইহাই আমাদের প্রধান ভরসা। কিন্তু যদি রাজনৈতিক কারণে ব্রিটিশ মন্ত্রীরা জাপানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন পূর্ব্বক গম্ভীর হইয়া বসেন, মার্কিণ বন্ধুরা বেদান্তের উপদেশ প্রদান করিতে করিতে প্রশান্ত মহাসাগরে পাড়ি মারিবার সংকল্প করেন, তাহা হইলে জাপান কি করিবে?

পূর্ব্বে বলিয়াছি, আমরা জাপানকে ভালবাসি, জাপানের নরনারিগণকে অতি নিকট আত্মীয় বলিয়া মনে করি। বলা বাহুল্য, এই জন্য বহু অর্থ ব্যয় ও শ্রমস্বীকার পূর্ব্বক এই ক্ষুদ্র ইতিবৃত্ত সঙ্কলন করিয়াছি। ইহাতে জাপানের ভৌগােলিক ও ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত, জাপানিগণের রীতিনীতি, আচার ব্যবহার, ধর্মবিশ্বাস, শিক্ষাপ্রণালী, শাসনপদ্ধতি প্রভৃতি বিবিধ বিষয় সংক্ষেপে বিবৃত হইয়াছে। বঙ্গের অমর কবি তাঁহার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ গীতিকবিতায় যাহাকে “অসভ্য জাপান” বলিয়া উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন, সেই জাপান কি কৌশলে পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ, পরাক্রমশালী ও সুসভ্য রাজ্য বলিয়া পরিগণিত হইল, তাহাও এই পুস্তকে লিখিত হইয়াছে।

এই পুস্তকের পরিশেষে রুষ-জাপান যুদ্ধের কারণ ও বর্তমান সময় পর্যন্ত যতগুলি উল্লেখযােগ্য যুদ্ধ সংঘটিত হইয়াছে, তাহারও বিবরণ সংক্ষেপে বিবৃত হইয়াছে।

সামটা,

শ্রীউমাকান্ত হাজারী।

৮ই ফ্রেব্রুয়ারী, ১৯০৫।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. মৎপ্রণীত “বঙ্গ জাগরণ ও স্বদেশের নানাকথা” দ্রষ্টব্য।