» » ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত: মধ্যযুগ।

বর্ণাকার

বৌদ্ধধর্ম্ম কোন সময়ে জাপানে প্রবেশ লাভ করিয়াছিল, কোন সময়ে জাপানিগণের রীতিনীতি, আচারব্যবহার বৌদ্ধ ভাবাপন্ন হইয়াছিল তাহা নিশ্চয়রূপে বলিতে পারা যায় না। খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দের পূর্ব্বে যে জাপানে বৌদ্ধসভ্যতা প্রচলিত ছিল, তাহার কোন নিদর্শন প্রাপ্ত হওয়া যায় না।

ইয়ুরােপীয় পণ্ডিতগণের অনুমান, চীনের বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই সর্ব্বপ্রথমে জাপানে গমন করিয়া, তথায় বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচারের পথ উন্মুক্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু এক্ষণে নানাস্থান হইতে যেরূপ প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে, তাহাতে স্পষ্টই প্রতীত হয় যে, জাপানে বৌদ্ধধর্ম্ম প্রবেশের বহুপূর্ব্বে তথায় প্রাচীন আর্য্যসভ্যতা ও ভারতীয় তান্ত্রিক ধর্ম্মের বিস্তার হইয়াছিল।

জাপানের প্রাচীন ইতিহাস পাঠে অবগত হওয়া যায় যে, খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দে যে সমস্ত ব্যক্তি জাপানে ভারতবাসী বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ তন্ত্রশাস্ত্রে সুনিপুণ ও কেহ কেহ ঐন্দ্রজালিক বিদ্যায় সুপণ্ডিত ছিলেন। কাই (Kii) প্রদেশীয় একটী উষ্ণ প্রস্রবণের নিকটে কয়েকজন হিন্দু সন্ন্যাসী বাস করিতেন। এইরূপ শুনা যায়, ইঁহাদিগের মধ্যে একজন নগ্ন ছিলেন এবং ইঁহার দৃষ্টি সর্ব্বদাই দক্ষিণদিকে থাকিত।

জাপানের ইতিহাসে বােধিসেন ভারদ্বাজ নামক একজন ভরদ্বাজ বংশীয় ব্রাহ্মণের উল্লেখ আছে। ইনি ভারতবর্ষ হইতে সমুদ্রপথে কোচীন-চীনে আগমন করেন, তথায় কিছুকাল অতিবাহিত করিয়া “ফোচে” নামক চীন দেশীয় পণ্ডিতের সহিত জাপানের “ওসাকা” নগরে উপস্থিত হন। বােধিসেন প্রায় চতুর্বিংশতি বর্ষকাল জাপানে অতিবাহিত করেন। ইঁহার মৃত্যুর পর, স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ, তাঁহার সমাধিস্থানে একখণ্ড প্রস্তর প্রােথিত হয়। অদ্যাপিও জাপানের সুবিখ্যাত নারা প্রদেশে বােধিসেন ভারদ্বাজের প্রতিষ্ঠিত মঠ ও স্মৃতি প্রস্তরফলক বর্ত্তমান আছে। “মান্‌জো-শিউ” নামক জাপানের প্রচীন পদ্য সংগ্রহ পুস্তকে “ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মণ ও বায়সের উপাখ্যান” নামক একটী ক্ষুদ্র কবিতা লিখিত আছে।

চীন ত্রিপিটকান্তর্গত গ্রন্থাবলী পাঠে অবগত হওয়া যায় যে, চীন দেশীয় ধর্ম্মপ্রচারকগণ সপ্তম শতাব্দ হইতে দশম শতাব্দ পর্য্যন্ত জাপানবাসিগণের নিকট বৌদ্ধধর্ম্ম ও বৌদ্ধনীতির মহিমা কীর্ত্তন করিয়াছিলেন।

সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে সাম্রাজ্ঞী সু-ইকো জাপানের সিংহাসনে অধিষ্ঠিতা ছিলেন। তিনিই এ দেশের প্রথম স্ত্রী-শাসনকর্ত্রী। বৌদ্ধধর্ম্মে তাঁহার অচলাভক্তি ও দৃঢ় বিশ্বাস থাকায় এই সময় হইতে জাপানে বৌদ্ধধর্ম্ম বদ্ধমূল হয়। এই শতাব্দীতে সপ্তজন সম্রাট ও পঞ্চজন সাম্রাজ্ঞী জাপানে রাজত্ব করেন। ভারতের বৌদ্ধধর্ম্ম ইতিহাসে প্রিয়দর্শী অশোকের ন্যায়, সাম্রাজ্ঞী কৈমিও ও সাম্রাজ্ঞী কো-কেন জাপানে সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন। কৈমিও রাজ্যের নানাস্থানে বৌদ্ধ মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া, প্রত্যেক মন্দিরে ভগবান শাক্যমুণির মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁহার সময়ে রাজ্যের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে পান্থ-নিবাস, অনাথ-আশ্রম ও চিকিৎসালয় স্থাপিত হয়। এই সকল কার্য্যের জন্য তিনি ব্যয় স্বীকারে অণুমাত্র কুণ্ঠানুভব করিতেন না।

নবম শতাব্দীর মধ্য হইতে একাদশ শতাব্দী পর্য্যন্ত জাপানের সর্বত্র ফুজিয়ারা বংশের বিশেষ প্রতিপত্তি হয়। জাপানী ঐতিহাসিকেরা এই সময়কে “ফুজিয়ারা সময়” বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। এই সময়ে ফুজিয়ারা বংশীয় কতিপয় সম্রাট ও সাম্রাজ্ঞীর যত্নে জাপানে বৌদ্ধধর্ম্মের অসাধারণ উন্নতি সাধিত হইয়াছিল।

খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীর পর হইতে মিকাডোর ক্ষমতা হ্রাস হইয়া জাপানে তৈরা ও মাইনামটো নামক দুইটি সম্ভ্রান্ত বংশের ক্ষমতা অত্যধিক বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। ইঁহাদের ভয়ে ভীত হইয়া, সম্রাট ভেদনীতি অবলম্বন পূর্ব্বক উভয় বংশকে বলহীন করিয়া ফেলেন। দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে তৈরা বংশে কায়ামর নামে জনৈক প্রতাপশালী ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বুদ্ধিবলে সম্রাটকে হস্তগত করিয়া, স্ব-বংশীয় প্রধান ব্যক্তিগণের সাহায্যে মাইনামটো বংশীয় নেতৃগণকে সংগ্রামক্ষেত্রে নিহত করেন।

কালক্রমে হতাবশিষ্ট মাইনামটো বংশে যােরিটোমো নামক জনৈক বীরযুবকের উৎপত্তি হয়। কথিত আছে, তাঁহার ন্যায় অসামান্য ধীশক্তিসম্পন্ন রাজনীতিজ্ঞ ব্যক্তি জাপানে জন্মগ্রহণ করেন নাই। তিনি ১১৮০ খৃষ্টাব্দে সম্রাট টাকাকুরার সহিত নিজ সুন্দরী ও সুলক্ষণা কন্যার উদ্বাহক্রিয়া সম্পন্ন করেন। যােরিটোমো ১১৮৪ খৃঃ অব্দে কৌশলে রাজশক্তি গ্রাস পূর্ব্বক জাপানের “দৈজো-দেজিন” অর্থাৎ প্রধান মন্ত্রীপদে সমারূঢ় হইয়া নিজেই সম্রাটের যাবতীয় কার্য্য পরিচালনা করিতে আরম্ভ করেন। কোন কোন জাপানী ঐতিহাসিকের নিকটে যোরিটোমো জাপান সাম্রাজ্যের “টাইকুন” অর্থাৎ সেনাপতি বলিয়া আখ্যাত হইয়াছেন।

এই সময় জাপানে জায়গীর-প্রথার প্রবর্ত্তন হয়। জায়গীরদারগণ আপনাপন অধিকৃত স্থান রক্ষার ব্যয় ভিন্ন নিজেদের বেতন জন্য বৎসরে ১০ হাজার “কোকু” অর্থাৎ ত্রিশ হাজার মণ ধান্য পাইতেন। জায়গীরদারদিগকে জাপানীরা “দাইমিও” বলিত।

১১৮৬ অব্দে জাপানে “সোগান” অর্থাৎ রাজ্যরক্ষক নামক একটী প্রধান পদের সৃষ্টি হয়। মাইনামটো নামক প্রথম সােগানবংশ ১১৮৬ খৃঃ হইতে ১৩৩৬ খৃঃ পর্য্যন্ত রাজ্যশাসন করেন। কাকামুরা নগরে তাঁহাদের বাসভবনের ভগ্নাবশেষ অদ্যাপি দেখিতে পাওয়া যায়। আসিকাগা নামক দ্বিতীয় সোগানবংশ ২৩৭ বর্ষ পর্য্যন্ত কিয়াটো নগরে বাস করিয়া রাজ্যশাসন করেন। এই বংশে হিদো-ইযোসী নামক জনৈক প্রসিদ্ধ ব্যক্তি সােগান উপাধি ধারণ ধরিয়া দুইবারে কোরিয়া রাজ্যের দ্বি-তৃতীয়াংশ অধিকার করেন।

খৃষ্টীয় ত্রয়ােদশ শতাব্দীতে দিগ্বিজয়ী জঙ্গিস খাঁর পুত্র সুপ্রসিদ্ধ কুবলাই খাঁ অসংখ্য মােগল সৈন্য লইয়া পঙ্গপালের ন্যায় জাপান রাজ্য আচ্ছন্ন করেন। প্রায় চত্বারিংশ বর্ষব্যাপী ভীষণ যুদ্ধে তিন লক্ষ মােগল সৈন্যের মধ্যে কয়েকজন মাত্রকে লইয়া কুবলাই স্বদেশে উপস্থিত হন। এই মহাসমরে জাপানবাসিগণ যে অদ্ভুত বীরত্ব ও অপূর্ব্ব স্বদেশানুরাগ প্রদর্শন করিয়াছিল, তাহা বর্ণনা করিতেও হৃদয় কম্পিত ও শরীর লােমাঞ্চিত হইয়া উঠে।

মহাবীর কুব্‌লাই জাতিনির্ব্বিশেষে প্রতিভার পূজা করিতেন। তিনি জাপানবাসী বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বিগণের হস্তে পরাজিত হইয়া, তাঁহার বিশাল রাজ্যে বৌদ্ধধর্ম্ম বিস্তারের জন্য চীন ও জাপানবাসী লামাগণকে আহ্বান করেন। বহু তর্কবিতর্ক ও আলােচনার পরে অবশেষে বৌদ্ধধর্ম্ম তাঁহার মনঃপুত হয়।

১৬০৩ খৃষ্টাব্দে টোকাগুয়া বংশের জনৈক প্রসিদ্ধ ব্যক্তি সােগান উপাধি ধারণ করিয়া জাপানের রাজসিংহাসন অধিকার করিতে মনস্থ করেন। দীর্ঘকালব্যাপী ভীষণ গৃহযুদ্ধের পরে মিকাডােবংশ কিয়াটো নগরে (মিয়াকো) ও সোগানবংশ জেডো সহরে (টোকিও) আপনাপন আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই দারুণ অন্তর্বিপ্লবের বিষময়ফলে জাপানের কি রাজনৈতিক, কি সামাজিক সমস্ত উন্নতিই বহুদিনের জন্য স্থগিত হইয়া যায়।

এই সময়ের অবস্থা বর্ণনাবসরে ইয়ুরােপীয় ও আমেরিকার ইতিহাস লেখকেরা লিখিয়াছেন;—জাপানে দুইটি নরপতি রাজত্ব করিয়া থাকেন। জেডাের রাজা রাজ্য শাসন করেন এবং কিয়াটোর রাজা বৌদ্ধধর্ম্ম রক্ষা করেন। সুপ্রসিদ্ধ জাপানী ঐতিহাসিক মিঃ ওকাকুরা “Awakening of Japan” নামক গ্রন্থে এই সময়ের জাপানের অবস্থার সহিত বর্ত্তমান ভারতবর্ষ ও চীন সাম্রাজ্যের তুলনা করিয়াছেন।

জাপানবাসিরা বৈদেশিক জাতিগণকে বিশেষতঃ ইয়ুরোপীয় খৃষ্টান সম্প্রদায়দিগকে, বহু কাল হইতে বিদ্বেষ ও অবিশ্বাসের চক্ষে দর্শন করিয়া আসিতেছে। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ইংরাজ, ফরাসী, ওলন্দাজ, পাের্টুগিস্, দিনেমার প্রভৃতি ইয়ুরােপীয় জাতিগণ বাণিজ্য ব্যপদেশে এসিয়ায় আগমন করিয়া, যেরূপ সামান্য সূত্র অবলম্বন পূর্ব্বক এই বিশাল মহাদেশ গ্রাস করিতে আরম্ভ করেন, তাহাতে জাপানীরা যে ইয়ুরােপীয়দিগকে আপনাদের ঘাের শত্রু বলিয়া মনে করিবে, তাহাতে আর আশ্চর্য্য হইবার কারণ কি? জনৈক প্রথিতনামা জাপানী ঐতিহাসিক লিখিয়াছেন,——যে দিন ইংরাজেরা বাণিজ্য উপলক্ষ করিয়া অন্যায়ভাবে রত্নগর্ভা বিশাল ভারতবর্ষ আত্মসাৎ করিল, সেইদিন হইতেই জাপানীরা ইয়ুরোপবাসিগণের চরিত্র অবগত হইয়াছে। ক্রমেই যখন খৃষ্টানেরা প্রাচ্যদেশবাসীদিগকে ভ্রষ্ট ও ধর্ম্মত্যাগী বলিয়া ঘোষণা করিতে আরম্ভ করিল, তখন হইতেই জাপানীরা ইয়ুরােপবাসীর প্রতি দারুণ বিদ্বেষভাব পােষণ করিয়া আসিতেছে।

আমরা ইতিপূর্ব্বে যে গৃহযুদ্ধের কথা উল্লেখ করিয়াছি, তাহার বিষময়ফলে ক্রমেই জাপানের অবস্থা শােচনীয় হইতে আরম্ভ হইল। এই সময়ে—১৮৫৩ খৃষ্টাব্দে—কমােডাের পেরি নামক জনৈক মার্কিণ নৌ সেনাধ্যক্ষ ৪ খানি রণতরি লইয়া জাপানে আগমন করেন। জাপান রাজ্য ও মার্কিণ সাধারণতন্ত্রের মধ্যে একটী বাণিজ্য-সন্ধি স্থাপন করাই তাঁহার অভিলাষ ছিল। এই সময়ে টোকাগুয়াবংশীয় দ্বাদশ সােগান জাপানে রাজত্ব করিতেছিলেন। তিনি পেরির প্রস্তাবে কর্ণপাত না করায়, পেরি কূপিত হইয়া পােতস্থিত কামানের সাহায্যে টোকিও উপসাগরের উপকূলবর্ত্তী নগর সমূহের উপর গােলাবৃষ্টি করিতে আরম্ভ করেন। বিপদ দেখিয়া জাপানবাসী বৌদ্ধগণ যুদ্ধদেবতা কার্ত্তিকেয়ের ও সিণ্টোগণ অনশন ব্রতাবলম্বন করিয়া সমুদ্র ও ঝটিকার উপাসনা করিতে লাগিল। গত পূর্ব্ববর্ষে যে জাতির জলযুদ্ধ কৌশল দেখিয়া পৃথিবীর বীরমণ্ডলী ধন্য ধন্য করিয়াছিল, কিঞ্চিদধিক অর্দ্ধ শতবর্ষ পূর্ব্বে সেই জাতির পূর্ব্বপুরুষগণ নৌকা ও কাষ্ঠ উড়ুপে আরােহণ করিয়া পেরির সম্মুখীন হইল। এই অসম সমরের পরিণামফল বুঝিতে পারিয়া, সম্রাট ও সােগান উভয়েই পেরির প্রস্তাবিত সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করিতে বাধ্য হন।

ইহার কতিপয় বর্ষ পরে, ইংরাজ, ফরাসী প্রভৃতি ইয়ুরােপীয় জাতিগণ আমেরিকাবাসীর ন্যায় জাপানের সহিত বাণিজ্য-সন্ধি সংস্থাপন করেন। কিন্তু খৃষ্টশিষ্যগণের অদম্য জঠরানল সহজে পরিতৃপ্ত না হওয়ায়, ১৮৬৩ খৃঃ ১১ই আগষ্ট তারিখে কোগিশামা নামক স্থানে তাহাদের সহিত জাপানিগণের একটী ক্ষুদ্র যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বলা বাহুল্য এই যুদ্ধেও জাপানীরা সম্পূর্ণ পরাস্থ হয়।

উপরিউক্ত ঘটনানিচয় হইতেই নিপনের নবযুগ আরম্ভ হইল। বৈদেশিক জাতির হস্তে বার বার পরাজিত হইয়া জাপানবাসীর হৃদয়ে যে গভীর ক্ষত উৎপন্ন হইল, অদ্যাপিও তাহার রক্ত নির্গম রুদ্ধ হয় নাই। পেরির উৎপীড়নে অনেকেই ব্যথিত হইয়াছিলেন। এক্ষণে ইয়ুরােপীয় খৃষ্টান জাতির আচরণ দেখিয়া সকলেরই মােহনিদ্রা ভঙ্গ হইল। জাপানের সুসন্তান মাত্রেই বুঝিলেন, আর রক্ষা নাই; এখন হইতে সাবধান না হইলে, অনতিকাল মধ্যেই সমগ্র রাজ্য শত্রুর করাল-কবলে নিপতিত হইবে; নিপনের আজন্ম-স্বাধীনতা-সূর্য্য চিরদিনের জন্য অস্তমিত হইবে।

বাগ্মিগণ হৃদয়বিলােড়নকারিণী বহ্নিতাপােচ্ছাসিনী বক্তৃতা দ্বারা, সুলেখকগণ অন্তর প্রজ্জ্বালনকারিণী রণােন্মাদিনী রচনা দ্বারা, স্বদেশীয় শ্রোতৃবর্গের ও পাঠকবৃন্দের চিত্ত উন্মত্ত করিয়া তুলিলেন। পরিশেষে,—অতি অল্প দিবস মধ্যে—সমগ্র জাপানবাসী একবাক্যে স্থির করিলেন যে, স্বদেশহিত-যজ্ঞে স্বার্থপশু উৎসর্গ না করিলে কোন উপায়েই জননী জন্মভূমির স্বাধীনতা রক্ষা হইবে না।

ইহা স্থির করিয়াই সর্ব্বপ্রথমে জাপানের অদ্বিতীয় শক্তিধর প্রধান সেনাপতি কিকি স্বদেশহিতব্রতে আত্মস্বার্থ বিসর্জ্জন দিলেন। তিনি বিশাল রাজ্য, সােগানের স্বর্ণসিংহাসন, অতুল্য সম্মান, সমস্তই সম্রাটচরণে উৎসর্গ করিয়া কেবলমাত্র একখানি সুশাণিত তরবারি গ্রহণ করিলেন। দেখিতে দেখিতে দাইমিও আখ্যাধারী জায়গীরদারগণ, কুগেবংশীয় ভূম্যাধিকারিগণ, আইচু ও টোকাগুয়া বংশীয় সামুরাইগণ ও অন্যান্য সম্মানিত বংশের রাজকর্ম্মচারিগণ একে একে কিকি সােগানের মহৎ দৃষ্টান্তের অনুসরণ করিলেন। লক্ষপতি স্বেচ্ছায় পথের ভিখারী হইলেন। এই দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হইয়া নিরক্ষর সৈনিকেরা পর্য্যন্ত আপনাপন নিস্করভূমি পরিত্যাগ পূর্ব্বক সম্রাট সমক্ষে দণ্ডায়মান হইল।

সমগ্র দেশ ব্যাপিয়া স্বদেশানুরাগের প্রবল ঝটিকা বহিতে লাগিল। দেশে দেশে, নগরে নগরে, গ্রামে গ্রামে, স্বদেশ ও সম্রাটের মঙ্গল কামনায় ভগবান শাক্যমুণির আরাধনা হইতে লাগিল। বালক হইতে বৃদ্ধ পর্য্যন্ত, কৃষক হইতে জমিদার পর্য্যন্ত, মূর্খ হইতে পণ্ডিত পর্য্যন্ত, অধিক কি বালিকা হইতে বৃদ্ধা পর্য্যন্ত, সকলেই সম্রাট ও স্বদেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করিতে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হইল। ঝটিকা বহিতে লাগিল। স্বদেশানুরাগ ও স্বজাতিপ্রেমের প্রবলবহ্নিতে জাপান-ভূমি পূত ও পুণ্যময় হইল। সোগান পদ বিলুপ্ত হইয়া, জাপান সাম্রাজ্য একমাত্র সম্রাটের অধীন হইল।

এইরূপে ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে প্রশান্ত মহাসাগরের সুনীলবক্ষে বালার্কদ্যূতিমণ্ডিত জাপান রাজ্যে নবযুগ আরম্ভ হইল।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. “জাপানের ধর্ম্মপ্রণালী” শীর্ষক প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।
  2. জাপানী ঐতিহাসিকগণের মধ্যে কেহ কেহ বােধিসেন ভারদ্বাজকে বৌদ্ধধর্ম্মাবলম্বী ভারতীয় ব্রাহ্মণ বলিয়া অভিহিত করিয়া গিয়াছেন।
  3. ত্রিপিটক অর্থে তিনখানি গ্রন্থ নহে। যেমন চতুর্বেদের প্রত্যেকের মধ্যে শত শত গ্রন্থ দেখিতে পাওয়া যায়, ষড়দর্শনের মধ্যে এক এক দর্শন শ্রেণীর শত শত পুস্তক রহিয়াছে, ত্রিপিটকেও সেইরূপ সমুদয় বৌদ্ধধর্ম্মগ্রন্থ সূত্র, বিনয় ও অভিধর্ম্ম এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া তিনটী শ্রেণীর একটী সাধারণ আখ্যা দেওয়া হইয়াছে। চৈনিক ত্রিপিটকে যে কত সহস্র গ্রন্থ রহিয়াছে এবং সে সমস্ত যে কোন্ ভাষা হইতে অনুবাদিত, এ পর্য্যন্ত তাহা নির্ণীত হয় নাই। জাপানী ত্রিপিটক সম্বন্ধে এই গ্রন্থের “জাপানী সাহিত্য ও সংবাদ পত্র” শীর্ষক অধ্যায় দ্রষ্টব্য।