» » জাপান সাম্রাজ্যের গঠনপ্রণালী ও রাজনীতি।

সমগ্র জাপান সাম্রাজ্য ৪৫টী “কেন” অর্থাৎ প্রদেশে বিভক্ত। প্রতি প্রদেশে একজন করিয়া “চো” অর্থাৎ শাসনকর্ত্তা অবস্থিতি করেন। প্রতি গ্রামেই গ্রামবাসিগণ কর্ত্তৃক নির্ব্বাচিত ১২ জন প্রধান ব্যক্তি লইয়া এক একটী গ্রাম্যসমিতি আছে। প্রতি গ্রামেই এক জন করিয়া পােলিস অবস্থান করে।

সম্রাটই রাজ্যের সর্ব্বপ্রধান কর্ত্তা; তিনি “নেকয়্যাকু” অর্থাৎ মন্ত্রিসভার সাহায্যে রাজ্যের প্রকৃত শাসন সংরক্ষণ করিয়া থাকেন। কার্যের শৃঙ্খলাসাধন জন্য মন্ত্রিসভা রাজস্ব, শিক্ষা, সামরিক, বৈদেশিক, অভ্যন্তরীণ, ঔপনিবেশিক প্রভৃতি নানা বিভাগে বিভক্ত আছে। প্রত্যেক বিভাগে একজন করিয়া মন্ত্রী (দৈজিন) আছেন।

১৮৯০ খৃষ্টাব্দে ইংলণ্ডের অনুকরণে জাপানে পালামেণ্ট অর্থাৎ প্রতিনিধি সভা স্থাপিত হয়। এই সভা আভিজাত ও সাধারণসভা নামে দুই ভাগে বিভক্ত। সাধারণ সভার সভ্যদিগের ক্ষমতা অধিক; কারণ সাম্রাজ্যের যাবতীয় আয় ও ব্যয়ের উপরে ইহাঁদের সম্পূর্ণ কর্ত্তৃত্ব আছে। যাহাঁদের বয়ঃক্রম ২৫ বৎসর এবং বৎসরে ১৫৲ টাকা বা তদূর্দ্ধ কর দিয়া থাকেন, সাধারণ সভার সভ্য মনােনীত করিবার জন্য তাঁহাদের একটী “ভােট” দিবার অধিকার আছে। বর্ত্তমান বৎসরে ৪৫টী “কেন” (জেলা) হইতে ২৯৬টী, ৫৩টী “সাই” (সহর) হইতে ৭৩টী, ৪টী “চো” (দ্বীপ) হইতে ৪টী, যেশোদ্বীপ হইতে ৬টী ও ওকিনাওয়া (লিচুপুঞ্জ) হইতে ২টী সভ্য সাধারণ সভায় প্রবিষ্ট হইয়াছেন। আভিজাত সভার সভ্যের সংখ্যা ৩৫৭ জন, ইহাঁরা সাত বৎসরের জন্য ও সাধারণ সভার সভ্যেরা চারি বৎসরের জন্য মনােনীত হইয়া থাকেন। জাপানবাসির পােষ্যপুত্র অথবা জাপান রমণীর স্বামী ভিন্ন কোন বৈদেশিক মতদাতা বা সভ্য হইতে পারেন না। সম্রাট কর্ত্তৃক উভয় সভার সভাপতি ও সহকারী সভাপতি মনোনীত হইয়া থাকে। তাঁহারা প্রত্যেকে বৎসরে ৬০০০৲ টাকা ভাতা পাইয়া থাকেন। অন্যান্য সভ্যরা প্রত্যেকে ১২০০৲ টাকা পাইয়া থাকেন। যে সমস্ত সভ্যেরা রাজকর্ম্মচারী, তাঁহারা কেবলমাত্র পাথেয় পাইয়া থাকেন। প্রতি বৎসরে তিনমাস কাল পার্লামেণ্ট বসিয়া থাকে। এক তৃতীয়াংশ সভ্য উপস্থিত না হইলে কোন বিষয় আলােচিত হইতে পারে না। এক সভার প্রস্তাবিত বিষয় অন্য সভা ও সম্রাট কর্ত্তৃক অনুমােদিত হইলে তাহা আইনরূপে গৃহীত হইয়া থাকে। কোন বিশেষ রাজনৈতিক আন্দোলন ব্যতীত অন্য কোন সময়ে যে কোন ব্যক্তি সভামধ্যে প্রবেশ লাভ করিতে পারেন।[১]

বর্ত্তমান সময়ে জাপানে একটী সুপ্রিমকোর্ট, সাতটী “কোশােইন” (আপিলকোর্ট) ৪৮টী “চিহো-সেবানসাে” (জেলাকোর্ট) ও ৩১০টী নিম্ন আদালত আছে। এই চারি শ্রেণীর আদালতের বিচারক সংখ্যা যথাক্রমে ২৫, ১২১, ৩৯৯ ও ৫৫৭ জন হইবে। এই সমস্ত বিচারালয়ে গত পূর্ব্ববর্ষে ১,৬১, ৮৫৪টী দেওয়ানী মােকর্দ্দমা ও ১, ৮৩, ৫৬২টী ফৌজদারী মােকর্দ্দমা হইয়াছিল।

জাপানের পােলিশ প্রথা সর্ব্বোৎকৃষ্ট। এখানে গ্রামে গ্রামে একজন করিয়া পােলিশ আছে। তাহাদের নিকটে এলাকাধীন স্থানের মানচিত্র ও অধিবাসিগণের তালিকা আছে।

প্রতি অফিসেই টেলিফোঁ সংযােগ রহিয়াছে। যে কোন ব্যক্তি তথায় পাঁচটী মাত্র পয়সা দিলে অন্যত্র সংবাদে পাঠাইতে পারে। এখানে উৎকোচের ব্যবস্থা আদৌ নাই। দেশবাসীর অর্থ ও শােণিত শোষণ করিবার জন্য জাপানী পােলিশের সৃষ্টি হয় নাই।

এক্ষণে জাপানে ১৩৯টী কারাগার আছে। প্রতি কারাগারেই একজন করিয়া জেল গভর্ণর আছেন। তাঁহার বার্ষিক বেতন নয় শত হইতে পঁচিশ শত টাকা। গত পূর্ব্ব বৎসরে জেলসমূহের কর্ম্মচারী সংখ্যা ১১,৯৯৫ জন ছিল। এক্ষণে সমগ্র কারাগারের কয়েদীগণের দৈনিক উপস্থিত সংখ্যার গড় ৬০ হাজার হইবে। কয়েদীগণের স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখা হয়, তাহাদিগকে গ্রীষ্মকালে প্রতি পাঁচ দিবসে ও শীতকালে প্রতি দশ দিবসে স্নান করিতে দেওয়া হয়। প্রত্যহ তিনবার করিয়া খাদ্য প্রদান করা হয়। কয়েদীরা মুক্ত হইয়া যাহাতে সদুপায়ে জীবিকার্জ্জন করিতে পারে, তাহার জন্য কারাগারের ভিতরে ও বাহিরে তাহাদিগকে বস্ত্রবয়ণ, সূচীকর্ম্ম, ইষ্টকনির্ম্মাণ প্রভৃতি, বিবিধ বিষয় শিক্ষা দেওয়া হয়। কয়েদীরা বাহিরে কর্ম্ম করিয়া যাহা উপার্জ্জন করে, মুক্তিদানকালে তাহা তাহাদিগকে প্রদান করা হয়।

জাপান গভর্ণমেণ্টের মােট আয় ৫০ কোটী টাকা হইবে। জমির মূল্যের শতকরা ২॥৹ হিসাবে প্রায় ১৮ কোটী টাকা ভূমির রাজত্ব সংগৃহীত হইয়া থাকে। বার্ষিক ৪৫০৲ টাকা আয় হইলে ইনকম্ ট্যাক্স দিতে হয়। গত বৎসরে ইহা হইতে প্রায় ৬ কোটী টাকা সংগৃহীত হইয়াছিল। অবশিষ্ট টাকা দেশীয় ও বিদেশীয় মদিরা,[২] তামাক,[৩] বাণিজ্য শুল্ক, রেলওয়ে, পােষ্টাফিস, মিণ্ট, বনবিভাগ, খনিকর, কষ্টম, ষ্ট্যাম্প প্রভৃতি হইতে গৃহীত হয়। পূর্ব্বে প্রতি জাপানীকে ৮৩ পেন্স বা ৫৷৹ করিয়া কর প্রদান করিতে হইত। গত মহাযুদ্ধের পর হইতে আর ৩৭ পেন্স করিয়া অধিক দিতে হইতেছে।

জাপান গভর্ণমেণ্ট সৈন্যপালনার্থ প্রতি বর্ষে প্রায় ছয় কোটী টাকা ব্যয় করিয়া থাকেন। সাধারণ শিক্ষার জন্য সমগ্র আয়ের শতকরা ২॥৹ টাকা অর্থাৎ প্রায় এক কোটী টাকা ব্যয় হইয়া থাকে। বাণিজ্য ও কৃষির উন্নতির জন্য প্রায় ৮৭ লক্ষ টাকা ব্যায়িত হয়। জাপান গভর্ণমেণ্ট যেস্থলে শিক্ষাব্যয় নির্ব্বাহার্থ ব্যক্তি প্রতি।৴৫ পয়সা করিয়া ব্যয় করেন, ভারত গভর্ণমেণ্ট সেই স্থলে আড়াই পয়সার অধিক ব্যয় করিতে অসমর্থ হইয়া থাকেন।

জাপানবাসিদিগের আর্থিক অবস্থা, ভারতসন্তানগণের ন্যায় শোচনীয় নহে। জাপানে প্রত্যেক ব্যক্তির গড় আয় বৎসরে ৮০৲ টাকা হইবে, তাহাদিগকে সর্ব্বপ্রকারে ৮৲ টাকার অধিক কর প্রদান করিতে হয় না।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. জাপানের মহাসভাসংক্রান্ত বিশেষ বিবরণ অবগত হইতে হইলে জাপান সাম্রাজ্যের গঠন বিষয়ক আইনের ৭ অধ্যায় পাঠ করা আবশ্যক।
  2. “সাকি” পাঁচ প্রকার। যথা, “যিশু” (পরিশ্রুত) “মিরিন,” (মিষ্ট) “সিরােজাকি,” (শ্বেতবর্ণ) “মােচু,” (আলু হইতে উৎপন্ন) ও “ডাকু সু” (অপরিষ্কার)।
  3. তিন বৎসর পূর্ব্বে তামাকের ব্যবসা ইংরাজ ও আমেরিকানদিগের হস্তগত ছিল। এক্ষণে গবর্ণমেণ্টের একচেটিয়া হইয়াছে। জাপানী তামাক এক্ষণে কোরিয়া, চীনের সর্ব্বত্র, প্রণালী উপনিবেশ (Straits setlements) ও ভারতবর্ষে বিক্রীত হইয়া থাকে।