» » ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত: প্রাচীনযুগ।

বর্ণাকার

ভারতীয় আর্য্যজাতিগণ যে অতি প্রাচীন কাল হইতে ভারতবর্ষ ব্যতীত পৃথিবীর অন্যান্য দেশ ও দ্বীপপুঞ্জাদির কথা সম্যক্‌রূপে অবগত ছিলেন, আর্যজাতি, আর্য্যধর্ম্ম ও আর্য্যাচার যে এক সময়ে পৃথিবী ব্যাপিয়া বিদ্যমান ছিল, তাহার ভূরি ভূরি প্রমাণ অদ্যাপি দেদীপ্যমান রহিয়াছে। “ফেলিক ওয়ারসিপ” নামক ইংরাজী গ্রন্থে লিখিত আছে, এক সময়ে তান্ত্রিক আচার, শিবলিঙ্গপূজা এবং ভারতীয় ব্রতাচরণ, প্রাচীন আসিরিয়া, (অসুর দেশ) চালিডিয়া, আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা প্রভৃতি নানা দেশে অনুষ্ঠিত হইত। আমাদের পুরাণ গ্রন্থে বলিরাজা ও সূর্য্যবংশীয় জনৈক নৃপতির পাতালে গমন করার কথা লিখিত আছে। আমেরিকায় বলিভিয়া ও পুরুভিয়া নামে দুইটী দেশ আছে। পুরুভিয়ার প্রধান নগর কুজনাে নগরীতে অদ্যাপি কয়েকটি দেবালয়, দেব বিগ্রহ ও একটী সূর্য্য মন্দিরের ভগ্নাবশেষ বিদ্যমান আছে। কেহ কেহ বলেন, প্রাচীন বলিভূমিও পুরুভূমি হইতে আধুনিক বলিভিয়া ও পুরুভিয়া নামের উৎপত্তি হইয়াছে। জনৈক সংস্কৃতজ্ঞ সুপণ্ডিত বহু প্রাচীন গ্রন্থ আলোচনা করিয়া লিখিয়াছেন;—ইংরেজেরা যাহাকে আমেরিকা বলিয়া বর্ণনা করিয়া থাকেন, শ্রীমদ্ভাগবতে তাহাকে আবর্ত্তন উপদ্বীপ নামে অভিহিত করা হইয়াছে। এই আবর্ত্তন উপদ্বীপের পশ্চিমখণ্ডে (আমেরিকার উত্তর প্রদেশে) সূর্য্যবংশীয় পুরুকুৎস রাজার রাজ্য পুরুভূমি অর্থাৎ পেরু প্রদেশ ও দক্ষিণ প্রদেশে বলি রাজার রাজ্য বলিভূমি অর্থাৎ বলিভিয়া দেশ বিদ্যমান আছে। এখানে অদ্যাপি “রামু-সীতোয়ো” অর্থাৎ রামসীতার উৎসব হইয়া থাকে।

H. M. Westrap প্রণীত Ancient Archœology নামক গ্রন্থে প্রাচীন মিশরীয়, গ্রীক, রােমান প্রভৃতি জাতির শিল্পকলা ও ভাস্কর বিদ্যার বহু বিবরণ সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। এই পুস্তক যত্নসহকারে পাঠ করিয়া জনৈক বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিক লিখিয়াছেন;—

এই গ্রন্থের ১৬৪ পৃষ্ঠায় গ্রীক দেবতা জুপিটারের প্রতিমূর্ত্তি অঙ্কিত আছে। এই মূর্ত্তি নিবিষ্টচিত্তে দেখিলেই মনে হয়, ইহা যেন ভারতীয় পৌরাণিক দেব মহাদেবেরই প্রতিমূর্ত্তি। বাম হস্তে পারাবত-শীর্ষ ত্রিশূল; দুই পার্শ্বে যেন জয়া-বিজয়া; পদতল সমীপে দুই দিকে ছিন্নমস্তার প্রতিরূপ; আর আমাদের দেশে দশভূজা প্রতিমার চালচিত্রে যেমন বহুবিধ দেব-দেবীর মূর্ত্তি অদ্যাপি অঙ্কিত হইয়া থাকে, এই জুপিটার-প্রতিমা-ফলকের ললাটদেশে যেন তেমনই চাল-চিত্র অঙ্কিত। এই পুস্তকের ১৭৪ পৃষ্ঠায় প্রাচীন এথেন্সে প্রচলিত মুদ্রা বিশেষের প্রতিমূর্ত্তি আছে; এই মুদ্রার একদিকে যেন লক্ষ্মী দেবীর মূর্ত্তি অঙ্কিত; অপর দিকে লক্ষ্মী-পেচক ও ধান্য পাত্র খুঁচির প্রতিরূপ বিন্যস্ত। এই পুস্তকের ১৮৮ পৃষ্ঠার চিত্র দেখিলেই মনে হয়, ইহা যেন আমাদের দেশের মহিষমর্দ্দিনীরূপের প্রতিরূপ; মহিষ কায়, হইতে অসুর বিনির্গত হইয়াছে; এই অসুর,—পার্শ্বোপবিষ্ট অপর অসুরের কেশাকর্ষণ করিতেছে। ১০১ পৃষ্ঠায় অঙ্কিত মূর্ত্তি সমূহ দেখিলেই মনে হয়, ঠিক যেন ভারতের বৃন্দাবনবিলাসিনী শ্রীরাধার প্রতিমা; পার্শ্বে বংশীবাদন তৎপর শ্রীকৃষ্ণ, কোন মূর্ত্তি বা বীণাধারিণী বীণাপাণির বিকৃতি। এই সকল মূর্ত্তির হাব-ভাব ও বেশ-ভূষা দেখিলে, নিশ্চয়ই ভারতীয় বলিয়া প্রতীত হইবে,—রাধা-কৃষ্ণপ্রতিমার পার্শ্বে হ্লাদিনী রসান্যাদিনী সখী-মণ্ডলী। পুস্তকের ১৭০ পৃষ্ঠায় রােমবিগ্রহ অঙ্কিত আছে, ইহা দেখিলেই মনে হইবে,—অবিকল যেন চতুর্ম্মুখ ব্রহ্মারই অনুকরণ! ২৩১ পৃষ্ঠায় যে রোমান-চিত্র বিশেষের প্রতিচিত্র অঙ্কিত আছে, তাহা দেখিলেই মনে হইবে, আমাদেরই শাস্ত্রবর্ণিত সমুদ্র-মন্থনের প্রতিমূর্ত্তি;—সমুদ্র-গর্ভ হইতে চন্দ্র ও উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব উঠিতেছে,—আবার চৈত্রেক-পার্শ্বে সমুদ্র সম্ভব সুধা লইয়া, দেবাসুরে মহাযুদ্ধ বাধিয়া গিয়াছে।

কেবলমাত্র গ্রীক বা রােম দেশে নহে, প্রাচীন মিশর দেশের মূর্ত্তি-প্রসঙ্গেও ভারতীয় দেবদেবীর প্রতিমার লক্ষণ দিব্যরূপ প্রকটিত। উপরি-উক্ত পুস্তকের ১৫৫ পৃষ্ঠায় যে চিত্র অঙ্কিত রহিয়াছে, তাহা দেখিলেই মনে হইবে,—ইহা যেন অবিকল জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রারই প্রতিমূর্ত্তি; জগন্নাথ কৃষ্ণবর্ণ, বলরাম শুভবর্ণ এবং ইঁহাদের উভয়ের মধ্যস্থলে সুভদ্রাদেবী উপবিষ্ট। প্রতিমা-চিত্রে যেরূপ,—সৌধ-মন্দির চিত্রেও সেইরূপ ভারতীয় ভাবানুকরণই পুরা মাত্রায় প্রকটিত। মিশরীয় প্রাচীন মন্দির বিশেষের দৃশ্য যেন ভুবনেশ্বর মন্দির সদৃশ।

এক সময়ে আর্য্যধর্ম্মই যে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে প্রচলিত ছিল, এই সকল রূপ-প্রতিমা কি তাহার অন্যরূপ পরিচায়ক নহে? সুদুর উত্তর কুরুবর্ষে, তির্ব্বতে, মানসসরােবরে, চীন-সাম্রাজ্যে, কৃষ্ণসাগরের উপকূলবর্ত্তী কলচিস প্রদেশে, তুরস্কের বসােৱা নগরে, পারস্যের অন্তর্গত নানা প্রদেশে, অদ্যাপিও হিন্দুদিগের প্রতিষ্ঠিত দেবমূর্ত্তি বিরাজমান আছে। এখনও অনেক হিন্দু সন্ন্যাসীরা এই সকল স্থানে গমন করিয়া থাকেন।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পঞ্চশতবর্ষ পূর্ব্বেও আর্য্যজাতির ইয়ুরােপ গমনের কথা অবগত হওয়া যায়। ভূগর্ভোত্থিত যে শিলালিপি হইতে ইহা স্থির হইয়াছে, তাহা অদ্যাপিও ইংলণ্ডের রাজকীয় কৌতুকাগারে রক্ষিত আছে

এই সকল দৃষ্টান্ত হইতে নিসংশয়ে প্রতীত হইতেছে,ভারতীয়েরা এক সময়ে পৃথিবীর সর্ব্বস্থানেই আপনাদের অক্ষুন্ন প্রভাব বিস্তার করিয়াছিলেন।

প্রাচীনযুগে হিন্দু বণিকেরা পোতারোহণপূর্ব্বক বালি, যাবা, সুমাত্রা, বোর্ণিও প্রভৃতি প্রাচ্য দ্বীপপুঞ্জে গমনাগমন করিতেন। এই সমস্ত স্থানে অদ্যাপিও হিন্দু উপনিবেশের সুস্পষ্ট চিহ্ণ বর্ত্তমান রহিয়াছে। হিন্দুরা যে, জাপানের অস্তিত্ব সম্বন্ধে অজ্ঞ ছিলেন না, তাহারও কয়েকটী প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। ইয়োকোহামার অনতিদূরে কামিকুরা নামক স্থানে ৩৩১/৩ হস্ত উচ্চ একটী বুদ্ধদেবের প্রতিমূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। আর একস্থানে ৪২ হস্ত উচ্চ একটি দেবমূর্ত্তি আবিষ্কৃত হইয়াছে। শেষোক্ত মূর্ত্তির গাত্রে সংস্কৃত ভাষায় কতকগুলি কথা খোদিত আছে। তাহাতে জানা যায়, খ্রীষ্ট জন্মিবার বহুশতবর্ষ পূর্ব্বে এই দেবমূর্ত্তি ভারতবর্ষ হইতে জাপানে আনীত হইয়াছিল।

জাপানের প্রাচীন নাম সুদর্শন দ্বীপ। রামায়ণের অন্তর্গত কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ডের চত্বারিংশ সর্গে চারুদর্শন সুদর্শন দ্বীপ ও সূর্ম্যরাগ-রঞ্জিত মনোহর স্বর্ণ পর্ব্বতের উল্লেখ আছে। কালক্রমে সুদর্শন নামের অপভ্রংশে ‘নিপন’ নাম হইয়াছে। প্রাচীন সুবর্ণ পর্ব্বত হইতে আধুনিক ‘ফুজিসান’ পর্ব্বতের নাম উৎপন্ন হইয়া থাকিবে। মহর্ষি বাল্মীকি সুদর্শন দ্বীপকে সূর্যোদয়ের স্থান বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, জাপানী ভাষায় নিপন শব্দের অর্থ সূর্য্যোদয়ের স্থান। আমাদের বৈবস্বত মনুর ন্যায়, জাপান রাজবংশের আদি পুরুষ সিণ্টো, সূর্য্য হইতে উৎপন্ন। জাপান রাজবংশধরেরা আপনাদিগকে অদ্যাপিও সূর্য্যবংশীয় বলিয়া অভিহিত করিয়া থাকেন।

অনেকে অনুমান করেন; যে সভ্যতারাগে জাজ্জ্বল্যমান হইয়া জাপান আজি উষার সুকুমার অরুণ প্রভার ন্যায় উত্তরােত্তর উন্নতির পথে অগ্রসর হইতেছে, সে সভ্যতা জাপানবাসিরা পাশ্চাত্য জাতির নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছে। এ অনুমান প্রকৃত নহে। পাশ্চাত্য সভ্যতার অভ্যঙ্গনে জাপানের বর-বপু কিঞ্চিন্মাত্রায় মসৃণ হইয়াছে সত্য, কিন্তু উহার জাতিকলেবর গঠনে যে ভারতবর্ষই মন্ত্রগুরু অদ্যাপিও তাহার দৃঢ় নিদর্শন বিদ্যমান আছে। এই বিবরণ আমরা ক্রমান্বয়ে লিপিবদ্ধ করিতে যত্ন করিব।

জাপান দ্বীপের উৎপত্তি ও তথায় লােকের বসতি সম্বন্ধে অনেক অপূর্ব্ব উপাখ্যান প্রচলিত আছে। তাহার অধিকাংশই ভারতীয় পৌরাণিক আখ্যায়িকার ন্যায় অপূর্ব্ব রহস্যে বিজড়িত। জাপানীদিগের বিশ্বাস, অতি প্রাচীনকালে এই দ্বীপে দেবতারা রাজত্ব করিতেন। বহুযুগ পরে সেই দেববংশে মানব ও দেবধর্ম্মবিশিষ্ট এক সম্প্রদায় মনুষ্যের জন্ম হয়। ইহার বহুবর্ষ পরে তাঁহাদের সন্তানসন্ততি হইতে বর্ত্তমান জাপানিগণের উৎপত্তি হইয়াছে।

ইয়ুরােপীয় পণ্ডিতগণের অনুমান যে, চীন হইতে জাপানীদিগের উৎপত্তি হইয়াছে। কিন্তু উভয় জাতির ধর্ম্ম ও ভাষার অসাদৃশ্য, রীতিনীতি ও আচার ব্যবহারের পার্থক্য, মানসিক গতি ও চরিত্রের ভিন্নতা দর্শনে, কিছুতেই উক্ত অনুমানের সারবত্ত্বা উপলব্ধি হয় না।

পাশ্চাত্য মানবতত্ত্ববিদেরা মনুষ্যবর্গের বর্ণ, মুখশ্রী ও গঠনাদির বিভিন্নতা অনুসারে সমগ্র মানবজাতিকে, ককেশীয়, মােঙ্গলীয়, ইথিওপীয়, মালয় ও আমেরিক এই পঞ্চ শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছেন। তাঁহাদের মতে চীন, বর্মা, শ্যাম, জাপান, এসিয়াস্থ রুষিয়া, তিব্বত প্রভৃতি দেশের অধিবাসিগণ মােঙ্গলীয় শ্রেণীভুক্ত। ইহাদিগের বর্ণ পীত, কেশ স্থূল ও ঋজু, শ্মশ্রু বিরল, মুখ প্রশস্ত ও চেপ্টা, গণ্ডাস্থি উন্নত এবং চক্ষু বাদামাকৃতি।

নিম্নশ্রেণীর জাপানিগণের গঠনাদি মােঙ্গলীয় ভাবাপন্ন হইলেও জাপানের শিক্ষিত ও উন্নতিবংশীয়দিগের বর্ণ ও শারীরিক গঠনাদি অনেকাংশে ভারতীয় শ্রেষ্ঠজাতিগণের অনুরূপ। তাঁহাদিগকে সহসা দর্শন করিলে, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ প্রভৃতি উচ্চশ্রেণীর বাঙ্গালী বলিয়া ভ্রম উপস্থিত হয়। তাঁহাদিগের বর্ণ গৌর, কেশ দীর্ঘ, নাসিকা উন্নত ও সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সুগঠিত। যাঁহারা সংবাদপত্রে জাপান-সম্রাট, মার্কুইস আইটো, মন্ত্রী টেরাউচি, এডমিরাল টোগো, সেনাপতি অকু প্রভৃতি সুপ্রসিদ্ধ জাপানিগণের আলােকচিত্র দর্শন করিয়াছেন, তাঁহারা নিশ্চয়ই আমাদের একমতাবলম্বী হইবেন। কয়েক বৎসর পূর্ব্বে কলিকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ অধিবেশনে একটী আশ্চর্য্য পরীক্ষা হইয়াছিল। তাহাতে দুই জন জাপানী ভদ্রলোক এদেশীয় পরিচ্ছদ পরিধান পূর্ব্বক সভায় উপস্থিত স্বত্বেও কেহই তাঁহাদিগকে বাঙ্গালী হইতে ভিন্ন বিবেচনা করিতে পারেন নাই।

পৃথিবীর সর্ব্বত্রই দৃষ্ট হয় যে, অনেক প্রদেশ আদিম অধিবাসী শূন্য হইয়া নূতন জাতি কর্ত্তৃক উপনিবেশিত হইয়াছে। ইয়ুরােপ মহাদেশের ইতিবৃত্ত পাঠ করিলে, ইহার প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যাইবে। আরও দেখা যায়, আদিম জাতি ও নবাগত জাতির সংমিশ্রণে নানাস্থানে নূতন নূতন জাতিনিচয়ের উৎপত্তি হইয়াছে। উদাহরণ স্বরূপ মূলাটো ও জম্বো প্রভৃতি জাতির কথা উল্লেখ করা যাইতে পারে। এইরূপ উদাহরণ ভারতবর্ষেও বিরল নহে।

আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, দুর অতীতের কোন এক সময়ে ভারতীয় আর্য্যজাতিগণের কোন এক শাখা সুদর্শন দ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছিলেন। এই মহাঘটনা, আর্য্যজাতির অতীত গৌরবের সুবর্ণযুগে, কি ইতিহাস-প্রসিদ্ধ বৌদ্ধযুগে ঘটিয়াছিল, তাহা নিঃসন্দেহে নির্ণয় করিবার অবসর উপস্থিত হয় নাই।

কোজিকি নামক জাপানের পুরাণগ্রন্থে লিখিত আছে যে, অতি প্রাচীন কালে সিণ্টো নামক জনৈক মহাপুরুষ ভগবান সূর্য্য হইতে উৎপন্ন হইয়া মর্ত্তধামে অবতরণ করেন। তাঁহার সন্তানসন্ততিরা বহুযুগ ধরিয়া পৃথিবী সুশাসন পূর্ব্বক অন্তর্হিত হইলে, নিপন রাজ্যে অতি ভয়াবহ দেবাসুর সংগ্রাম আরম্ভ হয়।

ভগবতী বসুমতী উকুনিনুনী নামক অজেয় অসুর কর্ত্তৃক পীড়িতা হইয়া, প্রভাকরপত্নী দেবী অমৃতরাশির আশ্রয় গ্রহণ করেন। মহাদেবী বসুন্ধরার কাতর-ক্রন্দনে বিগলিতা হইয়া মিকাডো নামক মহাবলশালী দেব সেনাপতিকে দৈত্য দলনার্থ ভূতলে প্রেরণ করেন। বহুযুগ ধরিয়া দেবদানবে ভীষণ যুদ্ধ হয়। অবশেষে মিকাডো ও তাঁহার মানসপুত্রগণের বাহুবলে দানবেরা পরাজিত হইয়া দেশত্যাগ পূর্ব্বক পাতাল প্রদেশে পলায়ন করে। যুদ্ধাবসানে মিকাডো নিপনের সম্রাট হন। ইহাই জাপানের পৌরাণিক ইতিহাস।

মিকাডাে বংশে জীমূতমনু নামক জনৈক মহাপ্রতাপশালী নরপতি জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম নিনো অব্দে অর্থাৎ খৃষ্ট জন্মিবার ৬৬০ বৎসর পূর্ব্বে ইহাঁর আবির্ভাব হয়। এই সময় হইতে জাপানে কাল গণনার সূত্রপাত হয়। দেববংশসম্ভূত বলিয়া জীমূতমনু রাজ্যের সর্ব্বত্রই প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিলেন। সহস্র সহস্র ধর্ম্মমন্দিরে মহােৎসব সহকারে তাঁহার নিত্য পূজা হইত। প্রজাগণ সাক্ষাৎ ঈশ্বর বােধে তাঁহাকে ভয় ও ভক্তি করিত। এই সময়ে জাপানীরা সিণ্টো ধর্মাবলম্বী ছিল। সূর্য্যপূজা, রাজভক্তি ও স্বদেশপ্রীতি এই ধর্ম্মের মূলমন্ত্র ছিল। প্রজা মাত্রেই সম্রাট ও স্বদেশের জন্য সাগর সলিলের ন্যায় অকাতরে অর্থ ও শােণিত ব্যয় করিত।

জীমূতমনু মিকাডাের পর হইতে জাপানে রাজ-সম্মান অত্যধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পাইতে থাকে। এই সময়ে জনসাধারণ সম্রাটকে দেবতা বােধে তাঁহার শরীর পরম পবিত্র বলিয়া বিশ্বাস করিত। রাজা কোন সময়ে মৃত্তিকা স্পর্শ করিতেন না। কোনস্থানে যাইতে হইলে বাহকের স্কন্ধে উঠিয়া গমন করিতেন। সম্রাটের নখর ও কেশ প্রভৃতি কেহই পাপভয়ে ছেদন করিতে সাহসী হইত না। সম্রাটের জন্য প্রত্যহ নূতনপাত্রে রন্ধন হইত, রন্ধনান্তে সেগুলি সমুদ্রগর্ভে পরিত্যাগ করা হইত। সম্রাট প্রত্যহ নূতন স্বর্ণপাত্রে ভােজন করিতেন। সে পাত্র পরিত্যাগ না করিয়া, তাহা অবসর মত দ্রব করিয়া নূতন পাত্র প্রস্তুত করা হইত। সম্রাটের পীড়া হইলে, সিণ্টো ধর্ম্মমন্দিরের পুরোহিতগণকে অনশনে থাকিয়া ত্রিসন্ধ্যা সূর্য্যোস্তোত্র পাঠ করিতে হইত। সম্রাট শাস্ত্রানুসারে দ্বাদশটি পত্নী গ্রহণ করিতে পারিতেন। পত্নীগর্ভজাত সন্তান মাত্রেই রাজ সম্মান প্রাপ্ত হইতেন। সর্ব্বাপেক্ষা জ্যেষ্ঠ পুত্রের গৌরব অধিক ছিল, তাঁহারই অদৃষ্টে সিংহাসনের উত্তরাধিকার ঘটিত। সম্রাটের মৃত্যু হইলে কনিষ্ঠ পত্নী মৃতপতির অনুগামিনী হইতেন। অন্যান্য পত্নীরা ইচ্ছা করিলে এই সতীধর্ম্ম পালন করিতে পারিতেন। বিধবা সম্রাট-মহিষীরা অন্য পতি গ্রহণ করিতে পারিতেন না।

এই সময়ে জাপানিগণের মধ্যে বিবিধ সংস্কার বিদ্যমান ছিল। তাহারা শুনিয়াছিল, পৃথিবীর নিম্নে একটি বৃহদাকার তিমিঙ্গিল আছে, সেই মৎস্য মস্তক নাড়িলে ভূমিকম্প হয়। তাহারা বলিত দেবমন্দির গুলি সিণ্টোর পতাকার উপরে স্থাপিত বলিয়া তথায় ভূমিকম্পের উপদ্রব হয় না। তাহাদের বিশ্বাস ছিল, কুদিনে মরিলে মনুষ্য প্রেতযােনি প্রাপ্ত হয়, অধার্ম্মিকগণ মরণান্তে শৃগাল ও উল্কামুখী হয়।

আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, সে সময়ে ভারতবর্ষ চীন, গ্রীক ও মিশর প্রভৃতি কয়েকটি দেশ ভিন্ন সমগ্র পৃথিবী অজ্ঞানান্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল। আশ্চর্যের বিষয়, এই সময় হইতে (২৫৫০ খৃঃ পূঃ) জাপানের পুরাবৃত্ত অতি সুন্দরভাবে লিখিত হইতে আরম্ভ হইয়াছে।

আমরা দেখিতে পাই, প্রাচীনযুগেও জাপানবাসীরা শিল্প ও বাণিজ্য কুশল জাতি বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিল। খৃষ্ট জন্মিবার ৬৫০ বৎসর পূর্ব্বে জাপানীরা স্বদেশজাত দ্রব্যাদি লইয়া চীন ও কোরিয়ার সহিত সমুদ্রপথে বাণিজ্য করিত। বর্ত্তমান সময়ের দুই সহস্র বর্ষ পূর্ব্বে জাপানে জনসংখ্যা গ্রহণ করা হইয়াছিল। ১৭০০ বৎসর অতীত হইল, জাপানে ডাকঘর স্থাপিত হইয়াছে। সহস্রাধিক বর্ষ বিগত হইল, জাপানবাসীরা রেশম বয়ন ও চীনাবাসন প্রস্তুত প্রণালী অবগত হইয়াছে।

খৃষ্ট জন্মিবার বহুবর্ষ পূর্ব্ব হইতেই জাপানীরা ভারতবর্ষের কথা অবগত হইয়াছে। এই সময়ে তাহারা ভারতবর্ষকে “তেনজিকু” ও ভারতবাসীকে “তেনজিকুজিন” নামে অভিহিত করিত। এই দুইটি শব্দের অর্থ যথাক্রমে স্বর্গ ও স্বর্গবাসী। এইরূপ প্রবাদ আছে, প্রাচীনযুগে জাপানীরা, ভারতবাসী কোন ব্যক্তিকে দর্শন করিলে বলিত;—“আজ আমাদের মানব জন্ম ধন্য হইল, আমাদের স্বর্গযাত্রার পথ উন্মুক্ত হইল। আমরা স্বচক্ষে স্বর্গবাসীকে দর্শন করিলাম।”

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. উত্তরকুরু যে সুমেরু প্রদেশের অন্তর্গত, তাহা রামায়ণ ও মহাভারত বর্ণিত বর্ণনানুসারে অবগত হওয়া যায়। সংস্কৃত শাস্ত্রবিদ উইলসন সাহেবও ইহা স্বীকার করিয়াছেন। যথা— “উত্তরকুরু—The country about the north pole. উত্তর —northern and কুরু—The northern part at the globe.” এ অবস্থায় আধুনিক সাইবিরিয়া প্রদেশকে উত্তরকুরু নামে অভিহিত করিলে কোন দোষ ঘটিবে না।
  2. ভবিষ্যপুরাণ—পূর্ব্বখণ্ডে ইয়ুরােপের প্রাচীন নাম অশ্বক্রান্ত বা ইষুজাত বলিয়া উক্ত হইয়াছে। যথা—
    ইষুজাতে নরাঃ শুক্লাঃ শূরাঃ শিল্পবিশারদাঃ।
    বাণিজ্যাদিরতাঃ ক্রূরা মায়ামোহ বিমিশ্রিতাঃ॥
    পণ্ডিত রামচরণ শিরােরত্ন মহাশয় তৎপ্রণীত “ভারতবর্ষ বিচার” নামক গ্রন্থে প্রাচীন দেশ সকলের যেরূপ আধুনিক নাম নির্দ্দেশ করিয়াছেন, কৌতূহলাক্রান্ত পাঠকবর্গের অবগতি-জন্য নিম্নে তাহার কতকগুলি উদ্ধৃত করিলাম।
    অশ্বক্রান্ত, ইষুজাত, ইয়ুরােপ। রথক্রান্ত, সূর্য্যারিকা, আফ্রিকা।
    বিষ্ণুক্রান্ত,অসেচনক, এসিয়া। আবর্তন, কুমারদ্বীপ, আমেরিকা।
    রমণক, … অষ্ট্রেলেসিয়া। স্বর্ণস্থান, …পলিনেসিয়া।
    ইন্দ্রদ্বীপ, … ইংলণ্ড। রুম, রােমকপত্তন, রােমনগর।
    পশুশীল, … পাের্টুগাল। ক্রমথ, শর্ম্মন,… জার্মানি।
    অশ্বিয়া, … অস্ত্রিয়া। শক, তুরস্ক। তুখারা, বুখারা
    মিশ্রদেশ, … মিসর। তলহ, ব্রাজিল, ইত্যাদি।
  3. এসিয়াটিক রিসার্চ্চের প্রথম, চতুর্থ ও দশমখণ্ড দ্রষ্টব্য।