বর্ণাকার

ঐতিহাসিক ঘটনাবলী

দেখা গেছে যে, ঐতিহাসিক ঘটনাবলী যা শুধুমাত্র রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কিংবা আদর্শগত—তা ফলাফল ও পরিণতির দিক দিয়ে যতই গুরুত্বপূর্ণ ও বিপ্লবাত্মক প্রমাণিত হোক না কেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আকর্ষণীয় হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না যুদ্ধ-বিগ্রহের প্রচণ্ড উদ্দীপনাময় কার্যাবলী তার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দার্শনিক তত্ত্ব  বুঝবার জন্য দর্শন বিদ্যা সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং উক্ত বিদ্যা অর্জন ও তাতে পাণ্ডিত্য লাভ করা আবশ্যক। কিন্তু সামরিক ঘটনাবলী এই জন্য চিত্তাকর্ষক হয় যে, সকলেই জানতে চায় যুদ্ধক্ষেত্রে জাতীয় বীরবৃন্দ আত্মোৎসর্গ, বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ কি কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন এবং স্বদেশ ও স্বজাতির জন্য কিভাবে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন! এই সব কৃতিত্বপূর্ণ কার্যাবলী ও কুরবানীর উপ্যাখ্যান পাঠ করে অন্তরের মাঝে এই মর্মে আবেগ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয় যেন আমরাও এভাবে আমাদের দেশ ও জাতির কাজে লাগতে পারি।

মজার ব্যাপার এই যে, কাহিনী যতটা লোমহর্ষক, ভয়াবহ ও রক্তাক্ত হয় ততটা হৃদয়গ্রাহী এবং চিত্তাকর্ষকও হয়।

যেহেতু যুদ্ধের কাহিনী হৃদয়গ্রাহী ও আবেগোদ্দীপক হয়ে থাকে সেজন্য এর পাঠকচক্রও বিস্তৃত হয় এবং জাতির প্রতিটি অংশ ও শ্রেণী এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। আজকাল রাষ্ট্রের হেফাজত ও নিরাপত্তার যিম্মাদারী কেবল সেনাবাহিনীর উপরই বর্তায় না, আধুনিক সমরশাস্ত্রের কারণে এতে জাতির প্রতিটি সদস্যই সমান অংশীদার হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে দেশের প্রতিরক্ষার প্রেক্ষাপটে প্রতিরক্ষার ইতিহাস অধ্যয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিরক্ষার ইতিহাস

কিন্তু আমরা যখন প্রতিরক্ষার ইতিহাস অধ্যয়ন করতে শুরু করি তখন অসংখ্য প্রশ্ন সামনে এসে দেখা দেয়। যেমন :

১. কোন দেশের পাহাড় পর্বত, রেল-লাইন, রাস্তা-ঘাট, গিরিপথ, প্রান্তর-ময়দান, বন-জঙ্গল, দুলদুলে স্থান ও নদী-নালা প্রতিরক্ষা স্ট্রাটেজীতে কিরূপ গুরুত্ব রাখে এবং বিজেতার বিজয় এবং পরাজিতের পরাজয়ের উপর ঐ সব প্রতিবন্ধকতা কিংবা সহজ সাধ্যতার (আসানীর) কি প্রভাব পড়ে?

২. একটি বিশাল সাম্রাজ্যের বিরাট বাহিনী প্রতিপক্ষের একটি ক্ষুদ্র বাহিনীর কাছে কেন পর্যুদস্ত হয় এবং কি সেই রহস্য যা একটি বাহিনীর চলনভঙ্গি (Movement) প্রতিপক্ষের যাবতীয় কূট-কৌশলকে পণ্ড করে দেয়?

৩. কেন অমুক সিপাহসালার খ্যাতিমান ও প্রশংসাধন্য?

যিনি ইতিহাসের এই অংশ অধ্যয়ন করেন তিনি এসব প্রশ্ন এবং এ ধরনের আরো অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন না হয়ে পারেন না।

এসব প্রশ্নের জওয়াব উপাখ্যান কিংবা কিস্‌সা-কাহিনীতে পাওয়া যাবে না। এজন্য এমন সব বই-পুস্তকের প্রয়োজন যা এসব প্রশ্নের সমাধান দিতে পারে। অবশ্য এই সব গ্রন্থকে নতুন পারিভাষিক জটিলতা থেকে মুক্ত রাখতে হবে যাতে করে পাঠকের ধ্যান-ধারণা এসব পরিভাষা আয়ত্ত করতে গিয়ে মূল বিষয় থেকে বিভ্রান্ত হয়ে না পড়ে কিংবা সাহিত্যিক ও শৈল্পিক সূক্ষ্মতা ও খুঁটিনাটির আবর্তে জড়িয়ে না পড়ে। এধরনের পরিভাষা প্রণয়ন এবং তার ব্যবহার এ-জাতীয় গ্রন্থ লেখকদের মনোবল দমিয়ে দেয়। কোন জাতি-গোষ্ঠী ততক্ষণ পর্যন্ত বিজয়ী কিংবা খ্যাতিমান হতে পারেনি যতক্ষণ পর্যন্ত না সে সমর ক্ষেত্রে অবতরণ করে স্বীয় ইতিহাসকে আপন রক্ত-আখঁরে লিখেছে এবং কোন জাতি-গোষ্ঠী ততক্ষণ পর্যন্ত এমনটি করার যোগ্য হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে সমর ক্ষেত্রের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত হয় এবং এই অবহিতি প্রতিরক্ষা স্ট্রাটেজী ও সমরশাস্ত্র সম্পর্কে যথাযথ পরিচিতি লাভের পরই কেবল হাসিল হতে পারে।

উপমহাদেশের ইতিহাসই ধরুন না কেন! রামায়ণ ও মহাভারতের যুগ। সে সময় ভারতবর্ষকে গোটা বিশ্বে বুদ্ধিমত্তা, প্রাচুর্য ও সভ্যতার শীর্ষে স্থান দেওয়া হ’ত। তার নিকট তখন আছে অশ্বারোহী বাহিনী, বিরাট হস্তীবাহিনী আর আছে সর্বোত্তম রথযান। তথাপিও সে বিশ্বজয়ীর আসন লাভে সক্ষম হয়নি। প্রশ্ন জাগে, এমনটি কেন হ’ল? ভারতবর্ষের ধন-সম্পদ ও প্রাচুর্যের কাহিনী তখন বিশ্বময় লোকের মুখে মুখে ফিরছে। ফলে আলেকজাণ্ডার ভারত অভিমুখী হন যাতে করে উজ্জ্বল এই হীরক খণ্ডটিকে তিনি তাঁর রাজমুকুটের শোভা বর্ধনে ব্যবহার করতে পারেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি কিছু সংখ্যক সেনা সহযোগে ভারতবর্ষের দিকে অগ্রসর হন এবং শেষাবধি রাজা পুরুর সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ বাঁধে।

পুরুর ছিল বিশাল সেনাবাহিনী। আর ছিল অসংখ্য হাতী, অশ্বারোহী সৈন্য ও লৌহবর্মে আবৃত বীর রাজপুত পদাতিক বাহিনী। তাঁর সমরাস্ত্র শত্রুর মুকাবিলায় সর্বোত্তম না হলেও একেবারে নিকৃষ্টও ছিল না। সাধারণ লোকের মধ্যে বিশেষ করে রাজপুত যুবকদের মধ্যে ত্যাগের সীমাহীন প্রেরণাও বিদ্যমান ছিল; বীরত্ব ও শৌর্যবীর্য তাদের শিরায় শিরায় মিশে ছিল। পুরুষ তো দূরের কথা, তাদের মহিলারাও মৃত্যুকে ভয় পেত না। কিন্তু রণক্ষেত্র যখন উত্তপ্ত হ’ল, দেখা গেল অভিজ্ঞ ও পারদর্শী পুরু যুবক আলেকজাণ্ডারের নিকট পরাজিত হয়েছেন। এমনটি কেন হ’ল? পুরুর পঙ্গপালের ন্যায় বিরাট বাহিনী আলেকজাণ্ডারের মুষ্টিমেয় ও স্বল্প সংখ্যক অশ্বারোহীর নিকট কেন পরাজিত হ’ল? এর কারণ ছিল এই যে, আলেকজাণ্ডার তাঁর শত্রুর দুর্বলতা কোথায় তা আঁচ করে নিয়েছিলেন। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, এই নওজোয়ান তাঁর পিতা ফিলিপের পক্ষ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে অতি উন্নত মানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি সেনাবাহিনী পেয়েছিলেন। ঐ বাহিনী সংখ্যায় বিরাট বড় ছিল না। কিন্তু ফিলিপ সেটাকে এমনভাবে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন যে, সেই বাহিনীর একটি অংশ যাকে তিনি “রিসালা” (অশ্বারোহী বাহিনী) বলতেন,—এতখানি যোগ্য ও দক্ষ ছিল যে, তা তাঁর সিপাহসালারের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনাকে এমন বিদ্যুৎগতিতে বাস্তবায়িত করতে পারত যে, শত্রু তার আক্রমণের তীব্রতা সহ্য করতে পারত না। ঐ রিসালার সমর-নৈপুণ্য ছিল সেই তীরের মত যা একজন অভিজ্ঞ তীরন্দাযের হাত দিয়ে নিক্ষিপ্ত হয়ে শত্রুর বক্ষ ভেদ করে তাকে চিরতরে খতম করে দেয়। স্থূলদৃষ্টিতে যে সম্পর্ক রয়েছে তীর ও তার নিশানা অর্থাৎ প্রতিপক্ষের দেহের সাথে—ঠিক সেই সম্পর্ক রয়েছে একটি সর্বোত্তম অশ্বারোহী বাহিনী (রিসালা) ও তার প্রতিপক্ষ বাহিনীর সাথে যার উপর এই অশ্বারোহী বাহিনী আপন সুযোগ্য সিপাহসালারের নেতৃত্বে হামলা করে এবং প্রতিপক্ষের কাতার কে কাতার তছনছ করে দেয়। অনন্তরে ঠিক যে মুহুর্তে রাজা পুরুর পদাতিক বাহিনী অত্যন্ত সাহসিকতা ও বীরত্বের সঙ্গে গ্রীক ফৌজকে পিছু হটতে বাধ্য করছিল ঠিক সেই মুহর্তে আলেকজাণ্ডারের অশ্বারোহী বাহিনী প্রচ্ছন্নভাবে অতর্কিতে নদী পার হয়ে পুরুর বাহিনীর পশ্চাদ্দেশ থেকে তার মধ্যখানে উদিত হয়। এই বিদ্যুৎগতিসম্পন্ন গ্রীক অশ্বরোহী বাহিনীর আক্রমণের প্রতিক্রিয়া এই হ’ল যে, পুরুর বাহিনী এর মুকাবিলার তীব্রতা সহ্য করতে পারল না। অন্য কথায়, পুরুর অশ্বারোহী বাহিনী এবং হস্তি বাহিনীকে এমন ট্রেনিং দেওয়া হয়নি যে, তারাও তৎক্ষণাত একত্রিত হয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেদের আক্রমণের গতি পরিবর্তন করতে পারে। পুরুর সেনাবাহিনীর অধিনায়কত্ব ন্যস্ত ছিল ঢিলা হাতে। গ্রীক আক্রমণের তীর তাঁর বক্ষে গিয়ে বিঁধে এবং আলেকজাণ্ডারের সংক্ষিপ্ত ফৌজ প্রবল ভারতীয় বাহিনীকে পরাজিত ও পর্যুদস্ত করে দেয়।

এটি এমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা যেখানে প্রতিরক্ষা বিষয়ক যোগ্যতাকে সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।

আলেকজাণ্ডারের ন্যায় সম্রাট হ্যানিবলও প্রতিরক্ষামূলক যোগ্যতাকে সঠিক এবং কার্যকর পন্থায় ব্যবহার করে রোমক বাহিনীকে ত্ৰিবিয়া এবং কীনের রণক্ষেত্রে পরাজিত করেন, যদিও রোমকদের সৈন্য সংখ্যা ছিল বিরাট ও বিপুল এবং তাদের কাছে অসংখ্য অশ্বারোহী সৈন্যও ছিল। এর মুকাবিলায় হ্যানিবলের অশ্বারোহী বাহিনীর সংখ্যা ছিল এক-চতুর্থাংশেরও কম। এতদসত্ত্বেও হ্যানিবল উক্ত দু’টি যুদ্ধে তাঁর ছোট্ট অশ্বারোহী বাহিনীকে এমনি সফলতার সঙ্গে ব্যবহার করেন যে, রোমক সৈন্যদের পরাজিত হয়ে পালাতে হয়।

এখন প্রশ্ন জাগে, এতবড় বিজয় লাভের পরও কেন হ্যানিবল রোম জয় করতে পারলেন না? শেষ পর্যন্ত তিনি কেবলমাত্র ব্যর্থ হয়েই ফিরেন নি বরং ধ্বংসপ্রাপ্ত হন। এমনটি কেন হ’ল? এর কারণ দু’টি :

(ক) হ্যানিবল অতঃপর যথাসময়ে সাহায্যকারী বাহিনী পাঠান নি, আবার যথেষ্ট পরিমাণ সমরাস্ত্র ও রসদ-সম্ভারও পৌঁছাবার ব্যবস্থা করেন নি। যাও পাঠিয়েছিলেন তা সময়মত পৌঁছে নি।

(খ) হ্যানিবল যেখানে স্বীয় ফৌজের প্রতিরক্ষামূলক যোগ্যতাকে তার প্রতিপক্ষের মুকাবিলায় সর্বোত্তম করে গড়ে তুলেছিলেন সেখানে তিনি এটা চিন্তা করেন নি যে, তাঁর শেষ লক্ষ্যস্থল কি এবং এর পাথেয় কি হওয়া উচিত।

তাঁর শেষ লক্ষ্যস্থল ছিল রোমের কেল্লাগুলো জয় করা। কিন্তু সে গুলো জয় করার জন্য তাঁর নিকট সমরাস্ত্রের ঘাটতি ছিল। অন্য কথায় তিনি পূর্ণ সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন নি এবং সমর- শাস্ত্রের আবশ্যকীয় বিষয়গুলোর ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করেন নি বিধায় তাঁকে ব্যর্থতা বরণ করতে হয়েছে।

উল্লিখিত যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনার পিছনে আমার উদ্দেশ্য এই যে, যখন রাষ্ট্র, জনসাধারণ কিংবা সিপাহসালার বিস্তারিত প্রতিরক্ষা পরিকল্পনাকে তাড়াহুড়ো কিংবা স্থূলদৃষ্টিতে দেখে তখন তাদেরকে ব্যর্থতা বরণ করতে হয়।

১৯১৪ ঈসায়ীতে জার্মানী যখন ফ্রান্সের উপর হামলার ইচ্ছা করল তখন জার্মান সম্রাট কাইজারের সিপাহসালার জেনারেল মলিটিকের জন্য বিরাট ও উত্তম প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী সরবরাহ করা হয়। কিন্তু জার্মানীর সমর পর্যালোচকগণ সুক্ষ্মদৃষ্টি দিয়ে অনেকগুলো দিকের উপর চিন্তা-ভাবনা করলেও এই বিরাট ও বিশাল বাহিনীর প্রতিরক্ষামূলক গতিবিধির গুরুত্বের প্রতি পুরোপুরি মনোযোগ দেন নি। বিশেষ করে তাঁরা এটি চিন্তা করে দেখেন নি যে, যদি যুদ্ধক্ষেত্র প্রাকৃতিক অথবা অন্যবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে দু’টো মোর্চাতেই ছড়িয়ে পড়ে এবং শত্রুর ডান ও বাম পার্শ্বের উপর হামলা করে তাকে তার মোর্চা থেকে বহিষ্কার করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে তখন জার্মান সেনাপতিকে কি করতে হবে? এই ভ্রান্তির পরিণাম এই হ’ল যে, যখন মিত্রবাহিনী মোর্চা বন্দী করে তাকে থামিয়ে দিল তখন তারা অঘোরে জীবন দিতে শুরু করে। এত মূল্যবান জীবন কুরবানী তারা বেশীক্ষণ দিতে পারে নি (আর তা দেওয়াও সম্ভব নয়) বিধায়, তারা শেষ পর্যন্ত থেমে পড়ে।

মিত্রশক্তিও জার্মানদের এই সমরশাস্ত্র ও রণনীতির প্রতিক্রিয়া সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে না দেখেই এর পুনরাবৃত্তি করে। ফলে মিত্রশক্তিকেও সীমাহীন জীবনহানির সম্মুখীন হতে হয়। যেহেতু জার্মানী (মিত্রশক্তির তুলনায়) একটি ছোট্ট দেশ, সে জন্য সে বেশীক্ষণ কুরবানী দিতে পারেনি! তাই শেষ পর্যন্ত সে অবসন্ন ও পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে।

যেহেতু জার্মানী ছাড়া সারা বিশ্বের প্রতিরক্ষা পর্যালোচকগণ শেষ বিজয়ের নেশায় ছিলেন মত্ত, সেহেতু তারা বিশ্বযুদ্ধের পর এই ভুল তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন যে, আগামী যুদ্ধগুলো মোর্চার আড়াল নিয়েই লড়া হবে এবং এভাবে কয়েক বছরের সামরিক দীর্ঘসূত্রিতা তথা দীর্ঘ দিন যাবত পরিচালিত যুদ্ধের কারণে যে রাষ্ট্রের নিকট সমর-সম্ভার কম হবে স্বভাবতই সে হেরে যাবে।

প্রকৃতপক্ষে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ এবারও অবস্থার সঠিক পরিমাপ করতে ব্যর্থ হন। ফ্রান্স মেজিনিউ লাইন বানায়। বেলজিয়াম ও হল্যাণ্ড মোর্চাবন্দীতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে। কিন্তু ১৯৩৯ ঈসায়ীতে জার্মানী যেহেতু পূর্বকৃত ভুল ধরতে পেরেছিল তাই সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার সংস্কারিত ও পরিশুদ্ধ নমুনা-মাফিক খুবই সাফল্যের সঙ্গে লড়ে। যদি মিত্রশক্তিও এই যুদ্ধের সঠিক ফলাফল অনুধাবন করতে পারত তাহলে তারা দেখতে পেত যে, জার্মানীর ১৯১৪-১৮ ঈসায়ীর হামলা ছিল সম্রাট হ্যানিবল অথবা অন্য কোন আক্রমণকারীর সেই হামলা মাফিক যে মেঠো জেতা তো জিতেছে, কিন্তু মযবুত দুর্গ-প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলবার মত যথেষ্ট সমর-সম্ভার যার ছিল না। যেখানে অতীতে ভারতবাসী হাতির সাহায্যে দুর্গ ভাঙত সেখানে আরবীরা ভাঙত মিনজানীক নামক প্রস্তর নিক্ষেপকারী কামান দ্বারা। জার্মানী ১৯৪০ ঈসায়ীতে ট্যাংক নির্মাণ করে। এর আবিষ্কারক ও উদ্ভাবক যদিও বৃটেন, কিন্তু সে এই মা’সূম বাচ্চাকে জার্মানীর হাতে বিক্রয় করে দেয় এবং জার্মানী একে দ্বিতীয় বিশ্ব-সমরে ব্যবহার করে। এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, প্রতিরক্ষা কৌশলের মূলনীতি যথার্থই প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ—

১. লড়াই সাধারণত একটি বড় এলাকায় হয়ে থাকে যেখানে সৈন্যদল সুদৃঢ় কেল্লা এবং মোর্চা ইত্যাদির উপর হামলা করে। তখন যে ফৌজ প্রতিরক্ষামূলক গতিবিধির যোগ্যতাকে যথারীতি কায়েম রাখে তারাই প্রতিপক্ষের উপর আধিপত্য বিস্তার করে। ১৯১৪-১৮ ঈসায়ীর লড়াই থেকে সাধারণত প্রতিরক্ষা পর্যালোচকগণ এজন্য ভুল শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন যে, শেষ বছরগুলোতে বিশ্বযুদ্ধ একটি কেল্লা ধ্বংসকারী লড়াইয়ের রূপ নিয়েছিল। আর যখন মিত্রশক্তির ফৌজ ট্যাংক, তোপখানা ও বিমান বহরের সাহায্যে জার্মানীর ফৌজী শক্তিকে দুর্বল করে দিয়ে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে তখনই তারা সম্মুখ পানে এগিয়ে যায়। এরপরও এই সব প্রতিরক্ষা পর্যালোচকগণ সঠিক সিদ্ধান্ত উদ্ভাবনে ব্যর্থ হন। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, যুদ্ধের ময়দানে হুঁশিয়ার ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী সিপাহসালার স্বীয় শত্রু মোর্চার উপর হামলা করবার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেন এবং প্রতিপক্ষের দুর্বল অংশের উপর কার্যকর আঘাত হেনে তাকে পেছপা করতে পারেন।

২. যে ফৌজের সিপাহসালার শত্রু ফৌজের মুকাবিলায় উত্তম গতিবিধির যোগ্যতা হাসিল করেন অর্থাৎ যিনি আপন গতিশীল ও সচল ফৌজকে যেখানে ইচ্ছা নিয়ে গিয়ে শত্রুর উপর প্রচণ্ড বেগে ও পূর্ণ শক্তিতে হামলা করতে পারেন—বিজয় ও সাফল্য তাঁরই পদচুম্বন করে।

যে ফৌজ সচল ও সক্রিয়— ট্যাংক, মোটর, অশ্বারোহী বাহিনী, বিমান এবং অন্যান্য সমরাস্ত্র— যেমন তোপখানা, এটম বোম ইত্যাদি যার অন্তর্ভুক্ত এবং এই সব সমরাস্ত্রের সঠিক ব্যবহার যে জানে, সাফল্য সাধারণত তাদেরই সাথী হয়। কেননা এই সব সমরাস্ত্র আক্রমণের পথে প্রতিবন্ধকতাকে দূর করতে এবং কেল্লা দখল করার কাজে সাফল্যের সাথে ব্যবহার করা যেতে পারে। এভাবে শত্রুকে সচল ও সক্রিয় থেকে অচল ও নিষ্ক্রিয় করা যেতে পারে এবং তার সাহস ও মনোবল দুর্বল করা যেতে পারে।

এখন আমি আপনাদের সামনে মুহাম্মদ বিন কাসিমের কয়েকটি যুদ্ধ তুলে ধরব যাতে করে আমরা ঐ সুযোগ্য ও সফল জেনারেলের সমর কৌশল বুঝিয়ে দিয়ে সমরশাস্ত্রের মূলনীতির গুরুত্ব সঠিকভাবে উদ্ভাসিত করতে পারি।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের বুনিয়াদী সমরনীতি

মুহাম্মদ বিন কাসিমকে আপনারা গল্প-কাহিনীর মাধ্যমে অবশ্যই জানেন। কিন্তু এখন আমরা এই যোগ্যতম জেনারেলকে তাঁর আসল রূপে পেশ করছি যাতে তাঁর প্রদর্শিত সামরিক কলা- কৌশল ও কর্মপন্থা থেকে উপকৃত হওয়া যায়। আমরা এই গ্রন্থে আপনাকে পারিভাষিক জটিলতার মধ্যে জড়াব না, বরং আমরা আমাদের দাবীকে ঐতিহাসিক ঘটনাবলী দ্বারা প্রমাণ করব এবং এভাবে সেই প্রতিরক্ষাগত শিক্ষা আপনার মস্তিষ্কে গেঁথে দেব যা ঐ সব ঘটনার মধ্যে নিহিত রয়েছে।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের জীবনী পাঠে আপনি অনুভব করবেন যে, সমরশাস্ত্রের এই অভিজ্ঞ জেনারেল প্রতিরক্ষা বিষয়ক নীতি বাস্তবায়নে কারো মুখাপেক্ষী হন নি, বরং অত্যন্ত নির্ভীক ও সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিটি ক্ষেত্রে একক ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কৰ্মপদ্ধতি অবলম্বন করে শত্রুর প্রতিরক্ষা কূটচাল ব্যর্থ করে দিয়েছেন। তিনি স্বীয় বাহিনী নিয়ে সেই স্থানেই পৌঁছেছেন যে স্থান সম্পর্কে শত্রুর ধারণা ছিল যে, আরব বাহিনীর পক্ষে সেখানে পৌঁছা মোটেই সম্ভব নয়।

সমরশাস্ত্রের এই মূলনীতিকে এই অটুট মনোবলসম্পন্ন, নির্ভীক ও যোগ্য সিপাহসালার শত্রুর নৈতিক দুর্বলতা কিংবা ভীরুতার কারণে নতুন রূপে ও নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজিয়েছেন।

প্রতিরক্ষার অগ্রগতিমূলক ইতিহাস

ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে, সর্বাগ্রে ফিরআওন নিয়মিত সেনাবাহিনী গঠন করেন। এ প্রায় খৃস্ট-পূর্ব বিশ শতাব্দীর আগের ঘটনা। ফিরআওন স্বীয় মিসরীয় ফৌজ (যা প্রধানত যঙ্গী ও হাবশী সেনা নিয়ে গঠিত ছিল)-এর সাহায্যে প্রথমে লোহিত সাগর উপকূলে অবস্থানরত জাতি-গোষ্ঠীকে পদানত করেন। অতঃপর আসিরিয়, ব্যাবিলনীয়, ফিনিকীয়, গ্রীস প্রভৃতি দেশের সরকার- গুলোকে পরাস্ত করে আপন আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য করেন।

প্রাচীন ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, যুদ্ধক্ষেত্রে ঐসব ফৌজী সিপাহীকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সোজা পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হ’ত। প্রথম কাতারের পর দ্বিতীয় কাতার, অতঃপর তৃতীয় ও চতুর্থ কাতার। এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্ভবত তাই ছিল যা ছিল ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত কার্যকর। অর্থাৎ সশস্ত্র লোকদের একটি দেওয়াল খাড়া করে দেওয়া হ’ত যা শত্রুর হামলার সময় একটি লৌহ প্রাচীরের কাজ দিত। এর ভেতর দিয়ে শত্রুর পদাতিক কিংবা অশ্বারোহী বাহিনী প্রবেশ করে একে ছিন্ন ভিন্ন করতে পারত না। যুদ্ধের সময় এই ফৌজ আক্রমণ ও পশ্চাদ্ধাবন করতে করতে সম্মুখে অগ্রসর হ’ত। তারা সড়ক ঢালাইকারী ইঞ্জিনের ন্যায় শত্রু সৈন্যকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে সম্মুখে অগ্রসর হ’ত। শত্রু সৈন্যের প্রতিরোধকে যখন এভাবে পিষে ফেলা হ’ত তখন ময়দানও পরিষ্কার হয়ে যেত। সেই যুগের ফৌজ ছিল অধিকাংশই পদাতিক; অধিনায়ক কেবল আরোহী হতেন। অবশ্য সেই যোদ্ধাও আরোহী হতেন যিনি ঘোড়া, রথ, হাতী অথবা উষ্ট্রপৃষ্ঠে আরোহণ করে শত্রু ফৌজের শৃংখলা বিক্ষিপ্ত ও বিনষ্ট করার কাজে নিয়োজিত থাকতেন। তখন একটি পদাতিক বাহিনীতে সাধারণত চার হাযার সৈন্য থাকত।

মেসিডোনিয়ার রাজা ফিলিপস্ (Philips) তাঁর ফৌজকে নতুন প্রশিক্ষণ দেন। তিনি পদাতিক ফৌজের ছোট ছোট রেজিমেন্টগুলোকে ছোট ছোট অধিনায়কদের নেতৃত্বে দিয়ে দেন। পদাতিক বাহিনীর একটি রেজিমেন্টে ছয় হাযার সৈন্য থাকত। ফিলিপ্‌স পুত্র আলেকজাণ্ডার পদাতিক বাহিনীর এই সংখ্যা বাড়িয়ে বার হাযারে উন্নীত করেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে লড়বার জন্য আলেকজাণ্ডার পদাতিক বাহিনীকে এমনভাবে বিন্যস্ত করেন যে, প্রথম কাতারের সৈন্যরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঘন নিবিড় হয়ে থাকত। প্রতিটি জওয়ানের নিকট ছ’ফুটের মত লম্বা ভালা থাকত যার মস্তক সংলগ্ন থাকত লৌহশলাকা নির্মিত অস্ত্ৰ।

দ্বিতীয় কাতারের সিপাহীদের নিকট পয়লা কাতারের সিপাহীদের চাইতে অধিকতর লম্বা ভালা থাকত, যা পয়লা কাতারের লোকদের কাঁধের উপর দিয়ে সামনে বের হয়ে থাকত। এভাবেই তৃতীয় কাতারের ভালা পয়লা এবং দ্বিতীয় কাতারের সিপাহীদের ভালার চাইতে অধিকতর লম্বা হ’ত। শেষ কাতারের সিপাহীদের নিকট যে বল্লম থাকত তা প্রায় চব্বিশ ফুট লম্বা হ’ত। এভাবে আলেকজাণ্ডার তাঁর বাহিনীকে এমন একটি লৌহ প্রাচীররূপে খাড়া করতেন যা সচল হয়ে আগেও অগ্রসর হ’তে পারত। এটা ছিল বল্লমের এমন একটি জঙ্গল যার ভেতর দিয়ে মানুষ কিংবা অন্য কোন পশুর পক্ষে অতিক্রম করাটা ছিল প্রায় অসম্ভব।

এতদ্ভিন্ন ফিলিপ্‌স আরোহী বাহিনী অর্থাৎ রিসালা তৈরী করেন যারা পৃথকভাবে নয় বরং সংঘবদ্ধভাবে শত্রুর উপর হামলা করতে পারত। এটাই ছিল সেই হাতিয়ার যার সাহায্যে আলেকজাণ্ডার ভারতবর্ষের রাজা পুরুকে পরাজিত করেন। তিনি লৌহবেষ্টনী দ্বারা সুরক্ষিত এই হিন্দু রাজার হাতী, রথ, ঘোড়া ও বলদসমূহের ঘেরাওকে ভেঙে-চুরে তছনছ করে দিয়েছিলেন। যদি পুরু তাঁর ফৌজের পশ্চাদ্ভাগকেও সুরক্ষিত করতেন এবং তাঁর হাতী ও রথকে হামলার পর অথবা হামলাকালীন সময়ে নতুন নতুন দিক-অভিমুখে ঘুরাবার ব্যবস্থা রাখতেন তাহলে আলেকজাণ্ডার কি বিজয়ী হতে পারতেন? এটি এমন একটি প্রশ্ন যার জওয়াব বিভিন্ন অবস্থা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার পর অকাট্য ‘না’ ছাড়া আর কিছুই হবে না।

ফিলিপ্‌সই ‘মিনজানীক’ আবিষ্কার করেছিলেন।

ইসলাম-পূর্ব আমলে রোমক ফৌজের সংগঠন ও বিন্যাস

গ্রীকদের পর যখন রোমকরা ক্ষমতা লাভ করল তখন তারা পদাতিক বাহিনীর কাতার এভাবে বিন্যস্ত করেন :

(ক) প্রথম কাতারে তারা যুবক ও তরুণদের এনে দাঁড় করান।

(খ) দ্বিতীয় কাতারে এমন সব লোক এনে দাঁড় করান যাদেরকে আমরা অর্ধবয়সী বলতে পারি তা বয়সের বিচারে হোক অথবা— অভিজ্ঞতার দিক দিয়েই হোক।

(গ) তৃতীয় কাতারে তারা সমর কুশলী ও রণনিপুণ বীরদেরকে এনে দাঁড় করান।

এই বিন্যাসের দ্বারা সম্ভবত তাদের এই অভিপ্রায় ছিল যে, অভিজ্ঞ সিপাহী যুবকদের পৃষ্ঠপোষকতা করবে। তাছাড়া অনভিজ্ঞ তরুণ সিপাহীরা ঘাবড়ে গিয়ে কিংবা রক্তপাত ও হানাহানির ভীতিকর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে পৃষ্ঠ প্রদর্শনের সুযোগ পাবে না।

পদাতিক বাহিনীর সামনে আরোহী বাহিনী থাকত। তাদের নিকট হাতিয়ার হিসাবে থাকত তলোয়ার ও বল্লম। এই পদাতিক বাহিনী গোটা পল্টনের মুহাফিজ (রক্ষক) হ’ত।

ইসলাম-পূর্ব আমলে ইরানী ফৌজের সংহতি বিশ্বাস

ইরানী ফৌজের বিন্যাসও প্রায় এমনটিই হ’ত। ইসলামের সূচনা-পর্বের কিছুকাল পূর্বে ইরানী ও রোমকরা নিজ নিজ ফৌজকে বিভিন্ন রেজিমেন্টে ভাগ করেছিল। একটি রেজিমেন্টের সৈন্য সংখ্যা হ’ত দশ থেকে বার হাযার। রোমক রেজিমেন্টের অধিনায়ককে বলা হ’ত “বাৎরীক”। বাৎরীকের অধীনে দু’জন অধিনায়ক “তুমার খান” নামে আভহিত হতেন এবং প্রতি তুমার খানের অধীনে পাঁচ হাযার সিপাহী এবং পাঁচ জন “তুনজারিয়া” থাকতেন। প্রতি তুনজারিয়া এবং “কূস” দু’শ পদাতিক সৈন্যবিশিষ্ট হতেন। কুসের অধীনে চারজন “কুমতারাহ” এবং কুমতারাহর অধীনে কয়েকজন “দামরাখ” থাকতেন। প্রতি দামরাখের অধীনে থাকত দশজন সৈনিক।

উপরিউক্ত ব্যবস্থাপনায় একটি বাহিনী একক থাকার পরিবর্তে খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যায়। কেননা প্রতিটি খণ্ড নিজ নিজ অধিনায়কের অধীনেই লড়াই করত।

রোমকরা গ্রীকদের অনুকরণ করে আরোহী বাহিনীকে একটি আলাদা বাহিনী হিসাবেই রাখে। কিন্তু তারাও যুদ্ধক্ষেত্রে আরোহী বাহিনীকে পদাতিক বাহিনীর সামনে এনে দাঁড় করায় যাতে এরা পদাতিক বাহিনীর দেখাশুনা করতে পারে। ইরানীরা সূচনাকালে তাদের ফৌজকে এভাবে বিন্যস্ত করে যে, প্রতিটি রেজিমেন্টের সিপাহসালারকে—যিনি আমীর শ্রেণীর হতেন, “মীর-ই- মীরান” নামে ডাকা হ’ত।

মীর-ই-মীরানের অধীনে চারজন অফিসার থাকতেন যাকে “আস্পাহাদ” বলা হ’ত। আস্পাহাদের অধীনে চারজন “মারযুবান” থাকতেন এবং প্রত্যেক মারযুবানের অধীনে থাকতেন চারজন অধিনায়ক আর প্রত্যেক অধিনায়কের অধীনে আরোহী বাহিনীর দশজন ও পদাতিক বাহিনীর পাঁচজন সৈনিক থাকতেন। তাদের হাতিয়ার ছিল তলোয়ার, নেযা, বল্লম, মিনজানীক এবং তীর। রোম এবং ইরানে নিয়ম ছিল যে, বৎসরে একবার নির্দিষ্ট সময়ে সকল ফৌজ বাদশাহ কিংবা সর্বাধিনায়কের সম্মুখ দিয়ে এভাবে অতিক্রম করতেন যে, সর্বাগ্রে সর্বাধিনায়ক সওয়ার হতেন। তাঁর পাশাপাশি একজন ক্রীতদাস থাকত। সর্দার তাঁর যেরা, খোদ, দস্তানা, চার আয়না এবং জওশন পরিহিত থাকতেন এবং অশ্বপৃষ্ঠে লৌহ চাদর ঘেরার ন্যায় পড়ে থাকত। একে “বরকিস্তাওয়ান” বলা হ’ত। সর্দারের পর তাঁর ফৌজ সকল প্রকার অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাস্তা অতিক্রম করত। আরোহী বাহিনীর সৈনিকের থাকত ঢাল, নেযা, গুর্য, রশি, তুবরা, লৌহ নির্মিত মিনজানীক, বাগডোর (ঘোড়া বাঁধবার জন্য), নাগের থলি, সূচ, কাঁচি, হাতুড়ী (ঘোড়ার পায়ে নাল মারার জন্য), কাড়, লুবনা সওয়া, তূণীর, কম্বল (মুড়ি দেবার জন্য), চড়ানো কামান এবং দুটো ফালতু কামান। প্রতিটি আরোহীর ক্রীতদাসের নিকট একটি ফালতু তূণীর থাকত। এই প্রদর্শনী থেকে জানা যেত, আরোহী, অধিনায়ক এবং তাদের ক্রীতদাসের নিকট সাজ-সরঞ্জাম সঠিক অবস্থায় আছে কি না।

এই সব অবস্থা বর্ণনা করার পেছনে আমাদের উদ্দেশ্য এই যে, যদিও ভারতীয় ও ইরানীদের বন্ধুত্ব অনেক কাল অটুট ছিল, কিন্তু ভারতীয় ফৌজের নিয়ম-শৃংখলার উপর ইরানী ফৌজের শাসন- শৃংখলার গভীর প্রভাব পড়েনি—যদিও সমরাস্ত্র নির্মাণে ভারতীয়রা অনেক অগ্রসর ছিল। ভারতীয় ফৌজ স্বীয় ভূখণ্ড থেকে বহির্গত হয়ে বহিঃরাষ্ট্রের উপর আক্রমণোদ্যত হয়নি বিধায় তারা অপরের সমরশাস্ত্র অনুধাবন করবার কষ্ট স্বীকারে যেমন রাযী হয়নি, তেমনি তাদের বন্ধুত্ব থেকে উপকৃত হতেও চেষ্টা করেনি—এমতাবস্থায় যে, কয়েকজন রাজার দরবারে ইরানী ও আরব বংশোদ্ভূত লোকেরা অধিনায়ক পদে চাকুরীও করত।

ইসলাম-পূর্ব আমলে আরব ফৌজ

ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরব জাতি বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। তাদের কোন নিয়মিত সেনাবাহিনী ছিল না। কখনো যুদ্ধ-বিগ্রহ দেখা দিলে গোত্রের লোকেরা নিজ নিজ হাতিয়ার এবং যার যার সওয়ারীসহ যুদ্ধ করবার জন্য বেরিয়ে পড়ত। খোলা ময়দানই হ’ত তাদের যুদ্ধক্ষেত্র। আর যে গোত্রের নিকট ভাল ঘোড়া কিংবা উষ্ট্রারোহী ও যোদ্ধা অধিক সংখ্যায় থাকত সেই গোত্রই অন্যদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করত। অশ্বারোহী সৈন্যের নিকট তলোয়ার, বল্লম, তীর ধনুক ইত্যাদি অস্ত্র থাকত।

অবশ্য আরবদের কতিপয় পরিবার যারা ইরান সীমান্তে বসতি স্থাপন করেছিল—তারা বেশ প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করে নিয়ে ছিল।

তারা ছিল ‘তুব্বা’-র বাদশাহ হামীর গোত্রের রঈসকুল এবং “মুনযির” সুলতানগণ। মুনযির গোত্রের বাদশাহদের রাজধানী ছিল “হীরা”।

মরুবাসী আরবদের সমর-পদ্ধতি ছিল একই ধরনের অর্থাৎ অতর্কিতে হামলা করা কিংবা রাত্রিকালে আকস্মিকভাবে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়া। এতে যদি তাৎক্ষণিক জয়লাভ ঘটে যায় তাহলে লুটপাট করে নিজ আবাস স্থলে ফিরে আসা। অন্যথায় দুই একটা সংঘর্ষের পরই উভয়পক্ষ পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে যেত। যুদ্ধের প্রথম অথবা দ্বিতীয় দিন উভয় পক্ষের ফৌজ যখন সজ্জিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে যেত তখন যুদ্ধক্ষেত্রকে উত্তপ্ত করে তোলার জন্য দু’পক্ষের এক একজন দুঃসাহসী আরোহী কিংবা পদাতিক সৈনিক নিজ নিজ প্রতিপক্ষকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে এগিয়ে আসার জন্য চীৎকার করে আহ্বান জানাত। এই যুদ্ধ চলাকালে উভয় ফৌজই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে এ দু’জনের রণনৈপুণ্য প্রত্যক্ষ করত। এদের একজন নিহত হবার পর তার বাহিনীর অন্য কেউ নিহতের বদলা নেবার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হ’ত। কোন সময় এমনও হ’ত যে, যখন এক পক্ষের ফৌজ দেখতে পেত যে, তাদের বীরযোদ্ধা পরাভূত হতে চলেছে তখন তাদের গোটা ফৌজ কিংবা তার কিছু অংশ প্রতিপক্ষের উপর হামলা করে বসত। কখনো এমন হ’ত যে, একজন নামকরা সর্দার দ্বন্দ্ব যুদ্ধে মারা যাবার পর পর তার ফৌজ হার মেনে পালিয়ে যেত। খালিদ বিন ওয়ালীদ (রা) শত্রুর উপর ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করবার জন্য প্রায়ই শত্রুর নামকরা সর্দারকে স্বীয় যোগ্য ও বীর অশ্বারোহী সৈনিকের সঙ্গে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে লাগিয়ে পরপারে পাঠিয়ে দিতেন। কয়েকবার তিনি নিজেও দ্বন্দ্ব যুদ্ধে অবতরণ করেছেন।

ফৌজী বিন্যাস ও সংগঠনে আঁ-হযরত (সা)-এর নতুন উদ্ভাবন

আঁ-হযরত (সা) মুজাহিদদেরকে নতুনভাবে প্রশিক্ষণ দান করেন। তিনি তাদেরকে শুধু সমরাস্ত্র ব্যবহার করার ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞ করে তেলেন নি, বরং রাত দিন চলে সাধারণ সড়ক পথ কিংবা দূরতিক্রম্য রাস্তা দ্রুততার সঙ্গে পার হবার যোগ্যও বানিয়ে দেন। তিনি ফৌজী রেজিমেন্টকে নিজ অধিনায়কের নেতৃত্বাধীনে বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে লড়ার কৌশল শিক্ষা দেন। তিনি ফৌজের চলাচল ও গতি-বিধিকে (শান্তিকালীন কিংবা যুদ্ধকালীন যে কোন সময়েই হোক) এমনি সুশৃঙ্খল বানিয়ে দেন যে, মুসলিম ফৌজ তাদের সিপাহসালারের মৌখিক নির্দেশ কিংবা ইশারা-ইঙ্গিতে বিভিন্ন ধরনের ফৌজী কুটচাল মাফিক সুশৃঙ্খল ও ঐক্যবদ্ধভাবে চলাচল করতে পারত।

তিনি মুজাহিদদেরকে ছোট-বড় কোম্পানী ও প্লাটুনে ভাগ করেন। অতঃপর এইসব ছোট ছোট প্লাটুনকে মিলিত করে এমনভাবে একাত্ম করেন যে, যুদ্ধ অথবা শান্তিকালীন সময়ে তারা নিয়ম-শৃঙ্খলার সাথেই জীবন যাপন করত। যখন মুজাহিদবৃন্দ জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ্‌র জন্য জমায়েত হ’ত তখন রসূল (সা) (অতঃপর খুলাফায়ে রাশেদীনও) এই জমায়েত পরিদর্শন করতেন। দুর্বল ও অল্পবয়স্ক মুজাহিদকে ফিরিয়ে দেওয়া হ’ত। বাকী যারা থাকত তাদেরকে নিয়ম-কানুন ও শৃঙ্খলা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হ’ত। যুদ্ধের অনুশীলন ধারাবাহিকভাবে করানো হ’ত। কেবল সেই দিনই নয় বরং ছাউনী থেকে যাত্রা শুরু করার পরও শত্রুর মুকাবিলায় ও সংঘর্ষকালীন সময় এই প্রশিক্ষণ ধারা অব্যাহত থাকত। যখনই মওকা মিলত—যুদ্ধক্ষেত্রেও সমস্ত মুজাহিদকে বরাবরের ন্যায় সামরিক নির্দেশাদি প্রদান করা হ’ত।

মুজাহিদ ভর্তি এবং গণীমতের মাল বণ্টন পদ্ধতি

মুসলমানদের সর্বপ্রথম সিপাহী (মুজাহিদ) ছিলেন মুহাজিরগণ। কিন্তু মদীনায় আগমনের পর অনেক আনসার এতে শামিল হন। পরবর্তীকালে মক্কা বিজয় পর্যন্ত অধিক সংখ্যক মুজাহিদই ছিলেন মদীনার অধিবাসী। অতঃপর বিভিন্ন গোত্রের সাহাবী (রা) এবং নও-মুসলিম জিহাদের উদ্দেশ্যে ইসলামী পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। আঁ-হযরত (সা) স্বয়ং এই ফৌজের নেতৃত্ব দিতেন। তাঁর অধীনে বিভিন্ন সেনানায়ক থাকতেন। আঁ-হযরত (সা) এবং হযরত আবূ বকর (রা)-এর যুগে যখন যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং শত্রু বাহিনীর সংখ্যা বাড়ল তখন মুসলিম মুজাহিদ বাহিনীর সংখ্যাও বাড়ানো হ’ল। এই সব মুজাহিদকে রসূল (সা) আপন আপন গোত্র ও পরিবার অনুযায়ী ভাগ করে দেন। তখনো কোন নিয়মিত বাহিনী ছিল না। যখন প্রয়োজন দেখা দিত তখন রসূলুল্লাহ (সা) ও খুলাফায়ে রাশেদীন মসজিদে খুতবা প্রদানের মাধ্যমে জিহাদের জন্য স্বেচ্ছাসেবক আহ্বান করতেন। এদের কোন বেতন কিংবা পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হ’ত না, শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি ও বেহেশত লাভের সুসংবাদ দেওয়া হ’ত। অবশ্য জয়লাভের পর গনীমতের মাল (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) বিশেষ মূলনীতির ভিত্তিতে তাদের মধ্যে বন্টন করা হ’ত। এ ছিল জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ, ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য সাধন কিংবা লাভালাভের প্রশ্ন এর সাথে কখনো জড়িত ছিল না। বংশ ও গোত্র অনুসারে বাহিনীকে ভাগ করে দেওয়া হ’ত। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়, বনী উমাইয়া আমলে বসরার সেনাদলের পাঁচটি ভাগ ছিল যাকে ‘খুম্মাস’ বলা হ’ত। প্রতিটি ভাগের (  অংশ) মধ্যে একটি গোত্র নিম্নলিখিত গোত্রগুলোর মধ্য থেকে হ’ত :

ইয্‌দ, তামীম, বকর, ‘আবদুল কায়স, আহ্‌ল-ই-আলিয়া (অর্থাৎ কিনানা, কুরায়শ, ইয্‌দ, সুজায়লা, খাছআম, কায়স, আয়লানের সকল পরিবার, মুযায়না)। কুফার অধিবাসীদেরকে আহ্‌ল-ই-মদীনা বলা হ’ত। অবশ্য সকল অবস্থায় আরোহী এবং পদাতিক বাহিনী আলাদা আলাদা হ’ত। এসব আরোহী ও পদাতিক বাহিনীকে পরস্পরের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হ’ত না।

প্রতিটি এক-পঞ্চমাংশের উপর এই সব গোত্রের আমীর-উমারা থেকে একজনকে আমীর বা সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হ’ত। এই পন্থা গোটা বাহিনীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। বাহিনীর অধিনায়ক পদে সাধারণত সাহাবা কিংবা নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্য থেকে কাউকে মনোনীত করা হ’ত।

হযরত উমর (রা)-এর ফৌজী সংগঠনও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি

হযরত উমর (রা)-এর খিলাফত আমলে সবুজ শ্যামল এলাকা অবধি ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হলে আমীরুল-মু’মিনীন ঘোষণা দেন যে, বিজিত এলাকায় মুজাহিদরা কৃষিকর্মে লিপ্ত হবে না, জায়গা-জমিও খরিদ করবে না এবং স্থায়ীভাবে বসবাসও করবে না। কেননা এতে তারা আরামপ্রিয় ও সুবিধাভোগী হয়ে উঠবে। অবশ্য জীবিকার প্রয়োজন সম্মুখে রেখে তিনি এই ঘোষণাও দেন যে, প্রতিটি আমীর ও সিপাহী এবং তাদের সন্তানদের জন্য ভাতা নির্ধারণ করে দেওয়া হ’ল। এটাও একটা বিখ্যাত ঘটনা যে, হযরত উমর (রা) ইরাক থেকে প্রত্যাবর্তনকালে এই মর্মে নির্দেশ জারী করেছিলেন যে, মুসলিম ফৌজকে সেখান থেকে এমন এক জায়গায় স্থানান্তরিত করা হোক যেখানকার মৌসুম ও পরিবেশ হেজাযের অনুরূপ। স্থানটি ছিল কুফা। পরবর্তীকালে কুফা ফৌজী ক্যাম্প থেকে সৈন্য ছাউনি এবং সৈন্য ছাউনি থেকে বিরাট বড় শহর, অতঃপর দারুল-খুলাফা বা রাজধানীতে পরিণত হয়।