সংক্ষিপ্তসার
প্রতিরক্ষামূলক শিক্ষা, উত্থাপিত অভিযোগসমূহ এবং এর জওয়াব
এখানে সর্বাগ্রে এই প্রশ্ন দেখা দেয় যে, এটি কি চাচা (হাজ্জাজ) এবং ভাতিজা (মুহাম্মদ বিন কাসিমের) একক সিদ্ধান্ত (تهور) ছিল না যে, এত বড় মহারাজার বিরুদ্ধে মাত্র কয়েক হাজার সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হলেন? যার ফৌজ সর্বতোভাবে অস্ত্রসজ্জিত ছিল, যার রাজ্য ছিল খুবই সম্পদশালী, আর তাঁর রাজধানীর মুহাফিজ ও তত্ত্বাবধায়ক ছিল মযবুত দুর্গ; আর মুসলিম বাহিনী এসেছিল তাদের স্বদেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে যেখানে সাহায্য ও রসদ-সম্ভার পৌঁছানো ছিল এক দুরূহ ব্যাপার।
এ প্রশ্নের জওয়াবে আমরা মশহুর প্রতিরক্ষা পর্যালোচক লীড ল হার্ট-এর গ্রন্থ থেকে তাঁর মতামত উদ্ধৃত করছি।
“এসব সত্ত্বেও যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা থেকে একটি তত্ত্ব প্রমাণিত হয়েছে যে, ফৌজের বিরাটত্ব কিংবা দামী ও মূল্যবান অস্ত্রশস্ত্র প্রকৃতপক্ষে ততখানি গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতখানি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে থাকেন এগুলোকে হুকুমতের আমীর উমারা ও জেনারেলগণ। অর্থাৎ এসব লোক তাদের প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রের শক্তির পরিমাপ ফৌজের সংখ্যা দিয়ে নির্ধারণ করে থাকেন। তথাপি এটাও স্বাভাবিক ব্যাপার যে, জনসাধারণ ঐ সব নেতারই মতামত দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একই সুরে কথা বলে থাকে। কারণ সংখ্যা শক্তির ভিত্তিতে শক্তির পরিমাপ করা খুবই সহজ, কিন্তু সেনাবাহিনীর যোগ্যতার পরিমাপ করা তত সহজ নয়। এ সংখ্যার ভিত্তিতেই সরকার জনসাধারণকে প্রভাবিত করে ফৌজের সংখ্যা বৃদ্ধি করবার জন্য রাযী করিয়ে নেয় এবং এভাবে জনসাধারণের কাছ থেকে সর্বপ্রকার ট্যাক্সের বর্ধিত হার নির্বিবাদে আদায় করে থাকে।
“বস্তুতপক্ষে কোন দেশের প্রতিরক্ষাগত সঠিক ভারসাম্য নির্ভর করে তার ফৌজের যোগ্যতার উপর এবং এই যোগ্যতা ফৌজের অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার, তার চলাচল ও গতিবিধি, সহ্য ক্ষমতা, একাগ্রতা, শৃঙ্খলা ও বিন্যাসের মত কয়েকটি জটিল বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভরশীল। ফৌজের অধিনায়ক যদি উপযুক্ত যোগ্যতার অধিকারী না হন তাহলে ফৌজ হবে সেই রেলগাড়ীর মত, যার ইঞ্জিন বেকার ও অথর্ব।”
আমরা যখন উপরিউক্ত বর্ণনার সঙ্গে মুহাম্মদ বিন কাসিম সম্পর্কিত ঘটনাবলীর তুলনা করি তখন মূল বিষয়টি বুঝে নিতে আর কোন অসুবিধা হয় না।
আমরা যদি রসূল করীম (সা)-এর প্রতিরক্ষা কৌশলের দিকে মনোনিবেশ করি তাহলে আমাদের এ সিদ্ধান্ত আরও নির্ভুল বলে মনে হয়। আর রসূল (সা)-এর প্রতিরক্ষা কৌশলের ঘটনাবলী লীডল হার্ট-এর গ্রন্থ রচনার আগেই সংঘটিত হয়েছিল।
সমরনীতিতে মুহাম্মদ বিন কাসিম আঁ-হযরত (সা)-এর পরিপূর্ণ অনুসরণ করেছেন। তিনি মুজাহিদবৃন্দকে প্রশিক্ষণ দিয়ে মনোবল-সম্পন্ন, নির্ভীক এবং একদেহ একপ্রাণে পরিণত করেন। তিনি তাদের মধ্যে খুদী তথা ব্যক্তিত্বের অনুভূতি জাগ্রত করেন। জিহাদী প্রেরণা সৃষ্টি করে তাদেরকে ঐকান্তিক কুরবানীর জন্য তৈরী করেন। আঁ-হযরত (সা) বদরে যুদ্ধের পূর্বে স্বীয় ফৌজকে এমনিভাবেই সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল করে তুলেছিলেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিম প্রতিটি ক্ষেত্রে একজন অভিজ্ঞ জেনারেল ও উন্নতমানের রাজনীতিবিদের মত ভাবী ঘটনাবলী, তার ফলাফল ও পরিণতি সম্পর্কে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে স্বীয় প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি তাড়াহুড়ার আশ্রয় যেমন গ্রহণ করেন নি, তেমনি অহমিকাবোধ কিংবা গর্বের শিকারও হননি। এটাই একমাত্র কারণ যে, আবেগের বশবর্তী হয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিম তাৎক্ষণিকভাবে আক্রমণ ও পশ্চাদ্ধাবন করতে গিয়ে সিন্ধুর রাজধানীর দিকে অগ্রসর হননি; বরং তিনি ছয় মাস শীরাযে অবস্থান করে প্রথমে নিজের ফৌজকে সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত করে গড়ে তুলেন। তিনি প্রতিটি বিজয়ের পর প্রতিটি বিষয়ের পরিমাপ এবং তুলনামূলক বিচার-বিবেচনা করে তবে সম্মুখে অগ্রসর হন।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের হামলার ব্যাপারে দ্বিতীয় আপত্তি
দ্বিতীয় প্রশ্ন এই যে, যখন মুহাম্মদ বিন কাসিম মাকরানের কুযপুর অর্থাৎ পাঞ্জগোর শহর জয় করলেন তখন কেন বুদ্ধিয়া, তুরান এবং সূস্তান জয় করবার জন্য সম্মুখে অগ্রসর হলেন না। অধিকন্তু এটা কি তাঁর নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল না যে, কয়েদীদের যথাসত্বর মুক্তি দিতেন এবং রাজা দাহিরকে তার কৃতকার্যের শাস্তি প্রদান করতেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিম-এর গৃহীত কর্মপন্থা সঠিক ছিল
যদিও এসব প্রশ্ন বিবেচনাযোগ্য, তবে এগুলোর জওয়াব দেবার পূর্বে মূল ঘটনাবলীকে প্রতিরক্ষা, রাষ্ট্রনীতি এবং সমরশাস্ত্রের মূলনীতির উপর পরখ করে দেখাই সমীচীন হবে। সিন্ধু অভিযানে রওয়ানা হবার পূর্বে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মুহাম্মদ বিন কাসিমকে ঐ সব পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন, যা হযরত ওমর এবং হযরত ‘উছমান (রা)-এর খিলাফত আমলে উক্ত দেশে জিহাদ পরিচালনার ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছিল। অতএব প্রাথমিক যুগে যে সমস্ত কারণে মুসলমানদের পরাজয় ঘটেছিল— মুহাম্মদ বিন কাসিম সে সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন। আর এ কারণেই তিনি পাঞ্জগোর অবস্থান করে গুপ্তচরের মাধ্যমে বেলা ও দেবল পর্যন্ত মধ্যবর্তী এলাকার রাস্তা, পাহাড় পর্বত ইত্যাদির অবস্থা যথাযথভাবে এবং পরিপূর্ণরূপে জেনে নিয়েছিলেন। পাঞ্জগোর থেকে বেলা প্রায় দু’শ মাইল দূরত্বে অবস্থিত, যদিও এ দূরত্ব সোজাসুজিভাবে ১৫০ মাইলের বেশী হবে না। কিন্তু পানীয় জলের অভাব ছিল সর্বত্র এবং জঙ্গলের কারণে রাস্তা ছিল দূরতিক্রম্য। অতএব প্রতিরক্ষা নীতির দৃষ্টিতে অপরিহার্য ছিল যুদ্ধের পূর্বে সে দেশের অবস্থা সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত হওয়া। আঁ-হযরত (সা) বদর যুদ্ধের পূর্বে কয়েকবারই বদরের রণক্ষেত্র খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছিলেন।
আজকালকার প্রতিরক্ষা পর্যবেক্ষক কিংবা জেনারেল হয় নিজে স্বয়ং বিমানে আরোহণ করে যুদ্ধ এলাকা পর্যবেক্ষণ করেন অথবা তাঁর জন্য বিমান থেকে সমস্ত এলাকার ছবি তুলে একটি বিরাট মানচিত্র তৈরী করা হয় এবং চিত্রপটে অভিজ্ঞ ব্যক্তি জেনারেলের জন্য খুবই বিস্তৃত রিপোর্ট তৈরী করেন, যাতে করে তিনি পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল, নদী-নালা, রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট, মাঠ-ময়দান প্রভৃতি সম্পর্কে পরিপূর্ণ তথ্য লাভ করতে পারেন। এই রিপোর্ট পাঠ করেই মানচিত্রের সাহায্যে জেনারেল তার প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা তৈরী করেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের নিকট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গুপ্তচর এবং নির্ভীক অশ্বারোহী ছিল, যাদের মাধ্যমে তিনি ঐসব এলাকার চড়াই-উৎরাই এবং অন্যান্য বাধা-বিপত্তি সব জেনে নেন। এক্ষেত্রে তিনি স্থানীয় পথ-প্রদর্শকদেরও কাজে লাগান। নেপোলিয়নের উক্তি: “যুদ্ধক্ষেত্রে জয়লাভের জন্য সময়-জ্ঞান একটি অপরিহার্য হাতিয়ার। আমার সাফল্যের অন্যতম বিরাট রহস্য এই যে, আমি সব সময় ধৈর্য ও স্থৈর্যের সঙ্গে উপযুক্ত মুহূর্তের অপেক্ষা করেছি। আর এমনটি করা খুব সহজ কাজ নয়। কেননা এর জন্য চাই ইস্পাত-কঠিন হাদয়।”
মুহাম্মদ বিন কাসিমের সামনে ছিল দু’শ মাইলেরও অধিক অত্যন্ত বিপজ্জনক জঙ্গল। এসব জঙ্গলের বাসিন্দারা ছিল মুসলিম ফৌজের জানের দুশমন।
তাদের কাছে বিরাট এবং উন্নত মানের অস্ত্রধারী ফৌজ ছিল। এমতাবস্থায় তাদেরকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে নিক্ষেপ করাটাই ছিল যুক্তিযুক্ত, যাতে করে মুসলিম ফৌজ বেলা পর্যন্ত আকস্মিকভাবে পৌঁছে যেতে পারে। ঘটনা সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, শত্রু সে সময় কিছুই করেনি। এমতাবস্থায় মুসলিম ফৌজ বেলার আশেপাশে পৌঁছে যায়। আরমান ও বেলা বিজিত হয় এবং মুহাম্মদ বিন কাসিম ২৫ হাজারের মত শত্রু সৈন্যকে ধ্বংস ও বরবাদ করে দেন। এর পর তিনি আহত শত্রুর দেখাশোনা ও সেবাযত্ন করেন। কেবল সাধারণ সৈনিকদেরই নয়—বরং তাদের সেনাপতিকেও তিনি সসম্মানে মুক্তি দেন; শত্ৰু ফৌজের সমরাস্ত্র ও রসদ-সম্ভার হস্তগত করাকেই তিনি যথেষ্ট মনে করেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, মুহাম্মদ বিন কাসিম সে যুগের স্থানীয় প্রচলিত যুদ্ধনীতি কেন অনুসরণ করেন নি, অর্থাৎ আহত ও অন্যান্য যুদ্ধবন্দীকে কেন হত্যা কিংবা গোলামে পরিণত করেন নি? তাঁর এই কোমল আচরণ কি তাঁর দুর্বলতার পরিচায়ক নয়?
একথা নিশ্চিত সত্য যে, মুহাম্মদ বিন কাসিমের এই সহানুভূতিপূর্ণ ও উদার ব্যবহার তাঁর শত্রুকেও বিস্ময়ের মাঝে নিক্ষেপ করেছিল। ব্রাহ্মণদের কাছে যারা ছিল অস্পৃশ্য ও নিচু জাতির লোক বলে পরিচিত, তারা মুসলমানদের নিকট মানবেতর এবং নিকৃষ্টতম ব্যবহার পাবারই ধারণা করেছিল। কিন্তু কার্যত দেখা গেল, সব কিছুই তাদের প্রত্যাশার বিপরীতে সংঘটিত হচ্ছে। ব্রাহ্মণ এবং রাজপুত তাদের চেয়ে হেয়তর জাতির লোকদের খেদমত করাটাকে তাদের মর্যাদার পরিপন্থী বলে মনে করত। কিন্তু মুসলিম মুজাহিদবৃন্দ আহত যুদ্ধবন্দীদের নিঃস্বার্থভাবে সমগ্র দেহমন দিয়ে খেদমত করে। সিন্ধুর অধিবাসীবৃন্দ ঐদিন ইসলামী সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নমুনা প্রথম বারের মত দেখতে পায়। তারা মুসলিম বাহিনীকে যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুর প্রতি নিঃশঙ্কচিত্ত ও ভয়-ভীতিহীন দেখতে পায়, আর যুদ্ধের পর দেখতে পায় একে অন্যের সর্বোত্তম সহমর্মী ও বন্ধু হিসাবে। তাদের (মুসলমানদের) মধ্যে না জাতিগত ভেদাভেদ ছিল, না ছিল জাঁক-জমক ও অহঙ্কারের সামান্যতম চিহ্ন। এটি ছিল প্রথম কার্যকর আঘাত, যা মুহাম্মদ বিন কাসিম রাজা দাহিরের হুকুমতের উপর হেনেছিলেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম যদি যুদ্ধবন্দীদেরকে গোলামে পরিণত করতেন এবং তাদেরকে ইরাকে পাঠিয়ে দিতেন তাহলে তাদের দেখা-শোনা ও তত্ত্বাবধানের জন্য ফৌজের কিছু অংশকে ব্যস্ত রাখতে হ’ত। ফলে তাঁর ছোট ফৌজ স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল হয়ে পড়ত। আর যুদ্ধবন্দীদেরকে সঙ্গে নিয়ে ইরাক যেতে হলেও নানা অসুবিধা দেখা দিত। বন্দীরা মুসলিম ফৌজের দ্রুত চলাচলে সেই ভারী লৌহ জিঞ্জীরের ভূমিকা পালন করত, যা পা জড়িয়ে থাকে। এমতাবস্থায় মুহাম্মদ বিন কাসিম অত্যন্ত দূরদর্শিতা ও কৌশলের সাথে কর্ম সম্পাদন করে একদিকে নিজের ফৌজের শক্তি বহাল রাখেন এবং অন্যদিকে শত্রুর অন্তরও জয় করেন।
বেলা যুদ্ধক্ষেত্রে মুহাম্মদ বিন কাসিম আঁ-হযরত (সা)-এর ন্যায় স্বীয় দুশমনকে ভীত-চকিত করে এতটা সন্ত্রস্ত ও হত-বিহ্বল করে দেন যে, তারা তাঁরই (মুহাম্মদ বিন কাসিমের) প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা মুতাবিক চলতে থাকে। এখানে বদর, উহুদ, খন্দক, হুদায়বিয়া প্রভৃতি যুদ্ধের কথা ধরা যেতে পারে। আঁ-হযরত (সা) প্রত্যেক বারই এমন প্রতিরক্ষা কৌশল অবলম্বন করেন যে, তাতে শত্রুর প্রতিরক্ষা বেকার হয়ে পড়ে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, বদর যুদ্ধে কুরায়শ আঁ-হযরত (সা)-এরই নির্বাচিত যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করায় তাদের অশ্বারোহী কোম্পানী—যার অধিনায়ক ছিলেন খালিদ ইব্ন ওয়ালীদ, একেবারে অথর্ব ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। খন্দক যুদ্ধেও খালিদ বাজিতে হেরে যান এবং হুদায়বিয়া প্রান্তরেও পরাজয় যখন অবধারিত তখন তিনি আঁ-হযরত (সা)-এর পদ চুম্বন করেন এবং মুসলমান হয়ে যান। সেই হযরত খালিদ (রা) মুসলমান হবার পর কোন যুদ্ধেই আর কখনও পরাজিত হননি এবং দুনিয়ার প্রবল পরাক্রমশালী সাম্রাজ্য তাঁর হাতেই বিধ্বস্ত হয়।
মুহাম্মদ বিন কাসিম হিন্দী সেনাপতিকে তাঁরই নির্মিত ফাঁদে ফেলে বাঁদর নাচ নাচান। অতঃপর তাকে স্বীয় প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা মাফিক একটি জায়গায় টেনে এনে তার উপর এমনই কার্যকর আঘাত হানেন যে, গোটা হিন্দী বাহিনী বিধ্বস্ত ও বরবাদ হয়ে যায়।
কিন্তু এই ধ্বংসের পর তিনি ইসলামের সহিষ্ণুতা, উদারতা, সমবেদনা, সংবেদনশীলতা প্রভৃতি গুণের মলম লাগিয়ে সিন্ধুবাসীদেরকে তার প্রেমানুরাগীতে পরিণত করেন। তিনি সামরিক ও রাজনৈতিক দু’টো বিজয় একই সঙ্গে লাভ করেন। রাজার বড় বড় জেনারেল মুকা, রাসেল প্রমুখ মুহাম্মদ বিন কাসিমের অনুগত ভৃত্যে পরিণত হন।
এ ধরনের যুদ্ধাবস্থা সম্পর্কে বৃটিশ প্রতিরক্ষা পর্যবেক্ষক লীল হার্ট লিখেছেন: “অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে, কেবলমাত্র আক্রমণের দ্বারা শত্রুর উপর জয় ও সাফল্য লাভ সর্বোত্তম প্রতিরক্ষা নীতি নয়, বরং শত্রুর উপর সাফল্য লাভ করবার জন্য কয়েকটি পন্থাই ব্যবহার করা যায়। অবশ্য গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে সে সব পন্থার ভেতর থেকে উপযোগী পন্থা ইখতিয়ার করাই সিপাহ্সালারের কর্তব্য। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, শত্রুকে ধোঁকা দিয়ে তার পৌঁছুবার পূর্বেই নির্দিষ্ট মোর্চা কব্জা করে নিতে হবে [এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ, বদর যুদ্ধের মোর্চা— যা আঁ-হযরত (সা) কব্জা করেছিলেন—গ্রন্থকার ]। আর শত্রু যদি মযবুত ও সুদৃঢ় মোর্চার অধিকারী হয় তাহলে কোন-না-কোন চালে ও কৌশলে তাকে উক্ত মোর্চা পরিত্যাগে বাধ্য করতে হবে [উদাহরণত, মুহাম্মদ বিন কাসিম উপকূলের দিকে অগ্রসর হবার ভান করে হিন্দী সেনাপতিকে স্বীয় প্রতিরক্ষা চালে বন্দী করেন এবং তাকে কেল্লা পরিত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেন—গ্রন্থকার]। অথবা শত্রু ফৌজের উপর এমন অবস্থায় হামলা করতে হবে যখন তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে—হয় নিজেদের ফৌজকে মার্চ করাতে অথবা নতুনভাবে বিন্যস্ত করতে ব্যস্ত [এর উদাহরণ, হিন্দী সেনাপতির দুর্গ থেকে বহির্গত হয়ে সম্মুখে অগ্রসর হওয়া এবং পুনরায় নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফৌজকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করে লড়াই করা। এই সুযোগেই মুহাম্মদ বিন কাসিম হিন্দী ফৌজের উপর হামলা করে তাকে ধ্বংস করে দেন।—গ্রন্থকার]। এমত অবস্থায় শত্রু ফৌজকে সক্রিয় হবার মুহূর্তেই পাকড়াও করা হয় অথবা তার এতটা সময় মেলে না যে, সে নতুন কোন মোর্চা পরিপূর্ণভাবে সুদৃঢ় করতে পারে। তাই তার উপর জয়লাভ করতে বেগ পেতে হয় না।”
যদি হিন্দী সেনাপতি স্বীয় প্রতিরক্ষা নীতির উপর স্থির মস্তিষ্কে সক্রিয় থাকতেন তাহলে খুব সম্ভব মুহাম্মদ বিন কাসিম স্বীয় অভিষ্ট লক্ষ্য হাসিলে কামিয়াব হতে পারতেন না। এ ধরনের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার অত্যন্ত বিখ্যাত উদাহরণ য়ূরোপের বিখ্যাত সমর-বিশেষজ্ঞ হ্যানিবল এবং ফীস-এর মধ্যকার যুদ্ধগুলো। হ্যানিবল উপর্যুপরি জয়লাভের মাধ্যমে রোমান রাষ্ট্র এবং ইটালীয় ফৌজকে ভীষণ রকমে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছিলেন। কিন্তু ফীস উক্ত পদ্ধতিতেই লড়াই করতে থাকেন। তিনি হ্যানিবলকে এমন সুযোগ দেন নি যে, তিনি তার ফৌজের সঙ্গে কোন নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে লড়াই করে যাবেন। তিনি (ফীস) সাফল্যের সঙ্গে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করতে থাকেন এবং যখনই সুযোগ মিলত হ্যানিবলের সাহায্যকারী বাহিনী, রসদ-সম্ভার এবং রসদবাহী বাহিনীর উপর বিদ্যুদ্গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়তেন এবং সেগুলো ধ্বংস করে অদৃশ্য হয়ে যেতেন। শেষাবধি ফীস যেখানে রোমক ফৌজের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেখানে হ্যানিবলও কার্থেজীয় ফৌজকে অক্ষম ও নিষ্ক্রিয় করে ছেড়েছিলেন।
কুলবার হিটলারের রাশিয়া আক্রমণের সামরিক পরিকল্পনা সম্পর্কে যে পর্যালোচনা করেছেন তা এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
“প্রকৃত সত্য এই যে, হিটলার ভেবে দেখনে নি—এই বিশ্বযুদ্ধের হৃদপিণ্ড কোথায়, যেখানে কার্যকর ও মারাত্মক আঘাত হেনে শত্রুকে খতম করে দেওয়া যায়। হিটলার এটা মনে করেন নি যে, তাঁকে বার্লিন থেকে লণ্ডন পানে গতি ফেরাতে হবে এবং জার্মানীর জন্য মস্কোকে খতম করা লণ্ডনকে খতম করার পূর্বে অপরিহার্য নয়। ১৯৪০ ঈসায়ীতে এ যুদ্ধের সূচনা তো তিনি সঠিকভাবেই করেছিলেন। কিন্তু এরপর তিনি নেপোলিয়ানকে অনুকরণ করেন, অর্থাৎ এক্ষেত্রে দু’জন একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করেন।”
লড়াই-এর সঠিক গতিমুখ দ্বারা কি বোঝায়, তা আমরা এখানে পরিষ্কার করে দিতে চাই। এ গতিমুখ প্রকৃতপক্ষে সেই গতিমুখ নয়, যেখান থেকে হামলাকারী স্বীয় ফৌজকে অগ্রসর করেছে। কেননা প্রতিরক্ষা ও সামরিক অবস্থাদির কারণে এ গতিমুখের সংজ্ঞা বারবার বদলে থাকে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এ গতিমুখ দ্বারা সেই দিক বোঝায় না যে দিক দিয়ে হামলাকারী ফৌজ তার রসদবাহী পশু, সমরাস্ত্র এবং বিবিধ সাহায্য-সামগ্রী নিয়ে আসে, বরং এই গতিমুখ দ্বারা সেই দিককে বোঝানো হয়, যেদিক হামলাকারীর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার দৃষ্টিতে যুদ্ধের প্রাণস্বরূপ। বর্তমান বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর অবশ্য কর্তব্য ছিল, সর্বাগ্রে ইংল্যাণ্ডকে খতম করা। এতে বৃটিশ নৌ-শক্তিও ধ্বংস হয়ে যেত। কেননা যতদিন পর্যন্ত বৃটিশ নৌবহর নিরাপদ থাকত, ইংলণ্ড তার নিজের এবং সহযোগী মিত্রশক্তির ফৌজকে যেখানে ইচ্ছা নিয়ে গিয়ে জার্মানীর বিরুদ্ধে নতুন ফ্রন্ট খুলে দিতে পারত। অবস্থা ছিল হিটলারের অনুকূলে এবং তিনি ছিলেন একটি বন্য ষাঁড়ের মত গোলাকার আখড়ার ভেতর—যেখানে এবং যে দিকেই তিনি চাইতেন হামলা করতে পারতেন। যুদ্ধের গতিমুখ পরিবর্তন করা সম্পর্কে নেপোলিয়ান লিখেছেন:
“যুদ্ধের গতিমুখ (যদি এটা জানা যায় যে, এ দিকটি ভুল) বাধ্য হয়ে পরিবর্তন করা অত্যন্ত কষ্টকর ব্যাপার। এটা শুধুমাত্র একজন অত্যন্ত যোগ্য ও উপযুক্ত জেনারেলই সাফল্যের সঙ্গে করতে পারেন। আর যে জেনারেল ইচ্ছাকৃতভাবে ( বাধ্য না হয়ে) গতিমুখ পরিবর্তন করেন তিনি এমন একটি বিরাট ভুল করেন যা আর শোধরানো যায় না। এমনতর জেনারেলকে জেনারেল বলা যায় না।
“হিটলার এই গতিমুখকে বাধ্য হয়ে পরিবর্তন করেন নি, বরং তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই তা করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধেও হেরে গিয়েছিলেন।”
বেলা যুদ্ধেও হিন্দী সেনাপতি বুঝেন নি তার যুদ্ধের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি এবং তার দুশমন কি চাচ্ছে? অতএব তিনিও নিজের ফৌজকে আরব ফৌজের বিরুদ্ধে এমন অবস্থায় লড়িয়েছেন যখন তারা অনেকগুলো খণ্ডে বিভক্ত ছিল এবং প্রতিটি খণ্ড আবার এদিক-ওদিক বিক্ষিপ্ত ছিল।
দেবল বিজয়ের শিক্ষা
এখানে প্রশ্ন জাগে যে, মুহাম্মদ বিন কাসিম রাজা দাহিরের সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্য বসরা থেকে রওয়ানা হয়েছিলেন, অথচ দেবল ও নীরুন জয় করবার পর তিনি সূস্তান, তুরান এবং বুদ্ধিয়াতে অহেতুক সময় নষ্ট করতে থাকলেন এবং নিজ মিশনকে পরিপূর্ণ রূপ দেবার জন্য সম্মুখে অগ্রসর হলেন না। এর কারণ কি এবং তাঁর এ লড়াইয়ের প্রতিরক্ষামূলক শিক্ষাটাই বা কি?
সর্বপ্রথম যে শিক্ষাটা আমরা পাই—তা হ’ল রাজা দাহিরের সেই চিঠি যা তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিমকে লিখেছিলেন। এর থেকে স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয় যে, “শত্রু কে কখনোই খাটো করে দেখতে নেই।” এই সর্বজনজ্ঞাত উক্তির উপর রাজা দাহির আমল করেন নি। রাজা দাহির ২৫ হাযার ফৌজ বেলায় পাঠান। এ ফৌজ পরাজিত হয়। তথাপি তাঁর মস্তিষ্ক থেকে গর্ব ও ঔদ্ধত্যের ভূত নামেনি। দেবল যখন তাঁর হস্তচ্যুত হয় তখনও তিনি অবস্থা সম্পর্কে সঠিক পরিমাপ করতে ব্যর্থ হন।
দ্বিতীয় যে শিক্ষা আমরা পাই তাহ’ল এই যে, মুহাম্মদ বিন কাসিম উক্ত দুর্গ জয় করবার সঠিক পরিমাপ করেই উপযোগী সমরাস্ত্র যেমন, মিনজানীক, আরূস ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন।
তৃতীয় শিক্ষা এই যে, শত্রুর সঙ্গে কঠোর ব্যবহারের পরিবর্তে কোমল ও সদয় আচরণ এবং তাদের ধর্ম সম্পর্কে সহিষ্ণু ও উদার ব্যবহার এমন একটি কর্মপদ্ধতি, যা ছিল হাদীছ পাক-এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এই কর্মপদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে মুহাম্মদ বিন কাসিম বৌদ্ধ ধর্মের সমস্ত অনুসারী, জাট ও মায়দদেরকে স্বীয় সমর্থক ও সহযোগীতে পরিণত করেন। এটি ছিল রাজা দাহিরের জন্য একটি বিরাট নৈতিক পরাজয়, যার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সময়ের ব্যবধান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য খুবই বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়।
মুহাম্মদ বিন কাসিম শুরু থেকেই রাজা দাহিরের ফৌজ, অর্থ, বিত্ত, সমরোপকরণের আধিক্য ইত্যাদি সম্পর্কে সঠিক পরিমাপ করে নিয়েছিলেন। একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, তিনি প্রতিটি পদক্ষেপ গুণে গুণে হিসেব করে ফেলেছিলেন এবং প্রতিটি পদক্ষেপের পূর্বে পথের চড়াই-উৎরাই সম্পর্কে পরিমাপ করে নিয়েছিলেন।
রাজা দাহিরের রাজধানীকে সিন্ধুনদ দু’ভাগে বিভক্ত করে রেখেছিল। অথচ তা নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য রাজা দাহির সিন্ধুনদের কোথাও পুল ইত্যাদি নির্মাণ করেন নি।
সিন্ধুনদের পূর্ব এলাকা ছিল উর্বর এবং এ এলাকায় বড় বড় শহর আবাদ ছিল। যেহেতু এখানে হিন্দু ধর্মের অনুসারীদেরই ছিল সংখ্যাধিক্য, তাই এদের প্রতি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা মনের দিক দিয়ে প্রসন্ন ছিল না। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল জাট ও মায়দ প্রভৃতি, যাদেরকে রাজপুত, বিশেষ করে বর্ণ হিন্দুরা—(ব্রাহ্মণ) খুবই অবজ্ঞার চোখে দেখত।
পশ্চিম কিনারে ছিল বুদ্ধিয়ার রাজধানী, যা ছিল রাজা দাহিরের একটি করদ রাজ্য। এ এলাকার বাসিন্দারাও হয় বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী, নয়ত অগ্নিপূজক ছিল। এখানে রাজপুত সৈনিক ছিল খুবই কম। আর যারা ছিল তারা রাজার আত্মীয়-স্বজনের নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত ছিল। শাসক গোষ্ঠির লোকদেরকে রাজা দাহির গভর্নর (শাসনকর্তা) হিসাবে সূস্তান, বুদ্ধিয়া, তুরান প্রভৃতি রাজ্যে মোতায়েন করে রেখেছিলেন। যেহেতু এসব শাসক খুবই অহঙ্কারী এবং উদ্ধত ছিলেন, সেজন্য জনসাধারণ তাদের প্রতি বেজায় অসন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু রাজা দাহিরের শক্তি ও প্রতিপত্তির সামনে তারা ছিল অসহায়। মুহাম্মদ বিন কাসিমের ধর্মীয় উদারতা ও সহিষ্ণুতা ঐ সব লোকের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল গভীরভাবে।
যদি মুহাম্মদ বিন কাসিম নীরূন থেকে সিন্ধুনদ পার হয়ে চলে যেতেন তাহলে:
ক. রাজা দাহিরের সাম্রাজের পশ্চিমাংশের সহযোগী ও মিত্র রাজা এবং ঠাকুর মুহাম্মদ বিন কাসিমের পশ্চাদ্দেশে হামলা করে বসরা ও দেবলের মধ্যবর্তী যাতায়াতের রাস্তা বিচ্ছিন্ন করে দিতেন।
খ. মুহাম্মদ বিন কাসিমকে সম্মুখ দিকে রাজা দাহিরের বেশুমার ফৌজের মুকাবিলা করতে হ’ত এবং পশ্চাদ্ভাগে আরব ফৌজের উপর মিত্র করদ রাজন্যবর্গের ফৌজের চাপ গিয়ে পড়ত। ফলে আরব ফৌজ দু’টি ভারী শক্তিশালী ফৌজের মাঝে দারুণ বেকায়দায় পড়ত, বিশেষ করে পরাজয়ের ক্ষেত্রে, যখন তাঁর পশ্চাদ্ভাগে সিন্ধুনদের রাস্তা বন্ধ হয়ে যেত।
উপরে যে সব দলীল-প্রমাণ উল্লেখ করা হ’ল—তার বিরুদ্ধে যে কেউ সেনাপতি তারিকের স্পেন আক্রমণের কথা বলতে পারেন। এক্ষেত্রে আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, সেখানে প্রতিরক্ষার রূপ ছিল ভিন্ন। উপযোগী কোন স্থানে তারিকের জীবনী লিখতে গিয়ে ইনশা-আল্লাহ আমরা এতদ্সম্পর্কে আলোচনা করব।
মুহাম্মদ বিন কাসিম পশ্চিম এলাকা দখল করার পর রাজা দাহিরের ফৌজ অর্ধেকেরও কম হয়ে যায়। উপরন্তু তিনি স্বীয় ফৌজে জাট, ঠাকুর, মায়দ প্রভৃতি সম্প্রদায়ের লোক ভর্তি করা শুরু করেন। অর্থাৎ যেখানে রাজা দাহিরের ফৌজ সংখ্যার দিক দিয়ে হ্রাস পেল, সেখানে মুহাম্মদ বিন কাসিমের ফৌজ সংখ্যার দিক দিয়ে বেড়ে গেল। এমতাবস্থায় মুহাম্মদ বিন কাসিম লোভী হয়ে উঠেন নি, বরং শাসন-শৃঙ্খলা, প্রশিক্ষণ ও বিন্যাসের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। সিন্ধী লোকদের ভেতর থেকেই তিনি সর্বোত্তম লিপিকার গোয়েন্দা, গুপ্তচর, দুঃসাহসী সিপাহী, পথ-প্রদর্শক প্রভৃতি পসন্দমত বাছাই করে নেন।
এ বিষয়টি মুহাম্মদ বিন কাসিমের হৃদয়-মনে খুব ভাল করেই গাঁথা ছিল যে, আরব থেকে উট এবং উৎকৃষ্ট ঘোড়া বারবার নিয়ে আসা অসম্ভব। সিন্ধুনদের পশ্চিম এলাকায় সওয়ারীর জানোয়ার খুব বেশী সংখ্যায় পাওয়া যেত। অতএব তিনি এ এলাকা থেকে জানোয়ার সংগ্রহ করে শুধু নিজস্ব ঘাটতিই পূরণ করেন নি, দুশমনকেও এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ থেকে বঞ্চিত করে দেন।
এতদ্ভিন্ন এ এলাকায় আরব সৈনিকদের জন্য প্রয়োজনীয় শুষ্ক ফলমূল, বালি প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। এতে আরব সৈনিকদের বোঝা অনেকটা হ্রাস পেল এবং তারা নিজেদের দ্রুতগতি ও ক্ষিপ্রতা বজায় রাখতে সক্ষম হ’ল। নিজস্ব স্বাদ ও রুচি মাফিক যুদ্ধক্ষেত্রে আহার্য-দ্রব্য পাওয়া একটি বিরাট নেয়ামত।
রাজা দাহিরের সংকীর্ণ দৃষ্টি ও অদূরদর্শিতার কারণে মুহাম্মদ বিন কাসিম নির্বিঘ্নে এ এলাকা পদানত করতে অগ্রসর হন। সিন্ধু নদের উপর এমন কোন পুল ছিল না, যার সাহায্যে রাজা দাহির নিজের ফৌজ পূর্ব কিনার থেকে পশ্চিম কিনারে সত্বর স্থানান্তর করতে পারতেন। ফলে মুহাম্মদ বিন কাসিমের দক্ষিণ ও পশ্চাদ্ভাগ সম্পূর্ণ সুরক্ষিত ছিল। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফায়দা—যা মুহাম্মদ বিন কাসিম পশ্চিম কিনার জয়ের মাধ্যমে লাভ করেছিলেন, তা হ’ল রাজা দাহিরকে আলস্যের মাঝে নিক্ষেপ। রাজা দাহিরের ধারণা ছিল যে, মুহাম্মদ বিন কাসিম এই এলাকায় লুটপাট করে ইরাকে ফিরে যাবেন। রাজা দাহির হিন্দু ধর্মের অনুসারী ছিলেন। তাঁর পরামর্শদাতা ও উপদেষ্টা ছিল ব্রাহ্মণ ও রাজপুত। তারা মনে করেছিল যে, মুহাম্মদ বিন কাসিমের বিজয়ের কারণে বৌদ্ধ জনগণ হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, কিংবা এতটা কমযোর হয়ে যাবে যে, তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উপর হিন্দুরা খুব সহজেই দখল জমাতে পারবে। সম্ভবত এ জাতীয় কল্পনা ও ধ্যান-ধারণার মাঝেই রাজা দাহির ডুবে গিয়েছিলেন। তাই মুহাম্মদ বিন কাসিমের মুকাবিলায় পশ্চিম কিনারে তেমন কোন ব্যবস্থাই তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত নেন নি যতক্ষণ পর্যন্ত না মুহাম্মদ বিন কাসিম উক্ত এলাকা পদানত করেছিলেন।
উক্ত এলাকা জয়ের সঙ্গে সঙ্গে মুহাম্মদ বিন কাসিম ভাবী বংশধরদের জন্য একটি নতুন ধরনের ফৌজ সৃষ্টি করেন। এটি ছিল আর্মার্ড কোর। রাজা এবং ঠাকুর মুহাম্মদ বিন কাসিমের ফৌজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল। এখন তারা আর আগের মত আলাদা আলাদা স্বায়ত্তশাসিত ছিল না, বরং মুহাম্মদ বিন কাসিম প্রথমে তাদেরকে আঁ- হযরত (সা) বর্ণিত শাসন-শৃঙ্খলার ছাঁচে ঢেলে সাজান। অতঃপর তাদেরকে বিন্যস্ত করে স্বীয় ফৌজের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। সাম্য-ভ্রাতৃত্ব, সংবেদনশীলতা, প্রেম-ভালবাসা এবং ত্যাগের মলম তিনি ছ্যুৎ-অচ্ছুৎ এবং জাতপাতের নিষ্পেষণে নিষ্পেষিত লোকদের দিলের উপর লাগিয়ে দেন। এখানে সেবার অর্থ প্রতিশ্রুতির গালভরা বুলি ছিল না। মুহাম্মদ বিন কাসিম হযরত ওমর (রা)-এর প্রতিষ্ঠিত নীতির ভিত্তিতেই সৈনিক এবং তাদের পরিবার-পরিজনের মাসিক ভাতা নির্ধারণ করে দেন। এই নীতির উপর পরবর্তীকালেও কম-বেশি আমল করা হয়েছে। কিন্তু ইসলামের প্রচলিত রীতি-নীতি যখন মোগল শাসনামলে নিঃশেষ করে দেওয়া হয়, তখন তার আঙ্গিক কাঠামোও পরিবর্তিত হয়ে যায়।
অবশ্য ফ্রান্স এবং পরে বৃটিশ সরকার মুহাম্মদ বিন কাসিম প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে জীবিত করেন। বৃটেন হিন্দী আর্মার্ড অশ্বারোহী বাহিনী এবং পল্টন বানিয়ে ভারতবর্ষকে মোগল এবং মারাঠাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়।
লর্ড ক্লাইভ ইণ্ডিয়ান আর্মীর সংস্কার সাধন করেন। তবে অধিককাল ভারতবর্ষে অবস্থানের কারণে তিনি রাষ্ট্রীয় জাতপাতের রঙে রঞ্জিত হয়ে যান এবং এমন একটি ভুলের শিকার হন, যা তার সৃষ্ট ইণ্ডিয়ান আর্মীর ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দেয়। এই ধ্বংসাত্মক কাজে লর্ড কিচেনার তাকে সাহায্য করেছিলেন।
একথার দ্বারা আমরা এই বোঝাতে চাচ্ছি যে, তারা আর্মার্ড কোরের অধিনায়কত্ব হিন্দী অফিসারদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বৃটিশ অফিসারদের হাতে তুলে দেন। ফলে হিন্দী অফিসার এবং বৃটিশ অফিসারদের মধ্যে অনাস্থা ও অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। আমি যেহেতু ফৌজে আর্মার্ড হিসাবে ভর্তি হয়েছিলাম, সেহেতু আমি ভেতর থেকে এই বিপ্লব সম্পর্কে অধ্যয়ন করার সুযোগ পাই। পেটের জন্যই হোক কিংবা পরাধীনতার কারণেই হোক—অসহায় ছিলাম আমরা। প্রকৃত সত্য এই যে, হীনমন্যতাবোধ ভারতীয় অফিসারদের মধ্যে সে সময় আরও বেশী বৃদ্ধি পায়, যখন বৃটিশ অফিসাররা বলতে শুরু করেন যে, “ভারতীয়রা উন্নতমানের সৈনিক হতে পারে, কিন্তু ভাল অধিনায়ক হতে পারে না। এজন্য হিন্দুস্তানী অফিসারদেরকে ফৌজে উচ্চপদে দেওয়া যেতে পারে না।১” এ ধরনের কর্মপদ্ধতির যে পরিণতি ঘটেছিল, এখানে তা বলার প্রয়োজন নেই। রাজা দাহিরের ফৌজে গভর্নরের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা বৌদ্ধ রাজা ও ঠাকুরদের পসন্দনীয় ছিল না। ধর্মপালনের ক্ষেত্রেও তারা পুরোপুরি স্বাধীন ছিল না। ফৌজের মধ্যে জাতিগত বৈষম্য আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার ভিত্তিমূলকে নড়বড়ে করে দিয়েছিল।
এ শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা প্রতিরক্ষা কৌশল সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেও মুসলমানদেরকে কয়েকটি দেশের শাসন ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে এবং তা তাদের ব্যক্তিত্বে, অহংবোধে এবং জিহাদী আবেগ-স্পৃহায় কঠিন আঘাত হেনেছে।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রতিরক্ষা নীতি অর্থাৎ স্বীয় দক্ষিণ, বাম ও পশ্চাদ্ভাগকে শত্রুর হামলা থেকে নিরাপদ করার নীতি অনুকরণ করেন নেপোলিয়ন—যখন তিনি অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে হামলা পরিচালনা করেন।
জেনারেল মাড ১৯১৭ ঈসায়ীতে তুরস্কের বিরুদ্ধে উক্ত প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা অনুসরণ করেন, অর্থাৎ তিনি টাইগ্রীস (দজলা) ও ইউফ্রেটিস (ফোরাত) নদীকে স্বীয় অগ্রাভিযানরত ফৌজের মুহাফিজে পরিণত করেন। তুর্কীরা রাজা দাহিরের মতই ঐ দু’টো নদীর না পুল বানিয়েছিল, না জাহাজ চলাচলের জন্য উন্নত কোন ব্যবস্থাই উদ্ভাবন করেছিল। এর পরিণতি তাদের এভাবে ভোগ করতে হয়েছিল যে, ইরাক-ই-আরব তাদের থেকে চিরদিনের মত হাত ছাড়া হয়ে যায়। তুর্কীরাও প্রতিরক্ষা কৌশলের নীতি ভুলে গিয়ে আরবদেরকে তাদের তুলনায় হেয়তর ভেবেছিল। মজার ব্যাপার এই যে, তারপরও তারা এই আশা নিয়ে বসে ছিল যে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে আরবরা তুর্কীদের সঙ্গী হবে, তাদের সমর্থন দেবে। কিন্তু ইংরেজরা উল্লিখিত কার্যকর কৌশলের সঙ্গে কাজ করে এবং অর্থবিত্ত ও প্রোপাগাণ্ডা দ্বারা আরবদেরকে নিজেদের পক্ষে টেনে নেয়।
সিবী যুদ্ধের শিক্ষা
ক. সিবীর যুদ্ধে যখন সিন্ধী ফৌজের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, জনসাধারণ তাদের পেছনে নেই, তখন ব্যক্তিগত বীরত্বের ভিত্তিতে এবং আত্মোৎসর্গের প্রকাশ ঘটাবার লক্ষ্যে তারা শেষাবধি লড়ে গেলেও তাদের মনোবল কিন্তু ভেঙে যায়। এ লড়াই থেকে এটা পরিষ্কাররূপে প্রতিভাত হয় যে, যতক্ষণ পর্যন্ত রাজা বজ্র তাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এসব লোক জোশে উদ্দীপ্ত হয়ে এবং সাহসিকতার সঙ্গে লড়েছে। কিন্তু যেই রাজা বজ্র দুর্বলতা প্রদর্শন করেছেন অমনি সিন্ধী ফৌজও উৎসাহ ও মনোবল হারিয়ে ফেলেছে।
খ. একটি সুশৃঙ্খল, সুসংগঠিত ও সুবিন্যস্ত ফৌজ যত অল্প-সংখ্যকই হোক না কেন, সাধারণত একটি বিরাট সংখ্যক বিশৃঙ্খল ফৌজের উপর জয়লাভ করে থাকে। এ ধরনের বিশাল সেনাবাহিনী বস্তুতপক্ষে ভেড়ার পালের মত যা বিনা কারণে ভয় পেয়ে পালাতে উদ্যত হয় এবং বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে।
গ. যে ফৌজ প্রতিরক্ষা নীতির আওতাধীন লড়াই করে তারা অটুট ইচ্ছাশক্তির সঙ্গেই লড়াই করে এবং তাদের অধিনায়ক শত্রুর সামনে তাদেরকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে এমন এক স্থানে লড়বার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন যেখানে সে দুশমনের উপর মারাত্মক ও কার্যকর আঘাত হেনে তাকে পরাজিত করতে পারে।
সিবীর যুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধের আল-আলামীন ফ্রন্টের যুদ্ধের সঙ্গে বেশ খানিকটা সাদৃশ্যপূর্ণ। ঐ যুদ্ধে মিত্রশক্তি জেনারেল রোমেলের বিজয়ী বাহিনীকে তাদের মোর্চা পর্যন্ত অগ্রসর হবার সুযোগ দেয়। অতঃপর তাদের উপর এমনই পাল্টা আঘাত হানে যে, তারা হতভম্ব হয়ে যায়।
নীরূন ছাউনী
রাজা দাহির দ্বিতীয়বারের মত তাঁর দিবা নিদ্রা থেকে জেগে ওঠেন এবং কিছু ফৌজ রাজা রামচন্দ্র প্রমুখের নেতৃত্বাধীন এই উদ্দেশ্যে পাঠান যে, তারা বুদ্ধিয়া, সূস্তান এবং তুরান-এর জনসাধারণকে উস্কে দিয়ে তাদের পতাকাতলে এনে দাঁড় করাবে। কিন্তু এক্ষেত্রেও তারা কয়েকটি ভুল করে বসেন। যেমন, তারা মুহাম্মদ বিন কাসিমের সাফল্যের গোপন রহস্য অনুসন্ধান করেনি কিংবা তা উপলব্ধি করবারও চেষ্টা করেনি। তাছাড়া প্রতিরক্ষাগত দৃষ্টিকোণ থেকে উক্ত ফৌজের অধিনায়ক নির্বাচনও সঠিক হয়নি। কেননা এ দু’জন অধিনায়ক দুর্বলচেতা হবার কারণে—জনসাধারণের মাঝে নিজেদের মর্যাদা খুইয়ে বসেছিলেন। এছাড়া রাজা দাহিরের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনাও ছিল ভুল। তাঁর সেই পন্থাই অবলম্বন করা দরকার ছিল, যে পন্থা রাশিয়াতে স্টালিন ১৯৪০–৪৪ সালে জার্মান ফৌজের বিরুদ্ধে অবলম্বন করেছিলেন। অর্থাৎ একটি বিশাল জানবায ফৌজ গোটা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে বিজয়ী সেনাবাহিনীকে গেরিলা ধরনের যুদ্ধের মাধ্যমে এতটা পেরেশান ও বিব্রত করে তোলা উচিত ছিল, যাতে করে আরব ফৌজ সে এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এই সাফল্যের গোপন রহস্য সাধারণ গণমানুষের অন্তর-মানস জয় করে তাদেরকে একটি অটুট মনোবল-সম্পন্ন সশস্ত্র ফৌজে পরিণত করার মধ্যে নিহিত ছিল। রাজা দাহির এই প্রতিরক্ষা নীতি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন নি।
যাই হোক, যে বিপদ রাজা গোপী মুহাম্মদ বিন কাসিমের জন্য সৃষ্টি করেছিলেন, মুহাম্মদ বিন কাসিম অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে তার মুকাবিলা করেন অর্থাৎ তিনি বিদ্যুদ্গতিতে হামলা করে সিন্ধী ফৌজকে মেরে তাড়িয়ে দেন।
নদী পার
সিন্ধু নদ পার হতে মুহাম্মদ বিন কাসিম অত্যন্ত কৌশলের আশ্রয় নেন। তিনি দাহিরের ফৌজের অধিনায়কদেরকে জানতে দেন নি, শেষাবধি তিনি কোথা দিয়ে, কিভাবে এবং কখন সিন্ধুনদ পার হচ্ছেন। বারবার সে জায়গায়—যেখানে তার নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে, শত্রু মনে করছে যে এখান দিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমের ফৌজ সিন্ধুনদ পার হবে—সেখানে তিনি ছোট ছোট আরবীয় প্লাটুন দ্বারা হামলা করান, যাতে করে রাজা দাহিরের তামামতর মনোযোগ সে অংশেই কেন্দ্রীভূত থাকে। কিন্তু এই সঙ্গে তিনি নিজের জন্য সেই স্থানই বাছাই করে নেন যেখান দিয়ে তিনি সাফল্যের সঙ্গে সিন্ধুনদ পার হতে সক্ষম হন।
এই প্রতিরক্ষা নীতি মিত্রবাহিনীর সুপ্রীম কমাণ্ডার জেনারেল আইজেন হাওয়ার অনুসরণ করেছিলেন; অর্থাৎ তিনি হিটলারকে আগাগোড়া এই বিশ্বাস জন্মিয়ে দেন যে, মিত্রবাহিনী ইংলিশ চ্যানেলের (English Channel)-এর উপকূল ভাগে আক্রমণ করবে এবং উক্ত উপকূল ভাগে উপর্যুপরি তিনি কয়েকবার প্রচণ্ড আক্রমণ করেন, যাতে জার্মানদের নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মে যে, পাল্টা আঘাত উক্ত জায়গায়ই হবে। কিন্তু মিত্রবাহিনী উল্লিখিত স্থানের পরিবর্তে ফ্রান্সের ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে সফল হামলা পরিচালনা করে দ্বিতীয়বার য়ূরোপে প্রবেশ করে। যদি মিত্র বাহিনী এ ধরনের প্রতিরক্ষা চাল না চালত তাহলে তাদেরকে বিরাট মূল্যের কুরবানী দিতে হ’ত। অতএব প্রতিটি সিপাহ্সালারের অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে, তিনি তাঁর প্রতিপক্ষকে এমনভাবে অসতর্ক ও বেখবর রাখবেন, যেন সে প্রতিরোধের যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন করতে সক্ষম না হয়। মিত্রবাহিনী ফ্রান্সে অবতরণ করার পর হিটলার ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। জার্মান ফৌজ যদিও মিত্র বাহিনীর উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়, কিন্তু তখন সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেছে। শেষাবধি হিটলার পরাজিত হন। এভাবেই রাজা দাহির সেনাপতি রাজা রাসেল মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু পার হওয়া সম্পর্কে যখন জানতে পারলেন তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। রাসেল বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেন, কিন্তু শেষাবধি পরাজয়বরণ করেন।
জয়পুর যুদ্ধের শিক্ষা
এ যুদ্ধ থেকে যে শিক্ষা পাই তা হ’ল এই যে, ছোট্ট সুশৃঙ্খল একটি দল—যার চলাচল ও গতিবিধির যোগ্যতা রয়েছে, সে যখন এই চলাচল ও গতিবিধিকে একটি উত্তম প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা মুতাবিক কার্যকর করে তখন এই ছোট্ট দলটি বড় বড় দলকেও অসহায় বানিয়ে দেয়।
এ যুদ্ধে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সামনে কোন লক্ষ্য কাজ করেছিল?
এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, মুহাম্মদ বিন কাসিম এমন পরিকল্পনা তৈরী করেছিলেন যেন এর সাহায্যে রাজা দাহিরকে খতম করবার সঙ্গেই তিনি তার ফৌজের উপর কার্যকর আঘাতও হানতে পারেন। অতএব সর্বপ্রথম তিনি হিন্দী রাজার প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা উপলব্ধি করবার পর তার ফৌজের বিন্যাস সম্পর্কে অবহিত হন। এর থেকে তিনি তার ফৌজী বিন্যাসের দুর্বলতা কোথায় তাও জানতে পারেন। অর্থাৎ রাজা দাহির তাঁর হাতীগুলোকে শত্রুর উপর হামলা করবার পরিবর্তে নিজের কৃতিত্ব প্রকাশের জন্য কিংবা সে সবকে নিজের ব্যক্তিগত হেফাজতের জন্য মোতায়েন করেছিলেন। এসব হাতী রাজা দাহিরের ট্যাংক ফৌজের স্থলে ছিল। ফলে তিনি এর ভুল ব্যবহার করেন। এতদ্ভিন্ন তিনি তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীকেও নিজের হাতীগুলোর সামনে এনে খাড়া করেন। অথচ অশ্বারোহী বাহিনী, যার স্থান দখল করেছে বর্তমানে বিমান ও ট্যাংক বাহিনী, সে যুগেও ফৌজের মুখ্য ভূমিকা পালন করত। এ বাহিনী সিপাহ্সালারকে শত্রুর চলাচল ও গতিবিধি সম্পর্কে অবহিত করত, তার ফৌজের বিভিন্ন ব্যুহের দেখাশোনা করত এবং সুযোগ মিলতেই বিদ্যুৎ গতিতে শত্রু ফৌজের উপর আক্রমণোদ্যত হ’ত। মুহাম্মদ বিন কাসিম স্বীয় অশ্বারোহী বাহিনীকে এ ধরনের দায়িত্ব সোপর্দ করেছিলেন।
জয়পুরের যুদ্ধের সঙ্গে খালিদ (রা) বিন ওয়ালীদ-এর ইয়ারমুক যুদ্ধ এবং আলেকজাণ্ডারের ইযবেলা যুদ্ধের সাদৃশ্য ছিল। আলেকজাণ্ডারের ইযবেলা যুদ্ধের বিন্যাস নিম্নে প্রদর্শিত চিত্রে দেখান হ’ল:
আলেকজাণ্ডার এটা জেনে নিয়েছিলেন যে, দারার সম্ভাব্য সাফল্যের রহস্য কোথায়। অতএব তিনি তাঁর সর্বোত্তম অশ্বারোহী কোম্পানীসহ ইরানী ফৌজের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান থেকে দারার উপর এমন সময় অতর্কিতে হামলা করেন যখন তাঁর দ্রুতগতিসম্পন্ন অশ্বারোহী বাহিনী ও পদাতিক ফৌজ ইরানীদের উপর তীব্র আক্রমণ চালিয়ে তাদের সার্বিক মনোযোগ নিজেদের দিকে টেনে রেখেছিল। দারার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই ইরানী ফৌজ মনোবল হারিয়ে ফেলে এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করতে উদ্যত হয়। কিন্তু তাদের অধিকাংশই গ্রীক সৈন্যের তলোয়ারের মুখে যুদ্ধক্ষেত্রে চিরদিনের তরে গা এলিয়ে দেয়।
যে ভাবে দারার মৃত্যুর পর ইরানী হুকুমতের পক্ষ থেকে আলেকজাণ্ডারকে প্রতিরোধ করবার মত আর কেউ ছিল না, তেমনি জয়পুর সমরক্ষেত্রে রাজা দাহিরের মৃত্যুর পর আরব বাহিনীর সাথে সিন্ধী বাহিনীর যে সব লড়াই অথবা মুকাবিলা হয়েছে সে সবের তেমন কোন গুরুত্বই আর রইল না। মুহাম্মদ বিন কাসিম একটি কার্যকর আঘাতেই রাজা দাহিরের হুকুমত খতম করে দেন।
এতদসত্ত্বেও মুহাম্মদ বিন কাসিম একটি বিষয়ে লক্ষ্য রেখেছিলেন, যদিও রাজা দাহির মারা গেছেন, কিন্তু তার সাম্রাজ্যের রাজধানী আরোর এখনও তাঁর নিয়ন্ত্রণে আসেনি। অতএব তিনি জয়চান্দ এবং রাজা গোপীর পশ্চাদ্ধাবনের পরিবর্তে আরোর জয়ের স্থির সিদ্ধান্ত নেন। অনন্তর তিনি বিদ্যুৎ গতিতে তার দুর্গ অভিমুখে অগ্রসর হন এবং সত্বরই তা জয় করে সিন্ধু সাম্রাজ্যের বিজয়ী অধিনায়কের আসনে অধিষ্ঠিত হন। বাহ্মনাবাদ, স্কালিন্দা, সিককা, মুলতান নিজের থেকেই পাকা ফলটির মত তাঁর বিজয়ী আঁচলে পতিত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষাংশ সম্পর্কে জেনারেল ফুলার নামক বৃটিশ প্রতিরক্ষা পর্যবেক্ষক এবং ইঙ্গারসোল (Ingersole) নামক আমেরিকান বিশেষজ্ঞ জেনারেল আইজেন হাওয়ারের নিম্নোদ্ধৃত দৃষ্টিভঙ্গির কঠোর বিরোধিতা করেন অর্থাৎ আইজেন হাওয়ার তাঁর এক সরকারী রিপোর্টে লিখেছিলেন:
“বার্লিন সম্পর্কে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে, এখন এটা আর খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা শহর নয়। আমার দৃষ্টিতে প্রতিরক্ষাগত প্রয়োজনগুলোর রাজনৈতিক চাহিদার উপরই অধিক গুরুত্ব ছিল। যেখানে আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি জার্মান রাজধানীর উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করতে চাচ্ছিল—সেখানে আমার প্রতিরক্ষাগত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এই যে, শত্রু শক্তি যখন মরণ-দশায় ধুকছে তখন তাকে আগে-ভাগে খতম করে দেওয়াই ভাল। কেননা আমি আমার সামরিক শক্তি বিধ্বস্ত ও বিরান বার্লিনের উপর ব্যয় করার পরিবর্তে তা শত্রুশক্তির উপর ব্যয় করবার পক্ষপাতী ছিলাম।”
জেনারেল ফুলার (Fuller) এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন: “যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিরক্ষাগত দৃষ্টিভঙ্গির উপর শত্রুর সেই অবস্থার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার না থাকে যাকে মরণ দশায় আখ্যায়িত করা যায় তাহলে তা আর কখন হবে? আর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিরক্ষাগত দৃষ্টিভঙ্গি এই পরিস্থিতিতেও যদি গুরুত্ব না দেয় তাহলে যুদ্ধ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে মানিয়ে নেবার কি একটি মেশিন মাত্র নয়!”
জেনারেল আইজেন হাওয়ারের ভুলের মাশুল দিচ্ছে আজ গোটা দুনিয়া। এক্ষেত্রে জেনারেল ফুলারের অভিমতের যথার্থতার ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
যদি মুহাম্মদ বিন কাসিমও শত্রুর শক্তি ধ্বংস করবার জন্য বাহ্মণাবাদের দিকে ধাওয়া করতেন তাহলে খুবই আশংকা ছিল যে, হিন্দু রাজন্যবর্গ সাহায্যকারী সেনা পাঠিয়ে এবং আরোরকে নিজেদের আশ্রয়কেন্দ্র বানিয়ে কঠোর প্রতিরোধ সংগ্রামে অবতীর্ণ হতেন। আরোর ছিল একটি উপদ্বীপে অবস্থিত। এটি জয় করবার জন্য খুবই জটিল প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হ’ত। কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিমের বিদ্যুদ্গতিসম্পন্ন ক্ষিপ্রতা হিন্দুদেরকে সুযোগ দেয়নি যে, তারা মায়দের পুল ধ্বংস করে দেবে। এই পুলের মাধ্যমেই মুহাম্মদ বিন কাসিম আরোরের উপর চড়াও হতে পেরেছিলেন।
যদি জেনারেল আইজেন হাওয়ার বার্লিন দখল করতেন তাহলে আজ বার্লিন দু’অংশে বিভক্ত হ’ত না এবং বার্লিন নিয়ে আজকের এই জটিল ও সমস্যাসংকুল পরিস্থিতিরও উদ্ভব ঘটত না।
শক্তি ও বিজ্ঞান
মুহাম্মদ বিন কাসিম প্রতিটি ক্ষেত্রেই উপযুক্ত পন্থার মাধ্যমে শক্তির পরিবর্তে জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার (অর্থাৎ বিজ্ঞানের) ব্যবহার করতেন। যেখানে রাজা দাহির স্বীয় হস্তীযুথ নিয়ে গর্বিত ছিলেন সেখানে হস্তীযুথের ধ্বংস সাধনের জন্য মুহাম্মদ বিন কাসিম স্বীয় অশ্বারোহী বাহিনীর সওয়ারদের ক্ষিপ্রগতি এবং উন্নত ধরনের তীরন্দাযীর সাহায্য গ্রহণ করেন। তিনি রাজা দাহিরের হস্তীযুথের উপর কেরোসিন তৈলে সিক্ত তুলার জ্বলন্ত পিণ্ড তীরের সাহায্যে নিক্ষেপ করেন। হাতী কেবল আগুনকেই ভয় পায়, আর মুহাম্মদ বিন কাসিম হাতীর এই দুর্বলতাকে অত্যন্ত সাফল্যের সাথে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেন।
আমরা তৈলসিক্ত জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড ব্যবহারের দিকে বিশেষভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করছি। তৈলসিক্ত অগ্নিপিণ্ডের গোপন রহস্য যতদিন পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের নিকট সুরক্ষিত ছিল ততদিন দুনিয়ার কোন শক্তিই তাদের মুকাবিলায় দাঁড়াতে পারে নি। জয়পুর যুদ্ধের অবস্থা আমরা লিখেছি। এখন আমরা ফরাসী ঐতিহাসিক ও প্রখ্যাত লেখক ডি. জায়েন ওয়েলের পর্যবেক্ষণ পেশ করছি। তিনি ১২২৪ খৃস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং সম্রাট সেন্ট লুই-এর সঙ্গী ছিলেন। লুই ছিলেন য়ুরোপীয় ক্রুসেড নাইট বাহিনীর অধিনায়ক যিনি সপ্তম ক্রুসেড যুদ্ধে গোটা মুসলিম বিশ্বের উপর ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। এই ক্রুসেড বাহিনী ১২৪৮ খৃস্টাব্দে ফ্রান্স ভূখণ্ড থেকে রওয়ানা হয় এবং ১২৪৯ খৃস্টাব্দের জুন মাসে মিসরে গিয়ে পৌঁছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মিসরকে (যা ইসলামী হুকুমতের মধ্যে বিশিষ্ট ক্ষমতার অধিকারী ছিল) খতম করে বায়তুল মুকাদ্দাসকে পুনরায় অধিকার করা। এ যুদ্ধ মনসূরা নামক স্থানে সংঘটিত হয়।
ফ্রান্স সম্রাজ্ঞীর অনুরোধে ডি. জয়েন ওয়েল উক্ত ক্রুসেড যুদ্ধের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন। তিনি খুব সহজ সরল ভাষায়, উপদেশপূর্ণ ভঙ্গীতে এবং অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গেই উক্ত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন। আমরা তা থেকে সংক্ষিপ্তভাবে কিছু ঘটনা আমাদের মতের সমর্থনে উদ্ধৃত করছি। এখানে আমাদের উদ্দেশ্য তৈলসিক্ত জ্বলন্ত তীর ব্যবহারের প্রকৃতি ও বাস্তবতা তুলে ধরা, যাকে উক্ত লেখক ‘গ্রীক-অগ্নি’ নামে অভিহিত করেছেন। এর আবিষ্কারক যে মুসলমান তা তিনি স্বীকার করেন নি। আরবরা যখন তাদের মিনজানীকের সাহায্যে উক্ত আগুনকে ক্রুসেডার বাহিনীর কাষ্ঠ নির্মিত মিনারের উপর, যাকে দুবাবা কিংবা কাব্শ বলাই সঙ্গত— প্রথমবার আকস্মিকভাবে নিক্ষেপ করল এবং সেটিকে জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে দিল—তখন উক্ত লেখক সে সম্পর্কে এভাবে লিখেছেন (এটি ছিল সেই যুগ যখন বিরাট সংখ্যক ক্রুসেডার বাহিনী মিসরীয় ফৌজকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল):
“এক রাত্রে আমরা আমাদের মিনারায় (Tower) বসে শত্রুর আনাগোনা ও যাতায়াত পথের প্রতি নজর রাখছিলাম। এমন সময় আরবদেরকে একটি ইঞ্জিন (মিনজানীক) চালু করতে দেখলাম, যার সাহায্যে তারা চক্রাকারে গ্রীক অগ্নি-গোলক আমাদের উপর নিক্ষেপ করতে থাকল। সেই অগ্নি-বৃষ্টির অব্যাহত ধারাদৃষ্টে আমার মনিব বিখ্যাত বীর ও খ্যাতনামা নাইট ওয়াল্টার অব একবরী চীৎকার করে বললেন:
“হায় খোদা! আমরা আজ এমন এক ভয়াবহ বিপদের মাঝে নিক্ষিপ্ত যা আমরা অদ্যাবধি দেখিনি। যদি আমরা আমাদের জীবন বাঁচাবার খাতিরে ঐসব দুবাবাকে ছেড়ে দিই তাহলে আমাদেরকে ভীরু আখ্যা দেওয়া হবে। কেননা আমরা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য (অর্থাৎ রাস্তা পাহারা দেওয়া) পরিত্যাগ করছি।
“হে প্রভো! তুমিই বল, তুমি ভিন্ন এই বিপদ ও বেইয্যতির হাত থেকে কে আমাদের বাঁচাতে পারে? আমরা করজোড়ে তোমার নিকট মিনতি জানাচ্ছি, তুমিই আমাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন কর, তুমিই আমাদের সাহায্যকারী ও রক্ষক হও।
“এর পর যে-ই না আমাদের উপর ঐসব অগ্নি-গোলা পড়তে লাগল অমনি আমরা মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম, যাতে নিক্ষিপ্ত গোলা আমাদের গায়ে না লাগে। প্রথম অগ্নি-গোলা আরবদের গোপন পথে টহল দানকারী দু’টি দুবাবার মধ্যে এসে পড়ে। আমাদের বাহিনীর অগ্নিনির্বাপক প্লাটুন তাৎক্ষণিকভাবে তা নেভাতে শুরু করল। আরব সৈন্যরা ঐসব ক্রুসেডারদের উপর তীর বর্ষণ করে। কিন্তু তারা ঐসব নিক্ষিপ্ত তীরের হাত থেকে নিরাপদ থাকে। কেননা বাহিনীর হেফাজতের জন্য আমরা সম্রাটের নির্দেশে এসব দুবাবার সামনে দু’টি রক্ষী-ব্যুহ (wing) বানিয়েছিলাম।
“ঐ সব গ্রীক অগ্নি-গোলক মদের পিপার মত মোটা ছিল। নিক্ষিপ্ত গোলার মাঝ থেকে আগুন বিরাট এক শিখার আকারে বেরিয়ে আসত এবং এর ভেতর থেকে এমনই এক ভীতিকর ও ভয়াবহ আওয়াজ বের হ’ত যে, মনে হ’ত—বিদ্যুৎ চমকের পর মেঘের প্রচণ্ড বজ্রনাদ ধ্বনিত হচ্ছে। উড্ডয়ন মুহূর্তে গোলার আকৃতি একটি ভীতিপ্রদ সর্পাকৃতির রূপ ধারণ করত। এই গোলার আলো এত তীব্র ছিল যে, রাত্রিবেলা সমস্ত সেনাছাউনী দিবালোকের ন্যায় আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আরবরা মিনজানীককে আমাদের খুবই কাছাকাছি দুবাবার আড়ালে নিয়ে এসেছিল। এর পর তারা দিনের বেলায়ও আমাদের উপর অগ্নি-বর্ষণ করছিল। তারা আমাদের সে দু’টি দুবাবা, সিসিলীর সম্রাট ছিলেন যেগুলোর রক্ষক, জ্বালিয়ে দেয়। এতে সম্রাট সেন্ট লুই তাঁর সমস্ত সহযোগী ব্যারন এবং নাইটদের কাছে আবেদন জানান, যেন তারা নিজেদের জাহাজ থেকে যে যতটা পারেন কাঠ দেন যাতে করে নতুন দুবাবা বানানো যেতে পারে। … … এরপর আরব বাহিনী তাদের সমস্ত মিনজানীক, যার সংখ্যা ছিল ষোলটির মত—সম্মুখে এগিয়ে নিয়ে অবশিষ্ট দুবাবাগুলোও পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।…”
ডি. জয়েন ওয়েলের পুস্তক পাঠে জানা যায়, কী ভাবে তৈলসিক্ত জ্বলন্ত তীরের সঠিক ও অব্যর্থ ব্যবহার দ্বারা মিসরীয়রা ক্রুসেডের সপ্তম আক্রমণ অভিযানকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছিল। তারা কেবল তাদের দুবাবাই জ্বালায় নি বরং তাদের নৌ-বহরও জ্বালিয়ে ছাই করে দিয়েছিল; সম্রাট লুইকে বন্দী করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে মুক্তিপণের বদলে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। সবচেয়ে বেশী প্রশংসনীয় ও বিস্ময়কর ব্যাপার হ’ল এই যে, এই মিসরীয় ফৌজের অধিনায়ক ছিলেন একজন মিসরীয় রমণী। ইনি ছিলেন মরহুম বাদশাহ আল-মালিকু’স-সালিহ্র সহধর্মিণী। মনসূরা যুদ্ধে সাম্রাজ্যের ভাবী উত্তরাধিকারী প্রথম যুবরাজ শাহাদাত লাভ করেন। বাদশাহ্ কিছুটা পুত্র শোকে আর কিছুটা অসুখে পড়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন। কিন্তু নির্ভীক এবং দূরদর্শী মুসলিম শাহযাদী শুজাউদ্দুর বাদশাহ্র মৃত্যু সংবাদ গোপন রাখেন যতক্ষণ না তিনি ক্রুসেডার বাহিনীকে পরিপূর্ণরূপে পরাজিত ও পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হন।
এ ইতিহাস পাঠ করলে আমরা মুসলিম জাতির অটুট ইচ্ছা-শক্তি ও অদম্য মনোবল সম্পর্কে জানতে পারি। বাদশাহ কিংবা সিপাহ্সালার যদি শাহাদত বরণও করতেন তবু তারা শত্রুকে পরাভূত না করে ক্ষান্ত হ’ত না। উল্লিখিত মুসলিম মহিয়সী নারীর গৌরবময় কর্মকাণ্ড মুসলিম ইতিহাসের একটি স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়। আমি ক্রুসেড যুদ্ধের ইতিহাস লিখতে গিয়ে উক্ত শাহযাদীর বীরত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর উল্লেখ করেছি।
তৈলসিক্ত জ্বলন্ত তীরের গোপন রহস্য জনৈক সিরীয় শত্রুপক্ষের নিকট ফাঁস করে দেয়। কিন্তু এর ব্যবহার পরের লড়াইগুলোতে কম হয়েছে। অবশ্য ১৯৩৯-৪৫ ঈসায়ীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই অস্ত্রটিই অগ্নিশিখা নিক্ষেপক (Flame Thrower) রূপে আবির্ভূত হয়। সৈনিকরা এগুলোকে হাতে টেনে অথবা ট্যাংকের সাহায্যে চালায়। বিমানের সাহায্যে আগুন বোমারূপেও এর ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।
মিনজানীক কালক্রমে তোপখানার তোপ এবং মর্টারের রূপ নেয়। মোটকথা, জাগ্রত জাতি-গোষ্ঠী আগুনের একটি পোশাকে আবৃত করে একে দুশমনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। মিনজানীকের উপর পর্যালোচনা করতে গেলে অবরোধ এবং দুর্গজয়ের কথা এসে যায়। বৃটিশ প্রতিরক্ষা পর্যবেক্ষক জেনারেল টুকার বলেন:
“আদি কাল থেকে দুর্গ জয়ের জন্য একটি মূলনীতিই প্রয়োগ করা হচ্ছে, যদিও এ মূলনীতিকে কার্যকর করতে গিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রেই অপেক্ষাকৃত আধুনিক পন্থা অনুসরণ করা হয়েছে, আর সে মূলনীতিটি হ’ল, দুর্গ-বিধ্বংসী সমরাস্ত্রের ব্যবহার।
“যে সিপাহ্সালার শত্রু দুর্গের উপর হামলা করার পূর্বে নিজের ফৌজকে দুর্গ-বিধ্বংসী সমরাস্ত্র দ্বারা সজ্জিত করেনি, তার আক্রমণ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে।”
অপর প্রতিরক্ষা পর্যবেক্ষক লীড্ল হার্ট এ সম্পর্কে লিখেছেন: “যদি আক্রমণরত বাহিনীর অধিনায়ক অবরুদ্ধ শত্রু বাহিনীর উপর হামলা করে তাদের আত্মরক্ষা মোর্চা ভেঙে ফেলার যোগ্যতা না রাখেন তাহলে দুশমনকে অবরোধ করে বসে থাকা তার জন্য অর্থহীন।”
মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা ঐসব মূলনীতিকে যে অতি সুন্দরভাবে বাস্তবায়িত করেছিল—ইতিহাস তার সাক্ষী।
কেবল আত্মরক্ষার তাগিদ
মোটকথা, যে জাতি-গোষ্ঠী সিমেন্ট, লোহা কিংবা প্রস্তর নির্মিত প্রাচীরের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে বাঁচতে চায় তাদেরকে সব সময়ই ব্যর্থতা বরণ করতে হয়। রাজা দাহির স্বীয় ফৌজের কোম্পানীগুলোকে—যা সব সময় তাঁর প্রতিপক্ষ ফৌজের তুলনায় সংখ্যা ও সমরাস্ত্রের দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ ও অগ্রগামী ছিল, দুৰ্গবন্দী হয়ে লড়বার নির্দেশ দেন। রাজা দাহির তাঁর দুর্গের দৃঢ়তা, রসদ- সত্তার ও সমরাস্ত্রের প্রাচুর্য এবং স্বীয় ফৌজের ত্যাগের ব্যাপারে গর্বিত ছিলেন। এ কারণে বারবার পরাজিত হবার পরও তিনি একজন জুয়াড়ীর মতই আচরণ করতে থাকেন, কিন্তু নিজের অজ্ঞতা ও বোকামীর জন্য প্রতিবারই পরাস্ত হন। রাজা দাহির এবং তাঁর উপদেষ্টাগণ বারবার ধারণা করতে থাকেন যে, আরব ফৌজ ক্ষুধা ও অনাহারের কারণে অবরোধ ছেড়ে দিয়ে নিজেদের দেশে পাড়ি জমাবে। কিন্তু প্রত্যেকবারই হিন্দী ফৌজ আরব ফৌজের সামনে অস্ত্র সমর্পণ করে। প্রশ্ন জাগে, এমনটি কেন হ’ল?
এর কারণ এই যে, রাজা দাহির শুরু থেকেই তাঁর ফৌজের ভেতর হীনমন্যতাবোধের সৃষ্টি করেন। অন্য কথায়, রাজা নিজেই তাঁর সৈনিকদের খুদী তথা অহংবোধকে মিটিয়ে দিয়েছিলেন অর্থাৎ তিনি হিন্দী সিপাহীদেরকে কেবল আত্মরক্ষার তা’লীমই দিয়েছিলেন। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে, শত্রুকে সর্বাগ্রে আঘাত হানা আত্মরক্ষার সর্বোত্তম নীতি। প্রকৃতি কেবল রাজা দাহিরের সঙ্গেই এমন আচরণ করেনি, বরং আমরা যখনই ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টে দেখি, দেখতে পাই—প্রকৃতি তাঁর মত সবার সাথেই ঐ একই আচরণ করেছে। দূরে যাবার দরকার নেই, ১৯১৪-১৮ ঈসায়ীর বিশ্বযুদ্ধে বেলজিয়াম এবং ডেনমার্ক খুবই শানদার ও সুদৃঢ় দুর্গ নির্মাণ করেছিল। কিন্তু তারা মাত্র কয়েক ঘণ্টার ভেতরেই জার্মানীর তোপের মুখে মস্তক নুইয়ে দেয়। ১৯৩৯-৪৫ ঈসায়ীর বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে ফ্রান্স মেজিনু লাইনের উপর কোটি কোটি পাউণ্ড ব্যয় করে এবং এতে কয়েক বছর লেগে যায়। ঐ মোর্চাকে তারা দুর্ভেদ্য করে তৈরী করেছিল। আমাকেও (গ্রন্থকারকে) সেই সিমেন্ট এবং লৌহ নির্মিত শহরের নিরাপত্তা বিধানে মোতায়েন করা হয়েছিল। কিন্তু যখন জার্মান ট্যাংকের প্লাবন সম্মুখে অগ্রসর হ’ল তখন এসব মোর্চা ঠিক তেমনি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল যেমনভাবে বিরাট ঝড়-তুফানে বড় বড় রক্ষ জড়ে-মূলে উৎপাটিত হয়।
জার্মানী এ শিক্ষা কেবল ফ্রান্সকেই নয় বরং গোটা মিত্রশক্তিকেই পুনরায় শিখিয়ে দেয় যে, যে জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে নিজের আত্মরক্ষার জন্য ইটের জবাব পাথর দিয়ে দেবার অদম্য ইচ্ছা থাকে না—তারা কেবল আত্মরক্ষামূলক লড়াই লড়ে বেঁচে থাকতে পারে না।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, যেই জার্মানী দুনিয়াকে শেখাল “সর্বাগ্রে আক্রমণ পরিচালনাই আত্মরক্ষার সর্বোত্তম নীতি”—য়ুরোপ জয় করবার পর সেই জার্মানী নিজেই আটলান্টিক প্রাচীর (Altantic Wall) নির্মাণ করে আলস্যের মাঝে গা এলিয়ে দিল। হিটলার বার বার য়ুরোপকে ধমক দিতেন, ‘যে কেউই য়ুরোপ সীমান্তের নিকটবর্তী কদম রাখবে, আমরা তাকেই ধ্বংস করে দেব।’ কিন্তু এবারও প্রকৃতি সেই ফয়সালাই শোনাল যা ইতিপূর্বেও সে শুনিয়েছিল। তবে হাঁ, এতটুকু পার্থক্য ছিল যে, প্রথমবার হিটলার আক্রমণকারী হবার কারণে বিজয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু এবার নিজকে অবরুদ্ধ করে ফেলবার কারণে তিনি কেবল পরাজিতই হলেন না, ইহজগত থেকেও চির জনমের মত বিদায় নিলেন।
এক্ষেত্রে একটি কথা আমাদের স্মৃতিতে গেঁথে নেওয়া দরকার যে, মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন দেখলেন, শত্রু ফৌজের সংখ্যাধিক্য তাঁর জন্য সিন্ধুনদ অতিক্রমের ক্ষেত্রে বড় রকমের প্রতিবন্ধক, তখন তিনি উদ্ভাবনী শক্তির সাহায্যে নৌকা দ্বারা একটি পুল সিন্ধুনদের অনুকূল কিনারে তৈরী করলেন। অতঃপর রাতারাতি একে স্রোতের অনুকূলে ভাসিয়ে দিয়ে তার শেষ প্রান্ত অপর পাড়ে বেঁধে দিলেন। এ ধরনের পুল তৈরীর দৃষ্টান্ত প্রতিরক্ষার ইতিহাসে খুব কমই মেলে। জেনারেল উইংগেট বার্মায় এ ধরনের পুল তৈরী করলে দুনিয়ার সব পত্র-পত্রিকা তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় মেতে উঠেছিল।
আফসোস হয় যে, মুসলিম বিশ্ব মুহাম্মদ বিন কাসিমের মত খ্যাতনামা একজন জেনারেলের জীবনেতিহাস এখন পর্যন্ত সঠিক-ভাবে সাধারণ্যে তুলে ধরতে পারেনি।
সিপাহ্সালার এবং তাঁর দায়িত্ব
হিন্দী রাজা যখন থাকবেন না তখন হিন্দী ফৌজও লড়াই পরিত্যাগ করবে—মুহাম্মদ বিন কাসিম এই রাজনৈতিক রহস্যের কথাও বিস্মৃত হন নি। আরব ফৌজের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, আঁ-হযরত (সা) মুতার যুদ্ধে প্ৰথমে যায়দ (রা) বিন হারিছাকে সিপাহ্সালার মনোনীত করেন এবং বলেন: তিনি শহীদ হলে হযরত জাফর বিন আবু তালিব এবং জাফর শহীদ হলে ‘আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রা) সিপাহ্সালার হবেন, আর ‘আবদুল্লাহ্ও যদি শহীদ হয়ে যান, তাহলে মুসলমানরা নিজেদের মধ্য থেকে যে কাউকে সিপাহ্সালার নির্বাচিত করে নেবে। ‘আবদুল্লাহ্ শাহাদাতে সেনানায়কগণ খালিদ বিন ওয়ালীদকে তাদের সিপাহ্সানার মনোনীত করেন এবং শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। শেষাবধি রোমক সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে চলে যায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রথমবারের মত আঁ-হযরত (সা) প্রতিরক্ষা নীতিতে ঢুকিয়ে দেন। আজকের পাশ্চাত্য বিশ্ব অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে এ নীতি অনুসরণ করছে।
এ দু’টি দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য বুঝিয়ে বলার অবকাশ রাখে না। মুহাম্মদ বিন কাসিমের মুকাবিলা করতে গিয়ে হিন্দী সিপাহ্সালার যখন মারা যান তখন হিন্দী ফৌজ যুদ্ধের উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিমকে যখন খলীফার নির্দেশে কয়েদ করা হ’ল তখনও আরব ফৌজের অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও অটুট মনোবলের মধ্যে কোনরূপ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি।
সেনাপতিকে কোথায় অবস্থান করা উচিত
সেনাপতিকে লড়াইয়ের মুহূর্তে কোথায় অবস্থান করা উচিত? মুহাম্মদ বিন কাসিমের অধিনায়কত্ব থেকে জানা যায়, তিনি প্রত্যেকবার সেখানেই অবস্থান করতেন, যেখান থেকে শত্রুর চলাচল ও গতিবিধি সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। হতে পারে যে, এই অবহিতি তাঁর নিজের ব্যক্তিগত দেখাশোনার কিংবা তাঁর সেনানায়কদের প্রেরিত লিপি অথবা গুপ্তচরদের প্রেরিত তথ্যাদির উপর নির্ভর করত।
তিনি ভয় কাকে বলে জানতেন না। নির্ভীকতার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দূরদর্শী এবং সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে কাজ করতেন। খুন-যখম তাঁর আবেগকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত উস্কে দিতে পারত না। প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা একবার স্থিরীকৃত হয়ে গেলে অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি তা বাস্তবায়িত করতেন।
অপরদিকে তাঁর প্রতিপক্ষ রাজা দাহির প্রকৃতপক্ষে কখনো যুদ্ধক্ষেত্রেই আসেন নি। বিপদ-আপদ থেকে দূরে থাকাটাই তিনি পসন্দ করতেন। তাঁর সরকার সে সব খবরের উপরই নির্ভর করত, যা বিভিন্ন সূত্র থেকে কখনো-সখনো সংগৃহীত হ’ত। এমত দৃষ্টিভঙ্গির উপর মতামত দিতে গিয়ে জেনারেল ফুলার বলেন:
“যে ব্যক্তি নাটকে মঞ্চস্থিত পর্দার পেছনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন অভিনেতাকে নির্দেশ দেন, ঠিক তারই মত নির্দেশ প্রদানকারী কাউকে আমরা সত্যিকার অর্থে জেনারেল বলতে পারি না; বরং প্রকৃত জেনারেল তিনিই যিনি স্বয়ং যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে অন্যান্য অভিনেতাকেও যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। অতএব একজন জেনারেল (সিপাহ্সালার)-এর দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সেই মুতাবিক নির্দেশ জারী করাতেই শেষ হয়ে যায় না, বরং তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য হ’ল, তিনি জানতে চেষ্টা করবেন, তাঁর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা ও নির্দেশাদি যথাযথ অনুসরণ ও পালন করা হচ্ছে কিনা যদি পালন করা না হয় তাহলে তার কারণ কি এবং কতদূর পর্যন্ত উক্ত নির্দেশের ভেতর রদ-বদল করা সম্ভব।
নেপোলিয়ন এ সম্পর্কে বলেছেন: “সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্রে লোকে কেবলমাত্র নিজেদের কষ্ট-ক্লেশই দেখতে পায়, শত্রুর কষ্ট-ক্লেশের দিকে দৃকপাতও করে না। এটি করা অবশ্য কর্তব্য। এছাড়া এটাও জরুরী যে, সিপাহ্সালার তার নিজের যোগ্যতার উপর আস্থা রাখবেন।
“উদাহরণত, উত্তর আফ্রিকার লড়াইয়ে জার্মান জেনারেল রোমেল লড়াইয়ের উভয় দিক নিয়েই গভীর চিন্তা-ভাবনা করেন। তাঁর নিজের কষ্ট-ক্লেশের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপক্ষ বৃটিশ অধিনায়কের বিপদগুলোরও সঠিক পরিমাপ করেন। কিন্তু বৃটিশ অধিনায়ক জেনারেল ক্যানিংহাম কেবল নিজের কষ্ট-ক্লেশই অনুভব করেন। কেননা যখন জেনারেল রোমেল তার পশ্চাদ্দেশে এসে বীর শীফারজানের নিকটবর্তী রসদবাহী ও অন্যান্য ব্যবস্থা-সামগ্রীর উপর হামলা চালিয়ে তা তছনছ করে দেন তখন তিনি (ক্যানিংহাম) এতখানি দিক্ভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন যে, তিনি এও ভুলে গিয়েছিলেন—তাঁর ফৌজও জেনারেল রোমেলের ফৌজের পশ্চাদ্দেশে রয়েছে এবং তার জন্যও তো অনুরূপ কষ্ট-ক্লেশ অপেক্ষা করছে যে ধরনের কষ্ট-ক্লেশের মুখোমুখি হতে হচ্ছে স্বয়ং জেনারেল ক্যানিং- হামকে। অবস্থা যদি সত্যি তাই হয়—তাহলে বলতেই হয় যে, জেনারেল ক্যানিংহামের রীতি ও আচরণ একজন যোগ্য অধিনায়কসুলভ ছিল না।
“জেনারেল অকিনলেক কিন্তু এ ধরনের অবস্থার কারণে বিভ্রান্ত হন নি। তিনি জেনারেল ক্যানিংহামের অসুবিধাগুলোর সাথে শত্রুর বিপদ-মুসিবত সম্পর্কেও সঠিক পরিমাপ করতে সক্ষম হন। সাহসিকতা, বীরত্ব ও মনোবলের সঙ্গে তিনি এমন রীতি অবলম্বন করেন যার জন্য তিনি ফৌজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে সমর্থ হন।
সামনে গিয়ে জেনারেল ফুলার উল্লিখিত বর্ণনার সমর্থনে মার্কিন প্রতিরক্ষা পর্যবেক্ষক আলেকজাণ্ডার ক্লিফোর্ড-এর যে পর্যালোচনা উদ্ধৃত করেছেন, নিম্নে তা দেওয়া গেল:
“জেনারেল রোমেল তার ফৌজকে চোখের পলকে যুদ্ধক্ষেত্রের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত নিয়ে যাবার যোগ্যতার অধিকারী হন—এজন্য যে, তিনি নিজেই সরাসরি তাদের অধিনায়কত্ব করছিলেন। তিনি সঠিকভাবে পরিমাপ করে নিয়েছিলেন যে, যে-ভাবে নৌ-বাহিনীর অধিনায়ক (এডমিরাল) স্বয়ং জাহাজে আরোহণ করে স্বীয় নৌ-বহরের যথাযোগ্য গতিবিধি ও চলাচলকে সক্রিয় করে শত্রুর নৌ-বহরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন ঠিক তেমনি প্রান্তর-সমুদ্রে স্থলবাহিনী প্রধানের জন্যও নিজের ফৌজকে নিজেই নেতৃত্ব দান করা কর্তব্য। এমতাবস্থায় তিনি নিজেই স্বয়ং সমরক্ষেত্রে উপস্থিত হবার কারণে স্বীয় ট্যাংক কোম্পানীকে (সেকালের অশ্বারোহী বাহিনী– গ্রন্থকার) শত্রু কোম্পানীর সঙ্গে সরাসরি কিংবা আহরিত তথ্যানুযায়ী উপযোগী পন্থায় লড়িয়ে থাকেন। এ সব অবস্থায় তিনি স্বীয় প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা সম্পর্কে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন এবং তাঁর নির্দেশাদি অধিনায়কদের নিকট খুব সংক্ষিপ্ত সময়েও স্বল্প বিরতির মাঝেই পৌঁছে যায়। আর তাঁর অধীনস্থ সেনানায়কদের সে সব নির্দেশকে তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করতে পারেন। এতদ্ভিন্ন যদি শত্রুর কোন সামরিক চালের কারণে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, তাহলে তিনি তাঁর প্রথম নির্দেশের মাঝে উপযোগী পরিবর্তন সাধনও করতে পারেন। অর্থাৎ জার্মান সেনানায়কদের নিকট যখন তাদের সেনাপতি জেনারেল রোমেলের নির্দেশ পৌঁছে যেত, তখন বৃটিশ সেনাপতির কাছেও যুদ্ধ-ক্ষেত্রের খবর পৌঁছুত না। কেননা বৃটিশ অধিনায়ক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে পশ্চাদ্দেশে অবস্থান করতেন। এ পরাজয়ের কারণ এটা ছিল না যে, জার্মান জেনারেল বৃটিশ জেনারেলের চেয়ে বেশী যোগ্য ছিলেন; বরং এর কারণ ছিল এই যে, তাদের (বৃটিশ জেনারেলদের) প্রশিক্ষণ ছিল অতি প্রাচীনকালের। বৃটিশ জেনারেলদের পরিকল্পনা এবং কর্মপন্থা ১৯১৪-১৮ ঈসায়ীর মোর্চার লড়াইয়ের অনুরূপ ছিল। তাঁরা বিস্তৃত ও প্রশস্ত রণক্ষেত্রে ট্যাংকের সঠিক চলাচল ও গতিবিধির পন্থা সম্পর্কে অজ্ঞ ও অনবহিত ছিলেন।”
এখন যদি আমরা সিন্ধুর লড়াই-এর উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তাহলে মুহাম্মদ বিন কাসিম এবং রাজা দাহিরের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপদ্ধতির মধ্যে নিম্নরূপ পার্থক্য পরিলক্ষিত হবে।
জেনারেল রোমেল এই আরব বংশোদ্ভূত জেনারেল মুহাম্মদ বিন কাসিমের ন্যায় স্বীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে একেবারে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে নির্দেশ জারী করতেন। তাঁর দূরদর্শী চক্ষু যুদ্ধের অবস্থাসমুহ নিজের থেকেই দেখতে পেত। ডাক-হরকরা তাঁর নিকট প্রতি মুহূর্তের সংবাদ নিয়ে আসত। ফলে তিনি তাঁর শত্রুর প্রতিরক্ষা চাল এবং সামরিক কূটকৌশলকে মাত করে দিতে সক্ষম হন।
যেখানে মুহাম্মদ বিন কাসিম বিপদ-আপদকে আদৌ গ্রাহ্যের মধ্যে না এনে সকল অবস্থা নিজের চোখেই দেখতেন, সেখানে (যদি আমরা ঐতিহাসিকদের সে সব বর্ণনা বিশ্বাস নাও করি যে, রাজা দাহির হাতীর হাওদায় বাঁদী, নর্তকী ও পানপাত্র নিয়ে উপস্থিত ছিলেন) রাজা দাহির অবস্থান করতেন তাঁর ফৌজ থেকে অনেক দূরে—অনেক পেছনে।
যদি বেলা রণক্ষেত্রে তিনি তাঁর সেনাপতির নিকট নাও পৌঁছে থাকেন, তাহলে তাঁকে আমরা এভাবে ক্ষমা করতে পারি যে, তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিমের শক্তি ও যোগ্যতার সঠিক পরিমাপ করতে পারেন নি। মুহাম্মদ বিন কাসিম ছিলেন তখন ১৯ বছরের এক তরুণ, যাঁর নিকট মাত্র কয়েক হাজার সৈন্য ছিল। আর সে সব সৈন্যের হাতিয়ার হিন্দু সৈনিকদের তুলনায় অতি সাধারণ মানের ছিল। কিন্তু যখন বেলার পরে দেবল এবং পরে নীরুন, সহওয়ান ও সিব্বী পর্যন্ত বিজিত হয়ে গেল তখনও আরাম-আয়েশে তাঁর ব্যস্ত থাকাটা মোটেই ক্ষমার যোগ্য নয়, বিশেষ করে যখন তিনি জানতে পারলেন যে, মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুনদ পার হবার স্বপ্নে বিভোর।
এ ব্যাপারে আত্মপ্রশংসার জন্য নয় বরং শিক্ষা গ্রহণের জন্য আমি আমার স্মৃতিকথা এখানে পেশ করছি।
ঈসায়ী ১৯৪৯ সাল। ভারতীয় ফৌজ কাশ্মীরে প্রবেশ করে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিল। আমার উপর উক্ত ফ্রন্টের বিরাট একটি অংশের যিম্মাদারী সোপর্দ করা হয়। আমি রাওয়ালপিণ্ডি পৌঁছে দেখতে পেলাম:
১. আমাদের বৃটিশ সেনাপতি—যিনি বিগত দু’বছরের মধ্যে একবারের জন্যও ঝিলাম নদীর অপর পাড়ে পা রাখেন নি, সে সময় যুদ্ধরত ফৌজ থেকে কমপক্ষে চারশ’ মাইল দূরে নিজ বাংলোয় অবস্থান করছেন।
২. অবশিষ্ট জেনারেলগণও রাওয়ালপিণ্ডি কিংবা মারীর হোটেলগুলোতে অবস্থান করছেন।
৩. জেনারেলগণ ছাড়াও নিম্ন র্যাংকের বিরাট সংখ্যক অফিসার উল্লিখিত জায়গাগুলিতে আরামের সঙ্গে বসে ম্যাপ দেখে দেখে সৈনিকদের দিয়ে যুদ্ধ করাচ্ছেন।
কাশ্মীর উপত্যকার জঙ্গলগুলোতে না ছিল রাস্তা, না ছিল তার কিংবা টেলিফোন। নদীনালা ও পর্বতশ্রেণী যাতায়াত ও সংবাদ আদান-প্রদানের ব্যবস্থাকে খুবই দুরূহ ও কষ্টসাধ্য করে রেখেছিল। সংবাদ যদিও পৌঁছত তবে তা এত দেরীতে যে, তখন আর তার কোন গুরুত্বই থাকত না। বলা যেতে পারে যে, আজকালের ওয়ারলেসের যুগে এসব বাধা কোন বাধাই নয়। এর উত্তর এই যে, আমাদের বাহিনীর কাছে যে ওয়ারলেস সেট ছিল, তা ছিল একদম মান্ধাতার আমলের, যার উপর উচ্চতা, তুষারপাত এবং বাতাসের তীব্রতা গভীর প্রভাব ফেলত এবং দীর্ঘ দূরত্ব বা ত্রুটির জন্য কিংবা কমজোরীর কারণে কোন বার্তা পরিপূর্ণ ও সঠিকভাবে পৌঁছুত না; এমন কি সংবাদ আদান-প্রদানের ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াটাও বিস্ময়কর কিছু ছিল না।
কিন্তু এ দুর্বলতা যদি নাও থাকত তবু একটি বড় অসুবিধা এই ছিল যে, তখন যে গুপ্ত-সংকেত (Code) কিংবা পন্থা আমরা ব্যবহার করতাম তার মৌলিক নীতি পাক-ভারতে একই ছিল। কেননা উভয় প্রতিপক্ষের (হিন্দুস্তান এবং পাকিস্তান) সৈনিকেরা একই স্কুল এবং একই মূলনীতির অধীনে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ফলে কোড (Code) তখন বস্তুতপক্ষে আর কোড অর্থাৎ গোপন রহস্য ছিল না।
কম্যাণ্ড হাতে নিতেই যখন আমি আমার হেড কোয়ার্টারকে সম্মুখে অগ্রসর হবার জন্য বললাম, তখনই আমাকে অনেকগুলো বাধা ও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হল। যাই-হোক, এটা নিশ্চিত যে, পাকিস্তানী ফৌজকে পুঞ্ছ ও শ্রীনগর থেকে এজন্য হটে আসতে হয় যে, ফৌজের অধিনায়ক তখন কয়েকশ’ মাইল পেছনে বিলাস-ব্যসনে মত্ত ছিলেন। এ ছাড়া ফৌজ যেমন তখন সময়মত প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা পায়নি, তেমনি পায়নি নেতৃত্ব। তাদের কাছে না ছিল রসদ-সম্ভার, আর না ছিল সমরাস্ত্র। বিশেষত তাদের নিকট কার্তুজেরও পরিমাণ ছিল খুবই কম।
আমি প্রথমবার পুঞ্ছ নদীর ধারে অবস্থিত ৯০০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর গেলাম এবং আমার অধীনস্থ অফিসারবৃন্দকে সেখানে একত্র করলাম। পুঞ্ছ নদীর উপত্যকা উক্ত পাহাড়ের পাদদেশে আমাদের পদতলে অবস্থিত। আমি চাইলাম যে, সেখান থেকে সবাইকে পরিষ্কারভাবে এবং সুস্পষ্ট ভাষায় নিৰ্দেশ দিই।
আমি তিরাখীল থেকে উক্ত পাহাড় পর্যন্ত রত্রিবেলা পায়ে হেঁটে সফর করেছিলাম। উভয়ের মাঝে দূরত্ব ছিল প্রায় ১২ মাইল। আমাকে পথিমধ্যে ৫ হাজার ফুট উঁচু দু’টি পাহাড়ে আরোহণ করে এবং নদী-নালা অতিক্রম করেই সেখানে পৌঁছুতে হয়েছিল। এ সফর আমি মাগরিব থেকে শুরু করে অর্ধেক রাত্রির কিছু পর পর্যন্ত সময়ের মাঝে সম্পন্ন করেছিলাম এবং নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে ক্লান্তি ও অবসন্নতার কারণে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। ইতিমধ্যে উপজাতীয় বাহিনীগুলোর সর্দারবৃন্দ, যারা নিজেদেরকে ‘জেনারেল’ বলে অভিহিত করতেন—উল্লিখিত স্থানে পৌঁছে যান এবং অভ্যাস মাফিক সজোরে কথা-বার্তা বলতে শুরু করেন। এতে সেখানকার ব্রিগেডিয়ার সাহেব তাদেরকে পশতু ভাষায় আল্লাহ্র ওয়াস্তে আস্তে এবং নিম্নস্বরে কথা বলার জন্য অনুরোধ করেন। কেননা তাদের জেনারেল সাহেব কেবলই এসে পৌঁছেছেন এবং এখন তিনি শুয়ে ঘুমুচ্ছেন। একথা শুনেই ঐসব উপজাতীয় সর্দার বলেন, “আপনি আমাদেরকে ধোঁকা দেবেন না। আপনি আমাদেরকে ডেকে পাঠিয়েছেন আর আমরাও এসে গেছি। দু’বছরের বেশী হয়ে গেল, এর ভেতর কি কোন জেনারেল এ এলাকায় এসেছেন? কয়েকজন ব্রিগেডিয়ার ছাড়া অন্যরা কি তাদের নিজ নিজ ক্যাম্পে আরামের ঘুম ঘুমুচ্ছেন না? … আজকের যুগের কোন জেনারেল রাতভর পায়ে হেঁটে এতদূর এসেছেন—এমন কথাও কি আমাদের বিশ্বাস করতে হবে?” এরপর ভোরবেলা তারা আমাকে সশরীরে তাদের মাঝে উপস্থিত দেখে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমার নিকট ক্ষমা চান এবং তাদের স্বতস্ফূর্ত উল্লাস প্রকাশ করেন। এর বিপরীতে ভারতীয় ফৌজের জেনারেল এবং তাদের অধিনায়কবৃন্দ ঠিক যুদ্ধক্ষেত্রেই উপস্থিত ছিলেন। আমরা যদি আলোচ্য পর্যালোচনাসহ সমগ্র বিষয়টি নিয়েই পর্যালোচনা করে দেখি তাহলে একথা আমাদেরকে মেনে নিতেই হবে যে, ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর ভিত্তিতে কাশ্মীরে যা কিছুই হয়েছে তা আমাদের আশার বাইরে ছিল না এবং এর ফলাফল ও পরিণতি তাই হয়েছে যা হওয়া উচিত ছিল। কেননা যুদ্ধক্ষেত্রে নিজ ফৌজের সঙ্গে না থেকে কয়েকজন অধিনায়ক তাদের থেকে দূরে বহু পেছনে অবস্থান করছিলেন।
আমরা শিক্ষা গ্রহণ করব—কেবল এজন্যই আমি এসব লিখলাম যাতে করে আমার জাতির অধিনায়কবৃন্দ ভবিষ্যতে এ জাতীয় ভুলের পুনরাবৃত্তি করে আমার দেশের সার্বিক স্বার্থ বিনষ্ট না করেন।
আঁ-হযরত (সা) সব সময় স্বীয় ফৌজের নেতৃত্ব যুদ্ধক্ষেত্রেই করেছেন। হযরত আবু বকর (রা)-ও সেই কর্মপন্থাই অনুসরণ করেছেন। যখনই তিনি সেনাবাহিনী পাঠিয়েছেন তখনই তাদের অধিনায়ক নিযুক্ত করে তাদেরকে সে ধরনের দিক-নির্দেশনাই দিয়েছেন। তেমনি মার্কিন জেনারেল পেটি য়ুরোপে, বৃটিশ জেনারেল মন্টোগোমারী আফ্রিকায় এবং য়ুরোপে নিজ নিজ বাহিনীর সঙ্গেই ছিলেন। খালিদ (রা) বিন ওয়ালীদ, মুহাম্মদ বিন কাসিম, মূসা বিন নুসায়র, তারিক বিন যিয়াদ প্রমুখ বিখ্যাত জেনারেলও প্রতিরক্ষাশাস্ত্রের এই মূলনীতির উপর আমল করেছেন। তৈমুর লং, সুলতান সলীমের মত বিজয়ীরা একেবারে যুদ্ধের ময়দানে গিয়েই সৈন্য পরিচালনা করেছেন।
আজকালকার যুদ্ধ চলাচল ও গতিবিধির যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। ট্যাংক ও উড়োজাহাজ আজ অশ্ব ও উষ্ট্রারোহীর স্থান দখল করেছে। আঁ-হযরত (সা)-এর যুগেই খন্দক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু আঁ-হযরত (সা)-এর দূরদর্শী চক্ষু চলাচল ও গতিবিধির গুরুত্বকে ফৌজের জন্য খুবই অপরিহার্য ভেবেছেন এবং আরববাসীকে অশ্বারোহণ, তীরন্দাযী, দূর-দূরান্তের সফর, ঘোড়দৌড়, কষ্ট সহিষ্ণুতা ইত্যাদিতে অভ্যস্ত হবার জন্য সব সময়ই উপদেশ দিয়েছেন। প্রতিরক্ষা শাস্ত্রের এই মূলনীতি সেযুগের তুলনায় আজকের যুগে একান্তই অপরিহার্য। কেননা এ যুগের জনসাধারণ আরামপ্রিয়তার দিকেই বেশী ঝুঁকে রয়েছে। কষ্ট-সহিষ্ণুতা, কঠোর পরিশ্রম ও সহনশীলতার মত গুণাবলী ক্রমেই দুর্লভ হয়ে উঠছে।
অটুট সংকল্প ও ধৈর্য
সিপাহ্সালারের মধ্যে সুদৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ও অসাধারণ ধৈর্য শক্তি থাকা যারপরনাই জরুরী। সিপাহ্সালারের মধ্যে যদি অটুট সংকল্প কিংবা আত্মবিশ্বাস না থাকে তাহলে যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি তাঁর সৈনিকদেরকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াতে পারবেন না এবং তাঁর ফৌজকে এমন কোন কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ সামরিক গতিবিধির ব্যাপারেও অণুপ্রাণিত করতে ভরসা পাবেন না যার ভেতর বিপদ-আপদ কিংবা ধৈর্যের পরীক্ষা রয়েছে। উদাহরণত, মুহাম্মদ বিন কাসিমের যদি স্বীয় ফৌজের উপর এবং বিশেষ করে নিজের উপর বিশ্বাস না থাকত তাহলে তিনি সিবীর যুদ্ধক্ষেত্রে চন্দ্রাকৃতির প্রতিরক্ষা চাল, যা দুর্বলের জন্য একান্তই বিপজ্জনক, রাজা বজ্রের মত ধীর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কখনো প্রয়োগ করতে পারতেন না। তিনি তাঁর অশ্বারোহী বাহিনী দ্বারাই রাজার তিনশত হাতীর উপর হামলা করে বসেছিলেন এবং প্রত্যেকবারই নির্ভীকভাবে লড়াই করেছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে যথাযথ কৌশলও ঠিক করে নিয়েছিলেন। তাঁর ভেতর যদি অটুট সংকল্প ও ধৈর্য না থাকত তাহলে তিনি কখনো এতখানি সাহসিকতাপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে পারতেন না।
যুদ্ধে সংবাদ আদান-প্রদানের গুরুত্ব
সিপাহ্সালারেরই কেবল নয় বরং প্রত্যেক অধিনায়কেরই দায়িত্ব ও কর্তব্য হ’ল,—কেবল শত্রুরই নয়, বরং নিজ ফৌজের প্রতিটি প্লাটুনের চলাচল ও গতিবিধি সম্পর্কেও অবহিত থাকা। রাজা দাহির প্রত্যেক বারই এ ভুল করেছেন যে, তিনি তাঁর বাহিনীকে মুহাম্মদ বিন কাসিমের বিরুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে অলস ও গাফিল হয়ে বসে রয়েছেন। অপরদিকে মুহাম্মদ বিন কাসিমই শুধু নয়, হাজ্জাজ বিন ইউসুফও সিন্ধু বিজয়ের প্রতিদিনের কার্যবিবরণী বরাবর চেয়ে পাঠাতেন। এটা ছিল তাঁর উন্নত ও প্রশংসনীয় ব্যবস্থাপনা যে, প্রত্যেক আরব সিপাহ্সালারের প্রেরিত চিঠি-পত্রাদি হাজ্জাজ এক সপ্তাহ থেকে দশ দিনের ভেতরেই বসরায় পেয়ে যেতেন।
গেরিলা যুদ্ধের গুরুত্ব
ফিনল্যাণ্ডের মত ছোট্ট একটি রাষ্ট্রের গেরিলারা রাশিয়ার মত একটি বিশাল সাম্রাজ্যের সরকারকে পেরেশান ও বিব্রত করে তুলেছিল এবং রাশিয়ার গেরিলারা জার্মানীর বিজয়ী সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে ছেড়েছিল। চীনা গেরিলা বাহিনী সরকারের সাহায্য নিয়ে মার্শাল চিয়াং-কাই-শেক-কে চীন থেকে বহিষ্কার করে দিল। এর পর থেকেই গেরিলা বাহিনীকে লোকে অপরাজেয় ভাবতে শুরু করে। প্রশ্ন জাগে, হিন্দী গেরিলারা কেন বাজিতে হেরে গেল? এর জওয়াব খুবই পরিষ্কার। এটা ছিল হিন্দী অধিনায়কেরই ভুল, যিনি গেরিলাদেরকে এক স্থানে একত্র করে নড়িয়েছেন। বস্তুতপক্ষে এক স্থানে সমবেত হয়েও তারা লড়তে পারেনি। কেননা মুহাম্মদ বিন কাসিমের অশ্বারোহী ও উষ্ট্রারোহী বাহিনী তাদের খণ্ডগুলোকে এক এক করে পাকড়াও করেছিলেন।
ম্যাসিনা এবং স্পেনিশ গেরিলা
গেরিলা যুদ্ধ-পদ্ধতি কেবল সাম্প্রতিককালেই সম্মান, শ্রদ্ধা ও খ্যাতি লাভ করেনি বরং আমরা যখন নেপোলিয়নের লড়াইগুলোর কথা অধ্যয়ন করি তখনও জানতে পারি যে, ফ্যারাডিয়া ভোলো (Faradia Volo)– যিনি স্পেনিশ গেরিলাদের সর্দার ছিলেন, নেপোলিয়নের বিখ্যাত জেনারেল ম্যাসিনা (Massina)-কে ক্যালব্রিয়ার এলাকায় কতই না বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিলেন।
নেপোলিয়ন এবং রাশিয়ান গেরিলা
রাশিয়ান গেরিলারা নেপোলিয়নকে—যখন তিনি মস্কো থেকে বিজয়ী বেশে দেশে ফিরে যাচ্ছিলেন, ভীষণ যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে। মস্কো থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে ফরাসী সেনাবাহিনীর উপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাদের জান-মালের ভীষণ ক্ষতি সাধন করে। আমরা বরং বলতে পারি যে, ঐসব গেরিলাই নেপোলিয়নের মর্যাদায় এবং তাঁর ফৌজের উপর এমন কার্যকর আঘাত হানে যে, নেপোলিয়নের বাহিনী—যারা প্রথমে ছিল য়ুরোপ বিজয়ী, একটি পরাজিত শক্তিতে পরিণত হয়।
গেরিলাদের বিরুদ্ধে তুর্কী ফৌজ
১৯১২ ঈসায়ীতে বলকান যুদ্ধে মান্টেন্সরোর ছোট পার্বত্য রাজ্যের গেরিলারা তুর্কীদেরকে বারবার যন্ত্রণা দেয়। এর অর্থ অবশ্য এ নয় যে, তুর্কী সেনাবাহিনী খুবই দুর্বল ছিল। কেননা বিশাল সার্বিয়া রাজ্যের বিরাট শক্তিশালী সেনাবাহিনীকেও তুর্কীদের হাতে শেষাবধি নাকানি-চুবানি খেতে হয়েছিল।
স্পেন এবং গেরিলা
১৭৫৯ ঈসায়ীতে ফ্রান্সে মুরগণ স্পেনীয়দেরকে খুবই বিব্রতকর অবস্থার মাঝে নিক্ষেপ করেছিল। স্প্যানিশ বাহিনী মূরদের পশ্চাদ্ধাবন্ করতে মাইলের পর মাইল ছুটে যেত এবং ধারণা করত যে, সামনের খেজুর বনেই আমরা তাদেরকে ধরে ফেলব। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা ফাঁকা ও শূন্য ছাউনী ছাড়া আর কিছুই পেত না।
রাশিয়া ও গেরিলা
১৮৭৬-৭৭ ঈসায়ীতে রাশিয়া মুসলিম রাষ্ট্র তুর্কমানের উপর হামলা করে। রাশিয়ানরা খুব ধুমধাম ও বিরাট শান-শওকতের সাথে সম্মুখে অগ্রসর হয় এবং কেন্দ্রীয় শহর হাশিম দখল করে নেয়। কিন্তু শহর ছিল ফাঁকা। তুর্কমানেরা আশেপাশের পাহাড়গুলিতে আত্মগোপন করেছিল। তারা হঠাৎ হাশিমে অবস্থানরত রাশিয়ান ফৌজকে এমনভাবে বিব্রত করে তোলে যে, শেষ পর্যন্ত তারা শহর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। তুর্কমান গেরিলারা সুযোগ পেলেই রাশিয়ার রসদ-সম্ভারবাহী কাফেলা লুট করে নিত। ফলে রাশিয়ান ফৌজকে রসদের ঘাটতির কারণে বাধ্য হয়ে সেখান থেকে ফিরে যেতে হয়।
ওয়াযিরীস্তানের গেরিলা এবং ইণ্ডিয়ান আর্মী
১৯৩৬-৩৯ ঈসায়ীতে ওয়াযিরীস্তানের উপজাতীয় এলাকায় বৃটিশ ভারতীয় সরকার এবং উপজাতীয়দের মধ্যে যে লড়াই সংঘটিত হয়—আমি (গ্রন্থকার) তাতে শরীক ছিলাম। ফকীর ইপি ছিলেন উপজাতীয় গেরিলা বাহিনীর অধিনায়ক। তার অধীনে কোন সময়ই চারিশতের অধিক উপজাতি একত্রিত হয়নি। এর বিপরীতে ইণ্ডিয়ান আর্মীর সদস্যসংখ্যা ছিল চল্লিশ হাজারের মত এবং এই ফৌজ ছিল গোরা, গুর্খা, সীমান্তের বিখ্যাত (পাঠান) পল্টন এবং আর্মার্ড কোরের সমষ্টি। কামান এবং বিমানও এতে শামিল ছিল। ঐসব উপজাতীয়দের আচরণ ছিল এমনি যে, আজ তারা বন্নুর নিকটবর্তী অঞ্চলে অতর্কিত আক্রমণ চালান, কিছুদিন পর আবার মীর আলীতে গিয়ে হাযির হ’ল; তারপর রিযক প্রভৃতি স্থানে আবার তাদের আবির্ভাব ঘটল। ইণ্ডিয়ান আর্মী কয়েক শ’ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে যখন হামলাকারীদের কাছে গিয়ে পৌঁছুত তখন দেখা যেত, তারা সেই পাহাড়ী এলাকা থেকে ধোঁয়ার মত মিলিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও আবার ভেসে উঠেছে। এভাবে উক্ত উপজাতীয়রা কয়েক বছর ধরে বৃটিশ ভারতীয় বাহিনীকে বিব্রত করে রেখেছিল।
কিভাবে গেরিলা বাহিনীর মুকাবিলা করা যায়
জেনারেল ব্যাল্ফ সম্পর্কে পাশ্চাত্যের জনৈক প্রতিরক্ষা পর্যবেক্ষক লিখেছেন যে, তিনি নেপোলিয়নের প্রায় সম-মতাবলম্বী ছিলেন। তিনি বলেন:
“এশিয়ায় যুদ্ধ পরিচালনার সময় সেখানকার গেরিলাদের বিরুদ্ধে অটুট সংকল্প ও নির্মম হৃদয়ের পরিচয় দিতে হবে, যাতে করে ভয়, সন্ত্রাস এবং সিপাহ্সালারের অটুট সংকল্প তাদের সকল আশা-ভরসাকে হতাশা ও নিরাশায় পরিণত করে দেয়। তাদের বিরুদ্ধে সামরিক ক্রিয়াকাণ্ড শুরু করতে হবে খুবই ত্বরিত গতিতে এবং অত্যন্ত আচম্বিতে। এতে করে গেরিলারা কোন পরিকল্পনা গ্রহণের সুযোগই পাবে না। আর একবার যদি তারা পরাজিত হয় তাহলে তাদের মনোবল ভেঙে পড়বে।
“ভয়, ত্রাস এবং কঠিনতম শাস্তিই এসব উপজাতীয়দের সঠিক প্রতিষেধক—যারা কখন বিজয়ী দলের সাথে গিয়ে মিশবে সে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। এসব লোক ভয় পেলে গেরিলাদের থেকে আলাদা হয়ে যায়।”
জেনারেল টুকার এবং গেরিলা
ওয়াযিরীস্তান এলাকার যুদ্ধে আমি (গ্রন্থকার) নিজে আরও একটি পন্থা কার্যকর হতে দেখেছি। ১৯৩৭ ঈসায়ীতে উপজাতীয়রা বান্নু থেকে রিযমুকগামী সড়কে কয়েকবার সফল হামলা চালিয়ে ইণ্ডিয়ান আর্মীকে (অর্থাৎ আমাদেরকে) খুবই বিব্রত করে তুলেছিল। সড়কের সর্বাধিক বিপজ্জনক অংশের হেফাজতের দায়িত্ব দেওয়া হয় টুকার নামক একজন ইংরেজ কর্নেলকে। ইনিই পরবর্তীকালে জেনারেল টুকার নামে পরিচিত হন। তাঁর লিখিত গ্রন্থাদির উল্লেখ আমরা কয়েকবারই করেছি।
টুকার কয়েকদিন তাঁর ফৌজ নিয়ে রাত-দিন টহল দিতে থাকেন। সে সময় রসদবাহী লরী বহরের উপর উপজাতীয়রা সাফল্যের সঙ্গে হামলা চালিয়ে কয়েকবারই তা লুট করে নেয়। এ সম্পর্কে কর্নেল টুকারকে জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষত এজন্য যে, কর্নেল টুকার সাধারণ প্রচলিত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার বদলে কিছু নতুন পন্থা অবলম্বন করেছিলেন।
কিছুদিন পর খবর পাওয়া গেল যে, কর্নেল টুকার উপজাতীয়দেরকে তাদেরই ছড়ানো-বিছানো জালে আটকে এমন শিক্ষা দিয়েছেন যা তারা কোনদিনই ভুলতে পারবে না অর্থাৎ উপজাতীয়দের এত বেশী জীবন হানি ও আর্থিক ক্ষতি হয়েছে যার উদাহরণ সীমান্ত যুদ্ধগুলোতে সাধারণত পাওয়া যায় না। অথচ কর্নেল টুকারের ফৌজের একজন সদস্যও এতে আহত হয়নি। লোকদের বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, এটা কি করে সম্ভব হ’ল।
কর্নেল টুকার প্রচলিত নির্ধারিত নিরাপত্তামূলক টহলদানের পন্থা ছেড়ে দিয়ে প্রচ্ছন্নভাবে রাতে ও দিনে স্বীয় ফৌজকে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করে দেন। এসব গ্রুপের প্রতি নির্দেশ ছিল, তারা দিনের বেলা দূরবীন লাগিয়ে উপজাতীয়দের চলাচল ও গতিবিধি খুব ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। এসময় আকস্মিকভাবে উপজাতীয়দের কোন দল তাদের হাতের মুঠোয় এসে গেলেও তাদের উপর হামলা করবে না।
রাতে টুকারের বাহিনী উপজাতীয় বাহিনীর পেছনে পেছনে ছায়ার মত ফিরত এবং তাদের গতিবিধির উদ্দেশ্য বুঝতে চেষ্টা করত এবং ক্যাম্পে ফিরে এসে সে সম্পর্কে রিপোর্ট করত। কিন্তু তাদের উপর নির্দেশ ছিল যে, তারা সাধারণ রাস্তা দিয়ে কিংবা এমন কোনভাবে যাবে না, যাতে শত্রুরা তাদের উদ্দেশ্য ধরে ফেলতে পারে। এভাবে কর্নেল টুকার কেবল উক্ত এলাকা সম্পর্কেই একটা স্বচ্ছ ধারণা স্বীয় মস্তিষ্কে গেঁথে নেন নি, বরং উপজাতীয়দের কর্মপন্থা সম্পর্কেও বেশ ভালভাবে ওয়াকিফহাল হন।
টুকার তাঁর বিভিন্ন প্লাটুন প্রদত্ত রিপোর্ট থেকে জেনে নিয়েছিলেন যে, উপজাতীয়রা সড়কের একটি পুল বারূদের সাহায্যে উড়িয়ে দিয়ে সেখানে রসদবাহী লরী থামাতে চায়। যেই লরী থামবে অমনি তারা ইণ্ডিয়ান আর্মীর জরুরী ও মূল্যবান সাজ-সরঞ্জাম লুটে নেবে এবং বাকি মাল-সামানে আগুন লাগিয়ে পাহাড়ের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাবে।
উপজাতীয়রা খুব সতর্কতার সাথে কয়েকদিন যাবত পুল ধ্বংসের ব্যাপারে কাজ করে। এটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোন পুল ছিল না। সেজন্য উপজাতীয়দের নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে, টহলদানকারী বাহিনী স্বাভাবিকভাবে সড়কের উপর দিয়ে চলে যাবে এবং তারা তাদের পরিকল্পনায় সফল হবে। অনন্তর হ’লও তাই অর্থাৎ সড়কের উপর দিয়ে সশস্ত্র গাড়ী অতিক্রম করে গেল। কেউ এতটুকু সন্দেহও করল না। অবশ্য টুকারের বাহিনী অনুমান করে নিয়েছিল যে, চূড়ান্ত হামলা হবে আগামীকাল রাত্রে অর্থাৎ মটর কনভয় আসবার আগের রাতে।
নির্ধারিত রাতে ঐসব লোক ঘাসের তৈরী বেণী নিয়ে আসে যাতে করে বারূদে অগ্নি সংযোগের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। যদি কোন কারণে বারূদের ফিতা বেকারও হয়ে যায়, তাহলেও যেন কোন অসুবিধা না হয়।
এ কাজ কিভাবে সম্ভব হ’ল
পুলের আশেপাশে তারা পাথর এবং শিলাখণ্ড কয়েক দিন থেকেই জড়ো করতে শুরু করে দেয়। এর দ্বারা তারা বুঝাতে চাচ্ছিল যে, তারা সড়ক এবং পুলের মেরামতের জন্য এসব জড়ো করছে। কয়েক জায়গায় তারা ভূমিও খনন করেছিল। তারা সেই সঙ্গে সঙ্গোপনে পুলের তলায়ও গর্ত খনন করে এবং তার ভেতর মাটি ভরে দেয়, যাতে করে শেষ রাতে সহজেই মাটি সরিয়ে তার ভেতর বারূদ ভর্তি করে বিনা বাধায় পুলটি উড়িয়ে দিতে পারে। তারা পুল থেকে বেশ দূরে দূরে ঘাস জ্বালাতে থাকে, যাতে বোঝা যায় যে, সর্দির হাত থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যেই সড়ক নির্মাণরত শ্রমিকেরা আগুন জ্বালাচ্ছে।
একদিকে উপজাতীয়রা এই ব্যবস্থা নিল, অন্যদিকে টুকার স্বীয় প্লাটুনগুলোর জন্য অন্য ব্যবস্থা নিলেন। তিনি তাঁর ফৌজকে বণ্টিত করলেন এভাবে যে, যখন উপজাতীয়রা পুত্র থেকে সরবে অমনি একটা না একটা প্লাটুনের জালে পড়বে। বিশেষ প্লাটুন ছাড়া অন্য কারো গুলী চালাবার হুকুম ছিল না; বরং শত্রুর উপর খোখরী (গুর্খা খঞ্জর), সঙ্গীন এবং অনিবার্য প্রয়োজন দেখা দিলে বোমা ব্যবহারের অনুমতি ছিল। সবচেয়ে দূরে গোলন্দাজ ইউনিট মোতায়েন করা হয়েছিল, যারা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সব জায়গার দূরত্ব মেপে রেখেছিল এবং এক একটি জায়গার এক একটি বিশেষ নাম দিয়েছিল যাতে করে কামানের গোলা কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ওয়ারলেসের সাহায্যে শত্রুর উপর নিক্ষেপ করা যায়। যে-ই না উপজাতীয়রা ঘাস জ্বালাবার সময় দিয়াশলাই জ্বালিয়েছে অমনি টুকারের লুকায়িত প্লাটুন তাদের উপর সার্চ লাইট গোলা নিক্ষেপ করে এবং সেই সাথে মেশিনগানের গুলীও বর্ষণ করে। কয়েকজন উপজাতি সেখানেই মারা যায়। যারা বেঁচে ছিল তারা পিছু হটতেই অপর প্লাটুনের সঙ্গীনের শিকারে পরিণত হয়। যে সব লোক কেবল লুটতরাজ করবার জন্য গ্রাম থেকে বেরিয়ে এই আশায় আত্মগোপন করেছিল যে, রসদবাহী নরী আসা মাত্রই হামলা করবে–তারা ভীত-বিহ্বল হয়ে গ্রামের দিকে পালাতে থাকে। কিন্তু কামানের সার্চলাইট গোলার আলোতে তারা পরিষ্কার দৃষ্টিগোচর হয় এবং গ্রাম অবরোধকারী ফৌজের হাতে ধরা পড়ে।
কর্নেল টুকারের এই প্রতিরক্ষা কার্যক্রম ঐ এলাকার উপজাতীয়দের অনেকদিন পর্যন্ত নিশ্চুপ করে রাখে। বিশেষত এজন্য যে, উপজাতীয়দের যে সব লোক আহত হয়েছিল কিংবা মারা গিয়েছিল উপজাতীয়দের বহু চেষ্টা সত্ত্বেও আমরা তাদের উঠিয়ে নিয়ে যেতে দেইনি। উপরন্তু আমরা ঐ সব আহত ও নিহতদের মাধ্যমে জানতে পারি, গেরিলা অভিযানকারী এসব লোক কোন্ উপজাতির এবং কোন্ গ্রামের অধিবাসী ছিল।
মেহমন্দ এবং ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট
এই প্রসঙ্গে আরো একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য, যেখানে মেহমন্দ উপজাতি এবং ইণ্ডিয়ান আর্মীর মধ্যে সংঘর্ষ বেধেছিল।
১৯৩৫ ঈসায়ীতে মেহমন্দ উপজাতি বৃটিশ ভারত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং যুদ্ধ শুরুও হয়ে যায়। এই বিশৃঙ্খলার কয়েক মাস আগেই কেবল আমার (গ্রন্থকারের) কোম্পানী বার্ষিক প্রশিক্ষণ মহড়ার উদ্দেশ্যে উক্ত এলাকায় চার সপ্তাহ কাটিয়ে এসেছিল। তখন উপজাতীয় মালিক (সর্দার) আমাদের দাওয়াত করতে ক্যাম্পে এসেছিল এবং আমরা তার মেহমানদারীর স্বাদও উপভোগ করেছিলাম। সে সময় আমাদের কল্পনায় কিংবা চিন্তা-চেতনায়ও আসেনি যে, অল্প দিন পরেই আমরা পুনরায় এই এলাকায় যুদ্ধ করতে আসব। কোথায় এ অবস্থা যে, পল্টনের এক কোম্পানী শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে উক্ত এলাকায় ভয়-ভাবনাহীনভাবে ঘুরল-ফিরল আর কোথায় এ অবস্থা যে, একটি পরিপূর্ণ বিগ্রেড, যার সাহায্যে কামানবাহী গোলন্দাজ ইউনিট এবং উড়োজাহাজ প্রভৃতিও প্রস্তুত ছিল, গীলানাঈ গিরিপথের পারে কয়েকটি সংঘর্ষের পর তবে যেতে পেরেছিল। গীলানাঈ পার হবার পরও আমাদের অগ্রাভিযান অব্যাহত থাকে। একদা রাত্রি অতিক্রান্ত হবার পর ভোরবেলা দেখতে পেলাম, আমাদের ক্যাম্পের চারিদিককার টেলিফোনের তার কেটে দেওয়া হয়েছে এবং স্থানে স্থানে ইশতিহার লটকে দেওয়া হয়েছে। এসব ইশতিহার আমাদের টহলদানকারী প্লাটুন ভোরবেলা গুছিয়ে নিয়ে আসল। এসব ইশতিহার ছিল আমার নামে এবং এতে আমাকে বলা হয়েছিল উপজাতীয়দের বিরুদ্ধে লড়াই না করতে। অন্যথায় তারা আমাকে মৃত্যুমুখে পাঠিয়ে দেবে। এ থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ঐসব লোকের জানা ছিল যে, কোন্ কোন্ ফৌজ এই ব্রিগেডে শামিল আছে এবং তারা কোথায় কোথায় অবস্থান করছে।
কতকগুলো কারণে ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার সাহেব কয়েকদিনের জন্য অগ্রাভিযান মুলতবী রাখেন। প্রতি রাত্রেই বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে উপজাতীয় বাহিনী আমাদের ক্যাম্পের বিভিন্ন স্থানে অত্যন্ত নির্ভীকভাবে হামলা করত এবং এটা প্রকাশ করতে চাইত যে, রাত্রের রাজত্ব উপজাতীয়দের হাতে। উল্লিখিত মেহমন্দ উপজাতির সুবেদার হিকমত খান আমার সিনিয়র সুবেদার ছিলেন। তিনি এসব হামলা প্রতিরোধের জন্য আমাকে যে পরামর্শ দেন তা ছিল খুবই সাদাসিধে, কিন্তু খুবই নির্ভীক এবং সাহসিকতাপূর্ণ। তাকে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সামনে পেশ করি। তার পরামর্শ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সতর্ক করে দেওয়া হয় যে, ব্যর্থতার ক্ষেত্রে আমার চাকুরী হুমকির সম্মুখীন হবে এবং দুর্নাম হবে আমার অতিরিক্ত পাওনা। কিন্তু যেহেতু হিকমত খানের উপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস ছিল এবং তার যোগ্যতার ব্যাপারেও আমার পরিপূর্ণ আস্থা ছিল সেজন্য আমি যে কোন অবস্থার সম্মুখীন হতে রাযী হই।
সুবেদার হিকমত খানের পরিকল্পনা ছিল সাদাসিধে। তিনি তিন রাত্রি তার নির্বাচিত জওয়ানদের নিয়ে টহল দিয়ে উপজাতীয় লোকেরা যে যে পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে এসেছে, সেগুলো দিনের বেলা সনাক্ত করে নেন এবং তার প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা স্থির করে আমার পরামর্শ চান। আমি তার পরিকল্পনায় খুব কমই সংশোধন করি এবং অনুমোদনের জন্য ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের সামনে পেশ করি।
সন্ধ্যা হতেই এই ক্ষুদ্র প্লাটুন বেরিয়ে পড়ে। অর্ধেক রাত্রির পর উপজাতীয়রা শিবিরের উপর গুলী চালাতে আসে। ভোর চারটা পর্যন্ত কয়েক জায়গায় তারা গুলী চালায়। অতঃপর তারা ফিরে যায়। তাদের নিয়ম ছিল যে, তারা সবাই রাত্রিকালে হামলা চালিয়ে অবশেষে এক জায়গায় একত্র হ’ত এবং পরের দিনের কর্মসূচী স্থির করত। তারা প্রথমে নিশ্চিত হয়ে যেত যে, তাদের কোন সাথী আহত হয়নি কিংবা পথ হারিয়ে ফেলেনি। এর পর তারা দু’টি ভিন্ন পথে ফিরে যেত। পূর্ব রাত্রে চাঁদ উঠেছিল। উপজাতীয়রা যখন ঐসব আত্মগোপনরত বাহিনীর নিকট দিয়ে যাচ্ছিল তখন তারা তাদের উপর হালকা মেশিনগানের সাহায্যে হামলা চালায়। এতে তারা পিছু হটে যায় যাতে করে অন্য পথ ধরে বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু তারা পিছু হটতেই লুকায়িত অপর প্লাটুন তাদের উপর বোমা ও সঙ্গীনের সাহায্যে হামলা করে। কিছু হাতাহাতি লড়াইও হয়। উপজাতীয়দের অনেকেই মারা যায়। আহত ও নিহতদের থেকে জানা যায় যে, এসব লোকের অধিকাংশই ছিল আফগানিস্তান এলাকার, যারা আমাদের ফেতনাবাজ লোকদেরকে তাদের সঙ্গে টেনে নিয়েছিল। বাকী লোকেরা জীবনের মায়ায় বিপদের ভয়ে তাদের সহযোগী সেজেছিল। উপজাতীয়দের উপর এই শাস্তির গভীর প্রভাব পড়ে।
উল্লিখিত দৃষ্টান্ত থেকে এটা পরিষ্কার যে, গেরিলাদের বিরুদ্ধে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি ভীষণ জরুরী:
১. অধিনায়কের ভেতর অটুট সংকল্প থাকতে হবে এবং তিনি শাস্তি কিংবা পুরুস্কারের জন্য তৈরী থাকবেন।
২. প্রতিটি জওয়ানের মধ্যে ধৈর্য ও স্থৈর্যের সঙ্গে অনিবার্যভাবেই সাহসিকতাও থাকতে হবে।
৩. গেরিলাদের বিরুদ্ধে লড়াইরত বাহিনীকে সাধারণত হাতাহাতি যুদ্ধের জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে।
৪. গেরিলারা শত্রুর বিরুদ্ধে উন্নতমানের গোয়েন্দাগিরি করে। অতএব তাদের বিরুদ্ধে গৃহীত যে-কোন কার্যক্রম গোপন রাখতে হবে এবং কার্যক্রম গ্রহণকারী বাহিনীর জন্য স্বল্প থেকে স্বল্পতর সময়ের পূর্বে নির্দেশ জারী করতে হবে। তারপরও দেখতে হবে যে, গেরিলারা কোনভাবে তা জানতে পেরেছে কি না।
৫. ত্বরিত গতি ও কঠোরপ্রাণা হওয়া যে সব সিপাহী ও অফিসারের জন্য অপরিহার্য তাদেরকেই গেরিলাদের বিরুদ্ধে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পাঠাতে হবে।
৬. উল্লিখিত বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের কেবল নিজের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস থাকলেই চলবে না, স্বীয় সঙ্গী-সাথীদের উপরও তার পুরো আস্থা থাকতে হবে।
সামরিক গতিবিধির যোগ্যতা
শত্রুর বিরুদ্ধে যখন ফৌজ পাঠানো হয় তখন সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগ এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে চায় যে, ফৌজকে যে কাজের জন্য পাঠানো হচ্ছে সে কাজের যোগ্যতা তাদের আছে কিনা।
এই যোগ্যতার পরিমাপ ফৌজের পরিমাণ, সমরাস্ত্র, পরিবহন, রসদ-সম্ভার, ফৌজের প্রতিটি অংশের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহায়তা এবং সমরাস্ত্র ও রসদের দৈনন্দিন ঘাটতি পূরণ ব্যবস্থা থেকে করা হয়। উদাহরণত, যদি ফৌজের কোন একটি অংশও কমযোর হয় তাহলে গোটা ব্যবস্থাই ভেস্তে যাবে। যে অধিনায়ক এ প্রয়োজন-গুলোকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখেন না—তার ব্যর্থতা অনিবার্য।
১৯৩৯-৪৫ ঈসায়ী সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার যখন রাশিয়ার উপর হামলা করেন তখন তিনি রাশিয়ার আবহাওয়া ও মৌসুম এবং তার রাস্তাঘাট সম্পর্কে সঠিক পরিমাপ করেন নি। দৃষ্টান্তস্বরূপ, সেখানে ভীষণ ঠাণ্ডা ও তুষারপাতের কারণে ট্যাংক ও বিমান যে ব্যবহার করা যায় না এবং সড়কগুলো বৃষ্টি কিংবা বরফ গলবার পর যে অত্যন্ত খারাপ এবং পিচ্ছিল হয়ে ওঠে সে সম্পর্কে তিনি অবহিত হন নি। তাঁর অদূরদর্শিতার কারণে জার্মানীর বিজয়ী ফৌজকে ভীষণ প্রাণহানি ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
রাশিয়ান ফৌজও ফিনল্যাণ্ডে ঐ একই ভুলের কারণে চরমভাবে নাকানী-চুবানী খায়। কিন্তু আমরা যখন মুহাম্মদ বিন কাসিমের অভিযান সম্পর্কে চিন্তা করি তখন দেখতে পাই যে, তিনি পূর্বাহ্নেই তাঁর অভিযানের প্রতিটি দিক সম্পর্কে অত্যন্ত চিন্তা-ভাবনা করেছেন। উদাহরণত, লম্বা দূরত্ব, দূরতিক্রম্য রাস্তা, বিভিন্ন ধরনের এলাকা, কোথাও খাদ্যের প্রাচুর্য, কোথাও আহার্য ও পানীয় দ্রব্যের অপ্রতুলতা, কোথাও সুপেয় পানির প্রাচুর্য ইত্যাদি দিক সম্পর্কে তিনি পূর্বাহ্নেই ভেবে নিয়ে কর্মসূচী নির্ধারণ করেছেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের অভিযানের সাফল্য তাঁর অশ্বারোহী ও উষ্ট্রারোহী বাহিনীর উপর ছিল নির্ভরশীল অর্থাৎ এ জন্য দরকার ছিল তাঁর ভাল জাতের ঘোড়া ও উটের। তিনি যথাসময়ে তা সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন। তাঁর ফৌজের সংখ্যা ছিল কম। তিনি এই ঘাটতি পূরণের জন্য তাঁর বাহিনীতে সিন্ধী যুবকদের ভর্তি করেন। তিনি তাঁর ফৌজের ভারসাম্য বজায় রেখে তাদের চলাচল ও গতিবিধির যোগ্যতা বহাল রাখেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিম স্থল ও নৌ—উভয় ধরনের পরিবহনই যথাযথভাবে ব্যবহার করেন। তিনি তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীকে রাজা দাহিরের ফৌজের পশ্চাদ্দেশে অথবা দেশের যেখানেই ইচ্ছা সেখানেই সাফল্যের সঙ্গে নিয়ে গেছেন।
অতএব যিনিই সিপাহ্সালার হোন—তার জন্য অবশ্য কর্তব্য হ’ল, যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার পূর্বে স্বীয় ফৌজের প্রতিটি দিক সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।
মুহাম্মদ বিন কাসিম কেবলমাত্র অশ্বারোহী বাহিনী কেন সঙ্গে নিলেন
এখানে প্রশ্ন জাগে, মুহাম্মদ বিন কাসিম কেবল অশ্বারোহী ফৌজকে কেন সঙ্গে নিলেন? এর কারণ হ’ল এই যে, তাঁকে কয়েক হাযার মাইল পথ সফর করতে হবে বিধায় তাঁর ফৌজের অশ্বারোহী বাহিনীকেই কেবল তিনি সঙ্গে নেন—যে বাহিনী আধুনিক কালের ট্যাংক বাহিনীর মর্যাদায় অভিষিক্ত ছিল, আর উষ্ট্রারোহী বাহিনী ছিল মোটর আরোহী বাহিনীর মর্যাদায়।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের মুকাবিলা ছিল রাজা দাহিরের হস্তী বাহিনী, হিন্দী ঘোড়সওয়ার এবং পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে। কিন্তু হিন্দী ফৌজ সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত ছিল না। কেননা তাদের প্রশিক্ষণ বিশেষ কোন মূলনীতির আওতায় হ’ত না। এ যেন ছিল এক বিশাল জনসমাবেশ, যারা রাজার প্রতি তাদের স্বাভাবিক আনুগত্যের কারণে জীবন নিয়ে খেলতে তথা যুদ্ধ করতে এসেছিল। নিজের বীরত্বে তারা খুব আস্থাবান ছিল। এটা ছিল সে ধরনেরই গ্রুপ, যাদের সম্পর্কে নেপোলিয়ন বলেছেন:
“দু’জন মামলুক তিনজন ফরাসী অশ্বারোহী সৈনিককে অনায়াসে পরাস্ত করতে পারে। এই হিসাবে ১০০ জন মামলুক (অর্থাৎ আলজিরীয় অশ্বারোহী সৈনিক)-এর সাথে যদি ১০০ জন ফরাসী অশ্বারোহী সৈনিকের মুকাবিলা হয় তাহলে আমার মতে তারা সমকক্ষ হবে। কিন্তু মামলুকদের সংখ্যা যদি তিনশত করে দেওয়া হয় এবং তাদেরকে তিনশত ফরাসী অশ্বারোহী সৈনিকের মুকাবিলায় এনে দাঁড় করানো হয়, তাহলে ফরাসী অশ্বারোহী কোম্পানী নিশ্চিতরূপেই জয়ী হবে। এ সংখ্যা যদি আরো বাড়িয়ে দেওয়া যায় এবং একদিকে এক হাযার ফরাসী অশ্বারোহী সৈনিক এবং অন্যদিকে পনের’শ মুসলিম অশ্বারোহী সৈনিক হয় তাহলে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, প্রত্যেকবারই মামলুক-মুসলমানদের পরাজয় হবে।
“আমার এরূপ ভাষ্যের কারণ হ’ল, মামলুকরা বীর-বাহাদুর এবং সর্বোত্তম লড়াকু সৈনিক বটে। ব্যক্তিগত শৌর্য-বীর্যের দিক দিয়েও তারা একজন ফরাসী সৈনিকের তুলনায় আমার মতে শ্রেষ্ঠতর। কিন্তু যেহেতু তাদের মধ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলা নেই, বিন্যাস নেই, তাই তারা একত্রে সংবদ্ধ ভাবে লড়াই করতে জানে না। এ জন্যই তাদের সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে—তাদের লড়াই করবার দক্ষতাও সামগ্রিকভাবে ততই হ্রাস পেতে থাকে।
“তবে হ্যাঁ, যদি মামলুকদেরকে সুশৃঙ্খল ও সুসংহত করা যায় তাহলে তারা—যেহেতু প্রকৃতিগতভাবে অশ্বারোহণে পটু, কঠোর প্রাণা এবং সৈনিক বৃত্তিতে আগ্রহী—বিশেষ করে যখন তাদের ঘোড়াগুলোও সর্বোত্তম মানের হয়ে থাকে—খুবই বিপজ্জনক ও শক্তিশালী ফৌজে পরিণত হতে পারে।”
আমাদের ধারণায় আরব ও হিন্দী উভয় জাতিরই অশ্বারোহী সৈনিক ব্যক্তিগতভাবে শৌর্য-বীর্যে সমমানের ছিল। কিন্তু আরব সৈনিকরা ছিল সুশৃঙ্খল, সুসংহত ও সুবিন্যস্ত। অপরপক্ষে হিন্দী সৈনিকরা ছিল এসব গুণাবলী থেকে বঞ্চিত।
এই ঠাকুর এবং জাটরাই যখন মুহাম্মদ বিন কাসিমের পতাকাতলে সুসংবদ্ধ হয়ে লড়াই করে তখন তারাও একটি বিজয়ী দলে পরিণত হয়। বৃটিশ অফিসারগণ ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এই একই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটান। মোগল ও মারাঠা ফৌজ নিৰ্ভীক ও সাহসী বীরযোদ্ধা ছিল বটে, কিন্তু সুসংহত ও সুসংবদ্ধ ছিল না এবং তাদের সামরিক যোগ্যতাকে যথাযথভাবে কাজেও লাগানো হয়নি। অপরদিকে ইংরেজ অফিসারগণ ভারতীয় যুবকদের ছোট ছোট প্লাটুনে সুসংহত ও সুসংগঠিত করে সেই প্লাটুনগুলোকে বড় কোম্পানীর সাথে জুড়ে দেন। এভাবে তারা ভারতীয় যুবকদের দিয়ে একটি উন্নত ধরনের সেনাবাহিনী গঠন করেন। এই ভারতীয় সেনাবাহিনী দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম লড়াকু ফৌজ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ভাল অধিনায়ক পেলে ভারতীয় সৈনিক বিশ্বের যে কোন সৈনিকের চেয়ে যে কম যায় না—তা তারা হাতে কলমে প্রমাণ করে দেখিয়েছে।
সামরিক বাহিনীতে অহংবোধ এবং জাতীয় প্রেরণা থাকা আবশ্যক। এক্ষেত্রে ‘লীড্ল হার্ট’ বর্ণিত একটি ঘটনা প্রণিধানযোগ্য।
“১৯১৫ ঈসায়ীতে জার্মানীর ক্রমবর্ধমান শক্তিদৃষ্টে ফ্রান্স ও ইংল্যাণ্ড, জার্মান কর্তৃক আক্রান্ত হলে, একে অপরকে পারস্পরিক সামরিক সাহায্য প্রদানের প্রশ্নে চিন্তা-ভাবনা করছিল। এক আলোচনা বৈঠকে বৃটিশ প্রতিনিধি স্যার হেনরী উইলসন ফরাসী প্রতিনিধি জেনারেল ফো (Foch)-কে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আমাদের সরকার জানতে চান, যুদ্ধ দেখা দিলে ফ্রান্স আমাদের কাছে কি পরিমাণ সাহায্যকারী ফৌজ চাইতে পারে? আমাদের সরকার এটা জানতে চান এইজন্য যে, বৃটিশ সরকারের কাঁধে আরও বহুবিধ দায়িত্ব ও কর্তব্যের বোঝা রয়ে গেছে।’ এর জওয়াবে জেনারেল ফো বলেন, ‘সাহায্য হিসেবে আমরা তখন কেবলমাত্র একজন বৃটিশ সৈনিকই চাইব।’ জেনারেল ফো-র জবাব বিদ্রুপাত্মক ছিল না, বরং তিনি বেশ ভালভাবেই জানতেন যে, ঐ একটি বৃটিশ নাগরিকের জীবন রক্ষার্থে ইংলণ্ড তার সমস্ত শক্তি ফ্রান্সের সাহায্যার্থে নিয়োজিত করবে।”
এ বর্ণনার সপক্ষে দলীল-প্রমাণ পেশ করবার দরকার নেই। কেননা আমরা সবাই জানি যে, ১৯১৪-১৮ ঈসায়ীর বিশ্বযুদ্ধ একটি মাত্র লোকের হত্যার রক্তপণ আদায়ের দাবীকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছিল।
আমাদের উপলব্ধিতে একথা আসে না যে, কোন কোন ঐতিহাসিক কি করে হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে জালিম এবং নিষ্ঠুর আখ্যা দিলেন, যখন তিনি তাঁর নাগরিকের রক্তপণ আদায় তথা আপন কওম ও মিল্লাতের অহঙ্বোধ বাঁচিয়ে রাখবার জন্যই রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুর উপর হামলা করেছিলেন এজন্য যে, রাজা দাহির মুসলিম মহিলাদের অসম্মান ও মুসলিম বণিকদের হত্যা করিয়েছিলেন। এ ছাড়া তিনি মুসলিম দূতকে কেবল অপমানই করেন নি, বরং তাকে হত্যাও করেছিলেন। অতএব সিন্ধুর উপর মুহাম্মদ বিন কাসিম কেবল বাহানাবাজীর আশ্রয় নিয়ে হামলা করেন নি, বরং মুসলিম জাতির মান ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্যই তা করেছিলেন। যদি এই বাস্তব সত্য স্বীকার করে নিতে কারুর আপত্তি থাকে তাহলে তিনি নিম্নোক্ত ঘটনাবলী সম্পর্কে কি রায় দেবেন?
১. আবিসিনিয়ার (ইথিওপিয়া) বাদশাহ থিওডোর একজন ইংরেজ নাগরিককে কোন অপরাধের কারণে বন্দী করলে বৃটিশ গভর্নমেন্ট উক্ত নাগরিককে তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তি দানের আবেদন জানায়। থিওডোর তাকে মুক্তি দিতে অস্বীকার করলে বৃটিশ ১৮৬৮ ঈসায়ীতে আবিসিনিয়াকে আক্রমণ করে বসে।
২. ১৮৬০ সালে চীনের সঙ্গে বৃটেনের যুদ্ধ ঐ একই কারণে সংঘটিত হয়।
৩. ১৮৬৩ সালে ফরাসীরা এ ধরনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েই হাওয়াসের উপর চড়াও হয়েছিল।
এসব দৃষ্টান্তের সাথে সেসব সরকার জড়িত যাদেরকে আজকাল শান্তির রক্ষক (?) বলে অভিহিত করা হয়। অথচ আমরা যখন ঐ একই পাল্লায় মুহাম্মদ বিন কাসিমের হামলাকে মাপি, তখন ভিন্নমত পোষণ করা হয়। কী অদ্ভুত বৈপরিত্য!
মন্ত্রীবর্গ এবং প্রতিরক্ষা স্টাটেজী
ফিল্ড মার্শাল রবার্টসন বলেন: “আজকাল যুদ্ধের পূর্বে এবং যুদ্ধ চলাকালেও ফৌজের জেনারেল হেড কোয়ার্টার প্রকৃতপক্ষে কমাণ্ডার-ইন-চীফের দফতরে থাকে না, বরং তা মন্ত্রীদের দফতরে গিয়ে ওঠে। অর্থাৎ আজকাল মন্ত্রীদের দফতরেই অভিযান প্রেরণের সিদ্ধান্ত এবং প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা জন্ম নেয় এবং সেখানেই অভিযানের প্রতিটি দিকের খুঁটিনাটি সম্পর্কে গভীর আলাপ-আলোচনা হয়ে থাকে এবং সেখানেই রাজনীতিবিদরা প্রতিটি সমস্যার চুলচেরা বিশ্লেষণ শেষে গুরুত্বপূর্ণ ফয়সালা প্রদান করেন। আর সেনাপতির দায়িত্ব হচ্ছে কেবল সে সব ফয়সালা তথা পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করা।”
অতীতকালে রাজা-বাদশারা এ কাজটি নিজেরাই সম্পাদন করতেন। মন্ত্রী এবং জেনারেল তাঁদের পরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করতেন। আজ অন্যেরা তাদের স্থান দখল করে নিয়েছে।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এই মূলনীতির উপরই কাজ করেন এবং মুহাম্মদ বিন কাসিমকে ফৌজ, সমরাস্ত্র, রসদ, পরিবহন, চিকিৎসা-সামগ্রী, অর্থকড়ি—সর্বোপরি প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিয়ে সিন্ধুর দিকে প্রেরণ করেন। তাঁকে বিদায় করে দেবার পরও তিনি বিবিধ ব্যবস্থা সম্পন্ন করার কাজে ব্যাপৃত থাকেন, যাতে করে মুহাম্মদ বিন কাসিম কোন জিনিসের ঘাটতি অনুভব না করেন। তিনি দিক-নির্দেশনা দেন বটে, তবে উপস্থিত কর্মপন্থা গ্রহণের বিষয়টি মুহাম্মদ বিন কাসিমের উপরই ছেড়ে দেন।
যেভাবে সেই মহান শিক্ষক নিজেকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম প্রতিরক্ষা পরিকল্পনাবিদরূপে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, ঠিক তেমনি প্রতিটি মুসলমানের উচিত এ ধরনের দায়িত্ব পালনের জন্য নিজেকে সর্বদা প্রস্তুত রাখা।
জিহাদ প্রতিটি মুসলমানের উপর ফরয এবং কোন মুসলমানই এ দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। আমরা স্যার উইস হেগ-এর Cambridge History-র তৃতীয় খণ্ড পড়েছি। আফসোসের বিষয় যে, তাতে এই সম্মানিত গ্রন্থকার ইসলামী জিহাদ-এর ব্যাখ্যায় ন্যায়-বিচার ও নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে পারেন নি।
এই সম্মানিত লেখক স্যার উইলিয়াম ম্যুরের ধ্যান-ধারণার উল্লেখ করেছেন এবং উইলিয়াম ম্যুর জিহাদ-দর্শন, জিযয়া এবং বিজিত জাতি-গোষ্ঠীর সঙ্গে মুসলমানদের আচার-ব্যবহারের যে পর্যালোচনা করেছেন তিনি তাঁর সঙ্গে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। এ ধ্যান-ধারণা যে কতখানি ভিত্তিহীন তা আমরা সেসব আহকাম থেকে প্রমাণ করব, যেসব আহকাম আঁ-হযরত (সা), হযরত আবূ বকর (রা) এবং অন্যান্য খলীফা অভিযানে পাঠাবার প্রাক্কালে তাঁদের অধিনায়কদেরকে প্রদান করেছিলেন।
কুরআন মজীদ নিউ টেস্টামেন্টের মত কোন মানব রচিত গ্রন্থ নয়। এই পবিত্র গ্রন্থ সংস্কার কিংবা সংশোধনের কোন প্রয়োজন নেই এবং অদ্যাবধি এমন অপচেষ্টা কেউ করেও নি। এজন্য এই প্রশ্নও ওঠে না যে, মুসলিম ‘আলিম-উলামা কুরআন মজীদের আহকামে কোন রকমের হেরফের করে থাকবেন।