ক্রডিস-এর উপর এক নজর

এই প্রশ্নের উত্তর জানবার জন্য আমরা প্রথমে ‘ক্রডিস’-এর যুদ্ধ নীতি সম্পর্কে আলোচনা করব।

ক্রডিস-এর সংজ্ঞা

ক্লডিস গ্রীক শব্দ (Croat) থেকে উদ্ভূত। এটি ছিল একটি যুদ্ধ-পদ্ধতি; সম্ভবত আলেকজাণ্ডার কিংবা তাঁর পিতা ফিলিপ এ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন। এই যুদ্ধনীতির অধীন অধিনায়ক তাঁর অধীনস্থ ফৌজকে নিম্নরূপ বিন্যস্ত করতেন :

মুকাদ্দামা— (Advance Guard) অগ্রগামী বাহিনী।

মায়মানা— (Right flank) দক্ষিণবাহু।

কাল্‌ব আল-জায়শ— (Main body), মূল বাহিনী যেখানে সম্রাট কিংবা সর্বাধিনায়ক পতাকাসহ অবস্থান করেন।

মায়সারা— (Left flank), বাম বাহু।

সাকা— (Rear Guard), পশ্চাদ রক্ষী বাহিনী।

এই যুদ্ধনীতির অধীন গ্রীকরা, অতঃপর রোমকরা নিজেদের বাহিনীকে কয়েক অংশে বিভক্ত করে সেই সব অংশকে বৃত্তাকারে দাঁড় করিয়ে দিত যাতে করে শত্রু বাহিনী এক অংশকে চাপ দিয়ে পর্যুদস্ত করে দিলেও অন্য অংশ আপন স্থানে অটল থেকে শত্রুর অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে পারে। এ লক্ষ্য সোজাসুজি কাতারে অর্জিত হওয়া সম্ভব নয়।

খালিদ (রা) বিন ওয়ালীদ মুতার যুদ্ধে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে রোমকদের যুদ্ধনীতি পরখ করে দেখেন। অতঃপর এই নীতিকে নতুন রূপে ও নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজিয়ে রোমকদের বিরুদ্ধে প্রথমে মুতার যুদ্ধে, অতঃপর ইয়ারমুক যুদ্ধে অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে তা প্রয়োগ করেন। এতে তিনি যে পরিবর্ধন করেন তা হ’ল, বাহিনীর প্রতিটি অংশে এই নীতিমালাকে দৃঢ়তার সাথে বজায় রাখা যাতে মুজাহিদদের ভেতর ঐক্য ও সংস্কৃতি কায়েম থাকে এবং তারা একটি প্রাচীরের ন্যায় অগ্রসর হয়ে শত্রুর উপর আঘাত হানতে পারে। উপরন্তু তিনি অশ্বারোহী প্লাটুনকে এক জায়গায় এবং পদাতিক বাহিনীকে অন্য জায়গায় সন্নিবেশিত করেন।

খালিদ (রা) বিন ওয়ালীদ তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীর কাতারকে হাদীছে নববীর নির্দেশিত পন্থায় সোজা ও মিলিতাবস্থায় রাখেন। অবশ্য Echelon-এর মূলনীতি অনুযায়ী তিনি তাদেরকে নিম্নরূপ অগ্রপশ্চাৎ করে দাঁড় করান :

ফলে শত্রুরা মুজাহিদ বাহিনীর সংখ্যা সঠিকভাবে পরিমাপ করতে পারেনি। সমরকুশলী খালিদ (রা) তাঁর অল্প সংখ্যক সৈন্যকে শত্রুর সামনে এমনভাবে পেশ করেন যে, তাদেরকে সংখ্যায় অনেক বেশী দেখায়। ফলে শত্রুরা হয়ে পড়ে ভীত-সন্ত্রস্থ।

এই যুদ্ধনীতির ফলে বাহিনীর প্রতিটি পার্শ্ব শত্রুর অতর্কিত ও আকস্মিক হামলার হাত থেকে নিরাপদ থাকে। ঘটনাচক্রে দুশমন ফৌজের একটি অংশকে কুপোকাত করে ফেললেও অপরাংশ তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসে শত্রুর উত্তাল গতিকে থামিয়ে দিতে পারত। মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁর পূর্বসূরী প্রখ্যাত সিপাহসালার খালিদ (রা) বিন ওয়ালীদের সত্যিকার অর্থেই শাগরিদ ছিলেন। কেননা তিনিও কয়েকটি যুদ্ধে এই নীতি অবলম্বন করে জয়লাভ করেছিলেন।

আঁ-হযরত (সা)-এর উপযুক্ত শাগরিদ হযরত আবু বকর (রা) এবং খালিদ (রা) বিন ওয়ালীদ তাঁদের বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে যেভাবে বিন্যস্ত করতেন তা হ’ল,

১. দ্বিতীয়ার চাঁদের মত বাঁকা  ফলাযুক্ত অথবা এই রকম  সোজা। এই যুদ্ধনীতি দ্বারা শত্রু ফৌজকে ঠিক সেভাবে দাবানো হ’ত যেভাবে একজন কুস্তীগীর তার প্রতিপক্ষকে দুই বাহুর মাঝে দাবিয়ে ফেলে।

২. সংযুক্ত চাঁদ ◡ ◡ ◡ অর্থাৎ গোটা বাহিনীকে তিন অংশ ভাগ করে দেওয়া হ’ত এবং তিনটি অংশকে চাঁদের আকারে দাঁড় করান হ’ত। এই মূলনীতি সাধারণত অশ্বারোহী বাহিনীর ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হ’ত যাতে করে শত্রু সেনাকে জয়লাভের ক্ষেত্রে দু’দিক থেকে ঘিরে ফেলা যায়। পরাজয়ের অবস্থায় নম্বর ১ এবং নম্বর ৩ চন্দ্র নম্বর ২ কে সাহায্য করত।

৩. তৃতীয় পন্থা ▓ চতুর্ভুজ কিংবা সমান্তরাল ক্ষেত্রের ন্যায় ক্ৰডিস। এই পন্থা পদাতিক বাহিনীকে অশ্বারোহী বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচাবার উদ্দেশ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে অবলম্বন করা হ’ত। বিশেষ করে ছাউনী ফেলার সময় অথবা রাত্রিকালীন অতর্কিত হামলার হাত থেকে বাঁচবার জন্য এই পন্থা অনুসরণ করা হ’ত।

৪. উল্টা চাঁদ ; এই পন্থা সাধারণত জঙ্গল কিংবা অসমতল ভূমিতে অগ্রসর হবার মুহূর্তে অবলম্বন করা হ’ত, যাতে করে জ্ঞাত দিক থেকে হামলাকে প্রতিরোধ ও প্রতিহত করা যায়। এই নীতি সাধারণত অশ্বারোহী প্লাটুন স্বীয় সেনাদলকে বাঁচাবার উদ্দেশ্যে অনুসরণ করত।

৫. চতুর্ভুজ ▓▓ অথবা সমান্তরাল ক্ষেত্র; এটি ছিল রোমক ও পারসিক পদ্ধতি। ইসলামী ফৌজ এ পদ্ধতি ব্যবহার করেনি। অবশ্য ইংরেজরা নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধগুলোতে এই যুদ্ধনীতিকে সফল ও সার্থকভাবে অনুসরণ করেছিল।

৬. ত্রিভুজ ► যুদ্ধনীতিকে মুসলিম মুজাহিদবৃন্দ সেকেন্দ্রা ও দারার যুদ্ধে ইরানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছিল।

ইসলামী ফৌজ যুদ্ধক্ষেত্রে রাত্রিবেলা বিশ্রাম নেওয়ার সময় এবং শত্রুর আকস্মিক ও অতর্কিত হামলা থেকে নিরাপদ থাকবার জন্য এই যুদ্ধনীতিকে প্রয়োগ করত। মিত্রশক্তি ও জার্মানী কয়েক- বার বিশ্ব-যুদ্ধগুলোতে সাফল্যের সঙ্গে হামলার মুহূর্তে এই যুদ্ধনীতির পুনরাবৃত্তি করে।

‘আন্-নাফীর! আন্-নাফীর!’ যখন ফৌজের আমীর কিংবা অধিনায়ক “আন্-নাফীর” বলে আওয়াজ দিতেন তখন এর অর্থ হ’ত, ‘হামলা কর’।

‘আর-রাজ’আ! আর-রাজ’আ!’ স্বীয় আমীরের মুখ থেকে ‘আর-রাজ’আ’ আওয়াজ শুনে সেনাবাহিনী মনে করত যে, এসময় হামলা করা সমীচীন হবে না।

‘আল-খায়ল!’ আওয়াজে অশ্বারোহী বাহিনী শত্রুর উপর আক্রমণোদ্যত হ’ত।

‘আল্‌-আব্দ!” আওয়াজ শ্রবণ করতেই আরোহী তার অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে পড়ত যেন জানোয়ারগুলো বিশ্রাম পায়।

মোট কথা, আজকাল যেমন বিউগল, আওয়াজ কিংবা ইশারা-ইঙ্গিতে নির্দেশ পৌঁছে দেওয়া হয়—ঠিক তেমনিভাবে মুসলিম ফৌজে বিভিন্ন ধরনের গতিবিধির জন্য বিভিন্ন বিধি-বিধান ও ইশারা-ইঙ্গিত চালু ছিল। যেমন— ইত্তিবা‘উ’ল-মায়সারা, ইত্তিবা‘উ’ল-মায়মানা, জায়শ মাখরাফ, জায়শ মুস্তাক়ীম, জায়শ সূরাব, তাক়াদ্দুম, হ়াশ্‌ও তারতীব বা‘দ, তারতীব আল-ইনক়িলাব, আল-ইনফিতাল ইত্যাদি।

‘হূজওফা’— ‘হূবরা’! যে সময় অধিনায়ক এটা চাইতেন যে, স্বীয় সেনাবাহিনীকে কোন দিকে টেনে নিয়ে যাবেন অথবা তাকে বিশেষ কোন অবস্থা অর্থাৎ যুদ্ধনীতি, যেমন—চাঁদ ইত্যাদি মুতাবিক সুসজ্জিত ও সুসংগঠিত করবেন তখন সৈন্যেরা ঐসব শব্দ শোনার পর স্বীয় অধিনায়কের ইঙ্গিতের অপেক্ষা করত। যেমন, “হুজওয়া” শুনতেই সৈন্যরা স্বীয় অধিনায়কের দিকে চলা শুরু করত এবং “হূবরা” শোনার পর এর বিপরীত কর্মটি করত অর্থাৎ ফিরে যেত।

‘শি‘আর!’ একে আজকাল Pass word বলা হয়। আঁ-হযরত (সা) এটির প্রচলন করেন যেন ইসলামী ক্যাম্পে তথা মুসলিম সেনাশিবিরে কোন গুপ্তচর (বিশেষ করে) রাত্রিবেলা আসতে না পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, মুহাজিরদের সাংকেতিক চিহ্ন ছিল, ‘ইয়া বনী ‘আবদি’র-রাহমান!’ এবং আনসারদের ছিল,— ‘ইয়া বনী ‘উবায়দুল্লাহ!’ এই সাংকেতিক চিহ্ন কিন্তু বরাবর পরিবর্তিত হ’তে থাকত যাতে করে আপন ও পরের মাঝে পরিচয় খুঁজে বের করা যায়।

এখন আমরা কাতারবন্দী সম্পর্কে আমাদের মতামত পেশ করা সমীচীন মনে করছি। উক্ত যুদ্ধ পদ্ধতি প্রচলন করার সময় আঁ-হযরত (সা)-এর সম্ভবত নিম্নরূপ উদ্দেশ্য ছিল (আল্লাহ ই সঠিক জানেন) :

১. ফৌজ— বিশেষ করে অশ্বারোহী বাহিনী এমন একটি প্রাচীরের মত শত্রুর দিকে অগ্রসর হবে যার ভেতর কোন ফাটল থাকবে না এবং তা কোনরূপ অসমঞ্জস কিংবা বাঁকা-তেড়া হবে না।

ফাটলের কারণে উৎসাহী দুশমন মুজাহিদদের কাতারের ভেতর ঢুকে পড়তে পারে এবং এর প্রতিক্রিয়া প্রায় সময়ই খারাপ হতে বাধ্য।

অসমঞ্জস হবার কারণে হামলার টক্কর শত্রুর উপর একই সঙ্গে গিয়ে পড়ে না। এটা খুবই স্পষ্ট যে, যখন কয়েক হাযার সিপাহীর প্রচণ্ড ভীড় ও চাপ শত্রুর উপর আছড়ে পড়ে তখন তাদের সমস্ত আশা-ভরসা ও হিম্মত কর্পূরের মতই উবে যায়।

২. কাতারসমূহ সুবিন্যস্ত করবার উদ্দেশ্য ছিল এই যে, এতে শত্রুর হামলার আঘাত বরাবর উপর্যুপরি পড়তে থাকবে। পশ্চিমা ভাষায় আধুনিক নীতিতে একে Successive Attacks বলা হয়। এই মূলনীতি পাশ্চাত্য অধিনায়কগণ অশ্বারোহী বাহিনীর ক্ষেত্রে এবং আজকাল ট্যাংক ও বিমান হামলার সময় প্রয়োগ করে থাকেন।

জার্মান ফৌজ ১৯৪০ ঈসায়ীতে এই যুদ্ধনীতিকে (মূলত যা ইসলামী) সাফল্যের সঙ্গে কাজে লাগিয়ে সমগ্র মিত্রবাহিনীকে য়ুরোপ থেকে বহিষ্কার করে দিয়েছিল। মিত্রশক্তির সুপ্রীম কমাণ্ডার জেনারেল আইজেন হাওয়ার এই সোনালী নীতির অধীনে ১৯৪৪ ঈসায়ীতে রাইন নদী অতিক্রম করেছিলেন।

ক্রডিস নীতি মিত্রবাহিনী এবং জার্মান জেনারেল রোমেল উত্তর আফ্রিকার যুদ্ধগুলোতে এখতিয়ার করেছিলেন। দু’পক্ষের যেসব সেনানায়ক এই মূলনীতিকে যত সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছেন তার বাহিনী প্রতিপক্ষের উপর তত বেশী জয় লাভ করেছে।

ত্রিভুজ— এই যুদ্ধনীতিকে পাশ্চাত্যের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞগণ Spear Head নামে অভিহিত করেন। হিটলারের কমাণ্ডার-ইন-চীফ এই মূলনীতির উপর আমল করে ফ্রান্সের বিখ্যাত প্রতিরক্ষা মোর্চা মেজনিউ লাইন চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিলেন।

চন্দ্র ও যুক্ত চন্দ্র— এমন যুদ্ধনীতি ছিল যা মিত্র বাহিনী এবং ট্যাংক ফৌজের কম্যাণ্ডারগণ উত্তর আফ্রিকায় প্রয়োগ করেন।

উল্লিখিত নীতিগুলোকে মুহাম্মদ বিন কাসিম মওকামত সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করেন।

এই আলোচনা সাধারণের জন্য কিছুটা বিস্তারিতভাবে এজন্য করা হ’ল যেন তারা সেই সমরনীতি—যার বুনিয়াদ স্বয়ং আঁ-হযরত (সা) নিজ হাতে রেখেছিলেন এবং মুসলিম সেনাপতিগণ বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন, পাশ্চাত্য বিশ্ব তার মধ্যে যে খুব কমই পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছে, তা তারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন।

ভাবতে কষ্ট লাগে, আমরা আজ ভুলেই গেছি যে, আমরা অতীতে কি ছিলাম! ঐ সব কথা স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যই আমার এ লেখনী চালনা। আশা করি, আমার চেয়েও যোগ্য ও উপযুক্ত কোন লেখক এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করবেন এবং প্রকৃত ঘটনা সাধারণের সামনে তুলে ধরবেন যাতে আমাদের আত্মসত্তা পুনরায় জাগ্রত হয় এবং আমরা পুনরায় মর্দে ময়দান ও মর্দে মুজাহিদ হবার যোগ্যতা অর্জন করি।

এ কাজ যে সহজ নয় তা আমরা স্বীকার করি। কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে তো আর চলবে না। যথাসাধ্য দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। হযরত আবূ বকর (রা) বলেছেন : মুসলমানগণ! তোমাদের মধ্যে কেও যেন জিহাদ থেকে বিমুখ না হয়। কেননা কোন জাতিগোষ্ঠী একবার জিহাদ পরিত্যাগ করলে আল্লাহ তাদেরকে অপদস্থ না করে ছাড়েন না।

ইসলামে নৌ-বহর

মুহাম্মদ বিন কাসিমের অভিযানে নৌ-বাহিনীর সহযোগিতা খুবই কাজে লেগেছিল। এজন্য আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ ফৌজী শাখা সম্পর্কেও কিছু তথ্য পেশ করাকে অপরিহার্য বিবেচনা করছি।

হযরত ওমর (রা)-এর খেলাফত আমলে হযরত আবূ বকর (রা)-এর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা মুতাবিক মুসলিম বাহিনী যখন যূ’ল-কিসসা থেকে রওয়ানা হয় তখন হযরত মু’আবিয়া এবং তাঁর ভাই য়াযীদ বিন আবী সুফিয়ান (রা) “ছ়াগ়ূর” অর্থাৎ সমীন্তবর্তী স্থান-গুলো জয় করার নির্দেশ পান। ছ়াগ়ূরকে ‘আব্বাসী খলীফা হারুনুর রশীদ “আওয়াসিম” নামে অভিহিত করেন। সিরিয়ার সীমান্ত এলাকা এবং তার আশেপাশের স্থানগুলো ছিল এর অন্তর্ভুক্ত।

এসব সমুদ্রোপকূলীয় এলাকা যেমন— বায়রূত, জাবীল, সায়দা ইত্যাদি মুসলমানরা প্রথম আক্রমণেই রোমকদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু অল্প দিন পরই রোমকরা ঐ সব শহরের উপর পুনরায় কব্জা জমিয়ে বসে। কেননা রোমকেরা তাদের নৌ-বহরের সাহায্যে অতি সহজেই তাদের ফৌজ, সমরাস্ত্র রসদ-সম্ভার ও সাহায্যকারী বাহিনীকে সমুদ্রোপকূলের যে কোন জায়গায় নামিয়ে দিতে পারত।

হযরত মু’আবিয়া (রা) যখন সিরিয়ার গভর্নর নিযুক্ত হন তখন তিনি হযরত ওমর (রা)-এর নিকট নৌ-বহর নির্মাণের অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু হযরত ওমর (রা) অনুমতি দেন নি। হযরত ‘উছমান (রা)-এর খেলাফত আমলে হযরত মুআবিয়া (রা) মুসলিম নৌ-বহরের বুনিয়াদ রাখেন এবং খুব শীঘ্রই সেটাকে শক্তিশালী করে তোলেন। আরববাসী সাধারণভাবে এবং হেজাযবাসী বিশেষভাবে সামুদ্রিক সফরে ভয় পেত। এজন্য তাদের যেসব তেজারতী কাফেলা মিসর ও আবিসিনিয়ায় যেত সেগুলো কেবল শুষ্ক রাস্তা এখতিয়ার করত। অথচ ঐ সমস্ত রাস্তা সমুদ্র পথের চেয়েও বেশী দুরূহ ও দীর্ঘ ছিল। ২৮ হিজরীতে কাবরিস (সাইপ্রাস) জয় এবং ৭২00 মুদ্রা বার্ষিক জিয্‌য়া প্রাপ্তি মুসলমানদেরকে সমুদ্র সফরের প্রতি উৎসাহী করে তোলে।

হযরত মুআবিয়া (রা) রোমক বন্দীদের সাহায্যে আরবদেরকে নৌ-চালনা বিদ্যা ও জাহাজ নির্মাণের কলা-কৌশল শিখাবার একটি কেন্দ্র খোলেন। সেখানে জাহাজের উপযোগী যুদ্ধাস্ত্রও তৈরী হ’ত। ঐসব নৌ-স্কুলকে আরবরা “নরসানা” নামে অভিহিত করত। আর যেখানে নৌ-বহর একত্র করা হ’ত তাকে বলা হ’ত “উসতুল”। উসতুলগুলো ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত ছিল।

উন্নত মানের “নরসানা” সর্বপ্রথম তিউনিসে প্রতিষ্ঠা করা হয়।

যুদ্ধ বহরের সঙ্গে আরবরা জাহাজের উপর নিজেদের বাণিজ্য-সম্ভারও চাপিয়ে দেয়। মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধুর উপর হামলা পরিচালনার পূর্বে আরবদের বাণিজ্য জাহাজ এবং সেই সঙ্গে ইসলামের প্রচার ব্যাপদেশে ‘উলামা ও মুবাল্লিগবৃন্দ চীন ও শ্রীলঙ্কায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। ঠিক এধরনেরই একটি সামুদ্রিক কাফেলা লুট করবার অভিযোগে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ রাজা দাহিরের উপর হামলা করেন। সবচেয়ে বড় ধরনের জাহাজকে “শূনা” বলা হ’ত। শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্য এতে সৈন্য আরোহণ করত এবং শত্রু জাহাজের উপর হামলা চালিয়ে তাকে পরাভূত করত।

‘হাওয়াফা’ ধরনের জাহাজে ‘মিনজানীক’ স্থাপন করা হ’ত। এর সাহায্যে শত্রুর জাহাজের উপর তৈল সংযুক্ত অগ্নিগোলক নিক্ষেপ করা হ’ত এবং শত্রু জাহাজে আগুন ধরিয়ে তা জ্বালিয়ে দেওয়া হ’ত। সমুদ্রে ব্যবহার উপযোগী মিনজানীককে ‘উরাদাহ’ নামে অভিহিত করা হ’ত।

‘তারাদাহ’ বলা হ’ত এক প্রকার দ্রুত গতিসম্পন্ন নৌকাকে সাধারণত তা সংবাদ সংগ্রহ ও গোয়েন্দাগিরীর কাজে ব্যবহৃত হ’ত।

যে সব নৌকা নদীতে চলত সেগুলোকে ‘আশশারিয়াত’, ‘গুলুন্দাত’, এবং ‘মিসতাহাত’ নামে অভিহিত করা হ’ত। ‘আশশারিয়াত’ নদীতে যুদ্ধ জাহাজের ভূমিকা পালন করত, কিন্তু ‘গুলুন্দাত’ ও ‘মিসতাহাত’ অপরাপর কাজে ব্যবহৃত হ’ত।

নৌ-সেনাদের হাতিয়ার

যেরা, খোদ, ফলা, ঢাল, ভালা, কামান, তীর, কালালীব এবং বাসীকাফ। লৌহ শৃংখলকে ‘বাসীকাফ’ বলা হ’ত। এর অগ্রভাগে আকড়া লাগান থাকত। শত্রু জাহাজের কাছে গিয়ে তা টেনে নিয়ে উক্ত আকড়ার সাহায্যে নিজেদের জাহাজের সংগে বেঁধে ফেলা হ’ত। এভাবে সৈন্যরা শত্রু জাহাজের উপর আরোহণ করে তাদেরকে পরাভূত ও পর্যুদস্ত করত।

আরবরা সামুদ্রিক যুদ্ধের নতুন পন্থা আবিষ্কার করে। তারা জাহাজের মাস্তুলের উপর সিন্দুক বানায়। সৈন্যরা ঐ সিন্দুকে বসে সুযোগমত দাহ্য তেল সংযুক্ত অগ্নি-গোলা বিভিন্ন যন্ত্রের মাধ্যমে শত্রুর জাহাজের উপর নিক্ষেপ করত। তারা ‘আর্রাদাহ্‌র মাধ্যমে সাপ ও বিচ্ছু ভর্তি পাত্রও শত্রু জাহাজের উপর নিক্ষেপ করত।

শত্রু জাহাজকে ডুবিয়ে দেবার জন্য আরব জাহাজগুলোর সম্মুখ ভাগে তীরের মত, আবার কখনো বর্শার মত, হাতিয়ার লাগান হ’ত এই তীর কিংবা বর্শাকে জাহাজীরা ইচ্ছা মাফিক যে কোন দিকে ঘোরাতে পারত। হাতিয়ারের কার্যকর আঘাত শত্রু জাহাজে ফাটলের সৃষ্টি করত। অতঃপর এই ফাটল দিয়ে পানি ঢুকে জাহাজ ভর্তি হয়ে যেত। এই হাতিয়ারকে “লিজাম” এবং “আসতাম” বলা হ’ত।

জাহাজীদের জন্য রাতের বেলা আগুন জ্বালানো অথবা গান গাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। জাহাজের উপর মোরগ কিংবা কুকুর রাখারও অনুমতি ছিল না। সাধারণত জাহাজগুলোকে উপকুলের পরিবেশ মাফিক রাঙিয়ে দেওয়া হ’ত যাতে দুশমনরা ঐ সব জাহাজকে দূর থেকে দেখতে না পারে। এ ধরনের কাজকে আজকাল Camouflage বা দৃষ্টিভ্রম ঘটানো বলা হয়।

মুহাম্মদ বিন কাসিম সামুদ্রিক নৌ-বহরকে ভারী মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি নদীগুলোতে নৌকার সাহায্যে পুল বানাবার কাজও জাহাজীদের উপর সোপর্দ করে ছিলেন। মোট কথা, এই যোগ্য ও উপযুক্ত মহান অধিনায়ক স্থল-বাহিনী ও নৌ-বাহিনীকে সমভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন। একে আজকাল Combined operation নামে অভিহিত করা হয়।

আরবেরা নিজেদের জাহাজগুলোকে শত্রুর অগ্নি হামলা থেকে বাঁচাবার জন্য রেশম কিংবা পশমী চট সিরকায় ভিজিয়ে জাহাজের চতুর্দিক মুড়িয়ে নিত এবং শত্রুর আগুনের গোলাকে ঠাণ্ডা করবার জন্য সিরকা ও এক প্রকার উদ্ভিদ দ্বারা খামীরকৃত মাটি ব্যবহার করত। এসব জিনিস “গ্রীক অগ্নি”কে ঠাণ্ডা ও অকেজো করার জন্য অত্যন্ত কার্যকর ছিল।

ছাউনী এবং পদ্ধতি

মুহাম্মদ বিন কাসিম এই নীতি নির্ধারণ করেছিলেন যে, যেখানেই কিছুদিনের জন্য ছাউনী ফেলা হবে সঙ্গে সঙ্গে তার আশে-পাশে পরিখাও খনন করা হবে। ছাউনীকে সাধারণত চার ভাগে ভাগ করা হ’ত। পরিখা পাহারা দেবার জন্য পাহারাদার নিযুক্ত হ’ত যারা দরকারী মুহূর্তে রিজার্ভ বাহিনীকে সংবাদ দিত।

রাস্তার চৌকীগুলি সর্বাবস্থায় নিজ নিজ অবস্থানে অবিচল থাকত। মধ্য ভাগে নারী, শিশু, অসুস্থ মানুষ এবং সর্বাধিনায়ক অবস্থান করতেন। রসদ-সম্ভার এবং সমরাস্ত্র এখানেই থাকত।

সংবাদদাতা

প্রতিটি ফৌজের সঙ্গে লিপিকারদের একটি দল থাকত যাদের কাজ ছিল সর্বাধিনায়ককে শত্রুর অবস্থা সম্পর্কে লিখিতভাবে অবহিত করা। এরা রাজধানীকেও স্থানীয় অবস্থা সম্পর্কে নিয়মিত ও ধারাবাহিকভাবে অবহিত রাখত। এমনকি সর্বাধিনায়কের ভেতর বিশৃঙ্খল ও ভারসাম্যহীন অবস্থা পরিলক্ষিত হলে সে সম্পর্কেও কেন্দ্রকে নির্ভীকভাবে লিখে জানাত।

প্রচারকদল

ফৌজের সঙ্গে ইসলাম প্রচারকারী একটি দলও থাকত। এঁরা ছিলেন ইসলামের বিধি-বিধান পরিপূর্ণরূপে পালনকারী। যেহেতু ইসলামে রক্ত ও বংশগত কোন ভেদাভেদ নেই, তাই এই দলে কালো, সাদা, উজ্জ্বল, অনুজ্জ্বল সব বর্ণেরই লোক থাকতেন। এঁদের দেখলে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের ছবি ভেসে উঠত। এটি ছিল ইসলামের সর্বোত্তম ধরনের প্রচার যা শত্রু রাষ্ট্রে করা হ’ত। ভারতীয় জাতি-গোষ্ঠি যারা জাত-পাত, উঁচু-নীচু এবং ছ্যুৎ-অচ্ছ্যুতের অভিশাপে জর্জরিত ছিল, এই ধারার ইসলাম প্রচারে বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত হয়।

ডাক ব্যবস্থা

চিঠিপত্রের বিনিময় বা যোগাযোগ ব্যবস্থা দৃষ্টেও হাজ্জাজ বিন ইউসুফের যোগ্যতা সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। হাজ্জাজের হুকুমে স্থানে স্থানে ডাক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এতে করে হাজ্জাজের নির্দেশনামা এক সপ্তাহের মধ্যেই দেবলে মুহাম্মদ বিন কাসিমের নিকট পৌঁছে যেত। যারা এই এলাকা আমার মত কয়েকবার ঘুরে ফিরে দেখেছেন তারা এই সাধারণ ব্যবস্থাপনার বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারবেন। হাজার মাইলের অধিক দূরত্ব আজকাল এত স্বল্প সময়ে শুধু জীপ1 গাড়ীর সাহায্যেই অতিক্রম করা সম্ভব। তখন পশুপৃষ্ঠে আরোহণ করেই এই সময়ের মধ্যে উল্লিখিত দূরত্ব অতিক্রম করা হ’ত। প্রতিটি ডাক-হরকরা ১৫০ মাইলের অধিক পথ একদিনে অতিক্রম করত। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, তখন সে এলাকায় এমন শান্তি কায়েম হয়ে গিয়েছিল যে, মুসলিম ডাক-হরকরাগণ কোন-রূপ ভয়-ভীতি ছাড়াই দিবারাত্রি অবাধে সফর করতে পারত। তখনকার ডাকের রাস্তা ছিল বসরা, আহওয়ায, শীরায, সীরজান, নওমা শহর, ফাহরাজ, কাসরকান্দ, নীয, কীয ও আরমাঈল হয়ে দেবল।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. গ্রন্থকার মারী ভাগটি গোত্রকে একদিনে প্রায় শ’ মাইল সর করতে দেখেছেন। সওয়ারের জন্য ঘোড়ার ভাক বসিয়ে দেওয়া হ’ত!
    আমি ১৯২০ ঈসায়ীতে দেখেছি যে, এ. জি. জি. বেলুচিস্তানের ডাক, আরোহী হরকরার মাধ্যমে, মাঝরাত্রে কোয়েটা থেকে রওয়ানা হয়ে দুপুরের পর কালাত পৌঁছে যেত। এই দূরত্বও নব্বই মাইলের কাছাকাছি। এ কাজের জন্য ঘোড়া ও আরোহীকে পরিশ্রমী ও শক্ত প্রাণের হওয়া অপরিহার্য।