তীর-ধনুকের ব্যবহার

আরবদের মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র বলতে ছিল তীর-ধনুক। তারা যুদ্ধকালেই কেবল তীর ব্যবহার করত না বরং হরিণ এবং উট পাখি শিকারেও তা ব্যবহার করত। আরবের যে সব লোক উন্নত মানের তীরন্দায হ’ত তাদেরকে ‘রিমাতুল-হাদাক’ উপাধিতে ভূষিত করা হ’ত। কথিত আছে যে, তারা পলায়নপর হরিণের চক্ষুকে তীরের অব্যর্থ নিশানায় পরিণত করতে পারত। আরবে তীরন্দাযীর অনুশীলন এবং অধিকাংশ সময় তীরন্দাযীর প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হ’ত। সেখানে প্রচুর গুই সাপ পাওয়া যায়। এই প্রাণীটিকে গাছের সঙ্গে লটকে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে তীরের নিশানা বানিয়ে লক্ষ্যভেদে হাত পাকা করা হ’ত।

সমরশাস্ত্রে অভিজ্ঞ হয়ে গড়ে উঠার জন্য মুজাহিদদের প্রতি আঁ-হযরত (সা)-এর অমূল্যবাণী

বর্ণিত আছে যে, আঁ-হযরত (সা) তীরন্দাযী সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন : তোমাদের পক্ষে যতখানি শক্তি সঞ্চয় করা সম্ভব তা করবে। আর জেনে রেখ, তীরন্দাযীর মধ্যেই শক্তি নিহিত; মনে রেখ, তীরন্দাযীর মধ্যেই শক্তি নিহিত এবং ভালভাবে অন্তরে গেঁথে নাও, তীরন্দাযীর মধ্যেই শক্তির রহস্য লুকিয়ে আছে। এব্যাপারে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই।

রসূল আকরাম (সা) আরো বলেছেন : প্রতিটি ঈমানদার যে-সব বিষয়ে প্রবল আগ্রহ নিয়ে আনন্দ ও তৃপ্তিবোধ করবে তাহ’ল, নিজেদের ঘোড়াকে উত্তম প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং তা সুস্থ ও মোটা তাজা রাখা, স্বীয় ধনুকের ভাল ছিলা দিয়ে তীরন্দাযী করা এবং স্ত্রীর সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলা। বিষয়টি নিঃসন্দেহে কল্যাণকর। যারা কেবল আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এধরনের কাজ করবে এবং আল্লাহ্‌র পথে তীরন্দাযী করবে আল্লাহ, তাদেরকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন।

এ সমস্ত বর্ণনা থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে, আঁ-হযরত (সা) কিভাবে মুজাহিদদেরকে অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ হয়ে গড়ে উঠতে উৎসাহিত করেছেন। মুসলিম সেনাবাহিনীতে তীরন্দাযকে ‘নাশ্‌শাব’ উপাধিতে ভূষিত করা হ’ত। বনী উমাইয়াদের রাজত্বকাল পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে খনিজ তৈলের সাহায্যে তীর নিক্ষেপের একটি প্রক্রিয়া চালু ছিল। একে বলা হ’ত ‘তাফান্নুন’। তেল ব্যবহারের জন্য লোহা কিংবা কাঠের একটি নল থাকত। এই নলের ভেতর তীর দিয়ে অন্য একটি যন্ত্রের সাহায্যে তীর নিক্ষেপ করা হ’ত। তীরের সম্মুখভাগে খনিজ তেলে ভেজা এক খণ্ড তুলা লাগানো থাকত। এতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হ’ত। ফলে তীর দূরে নিক্ষিপ্ত হয়ে শুধু আঘাতই হানত না বরং শত্রুর উপর অগ্নি-বৃষ্টিও ঝরাত। এই পন্থার ব্যবহার শত্রুর অশ্বারোহী বাহিনীর হামলার মুকাবিলায় অত্যন্ত কার্যকর ছিল। কেননা ঘোড়া কিংবা উট আগুন বৃষ্টি দৃষ্টে ভয়ে ভড়কে যেত। মুহাম্মদ বিন কাসিম রাজা দাহিরের হস্তি বাহিনীর বিরুদ্ধে এই যন্ত্রই ব্যবহার করেছিলেন।

হিন্দুদের রামায়ণ ও মহাভারতের লড়াইগুলোতে এধরনের তীর ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে। অনারব জাতি-গোষ্ঠীগুলো তাতারদের আক্রমণ রুখবার জন্য এই জাতীয় অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। তারা এগুলোর নাম রেখেছিল ‘মুজাররাত’।

আজকাল যে ট্রেঞ্চ মর্টার (Trench Morter) ব্যবহৃত হচ্ছে তাও ঐ মূলনীতিকে অনুসরণ করেই। এতে ধাতব নির্মিত একটি নলের অর্থাৎ কার্টুজের টুপি চালনাকারী সূঁচ থাকে। ফায়ারিং কার্টুজ এই সূঁচের সাহায্যে চলে এবং নলের উচ্চতা মাফিক দুরত্ব অতিক্রম করে ফেটে যায়।

অশ্বারোহণ সম্পর্কে আঁ-হযরত (সা)-এর অমূল্য বাণী

আঁ-হযরত (সা) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি (সা) বলেছেন, “তোমরা নিজ নিজ অশ্বগুলোকে গভীরভাবে দেখা-শোনা ও যত্ন-আত্তি করবে, যে-ভাবে তোমরা নিজেদের স্ত্রী-পুত্রদের দেখা-শোনা ও যত্ন-আত্তি করে থাক।” অনন্তর তিনি যুদ্ধলব্ধ সম্পদ থেকে একজন অশ্বারোহীর অংশ দুইজন পদাতিকের সমান রাখেন এবং এই প্রথা খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগ পর্যন্ত চালু থাকে। আঁ-হযরত (সা) এবং খলীফাগণ অশ্বারোহীদের নিজেদের ভেতর প্রতিযোগিতা ও যুদ্ধের মহড়ার ব্যবস্থা করতেন। তারা অশ্বারোহী বাহিনীর সদস্যদের তাদের কাজের উপর উৎসাহিত, চাঙ্গা অনুপ্রাণিত করতেন।

অশ্বারোহী অর্থাৎ অভিজ্ঞ অশ্বারোহী বাহিনীর সাহায্যে মুসলমানরা দুনিয়ার ভাগ্য পাল্টে দিয়েছে। অশ্বারোহীর সাহায্যেই মুহাম্মদ বিন কাসিম রাজা দাহির ও তার সেনাপতিদেরকে বিব্রত ও পেরেশান করে তোলেন এবং পরিশেষে পরাজিত করেন।

আজকাল অশ্বারোহী বাহিনীতে ঘোড়া ও উটের স্থান দখল করেছে ট্যাংক, উড়োজাহাজ ও সাঁজোয়া মোটর গাড়ি। যদিও যুদ্ধের পন্থা ও পদ্ধতি এবং সমরাস্ত্র পাল্টেছে, কিন্তু সমরনীতি এখনও তাই আছে যা আগে ছিল; ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। এজন্য ইসলামের ইতিহাস গভীরভাবে অধ্যয়ন করা দরকার যাতে আমরা জানতে পারি যে, আমাদের মহান পূর্বপুরুষগণ কি ভাবে এবং কি করে টাকা-পয়সা, অস্ত্রশস্ত্র ও সেনাবাহিনী ছাড়াই দুনিয়ার বিরাট শক্তিগুলোকে পর্যদস্ত করে দিয়েছিলেন। আমি আমার ‘হামারা দেফা’ নামক গ্রন্থে লিখেছি, রুশরা কিভাবে ঘোড় সওয়ারের মাধ্যমে জার্মানীর ট্যাংক ডিভিশনকে ধ্বংস ও বরবাদ করে দিয়েছিল।

তীরন্দাযীর পর আরবরা তলোয়ার যুদ্ধে পারদর্শিতা লাভ করাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করত। কিন্তু তারা তলোয়ার সাধারণত বাহির থেকে আমদানি করত এবং এসব তলোয়ার একটা বিশেষ ধাচের হ’ত। অর্থাৎ তলোয়ারের বাট বা হাতল নিম্ন ধরনের হ’ত (নমুনা দেখুন)।

এই তলোয়ারের অগ্রভাগ বক্ষ সহ শরীরের যে কোন অংশে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় এবং এর তীক্ষ্ণ ধারের সাহায্যে মস্তক কিংবা দেহের যে কোন অংশকে মূল দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া যায়।

ভারতীয় তলোয়ার এবং এর নমুনা

ভারতীয় তলোয়ার দ্বারা কোপ মেরে কোন জিনিসকে কাটা কিংবা দ্বিখণ্ডিত করা চলত। কেননা এ তলোয়ারের ফলা তৃতীয়ার চাঁদের মত ঈষৎ বাঁকা। অবশ্য এই তলোয়ারের নীচে আলওয়ালা কীলক লাগানো থাকত, যাকে হাতাহাতি যুদ্ধে খুবই কার্যকর পন্থায় ব্যবহার করা হ’ত এবং শত্রুর গলায় শিরস্ত্রাণের তলায় ঢুকিয়ে দেওয়া যেত!

 রোমান ও ইরানী তলোয়ার এবং তার নমুনা

রোমীয় ও ইরানী তলোয়ার প্রধানত পাতলা এবং একদম সোজা হ’ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেহে বিদ্ধ করবার জন্য এটা ব্যবহার করা হ’ত। কেননা ঐসব জাতিগোষ্ঠীর দেহে লৌহ বর্ম পরিহিত থাকত, যার ভেতর তলোয়ারের তীক্ষ্ণ সূক্ষ্ম ফলা ঢুকিয়ে শত্ৰুকে সহজেই ঘায়েল করা যেত। কোপ দিয়ে কাটা তলোয়ার লৌহ বর্মের বিপরীতে ততক্ষণ পর্যন্ত বেকার প্রমাণিত হ’ত যতক্ষণ না তা বিশেষ পন্থায় নির্মিত হ’ত এবং এর চালক ও বাহক অভিজ্ঞ হবার সঙ্গে সঙ্গে যথেষ্ট শক্তিশালী হ’ত।

আরবে ব্যবহৃত তলোয়ার এবং তার নমুনা

আরবের লোকেরা সাধারণত য়ামনী, ভারতীয়, সিরীয় ও খুরাসানী তলোয়ার ক্রয় করত। এসব তলোয়ারকে বলা হ’ত ‘সুফে আতীকা’।

য়ামনী তলোয়ার হ’ত উন্নত মানের। এর ফলার ভেতর নালা থাকত। কারণ এর ফলে এই তলোয়ার খুবই মযবুত হ’ত। একে “মাহফূরা” বলা হত।

সাধারণভাবে য়ামনী তলোয়ারের হাতলে দু’টি ছিদ্র থাকত। এতে আরবের লোকেরা চামড়ার দস্তানা বাঁধত যা হাতের কবজীর চার পাশ জড়ালে হাতের মুষ্টি খুব মযবুত হ’ত। সিরীয় ও সুলায়মানী তলোয়ারের ফলার উপর ফুল ও লতা-পাতা খোদিত থাকত। ঐসব ফুল ও লতা-পাতার দ্বারা তলোয়ারের ঔজ্জ্বল্য ও কাঠিন্য অনুমান করা যেত। অবশ্য এ জাতীয় তলোয়ার লৌহবর্ম কাটার ক্ষেত্রে বেশী সক্ষম ছিল না।

মুসলিম ফৌজে তলোয়ারবাজীর মহড়া ও অনুশীলন

মুসলিম শিবিরে তলোয়ারবাজীতে কে কত পারঙ্গম তার মহড়া প্রায়ই অনুষ্ঠিত হ’ত। একই আঘাতে উট, বলদ ইত্যাদির গর্দান উড়িয়ে দেওয়া, পদাতিক এবং আরোহী উভয় অবস্থায় তলোয়ার যুদ্ধ করা, অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে দ্রুতগতিতে তলোয়ার চালিয়ে সবুজ গাছের গুড়ি কেটে ফেলা — ইত্যাদির অনুশীলন করা হ’ত।

আরব অশ্বারোহীরা নেযার ব্যবহারও খুব পরিশ্রমের সঙ্গে শিখত এবং সাধারণত শত্রুর উপর তাদের প্রথম হামলা নেযার মাধ্যমেই হ’ত। যেহেতু আরবীয় অশ্ব খুবই দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং ফুর্তিবাজ হ’ত এবং তার প্রশিক্ষণও হ’ত বিশেষ যত্নের সঙ্গে, ফলে আরবীয় নেযার হামলাকে রোমক, পারসিক এবং দুনিয়ার অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠী খুবই ভয় করত। নেযার হামলা এবং তীরন্দাযদের তীর বর্ষণের নৈপুণ্যের মাধ্যমেই সালাহউদ্দীন আয়্যূবী ক্রুসেডার নাইটদেরকে উপর্যুপরি পরাজিত করেছিলেন।

নেযার সঠিক ব্যবহার এবং অভিজ্ঞতা ও নৈপুণ্য লাভের জন্য সাধারণত কৃত্রিম যুদ্ধের মহড়া অনুষ্ঠিত হ’ত, অর্থাৎ কিছু সময় উভয় অশ্বারোহীর নিকটই মুকাবিলা করার জন্য নেযা থাকত এবং কিছু সময় একজনের নিকট তলোয়ার এবং অন্য জনের নিকট নেয়া থাকত।1

নেযার ফলা বা তীক্ষ্ণধার মুখ, যাকে আরবের লোকেরা “আবনীন” বলত এবং যাকে কতক লোক “ফালা”ও বলত— কয়েক ধরনের হ’ত।

নেযার বাঁশের দৈর্ঘ্য বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকমের হ’ত। যেমন— রোমকদের নেযা হ’ত খুব লম্বা এবং তাদের বাঁশের লাঠি লোহার পাত দ্বারা ঢাকা থাকত। কিন্তু আরবীয় নেযা সাধারণত দশ-বারো ফুটের বেশী লম্বা হ’ত না।

ভারতীয় ফৌজে নেযার ব্যবহার খুব জনপ্রিয় ছিল না। ভারতীয় অশ্বারোহী সাধারণত তলোয়ার চালনা ও তীরন্দাযীর উপর গর্ববোধ করত। আরব অশ্বারোহীরা হামলার মুহূর্তে প্রথমে নেযা ব্যবহার করত এবং হাতাহাতি যুদ্ধ ও প্রচণ্ড লড়াইয়ের সময় তলোয়ার চালাত। তারা দূর থেকে তীর বর্ষণ করত। অতঃপর নেযা চালাত; সবশেষে তলোয়ারের আশ্রয় নিত। আর তলোয়ার ভেঙে গেলে খঞ্জর ব্যবহার করত।

ভালা নামকরণের কারণ এবং এর ব্যবহার

কোন কোন সময় ‘ভালা’ শব্দটি ভুলবশত নেযার স্থলে ব্যবহার করা হয়। ভালা মূলত পদাতিক সৈন্যদের একটি হাতিয়ার, যা পদাতিক সৈন্যরা সাধারণত আরোহী শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহার করত। তারা প্রথমে ভালার সাহায্যে শত্রুর ঘোড়ার গতি পাল্টে দিত; অতঃপর তলোয়ারের আঘাত হেনে তার কম্ম সাবাড় করে দিত। ভারতের ইউ, পি, নেপাল প্রভৃতি রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে আজও ভালার ব্যবহার একটি সাধারণ ব্যাপার।

ভারতীয় ভালা এক ডালের হ’ত, আবার কয়েক ডালেরও হ’ত। আরবীয় ও ভারতীয় ভালা লম্বায় আট ফুটের কাছাকাছি হ’ত। অবশ্য রোমক ভালা ২৪ ফুট পর্যন্ত লম্বা হ’ত। রোমকরা দৌড়ে গিয়ে শত্রুর উপর ভালা নিক্ষেপ করত যাতে করে বহু দূরে অবস্থিত শত্রুর উপরও আঘাত হানা যায়। এভাবে তারা শত্রুর জীবনহানি ঘটাত। অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জ্যাভেলীন নিক্ষেপ এই অস্ত্র চালনারই স্মৃতি বহন করছে।

ঢাল এবং এর প্রয়োজনীয়তা

তলোয়ারের সঙ্গে ঢাল ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। শত্রুর তলোয়ারের আঘাত থেকে বাঁচবার জন্য এটাকে ব্যবহার করা হ’ত। ঢালের ব্যবহার সাধারণত পায়দল যুদ্ধের মধ্যেই সীমিত।

ঢাল বিভিন্ন জাতের এবং বিভিন্ন প্রকারের হ’ত। কোনটি গোল, আবার কোনটি সমান্তরাল ক্ষেত্রের ন্যায়। ঢাল গণ্ডারের চামড়া, লোহা, তামা, ইত্যাদি দ্বারা নির্মিত হয়। এটা পদাতিক সৈন্যকে তীর, তলোয়ার, বল্লম এবং নেযার আঘাত থেকে রক্ষা করে। আরবদের ঢাল তৈরী হ’ত উটের চামড়া দিয়ে, যাকে তাম্রপত্র দ্বারা আরও মযবুত করা হ’ত। ঢালের উপর আরবের লোকেরা চিত্রাংকন করত; বিভিন্ন বাণী কিংবা শ্লোক উৎকীর্ণ করত। এই নিয়ম অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর ভেতরও প্রচলিত ছিল।

লৌহবর্মের গঠনাকৃতি, ব্যবহার ও তার প্রয়োজনীয়তা

আরবে সর্বাধিক মশহূর লৌহবর্মের নাম ছিল ‘দিলামন’ যা ইস্পাত লৌহ ও কাতান সহযোগে নির্মাণ করা হ’ত। সর্বোত্তম লৌহবর্ম রোম ও পারস্যে নির্মিত হ’ত। দামী হবার কারণে বর্ম সাধারণত অধিনায়করাই পরিধান করতেন। পরবর্তী সময়ে আরব অশ্বারোহী বাহিনীর অশ্বারোহীরাও তা পরিধান করত। অবশ্য রোমক অশ্বারোহী বাহিনীর সব অধিনায়ক ও সৈনিকই বর্ম পরিধান করত। রোমক বাহিনীর পদাতিক সৈন্যরাও কখনো কখনো লৌহবর্ম ও শিরস্ত্রাণ পরিধান করত।

বর্মের যে অংশ বক্ষকে নিরাপদ ও সুরক্ষিত রাখে তাকে ‘জওশন’ বলে। কোন কোন সময় দারিদ্র্যের কারণে কিছু লোক কেবলমাত্র ‘জওশন’ই পরিধান করত।

লৌহ শিরস্ত্রাণ (হেলমেট) মস্তকের হিফাজতের জন্য ব্যবহার করা হয়। আরবীতে একে ‘বায়দা’ এবং ‘মিগফার’ বলে। শিরস্ত্রাণের আকার-আকৃতি হ’ত কয়েক প্রকারের। আমীর-উমারাদের শিরস্ত্রাণে কারুকার্য ও চিত্রাঙ্কণ থাকত। কোন কোনটির উপর আরবীতে আয়াতে কুরআনীও লিখিত থাকত। রোম ও পারসিকরা শিরস্ত্রাণের উপর নিজেদের ভাষায় চিত্রাঙ্কন ছাড়াও নানা ধর্মীয় শ্লোক উৎকীর্ণ করত।

খঞ্জরের ব্যবহার

খঞ্জর অধিকতর কাছাকাছি অবস্থায় হাতাহাতি যুদ্ধে ব্যবহাত হ’ত। কোন কোন সময় শত্রুর উপর দূর থেকেই খঞ্জর নিক্ষেপ করা হ’ত। এধরনের আঘাত খুবই কার্যকর হ’ত। আরবের লোকেরা এতে বিশেষ পারদর্শী ছিল।

কুড়াল ব্যবহার

পারসিক এবং রোমকরাই হাতিয়ার হিসাবে কুড়াল ব্যবহার করত। আরবরা এর ব্যবহার থেকে বিমুখ থাকে।

অবরোধ ভেঙে ফেলার যন্ত্রপাতি

আরবরা উন্মুক্ত প্রান্তরের অধিবাসী ছিল বিধায় তাদের কোন কেল্লা ছিল না। অতএব তাদের নিকট অবরোধ ভেঙে ফেলার কোন যন্ত্রও ছিল না। সর্বপ্রথম যিনি এই যন্ত্র সার্থকভাবে ব্যবহার করেন তিনি হচ্ছেন আঁ-হযরত (সা)। রসূলুল্লাহর দূরদর্শিতা শীঘ্রই মুসলমানদেরকে এই যন্ত্র ব্যবহারে পারদর্শী করে তোলে।

মিনজানীক

প্রাচীনকালে ফিনিসীয়রাই সর্বপ্রথম মিনজানীক ব্যবহার করে। গ্রীক এবং য়াহুদীরা তাদের নিকট থেকেই এর ব্যবহার শিখেছিল। গ্রীসের রাজা ফিলিপ এই যন্ত্রকে খুবই কার্যকর পন্থায় ব্যবহার করেন। পারসিকরা গ্রীকদের কাছ থেকে এর ব্যবহার শেখে।

মুসলমানরা যখন খায়বার উপত্যকা জয় করে তখন সেখান থেকে কয়েকটি মিনজানীক এবং দুবাবা তাদের হস্তগত হয়। আঁ-হযরত (সা)-এর পরামর্শক্রমে হযরত সালমান (রা) পরে কয়েকটি নতুন যন্ত্র তৈরী করেন।

মিনজানীক কয়েক প্রকারের হ’ত। কতকগুলো তো ট্রিগার টিপলেই চলত। ট্রিগারের Action হ’ত স্প্রীংয়ের উপর। মিনজানীক তীর, পাথর অথবা পেট্রোল জাতীয় তৈলপূর্ণ শিশি শত্রুর উপর নিক্ষেপ করত। কতকগুলো মিনজানীক রশির সাহায্যে ঘুরিয়ে তার দ্বারা বিভিন্ন অস্ত্র শত্রুর উপর নিক্ষেপ করা হ’ত। সাধারণত পাথরই ছিল এমন অস্ত্র যা খুব দূরে এবং খুব জোরে নিক্ষেপ করা যেত।

রাশিয়ানরা ১৯৪০-৪৪ সনের যুদ্ধে জার্মান ট্যাংকের উপর আত্মঘাতী ‘মলোটভ ককটেল’-এর বোতল রশির শিকায় করে ও অন্যান্য নানা উপায়ে ব্যবহার করে এবং এর সাহায্যে তারা জার্মান ট্যাংকে আগুন লাগিয়ে দেয়। অবশ্য এর আগে ট্রেঞ্চ মর্টার ও flame thrower-এর ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছিল। flame thrower-এর অনুরূপ একটি অস্ত্র মিসরের শাসনকর্ত্রী শাহযাদী শুজা’উদ্দুর ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করে তাদের দাবাবা ও নৌ-বহরকে একেবারে ধ্বংস করে দিয়ে ছিলেন। এই মুসলিম বীরাঙ্গনা ক্রুসেডারদের বিরাট বাহিনীকে যা গোটা য়ুরোপের সম্রাটগণ ঐক্যবদ্ধভাবে তৈরী করেছিলেন, এমন ভাবে পর্যদস্ত করেন যে, কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত পাশ্চাত্য শক্তিগুলো মুসলমানদের দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস পর্যন্ত পায়নি। অতএব একথা ঠিক নয় যে, অগ্নিশিখা নিক্ষেপের যন্ত্রের উদ্ভাবক পাশ্চাত্য দেশীয়—যারা বিশ্বযুদ্ধে এটি তৈরী করে ছিল। মিনজানীকের সাহায্যে এধরনের বস্তু—যেমন দাহ্য তেল ভর্তি শিশি নিক্ষেপ করতে চাইলে দাঁড়ি পাল্লার মত টাঙিয়ে এবং ঘুরিয়ে তা নিক্ষেপ করা হ’ত। এধরনের জিনিসের ওজন হাল্কা বিধায় এর সঙ্গে সীসার গোলা বেঁধে দেওয়া হ’ত যাতে করে এই হাল্কা বস্তুটি বহু দূরে নিক্ষিপ্ত হয়। এভাবে বিশেষ ধরনের তামার নলের ভেতর পুরে ধনুকের সাহায্যে শত্রু সৈন্যের উপর মুষলধারে তীরও নিক্ষেপ করা হ’ত। নীতি ছিল সেই একই যা আজকাল ট্রেঞ্চ মর্টার (Trench Mortar) থেকে গোলা নিক্ষেপের জন্য অবলম্বন করা হয়।

মুহাম্মদ বিন কাসিম-এর সর্ববৃহৎ মিনজানীকের নাম ছিল “উরূস” যার কামান টানবার জন্য পাঁচশত লোকের দরকার পড়ত। এই মিনজানীক দ্বারা মুহাম্মদ বিন কাসিম বিরাট বিরাট পাথর নিক্ষেপ করে দেবলের মন্দিরের পতাকা ভুপাতিত করে ছিলেন। এ ঘটনা ৮৯ হিজরীর।

দাবাবা এবং তার ব্যবহার

দাবাবা আসলে কাষ্ঠ-নির্মিত একটি চলন্ত দুর্গ। কিছু সৈন্য এর ভিতর ঢুকে শত্রু সৈন্যের নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাত থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে কেল্লার নিকটে পৌঁছে যেত। তারপর দাবাবার মীনারের সাহায্যে সিঁড়ি লাগিয়ে দুর্গ-প্রাচীরের উপর আরোহণ করত। দাবাবার অভ্যন্তর ভাগ নিরাপদ হবার কারণে সম্মুখে অগ্রসর হবার সময় শত্রু বাহিনীর নিক্ষিপ্ত তীরের হাত থেকে তারা বেঁচে থাকত। কতক দাবাবার সম্মুখ ভাগে লোহার তীক্ষ্ণ ফলকযুক্ত দণ্ড থাকত যার দ্বারা কেল্লার দরজায় অথবা প্রাচীরে ছিদ্র করা হ’ত।

এই যন্ত্রটি মিনজানীক অপেক্ষাও প্রাচীন। এটি সর্বাগ্রে মিসরবাসী, অতঃপর গ্রীক ও পারসিকরা ব্যবহার করে। মুসলমানদের হাতে এই যন্ত্রটি খায়বার থেকে প্রাপ্ত যুদ্ধলব্ধ সম্পদের সাথে আসে।

মুসলমানরা এই যন্ত্রের ভেতর নতুনত্ব আনেন। তারা দাবাবাকে সিরকা (টক ও ঝাঁঝযুক্ত পানীয়)-সিক্ত পশমী কাপড় দ্বারা মুড়িয়ে দেন। ফলে এই কাষ্ঠ-নির্মিত কেল্লাটি শত্রুর আগুনের হাত থেকে নিরাপত্তা লাভ করে। কেননা সিরকায় সাধারণত আগুন ধরে না।

ক্রুসেডাররা এই রহস্য জানত না। তাই শাহযাদী শুজাউদ্দুরের মুজাহিদ বাহিনী ক্রুসেডারদের দাবাবাতে সহজেই আগুন লাগিয়ে দেয়। ক্রুসেডাররা এ ধরনের আক্রমণের সঙ্গে পরিচিত ছিল না বিধায় তাদের অসংখ্য সৈনিক এ সব দাবাবার ভেতর জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায়। ক্রুসেডাররা এর নাম দিয়েছিল “শয়তানী আগুন’। কাষ্ঠ-নির্মিত দাবাবাকে সিরকা-সিক্ত করে আগুনের হাত থেকে নিরাপদ করার এই গোপন রহস্য দীর্ঘকাল যাবত আরব ছাড়া অন্য সকলের কাছেই অজ্ঞাত ছিল।

কাব্‌শ

কাব্‌শ দাবাবা জাতীয়ই একটি অস্ত্রের নাম। দাবাবার মাথাকে বারবার প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে প্রাচীরের মধ্যে ছিদ্র এবং ফোঁকরের সৃষ্টি করা হ’ত। কিন্তু এটা এমন সব কেল্লার ক্ষেত্রে বেকার প্রমাণিত হ’ত—যে কেল্লার প্রাচীরের আশেপাশে পরিখা খনন করা থাকত। এই পরিস্থিতি মুকাবিলার জন্য কাব্‌শ তৈরী করা হয়। এতে একটি লম্বা মোটা বলি লাগান থাকত যার সম্মুখ ভাগে নলের মাথায় থাকত সূঁচালো লোহা। এই লম্বা বলির সাহায্যে পরিখার অপর পারের প্রাচীর গাত্রে জোরে জোরে আঘাত হানা হ’ত। এতে প্রাচীরে ফাটল ও ছিদ্রের সৃষ্টি হ’ত।

মুসলমানরা তাদের বাহিনীতে বিভিন্ন রকমের মিনজানীক, দাবাবা ও কাব্‌শ রাখত। কোন কোন সময় ঐ সব দাবাবা ও কাব্‌শের সাহায্যে পরিখা ভরাট করবার জন্য বিভিন্ন ধরনের সাজ-সরঞ্জাম, যেমন—লাকড়ী, বালির বস্তা প্রভৃতি বহন করে নিয়ে যাওয়া হ’ত। অনেক সময় তীরন্দায কাব্‌শের ভেতর বসে থেকে নিকট থেকে দুর্গের ভেতর অবস্থানকারী শত্রুর উপর তীর নিক্ষেপ অথবা কেরোসিন তেলের সাহায্যে দুর্গের দরওয়াজায় আগুন লাগিয়ে দিত।

গ্রীক-অগ্নি

গ্রীক-অগ্নি আসলে এশিয়াবাসীর আবিষ্কার। রোমকরা কালিং কূস নামীয় একজন সিরীয়বাসী থেকে এটি খরিদ করে এবং এর সাহায্যে তারা কনস্টান্টিনোপল জয়ের উদ্দেশ্যে পরিচালিত কয়েকটি আরব হামলা ব্যর্থ করে দেয়। রোমকরা এর আসল নাম ও কার্য-প্রকৃতি গোপন রাখার উদ্দেশ্যে এর নাম দেয় ‘গ্রীক-অগ্নি’।

আরবরা শেষাবধি এর রহস্য জেনে ফেলে এবং ক্রুসেড যুদ্ধে মিসরীয়রা এটি সফলতার সঙ্গে ব্যবহার করেছিল। আরবরা গন্ধক তৈল জাতীয় কিছু বস্তু এবং কেরোসিন তেলের সংমিশ্রণে এটা বানাত। এই উপকরণসমূহ তারা জাহাজের সম্মুখে রক্ষিত তামার নলের মাধ্যমে শত্রুর উপর নিক্ষেপ করত। অতঃপর সেই দাহ্য বস্তুতে তীরের সাহায্যে আগুন লাগিয়ে দিত। এই উপকরণ ও মৌলিক পদার্থকে কাপড়ের টুকরোর উপর ফেলে কেল্লা কিংবা জাহাজের উপর মিনজানীক দ্বারা নিক্ষেপ করে তার ভেতর বিভিন্ন পন্থায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া হ’ত। হুসায়ন বিন নুমায়র ‘আবদুল্লাহ্ বিন যুবায়রকে অবরোধ করবার সময় খানায়ে কা’বার ‘গিলাফ’ এই উপকরণের সাহায্যেই জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

বারুদের ব্যবহার

বারূদ আবিষ্কারের কৃতিত্বও আরবদেরই। এটা ঠিক নয় যে, ফিরিঙ্গীরা এটি আবিষ্কার করেছিল। কেননা ফিরিঙ্গীদের দাবী অনুসারে বারূদ আবিষ্কারের কৃতিত্ব ‘শুয়ারেঞ্জ’ নামক এক ব্যক্তির যিনি ১৩২০ ‘ঈসায়ীতে এটি ব্যবহার করেন। অতএব এটির আবিষ্কারক যে আরবরাই—সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়।

যুদ্ধ-পদ্ধতি এবং আরব

বেদুঈন গোত্রগুলো ইসলাম-পূর্ব অন্ধকার যুগে একটি বিশেষ ধারা ও রীতিতে যুদ্ধ করত। এই রীতিকে বলা হ’ত ‘কার’ ও ‘ফার’—যার শাব্দিক অর্থ শান-শওকত ও ধুমধাম।

আরবরা ছিল স্বাধীন প্রকৃতির। তবে কবীলার সরদারের আনুগত্যকে তারা ফরয জ্ঞান করত। কিন্তু এই আনুগত্য হ’ত শৃংখলা-বিহীন। যুদ্ধের জোশে তারা একেবারে প্রতিপক্ষের উপর ঝাপিয়ে পড়ত এবং সকল সরদারই একে অপরের মুকাবিলায় সম্মুখে এগিয়ে যাবার প্রয়াস পেত। যার ফল হ’ত এই যে, এরা শত্রুর উপর একই সময় সংহতভাবে হামলা করতে পারত না। আর ঘটনাচক্রে যে সব লোক অবশিষ্ট লোকদের তুলনায় অনেক দূর এগিয়ে যেত—তারা মারা গেলে কিংবা আহত হ’লে বাকী সকলেই সুবিধা মাফিক সময় হামলা করার অপেক্ষায় থাকত।

যুদ্ধের সময় হামলা করবার পূর্বে এরা নিজেদের স্ত্রী-পুত্র ও সওয়ারী উটগুলোকেও একত্র করে একটি সুরক্ষিত স্থানে রেখে যেত। একে তারা বলত ‘মাজহোযা’। জয় ও পরাজয় উভয় অবস্থায়ই তারা এইস্থানে একত্ৰিত হ’ত।

আমরা (গ্রন্থকার) যখন ১৯১৪-১৬ ঈসায়ীতে আরব গোত্রগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করি, তখনও সাধারণ বেদুঈন গোত্রগুলোর মধ্যে এই রীতির প্রচলন দেখেছি। মনে হচ্ছিল যেন এই সব লোক আঁ-হযরত (সা)-এর উদ্ভাবিত যুদ্ধ-পদ্ধতি ভুলে গেছে। তিনি (রসূল করীম) স্বীয় পন্থার নাম দিয়েছিলেন ‘যাহ্‌ফ’–আর তা এই আয়াতের উপর ভিত্তি করে :

অর্থাৎ “আল্লাহ্ পাক নিশ্চিতই সেই সব লোককে ভালবাসেন যারা আল্লাহ্‌র রাস্তায় ‘সীসা ঢালা প্রাচীরে’র ন্যায় কাতারবন্দী হয়ে লড়াই করে।”

হাদীছ পাকেও ইরশাদ করা হয়েছে—

“একজন মু’মিন অপর মু’মিনের জন্য সীসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায় যার এক অংশ অপর অংশকে শক্ত রাখে।” এরই ভিত্তিতে আঁ-হযরত (সা) মুজাহিদবৃন্দকে এমন সোজা করে কাতারবন্দী করতেন যেমনটি সালাতের জন্য করা হ’ত। হামলার সময় লক্ষ্য রাখা হ’ত যেন কাতার বরাবর সোজা থাকে।

হযরত ‘আলী (রা) সিফ্‌ফীন যুদ্ধের সময় (৩৭ হি.) স্বীয় বাহিনীকে সম্বোধন করে বলেছিলেন:

“নিজেদের কাতার সোজা, সুদৃঢ় ও মযবুত প্রাচীরের ন্যায় বানিয়ে নেবে। বর্মধারীদেরকে সম্মুখে রাখবে। যারা বর্মহীন তারা বাহিনীর পেছনে থাকবে। অটুট মনোবল নিয়ে এগিয়ে যাবে। বল্লমের ফলাগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিলিয়ে নেবে এবং লক্ষ্যবস্তুর দিকে তাক করে রাখবে; চীৎকার করবে না। লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত হানতে নিশানা অব্যর্থ রাখবে, পতাকা অবনত হতে দেবে না। কেবলমাত্র তারাই পতাকার মুহাফিজ হবে যারা বাহাদুর। সত্যকে আঁকড়ে ধরবে এবং ধৈর্য অবলম্বন করবে। আর ধৈর্যের মাধ্যমেই কেবল বিজয় ও আল্লাহ্‌র সাহায্য নেমে আসে।”

এই বিধান ও নির্দেশ অটল। তবে একে সঠিকভাবে কাজে লাগানো অধিনায়কের বুদ্ধিমত্তার উপর নির্ভর করে। এ যুদ্ধ-নীতি আঁ-হযরত (সা) কায়েম করেছিলেন। যেহেতু হযরত ‘আলী (রা) কয়েকবার আঁ-হযরত (সা)-এর নেতৃত্বাধীনে লড়াই করেছিলেন, তাই তিনি তাঁর যুদ্ধের মূলনীতি সম্পর্কেও ওয়াকিফ ছিলেন। সময় অতিক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানরা এই যুদ্ধ-নীতির সঠিক তাৎপর্য ভুলে গেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, ইমাম ইব্রাহীম বিন ‘আবদুল্লাহ বিন হাসান বিন ‘আলী (রা) যখন ‘আব্বাসী খলীফা মনসুর প্রেরিত ফৌজের মুকাবিলায় এসে উপস্থিত হন, যার আমীর ছিলেন ‘ঈসা বিন মুসা, তখন ইমাম ইব্রাহীমকে তাঁর উপদেষ্টাবৃন্দ পরামর্শ দেন যেন তিনিও স্বীয় ফৌজকে “ক্রডিস”-এর যুদ্ধনীতির উপর পরিচালনা করেন। কিন্তু ইমাম এই যুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, “আমরা ইসলামের কাতারবন্দী ভিন্ন অন্য কোন কাতারবন্দী এখতিয়ার করতে পারি না।” যুদ্ধে ইমাম ইব্রাহীমের পরাজয় ঘটে। এখন প্রশ্ন জাগে, তাহলে আঁ-হযরত (সা)-এর যুদ্ধনীতি (আল্লাহ্‌র পানাহ্ চাই) এত স্বল্পকালের ব্যবধানেই কি ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল? যদি তা না হয় তাহলে এই পরাজয় কেন হ’ল?

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. এই গ্রন্থকার সৈন্য বিভাগের অশ্বারোহী বাহিনীতেই ভর্তি এবং পয়লা টুর্ণামেন্ট কৃত্রিম যুদ্ধ, যাকে Indian Army-তে Mounted Combat বলা হ’ত, ১৯১৪ সানের ডিসেম্বর মাসে যোগদান করেন। এই প্রতিযোগিতা লাখনৌ ছাউনিতে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হ’ত। এতে প্রতিযোগীরা ইংরেজী, ভারতীয়, ইরানী ও আরবীয় ধাঁচের তলোয়ার ও বল্লম নিয়ে প্রতিযোগিতায় অবতরণ করত যাতে এগুলোর একটির উপর অন্যটির যে প্রাধান্য রয়েছে তার পরিমাপ করা যায়। ১৯১৪ সনের প্রতিযোগিতাই ছিল এধরনের শেষ প্রতিযোগিতা। কেননা বিশ্বযুদ্ধে ট্যাংক ও ফাইটার বিমানের ব্যবহার ঘোড়া ব্যবহারের গুরুত্ব ও মর্যাদাকে হ্রাস করে দেয়।