বর্ণাকার

বোম্বাই সমুদ্রোপকূলে হামলা

১৫ হিজরীতে ‘উছমান বিন ‘আস কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। আরব বণিকেরা বোম্বাই-এর বন্দর গানখানায় এবং সিন্ধুর অন্তর্গত দেবলে বাণিজ্য উপলক্ষ্যে যেত। কিছু সংখ্যক দস্যু ও লুটেরা কয়েকবার এসব বণিকদের মালপত্র লুট করে। এদেরকে শায়েস্তা করবার জন্য শেষ পর্যন্ত ‘উছমান ইব্‌ন ‘আসকে একটি নৌ-বহর দিয়ে পাঠান হয়। ঐ অভিযানে নৌ-বহরের জীবন কিংবা সম্পদের কোন ক্ষতি হয়নি, তবুও হযরত ওমর (রা)-এর বিনা অনুমতিতে তা পাঠাবার কারণে ‘উছমানকে কৈফিয়তের সম্মুখীন হতে হয়। হযরত ওমর (রা) নৌ-অভিযানের বিরোধী ছিলেন।

ভারতবর্ষের উপর হামলা

২২ হিজরীতে মুসলিম মুজাহিদবৃন্দ ইরান জয় করে আরও সম্মুখে অগ্রসর হন এবং মাকরান, কিরমান ও সুস্তানের সীমান্তরেখা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেন।

মাকরানের শাসনকর্তা সিন্ধুর রাজার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন। এতদসত্ত্বেও মুসলিম সেনাপতি ইবনে ‘আমের সম্মিলিত শত্রু বাহিনীকে পরাজিত করেন। ইবনে ‘আমের এসব যুদ্ধের বিবরণ দরবারে খেলাফত পাঠিয়ে দেন। এতে তিনি ঐ এলাকা সম্পর্কে লিখেন, “এই পাহাড়ী ও ঘন জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় বিরাট সেনাদল চলাফেরা করতে পারে না। এখানে পানীয় জল ও রসদ- সামগ্রীরও দারুণ অভাব।” এই প্রেক্ষিতে হযরত ওমর (রা) মুজাহিদদের অগ্রাভিযান বন্ধ করে দেন।

৪৪ হিজরীত মুহাল্লাব বিন আবী সফরা কাবুলের রাস্তা দিয়ে খায়বার গিরিপথ জয় করেন এবং ভবিষ্যতের জন্য মুসলিম ফৌজের বিজয়ের দরজা খুলে দেন। বলা হয় যে, ফিরবার পথে মুসলিম ফৌজ কায়কান (কালাত) এবং কান্দাবীল (কান্দাহার), যাকে গান্দারীও বলা হ’ত, বিধ্বস্থ ও পদানত করে।

সিন্ধু আক্রমণের কারণ

৭৫ হিজরীতে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছাকাফী বসরার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। তিনি সাঈদ বিন আসলাম বিন যুর’আকে মাকরান সন্নিহিত এলাকার শাসক নিযুক্ত করেন। এ-এলাকার বনী আসার কবীলার সর্দার মুহাম্মদ আলাফী বিদ্রোহ ঘোষণা করলে সাঈদ সঙ্গে সঙ্গে উক্ত বিদ্রোহ দমন করেন। কিন্তু মুহাম্মদ আলাফী তার বহু সৈন্য-সামন্তসহ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং রাজা দাহিরের আশ্রয়াধীনে বসতি স্থাপন করেন। এখান থেকে তিনি উপর্যুপরি আরব বণিক এবং আরব এলাকাগুলোর উপর আক্রমণ চালাতে থাকেন এবং হত্যা ও ধ্বংসের বিভীষিকা কায়েম করেন।

হাজ্জাজ মুহাম্মদ আলাফীকে দমন করতে ব্যর্থ হয়ে আলাফী গোত্রের সর্দার সুলায়মানকে, যিনি সে সময় আরবে ছিলেন, হত্যা করেন। এতে মুহাম্মদ আলাফী অনুগত হবার পরিবর্তে আরও উগ্র হয়ে উঠেন। অবশেষে হাজ্জাজ মুহাম্মদ আলাফীকে ফেরত পাঠাবার জন্য রাজা দাহিরের কাছে দাবী জানান। রাজা দাহির সে দাবী মানতে শুধু অস্বীকৃতিই জানাননি—বরং তিনি হাজ্জাজের প্রেরিত মুসলিম দূতকেও হত্যা করেন। হাজ্জাজ মুহাম্মদ আলাফীর বিরুদ্ধে ফৌজ পাঠান। আলাফী রাজা দাহিরের সহায়তায় ঐ ফৌজকে পরাজিত করেন। ফৌজের সদস্যদের সংখ্যাল্পতাই ছিল এ পরাজয়ের অন্যতম কারণ। অবশ্য ফৌজের অধিনায়কের দ্বারা কতিপয় প্রতিরক্ষাগত ত্রুটিও সংঘটিত হয়। খলীফার বাহিনী খেলাফতের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনের পর তখন শাম ও তুর্কিস্তানের দিকে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। বায়তুলমালেও অর্থ সংকট চলছিল। ফলে হাজ্জাজকে বাধ্য হয়েই চুপ থাকতে হয়। তিনি মুহাম্মদ বিন হারূন এবং বুদায়লের পরাজয় যেমন কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না, তেমনি এর বদলাও নিতে পারছিলেন না।

রাজা দাহিরের অগ্রাভিযান

রাজা দাহিরের নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে, আরবদের জন্য তিনি স্থলপথ বন্ধ করে দিয়েছেন। এবার তিনি তাদের নৌ-বাণিজ্যও খতম করবার দৃঢ় সংকল্প নেন। সে সময় লঙ্কায় (সরন্দীপ) যাকে আরবরা “সীলন” নামে অভিহিত করত, আরবদের বেশ বড় রকমের বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। সেখানে তাদের বেশ বড় রকমের বসতিও গড়ে উঠেছিল। সীলন (সিলোন)-এর জনপ্রিয়তার কারণ ছিল সেখানকার রাজার সঙ্গে মুসলিম খলীফার বিশেষ বন্ধুত্ব। কোন কোন ঐতিহাসিক তো এতদুর পর্যন্ত লিখেছেন যে, সীলনের রাজা মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন।

মুসলিম বণিকদের একটি দল যখন সীলন থেকে হজ্জের উদ্দেশ্যে এবং ব্যবসার পণ্য-সামগ্রী নিয়ে জাহাজযোগে রওয়ানা হন তখন তাদের সঙ্গে কিছু বিধবা মহিলা ও য়াতীম শিশু ছিল। ঐসব মহিলার আত্মীয়-স্বজন জাহাজ ডুবিতে মারা গিয়েছিল। সরন্দীপের রাজা য়াতীম শিশু ও বিধবা মাহিলাদেরকে উপহার-সামগ্রী এবং আর্থিক সাহায্য দিয়ে কাফেলার সঙ্গে হেজাযে পাঠিয়েছিলেন, সেই সঙ্গে বন্ধুত্বের নিদর্শন-স্বরূপ তিনি বেশ কিছু উপঢৌকনও খলীফার জন্য পাঠিয়েছিলেন। এই কাফেলা সমুদ্র পথে দেবলের কাছে পৌঁছুলে কাফেলার যাবতীয় মালপত্র লুট করা হয় এবং লোকদেরকে বন্দী করে রাজা দাহিরের নিকট তাঁর রাজধানীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কয়েদীদের মধ্যে খারবু কবীলার একজন য়াতীম বালিকা ছিল। সে অত্যন্ত সুকৌশলে আপন রক্তে একটি চিঠি লিখে হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে পাঠিয়ে দেয়। চিঠিটা ছিল খুবই মর্মস্পর্শী। চিঠি পড়া মাত্রই হাজ্জাজ রাগে ও উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠেন। চিঠিটি এমন সময়ে তাঁর কাছে গিয়ে পৌঁছেছিল যখন তিনি নির্দেশনামাসহ মুহাম্মদ বিন কাসিমকে কুতায়বার নিকট পাঠাচ্ছিলেন।

আমরা এখানে একটি কাহিনী উল্লেখ করতে চাই যার স্মরণে আজ পর্যন্ত ঐ সব বিধবা ও য়াতীম সম্পর্কে সিন্ধুবাসীদের হৃদয়-মন ভারাক্রান্ত হয়ে আছে।

সিন্ধুনদের মাঝখানে একটি ছোট উপদ্বীপ রয়েছে যাকে রোহড়া বলে এবং শুক্কুরের সেতু মূল স্থলভাগের সাথে মিলিত করে। মুহাম্মদ বিন কাসিমের সময় একে সুকরালীদ বলা হ’ত। এই ছোট্ট উপদ্বীপটিতে একটি অনাবাদী ঘর রয়েছে। এই ঘর সম্পর্কে প্রসিদ্ধি এই যে, রাজা দাহির আরবের মুসলিম কুমারীদেরকে এখানে বন্দী করে রেখেছিলেন। রাজা দাহিরের কর্মচারীরা যখন তাদের সতীত্ব-সম্ভ্রম নষ্ট করার অসৎ উদ্দেশ্যে উক্ত ঘরে প্রবেশ করতে উদ্যত হয় তখন সেখানে একটি বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে রাজার সকল কর্মচারী মারা যায়। এরপর যারাই সে ঘরে প্রবেশ করতে চেষ্টা করেছে তারাই মারা গেছে। ধারণা করা হয় যে, আরব বন্দিনীরাও উক্ত ঘরেই নিহত হয়ে থাকবে।

জনশ্রুতি এইরূপ যে, প্রায় ১৩০০ বছর যাবত সে ঘরে কেউই প্রবেশ করেনি। ঘরের ধ্বংসাবশেষ আজও বিদ্যমান। কাহিনীর সকল বিবরণীই যে সত্য তেমন কথা বলা যায় না। তবে উক্ত কাহিনী থেকে মুসলিম নারীদের মর্যাদা ও সম্ভ্রমবোধ সম্পর্কে সিন্ধুর বর্তমান অধিবাসীদের অনুভূতি অনায়াসে আঁচ করা যায়।

উক্ত উপদ্বীপেই ছিল রাজা দাহিরের রাজধানী রাওর। এটা ছিল দুর্গের মত। এর সকল প্রাচীরই ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু এঘরটি এখনো টিকে থেকে রাজা দাহিরের কেল্লার ধ্বংসাবশেষের উপর যেন বিলাপ করছে এবং ভবিষ্যত বংশধরদেরকে মুসলিম বালিকাদের সম্ভ্রমবোধ, সাহসিকতা, আত্মোৎসর্গ ও কর্মকৌশলের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছে—চরম অবস্থায় কিভাবে ঐসব উচ্চমনা ও পবিত্র রমণীদের একজন বালিকা প্রতিনিধি হাজ্জাজকে নিজেদের বিপদের ব্যাপারে অবহিত করেছিল এবং এরপর সময় মত সাহায্য না আসা সত্ত্বেও হতাশা ও নিরাশাকে কাছে ঘেঁষতে না দিয়ে নিজেদের সতীত্ব-সম্ভ্রম ও ব্যক্তি-সত্তার হেফাজত করেছিল।

রাওর কেল্লা

জনশ্রুতি আছে যে, রাজা দাহিরের রাজধানী যদিও রাওর ছিল, কিন্তু রাওর মহলের বাইরে ছিল কেল্লা, যাকে আলোর বা (আরোড়) বলা হ’ত। রাওরে একটি ছোট্ট কেল্লার মত শহর ছিল। শাহী মহল এবং মন্ত্রীদের বাসাবাড়ী সেখানেই ছিল।

আপনি যদি পূর্ব নারা নদীর দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে অগ্রসর হন তাহলে নদীর উজান দিকে একটি পুল পাবেন। আপনি যদি পুল থেকে পশ্চিম দিকে দু’মাইলের মত অগ্রসর হন তাহলে সেখানকার বাসিন্দারা আপনাকে একটি বড় মত গৃহাঙ্গণ দেখাবে। তাদের ধারণা মতে, এখানে মুহাম্মদ বিন কাসিমের শিবিরের লোকেরা সালাত আদায় করত এবং এর আশেপাশেই শিবির ও ছাউনী ছিল। এখন আপনি যদি সেখানে দাঁড়িয়ে উত্তর দিকে তাকান, তাহলে আপনি একটি ছোট্ট পাহাড় পদ্ম ফুলের মত উপরের দিকে প্রস্ফুটিত দেখতে পাবেন। জনসাধারণের ভাষ্য অনুযায়ী আলোর দুর্গ, ফৌজের ছাউনী এবং শহর এখানেই ছিল। এর শাসনকর্তা ছিলেন রাজা দাহিরের ছোট ভাই রাজা গোপী। রাওর প্রাসাদ জয় করার পর মুহাম্মদ বিন কাসিম এ দুর্গও জয় করেন। এখন পর্যন্ত তার কিছু ধ্বংসাবশেষ উক্ত পাহাড়ের উপর বিদ্যমান আছে।

অভিযানের প্রস্তুতি

হাজ্জাজ একদিকে জরুরী ভিত্তিতে অভিযান প্রেরণের অনুমতি প্রার্থনা করে মুহাম্মদ বিন কাসিমের মাধ্যমে খলীফার কাছে দরখাস্ত পাঠান এবং অন্যদিকে মাকরানের শাসনকর্তা ‘উবায়দুল্লাহ্ কে লিখে পাঠান যেন তিনি স্বয়ং রাজা দাহিরের কাছে গিয়ে ঐ সমস্ত কয়েদীদের মুক্ত করে দেবার দাবী জানান।

কিন্তু রাজা দাহির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে অত্যন্ত ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করেন। এতে মুহাম্মদ বিন আলাফীরও হাত ছিল। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ প্রথম দিককার ব্যর্থতার কারণ বেশ ভালভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। দামিশ্‌ক থেকে প্রায় দু’হাজার মুজাহিদ বসরা এসেছিল। বসরার পার্শ্ববর্তী এলাকায় আরও প্রায় দু’হাজার মুজাহিদ পাওয়া গেল। এরপর তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিমকে শীরায গিয়ে অবস্থান করতে নির্দেশ দেন—যাতে করে সেখানে সিরিয়া ও ইরাক থেকে আরও মুজাহিদ পাঠানো যায়, আর এই মধ্যবর্তীকালীন সময়ে মুহাম্মদ বিন কাসিম স্বীয় ফৌজের শৃংখলা ও ব্যবস্থাপনা ঠিকঠাক করে নিয়ে এবং তাদেরকে সমরশাস্ত্রের মূলনীতি মুতাবিক তা’লীম দিয়ে একটি বিরাট অভিযানের জন্য প্রস্তুত করে নিতে পারেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিম স্বীয় শ্বশুর ও পিতৃব্য হাজ্জাজের নিকট থেকে ফৌজ সুসংগঠিত ও সুশৃংখল করার কৌশল আয়ত্ত্ব করেছিলেন এবং এ বিষয়টা তাঁর মস্তিষ্কে গেঁথে গিয়েছিল যে, ফৌজকে পরিশ্রমী ও কষ্টসহিষ্ণু হতে হবে। অধিকন্তু আরবদের সাফল্য ছিল অশ্বারোহী বাহিনীর বিদ্যুৎ গতির উপর নির্ভরশীল। মুহাম্মদ বিন কাসিম বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ঐ সব মুজাহিদকে অনেকগুলি প্লাটুনে সুসংগঠিত করেন। তাদের উপর বিভিন্ন পদাধিকারী অফিসার নিযুক্ত করেন। এ ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করতে ছ’ মাস লেগে গেলেও মুহাম্মদ বিন কাসিম ঐ দিনগুলোকে অযথা নষ্ট করেননি। তিনি গুপ্তচর ও ঘোড়সওয়ারের মাধ্যমে সিন্ধুর রাস্তা-ঘাট, দুর্গ ও রাষ্ট্রীয় অবস্থাদি সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অবহিত হন। প্রথম অভিযানে ভারতীয় দুর্গ এবং হস্তীবাহিনী আরবদেরকে পেরেশান করেছিল। কিভাবে এর প্রতিবিধান করা যায় সে ব্যাপারে তিনি চিন্তা-ভাবনা করেন এবং স্বীয় সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের আলোকে ফৌজের সামরিক মহড়ার ব্যবস্থা করেন।

এতদ্ভিন্ন তিনি ভারতীয় রোগ-ব্যাধি—যেমন জ্বর, আমাশয় ইত্যাদির জন্য ঔষধ-পত্র সঙ্গে নেন। ৭১১ ঈসায়ীতে এই ফৌজ তৈরী হয়ে গেলে হাজ্জাজ দুর্গ-বিধ্বংসী যন্ত্র ও অন্যান্য ভারী যুদ্ধাস্ত্র বসরা থেকে নৌ-বহরের মাধ্যমে সিন্ধুর উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন। ঐসব মালপত্র দেবল বন্দরের পরিবর্তে সোম মিয়ানী নামক অখ্যাত, কিন্তু বেশ সুন্দর—একটি বন্দরে নামানো হয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে সমস্ত লোক প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে গভীরভাবে পড়াশোনা করেছেন তাঁরা জেনে থাকবেন যে, মিত্র বাহিনী ফৌজের চলাচল ও গতিবিধির ক্ষেত্রে বর্তমান যুগের ট্রেনিংপ্রাপ্ত গ্রাজুয়েট বৃটিশ মিলিটারী স্টাফ অফিসাররা বৈদ্যুতিক তার, ওয়ারলেস, আধুনিক নৌ-বহর ও বিমানের সহায়তা সত্ত্বেও কি কি ভুল করেছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ বৃটিশ ফৌজ যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বসরা পৌঁছে তখন ভারী সামান জাহাজে চাপানো ছিল এবং সেসব নামানোর জন্য যে ক্রেন (Crane) আনা হয়েছিল তা ছিল ভারী মাল-পত্রের নীচে। ফলে এই নৌ-জাহাজকে পুনরায় বোম্বাই পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং তাকে পুনরায় ঠিক-ঠাক করে সামান চাপিয়ে বসরা পাঠান হয়। এই বৃটিশ ফৌজের সাথে আমরা ছিলাম। আমরা যখন দ্বিতীয়বার বসরা পৌঁছলাম তখন জানতে পারলাম যে, অশ্বারোহী বাহিনী ও গোলন্দাজ বাহিনীর ঘোড়া নামাবার জেটি তৈরী করা সম্ভব হয়নি। কেননা এর কিছু আসবাবপত্র বোম্বাইয়ে যে জাহাজে উঠানো হয়েছিল, ইঞ্জিন খারাপ হবার কারণে সে জাহাজ বসরা পৌঁছুতে পারেনি। ফলে ঘোড়াগুলোকে জাহাজের উপর থেকে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় এবং আমরা উপকূলে পানিতে দাঁড়িয়ে থেকে উপকূলের দিকে সাঁতরে আসা ঘোড়াগুলোকে পাকড়াও করতে থাকি। বাকী থাকল যুদ্ধাস্ত্র, যেমন— জীন, তলোয়ার, রাইফেল ইত্যাদি,—সেগুলোকেও ছোট ছোট নৌকায় বোঝাই করে কূলে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয়।

কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিমের মিনজানীক ‘আছম’–যা পাঁচ শ’ মানুষের সাহায্যে চালান হ’ত এবং সেটা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় পাথর এবং অন্যান্য ভারী সামান নৌ-বহর মারফত ভিন দেশের শত্রু এলাকায় যথাসময়ে সুন্দর ও সুষ্ঠভাবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অনুরূপভাবে পদাতিক ফৌজকেও নৌ-বহরের সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্যস্থলে নিয়ে আসা হয়।

মুহাম্মদ বিন কাসিম স্বীয় স্থল-বাহিনীকে দ্রুত গতিতে লম্বা দূরত্ব অতিক্রম করবার যোগ্য বানিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর বাহিনীতে আনুমানিক ছ’হাজার আরোহী অর্থাৎ ঘোড়-সওয়ার এবং ছ’হাজার উষ্ট্রারোহী ছিল। এদের সঙ্গে প্রায় তিন হাজার ভারবাহী উটও ছিল। ঐ ফৌজ দেখলে মনে হয়, মুহাম্মদ বিন কাসিম দেবল বিজয় পর্যন্ত শত্রুদের কোন মযবুত কেল্লা তাঁর পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে—তেমনটি চিন্তা করেন নি।

কুযপুর-পাঞ্জগোর ছিল মাকরানের রাজধানী। এই দুর্গ মুহাম্মদ বিন কাসিম কয়েক মাসের অবরোধের পর জয় করেন। এবং এখানে বসে কুযপুর থেকে দেবলের দুরুহ রাস্তা পার হবার প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা তৈরী করেন। পাঞ্জগোরের যুদ্ধে মুহাম্মদ বিন কাসিম এটা জানতে পেরেছিলেন যে, মামুলী দুর্গ জয় করবার জন্য ও পদাতিক ফৌজের দুর্গ বিধ্বংসী অস্ত্রের দরকার পড়বে যা সেখানে বর্তমান ছিল না।

প্রকৃতি কাসবেলা (লাসবেলা) এলাকাকে পশ্চিম থেকে আগত হামলাকারীদের জন্য একটি বিশেষ প্রতিবন্ধক করে রেখেছিল। এসব এলাকা ছিল ছোট ছোট পাহাড় দ্বারা—যা মাত্র কয়েক শ’ ফুট উঁচু—সাঁটানো। এসব পাহাড় কেয়ার পাহাড় শ্রেণীর শাখা-প্রশাখা মাত্র এবং এ উপত্যকায় বর্ষাতি নালাগুলো বেশ গভীর এবং প্রান্তরে বেশ প্রশস্ত হয়ে প্রবাহিত হ’ত। এসব নালা বৃষ্টির সময় খুবই বিপজ্জনক হ’ত। এসব পাহাড় ও নালা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রসারিত ছিল। পাহাড়ের উপর ঘন জঙ্গলের আচ্ছাদন ছিল এবং উপত্যকায় বিশেষ বিশেষ নালার ভেতর খননকৃত কুয়া এবং পাহাড়ী ঝর্ণা ছাড়া অন্যত্র পানি ছিল খুবই দুষ্প্রাপ্য। বর্ষাতি পুকুরগুলোর পানি খুবই লবণাক্ত হ’ত। সাধারণ কুয়ার পানি স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে অভ্যাসগত কারণে মিঠা লাগলেও বিদেশী মুসাফির ও পর্যটকদের কাছে তা ছিল নোন্‌তা। ঐ পানি পান করলে পেট খারাপ হ’ত। ফলে আমাশয় ও দাস্তের অভিযোগ সেখানে ছিল একটি সাধারণ ব্যাপার।

যদিও আজকাল সে এলাকার জঙ্গল খুব তাড়াতাড়ি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু চিহ্ন দৃষ্টে মনে হয়, কোন এক যুগে ঐ এলাকা দুরতিক্রম্য এবং কাঁটাপূর্ণ ঝোপঝাড়ে পূর্ণ ছিল। আরব, তুর্কী, ইরানী, তুর্কী, পাঠান এবং মোগল আক্রমণকারীরা সেখানকার যুদ্ধবাজ বাসিন্দাদের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচবার জন্য ঐ ঝোপ-ঝাড় জ্বালিয়ে দিয়েছিল যাতে করে শত্রুরা লুকিয়ে আড়াল থেকে আক্রমণকারী ফৌজের উপর হামলা চালাতে না পারে।

সিন্ধুতে মুহাম্মদ বিন কাসিমের যুদ্ধ

মুহাম্মদ বিন কাসিমের ফৌজ যখন বেলার দিকে অগ্রসর হয় তখন স্থানীয় লোকেরা এবং ভারতীয় ফৌজ (যার সংখ্যা ছিল ২৫ হাজারের মত) তাদেরকে প্রতিরোধ করতে শুরু করে। হিন্দু সেনাপতি স্বীয় ফৌজকে সমগ্র এলাকায় ছড়িয়ে রেখেছিলেন। ফৌজের বিভিন্ন প্লাটুন ও কোম্পানী নদী-নালা ও পাহাড়ী জঙ্গল থেকে অতর্কিতে বেরিয়ে এসে আরব ফৌজের উপর আক্রমণ চালাত এবং আরব ফৌজ তাদের উপর পাল্টা আঘাত হানার আগেই তারা জঙ্গলের ভিতর অদৃশ্য হয়ে যেত।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের সৌভাগ্য যে, ভারতীয় সেনাপতি পরিশ্রমী ও সাহসী ছিলেন না। অধিকন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন কুযপুর থেকে রওয়ানা হন তখন তিনি তাঁর এই অগ্রাভিযানের কথা একেবারে গোপন রাখেন। ফলে ভারতীয় ফৌজ আরবীয় ফৌজের উপর তখনই হামলা শুরু করে যখন তিনি বেলার একেবারে নিকটে পৌঁছে গেছেন। এতদ্‌সত্ত্বেও ভারতীয় ফৌজ বেশ দৃঢ়তার সাথে লড়াই শুরু করে। ফলে আরবীয় ফৌজ, যার ভেতর অধিকাংশই ছিল আরোহী এবং মাল ও সামানবাহী, খুবই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে এবং তাদের অগ্রগতি ব্যাহত হয়।

অতঃপর মুহাম্মদ বিন কাসিমের জন্য মাত্র দু’টো রাস্তাই খোলা ছিল:

  1. বর্তমান রাস্তা ছেড়ে দিয়ে উপকূল বরাবর তুলনামূলক খোলা প্রান্তর দিয়ে লড়াই করতে করতে সম্মুখে অগ্রসর হওয়া;
  2. শত্রু বাহিনীর অবস্থান-স্থল বেলা দুর্গের উপর হামলা করা এবং এভাবে দুশমনকে একস্থানে একত্র হয়ে লড়বার জন্য উৎসাহিত করা। কেননা গেরিলা ধরনের লড়াই আরব ফৌজকে—বিশেষ করে এর রসদবাহী ফৌজকে—বেশ ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।

গেরিলা তীরন্দায লুকিয়ে থেকে রসদবাহী পশু এবং মুজাহিদদের উপর বড় রকমের আঘাত হেনে চলেছিল। অনন্তর স্বীয় অভীষ্ট লক্ষ্য হাসিলের জন্য মুহাম্মদ বিন কাসিম এ-চাল চালেন যে, স্বীয় ফৌজের অগ্রগামী বাহিনীর গতিকে সিপাহী সিংহের (Spai Singh) ফাঁড়ির নিকট থেকে আগোর (Aghor) বন্দরের দিকে ফিরিয়ে দেন। এমনটি করার পূর্বে তিনি স্বীয় গুপ্তচর মারফত রটিয়ে দেন যে, আরব ফৌজ এখন উপকূল ভাগ দিয়ে অগ্রসর হবে এবং সেখানে আরব নৌ-বহর তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। এখবর তিনি বেশ দৃঢ়তা সহকারে ও সুকৌশলে শত্রুদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন।

এরপর তিনি স্বীয় ফৌজকে দু’অংশে বিভক্ত করেন। বড় অংশের নেতৃত্ব দেন মুহাম্মদ বিন হারুনকে এবং নির্বাচিত একটি কোম্পানী, যার সংখ্যা হবে হাজারের মত, নিজের সঙ্গে নেন এবং রাতের বেলা তাদেরকে নিয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে পড়েন। বড় অংশ নিয়ম বহির্ভূতভাবে অর্ধেক রাত্রির পূর্বে, যখন গোটা বিশ্ব-প্রকৃতি চন্দ্রালোকিত, অগ্রযাত্রা শুরু করে এবং দিনের বেলায়ও ধীরে সুস্থে সে যাত্রা অব্যাহত রাখে।

ভারতীয় সেনাপতি এই সামরিক চালে হেরে যান। তিনি যেই শুনলেন যে, আরব ফৌজ প্রান্তরের দিকে অগ্রসর হবার চিন্তা করছে, অমনি তিনি স্বীয় ফৌজকে একত্র হবার নির্দেশ দেন, যাতে করে আরব ফৌজকে খোলা ময়দানে বের হবার পূর্বেই পরাজিত ও ধ্বংস করে দেওয়া যায়। এ সিদ্ধান্তকে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে তিনি সাধারণ নিরাপত্তা নীতিকে লঙ্ঘন করেন অর্থাৎ দুর্গে খুবই স্বল্প সংখ্যক সৈন্য রেখে যান। কেননা তাঁর নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে, তিনি খুব সত্বর আরব ফৌজকে ধ্বংস ও বরবাদ করে দুর্গে ফিরে আসবেন।

মোট কথা, আরব ফৌজের অগ্রযাত্রার কথা শুনতেই ভারতীয় সেনানায়ক তাৎক্ষণিকভাবে রাতের বেলায়ই স্বীয় গেরিলা ফৌজের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য দুর্গ থেকে বেরিয়ে পড়েন যাতে করে তিনি তার সমগ্র ফৌজকে একত্র করতে পারেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের গুপ্তচর তাঁকে মুহুর্তের খবর মুহূর্তেই দিয়ে চলছিল। যা-হোক, হিন্দু সেনাপতি তার অশ্বারোহী বাহিনীর সাথে দ্রুত বেরিয়ে পড়েন। কেননা তিনি তার পদাতিক বাহিনীকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং ভোর বেলার পরিবর্তে আরব ফৌজের মধ্য-রাত্রিতে অগ্রযাত্রার খবর শুনে তিনি আরও দ্রুততার সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন যাতে স্বীয় কোম্পানী দ্বারা দু’দিক থেকে আক্রমণ করে মুহাম্মদ বিন কাসিমের আগোর বন্দরের দিকে অগ্রসর হবার পথ রোধ করতে পারেন। বেলা দুর্গের পদাতিক ফৌজকে তিনি এ উদ্দেশ্যেই নিজের সঙ্গে নেওয়া সমীচীন মনে করেন। কেননা তাঁর ফৌজের অধিকাংশ‍ই গোটা এলাকায় ছড়িয়ে ছিল। ফলে তার ধারণা ছিল যে, তার গেরিলা পদাতিক ফৌজ একত্র করতে সময় লাগবে। তাই যথা সত্বর দ্রুত আরব ফৌজের উপর কার্যকর আঘাত হানতে তিনি দুর্গের পদাতিক ফৌজকে সঙ্গে নেওয়া জরুরী মনে করেন। আসলে তিনি তখন মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রতিরক্ষা চালে বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁর চলাচল ও গতিবিধি গোপন রেখে প্রতিটি বিষয়ে উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলেন। মুহাম্মদ বিন হারূনের সাথেও তাঁর ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল। মুহাম্মদ বিন হারুনের ভালভাবেই জানা ছিল যে, সংবাদ পাওয়া মাত্রই তাকে দুর্গের দিকে ফিরে এসে মুহাম্মাদ বিন কাসিমকে মদদ দিতে হবে। এ দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য তিনি ফয়সালা করেন যে, তার ফৌজের কিছু অংশ রিজার্ভ ফৌজ হিসাবে শত্রুর মুকাবিলায় ছেড়ে যাবেন যারা লড়াই করতে করতে পিছু হটবে এবং হটতে হটতে নিজেদের বড় মূল ফৌজের সঙ্গে মিলিত হবে। ওদিকে হিন্দী ফৌজ সঠিক পরিমাপ করতে পারেনি, আরব সেনাপতির প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা কি! যা-হোক, চাঁদ যখন অস্তমিত হচ্ছিল এবং ভোরের শুকতারা উদিত হচ্ছিল ঠিক তখন মুহাম্মদ বিন কাসিম স্বীয় অশ্বারোহী বাহিনী সমেত দুর্গের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেন। ঘোড়াগুলো তখন লুকিয়ে ফেলা হয় এবং মুহাম্মদ বিন কাসিমের দুরন্ত বাহিনী পায়ে হেঁটে দুর্গের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যদিও দুর্গটি ছিল মাটি নির্মিত—তথাপি হামলা করার সময় সতর্কতা অবলম্বনের দরকার ছিল।

দুর্গের অধিবাসীরা সারাদিনের ক্লান্তিতে ছিল অবসন্ন। তাদের সেনাপতিও তখন চলে গিয়েছিল। অপরদিকে আরব সেনাপতিও তখন চলে গিয়েছিলেন। আরব ফৌজ তাদের থেকে প্রতি মুহূর্তে দূরে সরে যাচ্ছিল বলে তারা অলস ও অসতর্ক হয়ে পড়েছিল। কিছু পাহারাদার ঘুমিয়ে ছিল। আর কিছু ছিল আধা জাগ্রত। তারা নিজ নিজ স্থানে দাঁড়িয়ে অর্ধ-নিমীলিত নেত্রে থেকে থেকে “হোঁ-শি-য়া-র! খবর-দা-র!” ইত্যাদি ধ্বনি দিয়ে যাচ্ছিল।

চাঁদ ডোবার মুহুর্তে মুহাম্মদ বিন কাসিম বাছাই করা কিছু দুঃসাহসী সৈনিকসহ দুর্গ প্রাচীরের উপর আরোহণ করেন এবং বিশেষ কোন প্রতিরোধ ছাড়াই দুর্গের দরজা খুলে দেন। খোলা দরজা পেয়ে অবশিষ্ট সৈনিকও দুর্গাভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে এবং মুহাম্মদ বিন কাসিম সহজেই দুর্গের নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন।

চারিদিকে ভোরের আলো ফুটে উঠছিল, এমনি সময় মুহাম্মদ বিন কাসিম তিনজন দুঃসাহসী সৈনিকের মাধ্যমে মুহাম্মদ বিন হারূনকে ফিরে আসবার জন্য নির্দেশ পাঠান। সেখানে তখন ভীষণ লড়াই চলছিল এবং হিন্দী ফৌজ অত্যন্ত বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করছিল।

ইতিমধ্যে দুর্গ থেকে পালিয়ে গিয়ে কিছু হিন্দী সৈন্য তাদের সেনাপতির নিকট দুর্গ বিজিত হবার দুঃসংবাদ প্রদান করে। এখবর সেনাপতি ও হিন্দী সৈনিকদের কাছে বজ্রাঘাত তুল্য মনে হয়। তারা তাদের শেষ ভরসাটুকুও এতে খুইয়ে বসে। তবু সেনাপতি শেষ বারের মত সিদ্ধান্ত নেন, শত্রুর হাত থেকে দুর্গটি তাৎক্ষণিকভাবে ফিরিয়ে নিয়ে সম্ভ্রম রক্ষা করতে হবে। তিনি তার সমস্ত ফৌজকে দুর্গের দিকে ফিরে যাবার নির্দেশ দেন এবং স্বয়ং অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে দুর্গের দিকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে অগ্রসর হন যাতে তড়িৎ গতিতে দুর্গটি অবরোধ করা যায় এবং অবশিষ্ট আরব ফৌজ মুহাম্মদ বিন কাসিমের ফৌজের সাথে, যারা দুর্গ মধ্যে অবস্থান করবে, মিলিত হতে না পারে।

মুহাম্মদ বিন কাসিম দুর্গের উপর থেকে সব কিছু লক্ষ্য করছিলেন এবং সে অনুযায়ী উপস্থিত প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা তৈরী করছিলেন। তিনি ভারতীয় ফৌজের চলাচল ও গতিবিধি থেকে তাদের সেনাপতির অভিপ্রায় যখন বুঝতে পারলেন তখনই মুহাম্মদ বিন হারুনের মাধ্যমে হিন্দী ফৌজের উপর আঘাত হানবার পরিকল্পনা নেন। এ পরিকল্পনা তিনি প্রথম থেকেই নিজেদের মধ্যে আলোচনাক্রমে ঠিক করে রেখেছিলেন। ভাগ্যক্রমে ভারতীয় ফৌজ পুনরায় ভুল করে আরব ফৌজের জালে ধরা পড়বার জন্য ছুটে আসছিলে।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের পরিকল্পনা নিম্নোক্ত বিষয়ের উপর নির্ভরশীল ছিল:

  1. পলাতক হিন্দী সৈন্যরা তাদের সেনাপতিকে অবহিত করে থাকবে যে, দুর্গে বিজয়ী আরব ফৌজের সংখ্যা খুবই কম।
  2. ভারতীয় সিপাহ্‌সালারের মেযাজে ক্ষিপ্রতা থাকলেও তিনি তার ব্যক্তিগত মান-সম্ভ্রমের উপর অযথা গুরুত্ব আরোপ করবেন।
  3. হিন্দী ফৌজ বিক্ষিপ্ত থাকার দরুন ছোট ছোট দলে বিভক্ত থাকবে এবং তাদের সেনাপতি ধৈর্য্যহারা হবার কারণে তাদেরকে তাড়াহুড়ার ভেতরে ছোট ছোট দলে বিভক্ত অবস্থায়ই আক্রমণের নির্দেশ দেবেন।

এই প্রেক্ষিতে মুহাম্মদ বিন কাসিম ফয়সালা করলেন:

  1. তিনি হিন্দী ফৌজের মনোযোগ দুর্গ দখল করার দিকে ঘুরিয়ে দেবেন।
  2. মুহাম্মদ বিন হারুন তার ফৌজের বিরাট অংশকে তিনভাগে ভাগ করবেন। যেমন:

ক. একটি কোম্পানী রিজার্ভ ফৌজ হিসাবে হিন্দী ফৌজের সঙ্গে লড়াই করতে করতে দুর্গের দিকে পিছু হটবে। রসদবাহী তাদের সঙ্গে থাকবে, কিন্তু প্রতিটি মুজাহিদ এমনভাবে লড়ে যাবে যাতে দুশমন এ কোম্পানীর শক্তি সম্পর্কে সঠিকভাবে অবহিত হতে না পারে।

খ. বাকী ফৌজকে দু’ অংশে ভাগ করে দেওয়া হবে। উষ্ট্রারোহীদের সংক্ষিপ্ত পথে দ্রুততার সঙ্গে দুর্গের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে।

গ. অশ্বারোহী কোম্পানী উপত্যকা ও নালাগুলোর ভেতর দিয়ে পার হয়ে কেল্লার দক্ষিণ দিক থেকে এমন সময় হামলা করবে যখন দুশমন পুরোপুরি ময়দানে অবতরণ করেছে।

যে সময় আরব অশ্বারোহী বাহিনী শত্রুর উপর আক্রমণোদ্যত হবে তখন উষ্ট্রারোহী বাহিনীও অন্য দিক থেকে তাদের উপর অতর্কিতে হামলা করবে। এভাবে ভারতীয় ফৌজকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলা হবে।

অপর দিকে হিন্দু সেনাপতির প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা ছিল নিম্নরূপ:

ক. যখন মুসলিম ফৌজ (অর্থাৎ রসদবাহী রিজার্ভ ফৌজ) লাক চৌকীর (Luck Chouki) মুজাহিদ কেল্লার নিকট পৌঁছুবে তখন হিন্দী ফৌজ আরব ফৌজকে এভাবে ঘেরাও করে ফেলবে যে, তারা তাদেরকে পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে বাহ্যত দুর্গের দিকে অগ্রসর হতে দেবে। কেননা সে-স্থানে তিনি তার পদাতিক ফৌজ এবং তীরন্দায বাহিনীকে আরবী ফৌজের অপেক্ষায় গুপ্ত ঘাটিতে লুকিয়ে রেখেছিলেন।

খ. হিন্দী সেনাপতি কিছু হিন্দী অশ্বারোহী কোম্পানীকে দুর্গ অবরোধের জন্য রেখে বাকী কোম্পানীগুলোকে কয়েকটি প্লাটুনে ভাগ করে নেন যাতে তারা আরব ফৌজের উপর বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ করতে পারে।

হিন্দী ফৌজ এই তাড়াহুড়োর ভেতর নিজেদের সংবাদ আদান-প্রদানের দিকে মনোযোগ দেয়নি। উভয় ফৌজই নিজ নিজ সিপাহ্‌সালারের পরিকল্পনা মুতাবিক অগ্রসর হচ্ছিল। আরব সেনাপতি কৌশলের সঙ্গে স্বীয় অশ্বারোহী ও উষ্ট্রারোহী বাহিনীর বড় প্লাটুনগুলোকে গোপন রাস্তায় নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছিয়ে দেন। হিন্দী সিপাহ্‌সালার এদের এ সামরিক চাল ও গতিবিধি সম্পর্কে আদৌ জানতে পারেনি।

বেলা তিন প্রহর। যদিও হিন্দী ফৌজের অধিকাংশ অংশই গেরিলা হামলা বন্ধ করে দিয়েছিল, তথাপি মুসলিম ফৌজ (রিজার্ভ ও রসদবাহী) নকশার উপর নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে লড়তে লড়তে এবং পিছু হটতে হটতে বেলা দুর্গের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আরবী ফৌজ লাক চৌকীর ঘাঁটির নিকট পৌঁছলে গুপ্তচর তাদেরকে হিন্দী ফৌজের ওঁৎ পেতে থাকা অংশ সম্পর্কে অবহিত করে। ফলে আরবী ফৌজ হিন্দী বাহিনীর উপর ঝড়ের বেগে ঝাপিয়ে পড়ে। প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর মুসলিম ফৌজ সেসব পাহাড় দখল করে ফেলে এবং তাদের সিপাহসালারের নির্দেশের অপেক্ষা করতে থাকে।

মাগরিবের সময় ঘনিয়ে আসছিল। আরব ফৌজের বিভিন্ন সেনানায়ক তাদের সিপাহসালারের নির্দেশের অপেক্ষা করছিলেন। নির্দেশ পেতেই রিজার্ভ ফৌজ আস্তে আস্তে বেলা দুর্গের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। হিন্দী অশ্বারোহী বাহিনী আরব ফৌজের ধীর ও হাল্কা গতিকে তাদের ভীত ও সন্ত্রস্ত হবার কারণ বলে ধরে নিয়েছিল। অতএব হিন্দী অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী তাদের উপর তিন দিক থেকে হামলা করে বসে। যদিও রিজার্ভ ফৌজ খুবই দুর্বল ছিল, তবু তারা অত্যন্ত নির্ভীক ও বীরত্বের সঙ্গে লড়তে থাকে। প্রচণ্ডভাবে লড়াই চলছিল, এমনি মুহূর্তে হিন্দী ফৌজের উপর দক্ষিণ ও পূর্ব দিক থেকে আরব অশ্বারোহী বাহিনী ঝড়ের বেগে ঝাপিয়ে পড়ে। হিন্দী সেনাপতি স্বীয় অশ্বারোহী বাহিনীকে একত্র করে আরব অশ্বারোহী বাহিনীর উপর পাল্টা হামলা করেন। যুদ্ধ কয়েকদিক থেকে জোরেশোরে চলছিল, হিন্দী ফৌজ খুব সাহসিকতা ও বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করছিল, এমন সময় মুহাম্মদ বিন কাসিম অতর্কিতে উষ্ট্রারোহী বাহিনী নিয়ে হিন্দী ফৌজের উপর হামলা করে বসেন। নতুন এ হামলা ছিল অত্যন্ত জোরালো ও মারাত্মক। ফলে হিন্দী ফৌজের সিপাহ্‌সালার আহত হন এবং তার বাহিনীর পদস্খলন ঘটে। আরব ফৌজ অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে হিন্দী ফৌজের পশ্চাদ্ধাবন করে এবং ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়। হিন্দী ফৌজের শোচনীয় পরাজয়ের পর মুহাম্মদ বিন কাসিম আহত হিন্দী সৈন্যদেরকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উঠিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। তাদের মধ্যে তাদের সেনাপতিও ছিলেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিম হিন্দু ফৌজের আহত সৈনিকদের সেবা-শুশ্রুসার যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং সমস্ত যুদ্ধ বন্দীদেরকে অস্ত্রমুক্ত করবার পর মুক্তি দেন। সে সঙ্গে আহত সৈনিকদেরকেও নিরাময় ও সুস্থ হবার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি দেন। এদের মধ্যে হিন্দী সেনাপতিও ছিলেন। সেনাপতিকে মুহাম্মদ বিন কাসিম বিশেষ সম্মান ও নিরাপত্তার সঙ্গে স্বীয় ফৌজ থেকে দূরে সরিরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে আসেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের মনুষ্যত্ব এবং আহত দুশমনের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন হিন্দী সৈনিকদের মনে গভীর রেখাপাত করে। আরব ফৌজের মধ্যে বিরাজিত সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব দৃষ্টে তারা যারপর-নাই মুগ্ধ হয়। তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন তো সন্তুষ্ট চিত্তে মুসলমানই হয়ে যায়।

দেবলের উপর হামলা

মুহাম্মদ বিন কাসিম বেলা দুর্গে কয়েক সপ্তাহ অবস্থান করার পর এমন সময় দেবলের দিকে অগ্রসর হন যখন তাঁর ভারী অস্ত্রশস্ত্র সূময়ানীতে সামুদ্রিক নৌ-বহরের সাহায্যে পৌঁছুতে যাচ্ছিল। এসব সাজ-সরঞ্জাম পৌঁছে গেলে তিনি একটি মহরত ও শক্তিশালী কোম্পানীর রক্ষণাধীনে ভারী সরঞ্জামগুলো নিজের কাছে আনিয়ে নেন। দেবল শহরের পাশে খুবই মযবুত প্রাচীর ছিল। এর চতুর্দিকের খালে পানি ভরতি ছিল। এ শহরে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের একটি বিখ্যাত মন্দিরও ছিল। মন্দিরের গুম্বজ উচ্চতায় ছিল চল্লিশ ফুটেরও বেশী। গুম্বুজের উপরে একটি লাল ঝাণ্ডা সর্বদা পতপত করে উড়ত। সাধারণ মানুষ এবং মন্দিরের পূজারীদের সাধারণ বিশ্বাস ছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত এ পতাকা সগৌরবে উড্ডীন থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ শহর কেউ জয় করতে পারবে না।

শহরের ভেতর বেশুমার রসদ-সামগ্রী মওজুদ ছিল। অতএব অবরুদ্ধ নগরবাসীদের কয়েক মাস পর্যন্ত ভেতরে বসে কাটিয়ে দেবার মত ব্যবস্থা ছিল। অপরদিকে অবরোধকারীরা বিরাট অসুবিধার সম্মুখীন হয়। কেননা শহর কিংবা পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে রসদ সংগ্রহের কোন ব্যবস্থা ছিল না।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের গুপ্তচরেরা তাঁকে অবহিত করেছিল যে, দেবলের বেশীর ভাগ অধিবাসী বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। এসব লোক ব্যবসায়ী এবং খুবই ধার্মিক তবে ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধধর্মের ভিক্ষু ও পুরোহিতদের মাঝে বেশ শত্রুতা রয়েছে।

মুহাম্মদ বিন কাসিম সুময়ানী বন্দর থেকে নিজেদের ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র নিয়ে ৯২ হিজরীর জুম’আর দিন দেবলের সামনে গিয়ে পৌঁছেন এবং চতুর্দিক থেকে এমনভাবে অবরোধ সৃষ্টি করেন যাতে দেবলবাসীদের কাছে কোন প্রকার সাহায্য কিংবা রসদসামগ্রী পৌঁছুতে না পারে। কয়েক সপ্তাহ অতিবাহিত হবার পরও দেবলবাসীরা বাইরে বেরিয়ে আরব ফৌজের মুকাবিলা করার প্রতি কোন উৎসাহ প্রকাশ করেনি। অবশ্য যখন কোন আরব সৈনিক দুবাবার আড়ালে শহর প্রাচীরের নিকটে পৌঁছুতে চেষ্টা করত অমনি হিন্দী ফৌজ রেড়ীর তৈলসিক্ত জ্বলন্ত মশাল নিক্ষেপ করে তাদের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিত। আরব মিনজানীক “উরূস”-এর সাহায্য বড় বড় পাথর বৃষ্টিধারার মত বর্তানো হয়, কিন্তু অবরুদ্ধ শহরবাসীদের উপর বাহ্যত এর কোন প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়নি।

শেষ পর্যন্ত মুহাম্মদ বিন কাসিম গোলন্দাজ ইউনিটের অধ্যক্ষ জওয়াহিবাহ্‌কে মূর্তির মন্দিরের গুম্বজ লক্ষ্য করে গোলা নিক্ষেপ করবার নির্দেশ দেন যাতে মন্দিরের উপর উড্ডীয়মান পতাকা ভূপাতিত করা যায়। নিক্ষেপের সময় যখন মুহাম্মদ বিন কাসিম দেখলেন যে, গোলা গুম্বুজের উপর দিয়ে যাচ্ছে তখন তিনি উরূস-এর সম্মুখবর্তী পায়া এমনভাবে কেটে দেওয়ার জন্য জওয়াহিবাহ্‌কে নির্দেশ দেন যাতে করে গোলার ট্রিজেক্টরী (Trejectory) কিছু নীচু এবং সোজা হয়ে যায়। এমনটি করায় দ্বিতীয় গোলা ঠিকমত নিশানায় গিয়ে লাগে এবং লাল ঝাণ্ডা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

হিন্দুরা এটাকে তাদের জন্য একটা কুলক্ষণ হিসাবে ধরে নেয় এবং দুর্গের বাইরে বেরিয়ে মরবার এবং মারবার সিদ্ধান্ত নেয়। হিন্দী ফৌজ তলোয়ারের শপথ নিয়ে দুর্গের বাইরে বের হলে মুহাম্মদ বিন কাসিম স্বীয় অধিনায়কদের দৃঢ়তার সাথে পিছু হটবার নির্দেশ দেন। হিন্দুরা তাদের আকীদামাফিক এটাকেই তাদের জয় মনে করে আবেগ-উৎসাহে আরব ফৌজের পশ্চাদ্ধাবন করতে থাকে। মুহাম্মদ বিন কাসিম যেই বুঝতে পারলেন যে, এরা তাদের দুর্গ থেকে বেশ খানিকটা দূরে সরে এসেছে ঠিক তখনি স্বীয় অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে হিন্দী ফৌজের উপর পেছন দিক থেকে আক্রমণ করে বসেন। এতে বহু হিন্দী সৈনিক মৃত্যুমুখে পতিত হয়। শেষ পর্যন্ত হিন্দী ফৌজ অস্ত্র সমর্পণ করে এবং সন্ধির আবেদন জানায়। এখানেও মুহাম্মদ বিন কাসিম একজন যোগ্য মুসলিম সেনাধ্যক্ষের কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করে শত্রুর প্রতি দয়া, মনুষ্যত্ব, সহিষ্ণুতাও ঔদার্যমূলক আচরণ করেন।

দেবল বিজয় ও সন্ধি চুক্তি

হাবীব বিন মাসলামা আরব সিপাহ্‌সালারের পক্ষে নিম্নোক্ত চুক্তিপত্রটি লিখেন : “হাবীব বিন মাসলামা খলীফাতু’ল-মুসলিমীন-এর পক্ষ থেকে দেবল অধিবাসী সর্বসাধারণকে, চাই তারা খ্রীস্টান হোক, অগ্নি উপাসক, কিংবা য়াহুদী, উপস্থিত কিংবা অনুপস্থিত, তাদের জানমাল, আত্বীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, উপাসনালয় এবং শহরের নিরাপত্তা প্রদান করছেন। তোমরা এই নিরাপত্তার আওতায় ততক্ষণ পর্যন্ত থাকতে পারবে যতক্ষণ পর্যন্ত এই প্রতিজ্ঞায় অটল থাকবে। তোমরা জিয্‌য়া ও খারাজ (রাজস্ব) যত দিন পর্যন্ত দিতে থাকবে, আমাদের উপর ততদিন পর্যন্ত এই প্রতিজ্ঞা পালন করাও বাধ্যতামূলক হবে।”

বেলা ছিল একটি ছোট পল্লী। কিন্তু দেবল ছিল রাজা দাহিরের খুবই বিখ্যাত শহর ও বন্দর। বৌদ্ধধর্মের পুরোহিত, আমীর-উমারা, তাদের যুবতী স্ত্রী—সকলেই মুসলিম ফৌজের উন্নত ও পবিত্ৰ চাল-চলন, ভদ্রতা ও সংবেদনশীলতাদৃষ্টে বিস্মিত হয়ে যায়। তাদের কল্পনায়ও আসে নি যে, তারা (বিজয়ী সৈনিকদের) লুটপাটের হাত থেকে বেঁচে যাবে। কেননা সে-যুগে বিজয়ী ফৌজ পরাজিত শহরগুলোতে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালাত এবং ধন-সম্পদ ও সতীত্ব-সম্ভ্রম লুণ্ঠন করত।

শহরটি তলোয়ারের জোরে বিজিত হয়েছিল। তাই শহরবাসীদের নিকট থেকে রাজস্ব গ্রহণ জরুরী ছিল। শহরের সাধারণ নাগরিকবৃন্দ, যাদের অধিকাংশই ছিল ধনী ব্যবসায়ী, দেখতে না দেখতেই বিরাট অঙ্কের অর্থ নযরানা হিসাবে পেশ করে। এর ভেতর থেকে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মুহাম্মদ বিন কাসিম ঋণ পরিশোধের জন্য প্রথম কিস্তী হিসাবে বায়তুল মালে পাঠিয়ে দেন। অবশিষ্টাংশ সেনাবাহিনীর মধ্যে বিতরণ করেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের নামে রাজা দাহিরের পত্র

আরব ফৌজের সদাচরণ এবং বীরত্বের কাহিনী দেখতে না দেখতেই চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। রাজা দাহির এতদ্‌শ্রবণে খুবই ক্রোধান্বিত হন এবং মুহাম্মদ বিন কাসিমকে নিম্নোক্ত পত্র লিখেন:

“এই পত্র দ্বারা আমি তোমাকে জানিয়ে দিতে চাই যে, দেবল শহর, যা জয় করতে তোমাকে খুবই কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে, আসলে একটি মামুলী বাণিজ্য শহর বৈ ছিল না যার নিরাপত্তা ও হেফাজতের জন্য আমরা সাধারণ প্রাচীর নির্মাণ করেছিলাম এবং সেখানকার বণিকদের হেফাজতের জন্য আমরা অল্পই রক্ষী-ফৌজ মোতায়েন রেখেছিলাম।

“আমাদের চোখে উক্ত শহরের তেমন কোন গুরুত্ব ছিল না। তাই তা রক্ষার জন্য কোন দুর্গ যেমন নির্মাণ করিনি, তেমনি সেখানে কোন শক্তিশালী সেনাবাহিনীও আমরা রাখিনি। অতএব বণিক ও কারিগরদের বস্তীসম একটি শহর জয় করার মধ্যে তোমাদের উল্লাসের কোন কারণ নেই। আমরা যদি তার হেফাজতের জন্য রাজার মত কোন বাহাদুর সেনাপতিকে পাঠাতাম তাহলে তোমরা আমাদের সাথে যুদ্ধ করার মজাটা টের পেতে! সে তোমাদের সব বাহাদুরী ধূলিস্মাৎ করে দিত। এ দুনিয়াতে কেউ বাহাদুর সেনাপতি রাজাকে মুকাবিলা করতে পারে না। বিজয় সব সময়ই তার পদচুম্বন করে। তার তলোয়ার যে কোন বীরপুরুষের পানির পিয়াস মিটিয়ে দিতে পারে। যখন তা খাপ থেকে বের হয় তখন চতুর্দিকে ধ্বংসলীলার তাণ্ডব সৃষ্টি করে এবং শত্রুকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছিয়ে দেয়।

“তা ছাড়াও আমাদের কাছে আরও আত্মোৎসর্গীত বীর রাজা বর্তমান আছেন। তাঁদের ভিতর কাশমূর রাজ্যের রাজা খুবই শক্তিমান—যার অমিততেজা ফৌজ এবং অপরিমেয় শক্তি ও প্রভাবের সামনে ভারতের বড় বড় শাসকরাও মাথা নুইয়ে দিয়েছে। তুরান এবং মাকরানের শাসকদ্বয়ও আনুগত্য স্বীকার করে নিজেদের সৈন্যসামন্ত সব কিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণে দিয়ে দিয়েছে।

“যখন এই বিজয়ী রাজা লোক-লশকর এবং একশত হাতীসহ স্বীয় শ্বেত হস্তীর পৃষ্ঠে আরোহণ করে যুদ্ধে বের হন তখন পদাতিক ও আরোহী সৈনিক পুরুষেরা তাঁর মুকাবিলায় টিকতে পারে না। আমি কিন্তু তোমার যৌবন ও বোকামির প্রতি দয়াপরবশ হয়ে এমন বাহাদুর সৈনিক পুরুষকে তোমার মুকাবিলায় পাঠাইনি। কেননা তুমি তাঁর সামনে অঘোরে প্রাণ দিতে। দুনিয়ার কোন ফৌজ আমাদের সাম্রাজ্যের কোন একটি কোণেও প্রবেশ করবার স্পর্ধা রাখে না। অতএব তোমাদের নিরাপত্তা এতেই নিহিত যে, তোমরা নিজেদের দেশে ফিরে যাও এবং আমাদের রোষাগ্নি থেকে নিজেদের রক্ষা কর।”

মুহাম্মদ বিন কাসিমের জওয়াব

মুহাম্মদ বিন কাসিম দাহিরের দীর্ঘ পত্রের জওয়াব মাত্র কয়েক শব্দের মধ্যে দেন: “এ ধরনের বাহাদুর পুরুষের সাহস ও শক্তি পরীক্ষার জন্য আমি যথা সত্বর রওয়ানা হচ্ছি।” এই পত্রের সাথেই তিনি তাঁর ফৌজকে নীরূনের দিকে অগ্রসর হবার হুকুম দেন।

নীরূন[১] বিনা প্রতিরোধেই মুহাম্মদ বিন কাসিমের হস্তগত হয়। প্রজাকুলের সন্তুষ্টি মুহাম্মদ বিন কাসিমকে স্বীয় প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার উপর আমল করার সাহস আরও বাড়িয়ে দেয়। অতএব নীরুনে কয়েকদিন অবস্থান করার পর তিনি সহ্‌ওয়ানের দিকে অগ্রসর হলে লাহরাজ নামক শহরের অধিবাসীবৃন্দ অত্যন্ত সন্তুষ্ট চিত্তে তার আনুগত্য স্বীকার করে।

অতঃপর এখানকার ঠাকুর, জাট ও মায়দ প্রমুখ শ্রেণী ও জাতিগোষ্ঠী মুহাম্মদ বিন কাসিমের সহযোগী হতে শুরু করে। এদের মধ্যে কতক এমনও ছিল যারা নিজেরাই স্বতস্ফূর্তভাবে ইসলাম কবুল করে। কতক নিজ নিজ ধর্মে থেকেও এই নওজোয়ান মহান আরব সেনাপতির আনুগত্য স্বীকার করে নেয়।

এসব হিন্দী সহযোগী রাজা দাহিরকে পরাজিত করবার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল।[২]

সহওয়ান অভিমুখে অগ্রাভিযান

সহ্‌ওয়ানের শাসনকর্তা ছিলেন রাজা বজ্র। সহ্ওয়ান শহরের আজ আর সে খ্যাতি নেই। এর আশেপাশের যমীন আজও অত্যন্ত উর্বর। এখানকার অধিবাসীবৃন্দ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিল। রাজাকে তারা পসন্দ করত না। রাজা বজ্র শহরের মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। না জানি শহরের অধিবাসীরাই তাঁকে হত্যা করে বসে—এই আশংকায় তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সাথী-সঙ্গীদের নিয়ে রাজা কাকার কাছে গিয়ে আশ্রয় নেন। রাজার বজ্রের পলায়নে প্রজাবৃন্দ দুর্গের দরজা উম্মুক্ত করে দেয় এবং মুহাম্মদ বিন কাসিমের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করে। এখান থেকে মুহাম্মদ বিন কাসিম চুনা, নায়ারকোট এবং খফদার হয়ে সীসেম অর্থাৎ সিবীর দিকে অগ্রসর হন।

সিবীর রাজা কাকা

রাজা কাকার পূর্বপুরুষ গঙ্গা অববাহিকা থেকে আগমন করেছিল। এরা ছিল সেই সব লোক যাদেরকে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী হবার কারণে সেখান থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এই রাজাও রাজা দাহিরের করদ মিত্র ছিলেন।

রাজা কাকার নিকট তাঁর সহধর্মীরা দেবল ও নীরুন প্রভৃতি স্থান থেকে এসেছিল এবং সকলেই তাকে আরবদের সঙ্গে সন্ধি করবার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু তিনি তাদের পরামর্শে কান দেবার প্রয়োজন মনে করেন নি। রাজা কাকা সীসেম থেকে বহির্গত হয়ে হিলয়ানের দিকে অগ্রসর হন এবং বজ্রকে বলেন যে, তিনি সিবী থেকে দূরে মুহাম্মদ বিন কাসিমের মুকাবিলা করে তাকে পরাজিত করতে চান। কতক ঐতিহাসিক এখানে হিলয়ানের স্থলে বাজানের নাম উল্লেখ করেছেন।

রাজা দাহির এক বিরাট বাহিনী বজ্রের সাহায্যে পাঠিয়ে দেন যেন তারা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে ডান দিক ও পশ্চাদ্দিক থেকে হামলা করে বজ্রকে জয়ী হতে সাহায্য করে। এ বাহিনীর আগমনে বন্ধান কিংবা (হিলয়ান) এলাকার লোকেরা রাজা কাকার নিকট আবেদন জানায় যেন তাদেরকে মুহাম্মদ বিন কাসিমের উপর হামলা করে তার ফৌজকে ধ্বংস ও বরবাদ করবার সুযোগ দেওয়া হয়। রাজা কাকা আনন্দের সঙ্গে তাদের আবেদনে সাড়া দেন। অতএব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, বজ্র শাহী ফৌজ নিয়ে সিবী চলে যাবেন এবং রাজা কাকা সেখানকার ছোট ছোট ঠাকুর ফৌজ একত্র করে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সঙ্গে লড়বেন।

হিয়ানের ঠাকুরগণ রাজা কাকাকে বলে যে, তারা মুহাম্মদ বিন কাসিমের উপর রাতের বেলা অতর্কিত আক্রমণ করবে এবং ভোরবেলা যখন মুহাম্মদ বিন কাসিম ক্লান্ত-শ্রান্ত ও বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকবেন তখন রাজা কাকা যেন তাঁর উপর স্বীয় ফৌজ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন। রাজা কাকা তাদের এই প্রস্তাব মেনে নেন। রাত্রিবেলা হিলয়ানের ঠাকুর মুহাম্মদ বিন কাসিমের ফৌজের উপর হামলা করবার জন্য বের হয়। কিন্তু ভোর হলে তারা এই দেখে বিস্মিত হয় যে, তারা আরব ফৌজের দিকে অগ্রসর হবার পরিবর্তে ভুল নালা দিয়ে সফর করার কারণে সিবীর নিকটে গিয়ে পৌঁছেছে।

রাজা কাকার গুপ্তচরেরা যখন তাকে এখবর দিল তখন তিনি ধারণা করলেন যে, এসব লোক তাকে ধোকা দিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমের হাতে তুলে দিতে চায়। তাহলে কি তারা নীরুন, দেবল প্রভৃতি স্থানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিলে গেছে?

কাকার মনে এধরনের নানাবিধ কল্পনার উদয় হওয়া একান্তই স্বাভাবিক ছিল এবং এজন্য তিনি ভীষণ পেরেশানও ছিলেন। কেননা তারা ব্রাহ্মণদের জোর-যবরদস্তী এবং রাজা দাহিরের কর্মপন্থাতে খুশী ছিল না। রাজা দাহির ছিলেন কঠোর প্রকৃতির শাসক এবং ভীষণ অহঙ্কারীও। তাঁর ধারণা সম্ভবত এই ছিল যে, আরব ফৌজ অন্যান্য বিজয়ী সেনাদলের মত জয়লাভের পর নিজেদের বাড়ী-ঘরে ফিরে যাবে।

রাজা কাকা সিবী থেকে এজন্যই চলে এসেছিলেন যেন বজ্র থেকে আলাদা হয়ে প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সঠিক অনুমান করে উপযোগী ফয়সালা করতে পারেন। এদিকে ঠাকুর ফৌজ আকস্মিকভাবে রাস্তা ভুলে যাওয়াকে অশুভ চিহ্ন হিসাবে ধরে নেয়। সিদ্ধান্ত হয় যে, মুহাম্মদ বিন কাসিমের সঙ্গে সন্ধি করে তারা তাঁর সাথে মিশে যাবে।

রাজা বজ্র নিজেই নিজেকে সিবীর দুর্গে বন্দী করে ফেলেছিলেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম উক্ত কেল্লা অবরোধ করেন। কয়েক দিন পরেই বজ্রের মনে ভয় দেখা দেয় যে, প্রজাকুল মনের দিক দিয়ে তার সঙ্গে নেই। অতএব তিনি বিশ সহস্র বাছাইকৃত রাজপুত অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে দুর্গ থেকে অত্যন্ত গোপনে বেরিয়ে পড়েন এবং মুহাম্মদ বিন কাসিমের উপর অতর্কিতে হামলা করে বসেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের ফৌজ চতুর্দিক দিয়ে দুর্গ অবরোধ করবার জন্য ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিল। সেজন্য এই বিরাট হিন্দী ফৌজের জোরদার ও তীব্র আক্রমণ আরব ফৌজের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিম ছিলেন নির্ভীক ও দূরদর্শী অধিনায়ক। তিনি তাঁর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা মুতাবিক বিক্ষিপ্ত ফৌজকে একত্রিত হবার নির্দেশ দেন এবং যথা-সম্ভব সত্বর সেনানায়কদের এ পরিকল্পনার উপর আমল করবার তাকীদ দেন। বস্তুত তিনি এক্ষেত্রে তাঁর অনুকরণযোগ্য খ্যাতনামা অধিনায়ক খালিদ (রা) বিন ওয়ালীদেরই হুবহু নকল করেন অর্থাৎ তিনি তাঁর বাহিনীর মধ্য ভাগকে পেছনে সম্মুখ ভাগের দিকে হটে যাবার এবং ডান ব্যুহ ও বাম ব্যুহকে দৃঢ়তার সঙ্গে লড়বার হুকুম দেন। অর্থাৎ তাঁর সেনাব্যুহ দ্বিতীয়ার চাঁদের রূপ ধারণ করে।

প্রচণ্ড হাতাহাতি লড়াই চলছিল। হিন্দী ফৌজের সংখ্যাধিক্যের কারণে আরবদের বেশ ক্ষতি হচ্ছিল। মুহাম্মদ বিন কাসিম এসব কিছুই লক্ষ্য করছিলেন। যখন তিনি দেখতে পেলেন যে, তাঁর সেনাবাহিনীর অবশিষ্ট বিক্ষিপ্ত অংশ সুশৃংখল হয়ে শত্রুর পশ্চাদ্দিকে অগ্রসর হচ্ছে তখন তিনি গোটা ফৌজকে একযোগে হামলা করবার নির্দেশ দেন।

হিন্দী ফৌজ তাদের পশ্চাদ্দেশে হামলা হতে দেখে ঘাবড়ে যায়। বজ্র তার নিজের ফৌজকে চতুর্দিক থেকে ঘেরাও হতে দেখে ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যান। এতে হিন্দী ফৌজ মনোবল হারিয়ে বসে এবং সকলেই পিছন ফিরে কুম্ভ নদীর দিকে পালাতে শুরু করে। এমতাবস্থায় খুব কম সংখ্যক সৈন্যই আরব ফৌজের হাত থেকে জীবন রক্ষা করতে সমৰ্থ হয়। বহু সৈন্য হতাহত এবং যথেষ্ট সংখ্যক বন্দী হয়। বিপুল পরিমাণ যুদ্ধলব্ধ সম্পদ মুহাম্মদ বিন কাসিমের হস্তগত হয়। মুহাম্মদ বিন কাসিম যুদ্ধলব্ধ (মালে গণীমত) মালামালের সঙ্গে অনেক গোলামও ইরাকে পাঠান। এসব গোলাম ছিল যুদ্ধবন্দী। এরপর মুহাম্মদ বিন কাসিম সালূজ এবং কান্দাবীল অর্থাৎ কান্দাহারের দিকে অগ্রসর হন। সেখানকার অধিবাসীরা সকলেই ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তারা সন্তুষ্ট চিত্তে মুহাম্মদ বিন কাসিমের আনুগত্য স্বীকার করে নেয়। এখানে মুহাম্মদ বিন কাসিমের কাছে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নির্দেশ আসে, ‘রাজা দাহিরের দিকে অগ্রসর হয়ে তাকে পরাজিত কর।’ কেননা তখন মুহাম্মদ বিন কাসিমের ফৌজের পশ্চাদ্দেশ (Rear) এবং বাম ব্যুহ (Left-Flank) শত্রুর হামলার হাত থেকে নিরাপদ ও সুরক্ষিত হয়ে গিয়েছিল এবং হামলারত আরব ফৌজ এবং ইরাকের মাঝখানে আর কোন দুশমন তখন অবশিষ্ট ছিল না।

মুহাম্মদ বিন কাসিম নীরূন ফিরে আসেন, যাতে করে তিনি সিন্ধুনদ (বর্তমান ঠাঠের নিকটে) পার হতে পারেন। এখানে এসে তিনি দেবল ফৌজকে বিশ্রাম গ্রহণ কিংবা আহতদের সেবা-শুশ্রুষা করারও সুযোগ দেন নি। তিনি ছোট ছোট প্লাটুন নদের পশ্চিম কিনারে কয়েক দিকে পাঠান, যাতে করে ছোট ছোট রাজন্যবর্গকে পদানত করা যায়। এক্ষেত্রে আশহিয়ার, সূরনা বেটের রাজা মূকা প্রমুখের নাম করা যায়। মুহাম্মদ বিন কাসিম অনুভব করেন যে, তাদেরকে পদানত করা অগ্রাভিযানের পূর্বেই জরুরী। যা-হোক ঐসব রাজা আরবদের আনুগত্য স্বীকার করে নেয়। অবশ্য ভুট্টোর রাজা রাসেল বিরোধিতা অব্যাহত রাখেন এবং রাজা দাহিরের নিকট সাহায্যের আবেদন জানান।

বজ্র রাজা দাহিরের নিকট পৌঁছে গিয়েছিলেন। তিনি বিরাট একটি বাহিনীকে তাঁর পুত্র জয়সিংহের অধীনে গোথ নদীর (এটি সিন্ধু নদীর একটি শাখা) তীরে ঘেঁষে বেট দুর্গের দিকে পাঠান এবং নিজে এক বিরাট বাহিনী নিয়ে সিন্ধুনদের কিনার দিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হন। তিনি মুসলিম ফৌজের মুখোমুখি ছাউনী ফেলেন এবং বিভিন্ন স্থানে চৌকী কায়েম করেন যাতে করে আরব ফৌজ সিন্ধু নদের তীরে অবতরণ করতে না পারে।

মুহাম্মদ বিন কাসিম দূত মারফত একটি চিঠি রাজা দহিরাকে লিখে পাঠান। তাতে নিম্নরূপ পয়গাম ছিল :

১. সমস্ত আরব কয়েদীকে সম্মানের সাথে মুক্তি দাও।

২. রক্তপণ ও ক্ষতিপূরণ আদায় কর।

৩. তোমাকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দিচ্ছি। তা কবুল কর, অন্যথায় জিযয়া এবং রাজস্ব দিতে সম্মত হও।

৪. অস্বীকৃতির ক্ষেত্রে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।

এ পত্রের উত্তর রাজা দাহির কড়া ভাষায় দেন এবং মুহাম্মদ বিন কাসিমকে দূতের মাধ্যমে কুকুরের ন্যায় মরণ বরণের পয়গাম পাঠান।

রাজা দাহির স্বীয় বাহিনী এবং রাজা জয়সিংহের বাহিনী পাঠিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি বিরাট বাহিনী সিন্ধুনদের তীরে এ উদ্দেশ্যে পাঠান যেন তারা সূস্তান ও তুরানে ত্রাসের সৃষ্টি করে। সিপাহ্‌সালার নিযুক্ত করা হয় রাজা গোপীকে। আমরা প্রথমেই লিখেছি যে, এ-দু’জন রাজা দাহিরের পক্ষ থেকে বুদ্ধিয়ার গভর্নর ছিলেন। তারা সিন্ধুনদের তীরবর্তী বাগরূরের নিকট অবস্থান নেন। এসব বাহিনীর অগ্রাভিযান নিম্নরূপ অবস্থার সৃষ্টি করে:

১. বেট-এর রাজা জাহীন এবং রাজা রাসেলের সাহায্যের জন্য বহু লোক একত্রিত হয়। অনন্তর রাজা রাসেল রাজা মুকার উপর হামলা করবার জন্য অগ্রাভিযান পরিচালনা করেন।

২. বহুলোক বুদ্ধিয়া এলাকায় রাজা রামচন্দ্রের শুভাকাঙ্ক্ষীতে পরিণত হয় এবং বাগরূর নিকট জমা হয়ে তার ফৌজে যোগদান করে।

৩. কিন্তু অনেক ঠাকুর এমনও ছিল, যারা অন্তর দিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমকে চাইত। তাই তারা মুহাম্মদ বিন কাসিমের সঙ্গে এসে মিলিত হয়।

রাজা দাহিরের এই প্রতিরক্ষা চালের মুকাবিলায় মুহাম্মদ বিন কাসিম খুবই দ্রুতগতিতে পাল্টা চাল দেন। তিনি প্রথমেই জাট, মায়দ এবং ঠাকুর ফৌজকে সুসংগঠিত করে তাদেরকে সত্বর আপন ছাঁচে ঢেলে নেন। তিনি এ বাহিনীর সেনানায়কদের সঙ্গে উপদেষ্টা হিসাবে আরব অধিনায়ক নিয়োগ করেন, যাতে করে তারা সর্বাধিনায়কের মুখপাত্র হিসাবে সঠিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন।

নিজের কিছু ফৌজকে নীরুনে ছেড়ে মুহাম্মদ বিন কাসিম বিদ্যুদ্গতিতে রাজা রামচন্দ্রের দিকে অগ্রসর হন। রাজা দাহির যে সব সমরাস্ত্র ও রসদ-সম্ভার রাজা রামচন্দ্রের সাহায্যে পাঠিয়েছিলেন, আকস্মিকভাবে তা মুহাম্মদ বিন কাসিমের হস্তগত হয়, যদিও এটা ছিল একান্তই অপ্রত্যাশিত। মুহাম্মদ বিন কাসিম এর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ নীরূনে পাঠিয়ে দেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিম এভাবে স্বীয় বাহিনীকে বিন্যস্ত করেন। কিছু অশ্বারোহী কোম্পানী এবং কিছু উষ্ট্রারোহী প্লাটুনকে তিনি বিভিন্ন দিকে পাঠিয়ে দেন, যাতে তারা সেসব লোককে— যারা রাজা রামচন্দ্রের সাহায্যের জন্য একত্রিত হচ্ছে, মেরে তাড়িয়ে দেয়। অবশিষ্ট ফৌজ নিয়ে তিনি নিজে রামচন্দ্রের দিকে অগ্রসর হন।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের এই প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা যদিও সঠিক ছিল, কিন্তু একেবারে বিপদমুক্ত ছিল না। তথাপি ফল তা-ই হ’ল, যা মুহাম্মদ বিন কাসিম পূর্বাহ্নেই অনুমান করে রেখেছিলেন। অর্থাৎ রাজা রামচন্দ্র প্রথমে স্বীয় ফৌজকে গুছিয়ে নিয়ে সিন্ধু নদের তীর বেয়ে অগ্রসর হন, কিন্তু যখন তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিমের অগ্রসর হবার খবর শুনলেন এবং ছড়িয়ে পড়া গুজবের কারণে আরব ফৌজের সংখ্যা অনেক বেশী বলে জানতে পারলেন—তখন তার নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মে যে, তার ফৌজ নিশ্চিতভাবেই আরব ফৌজের ঘেরাও-এর মধ্যে পড়ে যাবে। অগত্যা তিনি দ্রুতগতিতে সিন্ধুনদের অপর পারে চলে যান এবং পাড়ে উঠে সমস্ত নৌকা জ্বালিয়ে দেন, যাতে মুহাম্মদ বিন কাসিম তার পশ্চাদ্ধাবন করতে না পারেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিম এই সংবাদ জানতে পেয়ে একটি মামুলী কোম্পানী একজন সেনানায়কের তত্ত্বাবধানে রেখে রাত্রিবেলা অত্যন্ত সঙ্গোপনে বেটের দিকে অগ্রসর হন। সাথে সাথে এই কোম্পানীর অধিনায়ককে নির্দেশ দিয়ে যান, ‘যেসব সিন্ধী আনুগত্য কবুল করবে তাদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেবে।’

মুহাম্মদ বিন কাসিম রাজা জয়সিংহের মুকাবিলার জন্য এত দ্রুততার সঙ্গে অগ্রসর হন যে, তিনি (জয়সিংহ) হতভম্ব হয়ে পড়েন। কেননা জয়সিংহের গুপ্তচরেরা তাকে আগেই এই সংবাদ দিয়েছিল যে, মুহাম্মদ বিন কাসিম রাজা রামচন্দ্রের মুকাবিলায় ব্যস্ত রয়েছেন। সেজন্য তিনি এবং রাজা রাসেল তাদের সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে বেট জয় করার ফন্দি আঁটছিলেন। কিন্তু যখন মুহাম্মদ বিন কাসিম তার বিরুদ্ধে অগ্রসর হলেন এবং অপরদিকে রাজা মুকাও অগ্রাভিযান করলেন, তখন রাজা জয়সিংহ ঘাবড়ে গিয়ে পিছু হটে যান এবং রাজা দাহিরের ফৌজের সঙ্গে গিয়ে মিলিত হন। ঐ সময় মুহাম্মদ বিন কাসিমের ফৌজের মধ্যে মহামারী দেখা দেয়। বহু ঘোড়া ও উট এতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। সৈন্যরাও জ্বর ও বাতে আক্রান্ত হয়। এই মহামারী মুহাম্মদ বিন কাসিমকে খুবই বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করে। অগত্যা তিনি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নিকট জরুরী সাহায্য ও ঔষধ চেয়ে পাঠান।

হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তাৎক্ষণিকভাবে দু’হাজার অশ্বারোহী সৈনিক এবং বেশ কিছু উট ও ঘোড়া পাঠিয়ে দেন। তিনি এক প্রকার সিরকা রুটিতে ভিজিয়ে সে রুটি রোদে শুকিয়ে নেন। এই রুটি পুনরায় পানিতে ভিজালে সিরকায় পরিণত হ’ত এবং এই সিরকা জ্বর ও বসন্ত রোগের প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করত। হাজ্জাজ এই রুটি বহুল পরিমাণে মুহাম্মদ বিন কাসিমের নিকট পাঠিয়ে দেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিম নিজেও নিশ্চেষ্ট ছিলেন না। তিনি সেখানকার বাসিন্দাদের বিরাট সংখ্যায় আরব ফৌজে ভর্তি করে নিয়েছিলেন। এসব লোক ভর্তি হবার মুহূর্তে তাদের ঘোড়া, তলোয়ার, ভালা প্রভৃতি নিজেদের সঙ্গে নিয়ে আসত। তারা যুদ্ধে তাদের অবদানের বিনিময়ে বেতন এবং যুদ্ধলব্ধ সম্পদ থেকে অংশ পেত। অতি অল্প দিনেই এই জাতীয় ফৌজের সংখ্যা বেড়ে কয়েক হাজারে গিয়ে পৌঁছে। মুহাম্মদ বিন কাসিম একদিকে অটুট মনোবল ও দূরদর্শিতার সঙ্গে শত্রুর মুকাবিলায় অগ্রসর হচ্ছিলেন। অন্যদিকে রাজা দাহির মহামারী সম্পর্কে অবগত হয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমকে বলে পাঠান, “এখনো সময় আছে; ফিরে যাওয়া তোমাদের জন্য কল্যাণকর। কথা দিচ্ছি, আমি তোমাদের পশ্চাদ্ধাবন করব না।”

সিন্ধুনদের ছাউনী এবং ফৌজের মুকাবিলা

মুহাম্মদ বিন কাসিম জবাবে বলেন, “খুব সত্বর আমি তোমার সঙ্গে মিলিত হবার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটে আসছি।”

রাজা তারবার্তা পাঠিয়ে স্বয়ং শিকার ও আনন্দভ্রমণে মত্ত হয়ে যান এবং রাজা রাসেল ও জয়সিংহকে একটি বাহিনী দিয়ে শত্রুর মুকাবিলায় প্রেরণ করেন। তাদের উপর নির্দেশ ছিল যে, তারা তাদের বাহিনী নিয়ে সিন্ধুনদের তীর ধরে সতর্কতার সঙ্গে টহল দিয়ে বেড়াবে, যেন আরব ফৌজ সিন্ধু পার হতে না পারে।

শত্রু ছাউনীর নিকট দিয়ে সিন্ধুনদ পার হবার জন্য মুহাম্মদ বিন কাসিম কয়েকবার ছোট ছোট প্লাটুন পাঠান। কিন্তু প্রত্যেকবারই হিন্দী ফৌজ আরব ফৌজকে মেরে তাড়িয়ে দেয়। এতদসত্ত্বেও মুহাম্মদ বিন কাসিম উপর্যুপরি প্লাটুনের পর প্লাটুন পাঠাতে থাকেন এবং বারবার ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও তার মনোবল এতটুকু ভেঙে পড়েনি।

রাজা কাকা এবং রাজা মুকার পরামর্শে এবার তিনি বহু আরব সৈন্য নিঃশব্দ গতিতে সাক্লা (মীরপুর সারা) এবং এর অগ্রবর্তী এলাকাতে স্থানান্তরিত করেন। জয়সিংহের সঙ্গী এ ধারণায় কাল ক্ষেপণ করেন যে, মুহাম্মদ বিন কাসিম নীরূনেই অবস্থান করছেন। প্রকৃতপক্ষে জাট এবং ঠাকুরদের সংখ্যা প্রতিদিনই এমনভাবে বেড়ে চলছিল যে, রাজা দাহিরের গুপ্তচরেরা মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা শক্তির হ্রাস-বৃদ্ধির সঠিক পরিমাপ করতে পারে নি। মুহাম্মদ বিন কাসিমের সাক্লাগামী ফৌজ কেবলমাত্র রাত্রিকালেই সফর করত, যাতে করে কেউ তাদের চলাচল ও গতিবিধি টের না পায় এবং দিনের উত্তপ্ত রৌদ্রের সফরজনিত ক্লান্তি থেকেও তারা মাহফুজ থাকে।

মুহাম্মদ বিন কাসিম দু’টি প্রবেশপথ বেছে নেন। তন্মধ্যে একটি সাক্লার নিকট সিন্ধুনদের তীরে। অনুমান করা চলে যে, এ দু’টি প্রবেশপথকে আজকাল ‘আল্লাহ রাখখো’ এবং ‘মারহ’ প্রবেশপথ বলা হয়। এদু’টি সাকার পশ্চিমে এবং শাহবন্দের উত্তরে অবস্থিত।

এখানে মুহাম্মদ বিন কাসিম নতুন একটি ফর্মুলা উদ্ভাবন করেন। তিনি অনেকগুলো নৌকা সিন্ধুনদের পশ্চিম তীরে একত্রিত করে একটির সাথে অন্যটিকে শক্তভাবে বেঁধে দেন। অতঃপর একরাত্রে কয়েকজন সাঁতারুকে নদীর ওপারে পাঠিয়ে অগ্রভাগের নৌকা, যেটির সাথে মযবুত রশি বাঁধা ছিল—পূর্ব কিনারে জুড়ে দেন। আকস্মিকতাই বলুন বা যোগ্যতাই বলুন—সিন্ধুনদের উপর একটি পুল তৈরী হয়ে যায় এবং তার উপর দিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিম ফৌজসহ বিদ্যুদ্গতিতে নদী পার হয়ে পূর্ব পাড়ে গিয়ে পৌঁছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে রাজা দাহিরের ফৌজ অভিমুখে অগ্রসর হন। রাজা দাহির তখন ফৌজের সাথে ছিলেন না। রাজা রামচন্দ্র যেই শত্রুর পার হবার কথা জানতে পারলেন অমনি রাজা রাসেলকে একটি বাহিনীসহ মুহাম্মদ বিন কাসিমের মুকাবিলায় পাঠিয়ে দেন এবং নিজে ফৌজের অবশিষ্টাংশ নিয়ে বাহমনাবাদের দিকে চলে যান।

রাজা দাহির সেখানে মুসলিম ফৌজের মুকাবিলায় অবতরণ না করে স্বীয় রাজধানীর দক্ষিণ দিকে একটি দুর্গে মুকাবিলা করার সিদ্ধান্তে নেন। কেননা উক্ত দুর্গের নিকটে পৌঁছতে হলে শত্রুকে একটি বিরাট দুলদুলে এলাকা অতিক্রম করতে হবে। এই দুলদুলে এলাকা হচ্ছে শাহদাদপুরের পার্শ্ববর্তী এলাকা, যাকে মুক্ষী ডাণ্ড স্কীমের অধীনে ১৯৪৫ সালে সরকার পরিষ্কার করে চাষ ও কর্ষণযোগ্য জমিতে রূপান্তরিত করেছেন এবং এখন সেখানে বেশ ভাল রকমের ফসলাদি উৎপন্ন হচ্ছে। এর মধ্যে সর্বোত্তম মানের কার্পাস তুলা এবং গম উল্লেখযোগ্য।

রাজা রাসেলের মুকাবিলায় মুহাম্মদ বিন কাসিম ‘আবদুল্লাহ বিন ‘আলী ছাকাফীকে পাঠিয়ে দেন এবং নিজে সমগ্র ফৌজ এবং ভারী সাজ-সরঞ্জাম একত্রিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। রাসেল এবং ‘আবদুল্লাহ্‌র মধ্যে মাহম নামক স্থানে প্রচণ্ড লড়াই সংঘটিত হয়, এতে রাসেল পরাজিত হন। তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিমের নিকট অস্ত্র সমর্পণ করেন এবং ভবিষ্যতে বিশ্বস্ত থাকবেন বলে শপথ করেন। শেষ পর্যন্ত মুকা, রাসেল এবং কাকা এই তিনজন রাজা মুহাম্মদ বিন কাসিমের অধীনে লড়াই করবার জন্য একত্রিত হলেন।

রাজা রাসেলের সাম্প্রতিককালের সকল অবস্থা জানা ছিল। তিনি মুহাম্মদ বিন কাসিমকে যথাসত্বর সম্মুখে অগ্রসর হবার পরামর্শ দেন, যাতে তাঁর ফৌজ দুলদুলে এলাকা অতিক্রম করে নিরাপদে জয়পুর (এটি রাওরের দক্ষিণে অবস্থিত ছিল) পৌঁছতে পারে। রাজা রাসেলের পথ প্রদর্শন এবং সুব্যবস্থাপনায় মুহাম্মদ বিন কাসিমের ফৌজ বিশেষ কোন বাধা ছাড়াই জয়পুরে গিয়ে পৌঁছে।

রাজা দাহির এ খবর শুনে মুকাবিলার জন্য দুর্গের বাহিরে খোলা ময়দানে বেরিয়ে আসেন। তাঁর ফৌজের সংখ্যা ছিল দেড় লক্ষেরও অধিক এবং তারা উন্নতমানের সমরাস্ত্রে সজ্জিত ছিল। জয়পুরের উত্তরে কুরিওয়াহ নদীর দক্ষিণ প্রান্তরে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের আরব ফৌজে প্রায় পাঁচ হাজার অশ্বারোহী এবং পাঁচ হাজার উষ্ট্রারোহী ছিল। সেই সাথে ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজারের মত ঠাকুর, মায়দ এবং জাট সৈনিক। এদের কাছে রাজা দাহিরের ফৌজের মত না ছিল উন্নতমানের সমরাস্ত্র—আর না ছিল হাতী। অবশ্য মুহাম্মদ বিন কাসিম হিন্দু আরোহী বাহিনীকে স্বীয় পরিকল্পনা মাফিক ঢেলে সাজিয়ে ছিলেন। আর তাঁর গোটা ফৌজ ছিল একদেহ, একপ্রাণ, সুশৃঙ্খল এবং সুসংগঠিত। নীচে যুদ্ধক্ষেত্রের একটি চিত্র পেশ করা যাচ্ছে। এর দ্বারা উভয় ফৌজ কিভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছিল, তা বুঝতে সুবিধা হবে (ছবি পরের পৃষ্ঠায়)।

রাজা দাহিরের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা ছিল স্বীয় ব্যক্তিগত নিরাপত্তার উপর নির্ভরশীল। মনে হয় যে জয়সিংহের অশ্বারোহী বাহিনীকেও তিনি তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং হেফাজতের জন্য নিযুক্ত করেছিলেন। আক্রমণের দায়িত্ব তিনি জাহীনের হাতে সোপর্দ করেছিলেন। জাহীন ছিলেন আত্মোৎসর্গী সাহসী একজন অফিসার। কিন্তু তার ফৌজ বিভিন্ন সর্দারের অধীনে ছিল বলে সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল ছিল না।

মুহাম্মদ বিন কাসিম ক্রদিসের সামরিক নীতির উপর স্বীয় ফৌজকে বিন্যস্ত করেছিলেন। হিন্দী অশ্বারোহী বাহিনীর আক্রমণকে ব্যর্থ করে দেবার জন্য তিনি স্বীয় ফৌজের সামনে খন্দক (পরিখা) খনন করে নিয়েছিলেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম যেহেতু তাঁর ফৌজের মনোবলের উপর পূর্ণ আস্থাশীল ছিলেন—সেজন্য তিনি নিজে আক্রমণের ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী হবার পরিবর্তে রাজা দাহিরের ফৌজের হামলার অপেক্ষা করতে থাকেন।

সর্দার জাহীন ঠাকুর অশ্বারোহী কোম্পানী দিয়ে হামলা করেন। কিন্তু তার সব হামলাই খন্দকের কারণে ব্যর্থ হয়ে যায়। খন্দকের আড়াল থেকে আরব তীরন্দাযগণ হিন্দী ফৌজের বিরাট ক্ষতিসাধন করে। ফলে হিন্দী ফৌজের মধ্যে কিছুটা হুড়াহুড়ি ও হৈ চৈ-এর সৃষ্টি হয়। ঠিক তখনি দক্ষিণ ও বাম বাহুর মুসলিম অশ্বারোহী বাহিনী তাদের উপর আক্রমণ করে বসে এবং খন্দকের কারণে তারা যারপরনাই অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে। অবস্থা দৃষ্টে রাজা দাহির তাঁর গোটা বাহিনীকে একযোগে হামলা করবার নির্দেশ দেন, যাতে করে তারা আরবদের হামলা প্রতিরোধ করবার পর বাকী আরব ফৌজকে দলে পিষে সম্মুখে অগ্রসর হতে পারে।

আরব ফৌজের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা মুতাবিক হিন্দী ফৌজের ভেতর যখন গোলমাল ও হৈ চৈ লক্ষ্য করা গেল ঠিক তখনই আবূ সাবির হামদানী এবং রাজা রাসেল লম্বা চক্কর কেটে হিন্দী ফৌজের পেছনে গিয়ে উপস্থিত হন এবং তাদের কেরোসিন তৈলে পূর্ণ জ্বলন্ত তীর নিক্ষেপকারী তীরন্দায বাহিনী তীর এবং তৈলের পিচকারীর সাহায্যে হস্তিযুথের উপর জ্বলন্ত মশাল নিক্ষেপ করতে থাকেন। আকস্মিকভাবেই একটি জ্বলন্ত তীর রাজা দাহিরের হাতীর শুড়ের রেশমী চাদরে গিয়ে গাঁথে এবং তাতে আগুন ধরে যায়। এই আগুনের কারণে হাতী ঘাবড়ে গিয়ে পালাতে থাকে। সাধারণ সৈনিকেরা মনে করল যে, রাজা দাহির তার নিজের জীবন বাঁচাতে কেটে পড়ছেন।

আবূ সাবিরের হামলার সঙ্গে সঙ্গেই মুহাম্মদ বিন যিয়াদ, রাজা মুকা এবং রাজা কাকার অশ্বারোহীবৃন্দ রাজা দাহিরের ফৌজের দক্ষিণ ও বাম ব্যুহের উপর হামলা করে বসে। এই হামলার সঙ্গে সঙ্গেই দক্ষিণ অগ্রবর্তী বাম বাহুর ফৌজও একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

রাজা দাহিরের মত্যু

রাজা দাহির মাহুতকে নির্দেশ দেন হাতীকে নদীর দিকে নিয়ে যাবার জন্যে। এখানে এসে হাতী পানির ভেতর শুয়ে পড়ে। রাজা দাহির সঙ্গে সঙ্গে হাতীর পিঠে থেকে নেমে পড়েন এবং ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হন। এমনি সময়ে রাজা দাহিরের পশ্চাদ্ধাবনরত একজন আরব অশ্বারোহী তাঁকে আক্রমণ করে এবং একই আঘাতে ধড় থেকে তাঁর মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। দাহিরের ফৌজ পরাজিত হয়। ৭১৩ খৃস্টাব্দের জুন মাসে ১০ই রমযান তারিখে এ ঘটনা ঘটে।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের এ যুদ্ধে এত সহজে জয়লাভ করবার অন্যতম কারণ ছিল এই যে, রাজা রাসেল রাজা দাহিরের সেনা সন্নিবেশ ও বিন্যস্তকরণের গূঢ় রহস্য সম্পর্কে তাঁকে পূর্বাহ্নেই অবহিত করেছিলেন। আরব ফৌজ তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও দুর্বলতা সম্পর্কে অবহিত ছিল। অবশ্য যুদ্ধে শত্রুর অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়াও খুবই জরুরী।

রাজা জয়সিংহ পিতার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তৎক্ষণাৎ আলোর গিয়ে দুর্গের দ্বার বন্ধ করে দেন। সেখানে রাজা দাহিরের স্ত্রী রাণী বাঈ,—যিনি রাজার আপন বোনও ছিলেন, পূর্ব থেকেই অবস্থান করছিলেন।

অগ্রাভিযান

মুহাম্মদ বিন কাসিম রাজা দাহিরের রাজধানীর দিকে অগ্রসর হতেই রাজা জয়সিংহ শহর রক্ষার ভার স্বীয় ভ্রাতা রাজা গোপীকে সোপর্দ করে নিজে বাহ্মনাবাদ গমন করেন। রাজা গোপীও জয়সিংহের যাবার পর বেশীক্ষণ শহরে অবস্থান করেন নি। তিনি দহলীলার দুর্গে গিয়ে দুর্গদ্বার বন্ধ করে দেন।

বাহ্মনাবাদের উপর হামলা।

মুহাম্মদ বিন কাসিম তৎক্ষণাৎ বাহ্মনাবাদের দিকে অভিযাত্ৰা শুরু করেন। পথিমধ্যে দহলীলা ও বাহরোরের দুর্গও জয় করে নেন। রাজা গোপী এখান থেকে কাথিওয়াড়ের দিকে পালিয়ে যান। বাহ্মনাবাদে বিশেষ কোন যুদ্ধ হয়নি।

স্কালিন্দার অভিমুখে অগ্রাভিযান

মুহাম্মদ বিন কাসিম অতঃপর বাবিয়া জয় করেন। এটি শতদ্রু নদীর তীরে অবস্থিত। এখানকার রাজা কস্ক মুহাম্মদ বিন কাসিমের খুবই বিশ্বস্ত সহযোগী প্রমাণিত হন। বাবিয়া থেকে মুহাম্মদ বিন কাসিম স্কালিন্দার দিকে অগ্রসর হন। এ শহরও তিনি খুব সহজেই জয় করেন।

মুলতানের দিকে অগ্রাভিযান এবং মুলতান বিজয়

স্কালিন্দা থেকে মুহাম্মদ বিন কাসিম মুলতানের দিকে অগ্রসর হন। পথিমধ্যে পড়ে সিক্কা দুর্গ, দুর্গাধিপতি ছিলেন রাজা বজ্রের দৌহিত্র। তিনি প্রথমে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে মুহাম্মদ বিন কাসিমের মুকাবিলা করেন। অতঃপর দুর্গমধ্যে অবরুদ্ধ হয়েও বীরত্বের সঙ্গে লড়ে যান। সতের দিনের ভীষণ যুদ্ধের পর শেষাবধি তিনি অস্ত্র সমর্পণ করেন। এই রাজা খুবই সাহসিকতা এবং কার্যকর বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে লড়াই চালালেও মুহাম্মদ বিন কাসিমের কয়েক গুণ ফৌজের মুকাবিলা করতে পারেন নি। তিনি পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করেন এবং আশেপাশের এলাকাকে এমনভাবে ধ্বংস ও বরবাদ করে দেন যে, মুহাম্মদ বিন কাসিম স্বীয় ফৌজের রসদ-সামগ্রীর জন্য ভীষণ অসুবিধার সম্মুখীন হন। হিন্দী ফৌজ বেশীর ভাগ ধন-সম্পদ মুলতান দুর্গে নিয়ে গিয়েছিল।

মুলতানের শাসনকর্তাও নিজেকে দুর্গমধ্যে অবরুদ্ধ করে ফেলেন। কয়েক সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও দুর্গ অবিজিতই থেকে যায়। এদিকে মুহাম্মদ বিন কাসিম রসদ-সম্ভারের ঘাটতির কারণে দারুণ অসুবিধায় পড়েন। দূর্গ-প্রাচীরে মিনজানীক নিক্ষেপ করা হয়। দুবাবা এবং কাব্‌শ ও ছোড়া হয়, কিন্তু দুর্গ-প্রাচীরের দৃঢ়তার মুখে সবকিছু হার মানে।

শেষাবধি রাজা কস্ক নিরাপত্তা প্রার্থনার জন্য আগত মন্দিরের পূজারীদের নিকট থেকে জেনে নেন—মুলতান শহরের প্রয়োজনীয় পানি কোথা থেকে আসে। যদি পানির সে নহর বন্ধ করে দেওয়া যায় তাহলে লোকে পানীয় জলের অভাবে বাধ্য হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে আনুগত্য স্বীকার করে নেবে। মুহাম্মদ বিন কাসিম শহরের পানি বন্ধ করে দেন এবং পরিণতিতে শহরের অধিবাসীরা আনুগত্য স্বীকার করে নেয়।

এখানে একটি মজার ঘটনা পাঠক সমীপে পেশ করা যেতে পারে। মুলতানের বিখ্যাত মন্দিরের যেসব পূজারী পানির নহরের সন্ধান দিয়েছিল তারা মুহাম্মদ বিন কাসিমের কাছে এই শর্তে নিরাপত্তা প্রার্থনা করেছিল যে, মুহাম্মদ বিন কাসিম তাদের মন্দির যদি স্পর্শ না করেন তাহলে তারা এমন একটি গুপ্তধনের সন্ধান দেবে, যার ভেতর মন্দিরে সঞ্চিত ধনরত্নের চেয়েও অনেক বেশী ধন-দৌলত রয়েছে। মুহাম্মদ বিন কাসিম তাদের এ শর্ত মঞ্জুর করেন। প্রকৃতই উক্ত গুপ্ত ধনভাণ্ডার থেকে এত বিপুল পরিমাণে ধন-সম্পদ উদ্ধার করা হয় যে, মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু অভিযানের জন্য খলীফার নিকট থেকে কর্জ স্বরূপ যে অর্থ গ্রহণ করেছিলেন, তার চাইতেও এটা ছিল কয়েক গুণ বেশী। মুহাম্মদ বিন কাসিম এসব ধন-সম্পদ হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নিকট পাঠিয়ে দিয়ে স্বীয় কর্জ মুনাফাসহ পরিশোধ করে দেন।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের রাওর প্রত্যাবর্তন

মুহাম্মদ বিন কাসিম এবার রাওরের দিকে প্রত্যাবর্তন করেন এবং একটি বাহিনী ঝিলাম নদীর তীরে অবস্থিত ব্রহ্মপুর শহরের দিকে পাঠান। এই বাহিনী কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই সাফল্য নিয়ে প্রত্যাবর্তন করে।

হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ওফাত এবং ভীলম্যানের উপর হামলা—অধিকন্তু খলীফা ওয়ালীদ বিন ‘আবদুল মালিকের ওফাত—নতুন খলীফা নির্বাচন এবং মুহাম্মদ বিন কাসিমের গ্রেফতারী

হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ৯৫ হিজরীতে ইনতিকাল করেন। ঐ বছরেই মুহাম্মদ বিন কাসিম গুজর ও ভীলদের বিরুদ্ধে ভীলম্যানের দিকে অভিযান প্রেরণ করেন। ভীলম্যান সিন্ধু সীমান্তের কাথিওয়াড় রাজ্য সংলগ্ন একটি রাজধানী, যার সিংহাসন ছিল কুযাজ (বর্তমান জয়পুর)। মুহাম্মদ বিন কাসিম এটা জয় করে প্রত্যাবর্তন করছিলেন—এমন সময় তিনি খলীফা ওয়ালীদ বিন ‘আবদুল মালিকের ইনতিকালের খবর পান। খলীফার ইনতিকাল হয়েছিল ৯৬ হিজরীর জুমাদিউছ-ছানী মাসে। তদস্থলে সুলায়মান বিন ‘আবদুল মালিক খলীফা নির্বাচিত হন। নতুন খলীফা য়াযীদ বিন মুহাল্লাবকে ইরাকের গভর্নর নিযুক্ত করেন এবং সেই সঙ্গে মুহাম্মদ বিন কাসিমকে গ্রেফতার করবার নির্দেশ দেন। সুলায়মান কুতায়বা বিন মুসলিমকেও হত্যা করেন।

মুসা বিন নুসায়র

সুলায়মানের ক্রোধ-বহ্নির হাত থেকে স্পেন বিজয়ী মুসা বিন নুসায়রও শেষরক্ষা পান নি। মুসার পুত্র ‘আবদুল আযীযকেও সুলায়মানের নির্দেশে হত্যা করা হয়। এভাবে অল্প দিনের মধ্যেই ইসলামী দুনিয়া কয়েকজন বিখ্যাত বীর ও বিজয়ী সেনানায়ক এবং যোগ্যতম প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ সেনাপতির খিদমত থেকে বঞ্চিত হয়।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের গ্রেফতারী

মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁর গ্রেফতারীর নির্দেশনামা অত্যন্ত ধৈর্য ও স্থৈর্যের সঙ্গে শোনেন এবং নিম্নোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করেন:

“লোকেরা আমাকে বিনষ্ট করে দিল। কোন্ যুবককে তারা বিনষ্ট করল? তাকেই, যে তাদের সংকট মুহূর্তে ও বিপদকালে কাজে এসেছিল এবং সীমান্তকে সুদৃঢ় ও অক্ষুণ্ণ রাখতে যে ছিল খুবই উপযোগী।”

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. বর্তমানে এ শহরের সঠিক অবস্থান জানা যায় না। আরব পর্যটকগণ একে মনসুরা (যার বুনিয়াদ রেখেছিলেন কয়েক বছর পর বিজয়ী মুহাম্মদ বিন কাসিমের পুত্র ওমর) এবং দেবলের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত বলে লিখেছেন। এই শহর সিন্ধু নদের পশ্চিম পাড়ে সহ্‌ওয়ানের নিকটে ছিল। মি. এম. পি. চাবিলানীর মতে, এটিই বর্তমান হায়দরাবাদ। আমরা এ মতের সঙ্গে একমত নই। বিশেষত এ জন্য যে, তারা এর দূরত্ব দেবল থেকে ২৫ ক্লোশ লিখেছেন। হায়দরাবাদ একদিকে সিন্ধু নদের পূর্ব কিনারে অবস্থিত এবং অন্যদিকে ১৪০ মাইলের মত সমুদ্র থেকে দূরে।

    অনুমানে বলা যায় যে, এ শহর বর্তমান জঙ্গশাহী এবং ঝুমপীর-এর দুলদুলের নিকটবর্তী ছিল। দূরত্ব ও দুলদুলে জমি, খারাপ ও তেতো পানি এবং খারাপ আবহাওয়ার দিক চিন্তা করলে এ স্থানটিই নীরূন হবে বলে মনে হয়। এটিই ছিল সেই শহর যেখানে প্রত্যাবর্তনকালে মুহাম্মদ বিন কাসিমের ফৌজ মশার কামড়ে ও বসন্ত রোগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়। এ এলাকায়, আজও বেশ পশু এ কারণে মারা যায়।

  2. এইসব সহযোগীই সেই সব হিন্দী অশ্বারোহী বাহিনীর পূর্বপুরুষ যাদের অস্তিত্ব বৃটিশ রাজত্বকাল অর্থাৎ ১৯৩২ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত ছিল। পরে এই বাহিনীকে ট্যাংক রেজিমেন্টে রূপান্তরিত করা হয়।