উমাইয়া খিলাফত আমলে ফৌজী সংগঠন

হযরত উমর (রা) ফৌজকে একটি আলাদা জামা’আতে সংগঠিত করতে শুরু করেন। এতদুদ্দেশ্যে আলাদা দফতর খোলা হয়। বনী উমাইয়া যুগে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের হাতে এর পূর্ণতা-প্রাপ্তি ঘটে। খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে সৈনিক বৃত্তি ‘জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ্’রই অন্তর্ভুক্ত ছিল।

উমাইয়াদের খিলাফত আমলে দু’ধরনের সৈনিক ছিল। যেমন,—

১. মুজাহিদ বা ফী সাবিলিল্লাহ জিহাদকারী। এধরনের মুজাহিদের সংখ্যা সাধারণত মোট সংখ্যার অর্ধেকের বেশী হ’ত। এরা আরবের অধিবাসী হ’ত এবং সাধারণত বনী কাহতান কিংবা য়ামানের আরব অথবা বনী আদনান (এরা মিসরের অধিবাসী) হিসাবে পরিচিত হ’ত।

২. বেতন-ভোগী অর্থাৎ জায়গীদার কর্তৃক নিযুক্ত বাহিনী। জায়গীরদাররা ছিলেন সেই সব মুসলমান যারা উমাইয়া খলীফাদের মদদগার ছিলেন। তারা তাদের খিদমতের বিনিময়ে বিভিন্ন ধরনের ইনাম পেতেন। জায়গীরদার তাদের বাহিনীর যাবতীয় ব্যয় নিজেরাই বহন করতেন। সাধারণত গোলাম ও দাসদের সমন্বয়ে তারা নিজেদের বাহিনী গড়ে তুলতেন।

ইসলামের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবার পর মুসলিম ফৌজের প্রথম পরাজয় এবং তার কারণ

আমীর মু’আবিয়া (রা) সুকৌশলে জিহাদী আবেগ-উদ্দীপনা বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকারীরা খুলাফায়ে রাশেদীনের সামরিক ব্যবস্থাপনার উপর—যা আঁ-হযরত (সা)-এর নির্দেশ ও হিদায়াত মুতাবিক ছিল, পূর্ণরূপে আমল করেনি। ফলে মুসলিম ফৌজ কনস্টানটিনোপল অবরোধকালে প্রথম পরাজয়ের সম্মুখীন হয়। পরাজয়ের কারণগুলোকে নিম্নরূপ চিহ্নিত করা যায় :

(ক) দুর্গ জয় করার জন্য পরিপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

(খ) ফৌজের মধ্যে আরামপ্রিয়তা ও সুখ-সুবিধার প্রতি অভিলাষ দেখা দিয়েছিল। ফলে তারা কঠোর পরিশ্রমে অনভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল।

(গ) জিহাদী প্রেরণা গোটা ফৌজে একইরূপ কার্যকর ছিল না। কেননা এতে কয়েকজন বেতন-ভোগী কর্মচারীও ছিল।

(ঘ) নিয়ম-শৃংখলার মধ্যে ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। সেনানায়ক ও মুজাহিদদের মধ্যে পূর্ণ সংহতি ছিল না।

এ ছাড়াও আরো কিছু কারণ থাকতে পারে।

আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের যুগে মুসলিম ফৌজে শুদ্ধিকরণ

আবদুল মালিক ইব্‌ন মারওয়ান যখন ক্ষমতাসীন হন তখন ফৌজী ব্যবস্থাপনার মান অনেক নীচে নেমে গেছে। আবদুল মালিক রূহ ইব্‌ন যানবাগ-এর নিকট এ বিষয়ে অভিযোগ করেন। ইনি পুলিশ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন। রূহ ইব্‌ন যানবাগ খলীফাকে বলেন : আমার দৃষ্টিতে এ কাজের উপযুক্ত একজন ব্যক্তিই আছেন এবং তিনি হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। হাজ্জাজ প্রথম জীবনে ছিলেন একজন শিক্ষক এবং এখন তিনি সৈন্য বিভাগের একজন কর্মচারী। খলীফা তাকে তাঁর দেহরক্ষী বাহিনীর অফিসার নিযুক্ত করেন। কেননা সাধারণত এমন হ’ত যে, খলীফা কোথাও যাত্রা শুরু করেছেন, অথচ তাঁর রক্ষী সৈনিকেরা নিজেদের ক্যাম্পে ঘুমিয়ে রয়েছে। মোটকথা, তারা কোনরূপ নির্দেশের পরওয়াই করত না।

হাজ্জাজ বিন ইউসুফ অফিসার নিযুক্ত হওয়ার পর একদিন দেখতে পেলেন যে, খলীফার সঙ্গী-সাথীরা যাত্রা শুরু করেছে বটে, কিন্তু সিপাহীরা তখনও তাদের খাবার খাচ্ছে। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এ বিলম্বের কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা অত্যন্ত অশিষ্ট ভাষায় এবং বেপরোয়া ভঙ্গীতে এর উত্তর দান করে। হাজ্জাজ তখন এদেরকে বেত মারার নির্দেশ দেন। তাদের তাঁবুগুলোতেও আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এসব তাঁবুর মধ্যে স্বয়ং রূহ ইবুন যানবাগের তাঁবুও ছিল। হাজ্জাজ রূহের ব্যক্তিগত চাকর-বাকরগুলোকেও বেত দিয়ে পিটান। তখন রূহ ইব্‌ন যানবাগ খলীফার নিকট এই মর্মে অভিযোগ করেন : যে লোক (হাজ্জাজ) কাল পর্যন্তও তার অধীনস্থ সামান্য কর্মচারী ছিল, আজ তার ধৃষ্টতা এতটা বেড়ে গেছে যে, সে আমার ব্যক্তিগত চাকর-বাকরগুলোকেই কেবল বেত দিয়ে পিটায় নি, বরং তাদের এবং আমার ব্যক্তিগত তাঁবুও জ্বালিয়ে দিয়েছে! রূহ্ ইব্‌ন যানবাগ আরও বলেন : আমীরুল মু’মিনীন! হাজ্জাজ বড় ধৃষ্ট হয়ে গেছে। তখন খলীফা হাজ্জাজকে হাযির হবার নির্দেশ দেন। হাজ্জাজ সম্মুখে আসতেই খলীফা রাগত স্বরে বলেন : তুমি এমন অশোভন আচরণ করলে কেন—বিশেষ করে তোমার নিজেরই গুরুজনের বিরুদ্ধে? হাজ্জাজ অত্যন্ত দৃঢ়তা ও গাম্ভীর্যের সাথে জবাব দেন : আমীরুল-মু’মিনীন! আমি তো কিছু করিনি। খলীফা বললেন, “তাহলে কে রূহ ইব্‌ন যানবাগের চাকর-বাকরগুলোকে বেত দিয়ে পিটিয়েছে এবং কে এর রক্ষীবাহিনীর তাঁবুগুলোতে আগুন লাগিয়েছে?”

উত্তরে হাজ্জাজ অত্যন্ত নির্ভীকভাবে বলেন, “খলীফার নির্দেশে তিনিই বেত লাগাবার নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাঁবুগুলো জ্বালিয়েছেন যাতে সংশ্লিষ্ট সকলেই বুঝতে পারে যে, এখন থেকে আলসেমি ও বেআদবী আর বরদাশত করা হবে না। এখন রইল সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির প্রশ্ন! তা আল্লাহ্‌র ফযলে আমীরুল-মু’মিনীন রূহ ইব্‌ন যানবাগকে একটি তাঁবুর বদলে কয়েকটি তাঁবু এবং একটি গোলামের পরিবর্তে কয়েকটি গোলাম দান করতে পারেন।”

খলীফা হাজ্জাজের এই উপস্থিত জওয়াবে খুবই প্রভাবাম্বিত হন। তিনি রূহ ইব্‌ন যানবাগকে ইন’আম দিয়ে সন্তুষ্ট করে দেন। ফলে ফৌজের উপর হাজ্জাজের অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়।

হাজ্জাজ যেখানে রক্তপাত ও নির্দয়তার জন্য কুখ্যাত ছিলেন, সেখানে তিনি যোগ্য এবং রুচিশীল ব্যক্তি হিসাবেও পরিচিত ছিলেন। বিখ্যাত আলিম ইয়াহ্ইয়াকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, “আমি লাহান অর্থাৎ যের যবর ও পেশের ক্ষেত্রে কোন ভুল করি না তো?” এই প্রশ্নের উত্তর উক্ত আলিম অত্যন্ত অলঙ্কারপূর্ণ ভাষায় প্রদান করেন। তিনি এও বলেন, “তুমি যেরের স্থলে পেশ এবং পেশের স্থলে যের পড়ে থাক।” এর অর্থ এও হতে পারত যে, তুমি জালিম এবং অবিচারক যে নীচাসনের পাত্র তাকে তুমি উচ্চাসন দাও আর যে উচ্চাসনের হকদার তাকে তুমি অপমানিত করে থাক।

হাজ্জাজের উদ্দেশ্য পূৰ্ণ হ’ল। তিনি ইয়াহ্ইয়া বিন যা’রকে খুরাসানের কাযী নিযুক্ত করেন।

যাই হোক, মুসলিম সেনাবাহিনী চিরদিন হাজ্জাজের নিকট কৃতজ্ঞ থাকবে। কেননা তিনি অধঃপতনের দিকে ধাবমান একটি জাতিকে পুনরায় বিজয়ী ও সফল জাতিতে রূপান্তরিত করেন।

ফৌজ ভর্তির প্রাথমিক অবস্থা ও তার পদ্ধতি

আজকাল প্রতিরক্ষা বিভাগের যে শাখাকে রিক্রটিং শাখা বলা হয়—তার বুনিয়াদ স্থাপন করেন হযরত উমর (রা)। প্রথম দিকে এই দফতরকে দীওয়ান বলা হ’ত। এর উদ্দেশ্য ছিল, সমস্ত মুসলমান অর্থাৎ মুহাজিরীন, আনসার ও তাবিঈনদের নাম ভাতার ক্রম ও পরিমাণ অনুসারে লিপিবদ্ধ করা। এই দফতর গঠিত হয় সেই ঘোষণার ফলে যা হযরত উমর (রা) মুজাহিদদের ব্যাপারে দিয়েছিলেন অর্থাৎ বিজিত রাষ্ট্রসমূহে অতিরিক্ত জায়গা-জমি খরিদ করবে না, কিংবা কৃষিকর্মে লিপ্ত হবে না, ইত্যাদি। এই দফতরের আওতায় সমস্ত মুজাহিদ এবং তাদের সন্তানাদিকে নির্ধারিত হারে ভাতা দেওয়া হতে থাকে।

ফৌজে ভর্তি হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের সম্পর্কে ব্যাপকভাবে খোঁজ-খবর নেওয়া হ’ত এবং সে অনুযায়ী বিভিন্ন তথ্য লিপিবদ্ধ করে রাখা হ’ত। যেমন :

(ক) দীওয়ানের অফিসার প্রথমে এটা দেখতেন যে, আবেদনকারী প্রার্থী হবার উপযুক্ত কিনা, অর্থাৎ সে স্বাধীন, প্রাপ্ত-বয়স্ক, সুস্থ, উদ্যোগী, সাহসী এবং মুসলমান কিনা।

(খ) প্রার্থীর বংশ-পরিচয়, হুলিয়া (দৈহিক বিবরণ), তার বিশেষ গুণাবলী ও পরিচয়-চিহ্ন খুবই সতর্কতার সঙ্গে লিপিবদ্ধ করা হ’ত যেন একই নামের বিভিন্ন ব্যক্তির পরিচিতিতে কোনরূপ বিভ্রান্তি দেখা দিতে না পারে।

(গ) ফৌজের বিন্যাস বংশ, জাতীয়তা এবং গোত্র থেকে শুরু হ’ত। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, আরববাসী দু’ ধরনের হ’ত। যেমন, ‘আদনান বংশীয় ও কাহতান বংশীয়। ‘আদনানী আরবদেরকে কাহতানী আরবদের অগ্রগণ্য মনে করা হ’ত। কেননা নুবুওত তাদের বংশেই এসেছিল। কুরায়শ বংশে বনু হাশিম ও বনু উমাইয়া ইত্যাদি ছিল, কিন্তু অগ্রাধিকার ছিল বনু হাশিমের।

(ঘ) যদি প্রার্থী অনারব হ’ত এবং কোন বংশের আওতায় না আসত তাহলে তাকে জাতীয়তার ভিত্তিতে তালিকাবদ্ধ করা হ’ত। যেমন, খুরাসানী, ফিরাউনী, পশ্চিমা তুর্কী, ভারতীয় ইত্যাদি।

বনু উমাইয়ার যুগে এই দফতর ফৌজি দফতরে পরিণত এর কয়েকটি শাখা ছিল। যেমন : (ক) যোগাযোগ (বার্তা আদান-প্রদান), (খ) বেতন, (গ) ভাতা ও পুরস্কার, (ঘ) ফৌজি ব্যয় নির্বাহ, (ঙ) সামরিক ব্যয় নির্বাহ ইত্যাদি। এই বিষয়টিও হাজ্জাজ বিন ইউসুফের হাতে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়।

মুসলিম ফৌজের বেতনভোগী হওয়া

খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগ পর্যন্ত ‘জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ’ থাকায় বিজয়ী মুজাহিদদের মধ্যে গনীমতের মাল (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) কন্টন করা হ’ত। কিন্তু হযরত আমীর মু’আবিয়া (রা) ফৌজকে খুশী করবার জন্য তাদের বেতন নির্ধারণ করেন এবং বেতনের অতিরিক্ত অনেক কিছু তাদেরকে প্রদান করেন। মু’আবিয়া (রা) ‘উলামাদেরকেও তাদের খিদমতের বিনিময় প্রদান করেন এবং তাদেরকে ফৌজে বনী উমাইয়ার নিয়ম মাফিক বেশ কয়েকটি পন্থায় ব্যবহার করেন। মু’আবিয়া (রা)-র স্থলাভিষিক্তগণ উপহার-উপটৌকন ও বিভিন্ন প্রকার দান-দক্ষিণার ক্ষেত্রে অনেক বাড়াবাড়ি করেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এসব কিছুকে নিয়মিত মাসিক ভাতায় রূপান্তরিত করেন। মুসলিম ফৌজের সংখ্যা গণনা

বুখারী শরীফে আছে, হযরত (সা) বলেছেন, “যে সমস্ত লোক ইসলামের কলেমা উচ্চারণ করেছে তাদের সংখ্যা লিপিবদ্ধ করা হোক।” অর্থাৎ প্রতিটি মুসলিম পুরুষ মুজাহিদ হিসাবে পরিগণিত হবে। তবুক যুদ্ধে মুসলিম মুজাহিদদের সংখ্যা ছিল তিরিশ হাযার। হযরত আবূ বকর (রা) ও হযরত উমর (রা)-এর যুগে এই সংখ্যা বেড়ে দেড় লক্ষে গিয়ে পৌঁছে।

বনু উমাইয়াদের যুগে কেবল বসরা ও কূফাতে মুসলিম পুরুষের সংখ্যা ছিল দু’লক্ষের কাছাকাছি। অনুরূপ সংখ্যক নারী এবং শিশুও নিশ্চয় ছিল। সিরিয়া, মিসর, পারস্য প্রভৃতি দেশের মুসলমানদের সংখ্যা এ থেকে অনায়াসেই অনুমান করা যায়।

আঁ-হযরত (সা)-এর যমানায় প্রতিটি গোত্রে এমন একজন লোক নিযুক্ত থাকতেন যিনি রোজ সকালে সমস্ত এলাকা ঘুরে নবজাত শিশু এবং মৃত ব্যক্তিদের নাম রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করতেন। অতঃপর এই হিসাব প্রাদেশিক রাজ্যসমূহের সদর মোকামে পাঠানো হ’ত এবং সেখান থেকে খলীফার সদর মোকামের রেজিস্টারে তা লিপিবদ্ধ করা হ’ত।

ফৌজি শ্রেণীক্ৰম : মর্যাদানুসারে

জাহেলিয়া যুগে প্রতিটি গোত্রের এক-একজন রঈস বা নেতা ছিলেন। গোত্রের রঈস স্বয়ং গোত্রের বাহিনী নিয়ে যেতে না পারলে অন্য কোন ব্যক্তি এবং সাধারণত নিজের কোন নিকটাত্মীয়কে আমীর নিযুক্ত করতেন। বাহিনীর এ-ধরনের সর্দারকে ‘মুনকাসিব’ বলা হ’ত। প্রত্যেক ‘মুনকাসিব’-এর অধীনে পাঁচজন ‘আরীফ’ থাকতেন। আর প্রত্যেক আরীফের অধীনে থাকত নির্দিষ্ট সংখ্যক সিপাহী।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে উল্লিখিত মূলনীতি অনুসারেই কাজ করা হয়েছে। অবশ্য প্রত্যেক আরীফের অধীনে প্রথম দিকে দশজন এবং পরবর্তী সময়ে সাতজন করে সৈন্য দেওয়া হ’ত। অবশ্য আরীফ-এর নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা ছিল না।

হযরত উমর (রা)-এর যুগে এখন একজন অফিসার নিয়োগ করা হয়, যিনি সিপাহীদের বেতন সভাপতির নিকট থেকে গ্রহণ করে তা আরীফদেরকে প্রদান করতেন এবং আরীফগণ নিজ নিজ সিপাহীদের মধ্যে তা বন্টন করে দিতেন। এই অফিসারকে বলা হ’ত ‘আমীর-ই-ইসবা’ যাকে আমাদের যুগে Military Accounts Officer বলা হয়।

বনী উমাইয়া ও বনী ‘আব্বাসের যুগে ফৌজী পদের রূপরেখা ছিল নিম্নরূপ :

সেনাধ্যক্ষ (আমীর) বা কমাণ্ডার ইন চীফ

প্রত্যেক সেনাধ্যক্ষের অধীনে দশজন সেনানায়ক

প্রত্যেক সেনানায়কের অধীনে দশজন নকীব

প্রত্যেক নকীবের অধীনে দশজন আরীফ

প্রত্যেক আরীফের অধীনে দশজন সৈনিক

পরিদর্শন (Inspection)

ইসলামের আবির্ভাবের পর্বে আরবরা যুদ্ধে রওয়ানা হবার প্রাক্কালে নিজ নিজ বাহিনী পরিদর্শন করত। আঁ-হযরত (সা) ও যখন কোন অভিযানে সেনাবাহিনী প্রেরণ করতেন তখন যাত্রার প্রাক্কালে প্রতিটি মুজাহিদকে পরিদর্শন করতেন। তিনি দুর্বল, অল্পবয়স্ক এবং বৃদ্ধ লোকদের জিহাদে যাবার অনুমতি দিতেন না। সৈন্যদের কাতার গুলোকে সোজা এবং সংঘবদ্ধাকারে কায়েম রাখার তিনি তাকীদ দিতেন। খুলাফায়ে রাশেদীনও এই নিয়ম চালু রেখেছিলেন। বনী উমাইয়া যুগের সূচনায় এর উপর আমল করা হলেও পরবর্তী সময়ে গাফিলতির কারণে তা পরিত্যাগ করা হয়। কিন্তু হাজ্জাজ বিন ইউসুফ পুনরায় অত্যন্ত শক্তভাবে উল্লিখিত নিয়মটি চালু করেন। পরিদর্শনের সময় হাজ্জাজ প্রতিটি সৈনিককে জিজ্ঞাসা করতেন সে কে এবং তার গোত্র কোনটি। সৈনিকের অস্ত্রশস্ত্র বিশেষভাবে পরিদর্শন করা হ’ত এবং প্রতিটি সৈনিকের স্বাস্থ্যও মনোনিবেশ সহকারে পরীক্ষা করা হ’ত। যে ব্যক্তি এত বড় একজন সংস্কারক ছিলেন তিনি যদি এক আধটু কঠোরতা দেখিয়েই থাকেন তাহলে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। যদি ইনসাফের দৃষ্টিতে তিনি তা করে থাকেন তাহলে তার আচরণ ঠিকই ছিল। কেননা এছাড়া বিগড়ে যাওয়া একটি জামা’আতকে সোজা পথে নিয়ে আসার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম।1

ফৌজী ছাউনি

আঁ-হযরত (সা)-এর সময়ে যখন কোন শহর জয় করা হ’ত তখন তার আশেপাশে সেনাছাউনি ফেলা হ’ত যাতে এর দ্বারা শহরবাসীদের কোনরূপ অসুবিধার কারণ না ঘটে।

হযরত উমর (রা) নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, এই ছাউনি যতদূর সম্ভব এমন স্থানে হবে যেখান থেকে মুসলিম ফৌজের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে শত্রুপক্ষ যেন বিচ্ছিন্ন করে দিতে না পারে। অধিকাংশ ঐতিহাসিক লিখেছেন যে, এমন স্থানে পারতপক্ষে সেনাছাউনি না ফেলার হুকুম ছিল যে স্থান এবং মদীনার মধ্যে কোন নদী বা সমুদ্র ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, মুসলিম সৈন্য মিসরের রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থান করেনি বরং “হিস্‌ন-ই-বাবেল”-এর নিকটবর্তী তাঁবুতে অবস্থান করেছে এবং পারস্য সাম্রাজ্যের রাজধানী মাদায়েনের পরিবর্তে ফুরাত নদীর কিনারে অবস্থান করেছে। পরবর্তী সময়ে কুফা ও বসরায় (ইরাকে অবস্থিত) সেনাছাউনি নির্মাণ করা হয়।

এই কর্মপদ্ধতির সর্বপ্রধান উদ্দেশ্য ছিল, সৈনিকদেরকে শহরের আরাম-আয়েশ ও খেল-তামাশা থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখা। আমরা যে যুগের কথা বলছি তখন মুসলিম সৈনিকরা সাধারণত নিজেদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধে যেতেন।

আরব সৈনিকগণ পরবর্তীকালে নিজেদের পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধে যেতেন না। এমতাবস্থায়ও তারা শহরের বাইরে আলাদা জায়গায় অবস্থান করতেন। দুর্গবেষ্টিত শহরগুলোতে যতটা সৈন্য রাখা সমীচীন ছিল ততটাই রাখা হ’ত। কুফার ন্যায় কায়রোও প্রথমে একটি ইসলামী ক্যাম্প ছিল, যা পরে বড় শহরে পরিণত হয় এবং এটি বর্তমানে মিসরের রাজধানী।

সামরিক পতাকার গুরুত্ব

পতাকা যাকে “লিওয়া” (لوا) এবং “রাইয়াত” (رأئيت) বলা হ’ত, যুদ্ধের সময় ছিল খুবই গুরুবহ। আমার প্রথম পুস্তকগুলোতে যেমন, ‘হাদীছে দেফা’2, এবং হযরত আবূ বকর (রা)-এর জীবন-বৃত্তান্তে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

আঁ-হযরত (সা) বদর যুদ্ধে মুজাহিদদেরকে তিনটি পতাকা প্রদান করেছিলেন। একটি ছিল সাদা যা তিনি মুস’আব ইবন ‘উমায়র (রা)-কে সোপর্দ করেছিলেন। ‘ইকাব নামের একটি কালো পতাকা হযরত ‘আলী (রা)-এর নিকট ছিল এবং অপর কালো পতাকাটি অর্থাৎ তৃতীয়টি রসুলুল্লাহ (সা) আনসারদেরকে প্রদান করেছিলেন।

আঁ-হযরত (সা) পতাকার হিফাজতের উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতেন। ছোট পরিমাপের পতাকাকে ‘লিওয়া’ বলা হ’ত যা সাধারণত অশ্বারোহী বাহিনীর অধিনায়ককে প্রদান করা হ’ত। পাশ্চাত্যের সৈনিকেরাও এই প্রথার অনুকরণ করে।

‘রাইয়াত’ মাপে ও আকারে ‘লিওয়া’ থেকে বেশ বড় ধরনের হ’ত। পতাকার মর্যাদা ও সম্মান ইরানী, রোমক, ভারতীয় তথা সকলের নিকটই সমভাবে ছিল। পতাকার পতন কিংবা শত্রু হস্তে তা চলে যাওয়াকে ভারতীয় সৈনিকদের জন্য খুবই অশুভ লক্ষণ মনে করা হ’ত। এমন অবস্থা দেখা দিলে সৈনিকরা অধিকাংশ সময় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যেত। আমরা আগামীতে আলোচনা করব যে, মুহাম্মদ বিন কাসিম যদিও খুবই অল্পবয়স্ক সিপাহসালার ছিলেন, তথাপি তিনি ভারতীয়দের মনে পতাকার পতনের যে প্রতিক্রিয়া তা বেশ ভালভাবেই অনুধাবন করেছিলেন। কেননা তিনি দেবলে অবস্থিত মন্দিরের লাল ঝাণ্ডাকে স্বীয় মিনজানীকের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করেছিলেন এবং এই পতাকা ভুলুণ্ঠিত হতেই ভারতীয় ফৌজ তাদের মনোবল হারিয়ে বসেছিল।

আঁ-হযরত (সা) পতাকার সম্মান ও মর্যাদার উপর খুব গুরুত্ব দিতেন। অবশ্য এই সাথে তিনি এ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণও দেন যে, পতাকা ভূপাতিত হবার সঙ্গেই সঙ্গেই তা পুনরায় উঠাতে হবে এবং যদি দুশমনের হাতে গিয়ে পড়ে তাহলে সম্ভাব্য সকল উপায় অবলম্বন করে তা শত্রু হস্ত থেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। এইরূপ নির্দেশ প্রদানের পেছনে রসূল (সা)-এর অভিপ্রায় সম্ভবত এই ছিল যে, অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও অটুটু মনোবল কোন অবস্থাতেই হারাতে নেই। অবস্থা ও সংকট যত কঠিনই হোক না কেন, কোন অবস্থাতেই হতাশাকে ধারে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হবে না।

আঁ-হযরত (সা) যখনই মুজাহিদ বাহিনীকে কোন অভিযানে প্রেরণ করতেন তখন তাদের অধিনায়ককে বিশেষ পতাকা প্রদান করতেন। সাধারণত প্রতিটি গোত্রের নেতার পতাকাই ঐ গোত্রের পতাকা বলে বিবেচিত হ’ত।

এই পতাকা প্রদান মুহূর্তে আঁ-হযরত (সা) এবং পরবর্তী খলীফাগণ দু’আ ও ওসীয়ত করতেন। হযরত উমর (রা) এক অধিনায়ককে পতাকা প্রদান করবার সময় নিম্নোক্ত বক্তব্য পেশ করেছিলেন :

“আল্লাহ্‌র নামে, তাঁরই সাহায্য ও সহযোগিতায় আমি এই পতাকা বিন্যস্ত করেছি। আল্লাহ্‌র সাহায্য নিয়ে রওয়ানা হও। আল্লাহ তা’আলা এই পতাকাকে সমুন্নত রাখুন। বিজয় ও সাফল্যের জন্য সত্যকে আঁকড়ে ধরা এবং ধৈর্য অবলম্বন করা অপরিহার্য।

“তোমরা আল্লাহ্‌র রাহে সেই সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়বে যারা আল্লাহ্‌র সঙ্গে কুফরী করে; কিন্তু সীমালঙ্ঘন করবে না। কেননা সীমালঙ্ঘনকারীকে আল্লাহ ভালবাসেন না। শত্রুর সঙ্গে মুকাবিলার মুহর্তে ভীরুতা ও কাপুরুষতা প্রদর্শন করবে না, বিজয় মুহূর্তে অপব্যয় ও অপচয় করবে না। বৃদ্ধ, অসহায় নারী কিংবা নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করবে না।

“বিশাল বাহিনী যখন তোমাদের সমনে এসে দাঁড়াবে এবং লড়াইয়ের ময়দান উত্তপ্ত হয়ে উঠবে তখন প্রাণভরে লড়বে, শত্রুকে হত্যা করবে। শত্রুর উপর অতর্কিত নৈশ আক্রমণ পরিচালনা কালেও এই নিয়ম মেনে চলবে।”

ফৌজি ব্যাণ্ডের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব

পাশ্চাত্যের প্রচার-প্রোপাগাণ্ডায় আমরা শুনেছি যে, মুসলিম সিপাহীরা ছিল অনুভূতিহীন মানুষ যাদেরকে কেবল খাওয়া, পান করা এবং মরতে শেখানো হয়েছিল। আমরা বিশ্ব-যুদ্ধ কালে এবং পরেও একথা শুনেছি। এমনকি জনসাধারণও মনে করে যে, ব্যাণ্ড পাশ্চাত্যের আবিষ্কার। কিন্তু প্রকৃত ঘটনাবলী এর বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য দেয়।

আইয়ামে জাহেলিয়াতে এবং তার পরেও মুসলিম ফৌজে ‘তবল’ বা ঢোল এবং ‘বওক”-এর ব্যবহার হ’ত। কবিগণ কবিতা আবৃত্তি করে ও গযল গেয়ে সৈন্যদেরকে উৎসাহিত করতেন। অবশ্য এটা ঠিক যে, এসব উপকরণ রাষ্ট্রের গৌরব ও শান-শওকত প্রকাশের সময়ে ব্যবহার করা হ’ত না। সে যুগে যখন যুদ্ধ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যেত তখন সিপাহীরা মিলিত কোরাসে কিংবা পৃথক পৃথকভাবে গান গাইত। মুজাহিদবৃন্দের মধ্যে যে-সব কবি উত্তম কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন মুজাহিদরা তাদেরকে মৌখিকভাবেই প্রশংসা করত না, বরং তাদেরকে আর্থিক পুরস্কারও দিত। খালিদ বিন ওয়ালীদ (রা)-এর উপর অপব্যয়ের সর্বাপেক্ষা বড় অভিযোগ ছিল এই যে, তিনি একজন কবিকে কয়েক হাযার দীনার কবিতা আবৃত্তির বিনিময়ে দিয়েছিলেন।

মুসলিম ফৌজ পরবর্তীকালে রোমক ও পারসিক বাহিনীর অনুকরণ করে এবং বাজনাকে নিজেদের গৌরব ও শান-শওকতের প্রকাশ-মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে।

একটি মুসলিম ফৌজের কাছে কয়েকশ’ বওক ও ঢোল থাকত। ফৌজের সদস্যরা মিলিত হয়ে গান গাইত। সৈন্যরা যুদ্ধ-যাত্রার মুহূর্তে মিলিত হয়ে গান গাইত যাতে করে সফরের দুঃখ-কষ্ট ও ক্লান্তির লাঘব ঘটে।

অস্ত্রশস্ত্র

ভারতবর্ষ, ইরান এবং রিওয়াবাসী অস্ত্রশস্ত্রের ক্ষেত্রে অনেক অগ্রসর ছিল। তখনকার দিনে তাদের অস্ত্রশস্ত্রই সর্বোত্তম এবং নতুন ধরনের ছিল। অবশ্য তারা সেগুলোর ব্যবহার সঠিকভাবে করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে তাদের পূর্ণাঙ্গ দক্ষতা ও নৈপুণ্যের অভাব ছিল। যেহেতু আরব মুজাহিদরা দরিদ্র ও অভাব-অনটনের কারণে উচ্চ মূল্যের লৌহ-বর্ম খরিদ করতে পারত না, তাই তারা নিজেদের প্রাণের নিরাপত্তার জন্য এই ঘাটতিটুকু পূর্ণ দক্ষতা ও নৈপুণ্যের সাথে অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার দ্বারা পূরণ করত। যে-ভাবে ইট, সিমেন্ট ও লৌহ-নির্মিত প্রাচীর ও কেল্লা দ্বারা কোন জাতিকে রক্ষা করা যায় না, ঠিক তেমনি মানুষের দেহও লৌহ-বর্মের দ্বারা নিরাপদ ও সুরক্ষিত রাখা যায় না— যতক্ষণ না সেই লৌহ-বর্ম পরিহিত দেহের বাহুতে শত্রুর উপর কার্যকর আঘাত হানার শক্তি থাকে। একজন শক্তিশালী বাহুধারীর নিক্ষিপ্ত তীর খুব কম সময়ই প্রতিহত করা সম্ভব হয়। এই তীরের আওতা থেকে নিরাপদ থাকার জন্য এমন বাহু দরকার যা বিদ্যুৎ বেগে তীরগুলোকে ঢালের পৃষ্ঠে লুফে নিতে পারে।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. হাজ্জাজ সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব। আমরা এর সঙ্গে একমত নই। —অনুবাদক।
  2. ‘ইসলামে প্রতিরক্ষা কৌশল’ নামে বর্তমান অনুবাদক কর্তৃক অনূদিত হয়ে ইতিমধ্যে প্রকাশিত ও নিঃশেষিত হয়ে গেছে। বর্তমানে ‘রসূলুল্লাহ ((সা)-এর রণ-কৌশল’ নামে এর ২য় সংস্করণ প্রকাশের পথে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। — অনুবাদক।