» » প্রথম পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

আজ কদিন হয় মনিরা এই অন্ধকার কক্ষে বন্দী হয়ে রয়েছে। এ কদিনের মধ্যে দু’দিন মাত্র খেয়েছে সে। আর বাকি দিনগুলো পানি ছাড়া কিছু মুখে দেয়নি। চোখ বসে গেছে। চুল এলোমেলো বিক্ষিপ্ত। ক’দিন গোসলেরও নাম করেনি সে। অবশ্য তাকে এসবের জন্য সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

মনিরাকে এই অন্ধকার কক্ষে বন্দী করে রাখার পর প্রায়ই আসতো নাথুরাম আর তার সঙ্গী জগাই। জগাইও নাথুরামের চেয়ে কুৎসিত কম নয়। হৃদয়টাও তেমনি জঘন্য শয়তানিতে ভরা। কঠিন পাথরের মত মন। যেমন নাথুরাম তেমনি তার সঙ্গী।

এদের দেখলেই মনিরা মুখ ফিরিয়ে নিতো। ঘৃণায় কুঞ্চিত হত তার নাসিকা। ওরা কোনো কথা জিজ্ঞাসা করলে মনিরা জবাব দিতো না। খাবার নিয়ে এলে খেত না সে। নাথুরাম কুৎসিত ইংগিতপূর্ণ তামাশা করতে ছাড়ত না। মনিরা নিশূপে শুনে যেত, কারণ সে জানে কোন কথা বলে লাভ হবে না। বরং এতে তার বিপদ আরও বাড়বে। তাই নীরবে সহ্য করে যেতো। কিন্তু এ ক’দিনের মধ্যে মনিরার চোখের পানি একটিবার শুকিয়েছে কিনা সন্দেহ।

নাথুরাম কুৎসিত ইংগিতপূর্ণ হাসি-তামাশা করা ছাড়া মনিরার সঙ্গে কোন দুর্ব্যবহার করতে সাহসী হত না, কারণ তারা জানতো মনিরা মুরাদের ভাবী বধূ।

মনিরাকে মুরাদের হাতে পৌঁছানোর জন্য মোটা বখশিস পেয়েছে তারা, ভবিষ্যতে আরও পাবে। নাথুরাম তার সঙ্গী জগাইকে নিষেধ করে দিয়েছে কেউ যেন মনিরার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করে।

মনিরা দাঁতে দাঁত পিষতো। কিন্তু কি উপায় আছে। সে দুর্বল অসহায় নারী।

মনিরা যখন বেশ কদিন না খেয়ে কাটিয়ে দিল তখন এক বুড়ীকে সঙ্গে করে নিয়ে এলো নাথু। মনিরাকে সর্বক্ষণ দেখা-শোনা আর নাওয়া-খাওয়া করানোর ভার দিল তার উপর। খুব সাবধানে কড়া পাহারায় রাখার নির্দেশ দিল নাথুরাম।

মনিরা তবু মনে কিছুটা সাহস পেল। যা হউক বৃদ্ধা হলেও সে নারী। নাথুরাম আর জগাইয়ের হাত থেকে আপাতত রক্ষা পেল সে তাহলে।

নাথুরাম আর জগাই বারবার বৃদ্ধাকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় একটা চাবি বুড়ীর হাতে দিয়ে বলল নাথুরাম-সতী, এই নাও চাবি, তুমি যখনই বাইরে যাবে, দরজায় তালা মেরে যাবে, দেখ মেয়েটা যেন না পালায়।

বৃদ্ধা জবাব দিল-কি যে বলো! আমার নাম সতী, আমার নিকট থেকে মেয়ে পালাবে, অমন জীবন রাখব না।

নাথুরাম হেসে বেরিয়ে গেল, জগাই তাকে অনুসরণ করলো।

এতক্ষণে মনিরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো বৃদ্ধার দিকে। ঠিক বৃদ্ধা নয় বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। দাঁতও পড়েছে অনেকগুলো। দু’চারটে যা আছে তাও নড়ছে। কথা বলার সময় বেশ বুঝা গেল সেটা।

বৃদ্ধার চুল পাকলে কি হবে। দাঁত নড়লেও কিছু আসে যায় না, তার সাজ-সজ্জা ছিল খুব। বিনুনী করে খোঁপা বাঁধা, কপালে সিঁদুরের টিপ, গালে কুমকুম, ঠোঁটে পানের রংঙের সঙ্গে লাল রং মেশানো রয়েছে। বৃদ্ধার গায়ের রং তামাটে। নাকটা বোঁচা, কেমন যেন বিদঘুঁটে চেহারা। ওকে দেখে মনিরার গা রি রি করে উঠল। যা চেহারা তার নাম আবার সতী। তবু এই নির্জন : সহায়-সম্বলহীন কক্ষে ওকেই মনিরা সাথী করে নিল।

মনিরাকে সতী তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেসে বললো–কিগো, অমন করে তাকিয়ে তাকিয়ে কি দেখছ?

মনিরা নিশ্চুপ থাকা ঠিক মনে করলো না, সেও বেশ স্বচ্ছকণ্ঠে বলল–একটু পানি দেবে আমাকে?

বুড়ী হেসে বলল–পানি খাবে তাই আবার এত কথা। দাঁড়াও এনে দিচ্ছি।

বুড়ী লণ্ঠন হাত বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে যাবার সময় দরজার তালা লাগাতে ভুলল না সে।

মনিরা বুঝল বুড়ী খুব চালাক। একটু পর এক গেলাস পানি হাতে কক্ষে প্রবেশ করলো সতী। বাঁ হাতে লণ্ঠন, দক্ষিণ হাতে পানির গেলাস।

মনিরা ভাবলো-বুড়ীকে কাবু করে পালানো খুব সহজ, কিন্তু কক্ষের বাইরে বলিষ্ঠ দু’জন পাহারাদার বন্দুক হাতে সতর্কভাবে পাহারা দিচ্ছে, তাদের চোখে ধুলা দিয়ে পালানো সম্ভব হবে না। তাছাড়া কক্ষটা কোথায়, শহরে না গহন বনে, মাটির নিচে না উপরে-তাও জানে না সে।

বুড়ীর হাতে থেকে পানির গেলাসটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে খেয়ে বলে মনিরা-আচ্ছা, তোমাকে আমি কি বলে ডাকবো?

সতী দিদি বলে ডেকো-এ নামেই সবাই আমাকে ডাকে।

এরপর থেকে সতী বুড়ীই মনিরার খোঁজখবর নিতো। খাবার সময় হলে খাবার নিয়ে আসতো। মাঝে মাঝে চুল আঁচড়ে বেঁধে দিতো। কিন্তু বুড়ী যাওয়ার সময় লণ্ঠনটা নিয়ে যেত। তখন মনিরা অন্ধকারে প্রহর গুণতো। কক্ষে অন্য কোন আলোর ব্যবস্থা না থাকায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠতো সে। অসুবিধা হত অনেক। তবু নীরবে প্রতীক্ষা করতে সতীর। দরজার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতো। এমনিভাবে আর কতদিন কাটবে!

একদিন বুড়ীর হাত পা ধরে কেঁদেছিল মনিরা, তাকে একটু বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছিল সে। কিন্তু বুড়ী বড় শক্ত। পাষাণ তার হৃদয়। হেসে বলেছিল-সাহেব ভাল হলে কত বাইরে যাবে, যেও। কত হাওয়া খাবে, খেও। তুমিই তো তাকে জখম করেছ।

মনিরা তবু শেষ চেষ্টা করে বলেছিল, তোমাকে অনেক টাকা দেব সতী দিদি।

বুড়ী জবাব দিয়েছিল-আমার তো টাকার কোন অভাব নেই। সাহেব আমাকে হাজার হাজার টাকা দিয়েছে। শুধু তুমি কেন, তোমার মত কত যুবতাঁকে আমি বাগে রেখেছি। তারা এখন সবাই আমার হাতের মুঠোয়। শিউরে উঠেছিল মনিরা, কিছুক্ষণ স্তব্ধ চোখে লণ্ঠনের আলোতে তাকিয়ে তাকিয়ে বুড়ীকে দেখেছিল। ভাবছিল, এর হাত থেকে বুঝি আর রক্ষা নেই।

বুড়ি যাবার সময় আলো নিয়ে চলে যায় কেন, একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল মনিরা তাকে। বুড়ি হেসে বলেছিল-আমি বোকা মেয়ে নই। তোমার মত অমন কত যুবতাঁকে আমি বশে রেখেছি। কারও ঘরে লণ্ঠন রাখিনি।

কেন রাখনি।

কেন রাখিনি জান? তোমরা যদি শাড়িতে আগুন ধরিয়ে পুড়ে মর।

বুড়ীর বুদ্ধির জোর দেখে মনিরা এত দুঃখেও হেসেছিলো। তার নিজের এতটুকু বুদ্ধিও নেই, তাহলে সেদিন সে নিজ হাতে দরজা খুলে বেরিয়ে আসতো না। হায়, কি সর্বনাশ সেদিন মনিরা করে বসেছে। এতদিনে হয়তো মনির ফিরে এসেছে। হয়তো তার সন্ধান নিতে এসে নিরাশ হৃদয় নিয়ে ফিরে গেছে। তার মামুজান আর মামীমার অবস্থা যে কি দাঁড়িয়েছে কে জানে। হয়তো পুলিশ মহল তার সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু এখন সে কোথায় রয়েছে নিজেই জানে না। যে ঘরে। সে বন্দী সে ঘর খানা কোথায়-মাটির বুকে না মাটির নিচে? আজ বুড়ী এলে যেমন করে থোক এ কথা জেনে নেবে মনিরা। অসহ্য অন্ধকার-মনিরা হাঁপিয়ে উঠেছে। আলো, আলো-একটু আলো তার প্রয়োজন।

মনিরার চিন্তাজাল বিচ্ছিন্ন করে অন্ধকারে আলোকরশ্মি ভেসে এলো। কখন যে দরজা খুলে লণ্ঠন হাতে বুড়ী এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়াল করেনি সে।

মনিরা বুড়ীকে দেখে উঠে দাঁড়ালো, সঙ্গে সঙ্গে ভূত দেখার মত চমকে উঠলো সে–বুড়ীর পেছনে যমদূতের মত দাঁড়িয়ে আছে মুরাদ। গায়ে জামার পরিবর্তে একটি চাদর জড়ানো।

মনিরাকে দু’পা পিছিয়ে দাঁড়াতে দেখে বলল মুরাদ-ভয় নেই, ভূত নই মনিরা। তোমার ছোরার আঘাতে আমার মৃত্যু ঘটেনি।

দাঁতে দাঁত পিষে বলে মনিরা-তা আমি জানি।

জান! আমার মৃত্যু ঘটেনি, জেনে খুশি হয়েছিলে প্রিয়ে?

মনিরা কোন জবাব দিল না।

মুরাদ বুড়ীকে বেরিয়ে যেতে ইংগিত করলো।

বুড়ী মেঝের একপাশে লণ্ঠন নামিয়ে রেখে বেরিয়ে যায়।

মনিরা প্রমাদ গণে। এতক্ষণ তবু কতকটা সে আশ্বস্ত ছিল, বুড়ী বেরিয়ে যেতেই কণ্ঠতালু তার শুকিয়ে ওঠে। বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয় মুখমণ্ডল। হিংস্র জন্তুর কবলে যেমন মেষশাবকের অবস্থা হয়, তেমনি অবস্থা হয় মনিরার। এই নির্জন কক্ষে আজ তাকে রক্ষা করার মত কেউ নেই। মনিরা অসহায়ের মত পিছু হটতে লাগল।

মুরাদের মুখে কুৎসিত হাসি ফুটে উঠেছে, দু’চোখে লালসাপূর্ণ চাহনি। গম্ভীর কণ্ঠে বলল–মনিরা, তুমি যে আঘাত আমাকে দিয়েছ, তা আমি নীরবে সহ্য করেছি, অন্য কোন নারী হলে আমি তাকে হত্যা করতাম।

মনিরা তীব্রকণ্ঠে বলল–তাই কর, তুমি আমাকে হত্যা কর শয়তান। এ বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু অনেক ভালো।

মুরাদ অদ্ভুত একটা শব্দ করলো–তাই নাকি? কিন্তু তোমাকে হত্যা করে আমি বাঁচবো কেমন। করে! এসো লক্ষীটি আমার। মনিরা, জান তোমাকে আমি কত ভালবাসি! আমার গোটা হৃদয় জুড়ে তুমি আর তুমি। তোমাকে পাবার দুর্বিসহ জ্বালা আমার গোটা অন্তরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার শরীরে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছ তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষত হয়েছে আমার মনে। তোমাকে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাব।

মনিরা রুদ্ধ নিঃশ্বাসে শুনছে মুরাদের কথাগুলো। বারবার জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট দু’খানা চেটে নিচ্ছিল। চোখের দৃষ্টি অসহায়ের মত ছুটে যাচ্ছিলো দরজার দিকে। এই মুহূর্তে কেউ কি তাকে বাঁচাতে পারে না। বুড়ীটা এলেও একটু সাহস হত তার। মনে-প্রাণে খোদাকে স্মরণ করে মনিরা।

লণ্ঠনের আবছা আলোতে মুরাদকে একটা ভয়ঙ্কর জীব বলে মনে হয় মনিরার। ক’দিনের। অনাহারে শরীর দুর্বল। কণ্ঠতালু শুকিয়ে আসছে। চোখদুটিও বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে। বুকের মধ্যে হাতুড়ির ঘা পড়ছে। এবার আর তার রক্ষা নেই। পাপিষ্ঠ মুরাদ আজ তাকে পাকড়াও করবেই। কিন্তু তা কিছুতেই হতে পারে না। যেমন করে তোক নিজকে ওর কবল থেকে বাঁচাতেই হবে। মনিরা মনে মনে এক বুদ্ধি আঁটলো হঠাৎ দু’হাতে মাথাটা চেপে ধরে বলে উঠলো-উঃ একি হল! চোখে এমন অন্ধকার দেখছি কেন, মা-মাগো-মনিরার দেহটা টলছে।

মুরাদ হঠাৎ ভড়কে যায়। অধীর কণ্ঠে বলে ওঠে–কি হল মনিরা, কি হল তোমার? যেমনি মুরাদ ওকে ধরতে যাবে অমনি মেঝেতে পড়ে গেল মনিরা।

মুরাদ তাড়াতাড়ি ওর মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে উচ্চকণ্ঠে ডাকল-সতী-সতী—

সতী বুড়ী হন্তদন্ত হয়ে কক্ষে প্রবেশ করলো–আমায় ডাকছেন বাবু?

হ্যাঁ, দেখো সে অজ্ঞান হয়ে গেছে। শিগগির পানি নিয়ে এসো।

বুড়ী সতী দেবী ছুটলো পানি আনতে।

মনিরা তবু নিশ্চিন্ত নয়। মুরাদের কোলে মাথা রেখে মনটা তার ভয়ে শিউরে উঠছে, তবু নীরবে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল।

সতী অল্পক্ষণের মধ্যেই এক ঘটি পানি নিয়ে হাজির হল–এই নিন পানি।

মুরাদ পানি নিয়ে মনিরার চোখেমুখে ঝাঁপটা দিতে শুরু করল আর বার বার ডাকতে লাগলো-মনিরা, মনিরা…..

মনিরা কিন্তু কিছুতেই চোখ মেললো না, যদিও পানির ঝাঁপটা তার অসহ্য লাগছিল তবু নিঃশ্বাস বন্ধ করে পড়ে রইল।

মুরাদ তখন মনিরার জ্ঞান ফিরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, ঠিক তক্ষুণি কারও অশ্বপদ শব্দ শোনা গেল। মুরাদ বুড়ীকে জিজ্ঞাসা করলো–কে এলো সতী?

সতী জবাব দেবার পূর্বেই শোনা গেল একটা কর্কশ কণ্ঠস্বর-হুজুর আমি।

ওঃ নাথুরাম, এতদিন কোথায় ডুব মেরেছিলে নাথু?

হুজুর, আমার অনেক কাজ। অনেক দিকে আমাকে সন্ধান রাখতে হয়। কিন্তু ওর কি হয়েছে হুজুর?

হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। নাথু, অনেকক্ষণ পানির ছিটা দিচ্ছি, তবু জ্ঞান ফিরছে না, কি করা যায় বলতো?

দেখি আমি। মনিরার পাশে বসে নাথুরাম।

মনিরার অন্তর কেঁপে ওঠে। আর কতক্ষণ নিজকে এভাবে বাঁচিয়ে রাখবে, পানির ঝাঁপটা খেয়ে খেয়ে ঠান্ডা ধরে এলো। নাকের মধ্যে পানি প্রবেশ করছে। চুল ভিজে চুপষে গেছে। কাপড়ের অবস্থাও তাই। তবে সে নিশ্চুপ পড়ে আছে।

নাথুরাম মনিরাকে পরীক্ষা করে বলল–কোন চিন্তা নেই হুজুর,জ্ঞান ফিরে আসবে।

মুরাদ আবার ডাকল-মনিরা-মনিরা, চোখ মেলে দেখ।

মনিরা চোখ মেলল না, যেমন ছিল তেমনি পড়ে রইল।

নাথুরাম বলল–হুজুর, আমি বেশিক্ষণ বিলম্ব করতে পারছি না। আজ বেটা ঘুঘুটাকে ফাঁদ থেকে বের করে আমাদের জম্বুর বনের গুহায় নিয়ে যাব।

মুরাদ প্রশ্ন করল-কার কথা বলছ, ডিটেকটিভ শঙ্কর রাওয়ের কথা বলছো?

হ্যাঁ, তাকে আর এখানে-মানে এই শহরের বাড়িতে রাখা ঠিক নয়। লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত, কোনক্রমে যদি বেরুতে পারে, তাহলে আর আমাদের রক্ষা থাকবে না।

মনিরা নিশ্চুপ সবই শুনে যাচ্ছিলো। সে এখন তাহলে শহরের কোনো গোপন বাড়িতে বন্দী রয়েছে। মি. রাও তিনিও তাহলে বন্দী এবং এই বাড়িতেই কোন কক্ষে তাঁকে আটক করে রাখা হয়েছে। মনিরার মনে একটু সাহস হয়। সে তাহলে শহরের মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু জন্ধুর বন তা আবার কোথায়! মি. রাওকে তাহলে জম্বুর বনে নিয়ে যাওয়া হবে। মনিরার কানে আবার আসে মুরাদের কণ্ঠস্বর….নাথু, মনিরাকেও এখানে রাখা ঠিক হবে না, কারণ এখনও আমি সম্পূর্ণ আরোগ্য হইনি, আমি ঠিকভাবে মনিরাকে দেখাশুনা করতে পারছি না। আরও কিছুদিন আমি মনিরাকে কোথাও গোপন করে রাখতে চাই।

সেজন্য কোন চিন্তা নেই হুজুর। নাথুরামের অসাধ্য কিছুই নেই। ওকে জম্বুর বনের পাতালপুরীর কক্ষে নিয়ে রাখব।

মুরাদের ব্যথাহত কণ্ঠস্বর-কিন্তু আমি?

সেজন্য ভাববেন না হুজুর। আপনার ঘা শুকিয়ে গেলে আপনিও যাবেন সেখানে, কোন অসুবিধাই হবে না আপনার। সুন্দর ঘর, পরিষ্কার বিছানাপত্র সব পাবেন আমার সেই পাতালপুরীর কক্ষে।

মুরাদ নাথুরামের কথায় খুশি হয়, আনন্দভরা গলায় বলে–সত্যি নাথুরাম তোমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দেব! যাবার সময় পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে যেও আমার কাছ থেকে।

মনিরার নাকে পানি প্রবেশ করায় বড় হাঁচি পাচ্ছিল, আর নিজকে সংযত রাখতে পারল না সে, হঠাৎ হচ্চো করে হেঁচে উঠল।

সঙ্গে সঙ্গে নাথুরাম আর মুরাদের কথা থেমে গেল। নাথুরাম বলল–হুজুর, এবার ওর জ্ঞান ফিরে আসবে, আর কোন চিন্তা নেই। তাহলে একে কবে সরাচ্ছি হুজুর?

মুরাদের চাপা কণ্ঠ–চুপ! জ্ঞান ফিরে এসেছে, সব জেনে ফেলবে।

হেসে বলল নাথুরাম-ভয় পাবার কিছু নেই হুজুর, নাথুরামের সেই পাতালপুরীর গোপন কক্ষ কেউ খুঁজে পাবে না একমাত্র যম ছাড়া।

মুরাদের হাসির শব্দ-ঠিক বলেছ। যেখানে মানুষ প্রবেশ করতে সক্ষম নয়, সেখানে যম কিন্তু অনায়াসে প্রবেশ করতে পারে।

হঠাৎ বলে উঠল বুড়ী সতী দেবী-আপনারা যাই বলুন, দস্যু বনহুর কিন্তু যমের চেয়েও ভয়ঙ্কর। সাবধানের মার নেই।

মনিরা বুড়ীর মুখে বনহুরের নাম শুনে কেমন যেন মুগ্ধ হল। খুশি হল সে। ঠিকই বলেছে বুড়ী। বনহুরের নামে যে মধু মেশানো ছিল, সেই মধু মনিরাকে চাঙ্গা করে তোলে। ভাবে সে ভয় কি, তার মনির রয়েছে। নিশ্চয়ই সে চুপ করে বসে নেই। যেমন করে হোক তাকে খুঁজে বের করবেই। খোদার ওপর অগাধ বিশ্বাস মনিরার, তাই ইজ্জত রক্ষা করবেনই তিনি।

মনিরা নিশ্চুপ পড়ে থেকেও বুঝতে পারল, নাথুরামের কানে কি যেন গোপনে বলল মুরাদ। নাথুরাম উঠে দাঁড়াল, তারপর বেরিয়ে গেল।

মুরাদ এবার সতাঁকে লক্ষ্য করে বলল–এর ভিজে কাপড় পাল্টে দাও। বেশ করে চুলগুলো আঁচড়ে দেবে। ভালমত জ্ঞান ফিরলে খাবার এনে দিও, বুঝেছ?

আপনার অত বুঝাতে হবে না বাবু, আমি সব ঠিক করে নেব।

মুরাদ মনিরার মাথা কোল থেকে নামিয়ে রাখল, তারপর পিঠের আর হাঁটুর নিচে হাতে দিয়ে তুলে পাশের খাটে শুইয়ে দিল। মনিরা স্তব্দ নিঃশ্বাসে চুপ করে রইল।

মুরাদ ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আর একবার বুড়ীকে তার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল।

এবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো মনিরা। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিল। যাক উপস্থিত বিপদ থেকে তবু রক্ষা পেল। কিন্তু এর চেয়ে আরও কঠিন বিপদ এগিয়ে আসছে তার জন্য। এত সহজেই তার নেতিয়ে পড়াও ঠিক হবে না-আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে বাঁচতে।

ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল মনিরা, একটু পানি দাও।

বুড়ী তাড়াতাড়ি পাশের একটি কলস থেকে গেলাসে পানি ঢেলে মনিরার মুখে তুলে ধরে বলল–খাও।

মনিরা আস্তে আস্তে উঠে বসল, তারপর এক নিঃশ্বাসে পানিটুকু খেয়ে খালি গেলাসটা ফিরিয়ে দিল বুড়ীর হাতে।

বুড়ী সতী হেসে বলল–এইতো ভালো হয়ে গেছ। এতক্ষণ বেচারা মুরাদ সাহেব কত কি করলেন। এখন ভালো বোধ করছ তো?

হাঁ, কিন্তু মাথাটা বোঁ বোঁ করছে, চোখে অন্ধকার দেখছি।

আজ কদিনের মধ্যে মুখে কিছু দিয়েছ, অমন হবে না? দাঁড়াও তোমার জন্য খাবার আনতে বলি।

বেশ, বল।

বুড়ী দরজার কাছে গিয়ে শিস দিল। সেকি কাণ্ড, মনিরা অবাক হলো। বুড়ীর দাঁত নেই তবু শিস দেবার ঢং দেখে রাগও হল, হাসিও পেল তার।

অমনি একজন দারোয়ান গোছের লোক এসে বুড়ীকে সালাম করে দাঁড়ালো। বুড়ী বললো–এই, শিগগির কিছু খাবার নিয়ে এসো, মেম সাহেব খাবেন।

লোকটা বুড়ীর কাঁধের উপর দিয়ে একবার মনিরার দিকে তাকিয়ে চলে গেল।

বুড়ী এসে বসল মনিরার পাশে।

মনিরা বলল–সতী দিদি, তুমি এদের ঝি, তাই না?

ছিঃ ছিঃ কি যে বল, আমি–আমি হলাম কিনা-ঐ তো সেদিন বলেছি তোমাকে।

হাঁ, ভুলেই গিয়েছিলাম, তুমি এদের সতী দিদি। আচ্ছা লক্ষী দিদি, এই বনটা শহর ছেড়ে কতদূর?

হেসে উঠলো বুড়ী সতী দেবী, বলল–কে বলে এটা বন? এটা বাড়ি, চোখে দেখতে পাওনা?

বাড়ি তো দেখছি, কিন্তু কোথায়-শহরে না বনে?

শহরে গো শহরে। কিন্তু মুরাদ সাহেব তোমাকে আজ অন্য জায়গায় চালান করবে।

কেন?

সে সব আমি কি জানি?

সতী দিদি, বল না কোথায় চালান করবে?

বললাম তো আমি জানি না।

এমন সময় দরজা খুলে যায়, সেই দারোয়ান গোছের লোকটা থালায় খাবার নিয়ে হাজির হয়। খাবার রেখে চলে যায় সে।

মনিরা কাপড়খানা পাল্টে কিছু খাবার মুখে তুলে দেয়। অনেক দিন পর আজ ভাল করে চুল বাঁধে সে। বুড়ী আজ খুব খুশি। মনিরা চুল বাঁধতে বাঁধতে বলে–আচ্ছা সতী দিদি, ওকে কেমন করে চিনলে?

কাকে লো?

ঐ যে তাকে?

তোমার সেই দস্যুটা?

হ্যাঁ।

ও বাবা, তাকে চিনব না, এ শহরের কে না চেনে তাকে?

তুমি তাকে দেখেছ কোনোদিন?

দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে বলে সতী-ও কথা বল না। দস্যু বনহুরকে দেখতে চাই না বাবা!

কেন?

সে নাকি যমের মত দেখতে।

খুব ভয়ঙ্কর, না?

তা তুমিই ভালো জানে, সে তোমাকে ভালবাসে।

কে বলল এ কথা তোমাকে সতী দিদি?

নাথু বলেছে।

কি বলেছে সতী দিদি, বল না?

ও! ঐসব আবার শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে বুঝি?

খুব!

বলেছিল সে, দস্যু তোমাকে নাকি পিয়ার করে, ভাল বাসে, আমি যেন তোমার ওপর খুব কড়া নজর রাখি। আচ্ছা মেয়ে, তোমার কি আর কাজ ছিল না, একটা কুৎসিত লোককে ভালবাসতে গিয়েছিলে?

কে বলল আমি তাকে ভালবাসি?

জানি, সব বলেছে নাথু আমাকে। তুমি দস্যু বনহুরকে অনেক ভালবাস। আচ্ছা, আমাদের মুরাদ সাহেবকে ভালবাসতে পার না।

আনমনা হয়ে যায় মনিরা। বনহুরের সুন্দর মুখখানা স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে তার চোখের সামনে।

বুড়ী হেসে বলে–ওকে মনে পড়েছে বুঝি? ছিঃ দেখতে অমন বিদঘুঁটে লোককে আবার মনে পড়ে? ওর চেয়ে মুরাদ সাহেব কত সুন্দর-যেন যুবরাজ। ওগো, তোমার সেই কুৎসিত লোকটা কেমন দেখতে?

আমার বনহুর?

হ্যাঁ গো হ্যাঁ।

তোমার নাথুর চেয়ে খারাপ দেখতে।

গালে হাত দেয় বুড়ী–সে কি গো, এমন তোমার চেহারা আর তুমি কিনা… ছিঃ ছিঃ ছিঃ, তার চেয়ে মুরাদ সাহেবকে স্বামী করে নাও, কোন বালাই থাকবে না।

তাই করে নেব সতী দিদি, তাই করে নেব।

সত্যি!

হ্যাঁ। কিন্তু আমি যা বলব তাই করবে? কতদিন একটু আলো-বাতাসের মুখ দেখি না। তুমি আমাকে বাইরে নিয়ে যাবে?

বাইরে! সর্বনাশ, ঐ কাজটা আমার দ্বারা হবে না। বুঝেছি পালাবে তুমি!

ছিঃ ছিঃ ছিঃ, পালাব আমি-ক খনও না। তোমাদের মুরাদ সাহেবের মত সুন্দর-সুপুরুষ লোক থাকতে আমি যাব বনহুরের মত একটি কুৎসিত লোকের কাছে? আরে থু! সত্যি দিদি, তুমি কত সুন্দর।

নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে গর্বের হাসি হাসে বুড়ী, বলে– বয়সকালে যা রূপ ছিল, কী বলব তোমাকে।

তা তো দেখতেই পাচ্ছি। না হলে কি আর নাথুরামের মত মানুষ তোমাকে নিয়ে ভুলেছে?

তা সত্যি, ওর জন্যই তো স্বামীর ঘর ছেড়েছি। জোয়ানকালে ওর কি কম রূপ ছিল!

তা দেখতেই পাচ্ছি। সুপুরুষ বটে–সত্যি দিদি, তোমার চোখের তারিফ না করে পারি না। কিন্তু দিদি, তুমি আমাকে একটু বাইরে নিয়ে চল না।

মনিরার কথা শেষ হয় না, কক্ষে প্রবেশ করে নাথুরাম আর অন্য এক লোক। নাথু দাঁত বের করে কর্কশ কন্ঠে বলে ওঠে-তা আর হচ্ছে না সুন্দরী, বাইরের আলো বাতাস দেখার ভাগ্য হবে যেদিন তুমি মুরাদ সাহেবের গলায় মালা দেবে।

মনিরার মুখমণ্ডল পাংশুবর্ণ হয়ে ওঠে। তবু গলায় জোর দিয়ে বলে–শয়তান! ভেবেছ তুমি বাঁচবে। কিন্তু মনে রেখ, তুমিও মরবে।

অট্টহাসি হেসে ওঠে নাথুরাম–আমাকে সতী পাওনি যে, ভয় দেখিয়ে কাবু করবে। এমন কোন বীরপুরুষ নেই যে আমাকে মারতে পারে। তোমার বনহুরকে আমি পুতুল নাচ নাচাতে পারি, জান সুন্দরী?

মনিরা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু নাথুরাম তার পূর্বেই সঙ্গীটিকে ইংগিত করলো।

সতী অবশ্য মনিরার ওপর কিছুটা সদয় হয়ে এসেছিল, হয়তো বাইরে যাবার সুযোগ পেত সে ওর সহায়তায়, কিন্তু সব নস্যাৎ হয়ে গেল। পালাবার একটা ক্ষীণ আশা এতক্ষণ যা মনিরার মনের কোণে উঁকি দিচ্ছিল, সমূলে তা মুছে গেল। পাথরের মূর্তির মত স্থির দাঁড়িয়ে রইলো মনিরা।

নাথুর ইংগিতে তার সঙ্গীটা ভয়ঙ্কর চোখদুটি মেলে একবার মনিরার দিকে তাকাল, তারপর কোমরের ভেতর হতে একটা ময়লা রুমাল বের করে এগিয়ে গেল মনিরার পাশে।

ভয়ে মনিরার হৃদকম্প শুরু হলো, শিউরে উঠলো সে। নিশ্চয়ই ঐ ময়লা রুমালখানায় ঔষুধ মাখানো রয়েছে। এখান থেকে তাকে সরানোর পূর্বে অজ্ঞান করা হবে, বুঝতে পারে মনিরা। কিন্তু কি উপায় আছে-বাঁচার কোনো পথ নেই। সে নারী-দুর্বল, অসহায়। লোকটার সঙ্গে পেরে ওঠা তার পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া নাথুরামের ভয়ঙ্কর কঠিন বলিষ্ঠ বাহু দুটির দিকে তাকিয়ে মনিরা স্তব্দ হয়ে যায়।

নাথুরাম পুনরায় ইঙ্গিত করল, লোকটা মনিরার নাকের ওপর রুমালখানা চেপে ধরলো।

মনিরা দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজিকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করলো কিন্তু পারল না সে। ধীরে ধীরে অবশ হয়ে এলো তার দেহটা। তারপর ওর আর কিছু মনে রইল না।