☼ অতুল সুর ☼
চোদ্দ শতকের বাঙালী
এই বইয়ের গোড়াতেই বলেছি যে বাঙলাকে দ্বিখণ্ডিত করে ভারত যখন স্বাধীনতা লাভ করল, পশ্চিমবঙ্গকে তখন বহু উৎকট সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, কিন্তু ১৯৪৮ সালের জানুয়ারী মাসে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় যখন মুখ্যমন্ত্রী হলেন তিনি তাঁর বহুমুখী প্রতিভা বলে, তাঁর ১৮ বৎসর (১৯৪৮-১৯৬২) মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কালে ওই সব সমস্যার অধিকাংশই সমাধান করে ফেললেন।
প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা যা পশ্চিমবঙ্গকে সমাধান করতে হল, তা হচ্ছে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শরণার্থীদের পুনর্বাসন করা। নানা জায়গায় তাদের জন্য শিবির স্থাপন করা হল ও সরকারী ভাতায় (doles) তাদের পরিচর্যা করা হল। তাছাড়া তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য ও মেয়েদের বিবাহের জন্য সরকারী অনুদান দেওয়া হল। বহুক্ষেত্রে গৃহ নির্মাণের জন্য সরকারী ঋণ দেওয়া হল। নিরাশ্রয়া মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ ও অশক্ত ব্যক্তিদের বিশেষ আশ্রমে (Homes) যত্ন সহকারে রাখা হল। শরণার্থীদের জন্য পেশা বা বৃত্তিগত কারিগরী শিক্ষা দেবার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হল। অনেক স্কুল কলেজ স্থাপন করা হল।
পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য সমস্যাও তিনি অনুরূপ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সমাধান করলেন। খাদ্য ও কাঁচামালের সমস্যা সমাধানের জন্য, কৃষির উন্নতির জন্য বহুমুখী পরিকল্পনাসমূহ রচনা করলেন। কৃষকদের উন্নত ধরনের ভূমিস্বত্ব দেবার জন্য জমিদারী প্রথা বিলোপ করলেন। সেচের ব্যবস্থা এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ‘দামোদর ভ্যালী কর্পোরেশন’ গঠিত করা হল। নদী ও খালসমূহ থেকে কৃষির সেচের জন্য যাতে জল পাওয়া যায়, তার ব্যবস্থা করা হল। এ ছাড়া, নানা স্থানে গভীর ও অগভীর নলকূপসমূহ বসানো হল। এসব করার ফলে কৃষির উৎপাদন অভূতপূর্ব ভাবে বেড়ে গেল। বিশেষ করে পাটের ক্ষেত্রে সামান্য পাঁচ লক্ষ গাঁট থেকে উৎপাদন পরিমাণ ৫০ লক্ষ গাঁটে বৃদ্ধি পেল।
সঙ্গে সঙ্গে দুগ্ধ সরবরাহের জন্য হরিণঘাটা ও বেলগেছিয়ায় ‘ডেয়ারি’ স্থাপন করা হল। পরিবহনের ভার স্টেট্ ট্রানসপোর্ট করপোরেশনের হাতে ন্যস্ত করা হল, কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সড়কও নির্মিত হল।
রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ও পতিত জমির পুনরুদ্ধার করা হল। বস্তীবাসী ও শিল্পে নিযুক্ত কর্মীদের জন্য সরকারী ‘হাউসিং এস্টেট’ বা আবাসভবনসমূহ তৈরী করা হল। অনরূপে আবাস ভবন নিম্ন- মধ্যবিত্ত ও মধ্যম মধ্যবিত্তদের জন্যও তৈরী করা হল। বৃহত্তর কলকাতার জন্য এক পরিকল্পনা রচিত করা হল।
দুর্গাপুরে এক ইস্পাত কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হল। দূর্গাপরে উপনগরী নির্মিত হল। সঙ্গে সঙ্গে চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ কারখানা, হিন্দুস্থান কেবল ওয়ার্কস্ ও কোক ওভেন প্ল্যাণ্ট ও গ্যাস গ্রিড সিস্টেম চালু করা হল। কল্যাণীতেও একটা উপনগরী নির্মিত হল।
স্বাস্থ্য উন্নয়ন, দূষিত জল নিষ্কাশন ও আবর্জনা দূরীকরণের জন্যও বিশেষ চেষ্টা চলতে লাগল। এ সবই ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের আমলে ঘটল।
৷৷ দুই ৷৷
১৯৬২ খ্রীস্টাব্দের ১ জুলাই তারিখে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের মৃত্যুর পর কংগ্রেস নেতা প্রফুল্লচন্দ্র সেন নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করেন। কিন্তু তাঁর অনুসৃত খাদ্যনীতি জনমতের বিরুদ্ধে যাওয়ায়, ১৯৬৭ খ্রীস্টাব্দের নির্বাচনে তিনি পরাহত হন ও অজয় মুখার্জীর নেতৃত্বে এক যুক্তফ্রণ্ট সরকার গঠিত হয়। কিন্তু তা ক্ষণস্থায়ী হওয়ায় ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ এক মন্ত্রীসভা গঠন করেন। কিন্তু তাও স্বল্পকাল স্থায়ী হওয়ায় ১৯৬৮ খ্রীস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারী তারিখে রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তিত হয়। ১৯৬৯ খ্রীস্টাব্দে ফেব্রুয়ারী মাসে অজয় মুখার্জির অধিনায়কত্বে এক বাম ফ্রণ্ট সরকার গঠিত হয়। কিন্তু মাত্র এক বৎসরের (ফেব্রুয়ারী ১৯৭০ পর্যন্ত) বেশি এ সরকার স্থায়ী হয় না। ১৯৭০ খ্রীস্টাব্দের ১৯ মার্চ তারিখে আবার রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তিত হয়। ১৯৭১ খ্রীস্টাব্দের এপ্রিল মাসে অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে এক ডেমোক্রেটিক কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয় এবং দু’মাস (জুন ১৯৭১) পরে তা ভেঙে পড়ে। তখন (৩০ জুন ১৯৭১) আবার রাষ্ট্রপতির শাসন প্রবর্তিত হয়।
১৯৭২-এর মার্চ মাসে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে এক কংগ্রেস সরকার গঠিত হয়। ১৯৭৭ খ্রীস্টাব্দের নির্বাচনে ‘বাম ফ্রণ্ট’ দল সাফল্য অর্জন করাতে জ্যোতি বসু ‘বাম ফ্রণ্ট সরকার’ গঠন করেন। ‘বাম ফ্রণ্ট’ সরকারই এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আছে।
৷৷ তিন ৷৷
ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের আমল থেকেই বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আওতায় শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি হয়েছিল। ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে ১০,৪৪,১১ পাঠরত ছাত্র সমেত ১৩,৯৫০ সংখ্যক প্রাইমারী স্কুল ছিল। ১৯৬০-৬১ খ্রীস্টাব্দে ওই সংখ্যা বেড়ে ২৮,৮৬,১৪২ পাঠরত ছাত্র সমেত ২৮,০১৬ প্রাইমারী স্কুলে দাঁড়ায়। অনুরূপভাবে ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে ৪,৫৭,৬৩৪ পাঠরত ছাত্র বিশিষ্ট ছেলেদের জন্য ১,৬৬৩ স্কুল ও ৬৪,৮৬৬ পাঠরত ছাত্রী সমেত ২৪০টি মেয়ে স্কুল ছিল। ১৯৬০-৬১ খ্রীস্টাব্দে স্কুলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩,৪৯৭ ও ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ২৩ লক্ষ। ১৯৪৭ খ্রীস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গে মাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যা নয়টি যথা (বন্ধনীর মধ্যে প্রতিষ্ঠার তারিখ)— কলিকাতা (১৮৫৭), বিশ্বভারতী (১৯৫১), যাদবপুর (১৯৫৫), বর্ধমান (১৯৬০), কল্যাণী (১৯৬০), নর্থবেঙ্গল (১৯৬২), রবীন্দ্র-ভারতী (১৯৬২), বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭৪) ও বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮৪)। এছাড়া, ইণ্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিউটও বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পেয়েছে। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ হ্রাসের জন্য ১৯৫০ খ্রীস্টাব্দে মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ গঠিত হয়। পর্ষদই এখন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা গ্রহণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে মাত্র স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষা গ্রহণ করে।
৷৷ চার ৷৷
শিক্ষার ক্ষেত্রে বামফ্রণ্ট সরকারের আমলে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা নীচের টেবিল থেকে বুঝতে পারা যাবে :—
বিদ্যায়তন | ১৯৭৭ সংখ্যা | ১৯৯২ সংখ্যা |
প্রাইমারী স্কুল | ৪০,৯৪১ | ৫১,০২১ |
মাধ্যমিক স্কুল | ৭,৮৭৪ | ৮,৪৪৩ |
উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল | ৬৯৫ | ১,৫৭৪ |
সাধারণ কলেজ | ২২৫ | ৩১৫ |
১৯৯২ সালে প্রাইমারী স্কুলে পাঠরত ছাত্র সংখ্যা ছিল ৯২,০০,০০০; মাধ্যমিক স্কুলে ৬৯,০৩,৭৫৪; উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে ২,৮৫,৮১১ ও কলেজ সমূহে ২,৬২,৭০০।
বামফ্রণ্ট সরকারের আমলে গ্রামীণ স্বায়ত্ব-শাসনকে আবার সঞ্জীবিত করা হয়েছে। বর্তমানে ১৬টি জিলা পরিষদ, ৩২৮টি পঞ্চায়েত সমিতি ও ৩,২৪২টি গ্রাম পঞ্চায়েত আছে। শহরাঞ্চলে আছে ১১২টি মিউনিসিপালিটি।
সেচের উন্নতির জন্য বামফ্রণ্ট সরকার তিস্তা পরিকল্পনা (১৯৮২) গ্রহণ করেছেন। এছাড়া, সেচের জন্য নদী থেকে জল-উত্তোলনের জন্য ২,৬৯৭টি স্কীম হাতে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া, আছে ৫,৭০১টি নলকূপ ও ৮,৫১,১৮২ হেকটর পরিমিত জমিতে জলসেচের জন্য সরকারী খাল। তড়িৎ-শক্তি উৎপাদনের জন্য সাওতালডি, ব্যাণ্ডেল, দূর্গাপুরে ও টিটাগড়ে নতুন শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রসমূহ স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু তড়িৎশক্তির নিষ্ক্রিয়তার ফলে তার সফল কৃষক বা জনগণ কেউই পাচ্ছে না। হলদিয়ায় নতুন বন্দর নির্মিত হয়েছে। কিন্তু কলকাতা বন্দরের হাল ক্রমশই খারাপ হচ্ছে। হুগলি নদীর ওপর দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। কলকাতাকে বেষ্টন করে চক্ররেল চালু করা হয়েছে। পাতাল রেলেও লোক চলাচল শুরু হয়ে গিয়েছে। এসব ছাড়া, ক্রীড়ামোদীদের সংবিধার্থে ইডেন গার্ডেন ও সল্ট লেকে স্টেডিয়াম নির্মিত হয়েছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনের জন্য ‘বাংলা আকাদেমী’ নামে এক নতুন সংস্থা স্থাপিত হয়েছে। কয়েকটা মঞ্চও স্থাপিত হয়েছে।