☼ অতুল সুর ☼
চোদ্দ শতকের বাঙালী
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাত্রে আকাশবাণী দিল্লি থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর ভাষণের কিছু অংশ দিয়েই শুরু করি। নেহেরুজি বলেছিলেন, “Our long subjection and the world war and its aftermath have made us inherit an accumulation of vital problems and today our people lack food and clothing and other necessaries and we are caught in a spiral of inflation and rising prices. We want to solve these problems wisely so that the burden on the common man grow less and their standard of living go up. “যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘আমাদের দীর্ঘদিনের অধীনতা ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ও তার অনুবর্তী ঘটনাসমূহের ফলে আমরা জীবনের অনেক পঞ্জীভূত গর্তের সমস্যার উত্তরাধিকারী হয়েছি। আজ আমাদের দেশের লোকের খাদ্য, বসন ও নিত্য আবশ্যকীয় দ্রব্য সামগ্রীর অভাব রয়েছে। আমরা মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যবৃদ্ধির নাগপাশে বদ্ধ হয়েছি। আমরা বিচক্ষণতার সঙ্গে এসব সমস্যার সমাধান করতে চাই, যাতে সাধারণ লোকের ক্লেশের বোঝা হ্রাস পায় ও তাদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পায়।’
৷৷ দুই ৷৷
সেই শুরু। নেহেরুর এই প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবায়িত করতেই ১৯৫১ সাল থেকে বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়ে চলেছে ভারতীয় অর্থনীতির ভাগ্যচক্র। তবুও কিন্তু আজ এই ৪৭ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও আমরা পেলাম না অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিয়েই আমরা আজ বড়াই করি।
আজ এতদিন পর যদি আমরা প্রশ্ন করি কেন এমন হল, কেন রাজনৈতিক স্বাধীনতার হাত ধরে এল না অর্থনৈতিক স্বাধীনতা? উত্তর পাব, ‘ভ্রান্ত নীতি’। প্রশ্ন উঠতেই পারে কোন জায়গায় ছিল ভুলটি? আসলে একটা ব্যাপার বুঝতে বোধহয় সাধারণ বুদ্ধির বেশি কিছু প্রয়োজন হয় না, তা হল যে-দেশের প্রতি পাঁচজন মানুষের চারজন থাকে গ্রামে, সে দেশে এযাবৎ সাতটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মোট খরচ হয়ে যাওয়া ৬৪৪২৭৬ কোটি টাকার মাত্র ১২% থেকে ১৪% প্রতিটি পরিকল্পনায় কৃষিতে খরচ হলে সামগ্রিকভাবে উন্নয়নের আশা করাটা নিতান্তই বাতুলতা হয়ে দাঁড়ায়। হ্যাঁ, ভুলটা ছিল ঠিক এক জায়গাটায়। কৃষিপ্রধান এই দেশের, যেখানে অধিকাংশ মানুষ গ্রামে থাকে, নির্ভর করে চাষবাসের ওপর, সেখানে পরিকল্পনার গোড়াতেই প্রয়োজন ছিল কৃষির ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপের। ভারতের কৃষি ব্যবস্থা যেহেতু অধিকাংশটাই বৃষ্টি নির্ভর, তাই বৃষ্টির পরিমাণ নিশ্চিত করাটা জরুরি ছিল প্রথমেই। আর এজন্যই প্রয়োজন ছিল আরও আরও বেশি গাছ লাগানোর। অর্থাৎ প্রথমেই দরকার ছিল বনমহোৎসবের। কিন্তু সেই বনমহোৎসবের প্রয়োজনীয়তাটাই ভারতের রূপকারেরা অনুভব করলেন স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে নয়, তিন-চার বছর পরে।
ওদিকে ভারতের কৃষি যেহেতু মরসুমি প্রকৃতির তাই চাষবাস ছাড়াও প্রয়োজন ছিল অন্য কোনও ক্ষেত্রের, যেখানে বছরের বাকী মাস যুক্ত থেকে আয়ের পথ নিশ্চিত করতে পারে গ্রামের মানুষ। তেমনই এক ক্ষেত্ৰ হল ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প। আদপে নজরই দেওয়া হয়নি এ ব্যাপারে। আধুনিকীকরণের কোনও প্রচেষ্টাই হয়নি এই কুটির শিল্পের। ফলে ক্রয়ক্ষমতা কমেছে গ্রামের মানুষের।
কৃষির উন্নতির জন্য প্রয়োজন ছিল সারের। তবে তা কখনই রাসায়নিক সার নয়। কারণ রাসায়নিক সার ব্যবহারে জমির দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হয়ে থাকে। তাই স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে উচিত ছিল আবর্জনা থেকে সার উৎপাদনের ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ রাসায়নিক সারের বদলে কম্পোস্ট সারের ওপর গরুত্ব দেওয়াটা অনেক অনেক বেশি দরকারি ছিল। কিন্তু তা হয়নি। এরই ফল ভুগতে হচ্ছে আজকে। আজ এতদিন পরে তাই নজর পড়েছে কম্পোস্ট সার উৎপাদনের দিকে।
৷৷ তিন ৷৷
অনেক জায়গায় শোনা যাচ্ছে সারা ভারত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য গ্রামের নাকি প্রভূত উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আসল কথা হল যেখানে রেলপথ রয়েছে কিংবা ইলেকট্রিক গ্রিড লাইন রয়েছে, উন্নতি হয়েছে সেই সব গ্রামেরই। ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামগুলি এখনও রয়ে গেছে আগের মতোই অনুন্নত অবস্থায়। সেখানে এখনও অধিকাংশ কৃষকই ভূমিহীন। তাঁরা অপরের জমিতে চাষবাস করে।
নিজেদের জমি তাঁদের কাছে আজও স্বপ্ন। কুটির শিল্পের আধুনিকীকরণের কণামাত্র সেখানে চোখে পড়ে না।
এতো গেল কৃষির কথা। ওদিকে শিল্পে ঘটে চলেছে আরেক ঘটনা। স্বাধীনতার দুই-তিন বছরের মধ্যেই শিল্পে দেখা দিয়েছে শ্রমিক বিরোধ। এই বিরোধ চাপা দিতে মজুরি বাড়ানো হয়েছে শ্রমিকের। ১৯৪৮ সালেই প্রথম কয়লা শিল্পের শ্রমিকেরা মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানায়। শ্রমিক বিরোধ এড়াতে বাড়ানো হয় মজুরি। সঙ্গে সঙ্গে এর প্রভাব অর্থনীতিতে না পড়লেও দিনের পর দিন এই ঘটনা চলতে থাকায় মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে ও উৎপাদন ব্যয় ক্রমাগত বেড়েছে। আর এর দরুণ বিদেশের বাজারে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারেনি ভারতীয় শিল্প। মার খেয়েছে রপ্তানি। টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে বাধ্য হয়ে রপ্তানি বৃদ্ধির তাগিদে। কিন্তু শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির আমদানি বন্ধ করা যায়নি বলে অবমূল্যায়নের সফল পাওয়া যায়নি।
যেসব ক্ষেত্রে বিকল্প পণ্য বাজারে এসেছে, সেসব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় আমরা দাঁড়াতে পারিনি। যেমন পাট শিল্পে দিনের পর দিন আমরা পিছিয়ে পড়েছি। তাই যে নেহেরু, একদিন আশার বাণী শুনিয়েছিলেন ভারতবাসীকে, তাঁর কন্যা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীই কিন্তু একদিন প্রায় বাধ্য হয়ে বলেছিলেন, “Freedom is not freedom if it does not mean a better deal and more opportunity for the poor and the depressed.”
কাজেই সেই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আজও আমাদের অধরা থেকে গেছে। তাই বলি রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের ৪৭ বছর পরে আজ ১৯৯৪ সালে দাঁড়িয়েও বুকে হাত দিয়ে কোনও সরকারি মুখপাত্রই দাবি করতে পারবেন না যে আমরা সাধারণ মানুষের বাস্তব আয় অন্তত ৪৭ পয়সাও বাড়াতে পেরেছি কিংবা দ্রব্যমূল্য কমাতে পেরেছি অন্তত ৪৭ পয়সা।