☼ অতুল সুর ☼
চোদ্দ শতকের বাঙালী
১৯৪৬ সালের নির্বাচনের পর হাসান শইদ সুরাবর্দী যখন নতুন সরকার গঠন করলেন, তখন তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করতে চাইলেন। কিন্তু মন্ত্রীসভায় কংগ্রেসের সদস্য সংখ্যা কি হবে, তাই নিয়ে মতানৈক্য হওয়ায় সে জোট আর হল না। এর ফলে উগ্র মুসলিম লীগ-পন্থী সুরাবর্দীর প্রতিপত্তি বেড়ে গেল। ১৯২৬ সালের দাঙ্গার তিনিই ছিলেন নাটের গুরু। এবার ক্ষমতা নিজ হাতে আসায় তিনি আবার একটা দাঙ্গা বাঁধাবার তালে রইলেন। অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য ১৯২৬ সালের দাঙ্গার মত এবারও তিনি কাজে লাগালেন কলকাতার নিম্নকোটির গরীব বেকার মুসলমান, অবাঙালী মুসলমান, সমাজবিরোধী মুসলমান ও সরকারী পুলিশকে। জিন্না যখন প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দিল, সুরাবর্দী তখন সঙ্গে সঙ্গে সে ডাকে সাড়া দিল। পুলিশকে নিষ্ক্রিয় রেখে নিজের দলকে তিনি ছেড়ে দিলেন কলকাতায় এক তাণ্ডবলীলা চালাবার জন্য।
৷৷ দুই ৷৷
দাঙ্গা শুরু হল ১৯৪৬ সালের ১৬ আগষ্ট তারিখে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিনে। হৈ-হল্লা করে মুসলমানরা এক মিছিল বের করল মানিকতলায়। মুখে তাদের মারমুখী বুলি— ‘লেকর রহেগা পাকিস্তান, লড়কে লেংগে পাকিস্তান।’ নির্বিবাদে তারা আক্রমণ করল নিরীহ হিন্দুদের ওপর। হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট লুঠ করল, মেয়েদের বে-ইজ্জত করল, আগুন লাগিয়ে বস্তিকে বস্তি পুড়িয়ে দিল। পথচারীদের ছুরি মেরে খুন করল। এসব বিশেষ করে ঘটল সেসব পাড়ায় যেখানে মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুর সংখ্যা ছিল কম। হিন্দুরাও এর পালটা জবাব দিল সে সব পাড়ায় যেখানে হিন্দুর তুলনায় মুসলমানের সংখ্যা কম!
সৈন্য, পুলিশ ও দমকল বাহিনীকে সুরাবর্দী আগে থাকতেই নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল। লালবাজারের কনট্রোল-রুমে বসে তিনি দাঙ্গার গতিপ্রকৃতির খবর নিতে লাগলেন। যখন দেখলেন যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে, এবং মুসলমানরাই বেশি মার খাচ্ছে, তখন কারফিউ জারী করা হল। কিন্তু শহর তখন সম্পূর্ণ ভাবে অরাজকতার কবলে গিয়ে পড়েছে। সকলেই নিরাপত্তার অভাব অনুভব করল। যানবাহন, কল-কারখানা সবই বন্ধ হয়ে গেল। চোরাগোপ্তা খুন-জখম সর্বত্রই হতে লাগল। ভয়ে লোক বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দিল। শহর অচল হয়ে যাচ্ছে দেখে সুরাবর্দী সামনে ও পিছনে পুলিশের গাড়ি ও নিজ গাড়িতে দেহরক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে শরৎ বসুকে নিয়ে শান্তিস্থাপনের উদ্দেশ্যে শহর পরিক্রমণে বেরুলেন। শান্তি খানিকটা স্থাপিত হল বটে, কিন্তু, হিন্দু মুসলমান এই উভয় সম্প্রদায়ের লোকই কেউ কারুকে আর বিশ্বাস করতে পারল না। হিন্দুরা মুসলমান পাড়ার ভেতর দিয়ে যাতায়াত বন্ধ করে দিল; অনুরূপভাবে মুসলমানরা আর হিন্দু পাড়ার ভেতর আসতে চাইল না। প্রথম পাঁচদিন দাঙ্গায় যে কতলোক হতাহত হয়েছিল, তার হিসাব আজ পর্যন্ত আমরা জানি না। তবে সরকারী মতে ৫০০০ জন নিহত, ১৫,০০০ জন আহত ও লক্ষাধিক লোক গৃহহীন হয়েছিল। বড়লাট লর্ড ওয়াভেলের মতে “The loss of life in Calcutta riots was far greater than at the battle of Plassey’. হতাহতদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যাই ছিল সবচেয়ে বেশি। এসময় আবদুল কালাম আজাদ ভয় করেছিলেন যে ১৬ আগস্ট ছুটির দিন ঘোষণা করলে গোলমাল হবে জেনেও প্রতিরোধের ব্যবস্থা না করা, ১৪৪ ধারা জারি ও সৈন্য ডাকতে অযথা বিলম্ব করা, এসবের প্রতিক্রিয়া বিহারে ও যুক্তপ্রদেশে প্রকাশ পাবে এবং সেসব জায়গায় সংখ্যালঘু, মুসলমানরাই মার খাবে। আজাদের ভয় সত্যেই পরিণত হয়েছিল। ২৩ আগস্ট এলাহাবাদে দাঙ্গা হল, ১ সেপ্টেম্বর বোম্বাইতে, ৯ সেপ্টেম্বর পূর্বে বঙ্গে, ১৪ সেপ্টেম্বর পুনরায় বোম্বাই ও ঢাকায়, ১৫ সেপ্টেম্বর আহমেদাবাদে, ২৩ সেপ্টেম্বর আবার কলকাতা ও ঢাকায়।
৷৷ তিন ৷৷
তামাম দুনিয়ার লোক সেদিন হতচকিত হয়ে গিয়েছিল নোয়াখালির বীভৎস ঘটনায়। বেঙ্গল প্রেস অ্যাডভাইসরী কমিটি তাঁদের প্রতিবেদনে লিখলেন— ‘উন্মত্ত জনতা মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম আক্রমণ করছে, লুটপাট করছে, হত্যা ও অগ্নিসংযোগ চলেছে…ঘটনা ঘটেছে নোয়াখালি সদর ও ফেনী মহকুমার ২০০ বর্গ মাইল জুড়ে। মনে হয় এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট পূর্ব পরিকল্পিত।’ এছাড়া, ব্যাপকহারে চলেছিল ধর্মান্তরকরণ। একজন প্রত্যক্ষদশী সাংবাদিক মধুসূদন চক্রবর্তী সেদিনকার ভয়াবহ ঘটনাসমূহ স্মরণ করে লিখেছেন—‘সুরাবর্দী সরকারের সাহায্যপুষ্ট নোয়াখালির মোল্লা-মৌলানারা গোলাম সানোয়ারের নেতৃত্বে কিভাবে গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস করেছে, নারীহরণ, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন এবং হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, অগ্নিসংযোগে ঘরবাড়ি পুড়িয়েছে, তা অবর্ণনীয়। শ্বেতাঙ্গললনা মুরিয়েল লেস্টার উপদ্রুত অঞ্চল সফরান্তে ক্ষুব্ধভাবে প্রশ্ন তুলেছিলেন— মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই কলঙ্কিত অধ্যায়ের জন্য দায়ী কে? কে-ই বা গ্রাম্য মুসলমানকে উস্কানি দিয়ে নিরীহ হিন্দুদের ঘরবাড়ি পোড়ানোর জন্য স্টিরাপ পাম্প সরবরাহ করেছিল। কে-ই বা তাদের অস্ত্রশস্ত্রের যোগান দিয়েছিল? যিনি এসবের জন্য দায়ী, তিনি তখন ঘটনাস্থলে না গিয়ে দার্জিলিং চলে গেলেন গভর্ণরের সঙ্গে সেখানে মিলিত হওয়ার জন্য। সুরাবর্দি’র এই আচরণে বিস্মিত হয়ে ‘স্টেটস্ম্যান’ পত্রিকা লিখল—‘The one remains at Darjeeling, the other has gone to join him there’. ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকা আরও লিখল— ‘মিলিটারী ও পুলিশকে কিছুই তোয়াক্কা না করে গুণ্ডারা তার কাটছে, পুল ভাঙছে, খাল বন্ধ করে দিচ্ছে, রাস্তায় বাধা সৃষ্টি করছে।’
নোয়াখালির এই সব ভয়াবহ ঘটনার খবর যখন দিল্লীতে গিয়ে পৌঁছাল, গান্ধীজী তখন কৃপালনীকে তথায় গিয়ে সরেজমিনে খবরাখবর নিতে এবং তাকে সব জানাতে বললেন। কৃপালনীর নিকট থেকে বিবরণ শুনেই মহাত্মা দিল্লী থেকে নোয়াখালির পথে যাত্রা করেন।
১৯৪৭ সালের ২০ নভেম্বর তারিখে গান্ধীজী তাঁর একান্ত সচিব হিসাবে অধ্যাপক নির্মল কুমার বসুকে সঙ্গে নিয়ে নোয়াখালি অভিমুখে যাত্রা করলেন। তাঁর এই যাত্রাকে ‘মানবতার এক শ্রেষ্ঠ অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। মহাত্মা গিয়ে দেখলেন এক করুণ দৃশ্য। চতুর্দিকেই হিন্দুদের ওপর বর্বরোচিত অত্যাচারের নিদারুণ নিদর্শন। নিজ নিজ গ্রামে হিন্দুরা ভয়ার্ত অবস্থায় বন্দী হয়ে আছে মুসলমান গুণ্ডাদের দ্বারা। হিন্দুদের মনে ভয় ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। বিভিন্ন গ্রামে মেয়েরা শাঁখা-সিঁদুর পর্যন্ত পড়তে ভয় পাচ্ছে। গান্ধীজী দেখলেন, হিন্দুদের মন থেকে ভয় দূর করতে না পারলে, কোন রূপ শান্তিপূর্ণ বাতাবরণ সৃষ্টি করা অসম্ভব। এই বাতাবরণ সৃষ্টির জন্য তিনি ‘করেংগে ইয়া মরেংগে’ নীতি অবলম্বন করলেন। হয় হিন্দু-মুসলমান যাতে শান্তি ও সৌহার্দ্যের সঙ্গে একত্রে বাস করতে পারে সেই আবহাওয়া সৃষ্টি করবেন, আর তা নয়তো নিজের প্রাণ দেবেন। তিনি ভাবলেন সত্য ও অহিংসা পরীক্ষার, এই তো উপযুক্ত সময়। গান্ধীজীর সঙ্কল্প সেদিন সার্থক হয়েছিল। নোয়াখালির শ্মশানশিবিরে তিনি কল্যাণময় শিবরূপে ‘অতন্দ্র প্রহরী’ হয়ে রইলেন। হিন্দুদের মন থেকে সেদিন ভয় কেটে গেল।
ভয় সাময়িকভাবে কাটল বটে, কিন্তু, তার কোন চিরস্থায়ী ফল হল না। যে বিষবৃক্ষ স্যার আবদার রহিম ও তাঁর জামাতা এচ. এস. সুরাবর্দী রোপণ করেছিলেন, তা জীবিতই রইল। হিন্দু-মুসলমান উভয় পক্ষই কেউ কারুকে আর বিশ্বাস করতে পারল না। বিদ্বেষ ও সংশয় পরস্পরের মনকে আচ্ছন্ন করল। স্বাধীনতা লাভের শর্ত হিসাবে দেশ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার পরও সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষ রোপণের পূর্বেকার সৌহাদ্যপূর্ণ পরিস্হিতি আর ফিরে এল না।