» » বাঙালী আরও হারিয়েছে তার স্বয়ম্ভরতা

বর্ণাকার

অতুল সুর

চোদ্দ শতকের বাঙালী

বাঙালী আরও হারিয়েছে তার স্বয়ম্ভরতা

বেশিদিন আগের কথা নয়। মাত্র দুশো বছর আগেও বাঙলাকে ‘সোনার বাঙলা’ বলা হত। তার কারণ, বাঙলাই ছিল ধনোৎপাদনের উৎস। কৃষিপ্রধান দেশের অর্থনীতিতে বাঙলাই ছিল প্রথম। খনিজ পদার্থ উৎপাদনেও বাঙলার ছিল সেই ভূমিকা। নিত্যপ্রয়োজনীয় নানারকম শিল্পজাত পণ্য উৎপাদনেও বাঙলা ছিল তাই। এক কথায়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাঙালি ছিল স্বয়ম্ভর। অর্থনৈতিক উৎপাদনে বাঙালির ছিল একাধিপত্য।

কালের আবর্তনে বাঙালির আজ আর সেই গৌরবময় অধিকার নেই। এমনকি নিত্য আবশ্যকীয় পণ্যের জন্য বাঙালি আজ পরমুখাপেক্ষী।

বিগত দুশো বছরের মধ্যে ধনোৎপাদনের ক্ষেত্রে বাঙালি ক্রমশ হটে গিয়েছে রাজস্থানীদের ও বিভিন্ন প্রদেশের লোকদের আগমনে। তারাই আজ বাঙলার ধনোৎপাদন ক্ষেত্রের মহাপ্রভু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দুশো বছর আগে বাঙলাকে যে ‘সোনার বাঙলা’ বলা হত তার কারণ ধনোৎপাদনে বাঙলাই ছিল ভারতে অদ্বিতীয়। নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বাঙলা নিজের ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যেই উৎপন্ন করত। নিজের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বাঙলা উদ্বৃত্ত সম্পদ বিদেশে রপ্তানি করত। এ পরিস্থিতিটা সুপ্রাচীন কাল থেকেই বলবৎ ছিল। চিনি, মশলা, সরিষার তৈল, কাপড় ইত্যাদিতে বাঙলা স্বয়ম্ভর ছিল।

খ্রীষ্ট-পূর্ব কালের গ্রীস দেশীয় লেখক ইলিয়াস ও লুকেনের রচনা থেকে আমরা জানতে পারি যে ধান চাষের দ্বিগুণ তুলার চাষ হত। খনার বচনেও আমরা এর সমর্থন পাই। সরিষার চাষও প্রাচীন বাঙলায় খুব ব্যাপকভাবে হত। এটা অবশ্য খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কেননা অনাদিকাল থেকে বাঙালী সরিষার তৈলের সাহায্যেই রন্ধনক্লিয়া সম্পন্ন করে আসছে। সন্ধ্যাকর নন্দীর (খ্রীস্টীয় একাদশ শতাব্দী) ‘রামচরিত’ থেকে আমরা জানতে পারি যে বরেন্দ্র দেশে এলাচের চাষ খুব ব্যাপকভাবে হত। অনরূপভাবে অন্যান্য যে সব পণ্যের চাষ হত, তার অন্যতম ছিল আদা, লঙ্কা, লবঙ্গ, দারুচিনি প্রভৃতি। বাঙলাদেশে এই সকল মসলা জাতীয় পণ্যের ব্যাপক চাষের কথা শুধু যে সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর ‘রামচরিত’-এ বলে গিয়েছেন তা নয়। তাঁর বহ পূর্বে টলেমি, ‘পেরিপ্লাস’-এর নাবিক-গ্রন্থকার ও অন্যান্য বৈদেশিক লেখকরাও বলে গিয়েছেন। বিশেষভাবে রোম সাম্রাজ্যে বাঙলার লঙ্কার বিশেষ আদর ছিল, এবং এক সের লঙ্কার দাম ছিল ৩০ স্বর্ণ দিনার। বাঙলার মসলিন ও নলেন গুড় রোম সাম্রাজ্যে বিশেষ সমাদৃত হত। কালিদাসও তাঁর ‘রঘু বংশ’-এ বাঙলায় ইক্ষু চাষের ব্যাপকতার কথা বলেছেন।

৷৷ দুই ৷৷

বাঙলার এই আর্থিক ঋদ্ধি মধ্যযুগেও বজায় ছিল। বস্তুত বাঙলার আর্থিক ঋদ্ধিতে চমৎকৃত হয়ে মধ্যযুগের বৈদেশিক পর্যটকরা বাঙলা দেশকে ‘ভূস্বর্গ” বলে অভিহিত করে গেছেন। সমসাময়িক বাঙলা সাহিত্য থেকেও আমরা বাঙলার বিপুল বৈষয়িক ঐশ্বর্যের কথা জানতে পারি। বাঙলার আর্থিক সম্পদ প্রতিষ্ঠিত ছিল তার কৃষি ও শিল্পের ওপর। নদীমাতৃক বঙ্গভূমি উৎপন্ন করত প্রচুর পরিমাণ কৃষিজাত পণ্য। এই সকল কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে প্রধান ছিল চাল, তুলা, ইক্ষু, তৈলবীজ, সুপারি, আদা, লঙ্কা ও নানাবিধ ফল। পরে পাট ও নীলের চাষও প্রভূত পরিমাণে হত। শতকরা ৯০ জন লোক কৃষিকর্মে নিযুক্ত থাকত। কৃষিকে ‘হীনকর্ম’ বলে কেউ মনে করত না। এমন কি ব্রাহ্মণরাও কৃষিকর্ম করতে লজ্জাবোধ করত না। সেকথা উয়ান চুয়াঙ বলে গেছেন। চণ্ডী-মঙ্গলের কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম লিখে গিয়েছেন যে, তাঁর সাতপুরুষ কৃষিকর্মে নিযুক্ত ছিলেন।

শিল্পজাত পণ্যের মধ্যে ছিল কার্পাস ও রেশমজাত বস্তু। সূক্ষ্ম বস্ত্র প্রস্তুতের জন্য বাঙলার প্রসিদ্ধি ছিল যুগ যুগ ধরে। দেশ-বিদেশে বাঙলার মসলিনের চাহিদা ছিল। এই জাতীয় বস্ত্ৰ এত সূক্ষ্ম ছিল যে একটি ছোট নস্যাধারের মধ্যে বিশ গজ কাপড় ভরতি করা যেত। বাঙলার শর্করার প্রসিদ্ধিও সর্বত্র ছিল। চিনি তৈরির জন্য বাঙলার নিজস্ব পদ্ধতি ছিল। সে চিনি সাদা ধবধবে হত। এ ছাড়া, বাঙলায় প্রস্তুত হত শঙ্খজাত নানারূপে পদার্থ, লৌহ, কাগজ, লাক্ষা, বারুদ ও বরফ। বীরভূমের নানা স্থানে ছিল লৌহপিণ্ডের আকর। তা থেকে লৌহ ও ইস্পাত তৈরি হত। বীরভূমের যে সকল স্থানে লৌহ ও ইস্পাতের কারখানা ছিল সেগুলি হচ্ছে দামরা, ময়সারা, দেওচা ও মহম্মদ নগর। এই সকল লোহা দিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদ পর্যন্ত কলকাতা ও কাসিমবাজারে কামান তৈরি হত। বলা বাহুল্য, এই লোহা ও ইস্পাত প্রস্তুতের জন্য বীরভূমের কারিগরগণ নিজস্ব প্রণালী অবলম্বন করত। বরফ তৈরির জন্যও বাঙলার নিজস্ব প্রণালী ছিল।

কিন্তু আজকের পরিস্থিতি এর বিপরীত দাঁড়িয়েছে। এসব নিত্যনৈমিত্তিক জিনিস আজ বাঙলাকে অন্যপ্রদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। ফলে দরিদ্র বাঙালীর (বাঙলার ৪৬ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে) অর্থ আজ অন্যপ্রদেশকে সমৃদ্ধ করছে!

কারখানা-শিল্প স্থাপনের পরে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের উদ্দীপনায় যে কয়েকজন উদ্যোক্তা কর্মবীরের (যথা রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, এন. সি. সরকার, করণোকুমার কর, রত্নবন্ধু দত্ত, ফণিন্দ্রনাথ গুপ্ত, সচ্চিদানন্দ ভট্টাচার্য, সতীশচন্দ্র রায়চৌধুরী, হেমেন্দ্র দত্ত, আলামোহন দাস, বীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, রণবীর চৌধুরী, অভিজিৎ সেন প্রমুখ) প্রয়াসে যে ক’টি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, তা আজ বাঙালীর হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। ছিনিয়ে নিয়েছে হয় রাষ্ট্র, নয়ত অবাঙালীরা। বাঙালির হাতে বড় কারবার যে নেই, তা নয়। তবে সেগুলো রাষ্ট্রের কর্ণধারদের আত্মীয়স্বজনের হাতে, নয়ত তাদের বেনামদারদের হাতে। এছাড়া, বাঙলার সমস্ত বড় শিল্প অবাঙালীদের হাতে—হয় আবাসিক বা অনাবাসিকদের হাতে। এসব প্রতিষ্ঠানে বাঙালীর মাত্র একটাই ভূমিকা আছে। সেটা হচ্ছে মজুর, করণিক বা শ্রমিকের ভূমিকা। ব্যবসাক্ষেত্রে অবশ্য কিছু বাঙালী এখনও টিকে আছে, তবে তারা অবাঙালীর প্রতিযোগিতায় ধুকছে। বস্তুত আর্থিক আঢ্যতার ক্ষেত্রে বাঙালী আজ প্রায় অবলুপ্তির পথে।

শিক্ষাক্ষেত্রেও আজ বাঙালির অধঃপতন লক্ষণীয়। আচার্য জগদীশচন্দ্র, প্রফুল্লচন্দ্র, মেঘনাদ সাহা, সতেন্দ্রনাথ বসুর দেশের ছেলেরা আজ উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে বা অন্য প্রদেশে যাচ্ছে। কেন? বাঙালীর এ সম্বন্ধে চিন্তা করার দরকার।

৷৷ তিন ৷৷

বাঙালীকে একজন ‘আত্মঘাতী’ জাতি বলেছেন। বাঙালীর বসনের দিকে তাকালেও তাই মনে হয়। প্রাচীনারা অবশ্য এখনও শাড়ি পরেন; কিন্তু নবীনাদের পাজামা, চুরিদার ও সালোয়ার পরার প্রবণতাই লক্ষিত হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী কালে পুরুষরা ধুতি পরিহার করে প্যাণ্ট ও হাফহাতা সার্ট পরছে। বাঙালীর নিজম্ব চটিজুতাও আজ লুপ্ত হয়ে গেছে। তার স্থান অধিকার করেছে রবারের হাওয়াই স্লিপার। বস্তুত পোষাক-পরিচ্ছদের দিক দিয়ে বাঙালী আজ এক বর্ণ চোরা জাতে পরিণত হয়েছে। বাঙালীর যে এক নিজস্ব ঐতিহ্য ছিল ও বৈষয়িক জীবনে একদিন সে স্বয়ম্ভর ছিল, তা আমরা ভুলেই গিয়েছি। আমরা ক্রমশ এক জারজ সংস্কৃতি ও বৈষয়িক জীবনচর্যার দাস হয়ে পড়ছি।