☼ অতুল সুর ☼
চোদ্দ শতকের বাঙালী
পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে পর্যন্ত বাঙালীর গৃহস্থালীতে ধামা, চুপড়ি, জাঁতা, কুলো, ধুনুচি, ঢেঁকি, হাতপাখা, হামানদিস্তা ইত্যাদি ব্যবহৃত হত। বাসন-কোসনের মধ্যে প্রভূত পাথরের ও কাঁসার বাসন ছিল। পিতলের বাসনও ছিল যেমন পিতলের ঘড়া, পিলসূজ, প্রদীপ, রেকাবি ইত্যাদি। মাটির উনুনে মাটির হাঁড়িতে ভাত-ডাল রান্না হত। রান্নাঘরে দুরকম উদ্দন থাকত—আমিষ ও বিধবাদের জন্য নিরামিষ রান্নার জন্য। এখন আর মাটির হাঁড়িকুড়িতে রান্না করা হয় না। বাসন-কোসনও পাথর- কাঁসা-পিতলের হয় না। অ্যালুমিনিয়াম ও স্টেনলেস স্টীল তাদের জায়গা দখল করেছে। রান্না-বান্নাও আর মাটির উনুনে হয় না। কেরোসিনের স্টোভ, ‘জনতা’, ইলেকট্রিক বা গ্যাস উনুনে রান্না হয়।
৷৷ দুই ৷৷
রান্না ভাত কাপড়ে ঠেকলে কাপড় ‘সকড়ি’ হয়ে যেত। আবার কাপড় বদলাতে হত। কোনো জায়গা ‘সকড়ি’ হয়ে গেলে ন্যাতা-গোবর দিয়ে সে-জায়গাটা শুদ্ধ করা হত। লোক মেঝের ওপর আসন বা কাঠের পিঁড়ির ওপর বসে খেত। খাওয়া হয়ে গেলে সেই জায়গাটা ন্যাতা-গোবর দিয়ে শুদ্ধ করে ফেলত। এখন ‘সকড়ি’ সংস্কার ও ন্যাতা-গোবর উঠে গেছে। এ-বেলার রান্না রেফরিজেরেটারে তুলে রাখা হয়, রাত্রে বা পরদিন খাবার জন্য। তাতে রেফরিজেরেটার ‘সকড়ি’ হয় না। এখন মানুষ মাটির ওপর আসন বা পিঁড়ি পেতে বসে খায় না। এখন চেয়ারে বসে টেবিলে খায়। এক্ষেত্রেও টেবিল ‘সকড়ি’ হয় না। তাছাড়া, মেয়েরা আর শিলনোড়া নিয়ে বাটনা বাটতে বসে না। এখন গুঁড়ো মশলাতেই কাজ সেরে ফেলে। একই উনানে আমিষ ও নিরামিষ রান্না হয়। বিধবারা স্বচ্ছন্দে তা খায়। এক কথায় আগেকার দিনের শুচিতা ও সকড়ি সংস্কার এখন বিলপ্ত হয়ে গেছে।
লোকে আগে গামছা পরে গাড়ু হাতে করে পায়খানায় যেত। পায়খানা করবার পর গামছাটাকে কেচে ফেলত। এখন আর ওসব বালাই নেই। লোকে পরিহিত কাপড় পরেই পায়খানায় যায়। গাড়ুও বিলপ্ত হয়ে গেছে। পায়খানা করবার পর ‘হাতেমাটি’ করার রীতিও এখন আর নেই। পায়খানায় গেলে কাপড় যে নোংরা ও অপবিত্র হয়ে যায়, এ-বোধ এখন আর নেই। অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে আমাদের ব্যবহারিক জীবনে এসব পরিবর্তন ঘটছে।
মেয়েরা আগে হাতে কাঁচের চুড়ি ও কপালে কাঁচপোকার টিপ পরতে ভালবাসত। এখন হাতে রিস্ট-ওয়াচ ও কপালে সিঁদুরের টিপ পরে। মেয়েদের পায়ে মল বা তোড়াও উঠে গেছে। মেয়েরা এখন আর বুক পর্যন্ত ঘোমটা দেয় না। আগে মেয়েরা পায়ে জুতা পরত না। এখন জুতা পায়ে দেওয়া একটা মর্যাদার চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিজাত ও মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা আগে পথে বেরত না। এখন তারা একা-একাই সিনেমা-থিয়েটার ও বাজার-হাটে যাচ্ছে। অনেকে আপিসেও যাচ্ছে চাকরির কারণে।
৷৷ তিন ৷৷
বাড়ির ভেতরেরও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। বাড়ির ভেতরে সেকালে মেয়েদের দুটো বড় কাজ ছিল—পান সাজা ও প্রদীপের সলতে পাকানো। এ-দুটোর কোনটাই এখন নেই। বাড়ির ভেতর মেয়েরা ঘোমটা দিয়ে ঘুরে বেড়াত। ভাশুর-শ্বশ্বর বা অন্য কোন গুরুজন সামনে এসে পড়লে সরে দাঁড়াত। ভাশুর ও মামাশ্বশুরের সঙ্গে ছোঁয়াছুয়ি হয়ে গেলে ‘ধান-সোনা’ উৎসর্গ করতে হত। এখন মেয়েরা স্বচ্ছন্দে ভাশুর ও মামাশ্বশুরের সঙ্গে কথা বলে, একসঙ্গে বসে খায় ও গা ঘেঁষাঘেঁষি করে সিনেমা-থিয়েটারে বসে।
প্রতি বাড়িতেই একটা করে আঁতুর ঘর থাকত। সেখানেই বাড়ির বৌ-ঝিরা প্রসব করত। মেয়েদের একমাস অশুদ্ধ বা অপবিত্র অবস্থায় আতুর ঘরে থাকতে হত। একুশ দিন বা একমাস পরে ষষ্ঠীপূজা না হওয়া পর্যন্ত শুদ্ধ হত না। এখন মেয়েরা হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে প্রসব করে বলে ষেটেরা পূজা, চারকৌড়ে, আটকৌড়ে ইত্যাদি উঠে গেছে।
সেকালে কোন বাড়িতে ঝি-চাকর ঢুকলে, আজীবন তারা সেই বাড়িতেই থাকত এবং বাড়ির লোকেরা তার সঙ্গে আত্মীয়তা করে তাকে ‘মাসী’, ‘দিদি’ ইত্যাদি বলে সম্বোধন করত। এখন লোকে তাদের ‘কাজের লোক’ বলে এবং তাদের নাম ধরে ডাকে।
৷৷ চার ৷৷
এছাড়া, বাঙালীর ব্যবহারিক জীবনে আরও অনেক সংস্কার ছিল। সেকালের লোক ভিখারীকে কখনও ফিরিয়ে দিত না। তবে অশৌচকালে ভিক্ষা দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল। ভিক্ষা দিতে গিয়ে মেয়েরা কখনও দু-চার কণা চাল মাটিতে ফেলত না। তাদের বিশ্বাস ছিল যে ভিক্ষার চাল মাটিতে পড়লে, সে কন্যাসন্তান প্রসবিনী হবে। সেকালে লোক সকালে কৃপণ বা নিঃসন্তান লোকের নাম করত না। তাদের বিশ্বাস ছিল যে ওরূপ লোকের নাম করলে সেদিন তাদের অন্ন জুটবে না। যাত্রার সময় কেউ হাঁচলে, সেটাকে অমঙ্গল জ্ঞান করত এবং পুনরায় ফিরে এসে অপেক্ষা করে তারপর যাত্রা করত। তাছাড়া, লোক বিশ্বাস করত যে বাঁ চোখ কাঁপা, বা বাঁ অঙ্গ যদি নাচে, তা হলে তার ক্ষতি হবে। টিকটিকি পড়াতেও বিশ্বাস করত। আরও বিশ্বাস করত যে মঙ্গলবারে বৃষ্টি নামলে তিনদিন, আর শনিবারে নামলে সাতদিন বৃষ্টি হবে। খেতে খেতে ‘বিষম’ লাগলে বলত, কেউ তার নাম করছে। এছাড়া বৃহস্পতিবারে কেউ লেনদেন করত না। বৃহস্পতিবারের বারবেলাটাও সব কাজে অশুভ বলে মনে করত। শনিবারে, মঙ্গলবারে ও জন্মবারে কখনও নববস্ত্র পরিধান করত না! জন্মবারে বা জন্মমাসে কোন ক্ষৌরকর্ম বা কেশকর্তন করত না। মেয়েরাও ছেলের জন্মবারে বা জন্মমাসে নতুন কাপড় ‘ভাঙত’ না বা নতুন হাঁড়ি ‘কাড়তো’ না। রাত্রিকালে মেয়েরা চুল বাঁধত না, বা সিঁদুর পরত না; কিংবা আয়নায় মুখ দেখত না। বলত, সেরূপ করলে কুলটা হতে হবে। দাঁড়কাক ডাকলে, সেটা খুব অমঙ্গলের লক্ষণ বলে মনে করত। দোকানীরা রাত্রে সূঁচ বেচত না। রাত্রে কালপেঁচা ডাকলে, সেটাকেও অমঙ্গলের লক্ষণ বলে মনে করত। এছাড়া বারবেলা, কালবেলা ইত্যাদিতে কোন শুভকর্ম করত না। একাদশীতে সধবা মেয়েদের মাছ খাওয়া অবশ্য কর্তব্য ছিল। বিশ্বাস করত যে একাদশীতে মাছ না খেলে সে বিধবা হবে। ওইদিন মেয়েরা পায়ে আলতাও পরত। স্বামীর আগে মেয়েরা কখনও অন্নগ্রহণ করত না। স্বামী বা কোন গুরুজনের নাম উচ্চারণ করত না। নামের প্রথম বর্ণটা পরিবর্তন করে তাদের নাম করত। কেউ এক চোখ দেখালে লোকে ভাবত অপরের সঙ্গে ঝগড়া হবে। এর প্রতিরক্ষার্থে তাকে দু’চোখ বন্ধ করে দেখাতে বলা হত।
৷৷ পাঁচ ৷৷
বাঙালী সমাজের রূপান্তরটা মাত্র নাগরিক সভ্যতাকেই আচ্ছন্ন করেনি, গ্রামীণ সভ্যতাকেও। যারা প্রথম গ্রাম থেকে শহরে বাস শুরু করেছিল, তারা গ্রামকেই শহরে তুলে নিয়ে এসেছিল। আজ তার বিপরীত প্রক্রিয়া চলছে। আজ গ্রামের লোকরাই শহরকে গ্রামে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। নাগরিক সভ্যতার চটক আজ গ্রামের লোকের মনকে আচ্ছন্ন করেছে। ফলে বাঙালী তার স্বকীয় সমাজ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। কিসের বিনিময়ে? পাশ্চাত্য সভ্যতার মোহের বিনিময়ে। সে সভ্যতা ভাল কি খারাপ তার বিচার আজ আর এখানে করব না।