☼ অতুল সুর ☼
চোদ্দ শতকের বাঙালী
দেশ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার পর পূর্ব বাঙলা পূর্ব-পাকিস্তান নাম গ্রহণ করে। কিন্তু গঠিত হওয়ার সময় থেকেই পূর্ব-পাকিস্তান পশ্চিম-পাকিস্তানের শোষণ নীতির লীলাক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়। তাদের নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত স্বাতন্ত্র্যের জন্য পূর্ব বাঙলার জনগণ এটা বরদাস্ত করতে পারল না। তারা বেশি ক্ষুব্ধ হল যখন সরকারী কর্মক্ষেত্রে, ও সৈন্যবাহিনী, নৌবহর ও বিমান বাহিনীতে পশ্চিম-পাকিস্তানিদেরই প্রাধান্য দেওয়া হল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতিরাই আধিপত্য করতে লাগল। এর ফলে পূর্ব-বাঙলার মানুষ হতাশায় আক্রান্ত হয়ে পশ্চিম-পাকিস্তানের বিরোধী হয়ে উঠল।
পূর্ব-বাঙলার জনগণের এই বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব চরমে উঠল যখন পশ্চিম-পাকিস্তান পূর্ব বাঙলায় রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে বাংলার পরিবর্তে উর্দু ব্যবহারের অভিযান শুরু করল। পূর্ব-বাঙলার বুদ্ধিজীবী মহল এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠল। পশ্চিম-পাকিস্তানি সরকার তখন বুলেটের সাহায্যে এই প্রতিবাদ দমন করবার চেষ্টা করল। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হল। ১৯৫২ খ্রীস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারী তারিখে পশ্চিম-পাকিস্তান সরকার উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে সম্মত হল।
৷৷ দুই ৷৷
সূচনায় মুসলিম লীগের অধিনায়কত্বে যে সরকার পূর্ব বাঙলায় কায়েম করা হয়েছিল, তা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত দলের কাছে ১৯৫৪ সালে পর্যুদস্ত হল। আওয়ামী দলের নেতৃত্বে গঠিত নতুন সরকারকে ১৯৫৯ সালে উচ্ছেদ করা হয়, যখন জেনারেল আয়ুব খান ক্ষমতা গ্রহণ করে পাকিস্তানের উভয় অংশকে সামরিক শাসনাধীনের অন্তর্ভূক্ত করেন।
১৯৬৯ খ্রীস্টাব্দের ২৫ মার্চ তারিখে রাষ্ট্রপতি আয়ুব খানকে আসনচ্যুত করে জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করে পাকিস্তানের শাসক হন। পরে ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রপতির পদ অধিকার করেন।
১৯৭০ খ্রীস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে পূর্ব-বঙ্গে এক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের স্বাধিকার সম্বন্ধে ছয়-দফা সনদ সম্বন্ধে গণভোট নেওয়া হয়। সর্বত্রই আওয়ামী দলের জয় জয়কার হয়। এর ফলে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ সংখ্যা-গরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনের পর শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের কয়েক দফা বৈঠক ও আলোচনা হয়। এসব বৈঠক ও আলোচনার ফলে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন যে ১৯৭১ খ্রীস্টাব্দের ৩ মার্চ তারিখে ঢাকায় জাতীয় সংবিধান পরিষদের প্রথম অধিবেশন হবে। কিন্তু ১ মার্চ তারিখে ইয়াহিয়া খান হঠাৎ ওই অধিবেশন অনিশ্চিতকালের জন্য মুলতুবী রাখা ঘোষণা করেন। তারপর ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে শেখ মুজিবর রহমনের সঙ্গে আলোচনায় প্রবৃত্ত হন। কিন্তু ২৫ মার্চ তারিখে তিনি শেখ মুজিবর রহমানকে বন্দী করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যান। এরই পদাঙ্কে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর দ্বারা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় এক নির্মম হত্যাকাণ্ড। আমেরিকার ‘টাইম’ পত্রিকায় ডন কগিন লেখেন— ‘পাক সৈন্যবাহিনী এ-সময় শ্লোগান দেয় ‘মারো শালা জারজ সন্তানদের মারো’ (‘kill the bastards’)। ‘একমাত্র ২৫ তারিখের রাত্রে দশ হাজার লোককে হত্যা করা হয়। বুদ্ধিজীবীদের মেরে ফেলা হয়, মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় ও অগণিত সরকারী ও বেসরকারী ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয়।’ (‘টাইম’ পত্রিকা)। এই নারকীয় অত্যাচার ও নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য প্রায় দশ হাজার শান্তিপ্রিয় পূর্ববঙ্গের নাগরিক ভারতে এসে আশ্রয় নেয়।
৷৷ তিন ৷৷
সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববঙ্গের জনগণ মুক্তি সংগ্রাম শুরু করে দেয়। ৩১ মার্চ তারিখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সংগ্রামীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে বলেন যে এই ঐতিহাসিক যুদ্ধে সংগ্রামীদের জয় নিশ্চিত। তিনিই সংগ্রামী পূর্ববঙ্গের নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’ যা আজও রয়ে গিয়েছে।
মুক্তিকামী সংগ্রামীরা অঞ্চলের পর অঞ্চল সৈন্যবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করে। এই সময় পাক সৈন্যবাহিনী ভারতীয় সীমান্তের মধ্যে প্রবেশ করে ভারতীয় নাগরিকদের ওপরও অত্যাচার শুরু করে। ১৯৭১ খ্রীস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর তারিখে পাক বিমানবাহিনী ভারতের অন্তর্ভূক্ত বয়রা গ্রামে এসে বোমা নিক্ষেপ করে। এই সময় তারা পশ্চিম ভারতের ছয়টি রাজ্যের মধ্যেও বিমান আক্রমণ করে। এদের প্রতিহত করবার আদেশ দেওয়া ছাড়া ভারতের আর কোন গত্যন্তর ছিল না। পাকিস্তান এই সময় আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৪ দিন ধরে প্রচণ্ড লড়াই চলে। পাকিস্তান অঞ্চলের পর অঞ্চল হারাতে থাকে। ভারতের সার্বিক জয় হয়। ১৪ ডিসেম্বর তারিখে পূর্ব বঙ্গে অবস্থিত পাক সৈন্যবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। দুদিন পরে পশ্চিম ভারতের লড়াইও স্তব্ধ হয়। বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয়। ঢাকা সে রাষ্ট্রের রাজধানী হয়। মুজিবর রহমানকে এই নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। তাঁকে বন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং তিনি সরাসরি লণ্ডন চলে যান। ১০ জানুয়ারী তারিখে তিনি বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। বাংলাদেশকে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হয়। এই উদ্দেশ্যে যে নতুন সংবিধান রচিত হয়, তাতে সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যবস্থা করা হয়। এই সংবিধান ১৯৭২ খ্রীস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর তারিখ থেকে বলবৎ হয়।
৷৷ চার ৷৷
১৯৭৫ খ্রীস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারী তারিখে শেখ মুজিবর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসাবে কর্মভার গ্রহণ করেন এবং এক উপদেষ্টা সংসদের সহায়তায় শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। বাংলাদেশ কৃষি-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (BKSAL) ব্যতীত আর সমস্ত রাজনৈতিক দল রদ করা হয়। কিন্তু ওই ১৯৭৫ খ্রীস্টাব্দের ১৫ আগস্ট তারিখে সংসদীয় মন্ত্রীমণ্ডলীর সদস্য খোন্দকার মুস্তাক আহমেদের নেতৃত্বে এক দল মুজিবর রহমানকে তার সমগ্র পরিবারসহ হত্যা করে। ২০ আগস্ট তারিখে বাংলাদেশে সামরিক আইন জারি করা হয়। সমস্ত রাজনৈতিক দল রদ করা হয়।
১৯৭৬ খ্রীস্টাব্দের ২৯ নভেম্বর তারিখে মেজর-জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রধান ‘সামরিক শাসক’ নিযুক্ত হন। ১৯৭৭ খ্রীস্টাব্দের ২২ এপ্রিল তারিখে এ. এম. সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করেন এবং মেজর-জেনারেল জিয়াউর রহমান নতুন রাষ্ট্রপতি রূপে শপথ গ্রহণ করেন। এক সাধারণ নির্বাচনে এটা সমর্থিত হয় এবং ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাস থেকে সামরিক শাসনের অবসান ঘটে।
১৯৮১ খ্রীস্টাব্দের মে মাসে সৈন্যবাহিনীর একদল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করে। ১৯৮১ সালের নভেম্বর মাসে এক সাধারণ নির্বাচনে তিনিই রাষ্ট্রপতি হিসাবে বিজয়ী হন। কিন্তু ১৯৮২ খ্রীস্টাব্দের ২৩ মার্চ তারিখে আবদুস সাত্তারকে অপসারিত করে লেফটানেণ্ট জেনারেল হোসেন মহম্মদ এরশাদ বাংলাদেশের প্রধান সামরিক শাসক হন। সংবিধান রহিত করা হয় ও সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। পরের বৎসর ২৭ মার্চ তারিখে সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে আমানুদ্দিন চৌধুরীকে অ-সামরিক রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করা হয়, কিন্তু ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর লেফটানেণ্ট জেনারেল এরশাদ নিজেই রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক শাসক হন। ১৯৮৫ খ্রীস্টাব্দের ১৬ জানুয়ারী সামরিক শাসন শিথিল করা হয় এবং সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে লেফটানেণ্ট জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকেন। ১৯৮৫ সালের ১ মার্চ তারিখে আবার সামরিক শাসন জারি করা হয়। ২১ মার্চ তারিখে এক গণভোটে (referendum) লেফটানেণ্ট জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রপতি পদে বৃত থাকার সমর্থনে জনগণের আস্থা লাভ করেন। ১৯৯০ খ্রীস্টাব্দের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতি পদে আসীন থাকেন। ১৯৯১ খ্রীস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারী তারিখে এক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন।
৷৷ পাঁচ ৷৷
১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময় বাংলাদেশের যে অবস্থা ছিল, আজ আর তা নেই। আজ আশমান-জমিন ফারাক হয়ে গিয়েছে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও সাহিত্য-সাধনার ক্ষেত্রে। এই দুই ক্ষেত্রেই আজ প্রভূত উন্নতি ঘটেছে। দেশবিভাগের সময় বাংলাদেশ মোটামটি কৃষিপ্রধান দেশ ছিল। কিন্তু আজ শিল্প ক্ষেত্রেও তার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে।
যে বাংলাদেশে আগে কোন উল্লেখযোগ্য শিল্প ছিল না, সেই বাংলাদেশে আজ চটকল, কাপড়ের কল, চিনির কল, দিয়াশালাইয়ের কল, কাঁচ তৈরির কল, কাগজ কল, মোজাগেঞ্জির কারখানা, অ্যালুমিনিয়াম শিল্প ইত্যাদি নানারকমের শিল্প স্থাপিত হয়েছে। একটা সিমেণ্ট শিল্পও স্থাপিত হয়েছে, যার বাৎসরিক উৎপাদন শক্তি হচ্ছে ২০ লক্ষ টন। চট্টগ্রামে একটা ইস্পাত নির্মাণ শিল্প সংস্থাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার বাৎসরিক উৎপাদন শক্তি হচ্ছে ২৫০,০০০ টন। এ ছাড়া তৈল পরিশোধনের জন্য একটা রিফাইনারীও স্থাপিত হয়েছে, যার শক্তি হচ্ছে ১৬,৮০,০০০ টন তৈল পরিশোধন।
এসব ছাড়াও একটা নিউজপ্রিণ্ট ফ্যাক্টরি, চারটা ফারটিলাইজার সার উৎপাদন ফ্যাক্টরি, একটা তরল প্রাকৃতিক গ্যাস প্ল্যাণ্ট ইত্যাদি স্থাপিত হয়েছে। জাহাজ নির্মাণ ও মেরামতের জন্য একটা শিপ-ইয়ার্ডও স্থাপিত হয়েছে। ১৯৮২ সালে যে নতুন সরকারী শিল্পনীতি ঘোষিত হয়েছে, সেই নীতি অনুযায়ী চটকল ও কাপড়ের কলগুলিকে সরকারী মহল থেকে মুক্ত করে বেসরকারী মহলের হাতে ন্যস্ত করার কথা বলা হয়। তবে অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ, গোলাবারুদ তৈরি, আণবিক শক্তি, বিমান-পরিবহন, যোগাযোগ, বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদন, বনজ শিল্প ইত্যাদি সরকারী মহলের হাতেই আছে। বৈদ্যুতিক শক্তির উৎপাদন ও পরিবেশন ‘বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেণ্ট বোর্ড’ ও ‘রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন বোর্ড’ দ্বারা সাধিত হয়। প্রাকৃতিক গ্যাস তিতাস থেকে পাওয়া যায় এবং পাইপের সাহায্যে ঢাকায় আনীত হয়। অন্যান্য জায়গাতে ড্রিলিং কার্য চালানো হচ্ছে এবং অনুমিত হয়েছে যে প্রাকৃতিক গ্যাসের যে রিজার্ভ আছে তা অন্ততঃ ২০০ বৎসরের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। বঙ্গোপসাগরেও ড্রিলিং চালিয়ে তেলের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। জামালপুর জেলায় কয়লারও সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। কয়লার সংরক্ষিত ভাণ্ডার ৭০ কোটি টন আছে বলে অনুমিত হয়েছে। রাজশাহী জেলাতেও কয়লার গভীর স্তর আছে বলে জানা গিয়েছে। এছাড়া অন্যান্য খনিজ পদার্থের মধ্যে লবণ, চুনাপাথর, সাদামাটি (white clay) ও কাঁচ তৈরির বালি আছে। ১৯৭৯ খ্রীস্টাব্দে সৌদি আরবের কাছ থেকে প্রাপ্ত তিন কোটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ডলার পরিমাণ অর্থের সাহায্যে জয়পুরহাটে একটি চুনাপাথর ও সিমেণ্ট কারখানার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। বঙ্গোপসাগর ও দেশের অভ্যন্তরস্থ অসংখ্য নদনদী ও খাল-বিল মৎস্য চাষের সহায়ক হয়েছে এবং সমুদ্র ও এই সকল অভ্যন্তরস্থ নদ-নদী ও খালবিল থেকে ১৯৮০-৮১ সালে ৬৪০,০০০ টন মৎস্য সংগৃহীত হয়েছিল।
অন্যান্য যে সকল শিল্পের কথা উপরে বলা হয়েছে ১৯৮৩-৮৪ সালে তাদের উৎপাদন ছিল— চট ও থলে ৩৩৫,০০০ টন, ইস্পাত পিণ্ড ১৩৭,০০০ টন, ইস্পাত নির্মিত দ্রব্য ১৯৪,০০০ টন, পরিশোধিত চিনি ১৫১,০০০ টন ও নিউজপ্রিণ্ট ৩০ লক্ষ টন। ১৯৮২ সালে শিল্প উৎপাদনের বৃদ্ধি-হার ছিল পাঁচ শতাংশ। ১৯৮১-৮২ সালে শিল্পে কর্মরত ছিল মোট জন-সংখ্যার সাত শতাংশ লোক। GNP পরিমাণ ছিল ৮.০৮ শতাংশ।
বাংলাদেশের মোট GDP-র ৫৪ শতাংশ পাওয়া যায় কৃষি থেকে। বাংলাদেশের টাকায় এর মূল্য পরিমাণ হচ্ছে ৩৭৫১.২ কোটি টাকা। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষিকর্মে নিযুক্ত থাকে। দেশের মোট আয়তনের ৬৪ শতাংশে চাষবাস করা হয়। তার মধ্যে ৮০ শতাংশে ধান ও নয় শতাংশে পাটের চাষ হয়। ১৯৮৩-৮৪ সালে ধানের উৎপাদন ছিল এক কোটি ৪৬ লক্ষ টন, পাট ৫২ লক্ষ টন, ইক্ষু ৬৯,৮৬,০০০ টন, গম ১১,৯১,০০০ টন, তামাক ৫১৭,০০,০০০ টন, চা ৯,৫০,০০,০০০ পাউণ্ড, ও আলু ১,১৫,০০,০০০ পাউণ্ড। পাট থেকেই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির দুর্বলতা হচ্ছে ঘন ঘন নৈসর্গিক দূর্যোগ ও উচ্চহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। সেজন্য বাংলাদেশ আজ খাদ্য সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে।
৷৷ ছয় ৷৷
শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের ইদানীং যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছে। মোট সংখ্যার ২৪ শতাংশ সাক্ষর। ১৯৮০ খ্রীস্টাব্দে সমগ্র বাংলাদেশে ৪৩,৬৩৪ প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৮,৯৪৬ মাধ্যমিক স্কুল ও ৬০০ ইনটারমিডিয়েট ও ডিগ্রি কলেজ ছিল। ছাত্র সংখ্যা ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে ৮০ লক্ষ, মাধ্যমিক স্কুলসমূহে ২০ লক্ষ, টেকনিকাল কলেজসমূহে ১৬,০০০ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ৩০,০০০। মোট ছয়টা বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তার মধ্যে একটি ইঞ্জিনিয়ায়িং ও একটি কৃষি সম্পর্কিত শিক্ষার জন্য। বাকি চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থিতি হচ্ছে ঢাকা, রাজসাহী, মৈমনসিংহ ও চট্টগ্রামে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবার জন্য ১৪টি কলেজ আছে। এছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ৪৭টি বিদ্যায়তন আছে। ১৬টি পলিটেকনিক ও ২৬টি পেশাগত বিদ্যায়তনও আছে।
বাংলাদেশে ৫৩টি দৈনিক পত্রিকা, ২০০ সাপ্তাহিক পত্রিকা, ৩৪টি পাক্ষিক, ১৯৪টি মাসিক ও ৪৩টি ত্রৈমাসিক পত্রিকা আছে। অধিকাংশ পত্রিকাই ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। “দৈনিক বার্তা- আল রাজশাহী’ নামে একটি সরকারী পত্রিকাও আছে।
বাংলাদেশ আজ অসাধারণ নিষ্ঠা দেখাচ্ছে সাহিত্য সাধনার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের মনীষীরা আজ যে-সব সৎসাহিত্য সৃষ্টি করছে, পশ্চিমবঙ্গে তা বিরল। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য আজ অপসংস্কৃতি ও গোষ্ঠীতোষণের শিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকদের না আছে সংগ্রামী মন, না আছে আত্মপ্রত্যয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত সুসংহত ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা। অথচ সাহিত্যের প্রধান ধর্ম হচ্ছে সমাজকে বিপথ থেকে ঠিক পথে নিয়ে যাওয়া। সে সাফল্য পশ্চিমবঙ্গের চলমান সাহিত্য অর্জন করতে পারে নি। সেদিক থেকে বাংলাদেশের চলমান সাহিত্য সাফল্যমণ্ডিত ও সম্ভাবনাময়। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনীষীরা, বাংলা একাডেমী ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমী যা করছে, তা বিস্ময়কর।
ঢাকার বাংলা একাডেমীর প্রশংসনীয় উদ্যোগ দেখলে চমকে যেতে হয়। এরা অগণিত বই বের করেছেন, নানা বিষয়ে যথা— অভিধান, পরিভাষা, গল্প-উপন্যাস, কবিতা, রচনাবলী, একুশের সংকলন, প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য, লোকসাহিত্য, নাটক, শিশু-কিশোর সাহিত্য, ইতিহাস-সংস্কৃতি, জীবনী, সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকল্যাণ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও লোক প্রশাসন, দর্শন ও মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, আইন, শিক্ষক-প্রশিক্ষণ, সাংবাদিকতা, চিত্রকলা, গণিতশাস্ত্র, পরিসংখ্যান, পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, কৃষিবিদ্যা, ভূগোল, ভূতত্ব ও মৃত্তিকাবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রকৌশল ও কারিগরিবিদ্যা, সাধারণ-বিজ্ঞান, স্বাধীনতা সংগ্রাম, অফিস-আদালত, ধর্ম ও সঙ্গীত। এসব বিষয়ে এঁরা আজ পর্যন্ত কয়েক শত বই বের করেছেন।
সবশেষে বলতে চাই বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে। শিশু ও কিশোরদের জন্য এঁরা যে সব বই বের করেছেন সেগুলি অপূর্ব নিঃসন্দেহে বলি যে বাংলাদেশের প্রকাশকরাও আজ অসামান্য কৃতিত্ব দেখাচ্ছেন বাংলাদেশের মনীষীগণের চিন্তাশীল রচনাসমূহ সর চির সহিত প্রকাশ করে।