☼ অতুল সুর ☼
চোদ্দ শতকের বাঙালী
নানা কারণে বাঙালী আজ খুবই কাহিল অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। অথচ একশো-দুশো বছর আগে পর্যন্ত আর্থিক জীবনে বাঙালী স্বয়ম্ভর ছিল। আজ তার নিত্য আবশ্যকীয় সব জিনিসই আসে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চাষবাস ও মজুরি থেকে যা সামান্য আয় করে, তার প্রায় সবটাই চলে যায় পশ্চিমবঙ্গের বাইরে। ফলে পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশ দুর্বল ও নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। বঙ্গাব্দ চোদ্দ শতকে বাঙালীর এ দুর্গতি তুঙ্গে উঠেছে।
নিঃস্ব বাঙালী যা-ও বা কিছু সামান্য সঞ্চয় করেছিল, তা বিগত শতাব্দীতে হারিয়েছে শতাব্দীর সূচনায় বেঙ্গল ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক দেওলিয়া হওয়ার ফলে, ১৯১২ খ্রীস্টাব্দে তুলার খেলার সর্বাত্মক জয়ার মত্ততায়, ১৯৪৭-৪৮ সালের ব্যাঙ্কিং সংকটে ও শেয়ার বাজারের হাতছানিতে। বর্তমানে সে আবার সর্বস্বান্ত হয়েছে ‘চিট’ ফাণ্ডের প্রকোপে।
চোদ্দ শতকের বাঙালী বেশি মার খেয়েছে শেয়ার বাজারে। শেয়ার বাজার থেকে পয়সা উপায় করতে হলে আবশ্যিকভাবে প্রয়োজন মোটা পুঁজি ও ঝুঁকি নেবার অসীম ক্ষমতা। এ দুটোই বাঙালীর নেই। ফলে নিঃস্ব বাঙালী যতবার শেয়ার বাজার থেকে ফায়দা তুলতে চেয়েছে, তত- বারই আঙুল পুড়িয়ে ঘরে ফিরেছে। শেয়ার বাজারের পাণ্ডাদের কায়দা কানুনগুলোর সঙ্গে পরিচয় না থাকলে এরূপই ঘটে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বাজারের পাণ্ডাদের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য সরকার ১৯৫৬ সাল থেকে শেয়ার বাজার নিজ নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিন্তু সরকার নিজেই শেয়ার বাজারের পাণ্ডাদের এসব কায়দা কানুন সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ। ফলে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনলেও কোন ফল ফলে নি। পঞ্চাশের দশকে হরিদাস মাদ্রার ও নব্বইয়ের দশকে হর্ষদ মেহটার কেলেঙ্কারী তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
৷৷ দুই ৷৷
চারদিকে যা দেখছি তাতে মনটা ভারী দমে যাচ্ছে। সবচেয়ে শোচনীয় দৃশ্য যা দেখছি, তা হচ্ছে দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে বিচ্ছিন্নতাবাদের আত্মপ্রকাশ। মনে হচ্ছে, বুঝিবা এবার দেশটা লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। মনে পড়ে গেল অনেকদিন আগে এক ইংরেজের বলা এক উক্তি। উইনস্টন চার্চিল একবার বলেছিলেন, ভারত স্বাধীনতা পাবার যোগ্য স্তরে এখনও পৌঁছায়নি। ভারতকে যদি স্বাধীনতা দেওয়া হয়, তাহলে ইংরেজ এদেশে আসবার আগে ভারতের যে অবস্থা ছিল, ভারত আবার সে অবস্থাতেই ফিরে যাবে। ভারত ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। তখন গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের উত্তেজনায়, আমরা চার্চিলের কথায় খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। চার্চিলকে আমরা অনেক কটু কথা বলেছিলাম। রুষ্ট হয়ে সেদিন আমরা চার্চিলের ওই উক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলাম।
তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। দেখলাম ভারতকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করেই স্বাধীনতা দেওয়া হল। সূতরাং জন্মসূত্রেই স্বাধীন ভারত বিচ্ছিন্নতাবাদের ধ্বজা কাঁধে নিয়ে তার মহাযাত্রা শুরু করেছে।
স্বাধীনতার পর দেশে দেখলাম, দুরকম রাজ—ঠাণ্ডা রাজ, আর ডাণ্ডা রাজ। ঠাণ্ডা রাজের আমলেই দেখলাম দেশের সংহতিকে বিনষ্ট করে আবির্ভূত হতে লাগল ভাষাভিত্তিক রাজ্যসমূহ। আজ আবার ডাণ্ডা রাজের আমলেও দেখছি সেই একই প্রবণতা। দেশের সংহতি আজ নষ্ট হচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রকোপে। দেশের ঐক্য যে আজ বিপন্ন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে এতে ঘাবড়াচ্ছেন না দেশের জনগণমন-অধিনায়করা। তাঁরা বলছেন এটা বিশেষ কিছু নয়। নাচ-গানের সমারোহ করলেই দেশের সংহতি বজায় থাকবে। এরকম কথা আর একবার শুনেছিলাম, বিধান ডাক্তারের আমলে। তখন বনমহোৎসবকে তিনি রূপায়িত করতে চেয়েছিলেন সাহানা দেবীর নাচের মাধ্যমে।
যেন মনে হচ্ছে যে দেশের সব সমস্যারই মকরধ্বজ হচ্ছে নাচগানের অনুষ্ঠান করে হৈ হৈ করা। কেবল ভয় পাই, এটা না শেষ পর্যন্ত নটরাজের প্রলয় নাচনে গিয়ে দাঁড়ায়।
ইংরেজ আমলেই দেশের মধ্যে মোটামুটি একটা রাষ্ট্রীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইংরেজ আসবার আগে যে ভারতে রাষ্ট্রীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়নি, তা নয়। হয়েছিল, যেমন মৌর্য সম্রাট অশোকের আমলে, গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলে, পাল-সম্রাট ধর্মপালের আমলে ও মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে, কিন্তু সে সবই ভেস্তে গিয়েছিল। ইংরেজ আসবার আগে ভারতের ইতিহাস তো তার সাক্ষ্য দেয়। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধবিগ্রহ, রক্তারক্তি, সিংহাসন লাভের জন্য পিতাপুত্রে, ভাইয়ে-ভাইয়ে মারামারি, কাটাকাটি, এটাই তো ছিল ভারত ইতিহাসের গতানুগতিক ধারা। আজ আবার সেই প্রবণতাই উৎকটভাবে প্রকাশ পাচ্ছে? এর কারণ কি?
কারণ একটাই। ভারত হল আপাত বৈষম্যের দেশ। এ বৈষম্য সর্বগ্রাসী ও নানারকম, নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক, ধর্মগত, জীবনচর্যার বৈষম্য ইত্যাদি।
৷৷ তিন ৷৷
ভারতের কোন নৃতাত্ত্বিক ঐক্য নেই। মোটামুটি, পাঁচটা বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর লোক ভারতে বাস করে, যথা প্রটো-অস্ট্রালয়েড, নর্ডিক, মেডিটেরেনিয়ান, আলপীয়-দিনারিক ও মঙ্গোলয়েড। এই পাঁচ নরগোষ্ঠীর লোক ভারতের মহামিলনক্ষেত্রে এসে মিলেছে। এই পাঁচ নরগোষ্ঠীর লোক মোটামটি ১০৩৫টা মাতৃভাষায় কথা বলে। এগুলো আর্য, দ্রাবিড় ও মণ্ডারী ভাষাভুক্ত। এদের সকলেরই মধ্যে ফোনেটিকস্, এটিমোলজি, মরফোলজি, সিনট্যাক্স ও সেমান্টিক্স-এর পার্থক্য আছে। উত্তর ভারতে প্রচলিত বর্ণমালাসমূহের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের বর্ণমালাসমূহের রূপগত বৈষম্যও লক্ষিত হয়।
এ বৈষম্য মাত্র নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাগত নয়। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়ও। মূলগতভাবে সমাজের ন্যূনতম সংস্থা হচ্ছে পরিবার, এবং পরিবারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় বিবাহ দ্বারা। কিন্তু ভারতে যত জাতি আছে তার চেয়ে বেশি বিবাহপ্রথা প্রচলিত আছে। একের বিধির সঙ্গে অপরের মিল নেই। উত্তর ভারতে মামাতো পিসতুতো ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে হয় না।
অথচ দক্ষিণ ভারতের অনেক জায়গায় এটাই হচ্ছে বাঞ্ছনীয় বিবাহ। সেখানে মামা-ভাগ্নীর মধ্যে বিবাহও বিধিসম্মত বিবাহ। উত্তর ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে বধূর সিঁথিতে সিঁদুর দানই বিবাহের মূলে অনুষ্ঠান এবং এটাই সধবা রমণীর চিহ্ন, কিন্তু দক্ষিণ ভারতে সিঁদুর দান প্রথা নেই। সেখানে কণ্ঠে তালিবন্ধন’ই বিবাহের প্রধান অনুষ্ঠান, এবং এটাই সধবা স্ত্রীলোকের চিহ্ন। আবার আদিবাসীদের মধ্যেও নানারকম বিবাহ-প্রথা প্রচলিত আছে। এক্ষেত্রেও উত্তর ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের কোন সাদৃশ্য নেই। আবার উত্তর-পূর্ব সীমান্তের আদিবাসীদের মধ্যে বিধবা শাশুড়ি ও বিধবা বিমাতাকে বিবাহ করার প্রথা প্রচলিত আছে। কেরলের নায়ারদের মধ্যে প্রচলিত বিবাহ অন্যত্র দৃষ্ট হয় না। বহুপতিক বিবাহ দক্ষিণ ভারতে টোডাদের মধ্যে ও হিমালয়ের পাদদেশস্থ অঞ্চলে দৃষ্ট হয়। অন্যত্র কিন্তু তা নেই। আছে কোনও কোনও জায়গায় দেবরণ প্রথা। তাছাড়া, বিবাহে মাঙ্গলিক আচার (যাকে আমরা স্ত্রী-আচার বলি) তা ভারতের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন রকমের।
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অশন-বসনের বিচিত্রতাও আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে জনগণের জীবনযাত্রা প্রণালীর অনৈক্য। বাঙলা, আসাম ওড়িশা ও পূর্ব-উপকূলের প্রধান খাদ্য চাউল। চাউল সিদ্ধ করে খাওয়া হয়। উত্তর ভারত, পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও অন্যত্র প্রধান খাদ্য গম। গম চূর্ণ করে জল দিয়ে মেখে রুটি তৈরি করে সেঁকে খাওয়া হয়। আবার পশ্চিম উপকূলস্থ অনেক জাতির প্রধান খাদ্য বজরা ও রাগি। বাঙলা, আসাম ওড়িশা ও আরও দু এক প্রদেশের লোকরা মাছ খায়। অন্যত্র মাছ খায় না, কিন্তু মাংস খায়। প্রাচ্য প্রদেশের লোকরা সরিষার তৈল দিয়ে রন্ধন-ক্লিয়া সম্পন্ন করে। উত্তরপ্রদেশের লোকরা কিন্তু ঘি ব্যবহার করে। রন্ধনক্রিয়ায় পশ্চিম ভারতের লোকরা তিলের তেল ও দক্ষিণ ভারতের লোকরা নারিকেল তেল ব্যবহার করে। মাত্র খাদ্যের দিক দিয়ে নয়, বসন-ভূষণের দিক দিয়েও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এক বিচিত্রতা দৃষ্ট হয়। পশ্চিম বাঙলার মেয়েরা (বিধবা ছাড়া) পাড়-বিশিষ্ট শাড়ি পরত। বিহার ও উত্তর প্রদেশের মেয়েরাও তাই। তার মানে তারা সেলাইবিহীন বস্ত্র ব্যবহার করত। কিন্তু রাজস্থান ও পাঞ্জাবের মেয়েরা সেলাইবিশিষ্ট বসন পরে। রাজস্থানের মেয়েরা বর্ণাঢ্য ঘাঘরা পরে। পাঞ্জাবের মেয়েরা পাজামা ও কামিজ পরে। পশ্চিম ভারতের মেয়েরা কাছা দেয়। অন্য জায়গার মেয়েরা কাছা দেয় না। পুরষদেরও ধূতি নানা জায়গায় নানা কায়দায় পরা হয়। বাঙলায় চটি-জুতা ব্যবহারই প্রচলিত ছিল। কিন্তু উত্তর ভারতের লোকরা গোড়ালি-বিশিষ্ট জুতা পরত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ভারতের লোকের সামাজিক ও জীবনযাত্রা প্রণালীর কোনও একতা নেই।
ভারতের লোকের ধর্মীয় একতাও নেই। দুর্গাপূজা, দশেরা, দেওয়ালী, হোলি প্রভৃতি উৎসবগুলিকে আমরা জাতীয় উৎসব বলি। কিন্তু এসব উৎসব পালনের সময়কাল ও মর্যাদার দিক দিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য হয়। বাঙলার শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব। কিন্তু সংলগ্ন বিহার প্রদেশে তা নয়। সেখানে কার্তিকী ষষ্ঠীতে অনুষ্ঠিত ‘ছট’ পরবই বছরের শ্রেষ্ঠ উৎসব। উত্তর ভারতে বোধ হয় ‘হোলি’ ও পশ্চিম ভারতে ‘দেওয়ালী’ই শ্রেষ্ঠ উৎসব। এ তো গেল সমষ্টির ব্যাপার। ব্যক্তির দিক থেকেও ধর্মীয় বিভেদ অসাধারণ। কেউ বৈষ্ণব, কেউ সৌর, কেউ গাণপতা, কেউ শৈব, কেউ শাক্ত, কেউ তান্ত্রিক, কেউ আস্তিক, কেউ নাস্তিক ইত্যাদি। আবার এসব ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অসংখ্য সম্প্রদায় আছে।
এক কথায় সব বিষয়েই ভারত এই আপাত বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতার সরে বাঁধা। সুতরাং আজ যদি ভারতে বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা প্রকাশ পায় তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
৷৷ চার ৷৷
কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী হলে কি হবে? কলকাতায় বাঙালী আজ পরবাসী। কেননা, কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বাসস্থানেরও অভাব ঘটছে। শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যখন কিছুকাল আগে এক রাজস্থানী ভদ্রলোক দাবি করেছিলেন যে রাজস্থানের সবচেয়ে বড় শহর হচ্ছে কলকাতা। কথাটার মানে বুঝলাম যখন উনি ওর ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, রাজস্থানেরও অনেক শহর আছে, কিন্তু সেসব শহরের কোনটাতেই এত রাজস্থানী বাস করে না, যত বাস করে কলকাতায়। যে হারে ইদানীং কলকাতায় রাজস্থানীদের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে এরকম উক্তিতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কিন্তু বাঙালীর এই শোচনীয় অবস্থার জন্য দায়ী কে? বাঙালী নিজেই। বাঙালীর উদাসীনতাই এর জন্য দায়ী। আজ এসব সমস্যার দিকে তাকাবার বাঙালীর সময় নেই! না আছে তার উদ্যম-উৎসাহ, না আছে সংগ্রামী মন। বাঙালী যে এসব গণের অধিকারী নয়, তা বলছি না। কিন্তু তার সমস্ত উদ্যম-উৎসাহ ও সংগ্রামী মন আজ চলছে বিপথে। তার উদ্যম-উৎসাহ ও সংগ্রামী মন আজ আত্মকলহে মিয়োজিত। মাত্র এক দলের সঙ্গে অপর দলের কলহ নয়। নিজ দলের মধ্যেই মতানৈক্য, দ্বন্দ্ব ও ‘সংঘর্ষ’। তাছাড়া আছে অপর দলের প্রতি আগ্রাসন, আঘাত ও অঘটন। এসব দেখে মনটা প্রায়ই খারাপ হয়ে যায়। অনেক সময়ই মনে হয় যে কলহ, মারামারি, কাটাকাটি করেই বুঝি বাঙালী জাতটা খতম হয়ে যাবে। বাঙালীর মত এক প্রতিভাশালী জাতির যে এ-রকম দুর্দশা হতে পারে, তা অকল্পনীয়। অতি প্রাচীনকাল থেকেই এ জাতটা সারা ভারতে প্রতিভাশালী জাতি বলে পরিচিত ছিল। বাঙালী জাতির এ পরিচিতিটা ছিল উত্তর ভারতের মানুষের বনামে। এর কারণ নৃতাত্ত্বিক। সেটা আমি আলোচনা করেছি আমার ‘ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ গ্রন্থে। সেজন্য তার পুনরাবৃত্তি আর এখানে করব না। মাত্র কিছু ঐতিহাসিক তথ্য এখানে দেব। নর্ডিক আর্যরা যখন পঞ্চনদের উপত্যকায় এসে বৈদিক সভ্যতার পত্তন করেছিল, তখন থেকেই তারা দুচক্ষে দেখতে পারত না আর্য ভাষাভাষী আলপীয় বাঙালীদের। বাঙালীদের তারা ঘৃণা করত। তারা বাঙালীদের নাম দিয়েছিল ‘বয়াংসি’। ঈর্ষার বশীভূত হয়েই তারা এটা করেছিল। ঈর্ষার কারণ, বাঙালীর শৌর্য বীর্য, শিক্ষা-দীক্ষা, উন্নত জীবনচর্যা, উচ্চতর ধর্ম ও ধর্ম স্থান। তবুও বৈদিক আর্যদের মধ্যে যারা উদারমনা ছিল, তারা গোপনে বাঙলায় আসত তীর্থ যাত্রা করতে। তবে এর জন্য তাদের শাস্তি পেতে হত প্রায়শ্চিত্ত করে। তারপর বৈদিক আর্যরা যখন সাংস্কৃতিক দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে উত্তর ভারতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করল, তখন তারা ধাক্কা খেল বাঙালী ও প্রাচ্যদেশের লোকদের কাছে। বহুদিন তাদের বিদেহ পর্যন্ত এসে অথর্ব হয়ে বসে থাকতে হয়েছিল। এই বাঙালী ও প্রাচ্য দেশের লোকদের শৌর্য বীর্যের কথা শুনেই দিগ্বিজয়ী গ্রীক বীর আলেকজাণ্ডার ফিরে গিয়েছিল বিপাশা নদীর পশ্চিম তীর থেকে। পরবর্তীকালে আর্যরা যখন দলে দলে বাঙলায় এল, তখন তাদের ভুলে যেতে হয়েছিল নিজেদের শ্রেষ্ঠ দেবতাদের (যথা ইন্দ্র, বরুণ ইত্যাদি), এবং তারা পূজো করতে আরম্ভ করেছিল বাঙলার দেবদেবীদের। তাদের নিয়েই রচিত হল পুরাণসমূহ। বৈদিক ধর্মের পরিবর্তে পৌরাণিক ধর্মেরই জয়জয়কার হল। এমন কি সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রেও এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটল। বাঙালী কাব্য-রচনায় যে নতুন রীতি উদ্ভাবন করল, তা ‘গৌড়ীয় রীতি’ নামে আখ্যাত হল। সেই রীতিতেই জয়দেব রচনা করলেন, তাঁর অমর গীতিকাব্য ‘গীতগোবিন্দ’।
মুসলিম আমলে আরও যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটল। যেসব দেবদেবী ঝোপজঙ্গলে বা পর্বতকন্দরে অধিষ্ঠিত ছিলেন তাঁরা প্রতিষ্ঠা পেলেন হিন্দুসমাজে। বাঙালী নিজ প্রতিভা বিকশিত করল এক সমৃদ্ধশালী সাহিত্য রচনা করে—চর্যাগীতি, পদাবলী ও অনুবাদ সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য ও চৈতন্যের জীবন-চরিতে। বাঙালী সে প্রতিভা আরও বিকশিত করল নানারূপে স্মৃতিগ্রন্থ রচনায়। ভবদেব, জীমূত-বাহন, রঘুনন্দন প্রমুখেরা নতুন নতুন বিধানগ্রহ রচনা করলেন। তারপর ইংরেজ আমলে বাঙালী কর্মকার পঞ্চাননের সহায়তায় চার্লসে উইলকিনস নির্মাণ করল বাংলা হরফ। তার ফলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটল শিক্ষা ও সাহিত্য প্রসারের ক্ষেত্রে। এক নতুন শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হল, যারা উত্তর ভারতের স্কুল কলেজে নিযুক্ত হয়ে উত্তর ভারতকে শিক্ষিত করে তুলল। এই শিক্ষিত সমাজই নেতৃত্ব গ্রহণ করল স্বাধীনতা আন্দোলনের, যে আন্দোলনের পরিণতিতে ভারত থেকে ইংরেজের মহাপ্রস্থান ঘটল। বাঙালীর এই প্রতিভা দেখেই গোখলে উদাত্তকণ্ঠে বলেছিলেন— ‘হোয়াট বেঙ্গল থিঙ্কস, টু ডে, ইণ্ডিয়া থিঙ্কস, টুমেরো।’
কিন্তু আজ সেই প্রতিভাশালী বাঙালী জাতি জীবনের সকল ক্ষেত্রেই হটে যাচ্ছে। একটা প্রতিভাশালী জাতির আজ যে শোচনীয় অবনতি ঘটছে, তা সত্যিই খুব দুঃখের বিষয়। এর একমাত্র কারণ বাঙালী আজ আত্মকলহে প্রমত্ত হয়ে অগ্রগতির সুযোগ ও সুবিধা করে দিচ্ছে অপরকে। এ আত্মকলহ আজ এমন এক স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে যে পরপর পরস্পরকে গালিগালাজ দেওয়াটাই প্রতিভার একটা বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এক সময় বাঙালীর আত্মপ্রত্যয়ের অভাব ছিল না। বঙ্কিমের কথাই ধরা যাক। বঙ্কিম বলেছিলেন— সকলেরই বিশ্বাস বাঙালী চিরকাল দুর্বল, চিরকাল ভীরু, চিরকাল স্ত্রীস্বভাব, চিরকাল ঘুসি দেখিলেই পলাইয়া যায়। যে বলে চিরকাল বাঙালীর এই চরিত্র, চিরকাল দুর্বল, চিরকাল ভীরু, স্ত্রীস্বভাব, তাহার মাথায় বজ্রাঘাত হউক, তাহার কথা মিথ্যা। বাঙালী কি এখনও আত্মকলহের বলি হয়ে থাকবে? আত্মকলহ বিলোপ করে, সে আজ আত্মবিক্রম প্রকাশ করুক এটাই হোক আজকের বাঙালীর সাধনা। কবিগুরুর সঙ্গে সে বলে উঠুক— ‘উথলি যখন উঠেছে বাসনা / জগতে তখন কিসের ডর।’
———