ওয়ালী আহমেদের মুখের উপর এক দোয়াত কালি ছিটিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল ওরা বাইরে হাসতে হাসতে। তখন বিকেল সাড়ে-পাঁচটা। লোকজন জমতে আরম্ভ করেছে ক্লাবে। অনেকেই আড়চোখে চাইল। সকালের সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার ওদের দেখে ডাকার অপেক্ষা না করেই সা করে এসে দাঁড়াল। দরজা খুলে দিয়ে সালাম ঠুকল। ভাল বখশিশের এমনি গুণ! তা ছাড়া ড্রাইভার রানা জিনাতের আনন্দোচ্ছল কথোপকথনে প্রচুর রসের সন্ধানও পেয়েছিল।

‘ওয়ালী আহমেদেকে আমি মস্ত বড় যাদুকর মনে করেছিলাম,’ বলল জিনাত। এখন দেখছি তুমি তার ওপর দিয়েও এক কাঠি। ব্যাপারটা কী বলো তো? হঠাৎ সব টাকা ফেরত দিয়ে মাফ চাইল কেন? কি জাদু করেছিলে তুমি?’

সবটা ব্যাপার ভেঙে বলতেই হেসে গড়িয়ে পড়ল জিনাত। ড্রাইভারও হাসতে আরম্ভ করল। ব্যাটা সব কথা শুনছে এবং তার মধ্য থেকে রস আহরণ করছে দেখে ওর দিকে চোখের ইশারা করে আরেক দফা হাসল জিনাত।

‘আর পারি না, বাপু। হাসতে হাসতে খিল ধরে গেছে পেটে।’

রানা এ হাসিতে যোগ দিতে পারল না। লক্ষ্য করল সে, সবুজ রঙের একটা ফোক্সভাগেন আসছে ওদের পিছু পিছু ভদ্র দূরত্ব বজায় রেখে। অনেকক্ষণ ধরেই পিছু নিয়েছে।

এ ক্লিফটন বিচে বিকেল বেলা অনেক লোকের ভিড়। বাগানের ভেতর পিঁপড়ের মত পিল পিল করে বেড়াচ্ছে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। সাগরের ধারে বসে কফি খেল ওরা, সূর্যাস্ত দেখল। ভবিষ্যতের গল্পে এমন মশগুল হয়ে গেল যে। খেয়ালই করল না বিকেল গড়িয়ে গেছে, গোধূলির শেষ রঙও কালচে হয়ে আসছে মেঘের গায়ে। আসন্ন রাত্রির কালো ছায়া পড়েছে জনশূন্য সাগরের তীরে। গা-টা ছম ছম করে উঠল জিনাতের।

‘চলো, উঠে পড়ি, রানা। সব লোক চলে গেছে। খেয়ালই করিনি এতক্ষণ।’

ধাপে ধাপে উঠে এল ওরা উপরে। অবাক হয়ে দেখল খা খা করছে জনশূন্য বাগানগুলো। ভোজবাজির মত অদৃশ্য হয়ে গেছে এত লোক সবাই। সবাই চলে গেছে অন্ধকার লাগার আগে আগেই। এতক্ষণে রানার মনে পড়ল ওর এক বন্ধু উপদেশ দিয়েছিল—ক্লিফটন বিচে যদি যাও, আর বিপদ কুড়োবার ইচ্ছে যদি না থাকে, তবে লক্ষ্মী ছেলের মত ফিরে এসো পাঁচটা বাজতেই।

রাস্তায় পৌঁছে দেখল রানা বেশ কিছুটা দূরে সেই সবুজ ফোক্সভাগেনটা দাঁড়িয়ে আছে। বাম দিকের মাডগার্ডের ওপর লম্বা এরিয়েল।

ট্যাক্সি দাঁড়িয়েই রয়েছে। কিন্তু ড্রাইভারটা পিছনের সিটে পা ভাঁজ করে শুয়ে ঘুমাচ্ছে অকাতরে। অনেক ডাকাডাকি করেও ওঠানো গেল না ওকে। হর্ন বাজতেই ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘আরে ও মুন্নির মা, বাচ্চা কাঁদছে শুনতে পাও না? উঠে মুতের কাঁথা বদলে দাও।’ বলেই আবার গুটিসুটি মেরে শুয়ে নাক ডাকাতে আরম্ভ করল। মৃদু হাসল রানা। এমন ঘুমও হয় মানুষের! চুলের মুঠি ধরে গোটা দুই শক্ত ঝাঁকি দিতেই উঠে বসল ড্রাইভার। একটু লজ্জিত হয়ে বলল, ‘ঘুমাইনি, স্যর। এই একটু গড়িয়ে নিচ্ছিলাম আর কি?’

মাইল চারেক যাওয়ার পরই ঘটল ঘটনাটা।

হঠাৎ অবাক হয়ে দেখল ওরা সামনে রাস্তার ওপর জ্বলে উঠল ছ’টা হেড লাইট। আলোগুলোর দূরত্ব দেখে আন্দাজ করল রানা ট্রাক হবে। সমস্ত রাস্তা জুড়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল তিনটে ট্রাক হেড-লাইট নিভিয়ে দিয়ে। ট্যাক্সিটা কাছে আসতেই হেড-লাইট জ্বালিয়ে এগোতে আরম্ভ করল ওদের দিকে।

ব্যাপার কী! অ্যাক্সিডেন্ট করবে নাকি?

মুহূর্তে রানার দেহের পেশিগুলো সজাগ হয়ে উঠল। বিপদের গন্ধ পেয়েছে ও। জায়গা ছাড়বে না এই ট্রাক। ওদের পিষে মারবার জন্যে পাঠানো হয়েছে এগুলোকে। মনে পড়ল রানার, এই একটু আগেই রাস্তার পাশে এদিকে মুখ করা পরপর তিনটে ট্রাককে ছাড়িয়ে এসেছে ওরা। তখন কিছুই সন্দেহ করেনি। এখন বুঝল ওগুলো আসবে এবার পিছন থেকে রাস্তা জুড়ে। পালাবার পথ থাকবে না। রানার অনুমানের সত্যতা প্রমাণ করবার জন্যেই যেন পিছন থেকে একসাথে জ্বলে উঠল ছ’টা হেড-লাইট। দুই হাতে তালি দিয়ে যেমন ভাবে মশা মারা হয়, তেমনি ভাবে হত্যা করা হবে ওদের। ফুল-স্পীডে এগিয়ে আসছে ট্রাকগুলো। আলোয় আলোময় হয়ে গেছে রাস্তা। পালাবার কোনও পথ নেই।

এখন উপায়? রাস্তার ডাইনে-বামে বিস্তীর্ণ অসমান অনুর্বর মাঠ। ট্রায়াম্প হেরাল্ডের পক্ষে ওই মাঠের ওপর দিয়ে ট্রাকের সাথে পাল্লা দেয়া সম্ভব নয়। সেখানেও ধাওয়া করে আসবে ওরা। আশপাশে লোকালয়ের চিহ্নও নেই যে কোনও রকম সাহায্য পাবে।

‘ব্রেক করো, ড্রাইভার। গাড়ি থামাও!’ চিৎকার করে উঠল রানা।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে ড্রাইভার। এমন ব্যাপার জীবনে দেখেনি সে কখনও। রানার চিৎকারে সম্বিত ফিরে পেল সে। বিপদ বুঝে প্রাণপণে ব্রেক করল। ছয় সাত গজ স্কিড করে দাঁড়িয়ে পড়ল ট্যাক্সি।

এইটুকু সময়ের মধ্যে দ্রুত চিন্তা করে নিল রানা অবস্থাটা। হয় স্বর্ণমৃগ, নয় ওয়ালী আহমেদ। সোহেল কৌশলে জুয়াড়ি থেকে সাবধান হতে বলেছিল ওকে। ওয়ালী আহমেদের প্রতিশোধ হওয়াই বেশি স্বাভাবিক। কারণ হোটেল থেকেই পিছু নিয়েছে ওয়্যারলেস ফিট করা সবুজ ফোক্সভাগেন। টাকার জন্য পাঠায়নি সে এদের—কারণ ওয়ালী আহমেদ নিজের চোখেই দেখেছে ওদের টাকাগুলো ইউনাইটেড ব্যাঙ্কে জমা দিতে। পাঠিয়েছে প্রতিশোধ নিতে। শিউরে উঠল রানা। কী ভয়ঙ্কর মৃত্যু! আর মাত্র গজ বিশেক আছে। দৈত্যের মত গর্জন করে এগিয়ে আসছে সাক্ষাৎ মৃত্যু। কাছে পিঠে সাক্ষী নেই কেউ। আগামীকাল সড়ক দুর্ঘটনার খবর বেরোবে পত্রিকায় মোটা হেডিং-এ। কে বুঝবে যে এটা খুন? নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নিতে চায় ওয়ালী আহমেদ রানার ওপর—মেয়েটির ওপর নিশ্চয়ই নয়। এবং ট্যাক্সি ড্রাইভারের তো প্রশ্নই ওঠে না।

‘লাফিয়ে পড়ো গাড়ি থেকে। দৌড় দাও ডান দিকে মাঠের মধ্য দিয়ে।’

‘আর তুমি?’ রানাকে বেরোতে না দেখে জিজ্ঞেস করল জিনাত।

‘যা বলছি তাই করো। জলদি!’ ধমকে উঠল রানা।

জিনাত এবং ড্রাইভার গাড়ি থেকে বেরিয়েই ছুটল ডান ধারে।

এক ঝটকায় দরজা খুলে রানাও বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে। আর মাত্র দশ গজ আছে। ডান ধারে গেলে চলবে না—তা হলে সবাই মারা পড়বে একসঙ্গে। দুই লাফে রানা সরে গিয়ে দাঁড়াল বাম দিকের মাঠের ধারে।

প্রথমেই সামনে থেকে ধাক্কা মারল মাঝের ট্রাকটা ট্রায়াম্প হেরাল্ডের নাকের ওপর। পরমুহূর্তেই পিছন থেকে হুড়মুড় করে এসে পড়ল আরেকটা ট্রাক। প্রচণ্ড ধাতব শব্দ হলো। চুরমার হয়ে গেল ট্রায়াম্পের নরম দেহ। তেলে চ্যাপ্টা হয়ে গেল লেটেস্ট মডেল ট্রায়াম্প হেরাল্ডের ছিমছাম চেহারা। গাড়ি বলে চিনবার উপায় রইল না। লোহার দামে বিকবে এখন ওটা। অন্যান্য ট্রাকগুলোও থেমে দাঁড়িয়েছে।

‘উও দেখো, ময়দান পর খাড়া হুয়া হ্যায় শায়তান।’

কথাটা কানে যেতেই আন্দাজের উপর গুলি ছুঁড়ল রানা দুবার। একটা আর্তচিৎকার কানে এল। দ্বিতীয়টা বোধহয় লাগল না। কিন্তু গুলির ভয়ে দমে যাবার পাত্র ওরা নয়। একটা ট্রাক থেমে রইল রাস্তার ওপর। বাকিগুলো নেমে আসছে মাঠে।

আরও দুটো গুলি ছুঁড়ল রানা। অন্য গাড়ির হেড-লাইটের আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল ড্রাইভিং হুইল ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল আরেকজন সিটের ওপর। অ্যাক্সিলারেটরের ওপর থেকে পা-টা বোধহয় সরেনি—মাঠের ওপর দিয়ে কোণাকুণি চলে গেল ফাস্ট গিয়ারে। এবারও দ্বিতীয় গুলিটা লাগল না।

দুটো গেল। কিন্তু বাকি চারটে এবার সোজা তেড়ে এল রানার দিকে। দৌড় দিল রানা মাঠের মধ্য দিয়ে, কিন্তু হেড-লাইটের আলোয় পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ওরা রানাকে। কয়েকজন লোক মিলে খোলা মাঠের ওপর একটা শেয়ালকে তাড়া করলে তার কেমন লাগে বুঝতে পারল রানা। ছুটোছুটি করাই সার, নিস্তার নেই কিছুতেই।

পাগলের মত গুলি করল রানা হেড-লাইট অফ করার জন্য। পাঁচটা গুলির পরই শেষ হয়ে গেল গুলি। দুটো ট্রাকের চোখ কানা করে দিয়েছে রানা। কিন্তু তাতে ফল হলো উল্টো। রানা আর দেখতে পাচ্ছে না ওদের। অথচ ওরা দেখতে পাচ্ছে রানাকে বাকি দুটো গাড়ির হেড-লাইটের আলোয়। যে কোনও মুহূর্তে ঘাড়ে এসে পড়তে পারে। এঁকে বেঁকে ছুটতে থাকল রানা মাঠময়। দৌড়াতে দৌড়াতেই রিলিজ বাটন টিপে ফেলে দিল খালি ম্যাগাজিন। এক্সট্রা ম্যাগাজিনটা ভরে নিল পিস্তলে। আর মাত্র আটটা গুলি। কাজেই বাজে খরচ করা যাবে না। টায়ার পাংচার করবার চেষ্টা বৃথা—তাতে ঠেকানো যাবে না। স্লাইড টেনে চেম্বারে গুলি নিয়ে এল রানা।

আবার একটা ট্রাকের হেড-লাইটের আলোয় ধরা পড়ল রানা। আলো না নেভাতে পারলে কোনও আশাই নেই। অদৃশ্য এক ট্রাকের গর্জন শোনা গেল পেছনে। দিশেহারার মত ছুটল ও। ছুটতে ছুটতে ট্রাকের শব্দ খুব কাছে এসে গেলে দিক পরিবর্তন করছে বিদ্যুৎগতিতে। আর গুলি ছুড়ছে সুযোগ পেলেই।

ছয়টা গুলির পর নিভে গেল সব হেড-লাইট। এবার শুধু দেখা যাচ্ছে চারটে উন্মত্ত দানবের ছায়া মূর্তি। ডান দিক থেকে একটা ট্রাক ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছিল প্রায়। লাফিয়ে সরে দাঁড়াতেই বাম দিক থেকে এল আরেকটা। মাডগার্ডের প্রচণ্ড এক ধাক্কায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেল রানা মাটিতে। প্যান্টের কাপড় ছিঁড়ে দাঁত বসাল শক্ত মাটি রানার হাঁটুর চামড়ায়। ছড়ে গেল শরীরের অনেক জায়গা—নোনতা ঘাম লেগে জ্বালা করে উঠল কাটা জায়গাগুলো। দরদর করে ঘাম ঝরছে সর্বাঙ্গ থেকে। নিঃশ্বাস পড়ছে হাপরের মত। উঠে বসবার চেষ্টা করল সে, কিন্তু পারল না। সোজা এগিয়ে আসছে একটা বিকট ছায়ামূর্তি। উঠে পড়ো। উঠে পড়ো, গর্দভ! এত সহজেই হেরে যাবে? আপন মনে বলল রানা। তারপর এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। ট্রাকটাকে পাশ কাটিয়েই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ও ফুটবোর্ডের ওপর। ড্রাইভারের কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপল ও, তারপরই চমকে উঠে লাফিয়ে নেমে গেল ফুটবোর্ড থেকে সামনে আরেকটা ট্রাক দেখে। এদিকেই আসছিল ট্রাকটা দ্রুতগতিতে। প্রচণ্ড শব্দে ধাক্কা লাগল দুটোয়। ডিজনির কার্টুনে দুই খরগোস যেমন পিছনের পায়ে ভর করে সামনাসামনি দাঁড়ায়–তেমনি দেখতে লাগল ট্রাক দুটোকে। দুটোরই সামনেটা উঠে গেল আসমানের দিকে—তারপর খেলনার মত পড়ে গেল কাত হয়ে। ছুটে সরে যেতে আর একটু দেরী হলে রানার ওপরই পড়ত।

পিস্তলে আর একটা গুলি আছে। শত্রু আছে দুটো। এদিকে দুই ট্রাকের প্রচণ্ড সংঘর্ষের শব্দ শুনে দুটোই আসছে এদিকে। একটা উল্টানো ট্রাকের আড়ালে সরে দাঁড়াল রানা। কাছে আসতেই গুলি করল। শেষ গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো না। হঠাৎ একটা ট্রাক বিগড়ে গিয়ে পাই পাই ঘুরতে থাকল মাঠের মধ্যে অল্প একটু জায়গায়। বাকি ট্রাকটা তিন সেকেণ্ড থেমে থেকে বোধহয় হৃদয়ঙ্গম করবার চেষ্টা করল ব্যাপারটা, তারপর হাঁ-হাঁ করে ছুটে গেল রাস্তার দিকে। রাস্তায় উঠেই সোজা পিঠটান দিল শহরের দিকে।

হাঁপাচ্ছে রানা। শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে ওর মাটির ওপর। কপালের দুইপাশে দপ দপ করছে শিরাগুলো। কান দিয়ে গরম ভাপ ছুটছে। এতক্ষণের প্রাণান্তকর দৌড়ের ফলে মাথার চুল পর্যন্ত ভিজে গেছে ঘামে। উল্টানো ট্রাকের গায়ে হেলান দিয়ে জিরিয়ে নিল ও কিছুক্ষণ। গুলিহীন পিস্তলটা রেখে দিল কোটের পকেটে।

হঠাৎ মনে পড়ল জিনাতের কথা। তাড়াতাড়ি শহরে ফিরে রিপোর্ট করবার তাগিদও অনুভব করল ও। তিন পা এগিয়েই পিছনে একটু খস খস আওয়াজ পেয়ে ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল রানা। প্রথমেই চোখ পড়ল একটা উদ্যত ছুরির ওপর। ডান হাতে কব্জিটা ধরেই আছড়ে ফেলল ও লোকটাকে মাটির উপর। বুড়ি গঙ্গার শুশুক মাছের মত মাথাটা নীচের দিকে করে ডিগবাজি খেল লোকটা। ছিটকে পড়ে গেল ছুরি হাত থেকে। উঠে বসবার চেষ্টা করছিল, শিরদাঁড়ার ওপর রানার বুটের একটা কড়া লাথি খেয়ে বেঁকে গেল ওর শরীর। মুখে গোঁ গোঁ আওয়াজ তুলেই লুটিয়ে পড়ল মাটিতে জ্ঞান হারিয়ে। এ সেই মাঠের মাঝখানে অ্যাক্সিডেন্ট হওয়া ট্রাকের অপর ড্রাইভারটা।

রাস্তায় উঠে এল রানা।

‘জিনা…!’ চিৎকার করে ডাকল ও।

‘আয়ি। উত্তর এল দূর থেকে।’

হেড-লাইট জ্বালা ও স্টার্ট দেয়া অবস্থায় রাস্তার ওপর দাঁড়ানো ট্রাকের মধ্য থেকে টেনে নামাল রানা দুর্ধর্ষ চেহারার এক পাঞ্জাবী ড্রাইভারের মৃতদেহ। ঠিক চোখের পাশে লেগেছিল গুলিটা। দরজায় এবং সামনের উইণ্ড-স্ক্রিনে রক্তের সঙ্গে লেগে আছে মগজের অংশ।

রাস্তায় উঠে এল জিনাত ও ট্যাক্সি ড্রাইভার। তোবড়ানো গাড়িটার দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ নিষ্ফল ক্ষোভ প্রকাশ করল ড্রাইভার, তারপর চূর্ণ বিচূর্ণ গাড়ির ড্যাশ বোর্ড থেকে ব্লু-বুক আর রোড পারমিটের টোকেনটা বের করে নিয়ে বলল, ‘হামকো ক্যয়া হ্যায়। গাঁড় ফাটেগা ইনশিওর ওয়ালোকা।’

উঠে বসল ড্রাইভার ট্রাকের ড্রাইভিং সিটে।

তখনও বন বন ঘুরছে একটা ট্রাক অন্ধকার মাঠের মধ্যে।

মাইল, ছয়েক আসতেই পিছনে কর্কশ হর্ন শোনা গেল, ‘বিপ…বিপ’। অভ্যাসবশে সাইড দিল ড্রাইভার। পাশ দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল সবুজ ফোক্সভাগেন। এরিয়েলের রডটা দুলছে এদিক ওদিক। রানা বুঝল ওয়্যারলেস ফিট করা আছে ওই গাড়িতে। রানার গতিবিধি সম্পর্কে ট্রাক ড্রাইভারদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে ওই গাড়ি থেকেই। ফোক্সভাগেনের ব্যাক লাইট যখন প্রায় অদৃশ্য হয়ে এল তখন হঠাৎ ট্রাকের মধ্যে কে যেন কথা বলে উঠল।

‘মাসুদ রানা। হুশিয়ার, মওত বহোত দূর ন্যহি!’

মাথার ওপর চেয়ে দেখল রানা। স্পীকার ঝুলছে একটা।