বৈষ্ণব তীর্থযাত্রীর চরম লক্ষ্য যেমন শ্রীবৃন্দাবন, আমাদের অর্থাৎ কারাসেবক-যাত্রীর পরম তীর্থ তেমনি সেন্ট্রাল জেল। ডিস্ট্রিক্ট আর স্পেশাল জেলগুলো যেন ওয়েসাইড স্টেশন। সেন্ট্রাল হল টার্মিনাস। এখানে এলে মনে হবে, হ্যাঁ, এইবার এসে পড়েছি। আমার প্রথম মনিব মোবারক আলি তাঁর ক্ষুদ্র পার্বত্য রাজ্যটির দিকে তাকাতেন আর বলতেন, আরে ছ্যা, এ আবার একটা জেল! চাকরি করা গেছে বটে সেই অমুক সেন্ট্রাল জেলে। কর্নেল ম্যাকফারসন্ সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট, গণপতি সান্যাল জেলর। সে সব দিন— ইত্যাদি। বলতে বলতে চোখ দুটো তাঁর সজল হয়ে উঠত। মুখের উপর দীপ্ত আলো ফুটিয়ে তুলত সেই কটি গৌরবময় দিন, আলি-সাহেবের জীবনে যারা এনেছিল ‘পরম লগন’। কোনো দুর্বল মুহূর্তে একদিন তিনি আমার কাছে ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর জীবনের চরম আকাঙ্ক্ষা। রাজত্ব নয়, মন্ত্রিত্ব নয়, জমিদারি-জায়গীরদারিও নয়, কোনো একটি সেন্ট্রাল জেলে জেলরের উচ্চাসন। কিন্তু হায়! এ আশা তাঁর জীবনে পূর্ণ হয়নি। থাক সে কথা।

‘স্বদেশী স্পেশ্যাল’ থেকে সেন্ট্রালে যেদিন প্রথম এলাম, মনে হল দীনেশ পণ্ডিতের গ্রাম্য পাঠশালা থেকে আর একবার শহরের মিশনারী ইস্কুলে পড়তে এসেছি। এলোপাথাড়ী হট্টগোলের এলাকা শেষ হল। ঢুকলাম এসে সুশৃঙ্খল এবং সুসংবদ্ধ নিয়মের রাজ্যসীমায়। দু-ধারে সুবিন্যস্ত পুকুর, বাগান, ফুলের কেয়ারী। এখানকার যারা অধিবাসী, তাদের পোশাক অভিন্ন। জাঙ্গিয়া কুর্তা, কোমরে গামছা, মাথায় টুপি। তারা ‘ফাইলে’ চলে, ফাইলে বসে, ফাইলে খায় এবং ফাইলে করে ঘুমোয়। এদের দৈনন্দিন জীবন কতগুলো প্যারেডের সমাহার—ল্যাট্রিন প্যারেড, বেদিং প্যারেড, ফীডিং প্যারেড, ওয়াশিং প্যারেড, আরো কত কি প্যারেড। সুদক্ষ সেনানায়কের মত এই প্যারেডগুলো চালনা করে যেসব কয়েদীপ্রধান, তাদের নাম মেট। তাদের পরনে কুর্তার বদলে কোট, কোমরে চাপরাশ, পায়ে স্যাণ্ডাল। এই মেট-গোষ্ঠীই হচ্ছে কারা-শাসনের স্টীল-ফ্রেম, যার উপর দাঁড়িয়ে আছে বৃহৎ বৃহৎ জেলের ডিসিপ্লিন। আহারে, বিহারে, কর্মে এবং দুষ্কর্মে সাধারণ কয়েদীর জীবনযাত্রা এই মেট-রাজতন্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তারা মেটের ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে, মেটের ডাকে জাগে।

সেন্ট্রাল জেলের রাষ্ট্রতন্ত্রে সুপারের যে Sovereignty বা পূর্ণাধিপত্য, সেটা হচ্ছে de jure। ডি ফ্যাকটো অধীশ্বর যিনি, তাঁর নাম চীফ হেড ওয়ার্ডার বা বড় জমাদার। মেট রাজতন্ত্রের তিনিই কর্ণধার এবং তাঁরই হাতে আসল শাসনদণ্ড। সুপারের হাতে যে শাসন, সেটা হচ্ছে Rule of Law, আর চীফের হাতে যে শাসন তার নাম Rule of Awe —প্রথমটার চেয়ে দ্বিতীয়টা যে অনেক বেশী কার্যকরী, সে বিষয়ে অভিজ্ঞ মুরুব্বিমহলে দ্বিমত নেই। লাঠির মাহাত্ম্য কতখানি জীবন্ত, এইখানে এসেই প্রথম প্রত্যক্ষ করলাম, এবং সেই সঙ্গে উপলব্ধি করলাম, বঙ্কিমচন্দ্র যে লাঠি প্রশস্তি গেয়ে গেছেন, এ যুগেও তার মধ্যে কিছুমাত্র অত্যুক্তি পাওয়া যাবে না।

কারারাজ্যের প্রধান বিভাগ দুটি—General Department বা সাধারণ বিভাগ আর Manufactory Department বা উৎপাদন বিভাগ। প্রথমটির উপর ন্যস্ত রয়েছে তার শাসকমণ্ডলীর পরিবহন এবং শাসিত বাহিনীর পরিচালন, তাদের খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, স্বাচ্ছন্দ্য এবং ডিসিপ্লিন। দ্বিতীয়টিতে জড়িত রয়েছে শিল্প, বাণিজ্য এবং কর্মসংস্থান সেন্ট্রাল জেলগুলো শুধু জেল নয়, ছোটখাটো শিল্পকেন্দ্র, নানা শিল্পের মিলনক্ষেত্র— ঘানি, তাঁত, সতরঞ্চি, দরজি-শালা, বাঁশ, বেত, কাঠ এবং লোহালক্করের জড়াজড়ি। এখানে টাটানগরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে আমেদাবাদ, বৌবাজারের সঙ্গে খিদিরপুর। এ ছাড়া জেলপ্রাচীরকে বেষ্টন করে রয়েছে তার বিস্তৃত সবজি-ক্ষেত।

সব ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ফোরম্যান পরিতোষবাবু খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিলেন। গর্বের সঙ্গে বললেন, সব তাঁর নিজের হাতে গড়া। কিন্তু কী লাভ ভূতের বেগার খেটে? ডেপুটি সুপার হবার পথ খোলা নেই কোনো কালা আদমির। ওটা শ্বেতচর্মের বিশেষ অধিকার, মগজের বর্ণ তার যাই হোক। সর্ ওয়ার্কশপে পুরোদমে কাজ চলেছে। শুধু একটা দেখলাম বন্ধ। পরিতোষবাবু বললেন, এটা হচ্ছে পেতল-কাঁসার কারখানা। ক’দিন আগেও এখানে দাঁড়ালে মাথা ধরে যেত এর ঠনাঠন্ শব্দে।

জিজ্ঞেস করলাম, কী তৈরী হত এখানে?

পরিতোষবাবু বললেন, বেশির ভাগ ঘণ্টা—ছোট বড় নানারকমের গঙ্। জেলে জেলে যে-সব ঘণ্টা দেখেন, সব আমাদের তৈরি। শুধু জেল কেন, ইস্কুল, কলেজ, থানা, কাছারি, চার্চ এবং আরো কত জায়গা থেকে অর্ডার পাই আমরা। আপনার কলেজে যে ঘণ্টাটা বাজত, হয়তো সেটা আমরাই পাঠিয়েছিলাম একদিন।

—তা হবে। বোধ হয় সেই ঘণ্টার টানেই এখানে এসে পড়েছি।

পরিতোষবাবু হেসে উঠলেন। বললাম, কাজ বন্ধ কেন? অর্ডার নেই বুঝি?

—অর্ডার আছে বৈকি। কিন্তু যোগেন নেই।

—যোগেন কে?

—যোগেন ছিল এখানকার Instructor। জেলে যাকে বলে ইসপিনদার। সে ব্যাটা খালাস হয়েছে এই মাসখানেক। ওরকম পাকা কারিগর আর পাচ্ছিনে। তাই তো হাঁদাটাকে বললাম, অর্ডারগুলো ফেরত দাও, আর একটা সার্কুলার করে দাও যে, ঘণ্টা আমরা আর দিতে পারবো না। ও কি বলে, জানেন? বললে Why? Let Jogen come. শুনুন কথা! যোগেন আসুক! আরে, যোগেন যদি আর চুরি না করে, তার যদি জেল না হয়, আমরা জোর করে ধরে আনবো তাকে?

এই ‘হাঁদা’ ব্যক্তিটি যে শ্বেতচর্ম ডেপুটি সুপার সে কথা বুঝতে অসুবিধা হল না। আরো কিছুদিন গেল। পেটা ঘণ্টার অর্ডার জমে উঠল। দু-চারটা তাগিদও আসতে শুরু করল। ডেপুটি সুপার বিব্রত বোধ করলেন। যোগেনের দোস্ত ছিল মহীউদ্দিন। তাঁতে কাজ করে। তাকে ডেকে পাঠানো হল। সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, যোগেনের কি হল? সে আসছে না যে?

মহীউদ্দিন বলল, সে হামি বাহার না গেলে কেমন কোরে বোলবো হুজুর?

—টোমার আর কটোডিন বাকী আছে?

—একুশ রোজ, সাব্

-টিকেট লেয়াও।

মহীউদ্দিনের টিকেট আনা হল। ডেপুটি সুপার উৎকৃষ্ট কাজের পুরস্কারস্বরূপ তার কুড়ি দিন special remission বা বিশেষ ধরনের জেল মকুফ সুপারিশ করলেন। সুপারের মঞ্জুরি এসে গেল আধ ঘণ্টার মধ্যে। মহীউদ্দিন পরদিনই খালাস হয়ে গেল।

দিনসাতেক পরে যোগেন এসে সেলাম করে দাঁড়াল সাহেবের অফিসে। পকেটকাটার অপরাধে আড়াই বছর জেল। এইবার নিয়ে আটবার হল তার শুভাগমন। সাহেব দেরাজ থেকে পেটাঘণ্টার অর্ডারগুলো বের করে তার হাতে দিয়ে বললেন, টুমি বহুৎ বড়মা আছে, যোগেন কর্মকার। এথা দেরি কাঁহে হুয়া?

যোগেন জবাব দিল না; মুচকি হাসল শুধু একবার।

পরদিন সকাল থেকেই ঘণ্টাওয়ালাদের ঠনাঠন্ শব্দে যথারীতি মাথাধরা শুরু হল পরিতোষবাবুর।

যোগেন দুটো একটা নয়। বছরের পর বছর ধরে শত শত যোগেন এমনি ঘুরে ঘুরে আসে, ধরা দেয় এই লৌহ-তোরণের বাহু-বন্ধনে, সূর্যের চারিদিকে যেমন করে ঘোরে গ্রহ আর উপগ্রহের দল। কী প্রচণ্ড আকর্ষণ! সারা জীবনেও এ পরিক্রমার বিরাম নেই। পাঁচবার, দশবার তো হামেশাই আসছে, যাচ্ছে; বিয়াল্লিশ বার জেল খেটেছে, এমন এক মহাপুরুষের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম এই সেন্ট্রাল জেলের হাসপাতালে। প্রথম যেদিন আসে, তার বয়স ছিল দশ। চুরাশী বছর বয়সে এইখানেই পড়ল তার শেষ নিঃশ্বাস।

এদের অনেককেই দেখলাম। ভদ্র, বুদ্ধিমান, চটপটে, কাজের লোক এবং এমন সব কারিগরি বিদ্যায় পারদর্শী, যার কোনো একটি অবলম্বন করে স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রার অভাব হবে না জেলের বাইরে কোনো জায়গায়। কিন্তু সে পথে এরা যায় না। জেলের ডাক এদের কাছে দুর্নিবার

রোজই এদের কেউ না কেউ খালাস পাচ্ছে। মাতব্বর গোছের একজনকে একদিন পাকড়াও করা গেল। অফিস থেকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে বললাম, কেউ কোথাও নেই, একটা সত্য কথা বলবি?

মহেশ দাঁতে জিভ কেটে আমার পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে বললে, বি কেলাসই হই আর যাই হই, হুজুরের কাছে কি মিথ্যে বলতে পারি?

—জেলে আসিস কেন?

মহেশ অসঙ্কোচে জবাব দিল, ইচ্ছে করে কি আর আসি বাবু? দশবার পকেট মারতে গেলে হঠাৎ ধরাও পড়তে হয় দু-একবার। হাত-সাফাই-এর কাজ। সবগুলো কি আর উতরে যায়?

—পকেট মারিস কেন?

-শোনো কথা! পকেট না মারলে খাবো কি?

—কেন? দেশে কত লোক তাঁতের কাজ করে খাচ্ছে। তোর মত একটা পাকা তাঁতীর কাজ জুটবে না?

মহেশ হেসে বললো, আপনি ভুলে যাচ্ছেন, হুজুর, পুরানো চোর আমি। আমার মত লোককে কাজ দেবে কে? আপনি বলবেন, ব্যবসা কর। কিন্তু ব্যবসার গোড়ার কথা হল বিশ্বাস। পুরানো চোরকে বিশ্বাস করে কেউ? পুঁজি নেই; ধারে মাল পাবো না; তৈরী জিনিস বিক্রী করতে গেলে লোকে বলবে চোরাই মাল। ধরে নিয়ে যাবে থানায়। তারপর ঘুরে ফিরে আবার সেই জেল।

বললাম, কোনো Mil-এ গিয়ে চাকরি কর।

—চাকরি দেবে কেন? চাকরি দূরের কথা, ভদ্দরলোকের পাড়ায় একটু আশ্রয় পাবারও উপায় নেই আমাদের। গেরস্তের রাত্তিরে ঘুম হবে না। ভলান্টিয়াররা পালা করে পাহারা দেবে। পুলিশ এসে ঘণ্টায় ঘণ্টায় দরজায় ধাক্কা মারবে, সারা রাত হাঁকডাক – করবে বাড়ি আছি কিনা দেখবার জন্যে। তারপর যদি কাছাকাছি কোথাও একটা চুরি- ডাকাতি কিছু হল, প্রথম দড়ি পড়বে আমারই হাতে।

আমি রেগে উঠলাম, দড়ি পড়লেই হল? মগের মুলুক নাকি? প্রমাণ করতে হবে তো?

—প্রমাণ! বিদ্রূপের হাসি ফুটে উঠল মহেশের মুখে, প্রমাণ কতো চান! পাড়ার দশজন ভদ্দরলোক নিজের পকেট থেকে গাড়িভাড়া দিয়ে কোর্টে গিয়ে সাক্ষি দেবেন। হলপ করে বলবেন, এই লোকটাকে সিঁদ কাটতে দেখেছি। কেউ বলবেন, একে দেখেছি বাকস্ মাথায় ছুটতে। সাপের সঙ্গে এক ঘরে বাস করা যায় হুজুর, কিন্তু দাগী চোরের সঙ্গে এক পাড়ায় থাকা যায় না।

একথার উত্তর খুঁজে পেলাম না। অন্য প্রশ্ন পাড়লাম। বললাম, তাই বলে জীবনভোর এই জেলের কষ্ট—

মহেশ বাধা দিয়ে বলল, কষ্টটা আপনি কোথায় দেখলেন স্যার? খাসা দোতলা বাড়ি, তিনবেলা ভরপেট খাবার, ধবধবে জামাকাপড়, শীতের দিনে তিনটা করে কম্বল, অসুখ করলে তোফা হাসপাতালে। দু’পাউণ্ড ওজন কমলে মাছ, মাংস, দুধ ঘি’র দেদার ব্যবস্থা। এরকম আরাম আছে নাকি জেলের বাইরে?

অবাক হয়ে গেলাম। বোকার মত প্রশ্ন করলাম, বলিস কি? জেলে তোদের কষ্ট হয় না?

—একটুও না। একটা কষ্ট শুধু ছিল। সেও সেই প্রথম প্রথম। আজকাল তাও নেই।

—কি সেটা?

—হুজুর অপরাধ নেবেন না?

—না। তুই বল্।

—সে হচ্ছে নেশা। যতদিন গলার ফোকরটা তৈরি হয়নি, বড্ড কষ্ট গেছে। এখন আর ভাবনা নেই।

ফোকরের কাহিনী যা শুনলাম—বিস্ময়কর এবং ভয়াবহ। একটা সীসার বল গলার ভিতর একপাশে রেখে, দিনের পর দিন তিল তিল করে তৈরি হয় এক গহ্বর। যন্ত্রণা তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে ভবযন্ত্রণা থেকে একেবারে মুক্তি পাবার সম্ভাবনা। এমনি করে বল গলায় আটকে দু-চারজন যে শেষ হয়ে যায়নি, তা নয়। মহেশের চোখের উপরেই একজন গেল সেবার। ফোকরের ঘা যখন শুকিয়ে যায়, বলটা ফেলে দিয়ে তার মধ্যে ওরা লুকিয়ে রাখে সিকি, আধুলি, গিনি, আংটি কিংবা সোনার চেন। এই গচ্ছিত সম্পত্তির বিনিময়ে আসে তামাক, বিড়ি, গাঁজা, চরস, কোকেন, আফিম, আরো কত কি নেশার উপকরণ। সে উপকরণ যারা যোগায়, আইনের কেতাবে তাদের কর্তব্য নির্দিষ্ট আছে এই সব নিষিদ্ধ-বস্তুর প্রবেশ রোধ করা। বলা বাহুল্য, তাদের কর্তব্য হানির দোষ শুধরে যায় উপযুক্ত কাঞ্চন-মূল্যে এবং সে ভার বহন করে ঐ ফোকরগচ্ছিত ধনের একটা মোটা অংশ।

মহেশ আমার কৌতূহল বুঝতে পেরে তার ফোকর থেকে উগরে বের করল একটা গিনি। তারপর সেটাকে আবার স্বস্থানে পাঠিয়ে দিয়ে আরো অনেক সুখ-দুঃখের কথা বলে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

কথায় কথায় তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সারা জীবন জেলে কাটিয়ে দিচ্ছিস, বৌ- ছেলেমেয়ের জন্যেও মনটা একবার কাঁদে না? ইচ্ছে হয় না, অন্য দশজনের মত তাদের নিয়ে ঘরসংসার করতে?

মহেশ বলেছিল, বৌ-ছেলে থাকলে তো মন কাঁদবে! ওসব ঝঞ্ঝাট আমাদের প্রায় কারুরই নেই।

বিস্মিত হয়ে বলেছিলাম, সে কি! এত যে মেয়েছেলে আসে তোদের সঙ্গে দেখা করতে? দরখাস্তে লেখে অমুক আমার স্বামী, অমুক আমার স্বামীর ভাই!

মহেশ হেসে ফেলল—স্বামী-টামী না বললে আপনারা দেখা করতে দেবেন কেন? আসলে বৌ নয় কোনোটাই।

একটু থেমে অনেকটা যেন আপন মনে বলেছিল, না-ই বা হল বৌ, এরাই আমাদের অসময়ের বন্ধু। রোগে-শোকে, আপদে-বিপদে এরা না টানলে আমাদের উপায় ছিল না। সেবার বসন্ত হল ঐ রামদিন কাহারের। কী সেবাটাই না করলে বিলি! লুকিয়ে রাখল নিজের ঘরে, কর্পোরেশনের লোক পাছে টের পেয়ে নিয়ে যায় হাসপাতালে। ওরই জন্যে ‘রামদিন বেঁচে গেল। তারপর পড়ল ও নিজে। রামদিনটা হাসপাতালে খবর দিয়ে এল। অ্যাম্বুলেন্স দেখে কী কান্না বিলির! কাঁদে আর বলে, আর বাঁচবো না, মহেশদা। নেহাত পরমায়ুর জোর ছিল মেয়েটার। প্রাণে মরল না, কিন্তু চোখ দুটো গেল। এখন রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে। মেয়েগুলো সত্যই বড় ভালো হুজুর।

মহেশ চলে গেলে মনে পড়ল, কবে কোথায় যেন পড়েছি—বাইরে থেকে মানুষের ভালো করতে যাবার মত বিড়ম্বনা আর নেই। অথচ, এই বিড়ম্বনাই আমরা কোমর বেঁধে করে যাচ্ছি। এই ‘বি’ ক্লাস জেলঘুঘু পুরাতন পাপীদের উদ্ধার করবার জন্যে একদল লোকের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। যে সব পণ্ডিত ব্যক্তি crime-এর জীবাণু নিয়ে মাথা ঘামান এবং সে পোকাগুলোর আসল বাসস্থান রক্তের মধ্যে না মাথার খুলিতে, এই মহাতথ্য সম্বন্ধে গবেষণা করেন, তাঁদের কথা বলছিনে। Crime-এর জন্মস্থান যে পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া—এই পুরানো ধুয়া তুলে Heredity vs. Environment-এর সনাতন ঝগড়া আমদানি করে যাঁরা মাসিকপত্রে পাঠকের কান ঝালাপালা করেন, তাঁদের প্রসঙ্গও আলোচনা করছিনে। আমি বলছিলাম তাঁদের কথা, যাঁরা ক্ষেপে উঠেছেন জেল রিফর্মের ধ্বজা নিয়ে। আহা! বড্ড কষ্ট কয়েদীগুলোর! কম্বলের জামাটা গায়ে ফোটে; দাও ওর নীচে একটা সুতী লাইনিং। কম্বল শয্যার উপর বিছিয়ে দাও একখানা করে চাদর। মাছের টুকরোটা বাড়িয়ে দাও। ধনের বরাদ্দটা হাস্যকর—এক ছটাকের ১২৮ ভাগের এক ভাগ। ঐ হোমিওপ্যাথিক ডোজটা ডবল কর। বেচারীরা বিড়ি খেতে পায় না? ডিগ্রেসফুল! এক বাণ্ডিল বিড়ি বরাদ্দ হোক প্রত্যেকের জন্যে, কিংবা দাও একটা করে হুঁকো-কলকে। বড্ড একঘেয়ে জীবন ওদের। মাঝে মাঝে ঝাড় একটা করে ম্যাজিক ল্যান্টার্নের লেকচার। একটা করে রেডিও সেট বসিয়ে দাও ওদের ব্যারাকের মাথায় গান-বাজনা? অবশ্যই চাই। ম্যান্ ডাজ নট লিভ বাই ব্রেড অ্যালোন! সন্ধ্যার পর কীর্তন করুক সবাই মিলে। মাঝে মাঝে জারি গান আর কবির লড়াই। অর্থাৎ জেলকে যেন কেউ জেল বলে বুঝতে না পারে। আহারে-বিহারে যতটা পার আরাম দাও। আহা, কী ভীষণ কষ্ট বেচারাদের!

হতভাগ্য কয়েদীর দুঃখে এই সহৃদয় রিফর্মারদের কোমল হৃদয় অহরহ বিগলিত হচ্ছে। কিন্তু বন্দীর হৃদয়ের খবর এরা পাননি কোনদিন। এঁদের একজনকে লক্ষ্য করেই বলেছিল মহেশ—সবচেয়ে অসহ্য আপনাদের ঐ ভিজিটার-বাবুরা। এমন চোখে চাইবে, যেন আমরা সব কেষ্টর জীব। একবার এক বুড়ো এসে ধরল আমাকে—শুনলাম, তিনি নাকি একজন রায়বাহাদুর—কেমন আছ? কি খাও? কি অসুবিধা তোমাদের? এমনি সব ন্যাকামি! গা জ্বলে গেল। বললাম, বাবু, জেলের মধ্যে কি খাই সে খবর না নিয়ে জেলের বাইরে গিয়ে কি খাব, তাই নিয়ে একটু মাথা ঘামান। তাতেই অনেক বেশি উপকার হবে আমাদের। কথাটা বোধ হয় ভাল লাগল না রায়বাহাদুরের। হন্ হন্ করে চলে গেল। এরকম কত দেখলাম। ওদের দরদ উথলে ওঠে যতক্ষণ জেল খাটছি। বাইরে গিয়ে যখন ফ্যাফ্যা করে বেড়াই, কেউ পৌঁছেও না। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়, আর সবাই মিলে ফন্দী আঁটে কি করে এই জেল-ঘুঘুটাকে জেলে পুরে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।

যোগেন মহেশ অ্যাণ্ড কোম্পানির অনেকগুলো মুখ আজ ভিড় করে আসছে মনের কোণে। কেউ বেশ জ্বলজ্বলে; কেউ বা ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে গেছে স্মৃতির অন্তরালে। এদেরই একজনের হাতে তৈরি আমার এই বেতের চেয়ারখানা। সংসারে যে-কটি আমার প্রিয়বস্তু আছে, তার মধ্যে এর স্থান ছোট নয়। এতকাল পরে আজও কোনো কোনো দিন নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায় এই চেয়ারখানা নিয়ে যখন আমার বাগানের কোণটিতে গিয়ে বসি, চোখের উপর ভেসে ওঠে কালো ছিপছিপে মজবুত গড়নের এক জোয়ান ছোকরা, হাসিহাসি মুখে বসন্তের দাগ, মাথায় ঢেউখেলানো বাবরি। নাম জিজ্ঞেস করলে বলত, রহিম শেখ, বেত-কামানের ওস্তাগর। অর্থাৎ তার পদমর্যাদা সম্বন্ধে সে নিজেও যেমন সচেতন ছিল অপরকেও তেমনি সজাগ করে রাখত।

রহিম গাঁজা, বিড়ি, চরস এসব স্পর্শ করত না। তার চেয়েও বড় নেশা এবং ঐ একটিমাত্র নেশা ছিল তার চুল। কেশ-প্রসাধনের জন্যে তেলের প্রয়োজন। সেটা নানা উপায়ে তাকে সংগ্রহ করতে হয়। সে তেলের কতক যেত তার মাথায়, আর বেশীর ভাগ যেত জমাদারের পায়ে। তা না হলে কাঁচির মুখে কোনদিন উড়ে যেত তার শখের বাবরি। বলাবাহুল্য, তৈল-সংগ্রহের জন্যে তার ফোকর-ব্যাঙ্কের উপর যে চাপ পড়ত গাঁজা- চরসের ধাক্কার চেয়ে সেটা বেশী বই কম ছিল না।

বি-ক্লাস বন্দীদের একটা সাধারণ ব্যাধি আছে, যাকে ওরা বলে ছোকরা রোগ- নিপীড়িত যৌন-জীবনের কুৎসিত বিকৃতি। জেল-ক্রাইমের একটা বড় অংশের মূলে রয়েছে এই ছোকরা রোগ, যার জন্যে দায়ী বোধ হয় ওদের স্ত্রী-সঙ্গ-বর্জিত দীর্ঘ কারাবাস এবং সেখানকার কলুষিত আবহাওয়া। এরই তাড়নায় কত কুটিল ষড়যন্ত্র, কত জঘন্য জিঘাংসা, কত আঘাত প্রতিঘাতের বীভৎস লীলা প্রতিদিন ঘটে যাচ্ছে ঐ লম্বা ব্যারাকগুলোর গহ্বরে, সে ইতিহাস কোনোদিন লেখা হবে না।

হাসপাতাল থেকে রহিম শেখের জন্যে দৈনিক বরাদ্দ ছিল আধসের দুধ। কিন্তু রহিম তার বাহক মাত্র। যে-ভাগ্যবান্ সে দুধ উদরস্ত করত, তার বয়স ছিল সতেরো; দেহের রং মোটামুটি ফরসা এবং স্বাস্থ্য নিটোল। একে নিয়েই একদিন ঘনিয়ে উঠল মেঘ, এবং তার শেষ পরিণতি হল ছোরা বর্ষণ—রহিম আর পটলার মধ্যে প্রাণ দেওয়া-নেওয়ার খেলা। আঘাতের মাত্রার বেশীর ভাগ পড়েছিল রহিমের ভাগে। তাই শাস্তির বেলায় সুপার তার পাওনাটা একটু কমিয়ে দিলেন। রহিমের ধারণা, সেটা সম্ভব হয়েছিল শুধু আমারই সানুগ্রহ হস্তক্ষেপের ফলে।

খালাস হবার কিছুদিন পর ও আমার সঙ্গে দেখা করতে এল আমার বাড়িতে। আমি তারই হাতের তৈরি আমার এই প্রিয় চেয়ারখানায় বসে কি একটা করছিলাম। রহিম খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, চেয়ারখানা তাড়াতাড়ি নামিয়ে দিলাম। জিনিসটা পছন্দসই হল না। আচ্ছা, তার জন্যে কি? এবার এসে আর একটা করে দিচ্ছি—একেবারে নতুন ডিজাইন। যতদিন বসবেন রহিমকে মনে পড়বে।

আমি বললাম, থাক, চেয়ারের দরকার নেই আমার। তোকে আর আসতে হবে না। কটা দিন অপেক্ষা কর। একটা ভাল কাজ জোটাতে পারবো বলে মনে হচ্ছে তোর জন্যে।

রহিম ব্যস্ত হয়ে বলল, না না, ওসব আপনি কখনো করতে যাবেন না।

তার আপত্তির বহর দেখে হেসে ফেললাম, কেন রে? কাজের কথা শুনে ভয় পাচ্ছিস কেন?

রহিম সোজাসুজি বলল, দরকার নেই আপনার কাজ খুঁজে। ওতে আমার তো কোনো উপকার হবেই না, বরং আপনি ফ্যাসাদে পড়ে যাবেন।

অবাক হয়ে বললাম, আমি ফ্যাসাদে পড়বো কেন?

রহিম বারান্দার কোণে চেপে বসে বলল, তবে শুনুন একটা গল্প বলি।

সেবার খালাস পেলাম—জেল থেকে। সাহেব চার টাকা বকশিশ দিলেন। সেই সঙ্গে দিলেন দু’দিনের খোরাকি বারো আনা আর শেয়ালদহ পর্যন্ত একখানা রেলের পাশ। মাথায় কি বখেয়াল এল। কোলকাতায় না ফিরে, মনে করলাম, ঐখানেই একটা কাজকর্ম জুটিয়ে নিয়ে থেকে যাবো। বেতের কাজ তো আগেই জানতাম। এবার একটা পাকা ওস্তাগরের হাতে পড়ে ছুতোর মিস্ত্রির কাজটাও বেশ ভালোরকম রপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সারাদিন কাজ খুঁজে বেড়াই, আর রাত্রিবেলা পড়ে থাকি ইস্টিশনে। দেখতে দেখতে টাকা কটা ফুরিয়ে গেল।

সেদিন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। প্ল্যাটফরমে ঘুরে বেড়াচ্ছি। একেবারে গা ঘেঁষে এক মাড়োয়ারী বাবু চলে গেল। পকেটে একতাড়া নোট। হাতটা নিশপিশ করে উঠল। লোকটা এমন হাঁদা, নোটগুলো হাতিয়ে নিতে লাগত ঠিক এক সেকেণ্ড। কিন্তু সামলে নিলাম নিজেকে, কপালে দুঃখ থাকলে যা হয়। ভোরের দিকে, তখনো ঘুম ভাঙেনি, পিঠে এক জুতোর ঠোক্কর। চোখ মেলে দেখি পুলিশের হাবিলদার। বললাম, মারছেন কেন খালি খালি?

—তবে রে শালা—বলে চুল ধরে টেনে তুলল। তারপর থানায়। ১০৯ ধারায় চালান দিয়ে দিল। সেদিন ছিল রবিবার। ওয়ারেন্ট সই করাতে হবে এস-ডি-ও সাহেবের বাসায় আমাকে নিয়ে চলল বেঁধে। শুনলাম হাকিমটা নাকি ‘পাগলা’। আসামী না দেখে ওয়ারেন্ট সই করে না।

বাড়ির সামনে টেনিস খেলবার মাঠ। তারই একপাশে বেতের চেয়ারে বসে একজন মেয়েছেলে উল বুনছিলেন। ভাবে বুঝলাম, এস. ডি. ও সাহেবের পরিবার। অল্প বয়স; মুখ দেখলেই বোঝা যায় প্রাণে দয়ামায়া আছে। পাশে একখানা ছোট টেবিল। পুলিশ দুজন একটু দূরে দাঁড়িয়ে খৈনি টিপছিল। সেই ফাঁকে একটু এগিয়ে গিয়ে সেলাম করে বললাম, মেমসাহেব, আপনার ঐ টেবিলটা পালিশ করা দরকার। মেহেরবানি করে যদি কাজটা আমাকে দেন। দু’দিন খেতে পাইনি।

প্রথমে উনি খানিকটা চমকে উঠলেন। পুলিশ দুটোও রা-রা করে ছুটে এল। তাদের হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে উনি এগিয়ে এসে বললেন, পালিশের কাজ জান তুমি?

—জানি, মেমসাহেব।

দেশী হাকিমের পরিবারেরা মেমসাহেব বললে খুশী হন, এটা আমার জানা ছিল।

উনি বললেন, তুমি চুরি করেছ?

—না, হুজুর। চারদিন হল জেল থেকে বেরিয়েছি। কাজ খুঁজছিলাম। ইস্টিশন থেকে খালি খালি ধরে এনেছে।

মেমসাহেব ভিতরে চলে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পরে সাহেবকে সঙ্গে করে ফিরে এলেন। তিনি এসে আমাকে অনেক কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। তারপর কোথায় কোথায় ফোন করে শেষটায় পুলিশদের হুকুম করলেন, আসামী ছেড়ে দাও।

প্রায় দশ-বারো দিন ধরে ওদের সব ফার্নিচার পালিশ করে দিলাম। মালমশলা কেনবার টাকা আমারই হাতে ধরে দিলেন। আমিই সব কিনে নিয়ে এলাম। হিসাব দিতে গেলাম; নিলেন না। কাজ দেখে মেমসাহেব ভারী খুশী। এ ক’দিন খেতে তো দিলেনই তার উপর বকশিশ দিলেন দশ টাকা।

এদিকে সাহেব আমার জন্যে কাজ খুঁজছিলেন। একদিন জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি কি কাজ জানো?

—সব রকম বেতের কাজ জানি হুজুর। মেমসাহেব যে চেয়ারটায় বসে আছেন, ওটা জেলে বসে আমিই তৈরি করেছিলাম।

—বটে!

ওখানকার কাজ শেষ হলে উনি আমাকে একটা চিঠি দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন শহরের বাইরে কোন্ এক জমিদার এক ইস্কুল খুলেছিলে, সেখানে। বড়লোকের খেয়াল। ভদ্দরলোকের ছেলেদের ধরে হাতের কাজ শেখানো হচ্ছে—তাঁত, কাঠের কাজ, ছুরি কাঁচি তৈরি, বেতের কাজ এইসব।

আমি হলাম বেতের মাস্টার। মাইনে কুড়ি টাকা। এস. ডি. ও. সাহেব বলে দিয়েছিলেন তুমি যে জেল খেটেছ, একথা কাউকে বোলো না। আমি মনে মনে হাসলাম। দাগী চোরের গায়ে জেলের গন্ধ লেগে থাকে,—একথা ওঁর জানা ছিল না। ছোকরা হাকিম কিনা।

মাসখানেকের মধ্যেই পুলিশের চেষ্টায় সব জানাজানি হয়ে গেল। ছাত্ররা বলে বসল, আমরা জেলখাটা চোরের কাছে কাজ শিখবো না। বুঝলাম, আমার চাকরি এবার খতম। মানে মানে সরে পড়ব ভাবছি, এমন সময় জমিদারের মেয়ের গলা থেকে হার চুরি গেল পুকুরঘাটে। পুলিশ এসে ধরল আমাকে। পিঠেও বেশ কিছু পড়ল, সে তো বুঝতেই পারছেন। জমিদার মামলা চালাতে দিলেন না। আমাকে ডেকে নিয়ে এক মাসের মাইনে বেশী দিয়ে চোখ-পাকিয়ে বললেন, জুতো দেখতে পাচ্ছিস?

আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, পাচ্ছি।

—খবরদার! আমার জমিদারির ত্রিসীমানায় কোনোদিন পা দিয়েছিস তো পিঠের চামড়া তুলে নেবো, বুঝলি?

এবারেও ঘাড় নেড়ে বললাম, বুঝেছি।

জমিদারবাবু হাঁক দিলেন, দারোয়ান!

দারোয়ান এসে আমার কান ধরে হিড়হিড় করে নিয়ে চলল। যাবার সময় কানে এল বাবু বলছেন, যেমন জুটেছে একটা পাগল এস. ডি. ও.! ইস্কুলের মাস্টার চাই, পাঠালো এক দাগী চোর!

কাজকর্ম করে খাবার শখ অ্যাদ্দিনে মিটে গিয়েছিল। এবার নিজের পথ ধরলাম। ইস্টিশনে জুটে গেল একটা কেস্। পকেট ভারী করে চলে এলাম। কোলকাতায়। কিছুদিন পরেই আবার সেই “পুরানা জেল”।

আমি বললাম, হাঁপ ছেড়ে বাঁচলি, কি বলিস?

—সে কথা আর বলতে, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল রহিম, বাইরে যে-কদিন থাকি, মনে হয় পরের বাড়ি আছি। নিজের বাড়িঘর বলতে যা কিছু আমাদের ঐ জেল। জেলকে লোকে ঠাট্টা করে বলে শ্রীঘর। কথাটা কিন্তু একেবারে খাঁটি, স্যার।

—বেশ, তা যেন হল। কিন্তু আমার কি ফ্যাসাদ হবে বলছিলি যে?

রহিম অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ঐ দেখুন, আসল কথাটাই ভুলে গেছি। কোলকাতায় আসবার ক’দিন পরেই পটলার সঙ্গে দেখা চিৎপুরে। তার কাছে শুনলাম, এস. ডি. ও. সাহেবের চাকরি নিয়ে টানাটানি। একটা দাগী চোরকে পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে বাড়িতে জায়গা দিয়েছেন, ইস্কুলে চাকরি করে দিয়েছেন—সাহেব কালেকটার নাকি বেজায় খাপ্‌পা। উনি আর এস. ডি. ও. নেই। সাধারণ হাকিম করে কোথায় বদলি করে দিয়েছেন। তাই তো বলছিলাম স্যার, পুরনো চোরের ভেজাল অনেক। আপনি কখনো এসব ঝঞ্ঝাটে জড়াতে যাবেন না। একটা বিপদ ঘটতে কতক্ষণ?

.

রহিম চলে গেল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত তার কথাগুলো মনের মধ্যে নড়েচড়ে বেড়াতে লাগল। অনেক কথার মধ্যে একবার সে বলেছিল, আমরা দাগী। আমাদের এ দাগ কি কোনো কালেও মিটবে না?

উত্তর দিতে পারিনি। হয়তো এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। মাঝে মাঝে মনে হয়, দাগী ওরা নয়, দাগ পড়েছে আমাদের চোখে, দাগ পড়েছে আমাদের মনে—যে চোখ দিয়ে ওদের দেখি, যে মন দিয়ে ওদের বিচার করি, সেইখানে। আমরা ভদ্র মানুষ, সভ্য মানুষ, সৎ মানুষ। কোনোদিন ভুলি না, এই লোকটা একদিন জেলের ঘানি টেনেছিল। সমাজের যে স্তরে যে স্থানটুকু সে ছেড়ে গিয়েছিল সেখানে ফিরে এসে দাঁড়াবার সুযোগ তাকে আমরা দিতে পারি না কিছুতেই। একবার যে গেল, সে চিরকালের তরেই গেল। যে ছাপ পড়ল তার কপালে, আমাদের চোখে সে কোনোদিন মুছবে না।

মনে পড়ে গেল অনেকদিন আগেকার ঘটনা। তখন কলেজে পড়ি। একটা কি সাহিত্য- সভাটভা উপলক্ষ করে প্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্রের সান্নিধ্যলাভ করবার সুযোগ জুটে গেল। ঘণ্টাকয়েক ছিলাম তাঁর কাছে; তাঁর সৃষ্ট পতিতা চরিত্রের প্রসঙ্গ নিয়ে কী একটা মন্তব্য করেছিলাম। তিনি হঠাৎ কেমন গম্ভীর হয়ে গেলেন। গড়গড়ার নলটা মুখ থেকে নেমে এল হাতে। তীক্ষ্ণ চোখ দুটো কেমন উদাস হয়ে উঠল। সহসা যেন কত দূরে চলে গেলেন। কোথাকার কোন্ অলক্ষ্য বস্তুর দিকে চেয়ে মৃদুকণ্ঠে বললেন, পতিতা! হ্যাঁ; ওদের নিয়ে অনেক কথাই উঠেছে, যদিও আমি সেটা ঠিক বুঝতে পারিনে। আমি যে ওদের অনেকের কথাই জানি। নিজে চোখে দেখেছি, এমন জিনিস ওদের মধ্যে আছে, যা বড় বড় সমাজে নেই। ত্যাগ বল, ধর্ম বল, দয়া, মায়া, প্রেম—মনুষ্যত্ব বলতে যা বুঝি, ওদের মধ্যেও অভাব নেই।

একটু থেমে করুণার্দ্র কণ্ঠে বলেছিলেন, তা ছাড়া, কোনো মানুষ নিছক কালো, তার মধ্যে কোনো redeeming feature নেই, একথা ভাবতে আমার কষ্ট হয়। ও আমি পারি না।

বাইরে সন্ধ্যার ছায়া ঘনিয়ে এসেছে। কেউ কোথাও নেই। একটি ছোট্ট বারান্দায় তাঁর সামনে পাশাপাশি বসে আমরা দুটি তরুণ ছাত্র। আমাদের দিকে না চেয়ে, অনেকটা যেন আত্মগত ভাবে, থেমে থেমে এই ক’টা কথা তিনি বলে গিয়েছিলেন। আজ এতকাল পরে ঐ হতভাগা দাগী চোর রহিম শেখের দিকে চেয়ে মানব-দরদী কথাশিল্পীর সেই বেদনাসিক্ত কথাগুলো মনে পড়ে গেল। ভাবছি, এরাও কি নিছক কালো? এদের মধ্যেও কি কোনো redeeming. feature নেই?

শতাব্দীর ওপার থেকে টমাস হার্ডির মানসকন্যা টেস্-এর কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি। একটি রাত্রির মুহূর্তের দুর্বলতা তার জীবনে নিয়ে এসেছিল লজ্জা; কলঙ্ক আর অভিশাপ। সে দাগ যখন সারাজীবনেও মুছে ফেলা গেল না, তার আর্ত কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হল এক কঠিন প্রশ্ন—The recuperative power of Nature is denied to maidenhood alone? নিরন্তর ভাঙাগড়াই তো প্রকৃতির লীলা। ছিন্ন শাখার মূল থেকে দেখা দেয় নবপত্রোদ্‌গম অতবড় পুত্রশোক, তারও ক্ষত একদিন মিলিয়ে যায় মায়ের বুকে। অশ্রুধারা শুকিয়ে যায়, ফিরে আসে হাসির ঝলক। কিন্তু মুহূর্তের তরে খণ্ডিত হল যে কুমারীর কৌমারধর্ম, তার কালিমা রেখা কি কোনোদিন মুছবার নয়? প্রকৃতির অপরাজেয় সঞ্জীবনীশক্তি এইখানেই শুধু ব্যর্থ হবে?

টেস্ তার প্রশ্নের জবাব পেয়েছে কিনা জানি না। কিন্তু রহিমের প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত। লৌহ যবনিকার অন্তরালে শত শত রহিমের চোখে ফুটে আছে ঐ একটি নির্বাক প্রশ্ন—আমাদের এ দাগ কি কোনোদিন মুছবে না?

প্রাণপূর্ণ দরদ নিয়ে যদি আসেন কোনো টমাস হার্ডি কিংবা শরৎ চাটুজ্জে, হয়তো এর জবাব একদিন মিলবে।

.

পনেরো বছর পরের কথা। ইতিমধ্যে গোটাসাতেক জেল ঘুরে আবার এসেছি কলকাতায়। আগের বছর বড় মেয়ে বিনুর বিয়ে দিয়েছি। জামাই-ষষ্ঠীর তত্ত্ব করতে হবে, সেই সব আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত গৃহিণীর বিশেষ ফরমাস—এক ঝুড়ি ল্যাংড়া আম দেওয়া চাই-ই। দুপুরে রোদ মাথায় করে বড়বাজার পোস্তায় গিয়েছিলাম আম কিনতে। ভীষণ ভিড়। অনেক দোকান ঘুরে বহু দরদস্তুর করে এক জায়গায় পছন্দ করে দাম দিতে যাচ্ছি—সর্বনাশ! মনিব্যাগ কৈ? এ পকেট ও পকেট বৃথাই হাতড়ে দেখলাম বার বার। আম ঐ পর্যন্ত রইল। ফিরবো যে তার ট্রামভাড়াটাও নেই। হ্যারিসন রোডের ফুটপাথ ধরে পূবদিকে পা চালিয়ে দিলাম।

—সেলাম, হুজুর।

চমকে উঠলাম। গলাটা চেনা-চেনা। তাকিয়ে দেখি, বেঁটে কালো কাঁচা-পাকা দাঁড়িওয়ালা একটা লোক। মাথায় ঢেউখেলানো বাবরি।

—কে, রহিম?

—হ্যাঁ, হুজুর। গরিবকে ভোলেননি, দেখছি।

—কেমন আছিস, রহিম?

—ভালোই আমি আপনার দোয়ায়।

একটু তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে চেয়ে রহিম বলল, আপনাকে কেমন যেন শুকনো দেখাচ্ছে, স্যর। শরীর ভালো আছে তো?

গোটা পঁচিশেক টাকা ছিল ব্যাগেতে। বড্ড মুষড়ে পড়েছিলাম। চেষ্টা করেও নিস্তেজ ভাবটা চাপা দিতে পারলাম না। বললাম, ভালোই আছি। তবে —

রহিম সাগ্রহে অপেক্ষা করছিল। আমি একটু হাসবার মত মুখ করে বললাম, মনিব্যাগটা চুরি গেল।

রহিম ব্যস্ত হয়ে বলল, এখন চুরি গেল? কোথায়?

বললাম, ঐ আমপট্টিতে, এই আধ ঘণ্টাটাক হবে। সে যাক্, তারপর তুই আছিস কোথায়? কাজটাজ কিছু

রহিম সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, আপনি দাঁড়ান বাবু, আমি এখুনি আসছি বলে ছুটে বেরিয়ে গেল।

আমি সেইখানেই অপেক্ষা করে রইলাম। পনেরো মিনিট, কুড়ি মিনিট, আধ ঘণ্টা যায়। হঠাৎ মনে হল, এ কি করছি? একটা পুরোনো চোর কি বলে গেল, আর তার কথায় দাঁড়িয়ে আছি আমি—একজন পদস্থ সরকারী অফিসার! পা বাড়াতে যাচ্ছি, রহিম ছুটতে ছুটতে এসে হাজির। ফতুয়ার পকেট থেকে দুটো মনিব্যাগ বের করে বলল, দেখুন কোটা আপনার?

আমি নিজের ব্যাগটা তুলে নিলাম।

রহিম বলল, খুলে দেখুন সব ঠিক আছে কিনা। দেখলাম, সব যেমন ছিল ঠিক তেমনি আছে। আমার বিস্ময়ের সীমা ছিল না। বললাম, কোথায় পেলি? রহিম হেসে জবাব দিল, সে অনেক কথা, হুজুর। সব আপনি বুঝবেন না। ছোকরাটা নতুন। আপনাকে তো চেনে না। তবে ভারী বিশ্বাসী। সরায়নি কিছুই, গোটাটাই জমা দিয়েছে। সর্দারের কাছে গিয়ে আপনার কথা বলতেই তাড়াতাড়ি বের করে দিল। সর্দার এখন ভারি ব্যস্ত, নৈলে নিজেই আসত। বলে দিল, বাবা যেন আমাদের কসুর মাপ করেন।

আমি একখানা দশটাকার নোট তুলে নিয়ে রহিমের হাতে দিতে গেলাম। সে দাঁতে জিভ কেটে জোড়হাত করে দু-পা পিছনে সরে গেল। তারপর আমার পায়ে হাত ছুঁইয়ে বলল, কসুর আর বাড়াবেন না হুজুর।

আমি আর পীড়াপীড়ি করতে পারলাম না। রহিম বলল, আম কিনতে এসেছিলেন এদ্দুর?

—হ্যাঁ, বড় মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে দিতে হবে। ঝুড়িখানেক ল্যাংড়া আম; সবাই বললে পোস্তাতে সুবিধা হবে।

রহিম বলল, এখানে আম কেনা কি আপনার কাজ? চলুন আমি কিনে দিচ্ছি।

আমার উৎসাহ কমে গিয়েছিল। বললাম, থাক। ওদিক থেকেই না হয় নেবো।

রহিম বলল, আপনাকে বাজারে ঢুকতে হবে না। কষ্ট করে এই মোড়টায় এসে একটু দাঁড়ান। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসছি।—বলে আমার সম্মতির অপেক্ষা না করেই সে চলে গেল।

মিনিট দশেকের মধ্যেই কুলীর মাথায় দু-ঝুড়ি ল্যাংড়া আম নিয়ে সে ফিরে এল এবং একটা ঘোড়ার গাড়ির ছাদে চাপিয়ে দিয়ে গাড়োয়ানকে বলল, বাবুকে পৌঁছে দিয়ে আয়। আমি আমের দাম জানতে চাইলাম। রহিম আবার হাতজোড় করল। বিরক্তির সুরে বললাম, না না, সে কি হয়? খালি খালি এতগুলো টাকা তুই দিতে যাবি কেন? আর আমিই বা নেবো কেন?

রহিম সঙ্কুচিত হয়ে বলল, আপনাকে দিইনি হুজুর। আমার বিনু-মাকে দিলাম। সেই কবে দেখেছি! আপনার চাকর নিয়ে আসত গেটের সামনে। দু-বছরের মেয়ে; যেন বেহেস্তের পরী। সেই আমাদের ছোট্ট বিনু-মা আজ বড় হয়েছে। সাদী হয়েছে। গরিব রহিম আর কিই বা দিতে পারে? দুটো আম দিলাম আমার মাকে

গলাটা আটকে গেল। চোখ দুটো ছলছল করে উঠল।

আমের দাম আর দিতে পারলাম না।

বাড়ি পৌঁছে গাড়ির ভাড়া দিতে গেলাম। গাড়োয়ান সেলাম করে বলল, ভাড়া পেয়ে গেছি, বড়বাবু।

—সে কি! কে দিলে ভাড়া?

—কেন, রহিম!

—না, না, সে হবে না। ও টাকা ফিরিয়ে দিও। ভাড়া তোমাকে নিতেই হবে!

গাড়োয়ান ভয়ে ভয়ে বলল, বলেন কি বাবু? ঐ রহিমকে আপনি চেনেন না? আস্ত পুঁতে ফেলবে আমাকে।