অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
ঈশ্বরের বাগান
চার
রাতে চন্দ্রনাথ ভাল ঘুমাতে পারেন নি। এমনিতেই সকালে ওঠার অভ্যাস। ঘুম না হলে আরও সকালে উঠে বসে থাকেন। অন্ধকার থাকে উঠোনে। গাছপালাগুলো নিঝুম। উত্তরের আকাশে বারান্দা থেকে বড় নক্ষত্রটা দেখতে পান। আজ দেখলেন বড় নক্ষত্রটা দেখা যাচ্ছে না। বর্ষাকাল, আকাশ মেঘলা থাকে। কিন্তু দু-দিন ধরে আকাশ শরতের আকাশের মত। নক্ষত্রটা দেখা যাবার কথা! কোথায় গেল। লিচু গাছটার নিচে এসে তিনি নিশ্চিন্ত হলেন। না, দেখা যাচ্ছে। ফের এসে বসলেন বারান্দায়। শান বাঁধানো মেঝে মাটির দেয়াল। ওপরে টিনের শেড। এটাই বড় ঘর। এই ঘরে তিনি একটা তক্তপোশে আলাদা শোন। পাশের বড় তক্তপোশটায় ধনবৌ তার দুই নাতিনাতিন আর মেজ বৌমা শুয়েছে। অতীশ চলে যাওয়ায় উত্তরের ঘরটা ছোট দুই ছেলে দখল করে নিয়েছে।
নক্ষত্রটা দেখার পর তার কেন জানি মনে হল, না কিছুই হারিয়ে যায় নি। অথচ সারাটা রাতই তিনি আধো ঘুম আধো জাগরণে দেখেছেন তাঁর কিছু হারিয়ে গেছে। তিনি দুবার বালিশের তলা, তোষকের নিচে হাত বাড়িয়েও দেখেছেন। তাঁর বাক্স প্যাঁটরা বলে কিছু নেই। অতীশ যা টাকা দেয় সব একটা পুঁটুলিতে রাখেন। দরকার মত টাকা পয়সা বের করে দেন। কড়াক্রান্তির হিসেব তিনি কখনও রাখেন না। জীবনটাই আন্দাজের ওপর চলে যাচ্ছে! অত হিসেবে কি দরকার। মোটামুটি একটা হিসাব রাখেন। দু-চার টাকার এদিক-ওদিক হলে তিনি কখনই ধরতে পারেন না। পুঁটুলিতে রুদ্রাক্ষের মালা আছে। আর আছে গোটা দশেক তাঁর জীবনের অমূল্য বই। বইগুলোও ঠিক আছে। পদ্মপুরাণ, পুরোহিতদর্পণ, কৃত্তিবাসের রামায়ণ, একটি এ-বছরের পঞ্জিকা, দ্রব্যগুণ সম্পর্কিত বই … না সবই ঠিক আছে। কেউ কিছু সরায়নি। তবু রাতে আধো ঘুম আধো জাগরণে কেন যে মনে হচ্ছিল কেউ তাঁর কিছু সরিয়ে নিয়েছে। তিনি কিছু হারিয়েছেন।
ধনবৌর পাতলা ঘুম। লম্ফ জ্বালতে দেখে বলেছিল, কি করছ?
চন্দ্রনাথ গম্ভীর গলায় বলেছিলেন, টাকা গুনছি। যেন এমন সময় কারো জেগে থাকা ঠিক না। তোমাকে কে আবার জাগতে বলেছে! খবরদারি করতে বলেছে। ঘুমাচ্ছ ঘুমাও।
ধনবৌ পাশ ফিরে শুতে গিয়ে বুঝেছিল ছোট নাতি প্যাণ্ট কাঁথা সব ভিজিয়েছে। তাড়াতাড়ি উঠে ডাকল, ও বৌমা, ওঠো। কাঁথা পাল্টে দাও। সব ভিজিয়েছে।
বৌমা উঠেও দেখেছিল, মশারির নিচে চন্দ্রনাথ বসে আছেন। সামনে সেই নতুন লাল সালু কাপড়ের পুঁটুলিটা। কি আঁতিপাতি করে খুঁজছেন।
—এত রাতে বাবা কি করছেন? বৌমা এমন প্রশ্ন করেছিল।
—এই খুঁজছি।
—কি খুঁজছেন?
—সেটা বলতে পারলে তো হতই। মনে করতে পারছি না। তোমরা কিছু আমার ধরেছিলে!
—না বাবা। পাশ থেকে আর একটা ছোট্ট কাঁথা বের করে ধনবৌর হাতে দেবার সময় বৌমা বলেছিল, এই নিন মা। এত পেচ্ছাপ করে!
—ছেলেমানুষ করবে না। শরীর না হলে হাল্কা হবে কি করে। বড় হবে কি করে। তোমরাই বা বুঝবে কি করে সন্তান মানুষ করা কি কষ্ট!
মেজবৌমা তারপর শুয়ে পড়েছিল। অতীশ চলে যাওয়ায় উত্তরের ঘরটা বৌমা ছেড়ে দিল। রাতে একা শুতে ভয় পায়। মেয়েটা বাড়ি নেই। বড় শ্যালক গোপাল এসে নিয়ে গেছে।
চন্দ্রনাথের দুম করে বড় শ্যালকের ওপর কেমন রাগ চড়ে গেছিল। নবাবী এখনও ঠিক আছে। স্বভাব চরিত্র ভাল ছিল না। বৌটিকে মারে! চরিত্রে কিছু দোষ ছিল এক সময়। গুণের মধ্যে এই নিঃসন্তান মানুষটি অলকাকে মেয়ের চেয়ে বেশি ভালবাসে। সময়ে অসময়ে অলকাকে কিছুদিন কাছে নিয়ে রাখে।
ধনবৌ কাঁথা পেতেও বোধহয় বসে বসে মজা দেখছিল। না হলে এক সময় বলবে কেন, বয়স যত বাড়ছে, তত ভীমরতি ধরছে।
—হ্যাঁ বলেছে!
—তা না হলে মানুষ কি হারায় নিজে জানে না!
—জানলে ত হয়েই যেত।
হঠাৎ ধনবৌ কেমন ক্ষেপে গেল।—আলো নিভিয়ে শোবে কিনা বল! তোমার কি। সময় নেই অসময় নেই পড়ে পড়ে ঘুমালেই হল। নিশ্চিন্ত জীবন। এখানে এসে আর কুটোগাছটি নাড়লে না।
চন্দ্রনাথ এসব কথায় ধনবৌকে ভীষণ ভয় পান। এদেশে আসার পর সত্যি তিনি আর কাজ নেননি। আর যে লোকটা এদেশে প্রায় যৌবন শেষে প্রৌঢ় বয়সে এলেন, তাঁকে কাজ দেবেই বা কে! কাজ যে একেবারে জুটছিল না তা বললে মিথ্যা হবে—কিন্তু কোথায় যেন চন্দ্রনাথের একটা বড় অহঙ্কার ছিল। এখন আর তেমন জমিদার কোথায়, জমিদারী কোথায়। দোকানে বসে বসে খাতা লিখবেন—চন্দ্রনাথ এটা ভাবতেও পারতেন না। এরই মধ্যে সুখে দুঃখে ঘর-বাড়ি বানিয়েছেন, পৈতৃক পেশা যজমানিটা ছাড়েন নি। কলোনির প্রায় সব ঘরেই পূজা পার্বণে তাঁর ডাক আসে। এখনও এটাই সম্বল। মেজছেলে অতীশ এখানে এসে চাকরি নেবার পর সংসার সচ্ছল। দিন তাঁর ভালই যাচ্ছিল। কিন্তু গোল বাধাল—কি যেন তাঁর হারিয়েছে। এইসব সাত-পাঁচ ভেবে তিনি আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন। ধনবৌর মাথা গরম হলে, হয়ত আর ঘুমাবেই না। বকর বকর শুরু করে দেবে। সারা-জীবন হাড়মাস জ্বলে খাঁ খাঁ হয়েছে এমন কত অভিযোগ উঠবে। এসব ভয়েই তিনি হারিকেনটা নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তারপরও ঘুম এল না। মানুষের কিছু হারিয়ে গেলে ঘুমায় কি করে!
রাত থাকতেই পা টিপে টিপে নেমে গেছিলেন তক্তপোশ থেকে। তামাকের একটা পিপাসা আছে। খুব সন্তর্পণে যেন কেউ টের না পায় দরজা খুলে বারান্দায় মাদুর পেতে বসেছিলেন। একপাশে শুকনো সব গাছগাছড়া টোফা মুছিতে রাখা। সেগুলো তাঁর কাছে গুপ্ত সম্বলের মত। তার মধ্যে দেশলাই গোঁজা থাকে। সেটা খুঁজে বের করার সময়ই মনে হয়েছিল, নক্ষত্রটা আকাশে নেই। কোথাও নেমে গেছে। লিচু গাছটার নিচে এসে নক্ষত্রটা খুঁজে বের করতেই সাহস ফিরে পেলেন। নিশ্চিন্তে তামাক খেলেন। তারপরই মনে করতে পারলেন অতীশের কোষ্ঠীটা তিনি দেখছেন না। বইপত্রের মধ্যে সবার করকোষ্ঠী তিনি ভারি গোপনে রেখেছেন। সেটাই বুঝি তাঁর হারিয়েছে। তার কাছে এখন সেটা যে খুবই প্রয়োজনীয় বস্তু।
নির্মলা সকালে উঠে ঘর থেকে বের হতেই দেখল, বাবা চোখ বুজে বারান্দায় বসে আছেন। ঠিক যেন এক নির্বিকল্প পুরুষ। অচৈতন্য প্রায়। আগে এমন রূপ দেখা না থাকলে নির্মলা এ-সময় খুবই বিপাকে পড়ে যেত। বাবার মধ্যে কি যেন অতিপ্রাকৃত কিছু খেলা করে বেড়ায়। তিনি সংসারে থেকেও যেন নেই। কোথায় এক অদৃশ্য অভিকর্ষ আছে যা তাঁকে টানে। তখন তিনি এমন কথাবার্তা বলেন যা সংসারী মানুষের পক্ষে সম্ভব না। এজন্য নির্মলা এই মানুষটির সেবাযত্নের কোনও ত্রুটি রাখে না।
সে ভাবল ডাকে, আপনি কি বসে বসে ঘোমাচ্ছেন। কিন্তু নির্মলা জানে, এ সময় তাঁকে ডাকলে তিনি ভারি বিরক্ত বোধ করেন। নির্মলার মুখে সামান্য হাসি খেলে গেল। আসলে মেজ ছেলে কলকাতায় চলে যাওয়ায় নিজেকে তিনি তার চেয়ে বেশি বিপন্ন বোধ করছেন। বার বার বলেছেন, তুমি এদিকে কোথাও কাজ দেখ। অত দূরে যেয়ে কাজ নেই। মানুষ দূরে গেলে পর হয়ে যায়।
অতীশ বাবার কথায় হেসে ফেলেছিল।
—হাসবে না।
—আপনি তো আগে এমন ছিলেন না বাবা। কত সহজে সব কিছু অগ্রাহ্য করতে পারতেন।
—বৃক্ষের মত মানুষ। যত বড় হয়, বয়স বাড়ে, তত ঝড় ঝাপ্টা বেশি লাগে। তাছাড়া কলকাতা জায়গাটা ভাল না। ওখানে গেলে মানুষ মানুষ থাকে না। তুমি ইতিহাস পড়ে দেখ। তাই লেখা আছে।
অতীশ বাবার সেকেলে মনোভাব একদম পছন্দ করে না। বাবার ঐ ভয়। অতীশ বলেছিল, সব বড় বড় মানুষেরা কিন্তু সেখানেই শেষ পর্যন্ত গেছেন। বিদ্যাসাগর মশাই বাবার আদর্শ পুরুষ। সে বলেছিল, আপনি জানেন না, তিনি কলকাতায় এসে বিদ্যাসাগর মশাই হয়েছিলেন। বীরসিংহ গাঁয়ে থাকলে বিদ্যাসাগর হতেন না।
বাবা কেন জানি আর কিছু বলেন নি। শুধু বলেছিলেন, তোমরা বড় হয়েছ, যা ভাল মনে কর করবে। তবে বয়স বাড়লে মানুষের ভয় বাড়ে।
নির্মলা তখন অতীশকে সমর্থন করে বলেছিল, বাবা, আপনি কলকাতার অত দোষ দেবেন না। নিজে ঠিক থাকলে কার কি করার আছে।
বাবা এ কথায়, তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিলেন। বুঝেছিলেন নির্মলা কলকাতার মেয়ে বলেই অভিযোগ হজম করতে রাজি না। পায়ের ওপর দু’ হাত ছড়িয়ে নিজের সারা শরীর দেখতে দেখতে বলেছিলেন, বড়ই প্রলোভন। কলকাতায় গেলেই লোভে পড়ে যায় মানুষ।
অতীশ বলেছিল, মানুষ বেঁচে থাকতে চাইবে না? মানুষ বড় হতে চাইবে না? কলকাতায় কত সুযোগ!
—মানুষের বড় হওয়া আর ধান্দাবাজ হওয়া এক কথা না অতীশ।
—সেটা সব জায়গাতেই আছে। দুষ্টু লোকেরা, ধান্দাবাজ লোকেরা ছত্রাকের মত গজায়। তারপর আর বাবা কোন কথা বলতে সাহস পান নি। এখন টের পাচ্ছে নির্মলা অতীশ বাড়ি না থাকায় সামান্য বিভ্রমে পড়ে গেছেন তিনি। আজীবন শহরে থেকে মানুষ বলে, প্রথম প্রথম এখানকার সব কিছুই বড় নির্জন এবং চুপচাপ মনে হত নির্মলার। কোথাও যেন জীবন সে-ভাবে জাঁকিয়ে বসে নেই। ব্যস্ততা নেই, অনিশ্চয়তা নেই—কেমন প্রাণহীন এক জগৎ। প্রথম প্রথম সে খুবই হাঁফিয়ে উঠত। মাইল তিনেক দূরে শহর, বড় মাঠ পার হয়ে গেলে পাকা রাস্তা। মাঝে মাঝে বাস ট্রাকের শব্দ কানে আসত শুধু। দূর দিয়ে গরুর গাড়ি যায়। একটা কোঁ কোঁ আওয়াজ। বাগদি মেয়েরা মাছ ধরে ফিরে আসে। গায়ে গামছা। হাল গরু ধানের ক্ষেত, হাঁসের ডাক প্রথম প্রথম কেমন বিশ্রী লাগত। বাবা হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে ক্ষেতের মধ্যে চবর চবর করে হাঁটছেন। তার শ্বশুর এই মানুষটা, জমিতে মুনিষদের সঙ্গে কেমন লেপ্টে থাকতেন—নির্মলার ভাল লাগত না। সকাল হলে গরু বের করা, গরু মাঠে দিয়ে আসা, দুধ দোওয়ানো, গোয়াল ঘর পরিষ্কার করা—এসবে ভারি দুর্গন্ধ—মাঝে মাঝে ওক পেতো তার। বৃষ্টির সময় উঠোনে পা দেওয়া যেত না, সারাটা উঠোন কাদায় থিকথিক করছে। নালা ডোবায় জল, ঘাস জঙ্গল, আর সাপের উপদ্রব। সব সময় নির্মলা বড় ভয়ে ভয়ে থাকত। শুধু একজন তার নিজের। তার সর্বস্ব। তাকে পাবে বলে সব স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে সে এ-জীবনে এসে ঢুকেছিল। চার বছর বাদে সেই মানুষ তাকে এখানে ফেলে কলকাতায় প্রবাসী হবে বলে চলে গেল।
নির্মলা কল পাড়ে গিয়ে মুখ ধুল। কাপড় ছাড়ল। সকালে বাবা তাকে একটা গুরুদায়িত্ব এখানে আসার পরই দিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বৌমা তুমি গৃহলক্ষ্মী। ঠাকুর তোমার হাতের ফুল বেলপাতা পেলে খুশী হবেন। তুমি রোজ পূজার ফুল দূর্বা তুলবে। বাসি কাপড় ছেড়ে নিও। এখন নির্মলার সেই গুরুদায়িত্ব পালনের সময়। ঠাকুরঘরের শেকল খুলে ঠাকুর প্রণাম সারল। ভেতর থেকে সাজি বের করে নিল নির্মলা। সব কাজই খুব আস্তে করছে। কারণ বাবার যা নমুনা তাতে মনে হচ্ছে তিনি অনেক ওপরে উঠে সন্তানকে লক্ষ্য রাখার জন্য চোখ বুজে আছেন। এই অবস্থায় খুটখাট শব্দে যদি তাঁর অভিকর্ষ নষ্ট হয় তবে তিনি ব্যাজার মুখে বলবেন, দিলে ত সব মাটি করে। আমি অতীশের চারপাশটা দেখব বলে বসেছিলাম—কোথায় গিয়ে উঠল—আর তোমরা খটাখট করে, দিলে সব মাটি করে।
প্রথম প্রথম নির্মলার বাবার এমন সব আচরণে হাসি পেত। সে দেখত, প্রতিবেশীরা বাবার কাছে এসে পায়ের কাছে বসে আছে। বলছে, কর্তা দেখেন ত সানু ভাল আছে কিনা। মাসের ওপর হল কোন চিঠি নেই!
বাবা বলতেন, এখন হবে না।
—কখন আসব কর্তা?
—কাল ঠাকুরঘরে যখন বসব তখন আসিস।
পরদিন এলে বাবা বলতেন, বুঝতে পারলাম না কিছু। দেখি রাতে।
সকালের দিকে এলে বলা, ভালই আছে। চিন্তা করিস না। চিঠি আসবে। কাজে কম্মে আটকে গেছে।
নির্মলার প্রথম প্রথম বাবার এমন আচরণ ভালও লাগত না। মনে হত বাবা মানুষকে ঠকাচ্ছেন। একদিন রাতে সে অতীশকে অভিযোগও করেছিল, এটা কি! বাবার কি দরকার লোককে মিথ্যে স্তোকবাক্য দেওয়া। বাবাকে ত এ-জন্য মিছে কথা বলতে হয়। তিনি কি ঠিক জানেন, কে কি করছে!
অতীশ কি লিখছিল, সব শুনতে পায়নি, বলেছিল, কে মিছে কথা বলছে!
—বাবা!
—বাবা মিছে কথা বলছেন! কেমন অবাক চোখে তাকিয়ে নির্মলাকে দেখছিল। অতীশের এই চোখকে নির্মলার বড় ভয়। যেন গভীর থেকে এক আত্মজিজ্ঞাসার মত প্রশ্ন, তুমি কে? তুমি আমার কে!
—তাই তো। আমতা আমতা করে নির্মলা পালাতে চাইলে, অতীশ খুব ধীরে ধীরে বলল, বাবার মিছে কথা বলার কারণ?
—লোককে দূরের খবর দেন। বাবা কি সেখানে গেছেন?
অতীশ কেমন সামান্য আশ্বস্ত ভঙ্গীতে বলল, তবে বিষয় এই। বাবা লোককে দূরের খবর দেন কেন! আমারও সেই প্রশ্ন, বাবা দূরের খবর দেন কেন। তারপরই অনেক দূরের কিছু যেন অতীশও দেখতে পায়। সে বলেছিল মানুষের মধ্যে কি থাকে, কি থাকতে পারে তুমি জান না। তাছাড়া বাবা আমার সরল মানুষ, ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি বাবা ঠকেছেন, কাউকে ঠকান নি। এই যে, বাড়িঘর এখানে বানিয়েছেন বাবা, কত সাপ ছিল, বাবা একটা সাপের গায়েও আমাদের হাত দিতে দেন নি। প্রকৃতির জীব, তোমরা বেঁচেবর্তে থাকবে তারা থাকবে না! বাবা এমন বলতেন। বাবার সঙ্গে যেখানে যখন যজমান বাড়ি গেছি দেখেছি বাবা সবার মঙ্গল কামনা করছেন। বলছেন, দাসমশাই আপনার সোনার সংসার, লক্ষ্মী ঘরে বাঁধা। বাবা নিজের জন্য তাঁর ঈশ্বরের কাছ থেকে বোধহয় কিছুই চেয়ে নেননি!
নির্মলার তখন ভারি অস্বস্তি। অতীশ কথাগুলি তার দিকে তাকিয়ে বলছিল না। বাইরে জানালার দিকে অতীশের মুখ। সে দূরের কোথাও কিছু দেখতে দেখতে যেন বলে যাচ্ছে। সুদূরে সে একবার হারিয়ে গিয়েছিল। এখানে আসার আগেই লোকমুখে সে-সব খবর নির্মলা জানে—দ্বীপ-টিপ সমুদ্র এবং পৃথিবীর এক কোমল অন্ধকার থেকে মানুষের প্রত্যাগমন ঘটলে এমনই বুঝি হয়। নির্মলা বলেছিল, তারাপিসি পাড়ায় বলে বেড়াচ্ছে, সব মিছে কথা। কর্তা কিছুই দেখতে পান না। আন্দাজে বলেন। বাবার কথা নাকি ঠিক হয় নি।
তারাপিসি প্রতিবেশী। এখানকার চারপাশে যারা আছে সবাই দেশের লোক। বাবা বাড়ি করার পরই দেশের মানুষজনকে খবর পৌঁছে দিয়েছিলেন, নিজের মঙ্গল চাও তো চলে এস। এখানে একটা বড় বনভূমিতে নতুন আবাস তৈরি হচ্ছে। সময় থাকতে বাড়ি-ঘর বানিয়ে নাও। পরে আর আসতে পারবে কি পারবে না ঠিক কি। সেই থেকে দেশের মানুষজন চলে আসতে লাগল। বাড়িঘর বানাতে থাকল। আসলে বাবার বাড়ি-ঘর হয়ে যাওয়ার পর মনে হয়েছিল বুঝি সবই আছে, গাছপালা মাঠ সবই আছে, কেবল সেই কাছের মানুষেরা নেই।
অতীশ নির্মলার দুঃখটা টের পেয়ে বলেছিল, বাবা কেন যে বলতে যান! এবং পরদিন সকালেই সে বাবাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, আপনি আর এ-সবের মধ্যে থাকবেন না। কার কে কোথায় আছে, কেমন আছে আপনার কি দরকার বলার। সংসারের কি লাভ এতে!
অতীশকে বিষয়ী হতে দেখে বাবা বলেছিলেন, রক্তে তোমার দোষ ঘটেছে। জীবনে লাভালাভই বড় করে দেখছ। মানুষের শুভাশুভ দেখছ না। তুমি তো বিষয়ী মানুষ নও।
অতীশ বাবার কথার জবাবে কিছু বলতে পারে নি। বোধহয় ভেবেছিল এই রকমেরই মানুষ তার বাবা। নির্মলার ওপরও বিরক্ত হয়েছিল। তার কথাতেই সে বাবার ব্যক্তিগত ভাল লাগা মন্দ লাগা বিষয়ে নাক গলাতে গিয়েছিল। বাবা কি টের পেয়ে তখনই বললেন, তারা বলেছে। ও তো বলবেই। বললাম, আমাকে সময় দে, বসতে দে, ভাবতে দে, মনোযোগী হতে দে, না তা চলবে না। তক্ষুনি বলে দিতে হবে। না হলে রাতে তারার ঘুম আসবে না। রাতে না ঘুমালে শরীর নষ্ট। আয়ু নষ্ট। এ-সব তোমরা বুঝবে না। বেঁচে থাকার জন্য জীবনে প্রশান্তি দরকার। তারার খুব কষ্ট হবে ভেবে বলতে গেলাম। মিলল না। মিলতে নাই পারে। তখন যে আমার শরীরে কোন দোষ ঘটেনি, তাই বা কে বলবে। দোষে পড়লে হয় না।
এই দোষ শব্দটি বাবা খুব বলেন। অর্থাৎ অপবিত্র ছিলেন। তারাপিসি বয়স আন্দাজে যৌবন ধরে রেখেছেন। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স—বাবা কি সেই যৌবনবতী মহিলাকে দেখে লুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। নতুবা দোষ ঘটে থাকতে পারে বলেছিলেন কেন। নির্মলা ফুলের সাজিতে একটা একটা করে শ্বেত জবা, রাঙা জবা বেলফুল রাখছে আর এমন সব ভাবছে। মানুষের শরীর ত। দোষ ঘটতেই পারে। বাবার পক্ষেই সম্ভব অকপটে সব স্বীকার করা। আর এভাবেই নির্মলা বুঝতে পারছিল, এই বাড়িটার ওপর গাছপালার ওপর এবং বাবার ওপর তার টান বেড়ে যাচ্ছে। আগের মত আর খারাপ লাগে না। ক্রমে নির্মলা এই সংসারের পবিত্রতা টের পেয়ে শহরের আকর্ষণ ভুলে যেতে বসেছিল। আর তখনই তার মানুষটার যে কি জেদ অথবা অভিমান বলতে পারে, মানুষের নীচতায় সে বড় কষ্ট পায়, সে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে কলকাতায় চলে গেল।
কাল রাতে নির্মলারও ভাল ঘুম হয়নি। এমনিতেই তার মানুষটার শরীরের প্রতি আকর্ষণ কম। সে দেখেছে, এগিয়ে না দিলে মানুষটা তার কিছুই গ্রহণ করে না কিংবা বলা যেতে পারে কোন দূরবর্তী নক্ষত্রের প্রভাব আছে তার ওপর। বাবাও বলেন এই নক্ষত্রের প্রভাবেই অতীশ এক জায়গায় সুস্থির হয়ে বসতে পারছে না! সময় লাগছে।
নির্মলা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরেছে। নির্মলা লম্বা উঁচু। ছিমছাম সুন্দর চেহারা। তীক্ষ্ণ নাক চোখ। চোখের ধার প্রবল। এই ফুলের বাগানে সে ঘুরে বেড়ালে টের পায় আশ্চর্য এক সুঘ্রাণ উঠছে। নীল আকাশ। ঘাস ভিজা ভিজা। ঘাসে বর্ষার কীট-পতঙ্গ উড়ে বেড়াচ্ছে। ফুল গাছগুলোর ডালপালা হাওয়ায় সামান্য দুলছিল। মা উঠে পড়েছেন। রান্নাঘর থেকে বাসন কোসন বের করার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সাবিত্রী এসে যাতে বসে না থাকে সে জন্য সব কাজ এগিয়ে রাখছেন।
বাবা বারান্দা থেকেই তখন ডাকলেন, আরে ওঠ তোরা। বেলা হয় না। তোদের ঘুম ভাঙে না কেন। একবার উঠে দেখ। কি দেখবে যেন নির্মলা বোঝে। দিন বয়ে যায়। কাজ কাম ফেলে রাখিস না। সকাল সকাল সব ঘরে তুলে নে। আসলে যেন সেই মোজেসের মত সে বাবার দৈববাণী শুনতে পায়। অতীশ কেন যে বাবার সবটাই এক আত্মসুখ ভেবে থাকে। বাবা এ-সব ভাবতে ভালবাসেন—ঈশ্বরের সঙ্গে তাঁর খুব নিকট সম্পর্ক। খেতে বসলে, বাবা বলবেন, ঠাকুর খাও। কখনও রান্নাবান্না পছন্দ মত না হলে বলবেন, ঠাকুর আজ খেয়ে সুখ পেল না।
ফলে নির্মলার কাছে বাড়িটা কোন আশ্রম টাশ্রমের মত মনে হয়। দু’দিনের জন্য এই আশ্রমে সবাই এসে হাজির হয়েছে। গাড়ি এলে সবাই সব ফেলে আবার উঠে পড়বে। রাস্তা গেছে বাড়ির পাশ দিয়ে। ইঁট সুরকির রাস্তা। ধারে ধারে বাবার হাতের গাছ। আম জাম নারকেল লিচু। বার-চোদ্দ বছরে গাছগুলো আকাশের নিচে ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছে। পূবমুখী ঠাকুরঘর। পশ্চিমমুখী বড় ঘর। পাশাপাশি দুটো উত্তর-দক্ষিণমুখী ঘর। বাড়ি-ঘর ছেড়ে বাবা কোথাও আজকাল দু-একদিনের বেশি থাকতে পারেন না। সব তিনি খেটে-খুটে করেছেন। বড় ছেলে তার বৌ নিয়ে বিদেশে থাকে। কালেভদ্রে আসে। কেমন আলগা সম্পর্ক সবার সঙ্গে। মাঝে মাঝে অতীশকে বলেন, ওকে একটা চিঠি দিস। আমি ভাল আছি লিখবি। টাকা পয়সার কথা কিন্তু কিছু লিখবি না। সুবিধা অসুবিধায় বাবাকে বড় ছেলে টাকা দেয় না বলে অভিমান আছে একটা। বড়ই স্বার্থপর। সংসারে লেপ্টে থাকার দামটা বুঝল না। তখনই কেন জানি এই মানুষকেই মনে হয় বড় বিষয়ী। বাবাকে বিষয়ী ভাবলে, নির্মলা অস্বস্তি বোধ করে। সে দেখল তখন সাজিতে নানা বর্ণের ফুল। বেলফুল, শ্বেত জবা, অপরাজিতা, ঝুমকো লতা, স্থলপদ্ম। সাজিটা বেশ বড়। পূজায় বসে বাবার ফুল কম পড়লে রাগ করেন।
নির্মলা এখন আঁতিপাঁতি করে খুঁজছে আর কি ফুল আছে। দেখলে মনে হবে সক্কালবেলায় এক যুবতী গাছগুলোর সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। একবার এ-গাছের নিচে আবার ও-গাছের নিচে বসে উঁকি দিয়ে যখন বুঝল, বাগানে আর একটি ফুলও নেই তখন নিশ্চিন্তি। বাবা বাগানে এসে ফুল আছে গাছে দেখতে পেলে রাগ করেন। বিফলেই ফুটল ফুলটা, যেন অভিশাপ দিতে পারে। ফুলের অভিশাপ বলতে! তখন তিনি বিড়বিড় করে খড়ম পায়ে বকবেন আর হাঁটবেন।—তোমরা বৌমা গাছে ফুল ফুটে থাকে দেখতে পাও না। বলত, আমি না দেখলে অনর্থক সকালে ঝরে থাকত গাছের নিচে। ঠাকুর সেবায় না লাগলে ফুল ফোটার কি দরকার বল!
বাবা তখনও ডাকছেন, ওরে ওঠ। উঠে ঠাকুর প্রণাম কর। প্রহ্লাদ আর কত ঘুমাবি। একবার শুক্রাচার্যের কাছে যেতে হবে। তারপর কি ভেবে আবার জোরে জোরে ডাকছেন, অ-বৌমা, বৌমা, আসল কথাটাই বলা হয়নি। তুমি শিগগির এসো।
নির্মলা কাছে এলে বললেন, অতীশের কোষ্ঠীটা পাচ্ছি না। তুমি কোথাও রেখেছ?
—আমার কাছেই ত রাখলেন। বললেন, বৌমা নিজের জিনিস বুঝে নাও।
—ঠাকুর একেবারে ভুলে গেছে। তারপরই প্রফুল্ল হাসি। যেন মসকরা করছেন নিজের সঙ্গে। তালে ভুল হচ্ছে। ঠাকুর তোমার তো সন্তান-সন্ততির বিষয়ে এত ভুল হয় না। শেষে বললেন, এটা দেবে। সুবল আচার্যকে ডেকে আনতে হবে। কোষ্ঠীটা দেখে শুক্রাচার্য কি বলে দেখি!
প্রহ্লাদ কর্তার হাঁক পেয়েই উঠে পড়ল। তারপর হাসু ভানুকে ডাকল। এই যে কর্তাসকল ওঠেন! ঘণ্টা বাজছে।
প্রহ্লাদ দরজা খুলে বের হয়ে এল। হাসু শুয়ে শুয়েই চিৎকার করছে, বৌদি বৌদি, ভানু আমাকে লাথি মারছে। দেখ এসে।
এই ছোট দুই দেওর ভারি দুষ্টু। বাবার বেশি বয়সের জাতক। এ-দেশের মাটিতে এ-দুটির জন্ম। অতীশের সঙ্গে বয়সের তফাত অনেক। যেন এরা বাবার পুত্র সন্তান না, অতীশের। এদের জন্য তার বড়ই দুর্ভাবনা। পড়াশোনা দেখার ভার তার ওপর। বাবা পড়ল কি পড়ল না—একেবারে দেখেন না। মানুষ নিজের চেষ্টাতেই সব করে—তার ইচ্ছাতেই সব হয়—এমন মানুষের ওপর সব ছেড়ে দেওয়া যায় না বলেই অতীশ যাবার আগে এই দুই ছেলের ভার নির্মলার ওপর দিয়ে গেছে।
নির্মলা ধমক লাগাল, দুটোকেই কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখব। তাড়াতাড়ি উঠে মুখ ধুয়ে নাও। পড়তে বসো। টাস্কগুলো কর। সব দেখব।
প্রহ্লাদ তখন বের হয়ে মাটি ছুঁয়ে প্রণাম করল। তারপর ঠাকুরঘরের দাওয়ায় মাথা ঠেকাল। চিমটি কেটে একটু মাটি তুলে জিভে ছোঁয়াল। দিনের কাজ এই করে আরম্ভ। গরুর ঘর থেকে ধলি কালিকে বের করতে হবে। দোয়াতে হবে। দুধের বালতিটা কলপাড়ে যাবার সময় সঙ্গে নিয়ে গেল। জমিতে কাদা করা আছে। কাল বিকেলে কিছু সাঁওতাল মেঝেন ঠিক করে এসেছে। সাতটা না বাজতেই চলে আসবে। এরই মধ্যে একবার যেতে হবে আচার্যের কাছে। তাকে ডেকে নিয়ে আসতে হবে। কাল থেকেই কর্তা কেমন উসখুস করছেন। আজ সকালে বুঝতে পারল তিনি অতীশ দাদাকে পাঠিয়ে ভাল নেই। আচার্য না আসা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছেন না। এবং তখনই মনে হল কর্তা সবার বেলায় এত জানেন নিজের বেলায় কিছু জানেন না কেন! অবশ্য এত সাহস নেই তার। ধার্মিক মানুষ বলে জানে এই ঠাকুরকর্তাকে। তল্লাটের মানুষেরা ভক্তি শ্রদ্ধা করে। সেও করে। কোনও গুপ্ত কলকাঠি আছে ঠাকুরের কাছে। সেটা নিজের বেলায় অকাজের বান্দা।
তখন ফুল দূর্বা ঠাকুরঘরে রেখে এল নির্মলা। তারপর ট্রাঙ্ক খুলে কুষ্ঠিটা বের করল। লম্বা। কারুকাজ করা ফিতে লাগানো একটা সরু কাঠের দণ্ড দিয়ে লাটাইর মত প্যাঁচানো। সবটা খুললে প্রথমেই চোখে পড়ে কল্যাণ শ্রীমান অতীশ দীপঙ্কর দেবশর্মণ ভৌমিকস্য জন্ম পঞ্জিকা— রোহিণী নক্ষত্র, বৃষ রাশি, নরগণ। তারপরই বোধহয় নিচের লেখাটুকুতে আছে গ্রহ নক্ষত্রের ভজনা—ওঁ আদিত্যাদি গ্রহাসর্বেন নক্ষত্রানি চরাশয় দীর্ঘসায়ু প্রকুবর্বন্ত যস্যের জন্মপত্রিকাং ব্রহ্মাদি দেবতা সর্বে গোষ্যাদি মাতৃকাস্তথা সূর্যাদয়ো গ্রহাসর্ব্বে রক্ষন্তু বালকং। হে আদিত্যাদি গ্রহ সব, বালককে সব বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করুন। নির্মলারও সঙ্গে সঙ্গে এমন বলতে ইচ্ছে হল। বালক কথাটা ভাবতেই কেমন রোমকূপে নির্মলার বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল। অতীশের বালক বয়সের কোন ফটো নেই। এই বাড়িটা তার মানুষজন, শতাব্দী পিছিয়ে এই গ্রহে এখনও বসবাস করে যাচ্ছে। ভাবতে গিয়ে কেমন আচ্ছন্ন বোধ করল নির্মলা। বাবার ডাকে সংবিৎ ফিরে পেল। বাবা জিজ্ঞেস করছেন বারান্দা থেকে, পেলে?
—পেয়েছি।
—আমাকে দাও। কাজ আছে।
মানুষটার সব কর্মফল এই কোষ্ঠীর মধ্যে আছে। মানুষটার ভূত ভবিষ্যৎ সব। কোষ্ঠীটা হাতে নিয়ে সে আজ কেন জানি ভারি রোমাঞ্চ বোধ করল। মানুষটা কিছুদিন হল তার সঙ্গে নেই। নেই বলেই বুঝি এত আগ্রহ। তার এখন কেন জানি কোষ্ঠীটা হাত-ছাড়া করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। নির্মলা কোষ্ঠীটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। সুবল আচার্য এল যখন তখন দশটা বাজে।
কলকাতায় তখন অতীশ, কুম্ভর সঙ্গে প্রিন্টিং সেকসান থেকে বের হয়ে আসছে। রঙ বার্নিশের গন্ধ। গন্ধটা সে কবে থেকেই পেয়ে আসছে। সেই সুদূরেও সে যখন ছিল এমনি রঙ বার্নিশের গন্ধ, গ্যাসের গন্ধ। জাহাজে ওঠার সময়ও প্রথম সে এমন একটা বিশ্রী কূট গন্ধ পেয়েছিল। তার পাশে সুপারভাইজার হরিহরবাবু, প্রিন্টিং ইনচার্জ মণিলাল। কুম্ভ সব বোঝাচ্ছিল। টিনপ্লেট কোথায় সাইজ করা হয় তারপর কিভাবে ব্লক হয় এবং শেষে সেই ব্লক লিথোতে তুলে টিন ছাপা থেকে ফ্যাব্রিকেশন সব।
তিনটে বড় বড় টিনের সেডের মধ্যে কারখানা। প্রিন্টিং সেকসানের দুটো অংশ। বড় অংশটায় গ্যাস চেম্বার, প্রিন্টিং প্রেস। বার্নিশ করার জন্য ছোট্ট ঘেরা জায়গা। তার পাশে আর্টিস্টদের ঘর। ডিজাইন থেকে ব্লক সব এ-ঘরে। তারই পাশে কাঠের পার্টিশান —সেখানে ম্যানেজারের ঘর। নিচের দিকে লাগোয়া অফিস, আলমারি ফাইল-পত্র সব। সেডের পাশে বড় অশ্বত্থ গাছ—গাছটায় একটা লাল রঙের ঘুড়ি আটকে আছে।
এক নম্বর টিনের শেড থেকে নেমে রাস্তা পার হতে হয়, রাস্তা পার হলে দু নম্বর টিনের শেড। অতীশ রাস্তায় নামতেই দেখল, একজন কুষ্ঠ রোগী খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসছে। কুম্ভ বলল, আমাদের পুরোনো মিস্ত্রি শিউপূজন। পাশেই থাকে। গেটে দারোয়ান, উঠে দাঁড়িয়েছে। বস্তি এলাকার মধ্যে এই তিনটে শেড বলে, কলহ বচসা কানে আসছে।
শিউপূজন দূর থেকেই গড় হল।
অতীশ বলল, আরে করছেন কি!
কুম্ভ আগে, হরিহর পেছনে, মাঝখানে অতীশ। কারখানায় কেউ উঁকিঝুঁকি মারছে না। লম্বা প্ল্যাটফরমের মত টিনের চালা বেশ দূরে চলে গেছে। ভিতরে ঢুকে সামনেই দেখল, একটা চওড়া বেল্টিং ঘুরছে। শেডের মধ্যে ঢুকতেই বাইরের সব কোলাহল মেশিনের শব্দে ডুবে গেল।
কুম্ভ বলল, এগুলো কামড়ি মেশিন। পাশে কাইচি। কাইচিতে দুটো লোক ভীষণ নিবিষ্ট হয়ে কাজ করছে। সেখান থেকে টিন ঢুকিয়ে নিয়ে কেউ আসছে কামড়ি মেশিনে। ঝপাঝপ মেশিন থেকে সাইজকরা টিনের পাত পড়ছে। প্রতিটি কর্মী ভীষণ হাত চালিয়ে কাজ করছে।
কুম্ভ বলল, নজর দিলে এটাও দেখবেন একদিন মেটাল বকস হবে। লাভের গুড় সব আগের ম্যানেজারের পেটে। এখন কে খায় দেখুন।
অতীশ হাঁটতে থাকল। কুম্ভবাবু সারাক্ষণ বকবক করছে। লম্বা চওড়া বাত বলছে। চারপাশে অজস্র বেল্টিং ঘুরছে। পরপর কটা পাঞ্চিং মেশিন, লেদ মেশিন। লেদম্যান ফুল স্পিডে লোহার মোটা রডে চিজেল সেট করে বসে আছে। কটর কটর করে লোহা কাটার শব্দ কানে আসছিল। পরিশ্রমী এই মানুষগুলো খুব বিপাকে পড়ে যেন কাজ করে যাচ্ছে। পর পর সে এ-ঘরে পঁচিশ ত্রিশজন কর্মী দেখল, সবাই রুগ্ন, চোখ কোটরাগত। একটা লোক ডিবের বিট কাটছিল উবু হয়ে, আর তার দিকে কেমন জ্বলন্ত চোখে তাকাচ্ছে। দেখলেই অস্বস্তি হয়। পাতলা ঢ্যাঙা পাতলুনের মত চেহারা, গোঁফ ততোধিক লম্বা। কুম্ভ নাম বলে যাচ্ছে।
দেখতে দেখতে অতীশের মনে হল, আবার সেই লজঝড়ে জাহাজ। হাত দিলেই সব খসে পড়বে। এই লজঝড়ে জাহাজটাকে মেটাল বকস বানাতে হবে। কিন্তু যা সব চেহারা শ্রমিকদের মেশিনপত্রের তার আগেই যদি সমুদ্রে জাহাজ ডুবে যায়! লজঝড়ে জাহাজের ক্যাপ্টেন সে এখন নিজে। নিয়তি মানুষকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে আসে। সে যতই লজঝড়ে জীবন থেকে পালাতে চায়, তাকে কে বা কারা বলিদানের জন্য যেন সেখানেই টেনে নিয়ে যায়। আর্চির প্রেতাত্মা সঙ্গে থাকে। গন্ধে অতীশ টের পায় সে এসে গেছে। তখনই কুম্ভ বলল, এর নাম মনোরঞ্জন। আমাদের বিটম্যান। ইউনিয়নের অ্যাসিস্ট্যাণ্ট সেক্রেটারি।
অতীশ জাহাজে ইউনিয়ন দেখেনি। সে বলল, ইউনিয়ন!
—এখানে সি পি এম-এর ইউনিয়ন।
সেই ইউনিয়নের লোকটা তখন বিট থামিয়ে হাতজোড় করে নমস্কার করল। অতীশও হাত তুলে নমস্কার করল। কিছু যেন বলতে চাইল লোকটা—অতীশ শুনতে চাইল না। প্রেতাত্মার গন্ধ তার নাকে এসে লাগছে। সে সোজা অফিসে এসে বসল, একদিনে সব বোঝা যাবে না। তবে গন্ধে বুজতে পারল আর্চি আশেপাশেই আছে। তাকে ধাওয়া করছে। কারো না কারো ওপর ভর করে তাকে জ্বালায়। এখানেও সে তাকে ছেড়ে দেবে না। অতীশ কিছু কিছু কাজ বুঝে নিতে গিয়ে বুঝল, এ-বিষয়ে তার কোনও অভিজ্ঞতাই নেই—ম্যাসিনের শব্দে সব কানেও ঢুকছে না। এতে আর্চির অনেক সুবিধে।
সে বলল, কুম্ভবাবু, একদিনে সব হবে না। চলুন বরং বস্তিটা একবার ঘুরে দেখে আসি। আসলে সে আর্চির অশুভ প্রভাব থেকে মুক্তি পাবার জন্যই যেন বাইরে বের হয়ে এল। এবং নিশ্বাস নিতে গিয়ে বুঝল, সেই গন্ধটা আরও ভারি, আরও ভুরভুর করছে। এখানে সে ভাল করে নিশ্বাস নিতে পর্যন্ত পারছে না। আর্চি আগের মত আবার তার পিছু নিয়েছে। কিন্তু সেটা কেন সে এখনও বুঝতে পারছে না। আর্চি কার উপর ভর করেছে, কুম্ভ না মনোরঞ্জন! সেটা কে? তার চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে হল।