☼ বিনোদ ঘোষাল ☼
রূপনগরের পিশাচিনী
খাবি খেতে থাকা শিউচরণের চল্লিশ বছরের আধমরা বডিটাকে মেঝেতে নামাল ভিখু আর হনুমান। কপালের ঘাম মুছল দুইজনে। শিউচরণ এমনভাবে শ্বাস নিচ্ছে যে দেখলে যে কেউ বুঝে যাবে যে কোনও শ্বাসই শেষ শ্বাস হবে। ঘরের মধ্যে একটা চাটাই পাতা আর পাশে একটা জলের লোটা। ব্যাস আর কিছু নেই। শিউচরণ মাঝেমাঝেই কেঁপে উঠছে। পৃথিবীর সব অক্সিজেন একবারে টেনে নেওয়ার জন্য সদ্য ডাঙায় তোলা কাতলামাছের মতো হাঁ করছে। কিন্তু অক্সিজেন পাচ্ছে না।
শিউচরণ মরে যাবে। যাবেই। আজ না হোক কাল কিংবা পরশু। আর সেইজন্য ওকে আনা হয়েছে কলকাতার মেছুয়াপট্টি থেকে সুদূর বেনারসে। সারা রাত মেলট্রেনের মেঝেতে শুয়েই শিউচরণকে নিয়ে এসেছে ওর বহুকালের পুরনো দুই বন্ধু ভিখু আর হনুমান। কুড়ি বছরের পুরনো বন্ধু এই তিনজনে।
ভিখু মুখ ঝুঁকিয়ে শিউচরণকে দেখল। ঘোলাটে চোখদুটোয় ফ্যালফেলে শূন্য দৃষ্টি। ফুটবলের মতো উঁচু পেট। বুকের খাঁচা উঠছে নামছে। ভিখু মুখ ফিরিয়ে তাকাল হনুমানের দিকে। তারপর দেহাতি হিন্দীতে হনুমানকে বলল একটু খাবার জল এনে দিতে। হনুমান কাঁসার লোটাটার ঢাকনা সরিয়ে দেখল ওতে জল ভরা। ঘোলাটে গঙ্গার জল। ওটা তুলে শিউচরণের মুখের সামনে ধরে ওকে হাঁ করাল। দুঢোঁক জলও ভাল করে খেতে পারল না। শেষ ঢোঁকের জল গালের কষ বেয়ে গড়িয়ে গেল। ভিখু হাতের চেটো দিয়ে সেই গড়িয়ে যাওয়া জলটুকু মুছে দিল। তারপর পুরনো বন্ধুর মাথায় একবার হাত রাখল।
রামজীর নাম নেয় শিউ। তোর অনেক সৌভাগ্য যে বাবা বিশ্বনাথের দ্বারে এসেছিস মরতে। সোজা স্বর্গলাভ হবে তোর। চলি আমরা। বলে ভিখু হনুমানের সঙ্গে বেড়িয়ে এল ঘর ছেড়ে।
শিউচরণ একা শুয়ে থাকল মোক্ষভবনের নয় নম্বর ঘরে।
বেনারসের মোক্ষভবন বিশ্বনাথ মন্দিরের অদূরেই একটি দোতলা বাড়ি। আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে এই বেনারসেরই এক পন্ডিত হরবিলাস শাস্ত্রী তাঁর জীবনের সমস্ত পুঁজি ঢেলে নির্মান করেছিলেন এই বাড়িটি একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। জীবনের অন্তিম শ্বাসটি বিশ্বনাথ ধামে ত্যাগ করে যিনি অক্ষয় মুক্তিলাভ করতে চান তাদের জন্যই গড়েছিলেন মোক্ষভবন। দুইতলা মিলিয়ে মোট বারোটি ঘর। বাড়িটি বয়স এবং পরিচর্যার অভাবে জীর্ন, বিবর্ণ। অনেক জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়েছে, নোনাধরা দেওয়ালে অচেনা সব দেশের বিচিত্র মানচিত্র। কিন্তু এসব নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। কারণ মোক্ষভবন তো হোটেল বা মেসবাড়ি নয়। এখানে যারা থাকতে আসেন তাদের সকলেরই থাকার দিন ফুরিয়েছে, আর কিছুক্ষণের অপেক্ষামাত্র। তখন তার জীবনের সকল লেনদেনের হিসাব শেষ। পৃথিবীর কোনও কিছুতেই তার আর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, একমাত্র পরপারের জন্য প্রতীক্ষা ছাড়া আর কিছু নেই।
কেয়ারটেকার রামরতন তিওয়ারি এই মোক্ষভবন সামলাচ্ছেন গত চল্লিশ বছর ধরে। এই ভবনেরই একটি ঘরে তিনি থাকেন সপরিবার। জীবনে এত মৃত্যু দেখেছেন যে তার মন দীর্ঘকাল ধরেই জগতের সবকিছুর প্রতি নিরাসক্ত। জীবনধারণের জন্য ন্যুনতম যেটুকু প্রয়োজন সেইটুকুই তার চাহিদা। মোক্ষভবন ট্রাস্ট থেকে তাকে সামান্য কিছু মাসোহারা দেওয়া হয়, আর এই মোক্ষভবনে যারা মোক্ষলাভের আশায় আসেন তাদের পরিবার আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব যদি কিছু দেন, ব্যাস এতেই চলে যায়। সত্তর বছরে পা দেওয়া ‘তিওয়ারিজী’ ও তার পরিবার জগতের প্রতি উদাসীন। তাদের এই ঔদাসিন্য শ্মশানের চন্ডালের মতো নয়, বরং সন্ন্যাসীর মতো।
তিওয়ারিজির অফিসঘরটা ভবনের মূল দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই ডানদিকের প্রথমে। বাড়িটা ফটোফ্রেমের মতো। মাঝখানে বাঁধানো উঠোনে ছোট একটি মন্দির, সেখানে রাম-সীতা-হনুমান, শিব এবং বিষ্ণু তিনজনেই রয়েছেন। তিনটে শিফটিং এ এখানে অষ্টপ্রহর ঠাকুরের নামগান চলে যাতে মুমূর্ষরা ঈশ্বরের নাম শুনতে শুনতে পরপারে যাত্রা করতে পারেন। উঠোনের চারদিকে বারান্দা এবং বারান্দার গায়ে সার সার ঘর। ওই ঘরগুলিতেই এক একজন শুয়ে রয়েছেন এবং সময় গুনছেন। কোনওঘরে কেউ একাই পড়ে রয়েছেন, হয়তো সাতকুলে তার কেউ নেই, পরিচিত বা অপরিচিত কেউ অবস্থা শেষ বুঝে নামিয়ে রেখে গেছেন তাকে অথবা কেউ এসেছেন সপরিবার। এখানে ঘর নিলে সপরিবার থাকারও ব্যবস্থা রয়েছে তবে ওই ঘরটুকুই পাওয়া যাবে। খাওয়াদাওয়া এবং বাকি ব্যবস্থা নিজেদের করে নিতে হবে। যারা একা পড়ে থাকেন তাদের দেখভাল করার জন্য তিওয়ারিজী তো রয়েছেনই আর রয়েছেন তার অ্যাসিসট্যান্ট বুধিয়া। মন্দিরের পুজারিজী লক্ষণপ্রসাদ শর্মাও সেবাতে হাত লাগান। তিওয়ারিজী বা বুধিয়া কিংবা লক্ষণপ্রসাদ যখন তাদের জীবনের প্রথমদিকে এই কাজের ভার নেন, তখন কোনও একাকী মুমূর্ষের মলমূত্র নিজের হাতে পরিস্কার অথবা তার পোশাক বদলানো, খাইয়ে দেওয়া ইত্যাদি নানা সেবার সময় ঘৃণায় কখনও নাক কুঁচকে আসত, বমি পেত, এইসব অপদার্থ মরনাপন্নগুলোর অসহায়তা দেখে মন খারাপের বদলে বিরক্তি লাগত, তারপর একসময়ে সয়ে যেতে যেতে অন্য এক ভাবনা এল তাদের মনে, তা হল পুন্য অর্জনের স্পৃহা। যত সেবা ততই তার নিজের পূণ্য সঞ্চয়ের ঝুলিটি ভরে উঠবে এই মোহ থেকে তারা কাজ করতেন। এই ইচ্ছেও একটা সময় রুগন হতে হতে মরে গেল। পড়ে রইল শুধু অভ্যাস আর নির্লিপ্তি এবং কর্তব্য। গোটা ভারতবর্ষর আনাচ কানাচ থেকে মৃতুপথযাত্রীরা এখানে আসেন জীবনের অন্তিম শ্বাস নিতে। তবে যারা আসেন তাদের মধ্যে শতকরা সত্তরভাগই হিন্দীভাষী এবং দেহাতি। অন্য ভাষার মানুষও আসেন কিন্তু সংখ্যায় খুব কম।
ভিখু আর হনুমান ঢুকল তিওয়ারিজির অফিস ঘরে। অফিসঘরও ন্যাড়া। একটা টেবিল, চেয়ার আর একটা কাঠের বেঞ্চ। টেবিলের ওপর রাখা একটা রেজিস্টার খাতা, ওই খাতায় আগে মৃতপ্রায় ব্যক্তির নাম ধাম ইত্যাদি সব নোট করে রাখা হয়। আর এক দেওয়ালে একটি বহু পুরনো কাঠের আলমারি। আলমারির পাল্লা নেই। প্রতিটি রগ্ধ্যাকে থরে থরে বাঁধানো খাতা রাখা।
অফিস ঘরে তিওয়ারিজ নির্লিপ্ত মুখে বসে রয়েছেন। সামনে কয়েকজন লোক। তারা কোনও একটি বিষয়ে হাতজোড় করে অনুনয় করছেন তিওয়ারিজী শান্ত মুখে হিন্দীতে বলছেন, মাপ করবেন আমার কিছু করার নেই। আমি নিয়ম ভাঙতে পারি না। গত চল্লিশ বছরে আমি নিয়ম ভাঙিনি, পনেরো দিনের বেশি একদিনও এখানে রাখার নিয়ম নেই। আমার মনে হয় আপনার বাবুজির এখনও ডাক আসেনি, ওকে বাড়ি নিয়ে যান, নয়তো কাছে অন্য কোনও হোটেলে রাখুন। ভগবানের ডাক না এলে মানুষ যাবে কী করে বলো?
আর দুটো দিন দেখি মনে হচ্ছে বাবুজী চলে যাবেন।
শুনে হাসলেন তিওয়ারিজি। শান্ত গলায় বললেন, বাবু এই চল্লিশ বছরে ষোল হাজার পাঁচশ তেষট্টিজন এই মোক্ষভবনে এসেছেন অনন্ত মুক্তি লাভের আশা নিয়ে। ওই যে দেওয়ালের আলমারিতে দেখছেন পুরনো খাতাগুলো, ওগুলো সব পুরনো রেজিস্ট্রার। প্রত্যেকটা এন্ট্রি আমার নিজের হাতে লেখা। এদের মধ্যে কম করে আটশ মানুষ পনেরোদিন থেকেও মুক্তিলাভ না করে ফিরে গিয়েছেন। ওপরওলার ডাক না পেলে, সঠিক সময় না এলে কারও কিছু করার নেই। বাবুজিকে নিয়ে যান। ওঁর আরও পরমায়ূ রয়েছে। দেখছেন তো মাত্র বারোটা ঘর। একটা ঘরে আমরা দুইজনের বেশি রাখতে পারি না। তাও তো এখন শীতকাল নয়, ওই সিজিনে আরও প্রেশার বেশি থাকে। বলে ভিখু আর হনুমানের দিকে তাকিয়ে তিওয়ারিজি বললেন, হ্যাঁ বাবু নমস্কার, বলুন কী সেবা করতে পারি?
বসে থাকা লোকগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে করতে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেল। ভিখু আর হনুমান এসে বসল ওই বেঞ্চে। ভিখু বলল নয় নম্বর ঘরে আমাদের বন্ধুকে রেখেছি। শিউচরণ।
আচ্ছা আচ্ছা বলুন।
ব্যাপার হল যে আমরা কেউ থাকতে পারছি না। আজই চলে যেতে হবে। রুজিরুটির ব্যাপার। ওর কাছে থাকার…
কোনও ব্যাপার না। মানুষ এসেছেও একা চলে যাবেও একা। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব এসবই দুইদিনের মায়া। আমরাই দেখভাল করে নেব কোনও চিন্তা করবেন না। তবে অন্তেষ্টি যদি আপনারা করতে চান তাহলে এখানে কাউকে থাকতে হবে না হলে আমরা ব্যবস্থা করব।
তাই করে দেবেন। কে আসবে কোনও ঠিক তো নেই। শিউচরণের খুব ইচ্ছে ছিল এখানে মরার, তাই আমরা নিয়ে এলাম।
হ্যাঁ কাশীতে মৃতু মানে মোক্ষলাভ। মা গঙ্গা, বাবা বিশ্বনাথ সকলেই রয়েছেন এই বারানসীতে।
হুঁ…বলে ভিখু জিজ্ঞাসা করল আচ্ছা টাকা পয়সা কী দিতে হবে?
তিওয়ারিজী হাসলেন। বললেন মোক্ষভবনে টাকা পয়সা কিছু লাগে না বাবু। জীবনের শেষদিনে আর কোনও বিজনেস চলে না, শর্ত শুধু একটাই পনেরোদিন পেরিয়ে গেলে কিন্তু আর ঘরে রাখা যাবে না, ওকে ফেরত নিয়ে যেতে হবে। সেইজন্য আপনাদের কোনও ফোন নাম্বার থাকলে দিয়ে যান। আমরা যোগাযোগ করে নেব।
তিওয়ারিজির কথা শুনে ভিখু আর হনুমান মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। হনুমান বলল আসলে আমাদের কারও ফোন নেই। আমাদের মালিকের দোকানের ফোন নাম্বার রয়েছে, সেটা দেব?
তাই দিন। হনুমান ওর শর্টের বুক পকেট থেকে ছোট একটা নীল রঙের ডায়েরি বার করল। তারপর তিন নম্বর পৃষ্ঠা খুলে একটা নাম দেখিয়ে বলল এই যে এটা আমাদের মালিকের নাম আর নাম্বার।
তিওয়ারিজি বুঝলেন এরা দুজনেই লেখাপড়া জানে না। তিনি খাতায় শিউচরণের এন্ট্রি যেখানে করেছেন তার পাশে নাম্বারটা লিখে নিলেন।
বলছি কি…মানে আমাদের মালিক খুব সুবিধার লোক নয়, ওকে আপনি জানালেন কিন্তু ও আমাদের হয়তো কিছুই জানাল না, আর শিউচরণ পনেরোদিন বেঁচে রইল। তাহলে কী হবে?
তিওয়ারিজি বললেন তাহলে ওকে ঘরে রাখা যাবে না ঠিকই, কারণ ওর পরে যারা আসবেন তাদেরও তো সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু রাস্তায় তো ফেলে আসতে পারি না আমরা। তাই মোক্ষভবনের পিছনে একটা টিনের শেড করা রয়েছে ওখানেই তাদের রাখা হয়। জল-খাবার ইত্যাদি সেবা তারা আগের মতোই পাবেন কিন্তু ঘর পাবেন না। আসলে এখানে যারা আসেন তাদের অনেকেই রয়েছেন যার চালচুলো আত্মীয়পরিজন কেউ নেই, হয়তো তিনি রাস্তার ভিখিরি বা ভবঘুরে তাকেও মোক্ষভবন জায়গা দেয়। এখানে সবাই সমান।
আচ্ছা। শুনে একটু নিশিন্ত হল দুইজনে। কারণ এখান থেকে একবার চলে গেলে ওদের যে আর ফেরার উপায় নেই দুইজনেই জানে। আর মালিকও জানাবে না শিউচরণের কথা। হনুমান বলল, তাহলে আমাদের কি কিছু দান দিয়ে যেতে হবে?
দিতেও পারেন, নাও পারেন।
আচ্ছা, আমরা গরিব মানুষ সামান্য কিছু বলতে বলতে পকেট থেকে একটা একশোটাকার নোট বার করে হনুমান।
তিওয়ারিজী বললেন আমাকে দিতে হবে না। উঠোনে মন্দির রয়েছে ওখানে প্রণামীবাক্সে দিয়ে দিন।
আচ্ছা।
কথার মাঝেই আবার একটা পার্টি ঢুকল। তাদের আত্মীয়কে নিয়ে আসা হয়েছে, শেষ অবস্থা। তিওয়ারিজি খাতা খুললেন। হনুমান আর ভিখু তাকে নমস্কার জানিয়ে বেড়িয়ে এল। মন্দিরের সামনে প্রনামীর বাক্সে একশোটাকার নোটটা গুঁজে মোক্ষভবন ছেড়ে বেড়িয়ে এল ওরা। এতদূর এসেছেই যখন গঙ্গাস্নান করে বিশ্বনাথ দর্শনের পূণ্য রাতে ট্রেনে চাপবে।
মোক্ষভবনের নয় নম্বর ঘরের মেঝেতে চিত হয়ে শুয়েছিল শিউচরণ। গোটা শরীরে কোনও সাড় নেই। শরীর বলে যে একটা পদার্থ রয়েছে সেটাও টের পাচ্ছে না ও। কখনও চেতনা আসছে আবার কখনও ঘোরের মধ্যে চলে যাছে। দিন সাতেক আগেই ও টের পেয়েছিল দিন ঘনিয়ে এসেছে, তখনই ভিখু আর হনুমানকে জানিয়েছিল ওর শেষ ইচ্ছের কথা। ত্রিশ বছর আগে শিউচরণের দাদাজী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল এই মোক্ষভবনে। তখন শিউচরণের বয়স কত আর হবে এই দশ বারো। দাদাজীকে বড্ড ভালবাসত শিউচরণ। দাদাজী অনেক কাহিনি শোনাত, কাঁধে চাপিয়ে ঘুরতে নিয়ে যেত। তারপর একদিন বিছানা নিয়ে নিল। বাবা আর দাদিমা মিলে দাদাজীকে সেই বেগুসরাইয়ের গাধপুরা গ্রাম থেকে থেকে নিয়ে এসেছিল এই বেনারসের মোক্ষভবনে। বাবা আর দাদিমা ফিরেছিল অনেকদিন পর। বাবার মাথা ন্যাড়া ছিল আর দাদাজী ফেরেনি। শুধু এই ছেঁড়াছেঁড়া কিছু দৃশ্যের স্মৃতি। পরে বেশ কিছুটা বড় হওয়ার পর বাবার কাছে শুনেছিল দাদাজীর অনেককালের ইচ্ছে ছিল বেনারসে গঙ্গামায়ের ঘাটে শুয়ে শেষ নিঃশ্বাস তাগ করার। দাদাজীর ইচ্ছেপুরণ করার জন্য বাবা দাদাজীকে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু টানা তিনদিন গঙ্গার ঘাটে কাটানোর পরেও দাদাজীর মৃতু হল না। তখনই একজন সাধু তাদের সন্ধান দিয়েছিলেন মোক্ষভবনের। ওখানে গিয়ে আরও চারদিন থাকার পর দাদাজী প্রাণ ত্যাগ করে। তারপর একেবারে শ্রাদ্ধ সেরে বাবা গ্রামের বাড়িতে ফিরেছিল। মোক্ষভবন নামটা মনে গেঁথে গিয়েছিল সেই থেকে।
গলা শুকিয়ে উঠেছে। ঘরের মধ্যে কাদের যেন কন্ঠস্বর। চোখ মেলে পাশ ফিরে দেখতে চেষ্টা করল শিউচরণ, পারল না। ভিখু আর হনুমান যে চলে গিয়েছে সেটা বুঝতে পেরেছে ও। আর কেউ নেই, একা। এবার চলে গেলেই হয়। জীবনে শুধু একটাই আফশোস থেকে গেল শিউচরণের। শুধু একটাই আফশোস। আর সেই আফশোস নিয়ে মরার জন্য যদি আবার ওকে জন্ম নিয়ে ফিরতে হয় সেই ভয় থেকেই ও মনেপ্রানে চেয়েছিল বেনারসে মরতে। কারণ বাবার কাছে শুনেছিল বাবা বিশ্বনাথের ধামে মরলে আর জন্ম হয় না। আর মানবজন্ম চাই না। বড় কষ্ট, বড় যন্ত্রণা। কথাগুলো মনে হতে আবার শরীরে মোচড় দিয়ে যন্ত্রণা এল শিউচরণের। অস্ফুটে আহ করে উঠল। চল্লিশ বছরের শিউচরণের চেহারা বলতে কয়েকটা হাড়কে কোঁচকানো চামড়ার চাদর দিয়ে ঢাকা। হাড় আর চামড়ার মাঝে মানুষের মাংস বলেও যে একটা পদার্থ থাকে সেটা প্রায় সাত আট বছর আগে থেকেই উধাও হতে শুরু করেছিল। অথচ আজ থেকে বছর বিশেক আগে বেগুসরাই থেকে যখন কলকাতা শহরের মেছুয়াপট্টিতে পা রেখেছিল তখন ওর চেহারা পরিণত শালগাছের মতো। হাট্টাখাট্টা জোয়ান। ঘরে অভাব। তাই কলকাতায় চলে এসেছিল কাজের সন্ধানে। মেছুয়া পট্টিতে ফলের বাজারে মুটেগিরি শুরু। তারপর গড়াতে থাকল সময়। তিরিশ বছর ছুঁই ছুঁই। বিয়ে শাদি করার কোনও আগ্রহ ছিল না শিউচরনের। মা চিঠিতে মাঝেমাঝেই লিখত, তোর জন্য মেয়ে দেখছি। শিউচরণ রাজি নয়। বছরে একবার দেশের বাড়ি যেত শিউচরণ। ছটপুজোর সময়। পুরো একমাস কাটিয়ে তারপর আবার কলকাতায় ফিরত। মেছুয়াপট্টিতেই একটা ঘর ভাড়া করে থাকত ছয়জন দেশয়ালি ভাই মিলে। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত ফলের ঝুড়ি, কার্টুন, লরি থেকে খালাস করা, গোডাউনে রাখা, আবার মাল নিয়ে অন্য লড়িতে তোলা। প্রচুর খাটনি। রোজগার মন্দ না। খৈনি ছাড়া আর কোনও নেশা ছিল না শিউচরণের। দুইবেলা কয়েকটা চাপাটি সবজি আর সন্ধেবেলায় পান্ডেজির দোকানের একলোটা গরম দুধ, ব্যাস ওতেই জীবন চলে যাচ্ছিল বেশ। কিন্তু জীবন আর কার চিরকাল একরকম চলে?
ঘরের ভেতর লোকের কোলাহলটা অসহ্য লাগছে শিউচরণের। একটু একাকিত্ব চাই। একটু নৈঃশব্দ। আআহ… আবার যন্ত্রনাবোধ ফিরে আসছে। পেটে অসহ্য ব্যাথাটা ফিরে আসছে আবার। বার বার ফিরে আসছে একটা মুখ। কপালে দগদগে কমলা রঙের সিঁদূর, নাকে সোনার নথ ফর্সা গোল একটি মেয়ের মুখ, হে রামজি আমাকে এবার তুলে নাও…দয়া করো। মনে মনে কাতর প্রার্থণা করতে করতে ঘাড়টা ডানদিকে হেলে গেল শিউচরণের। ঘরের মধ্যে ওর থেকে ঠিক চারফুট দূরে আরেকজনকে চাটাইতে শুইয়ে রেখে গেল দুই তিনজন লোক। পেটের ব্যাথার চোটে শিউচরণের আবার যেন হুঁশ কিছুটা ফিরেছে। তার মৃতু সহযাত্রীটিকে একবার দেখার জন্য অতি কষ্টে চোখ মেলে ঘোলাটে দৃষ্টি মেলল শিউচরণ, আর সঙ্গে সংগে ওর ওই মৃতপ্রায় শরীরটায় যেন কেউ চারশ চল্লিশ ভোলটের কারেন্ট ছুঁইয়ে দিল। শিউরে উঠল ও। চিৎকার করে কিছু একটা বলে উঠতে গেল কিন্তু শ্লেষ্মা মেশানো খানিকটা ঘড়ঘড় ছাড়া কিছুই বেরলো না মুখ থেকে। নেতিয়ে পড়া হূদস্পন্দন আবার যেন ঘোড়ার মতো ছুটতে শুরু করেছে টের পেল শিউচরণ। ভাল করে আবার দেখল…লোকটাকে। হ্যাঁ ওই…হ্যাঁ হ্যাঁ ও! বাঁ গালের ওই আঁচিল ও কী করে ভুলবে? হ্যাঁ সেই আঁচিল, সেই খাঁড়া নাক। উত্তেজনায় উঠে বসতে গেল শিউচরন, পারল না। চিৎকার করে ডাকতে গেল চারফুট দূরে নির্জীব শুয়ে থাকা লোকটাকে। সেটাও পারল না। আহহহ বড় অস্থির… বড় অস্থির লাগছে। কতযুগ ধরে গালে আঁচিলওলা যে লোকটাকে পৃথিবীর আনাচে কানাচে শয়নে জাগরণে খুঁজেছে শিউচরণ সেই দুলারাম সাহারন এখন ওর থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরত্বে। বুকের ভেতর কে যেন ক্রমাগত একের পর এক ফসস শব্দ করে দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছুড়ে মারছে। জ্বলে জ্বলে উঠছে সেই জায়গাগুলো। নিঃশ্বাস দ্রুত পড়তে থাকল শিউচরণের। দুলারাম! শেষপর্যন্ত শেষমুহূর্তে হলেও দেখা হয়েই গেল! একই ঘরে মাত্র কয়েক ফুট দূরে শিউচরণের জীবনের এক এবং পরম শত্রু যাকে দেখতে পেলেই ও খুন করবে সেই জিঘাংসা নিয়ে বছরের পর বছর নিজের লুঙ্গির গেঁজে ফোল্ডিং ছুরি নিয়ে ঘুরেছে। যার জন্য ওর জীবনটা শেষ হয়ে গিয়েছে, যার জন্য শিউচরণ মাত্র চল্লিশ বছর বয়েসে একা এই মোক্ষভবনের মেঝেতে শুয়ে জীবনের অন্তিম শ্বাসটি নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে সে মাত্র চারফুট দূরে! এই অবিশ্বাস্য সত্যিটাকে প্রাণপনে চিবিয়ে গিলতে গিলতে হড়হড় করে শিউচরণ চলে গেল বেশ কিছু বছর আগে।
সেবার দেশে ফেরামাত্রই মা বলেছিল এই শেষবার তোকে জিজ্ঞাসা করছি বিয়ে করবি?
না।
একটা মেয়ের ছবি দিয়ে গিয়েছে শাস্ত্রীজী। দেখ, যদি এটাও ভাল না লাগে তাহলে আর বলব না।
মায়ের বাড়ানো ফটোটায় নেহাত অনিচ্ছায় চোখ রেখেছিল শিউচরণ তারপর সেই ছবিতে রাখা চোখ আর সরাতে পারেনি। সেবার আর এক মাস নয়, টানা দেড় মাস দেশের বাড়ি থেকেছিল শিউচরণ। মুঙ্গেরের সাজুয়া গ্রামের মুন্নালাল যাদবদের ছোট মেয়ে পিয়ারির সঙ্গে বিয়ে, ফুলশয্যা সেরে তবেই কলকাতায় ফিরেছিল ও। ফিরে মন টেঁকেনি কাজে। মাস খানেকের মধ্যে শরীর খারাপের অছিলায় আবার ফিরে গিয়েছিল দেশে তার পিয়ারির কাছে। পিয়ারি…আহা ভগবান যেন অনেক যত্ন করে বানিয়েছিলেন পিয়ারিকে। নইলে দেহাতে গরিবের মেয়ে হয়ে, খাটালে গু গোবর সাফ থেকে ঘরের-বাইরের সব কাজ করেও এত রূপ! যেন সিনেমার হিরোয়িন! রামজীর ভজন কীর্তন গাইতেও যেমন ভাল পারত তেমনই পারত সিনেমার গান গাইতে। ছবিতে পিয়ারিকে দেখেই মজে গিয়েছিল শিউচরণ। তার মনে হয়েছিল এতদিন অপেক্ষা করা সার্থক। আর এই মেয়ে যেন তারই জন্য বসেছিল। তারপর ঝট মাঙ্গনি পট শাদি। গরিব ঘরের মেয়ে কুড়ি বছর বয়েসি পিয়ারির সঙ্গে গরিব ঘরের ত্রিশ বছর বয়সের শিউচরণের বিয়ে হল এই বিশাল পৃথিবীর এককোনে। আকাশ থেকে কোনও পুষ্পবৃষ্টি হল না, আকাশে হাইউবাজিও জ্বলল না, কিন্তু শিউচরণের মনে শত শত ফুল ফুটল, চোখে জ্বলে উঠল হাজার হাজার রঙিন হাউই। এত রূপসী, গুণবতী বউকে নিয়ে সে কী করবে বুঝে পায় না। আর ছলাকলাতেও পিয়ারির দুরন্ত প্রতিভা। দ্বিতীয়বার দেশের বাড়ি যাওয়ার পর পিয়ারি বায়না ধরল কলকাতা শহর দেখব। শিউচরণও চাইছিল পিয়ারিকে নিজের কাছে রাখতে। নিয়ে এল কলকাতা। হাওড়াব্রিজ, ভিক্টোরিয়া, চিড়িয়াখানা তো দেখলই, আর দেখল সিনেমা হলে সিনেমা। শিউচরণ আর দেশের বাড়িতে পাঠাল না, বড়বাজার অঞ্চলেই বন্ধুবান্ধবদের চেনাশোনায় খুপরি ঘর ভাড়া নিল একটা। পিয়ারির শরীরের গন্ধে, স্বাদে ডুবে গেল ডুবে গেল শিউচরণ। পিয়ারির যেন ঠিক ততটা আগ্রহ নেই শিউচরণের শরীরে ডুবতে, বরং ওর বেশি প্রিয় জরিচুমকি দেওয়া শাড়ি, রঙিন চুড়ি, সুন্দর গন্ধওলা সাবান, শ্যাম্পু, আরও সব সাজগোজের জিনিস। এক বছর গড়াল, তারপর দুই…শিউচরণের মা তার বউমাকে জিজ্ঞাসা করল নাতির মুখ কবে দেখব? বউমার মুখ উত্তর নেই। শিউচরণেরও না। কী উত্তর দেবে? নাতি উৎপাদনের আয়োজনে ত্রুটি কিছুই নেই, শিউচরণের মতে জমি চষা ঠিকঠাকই হয়েছে কিন্তু ফসল যে সবসময় ভাল চষার ওপর নির্ভর করে না তা যে কোনও কিষানই জানে। তবে সন্তান না হওয়া নিয়ে শিউচরণের বাপ মা শ্বশুর শাশুড়ি যতটা চিন্তিত ছিল ওরা দুজনে কেউই অতটা অখুশি ছিল না। পিয়ারি তো বেশিই খুশি ছিল, কিন্তু কলকাতার জল যত শরীরে পড়ছিল যত শরীরের জেল্লা বাড়ছিল ওর চাহিদাও বাড়ছিল লাফিয়ে। শিউচরন উদয়অস্ত খাটত বউয়ের চাহিদার যোগান দিতে। কারণ ওর জীবন হয়ে উঠেছিল পিয়ারিময়। জগতে পিয়ারির হাসিমুখ ছাড়া ও আর কিছু দেখতে চাইত না। মেছুয়াপট্টির এক সামান্য মুটের পক্ষে যতটা রোজগার করা সম্ভব ততটা করতে করতে তার চেয়েও বেশি করতে গিয়ে ধুঁকতে শুরু করেছিল ও। কিন্তু পিয়ারির কোনও হুঁশ নেই। সে নিজেকে নিয়েই বুঁদ। ঘরে একটা বড় আয়না, সেখানে পারলে সারাদিন দেখে নিজেকে। বছর কয়েকের মধ্যেই শিউচরণ তার কাছে পুরনো আর একঘেয়ে হয়ে উঠল। শিউচরণের চোখের মুগ্ধতা আর ভাল লাগছিল না তার। সুন্দরী বউ বলে বন্ধুমহলে শিউচরণ যত না খাতির পেত বউয়ের আঁচলধরা ভেড়ুয়া এই কথা তাকে শুনতে হত অনেক বেশি। কিন্তু তাতে শিউচরণের পৌরুষে এতটুকু আঘাত লাগত না, বরং আরাম লাগত। পিয়ারিকে ও ভালবাসে এই অনুভূতিটাই ওকে তৃপ্তি দিত বেশি। কিন্তু পিয়ারির চাহিদা বাড়ছিল। সেই চাহিদার খোঁজ পেল ফলপট্টির দালাল দুলারাম সাহারন। বাঁ গালে আঁচিলওলা পয়লানম্বরের খচ্চর, শিউচরণের বউ সুন্দর দেখতে এইকথা শোনার পর ভাবীর হাতে এককাপ চা খাব এই আবদারে সে শিউচরণের সঙ্গে এসেছিল ওই ঘরে। সরল বিশ্বাসে সেই বেইমানকে ঘরে মেহমান করে নিয়ে এসেছিল শিউ। তারপর সেই চা খাওয়া তার বাড়তে থাকল। শিউচরণ ঘরে না থাকলেও চা খেতে চলে আসতে থাকল। পকেটে দালালির কাঁচা টাকা, রাজস্থানী সুঠাম ফর্সা চেহারা, মুখে বড় বড় বুকনি, পিয়ারি গলে গেল খুব দ্রুত। দুলারাম আসা মানেই ভাল ভাল উপহার, শিউচরণের থেকে অনেক সুন্দর আদর। আরও ভালভাবে থাকার স্বপ্ন। শিউচরণ একদিন সন্ধেবেলায় ঘরে এসে দেখল ঘরে বউ নেই। খবর পেল হাতে বাক্স আর কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সে দুলারামের সঙ্গে বেরিয়েছে। শিউচরণ অপেক্ষা করল। রাত পেরিয়ে গেল সেই অপেক্ষায়। আরও দুইদিন সে ঘর থেকে বেরোল না, কিছু খেল না। খবর ছড়িয়ে গেল শিউচরণের বউ দালাল দুলারামের সঙ্গে ভেগেছে। শালা বউয়ের ভেড়ুয়া যেমন…ঠিক হয়েছে। শিউচরণ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি দুলারাম এমন করতে পারে। ঢের বিশ্বাস করেই পিয়ারির হাতের চা খাওয়ানোর জন্য নিজের ঘরে এনেছিল ওকে।
তৃতীয় দিনে বড়বাজার থেকেই একটা ছয় ইঞ্চি ফলার ফোল্ডিং ছুরি কিনল শিউচরণ। কলকাতায় দুলারাম কোথায় থাকে সেই খোঁজ নিয়ে সেখানে হানা দিয়ে শুনল বেশ কিছুদিন আগেই সেখান ছেড়ে চম্পট দিয়েছে। কোথায় কোথায় যেতে পারে তার লিস্ট তৈরি করে ছোরা প্যান্টের গেঁজে ভরে মাসের পর মাস পাগলের মতো ঘুরল। রাজস্থানেও গিয়েছিল বাড়িটাও খুঁজে বার করেছিল কিন্তু ওদের পায়নি। তীব্র ক্রোধ, প্রতিহিংসায়, কষ্টে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিল শিউচরণ। যত দিন যাচ্ছিল দুলারামকে খুঁজে বের করে ওর বুকের ভেতর ছয় ইঞ্চির ফলাটাকে ঢুকিয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠছিল। কিন্তু এত বড় পৃথিবীর কোথায় কোথায় খুঁজবে? তবু যেখানে ও যেতে পারে বলে সামান্য ইশারাও পেয়েছে, ছুটে গেছে। পায়নি। বেমালুম উধাও হয়ে গিয়েছিল দুলারাম পিয়ারিকে নিয়ে। শিউচরণের ইচ্ছে করত গোঁটা পৃথিবীটাকে আঁচড়ে দেখতে কোথায় লুকিয়ে রয়েছে শয়তানটা। আর পিয়ারি? নাহ রাগ নয় বরং এর পরেও কষ্ট হত, চিন্তা হত মেয়েটার জন্য। তখনও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত দুলারাম পিয়ারিকে জোর করে কিংবা কিছু ভুল বুঝিয়ে নিয়ে গিয়েছে, হয়ত পিয়ারি ফিরতে চাইছে, পারছে না, কাঁদছে শিউচরণের জন্য…
দুলারামকে খুঁজে পেল না শিউচরণ, কিন্তু তার বদলে যেটা পেল তা হল, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছে। যে শিউচরণ খৈনি ছাড়া আর কোনকিছু নেশা করত না, সে ডুবে গেল মদের বোতলে। দিন রাত এক করে শুধু নেশা আর নেশা। বন্ধুবান্ধবরা বোঝাতে চেষ্টা করে বুঝল এই লোকটা আসলে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার খেলায় নেমেছে। একে আর আটকানোর সাধ্য নেই। হাল ছেড়ে দিল তার কুলি কামিন ঠেলাগাড়িওলা, খালাসি বন্ধুরা। কয়েকবছরের মধ্যেই শিউচরণের বলিষ্ঠ চেহারাটা শুকিয়ে পাকিয়ে নারকেল দড়ির মতো হয়ে গেল। ধুঁকতে শুরু করল ও, মোট বওয়ার মতো আর দম রইল না। ফলে রোজগার কমতে কমতে তলানিতে। আরও বছর দুয়েক পর লিভার পচতে শুরু করল। পেটে জল। সময় শেষ হয়ে এসেছে বুঝে ওর দুই পুরনো বন্ধু ভিখু আর হনুমান যারা সারাদিন খাটাখাটিনির পরেও যতটা সম্ভব শিউচরণের দেখভাল করত তাদের কাছে জানাল নিজের অন্তিম ইচ্ছের কথা। বন্ধুর শেষ ইছে ফেলতে পারেনি। অনেক ঝক্কি নিয়ে আজ রেখে গেল ওকে। পেটের টানে আজ ফিরেও গেল।
গালের আঁচিলটা ধকধক করে জ্বলছে শুয়োরের বাচ্চাটার। হ্যাঁ ওই আঁচিলটাই ছিল দুলারামের চেহারার বৈশিষ্ট। ইসস ছোরাটা যদি এখন সঙ্গে থাকত…কিন্তু নিজে থেকে উঠে বসার ক্ষমতাও যে নেই শিউচরণের। তবু পারতে হবে, পারতেই হবে। রামজি নিজে ঠেলে পাঠিয়েছেন ওর শত্রুকে নিজে হাতে নিধন করার জন্য, এই সুযোগ ও ছাড়বে না কিছুতেই ছাড়বে না। ওই তো মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস টানছে দুলারাম, খাবি খাচ্ছে। এমনভাবে শ্বাস টানছে যে দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে যে কোনও শ্বাসই শেষ শ্বাস হতে পারে। শিউচরণ মনে মনে রামজির কাছে প্রার্থনা করল যেন দুলারাম না মরে। যেন আজকের দিনটা আজকের রাত্তিরটা বেঁচে থাকে…
প্রায় শেষ হয়ে আসা শরীরদুটো চারফুট দূরত্বে পড়ে রইল সারাদিন। তাদের মুখে গঙ্গাজল, মাথায় ঠাকুরের ফুল ছুঁইয়ে গেলেন পুজারীজি। সন্ধেবেলা গীতার কিছুটা অংশ পাঠ করে গেলেন তিনি। বুধিয়া এসে মাঝেমাঝে দেখে গেল ওদের, মুখে গঙ্গাজল, অল্প দুধ চামচে করে খাইয়ে গেল। বিকেল গড়িয়ে অন্ধকার নামল, ঘরে একটা টিমটিমে বাল্ব। দুলারাম মাঝে মাঝেই গোঙাচ্ছে। ওর বুকের ঘরঘর শব্দ শুনতে পাচ্ছে শিউচরণ। আজ সকাল পর্যন্তও ও নিজের মৃতুর জন্য অপেক্ষা করছিল কিন্তু এখন অপেক্ষা করছে আরেকটু রাত নামার। মাঝে মাঝে চোখ জুড়ে নামছে ঘুম, চেতনা চলে যাচ্ছে শিউচরণের। আবার ফিরে আসছে। ফুটবলের মতো উঁচু পেটের ভেতরে ভসভস করছে লিভার পচা হলদেটে জল। শিউচরণ চোখ বুজে অপেক্ষা করতে থাকল।
রাত নামল। চারদিক চুপ। অতিকষ্টে চোখে মেলে তাকাল শিউচরণ। বারবার চোখ বুজে আসছে। তাকিয়ে থাকতে বড় কষ্ট। চারদিক ঘোলাটে অন্ধকার। আর সময় নষ্ট করা ঠিক না, দুই হাতে ভর দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করল। নড়তে পারল না। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে পিয়ারির মুখটা মনের ভেতর ঝলসে উঠল আর পরমুহূর্তেই ঠিক কী যে হয়ে গেল যেন শরীরে দশ বছর আগের শক্তি এসে গেল ওর। হামাগুড়ি দিয়ে গেল দুলারামের কাছে। দুলারাম খাবি খাচ্ছে। দুইদিকে পা ছড়িয়ে ওর বুকের ওপর চেপে বসল শিউচরণ। দুলারামও চোখে মেলে তাকিয়েছে। বিস্ফারিত দুইচোখে ভয়, তীব্র ভয়, হ্যাঁ চিনতে পেরেছে শিউচরণকে…গালের আঁচিলটা দগদগে ঘায়ের মতো জেগে উঠেছে। দুলারাম ভয়ে চিৎকার করে উঠতে গেল, সেই সুযোগ দিল না শিউচরন। শাঁড়াশির মতো শক্ত দুই হাতের আঙুল দিয়ে চেপে ধরল দুলারামের গলা। দুলারাম দুই হাত দিয়ে ওকে সরাতে গেল। কিন্তু শিউচরণের শরীরে যেন বহুদিন পর অসুরের শক্তি ভর করেছে। দুলারামের দুই চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ভয়, যন্ত্রনা… আহা কী আরাম লাগছে দেখতে…কপালের রগ, নাকের পাটা ফুলে উঠছে শিউচরণের। নিঃশ্বাস ফেলছে দ্রুত। চোয়াল শক্ত। কপাল ঘেমে উঠছে উত্তেজনায়। দীর্ঘক্ষণ ধরে দুলারামের শ্বাসনালী চেপে রাখল প্রাণপনে। অনেকক্ষণ ধরে ছটফট করে তীব্র মৃতুযন্ত্রণা পেয়ে অবশেষে শিউচরণের হাতে মরল দুলারাম। ওর গালের কালো টপলা আঁচিলটা দপদপ করতে করতে থেমে গেল। দুলারামের বিস্ফারিত যন্ত্রণাক্লিষ্ট স্ট্যাচু হয়ে যাওয়া মুখটা কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করল শিউচরণ। আহহ কী আরাম কী আরাম…! খুনটা করতে করতে, করার পর ওই মরা মুখটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রায় রাত ভোর হয়ে গেল।
তারপর বুকের ওপর থেকে নেমে আবার চুপিসারে হামাগুড়ি দিয়ে নিজের চাটাইয়ে গিয়ে চুপ করে শুয়ে পড়ল। এতকালের ভারি শরীরটা আজ পালকের মতো হালকা লাগছে। এতদিন ভাবত দুলারামকে মারার পরমুহূর্তে যদি মরে যাই তাহলেও আফশোস নেই কিন্তু আজ এখন মনে হচ্ছে নাহ শুধু আজকের রাতটা যেন মৃতু না আসে, বহুযুগ পর স্রেফ এই রাত্তিরটা একটু ভাল করে ঘুমোতে চাইল শিউচরণ।
পরদিন সকালে মোক্ষভবনের বুধিয়া এসে দেখল পাশাপাশি মানুষদুটো একইভাবে শুয়ে। কারোরই হুশ নেই। প্রথমে শিউচরণের সামনে এসে নাকের সামনে আঙুল রাখল। খুব হালকা শ্বাস চলছে, আর হয়ত কয়েকঘন্টা। তারপর ওর পাশে গালে কালো আঁচিলওলা সাতজন্মের চালচুলোহীন ভিখিরিটা, যে গত তিরিশবছর ধরে এই দশাশ্বমেধ ঘাটে বসেই দুইবেলা ভিক্ষা করত, ঘাটের পাশে পড়ে খাবি খাচ্ছে দেখে কয়েকজন পরিচিত সাধু এসে গতকাল ওকে রেখে গেছিল মোক্ষভবনে, তাকে পরীক্ষা করে দেখল ওর শেষ দম বেরিয়ে গিয়েছে। বুধিয়া গেল তিওয়ারিজিকে খবর দিতে। মনিকর্ণিকার ঘাটে বাকি ব্যবস্থা। কাঠের আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যাবে আরও একটা চির একলা মানুষ। আর গতকাল বিকেল থেকে সম্পূর্ণ চেতনা হারিয়ে ফেলা শিউচরণ এসব কিছুই জানল না।