☼ বিনোদ ঘোষাল ☼
রূপনগরের পিশাচিনী
চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছিল কৌশিক। সত্যিই কোনও তুলনা নেই। ওর নিজের বাড়ি থেকে সাইকেলে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে যে এমন একটা বাড়ি যে এই দক্ষিণপাড়ায় থাকতে পারে তা ওর স্বপ্নের অতীত ছিল। দক্ষিণপাড়া হল হাওড়া মেন লাইনের একটি রেলস্টশনের নাম। হাওড়া স্টেশন থেকে মেনলাইনগামী লোকালে ঠিক আটটা স্টেশন পরেই দক্ষিণপাড়া। দক্ষিণপাড়ার পুবদিকে তিন কিলোমিটার দূরে জিটি রোড, গঙ্গা আর পশ্চিমদিকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে দিল্লিরোড। এই আট কিলোমিটার ব্যাস নিয়ে গোলাকার দক্ষিণপাড়া। বেশ পুরনো জায়গা, বিশেষ করে পুবদিকটায় এখনও বেশ কিছু প্রায় দুশো বছরের পুরনো বাড়ির সন্ধান মেলে। পশ্চিমদিক অবশ্য সেই তুলনায় নতুন। ষাট সত্তর বছর আগেও এইদিকটা ঘন জঙ্গলে ভরা ছিল। শিয়াল, বনবিড়াল, বিষাক্ত সাপ ইত্যাদির আখড়া। পরে ধীরে ধীরে জঙ্গল সাফ করে বসতি গড়ে ওঠে। কৌশিকের ঠাকুর্দা আজ থেকে প্রায় ষাঠট বছর আগে এখানে বাড়ি বানিয়েছিলেন তারপর থেকে পাকাপাকি এখানেই। কৌশিকের স্কুল জীবন এই দক্ষিণপাড়া বয়েজস্কুল তারপর কলকাতার কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন। এখন কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করছে এবং সঙ্গে সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা। তেইশ বছরের কৌশিকের শখ বলতে একটিই তা হ’ল গিটার। গানবাজনার প্রতি শখ ওর ছোটবেলা থেকেই ছিল, মাধ্যমিক পাশ করার পর খুব ইচ্ছে হল গিটার শেখার। ভর্তিও হল শিখতে। বছর দিয়েকের মধ্যে দিব্বি চলনসই শিখে নেওয়ার পর নিজের মনেই গান আর গিটার নিয়ে থাকে কৌশিক। লাজুক অন্তর্মুখী কৌশিক বরাবরই নিজের জগতে থাকতে ভালবাসে। ওদের বাড়ির পিছনে বেশ খানিকটা সাইকেল চালিয়ে গেলেই এখনও ধানক্ষেত, বাঁশবাগান, ঘন জঙ্গল পাওয়া যায়। যেদিন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস থাকে না সেদিন বেলার দিকে অথবা দুপুর-বিকেলে কৌশিক সাইকেল চালিয়ে চলে যায় ওইসব জায়গায়। অনেকক্ষণ একা একা ঘোরে, বাঁশবনের ভিজে মাটি, ঠান্ডা পরিবেশ অথবা ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে বয়ে আসা মিষ্টি হাওয়া ওর বড় ভাল লাগে। মন ভাল হয়ে যায়।
কৌশিকের আজ পর্যন্ত কোনও বান্ধবী হয়নি। দুই একজনকে কলেজে মনে ধরেছিল ঠিকই কিন্তু ওই পর্যন্তই। মনের বাইরে তার আর প্রকাশ ঘটেনি। এমনকি যাকে ওর পছন্দ হয় তাকে ওর ধারে কাছে আসতে দেখলেই ভয় পেয়ে যায় কৌশিক। সঙ্গে সঙ্গে দূরে, আড়ালে সরে যায়। এমন স্বভাব যার, তার প্রেমিকা জুটবে না সেটাই স্বাভাবিক।
তা নিয়ে যে কৌশিকের খুব আফসোস রয়েছে তাও নয়। বরং এই একা একা থাকার যে একটা মজা সেটা ওর দিব্বি লাগে। কৌশিকের বাড়িটা যেখানে সেই জায়গাটা দিন পনেরো আগে পর্যন্তও খুব চুপচাপ ছিল। কিন্তু হপ্তা দুয়েক আগে থেকে সেই শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে। বাড়িতে কৌশিকের ঘরের বড় জানলা যেদিকে মুখ করে তার থেকে ঠিক কুড়ি ফুট দুরেই ধীরেনকাকাদের বাড়ি। ওদেরও অনেক পুরনো বাড়ি। সেই বাড়ি কিছুদিন আগে থেকে আগাপাশতলা সারাইয়ের কাজ চলছে। ধীরেনকাকুর ছেলে মলয়দা ভাল চাকরি করে। সেই বাড়ি রেনোভেনশনের কাজ শুরু করেছে ফলে রাজমিস্ত্রি, পাথর কাটার মিস্ত্রি, ঢালাই মেশিন, লেবারদের হৈ হৈ সবমিলিয়ে এক ভয়ংকর দুর্যোগ। এত হট্টগোলে জাস্ট পাগল পাগল লাগছিল কৌশিকের। কতদিনে এর থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে জানা নেই। যে আয়োজনে কাজ শুরু হয়েছে তাতে স্পষ্ট কম করে মাস দেড়েকের ধাক্কা। এমন হলে জীবন আর বেশিদিন নেই। কী করা যায় তাই ভাবতে ভাবতেই আজ সকালে কৌশিকের বন্ধু বুদ্ধদেব এসে হাজির। স্কুল বেলার বন্ধু। কয়েক কথার পরেই কৌশিক বলেছিল আর পারছি না ভাই, মনে হচ্ছে খুব শিগগিরিই পাগল হয়ে যাব। সারাক্ষণ মাথার ভেতরে যেন কেউ হাতুড়ি পিটছে।
বুদ্ধদেব ওর বন্ধুকে চেনে। বলল কোথাও ঘুরতে চলে যা।
কতদিন? সাতদিন দশ দিন পনেরো দিন? তারপর? এ তো মাস দুয়েকের আগে থামবে না।
বুদ্ধ ঠোঁট কামড়ে বলেছিল একটা জায়গায় তোর থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারি, পুরো ফ্রিতে। যদি রাজি থাকিস তো কথা বলে দেখতে পারি।
কোথায়?
এই দক্ষিণপাড়াতেই। বিউটিফুল জায়গাটা। আমি শিওর দেখলে তোর ভাল লাগবে। আরামে যতদিন খুশি থাকতে পারবি। কেউ ডিস্টার্ব করার নেই।
কী বলছিস রে!
ঠিকই বলছি। যাবি দেখতে?
এখনই চল।
দুই বন্ধু মিলে তখনই রওনা দিয়েছিল সাইকেল চেপে।
কৌশিকের বাড়ি থেকে সাইকেলে বেশ কিছুটা পথ, চার কিলোমিটার মতো। দক্ষিণপাড়ার পূর্বদিকে। গঙ্গার কাছাকাছি জিটি রোড থেকে একটু ভেতরের রাস্তার ওপরে একটা পুরনো ফটকের সামনে এসে দাঁড়াল বুদ্ধ। কৌশিককে বলল এই যে এসে গেছি। বিবর্ণ পলেস্তারা চটা দুটো প্রায় দশফুট উঁচু থামের মাঝে ব্ল্যাক জাপান রঙ করা লোহার পাতের গেট। বাইরে থেকে ভেতর দেখা যায় না। একটা থামের গায়ে পাথরের ফলকে লেখা রয়েছে মিত্র ভিলা। লেখাটাও কিছুটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছে বয়সের ভারে।
কৌশিক জিজ্ঞাসা করল, কী করে ঢুকব রে?
আয় আমি জানি কী করে ঢুকতে হবে। বলে উবু হয়ে বসে ওই গেটের নিচের ফাঁকে হাত ঢুকিয়ে কী একটা টানল তারপর উঠে দাঁড়াল। চল গেট খুলে গেছে। নিচে একটা দড়ি রয়েছে ভেতরের শিকলের সঙ্গে সেট করা। দড়িটা টানলে ভেতরের শিকল খুলে যায়। এটা এই বাড়ির কেয়ারটেকার বাবলুদার টেকনিক, বলে বুদ্ধ বলল, চলে আয় ভেতরে। লোহার দরজাটা ঠেলে সরিয়ে দিল। দরজা সরা মাত্র কৌশিক দেখল বাড়ির ভেতরটা যেন ওর জন্যই অপেক্ষা করছে। গেট থেকে সোজা চলে গিয়েছে ইট বিছনো লন। লনের দুই ধার ঘন সবুজ লম্বা ঘাসে ঢাকা। বুদ্ধ আর কৌশিক ভেতরে ঢুকল। দরজাটা ভেতর থেকে শিকল টেনে দিল বুদ্ধ। বলল চল এবার। সাইকেল এখানেই থাক।
প্রায় আধঘন্টা ধরে পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখল কৌশিক। দক্ষিণপাড়াতে যে এমন বাড়ি থাকতে পারে তা ওর কল্পনার বাইরে ছিল। প্রায় কুড়ি কাঠা জমির ওপর বাড়ি। একতলা। আর বাকিটা জঙ্গল। জঙ্গলের গন্ধ যেন ছেয়ে রয়েছে বাড়িটাকে। কী অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ! পুরো বাড়িটাই উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। বাড়ির চৌহদ্দিতে একটা শানবাঁধানো পুকুরও রয়েছে। যদিও পুকুরের জল দেখেই বোঝা যায় সেটা দীর্ঘদিন অব্যবহূত।
এই বাড়ির কেয়ারটেকার বছর পয়তাল্লিশের বাবলুদা তার স্ত্রী পুত্র নিয়ে অনেক বছরই রয়েছেন। তবে ওর ঘরটা পুকুরের অপর ঘাটের দিকে। মেন বিল্ডিংটা একতলা হলেও বেশ বড় এবং মেনটেইন্ড। পুকুরের গা দিয়ে সরু রস্তা রয়েছে বাবলুদার টিনে ছাওয়া ঘরের দিকে যাওয়ার জন্য। অনেক গাছ এই বাড়িতে। নারকেল, সুপুরি, আম, জাম, কাঠাল, আতা, জামরুল, কামরাঙা তো রয়েছেই ফুলের গাছও অনেক। জবা, টগর, কল্কের পাশাপাশি কামিনী, গুলঞ্চও রয়েছে। আর বাকিটা লম্বালম্বা ঘাস এবং আগাছার জঙ্গল।
কেমন বুঝছিস? জিজ্ঞাসা করল বুদ্ধ।
আমি ভাবতেই পারছি না। মনে হচ্ছে অনেক দূরে কোথাও এসেছি। সেখানে এমন জায়গা, এই হাভেলি…
এখানে থাকবি? তাহলে বল ব্যবস্থা করে দেব। ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করল বুদ্ধ।
সত্যি থাকতে দেবে আমাকে?
বুদ্ধ বলল, একটা দিন সময় দে।