☼ বিনোদ ঘোষাল ☼
রূপনগরের পিশাচিনী
সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ রিকশাটা এসে থামল বাড়ির গেটের সামনে। এই সময়টা অপুর চূড়ান্ত ব্যস্ততা থাকে। অফিস বেরোনোর তাড়া। স্নান সেরে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গা মুছছিল।
মা হয়ে গেছে বেড়ে দাও। মাকে ভাত বেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিতে দিতেই দেখল রিকশা এসে থেমেছে আর তারপর রিকশাওলা তার নিজের সিট থেকে নেমে এক বৃদ্ধকে ধরে নামাল। বৃদ্ধের যে হাঁটার ক্ষমতাও নেই সেটা বোঝাই যাচ্ছে। রিকশাওয়ালার কাঁধে ভর দিয়ে কোনওমতে নামল সে। এখন আবার কে এল! উফফ!
বৃদ্ধকে একহাতে নিজের গায়ে প্রায় লেপটে নিয়ে অন্যহাতে রাস্তার ধারে অপুদের বাড়ি ঢোকার গ্রিলের গেটটা খুলল রিকশাওলা। মুখে বলল সাবধানে আসুন।
বৃদ্ধ কী বলল কিছুই শোনা গেল না। অপু ঘরে ঢুকে দেখল মা ডাইনিং টেবিলে ভাত বাড়ছে। থালার ওপরে ধোঁয়া ওঠা ভাত। ভাতের হাঁড়ি থেকে খোসাসমেত ডিমটা হাতায় করে তুলে থালার পাশের বাটিতে রাখল মা। বাটিতে নুন আর কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজ দিয়ে মাখা আলুভাতে। অপু বেশিরভাগ দিনই আলুভাতে, ঘি আর ডিমসিদ্ধ খেয়ে অফিসে যায়। দুপুরের খাবার হয় বাইরে অথবা মা টিফিন বাক্সে ভরে দেয়। রুটি-পরোটা চচ্চড়ি ইত্যাদি।
খেতে বসে অপু বলল একজন বুড়ো লোক ঢুকছে দেখলাম বাড়িতে। রিকশায় এসেছে।
কে?
চিনতে পারলাম না।
ও। বলে ডিমের খোসা ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অপুর মা তপতী। আসলে এই বাড়িতে মাঝেমাঝেই অচেনা লোক আসেন। কারণ অপুদের রাধাগোবিন্দের মন্দির রয়েছে। প্রায় নব্বই বছরের পুরোনো অধিষ্ঠিত কুলদেবতা। অপুর ঠাকুর্দা গোবিন্দলাল ভট্টাচার্য এই অষ্টধাতুর যুগল বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শালগ্রাম শিলাও থাকার ফলে নিত্য তিনবেলা ঠাকুরের বাল্যভোগ থেকে শুরু করে মধ্যাহ্নে অন্নভোগ, সন্ধেবেলায় ভোগারতি সবই হয়। ঠাকুর্দা চলে যাওয়ার পর সেই দায়িত্বও নিয়েছিল অপুর বাবা। রাধাগোবিন্দ অন্ত প্রাণ। তো ঠাকুর থাকার কারণে অপুর জ্ঞান হওয়া ইস্তক দেখে আসছে এই বাড়িতে প্রতিদিন বিভিন্ন সময়ে ভক্তদের আনাগোনা লেগেই রয়েছে। কেউ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দুই হাত জড়ো করে প্রণাম করে যায়, কেউ ভেতরে এসে বারান্দায় উঠে প্রণাম সারে। চেনা-অচেনা সবরকমই মানুষ আসেন।। সকলের সঙ্গে যে কথা হয় তাও নয়। সেইজন্য অপুর মুখে একজন বাড়িতে আসছে শুনে কোনও ভাবান্তর হল না তপতীর।
খেতে বসল অপু। এবার মিনিট পাঁচ-ছয়ের মধ্যে নাকে-মুখে গুঁজেই বাইকে উত্তরপাড়া রেলস্টেশন। সেখান থেকে ডাউন ট্রেনে হাওড়া স্টেশন তারপর বাসে ঝুলে মিন্টোপার্কে অফিস। অপু একটা ইন্সিওরেন্স কোম্পানির ডেটা এন্ট্রি অপারেটর। মোটামুটি স্যালারি। মা আর ছেলের চলে যায়। গরম ভাতে ঘি দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস অপুর এসেছে পারিবারিক সূত্রে। বাপ-ঠাকুর্দা দুইজনেই ছিলেন গাওয়া ঘি এর ভক্ত। পাতে একটু ঘি না পড়লে তাদের ভাত হজম হত না। অপু সেই ট্রাডিশন এখনও টেনে চলেছে। ভাত ভেঙে ঘি ঢেলে তার মধ্যে আলুসিদ্ধর দলাটা কিছুটা মেখে নিয়ে মুখে পুরতেই শুনতে পেল বারান্দায় কেউ একজন ফ্যাসফেসে গলায় ডাকছে। বউদি আছেন নাকি? অ বউদি।ফ্যামিলি ট্যুর প্যাকেজ
ওই লোকটাই ডাকছে, দেখো তো। মুখে ভাত চিবোতে চিবোতে বলল অপু।
তপতী বিরক্ত হল। লোকের আসার আর সময় হয় না। এত কাজ পড়ে। নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে ঘর ছেড়ে বেরোল তপতী। অপুদের বাড়িটা অনেক পুরোনো ইংরেজি এল শেপের। লম্বা লাল সিমেন্টের বারান্দার পাশে সার সার অনেকগুলো ঘর। পূর্বমুখী বাড়িটির ঠিক মাঝের ঘরটি হল ঠাকুরঘর। ঘরের ভেতরে দরকার ঠিক মুখোমুখি সিংহাসনে রাধাগোবিন্দের অধিষ্ঠান। যারা বিগ্রহকে দর্শন, প্রমাণ করতে আসেন বারান্দায় উঠে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঠাকুরদর্শন করেন। ঠাকুরঘরের দরজা সারাদিন খোলা থাকলেও কোলাপসিবল গেটটা আটকানোই থাকে।
অপু খেতে খেতে শুনতে পেল মা ওই লোকটার সঙ্গে কথা বলছে। বুড়োটার গলার স্বর কিছুই প্রায় শোনা যাচ্ছে না। মায়ের গলা শোনা যাচ্ছে। মা বেশ গলা চড়িয়েই বলল, এই অবস্থায় বাড়ি থেকে বেরোলেন কেন? পড়ে-টরে গেলে…আপনি সামনের ঘরে বসুন। আমি চা দিচ্ছি।
কে এসেছে? খুব সামান্য কৌতূহল হল অপুর। তবে সেটা স্থায়ী হল না। গপাগপ ভাতের গ্রাসের মুখে তুলতে থাকল।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে খাওয়া শেষ করে বেসিনে হাত ধুয়ে জুতো পরে বেরোতে যাবে তপতী এসে বলল বাদলদা এসেছে, তোকে খুঁজছে বেরোবার সময় একবার দেখা করে যা।
কে বাদলদা?
তোর বাবার বন্ধু বাদল গুপ্ত। মনে নেই? সেই যে আসত…
মাকে আর মনে করাতে হল না। ওহ হ্যাঁ বুঝেছি। হেবিব বুড়ো হয়ে গেছে তো, দূর থেকে দেখে চিনতেই পারিনি।
কাছ থেকেও চিনতে পারবি না। কী চেহারা হয়েছে তাকানো যায় না। একবার দেখা করে আয়।
উফফ এখন…একদম সময় নেই মা। দেখা করলেই কথা বলতে হবে।
যা না একবার মুখটা দেখিয়েই বেরিয়ে যাবি। তোকে খুব ভালোবাসত ছোটবেলায়।
মা কথাটা এমনভাবে বলল যে অপু এড়াতে পারল না। পায়ে জুতো গলাতে গলাতে বলল, যাচ্ছি।
একবার প্রণাম করিস।
হুঁ।
একেবারে প্রথম ঘরটা বৈঠকখানা। বাবা যখন ছিল তখন এই ঘরের মেঝেতে সারাক্ষণ বিছনো থাকত দুটো লালপাড় মাদুর। বাবার বন্ধুরা মিলে এই ঘরে কখনও বসাত কীর্তনের আসর কখনও এমনিই আড্ডা। কখনও সকালে কখনও দুপুর, অনেকসময় বিকেলে বসে সন্ধে গড়িয়ে রাত হয়ে যেত। এই ঘরে বসে বাবা ও তার বন্ধুরা কত রাত হরিবাসর করেছে, সেইসব স্মৃতি…ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল অপু। নিজেকে মনে মনে ফিরিয়ে এনে উঠে দাঁড়িয়ে কাঁধে অফিসের ব্যাগ নিয়ে গেল বাইরের ঘরে। গত ছয় বছর এই ঘরে আর মাদুর বিছনো থাকে না। বছর দুয়েক আগে অপু একটা রট আয়রনের সোফা আর টিটেবিল কিনে এই ঘরে রেখেছে। বন্ধুবান্ধব পরিচিতদের কেউ এলে এই ঘরেই বসে। অপু ঘরে ঢুকে দেখল সেই বাদলজেঠু সোফাতে প্রায় এলিয়ে বসে রয়েছে। পা দুটো সামনে টান করে ছড়িয়ে পুরোনো অভ্যাসমতো নাচাচ্ছে আর মাথাটা হেলিয়ে চোখ বন্ধ রেখে বিশ্রীভাবে শ্বাস নিচ্ছে। শ্বাসের মধ্যে কেমন একটা ঘরঘরে শব্দ। মা বলে না দিলে সত্যিই বোঝা কঠিন ছিল এ সেই বাদলজেঠু মানে বাদল গুপ্ত। মানুষের সুন্দর স্বাস্থ্য যে কী ভয়ংকর হয়ে যেতে পারে তা প্রথমবার দেখেছিল অপু নিজের বাবার ক্ষেত্রে। ওই বিশাল চেহারাওলা লোকটা মাত্র দুই বছরের মধ্যে শুকিয়ে গুটিয়ে এইটুকু হয়ে গিয়েছিল, নিজের বাবাকেও চেনা যেত না, গোল মুখে ফোলা গালদুটো এমনভাবে চুপসে গিয়েছিল যে পুরো মুখটাই হয়ে উঠেছিল বীভৎস। তাকাতে কষ্ট হত। বাবা চলে যাওয়ার পর অনেক রাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারত না অপু। বারবার ওই করুণ চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠত। চোখে সামান্য ঘুম এলেও স্বপ্নে চলে আসত কেমো নিতে নিতে কঙ্কাল হয়ে ওঠা বাবা। অপু ভাবত বাবার সেই চিরপরিচিত সুন্দর চেহারাটা কেন যে একবারের জন্যও মনে পড়ে না!
অপু বাদল জেঠুর সামনে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করতে গেল বাদলজেঠু কেমন আছ? পারল না প্রশ্নটা করতে। কেমন আছ-র বদলে জিজ্ঞাসা করল জেঠু জল খাবে?
বাদল চোখ খুললেন। দুই চোখের কোণে অল্প পিচুটি জমে। সোফা হয়ে ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বললেন, এই তো বিনোদ। তোকেই খুঁজছিলাম। অফিস যাচ্ছিস? বাহ ভালো ভালো। এই বয়সেই তো রোজগার করতে হবে, তা বিয়ে-থা করেছিস?
না বলার আগেই ওর পাশে এসে দাঁড়াল তপতী, বলল মেয়ে খুঁজছি।
আজকাল আবার বাপ-মাকে মেয়ে খুঁজতে হল নাকি? নিজে খুঁজিসনি? হেসে জিজ্ঞাসা করল বাদল। গালে বিজিবিজি সাদা দাড়ি, মাথায় কয়েকগাছা সাদা চুল খাড়া হয়ে রয়েছে। শুকনো তোবড়ানো গালদুটো হাসির কারণে দুইপাশে সরতেই ভেতর থেকে দুই-তিনটে মাত্র কালচে দাঁত বেরিয়ে এল। বাকি কটা আর নেই। মুখে ছোপছোপ কালো দাগ।
তপতী বলল নাহ তার অফিস ছাড়া আর কোনও কিছুরই সময় নেই।
নরেনদার খুব শখ ছিল ছেলের ধুমধাম করে বিয়ে দেওয়ার। বারবার বলত সেই কথা। মেনুও ঠিক করে ফেলেছিল। ডায়েরিতে লেখা ছিল সেই মেনু। যাক বিয়ে করলে চেষ্টা করিস সেই মেনু রাখতে নরেনদা খুশি হবে।
অপুর আবার মনে পড়ল বাবার মুখটা। শেষদিকের সেই যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখটা। সারাজীবন হাসিখুশি আমুদে মানুষটার জন্য শেষ দুটো বছর যে কী অভিশপ্ত হয়ে উঠেছিল। চলে যাওয়ার দিন সাতেক আগের এক রাতের কথা বার বার মনে পড়ে। অপু তখনও চাকরি পায়নি। সারাদিন টিউশন করে আর চাকরির অ্যাপ্লিকেশন করে চলে। একদিন রাত দশটা নাগাদ রাতের খাবার খেয়ে নিজের ঘরে ঢুকে ক্লান্ত শরীরে বিছানায় সবে গা এলিয়েছে অপু, মা এসে বলল দেখো তো বাবা ডাকছে।
কেন? সামান্য বিরক্তই হয়ে উঠেছিল ও।
দেখো না, কী যেন বলবে তোকে। আমি বলেছিলাম তুই ক্লান্ত…
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অপু বলেছিল আচ্ছা যাচ্ছি। বাবা যে ঘরের বিছানায় প্রায় মিশে গিয়ে সারাদিন শুয়ে থাকত সেখানে গিয়ে টাঙানো মশারির সামনে জিজ্ঞাসা করেছিল, বলো কী বলছ?
মশারির ভেতর থেকে ঠান্ডা হাতটা ধরেছিল। বাবার হাত কাঁপছিল অল্প অল্প। কী হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ লাগছে?
আমি মরতে চাই না অপু। মশারির ভেতরের আবছা বাবা ফুঁপিয়ে উঠেছিল সেই রাতে।
উফফ কেন যে…কেন যে সেই অসহ্য দৃশ্যগুলো বার বার মনে পড়ে।
অপু ঝুঁকল বাদলজেঠুকে প্রণাম করার জন্য। ময়লা, বহু পুরোনো সাদাটে একটা পায়জামার নিচে শীর্ণ দুটো পায়ের পাতা। আঙুলে বিশ্রি বড়বড় ট্যারাব্যাকা নখ। হাত ছুঁয়ে প্রণাম করতে একটু ঘেন্নাই লাগল অপুর। বাবা যতদিন অসুস্থ ছিল, যখন আর নিজের পরিচর্যা করতে একেবারেই পারত না তখনও কিন্তু এক বেলার জন্যও এমন নোংরা হয়ে ওঠেনি। তার কারণ অবশ্যই মা। বাবা যেদিন বিকেলে চলে গেল সেদিন সকালেও মা যত্ন করে বাবার পায়ের নখ কেটে দিয়েছিল নেলকাটার দিয়ে।
লম্বা একটা শ্বাস ছাড়ল অপু। আবার ভালো করে তাকাল বাদলজেঠুর দিকে। যেভাবে শ্বাস নিচ্ছে তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আর বেশিদিন আয়ু নেই। বেশিদিন কেন বেশিক্ষণও না থাকতে পারে।
বস, তোকে কতদিন দেখি না, একটু কথা বলি।
ওর এখন বসার সময় নেই বাদলদা। অফিস রয়েছে। দেরি হয়ে যাবে। বলল তপতী।
অহ আচ্ছা যা, আমি আছি…আমি আছি…কয়েকবার বলল বাদল।
অপু সরে এসে মাকে ইশারায় ডাকল। তপতী কাছে আসতেই অপু নীচু গলায় বলল মা আমি কিন্তু এর অবস্থা খুব সুবিধার বুঝছি না। কঠিন কোনও অসুখ হয়েছে। একেবারে শেষ অবস্থা।
তপতী বলল, হ্যাঁ দেখে চেনা যাচ্ছে না। কী শৌখিন মানুষ ছিল আর কী…তুই আর দেরি করিস না, যা।
ট্রেনে যেতে যেতে পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ছিল অপুর। সেইসব দিনগুলো। ঠাকুর্দাকে ও চোখে দেখেনি, কিন্তু বাবার আমলে বাড়িতে রাধাগোবিন্দের দোল উৎসব হত। প্যান্ডেল, উদয়অস্ত নামকীর্তন, ভোগারতি, কর্পূর, ধূপ-ধুনোর গন্ধ, সঙ্গে মাইকে শ্রীটুল হারমোনিয়াম, বেহালা, কর্তাল আর লীলাকীর্তনের পদ…আহা সেইসব দিনগুলো। এই সাতাশ বছরের জীবনে অন্তত পনেরো-ষোলো বছর পর্যন্ত এমন ধুমধাম উৎসব নিজের বাড়িতে দেখেছে অপু। বাবা অসুস্থ হওয়ার বছর কয়েক আগে থেকে অবশ্য উৎসবের জাঁকজমকে একটু ভাটা পড়েছিল, কারণ বাবা এত পরিশ্রম করে উঠতে পারছিল না। আসলে শরীর যে তার ভেতরে ভেতরে খারাপ হতে শুরু করেছে সেটা একেবারে শেষবেলা পর্যন্ত গোপন রাখার চেষ্টা করেছিল।
বাবার বন্ধু মানেই ছিল কীর্তন, কৃষ্ণনামগানের বন্ধু। নারায়ণ জেঠু, প্রদীপকাকা, মানিক জেঠু, প্রিয়লালজেঠু, ভদ্রেশ্বর জেঠু আরও অনেক অনেক বন্ধু ছিল বাবার। এরা কেউ গাইতে পারত কেউ বা বাজাত হারমোনিয়াম বা শ্রীখোল অথবা আড়বাঁশি। বাদলজেঠুর উপস্থিতিটা সবথেকে বেশি নজরকাড়া। একেবারে বাবুয়ানি মেজাজ ছিল জেঠুর। মাইনে করা রিকশাওলা ছিল। তা রিকশাওলার নাম ছিল তপন। চাটগাঁ-র বাঙাল বাদলজেঠুর কথাবার্তার মধ্যে সেই টোন ছিল। রিকশা যখন এসে নামত অপুদের বাড়ির সামনে অপু দেখত ধপধপে সাদা পাঞ্জাবি আর চোস্তা পরে বাদলজেঠু নামছে। দামি পাতলা ফিনফিনে সুতির কাপড়ের সেই পাঞ্জাবির দুই হাতায় গিলে করা। গলায় নীল সুতোর কাজ, গা থেকে ভুর ভুর করে চন্দনের গন্ধ বেরোচ্ছে। পাঞ্জাবিতে সোনার বোতাম, গলায় সরু সোনার চেন, গোল্ডেন ফ্রেম চশমা। কলপ করা কুচকুচে কালো চুল পরিপাটি ব্যাকব্র্যাশ। ঘিয়ে রঙের কোলাপুরি চটি। বাদল জেঠু ধীরে-সুস্থে বাড়িতে ঢুকত তার একহাতে ধরা থাকত দই বা মিষ্টির বড় হাঁড়ি অন্যহাতে ফিলটার উইলস। জেঠুকে দেখলেই মন খুশি হয়ে উঠত অপুর। কারণ তিনি যখনই আসতেন অপুর জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসতেন। কখনও চকোলেট, কখনও শোনপাপড়ি অথবা ক্রিম বিস্কুটের প্যাকেট। এসেই ডাক দিতেন কই আমার বাবা কই?
হাফপ্যান্ট অপু সঙ্গে সঙ্গে এসে দাঁড়াত জেঠুর গা ঘেঁষে, সিগারেট আর চন্দন মেশানো একটা অপূর্ব গন্ধ! পাঞ্জাবির পকেট থেকে জেঠু বার করে দিত অপুর জন্য আনা জিনিসটা। তারপর বলত যা মাকে বল গিয়ে ভালো করে চা বানাতে।
খুব সুন্দর গানের গলা ছিল বাদলজেঠুর। হারমোনিয়াম নিয়ে মাইকে যখন কৃষ্ণওও…বলে সুর বসাত শ্রোতারা আহা করে উঠতেন। গাইতে গাইতে ভাবের ঘোরে জেঠুর দুইচোখ দিয়ে জল গড়াত। আর অপুর কষ্ট হত, ভাবত জেঠুর এত কষ্ট কেন? অবশ্য গানের সময় শুধু বাদলজেঠু নয় কখনও বাবাও কাঁদত ফুঁপিয়ে। কাঁদত আর গাইত। প্রতিবছর দুর্গাপুজোর কয়েকদিন আগে জেঠু এসে মাকে একটা শাড়ি দিয়ে বলত বউদি দেখুন পছন্দ হয় কি না। মা হাসিমুখে বলত, খুব সুন্দর। বাবার থেকে কম করে বছর সাত-আষ্টেকের বড় বাদলজেঠু। অপু অনেকবার শুনেছে, কখনও বাবা কিংবা মা বাদলজেঠুকে বলছে বাদলদা এবার আর বাছাবাছি করবেন না, বিয়েটা করে ফেলুন। অনেক বয়স হল কিন্তু। এখন যাও বা সম্বন্ধ আসছে এরপর কিন্তু আর পাবেন না। আপনার দাদা-বউদিদেরও তো বয়স হচ্ছে তারা আর ক’দিন দুইবেলা খাওয়াবে আপনাকে?
বাদলজেঠু সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে বলত না না এই বছর এক্কেবারে ফাইনাল। ঘটককে বলেছি একটু যেন গায়ের রংটা ফর্সা হয়, আর মুখটা যেন…বউদি বিয়ে ফাইনাল হলে আপনাকে একটা ভালো শাড়ি দেব। একটু রাধাগোবিন্দকে বলুন যেন এবার হয়ে যায়।
এমনই সহজ মন ছিল বাদলজেঠুর। নাহ বিয়ে শেষপর্যন্ত আর হয়নি। মেয়ে খুঁজতে খুঁজতে তার খোঁজার বয়সও পেরিয়ে গিয়েছিল। বাবার কাছে অপু জেনেছিল বাদলজেঠুর খরচের হাত যত দরাজ ছিল রোজগারে তেমন মন ছিল না। পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ আর নিজে টুকটাক বিজনেস, সেই বিজনেসেরও কোনও ঠিক ঠিকানা নেই কখনও ইমারতি কখনও কীর্তনের দল আবার কখনও মাছ ধরার ট্রলার ভাড়া নেওয়া। মন কোনও কিছুতেই স্থির না থাকার কারণে প্রতিটা বিজনেসেই লস। পকেটে টাকা থাকলেই দেদার খরচ আর শেষ হলেই ধারদেনা করতেও পিছত না। তিন ভাইয়ের যৌথ পরিবার। বাদলজেঠুই কনিষ্ঠ। বিয়ে-থা না করায় দুই দাদার ঘরেই দুইবেলা আহার। তবে সম্পর্ক তিক্ত হচ্ছিল দিনে দিনে। মাঝে মাঝে অপু শুনত বাদলজেঠু খুব আফসোস করে বাবা আর মাকে বলছে বুঝলেন এই বাড়িতে আর থাকতে ইচ্ছে করে না। আমার দুটো দাদাই হাড়ে বজ্জাত।
বাবা যখন অসুস্থ হয়ে পড়ল তখনও মাঝে মাঝে বাদলজেঠু আসত বাবাকে দেখতে। হাতে ফলের প্যাকেট। তবে বাবা চলে যাওয়ার পর ওর আসাও কমে গেছিল। শুধু ওর নয়, বাবার বন্ধুরা আর কেউই তেমন আসত না। উৎসবগুলো সবই একে একে বন্ধ হয়ে গেল। কে করবে?
শেষবার বাদলজেঠু সেদিন বাড়িতে এসেছিল সেটাও কম করে বছর চারেক আগে হবে। সেবারও দেখা হয়েছিল অপুর সঙ্গে। চেহারা বেশভুষা সেবারেও যথেষ্ট মলিন ছিল কিন্তু তবু এবারের মতো নয়। এমন অবস্থা কী করে হল কে জানে…!
রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বাড়ি ফিরতেই রীতিমতো চমকে গেল অপু। মা দরজা খুলতে খুলতে নিচু গলায় বলল একটা কাণ্ড হয়েছে।
কী?
বাদলদা যায়নি। রয়ে গেছে।
মানে! জুতোটা খোলার আগেই থমকে গেল অপু। কেন যায়নি?
জানি না। প্রথমে বলল দুপুরে ভোগ খাবে। না তো বলতে পারি না। ঠিক এই কটা ভাত আর সামান্য তরকারি মুখে দিলেন। কোনওকালেই বেশি খেতেন না। এখন একেবারে পাখির আহার। খেয়ে উঠে বললেন বুঝলেন বউদি আমি কটা দিন এখানে থাকব। সাতটা দিন আমি একটু থেকে তারপর চলে যাব।
মানেটা কী? তুমি রাজি হয়ে গেলে? বিরক্ত হয়ে উঠল অপু।
আরে আমি বললাম আপনার শরীর এমন অসুস্থ এখানে কে দেখাশোনা করবে? তো বললেন আমাকে কোথাও কেউ দেখার নেই বউদি। কিচ্ছু দেখাশোনা করতে হবে না। আমাকে ওই সকালে আর বিকেলে এককাপ করে চা দেবেন। দুপুরে একটু ভাত আর রাতে বাতাসা দিয়ে একটু মুড়ি ব্যস। বলে তোর বাবার ঘরে শুয়ে পড়ল।
বাহ শুয়ে পড়ল আর তুমি কিছু বললে না! বিরক্ত হয়ে উঠল অপু। কী অবস্থা দেখেছ চেহারার? আজ আছে কাল নেই অবস্থা। শরীরে কী রোগ ধরেছে কেউ জানি না, কেন এতদিন পর আচমকা এসেছে তাও জানা নেই।
তপতী বলল আসলে কী করে বলি বলতো চলে যান? ভালো করে কথা পর্যন্ত বলতে পারে না এমন শ্বাসকষ্ট। সন্ধেবেলা এইটুকু মুড়ি দিয়েছিলেন তাও পুরোটা খেতে পারেনি। সারাদিন ধরেই শুয়ে রয়েছে।
তোমাকেও বলিহারি! ধরো আজ রাতেই যদি মরে যায় তখন সেই ঝামেলা কে পোহাবে? দেখে মনে তো হয় না আর সাতকুলে কেউ রয়েছে বলে। তখন কোথায় দৌড়ব আমি?
তপতী কী বলবে বুঝতে না পেরে হাঁ করে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, না না মরবে কেন? অত খারাপও নয়, তাহলে নিজে নিজে এলেন কী করে…বলেই একটু থামল তারপর যেন নিজের মনেই বলল, সন্ধেবেলায় যখন যখন চা দিলাম আমাকে বললেন, বুঝলেন বউদি নরেনদার বড় সৌভাগ্য রাধাগোবিন্দের চরণের কাছে নিজের প্রাণটা গিয়েছে। আহা আমারও যদি নরেনদার মতো ভাগ্য হত…
মা তুমি এই শোনার পরেও থাকতে দিলে! প্রায় আর্তনাদ করে উঠল অপু। এবার বুঝতে পেরেছ তো ওর এখানে আসার কারণ? এখানে মরতেই এসেছে। সকালে চেহারা দেখেই বুঝেছি ঘরবাড়িও গেছে, কিচ্ছু নেই। হায় ভগবান!
দাঁড়া দাঁড়া তুই অত অস্থির হস না। আমার মনে হয় না এসব কিছু…খারাপও লাগে অপু। একসময় কী ছিলেন মানুষটা। তোর বাবাকে খুব ভালোবাসতেন।
মা এখন এসব ভেবে লাভ নেই। বরং এটা ভাব যদি কিছু একটা হয়ে যায়…
আরে বার বার একই কথা বলছিস! দুম করে কি কেউ মরে যায়? দেখছিস তো কথা বলছে, হাঁটছে…
যদি নিজে নিজে মরতে চায়? এতক্ষণ ধরে মাথার ভেতরে ঘুরপাক খেতে থাকা কথাটা মাকে বলেই ফেলল অপু।
ছেলের কথা শুনে কেমন যেন চমকে উঠল তপতী। কী বলছিস?
খুব ভুল কি বলছি? এমন সম্ভাবনা কি থাকছে না?
তপতী এবার আর কিছু বলার মতো খুঁজে পেলেন না। বরং ছেলের যুক্তির কাছে হেরে গিয়ে অসহায়ভাবে বললেন দেখ কী করবি। তুই কথা বল। তবে…আজ রাত্তিরটা ছেড়ে দে। এত রাতে কোথায় যাবে বল?
অপু। কিছু বলল না। নিজের ঘরে ঢুকে জামাকাপড় ছেড়ে আগেই সোজা গেল বাদলজেঠু যে ঘরে শুয়ে রয়েছে সেখানে। জেঠু বাবার খাটটায় চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে। পরনে একটা হলদেটে হয়ে যাওয়া স্যান্ডো গেঞ্জি। আর লুংগি। মানে এই দুটো জিনিস ওর সঙ্গেই ছিল। চেহারাটা বিছানায় মিশে গিয়েছে। অপু একবার মনে করার চেষ্টা করল বাবার চেহারা কি শেষ দিকে এতটাই খারাপ হয়েছিল? না বোধহয়। হলেও অন্তত এর মতো হতভাগ্য ছিল না বাবা।
বাদলজেঠু চিত হয়ে শুয়ে পা নাচাচ্ছে। চোখ বন্ধ এবং হাতদুটো বুকের ওপরে জড়ো করা। বিছানার পাশে রাখা জলের বোতল, গ্লাস, খালি চায়ের কাপ প্লেটের ওপর রাখা।
জেঠু ঘুমোচ্ছে? জিজ্ঞাসা করল অপু।
চোখ মেলল বাদল। অপুর দিকে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে তারপর বলল না না ঘুম কই? বোস। অফিস থেকে কখন এলি?
এই একটু আগে।
চা খেয়েছিস?
না খাব। বলেই অপু সরাসরি জিজ্ঞাসা করল তুমি আজ বাড়ি ফিরলে না?
নাহ বউদিকে বলেছি এখানে কটাদিন থাকব। তারপর ফিরব।
তুমি কি ওই পুরোনো বাড়িতেই থাক?
না না সেসব কবে চলে গেছে এখন…ওই থাকি…
অপু যা বোঝার বুঝে নিল। বলল কিন্তু জেঠু আমি তো মাকে নিয়ে কাল সকালে বেরোবো। মামাবাড়ি মানে বর্ধমানে যাব কয়েকদিনের জন্য। মা তোমাকে কিছু বলেনি?
নাহ বউদি কিছু…
মা…ও মা…
তপতী বাইরেই দাঁড়িয়েছিল। অপুর ডাক শুনে ঘরে এসে বলল, কী বলছিস?
তুমি জেঠুকে বলোনি তোমাকে নিয়ে কাল বর্ধমানে যাব।
কই…আমাকে…
আরে তোমাকে বলেছিলাম না কয়েকদিন আগে? ভুলে গেছ? বলতে বলতে মাকে চোখ টিপে ইশারা করল অপু।
ও হ্যাঁ বলেছিলি না…তাই তো…কোনওমতে কথাগুলো বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল তপতী। অপু বাকিটা ট্যাকল করল, জেঠু, তুমি এক কাজ কোরো তাহলে কাল সকালে চলে যেও। আমরা ফিরে আসি তারপর আবার নাহয় এসে কয়েকদিন থেকে যেও কেমন…আসলে ওখানে বলা রয়েছে।
চলে যাব? আমি যে কয়েকটা দিন…
আসলে তুমি তো কিছু বলেও আসোনি। আমাদের কাল যেতেই হবে, খুব দরকার রয়েছে…মিথ্যে কথাগুলো বলতে সত্যিই খারাপ লাগছিল অপুর। আজ সারাদিন ধরে পুরোনো জীবনের ছোটছোট মুহূর্তগুলো মনে এসেছে ওর। অনেকদিন পর স্মৃতির টুকরোগুলো নাড়াচাড়া করতে বড় ভালো লেগেছে কিন্তু স্মৃতি-ভাবনা আর বাস্তবে বড় ফারাক।
তুমি তাহলে কাল সকালে চা-টা খেয়েই যেও। বলতে বলতে অপু দেখছিল বাদলের আশেপাশে কোনও ওষুধের স্ট্রিপ বা ব্লেড ইত্যাদি কিছু রয়েছে কি না। নাহ কিছুই নেই।
আচ্ছা…। চলে যাব তাহলে। শান্তভাবে উত্তর দিল বাদল। তারপর আবার চোখ বুজে ফেলল।
অপু ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল মা রান্নাঘরে। হাঁড়ি থেকে গরম ভাত ঢালছে নতুন একটা থালায়। অপু কিছু বলার জন্য একবার থামল তারপর কিছু না বলেই ঘর পেরিয়ে চলে গেল।
সকাল সাতটা নাগাদ রোজ ঘুম থেকে ওঠে অপু। আজও উঠল। ওঠামাত্রই মনে পড়ল বাদলজেঠুর কথা। মনে পড়তেই বুকের ভেতরটা গুরগুর করে উঠল। ধড়মড় করে উঠে ওই ঘরে দেখতে দেখতে যেতে গিয়ে দেখল পাশের ঘরে মা স্টিলের আলমারি খুলে বসেছে। এই সকালে জামা কাপড়ের আলমারি খুলে মা কী করছে?
মা। ডাকল অপু।
উঁ মুখ না ফিরিয়েই উত্তর দিল তপতী। তারপর শুধু বলল, দেখেছি, ঠিক আছে। একটু পরে চা দেব। চা খেয়ে চলে যাবে বলেছেন। তুই চিন্তা করিস না। মায়ের গলা যেন সামান্য ভারি।
শুনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হল অপু। তারপর আবার জিজ্ঞাসা করল তুমি সকালে আলমারি খুলে কী করছ?
খুঁজছি। আলমারির ভেতরে হাত ঢুকিয়ে জামাকাপড়ের স্তূপের মধ্যে কী যেন খুব মনোযোগ দিয়ে খুঁজছিল তপতী…। কোথায় যে গেল…এখানেই তো ছিল… নিজের মনেই বলতে বলতে আবার বলে উঠল এই তো এতক্ষণে পেয়েছি…বাব্বাহ! বলে স্বস্তির শ্বাস ফেলল তপতী।
কী ব্যাপার বলো তো। কী পেলে?
তপতী উত্তর না দিয়ে শুধু বলল রান্নাঘরে চা-টা বসানো রয়েছে একটু ছেঁকে নিবি। তুই তোরটা শুধু নিয়ে নে, আমি আমার আর বাদলদারটা নিয়ে নেব।
হুঁ বলে রান্নাঘরের দিকে এগোল অপু।
প্রায় আধঘণ্টা পরে অপু দেখল বাদলজেঠু তৈরি হয়ে বেরোচ্ছে। ঠাকুরঘরের সামনে এসে রাধাগোবিন্দকে সাষ্টাঙ্গে প্রমাণ করল, সম্বল বলতে একটা ছোট পুরোনো প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ। ওর মধ্যে গতকালকের লুংগি আর একটা গামছা। প্রণাম সেরে মেঝেতে দেওয়ালে ভর দিয়ে কোনওমতে উঠে দাঁড়াল। মা এসে সামনে দাঁড়িয়েছে।
বউদি চলি তাহলে ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলল বাদল জেঠু।
একটু দাঁড়ান বাদলদা। অপুর বাবা খুব শখ করে এই তসরের পাঞ্জাবিটা বানিয়েছিল। পরতে পারেনি, অপু তো পাঞ্জাবি পরে না। আপনি পরবেন? নিন এটা। বলে হাতে ধরা একটা পাট করা গোলগলা পাঞ্জাবি বাদলজেঠুর দিকে এগিয়ে দিল মা।
আমাকে দিচ্ছেন? আবার কোঁচকানো গালে টান দিয়ে হাসল বাদল জেঠু। চোখদুটো জুলজুল করে উঠল উটকো আনন্দে। হাতের প্লাস্টিকটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে পরম যত্নে দুই হাত বাড়িয়ে পাঞ্জাবিটা নিয়ে বড় আদরে দেখল তারপর বলল পরেই নিই কী বলেন?
হ্যাঁ যা ইচ্ছে আপনার।
ওখানে দাঁড়িয়েই নিজের গায়ের ময়লা কোঁচকানো প্রাচীন পাঞ্জাবিটা গা থেকে ছেড়ে শতচ্ছিন্ন স্যান্ডেগেঞ্জির ওপর ওই নতুন ঝকঝকে ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবিটা পরল বাদলজেঠু। পাঞ্জাবি পরতে গিয়েও যেন হাঁফিয়ে উঠল। তারপর পুরোনো পাঞ্জাবিটা পাকিয়ে প্লাস্টিকে ভরে নিয়ে বলল, চলি বউদি। আসি রে অপু, মাকে সাবধানে নিয়ে যাস। বারান্দার নিচে রাখা অর্ধেক ক্ষয়ে যাওয়া চটিতে পা গলিয়ে খুব ধীরে ধীরে পা ফেলে এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল বাদলজেঠু। অপু আর তপতী দুজনেই চুপ করে তাকিয়ে থাকল যতক্ষণ না সেই পাঞ্জাবিটা ওদের দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।