লিফটের সামনে বিরাট লাইন। পাশাপাশি দুটো লিফট, কিন্তু একটার বুকে আউট অফ অর্ডার-এর লকেট ঝোলানো। ফলে লাইন লম্বা হয়েছে। স্বপ্নেন্দু রুমালে মুখ মুছতে মুছতে গেট পেরিয়ে থমকে দাঁড়াল। যাঃ শালা!
এখন ঘড়িতে এগারোটা বাজতে দশ। পৌনে এগারোটায় মিসেস বক্সী দেখা করতে বলেছেন। অলরেডি পাঁচ মিনিট লেট! যেভাবে বাসে ঝুলে আসতে হয়েছে তাতে আটতলায় হেঁটে ওঠা অসম্ভব ব্যাপার। সে চোখ বুলিয়ে লাইনের লোক গুনতে লাগল। আটজনের বেশি যদি না হয় তাহলে তার সুযোগ আসবে চতুর্থ দলে। কী করা যায় বুঝে উঠছিল না স্বপ্নেন্দু। এই সময় ইন্দ্রিয় লাফিয়ে উঠল। হেনা সেন! মুহূর্তেই এই একতলাটা যেন বিয়েবাড়ি হয়ে গেল। হেনা সেন ধীরে সুস্থে লাইনের শেষে দাঁড়াতেই স্বপ্নেন্দু চট করে তার পেছনে দাঁড়াল!
হেনা সেন এই আটতলা অফিসের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা। সুন্দরী বললে কম বলা হবে, মহিলার শরীরে যেন ঈশ্বর মেপে মেপে জাদু মাখিয়ে দিয়েছেন। অমন সুন্দর গড়নের বুক এবং নিতম্ব এবং তার সঙ্গে মেলানো অনেকটা উন্মুক্ত কোমর দেখলেই কলজেটা স্থির হয়ে যায়, মহিলা যখন কথা বলেন তখন আফসোস হয়, কেন শেষ হল। হেনা সেনের সঙ্গে স্বপ্নেন্দুর আলাপ নেই। এতদিন হেনা বসত তিনতলায়। সেখানকার বড় অফিসারের সঙ্গে কী একটা গোলমাল হয়ে যাওয়ায় ট্রান্সফার নিয়ে গত পরশু আটতলায় এসেছেন। পদমর্যাদায় স্বপ্নেন্দু অনেক ওপরে কিন্তু এই বাড়িতে হেনাকে চেনে না এমন কেউ নেই, কিন্তু তাকে?
স্বপ্নেন্দু বাতাসে অসম্ভব মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছিল। সেটা যে সামনের শরীরটা থেকে আসছে তা অন্ধও বলে দিতে পারবে। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে জামার কলার ঠিক করল। মুখটা অকারণে রুমালে মুছল। যদিও হেনা সেনের চোখ এখন লিফটের দিকে তবু সে নিজেকে স্মার্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। মহিলার মাখনরঙা ভরাট পিঠ আর ঘাড় দেখে স্বপ্নেন্দুর মনে হল ওর শরীরে যেন অজস্র ফগ চাপ বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুর্ধর্ষ! লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন না ফুলের বাগানে— ভঙ্গি দেখলে ঠাওর করা মুশকিল। এখনও পর্যন্ত এই অফিসের কোনও রাঘব বোয়াল ওঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। মহিলার নাকি আত্মসম্মান বোধ খুব।
স্বপ্নেন্দু মিসেস বক্সীর মুখটা মনে করল। আজ ঠিক চিবিয়ে খাবে তাকে। আটতলার সুপ্রিম বস মিসেস বক্সী। পাঁচ ফুটি ফুটবল। গায়ের রঙ অসম্ভব ফরসা কিন্তু শরীরে কোনও খাঁজ নেই, মুখটা বাতাবি লেবুর কাছাকাছি। সেই মুখে সিগারেট গুঁজে ইংরাজিতে ধমকান। জরুরি মিটিং ছিল। হেনা সেনের কোমরের দিকে তাকিয়ে স্বপ্নেন্দু বলল, থাক মিটিং। লিফটে লাইন পড়লে সে কী করবে। সঙ্গে সঙ্গে তার খেয়াল হল। মিসেস বক্সী ইচ্ছে করলে তাকে বদলি করে দিতে পারেন।
স্বপ্নেন্দু ঠোঁট কামড়াল। ঠিক সেই সময় হেনা সেন পেছন ফিরে তাকালেন। স্বপ্নেন্দু হাসবার চেষ্টা করল। আহা, কি বুক। হেনা সেন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি কিছু বললেন?’
‘আমি? না তো।’ কলজেটা যেন লাফে গলায় উঠে এসেছে।
‘মনে হল!’ হেনা সেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন।
‘না! মানে এই লাইনটার কথা ভাবছিলাম।’ স্বপ্নেন্দুর খেয়াল হল মিসেস বক্সীর বিরুদ্ধে জেহাদটা বোধহয় কিছুটা ঠোঁট ফসকে বেরিয়েছে।
‘লাইন? লাইনের কথা কেউ আবার শব্দ করে ভাবে নাকি?’ হেনা সেন ততক্ষণে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। স্বপ্নেন্দুর খুব ইচ্ছে করছিল কথা বলতে। তার পেছনে এখন আরও দশ-বারো জন দাঁড়িয়ে গিয়েছে।
সে বলল, ‘আপনি তো আটতলায় এসেছেন।’
‘হ্যাঁ। আমি ওখানকার ডি.ও। আমার নাম স্বপ্নেন্দু সোম।’
‘স্বপ্নেন্দু? বেশ সুন্দর নাম তো?’
কথাগুলো তার মুখের দিকে না তাকিয়ে বলা। তবু স্বপ্নেন্দুর মনে হল তার নামটাকে এমন সুন্দর করে আজ পর্যন্ত কেউ উচ্চারণ করেনি। লাইনটা টুকটুক করে এগোচ্ছিল মাঝে মাঝে। এবারে ওদের সুযোগ এসে গেল। হেনা সেনের হাঁটা দেখে স্বপ্নেন্দুর মনে হল দুটো জমাট ঢেউ পাশাপাশি দুলে গেল। লিফটে জায়গা ভরাট। হেনা সেন ওঠার পর লিফটম্যান দরজা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছে দেখে স্বপ্নেন্দু একচিলতে জায়গায় পা রেখে শরীরকে সেঁধিয়ে দিল। ফলে তাকে এমনভাবে দাঁড়াতে হল যে হেনা সেনের শরীরের অনেকটাই তার শরীরে ঠেকেছে। এত নরম আর এত মধুর কিন্তু এত তার দাহিকাশক্তি যে স্বপ্নেন্দুর মনে হল সে মরে যাবে। আর এই লিফটটা যদি অনন্তকাল চলত। যদি আটতলা ছাড়িয়ে একশ আটতলায় উঠে যেত। কিংবা এই মুহূর্তে লোডশেডিং-ও তো হতে পারত। মাঝামাঝি একটা জায়গায় লিফটটাকে বেশ কয়েক ঘণ্টা আটকে থাকতে হত তাহলে। কিন্তু এসোব কিছুই হল না। বিভিন্ন তলায় যত লোক নামছে তত হেনা সেনের সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়ছে। সাততলায় যখন লিফট, তখন একহাত ব্যবধান।
স্বপ্নেন্দুর মনে হল তার শরীরে যেন হেনা সেনের বিলিতি গন্ধ কিছুটা মাখামাখি হয়েছে। সে গাঢ় গলায় বলল, ‘যদি কোনও প্রয়োজন হয় তাহলে আমাকে বলবেন মিস সেন।’
‘ওমা আমাকে আপনি জানেন?’
‘চিনি কিন্তু জানি না।’ কথাটা খুব নাটকীয় ভঙ্গিতে বলতেই লিফটের দরজা খুলে গেল। হেনা সেন এমন অপাঙ্গে তাকালেন যে স্বপ্নেন্দু রুমাল মুখে তুলল।
দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতেই হরিমাধব ছুটে এল, ‘আপনাকে ম্যাডাম আধঘণ্টা ধরে খুঁজছেন। খুব খেপে গেছেন।’
‘খেপে গেছেন?’
‘হ্যাঁ। ইংরেজিতে গালাগাল দিচ্ছিলেন একা বসে।’
স্বপ্নেন্দু দেখল চলে যেতে যেতে হেনা সেন আবার অপাঙ্গে তাকালেন। কিন্তু এবার তার ঠোঁটে যে হাসি ঝোলানো তার মানেটা বড় স্পষ্ট। মনে মনে হরিমাধবের ওপর প্রচণ্ড চটে গেল স্বপ্নেন্দু। একদম প্রেসটিজ পাংচার করে দিল বুড়োটা। সে গম্ভীর মুখে নিজের ঘরে এসে বসল।
এই অফিসে সে দুই নম্বর। তার নিচে অন্তত আশিজন কর্মচারী। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ অবস্থা তার। ওপর তলা কারণে অকারণে তাকে ধমকাচ্ছে আবার নিচের তলার লোকজন সুযোগ পেলেই চোখ রাঙিয়ে যায়। নিচের তলার কর্মচারীদের ইউনিয়ন আছে। সে না ঘাটকা না ঘরকা। হরিমাধবকে ডেকে এক গ্লাস জল দিতে বলে স্বপ্নেন্দু ট্রান্সফার অ্যাণ্ড পোস্টিং-এর ফাইলটা খুলে বসল। হেনা সেনকে দেওয়া হয়েছে স্ট্যটিসটিকে। কোনও কাজ নেই সেখানে। মাসে দুবার রিপোর্ট পাঠালেই চলে। তাছাড়া বুড়ো হালদার আছে চার্জে। লোকটা কাজ পাগল মানুষ। ওর সেকশনের সবাই ওর কাঁধে কাজ চাপিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এই অফিসে একটা কথা চালু আছে। স্ট্যটিসটিক হল পানিশমেণ্ট সেল। কোনও পার্টি ওই টেবিলে কোনদিন যাবে না। সবাই পোস্টিং চায় সেকশনে। হেনা সেনকে ইচ্ছে করেই স্ট্যাটিসটিকে দেওয়া হয়েছে। মিসেস বক্সীর কাণ্ড এটা। এই সময় টেলিফোন বাজল।
‘সোম স্পিকিং।’
‘হোয়াট ডু য়ু ওয়াণ্ট?’ মিসেস বক্সীর গলা।
‘মানে?’
‘কাম শার্প। এক্ষুণি আসুন।’
জলটা খেয়ে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল স্বপ্নেন্দু। পকেট থেকে চিরুনি বের করে চুলে বুলিয়ে নিল। তারপর দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
মিসেস বক্সীর ঘরটা বিশাল। কার্পেটে মোড়া। ঘোরানো চেয়ার এবং টেবিল ছাড়াও এক কোণে কালো ডেকচেয়ার রয়েছে বিশ্রাম নেবার জন্যে। দরজা খুলে ভিতরে পা দিতেই মিসেস বক্সীর মুখের সিগারেট দুলতে লাগল, ‘এই রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন অফিসার পেলে আপনি কী করতেন?’
‘মানে?’
‘আপনার কটায় আসার কথা ছিল?’
‘ট্র্যাফিক জ্যাম ছিল ম্যাডাম! তার ওপর লিফট খারাপ।’
‘এইসব সিলি বাহানা কেরানিরা দেয়। আপনি কি ডিমোশন চান?’
স্বপ্নেন্দু মাথা নিচু করল, ‘সরি, কিন্তু এটা অনিচ্ছাকৃত।’
‘আই অ্যাম ফেড আপ। আপনারা কী ভেবেছেন? এটা অফিস না অন্য কিছু? দশটায় অ্যাটেণ্ডেন্স। আমি সাড়ে দশটা পর্যন্ত প্রত্যেককে গ্রেস দিয়েছি। কিন্তু এগারোটায় অ্যাটেণ্ডেন্স টোয়েণ্টি পার্সেণ্ট। আপনি ডি. ও. হয়েও ঠিক সময়ে আসছেন না। এক্সপ্লেইন।’
‘আমি দুঃখিত।’
‘দ্যাটস দি অনলি ওয়ার্ড য়ু নো। দিস ইজ লাস্ট ওয়ার্নিং।’ সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে গুঁজে মিসেস বক্সী বললেন, ‘বসুন।’
চেয়ারটা টেনে সন্তর্পণে বসল স্বপ্নেন্দু। মহিলা চেয়ারে এমন ডুবে গেছেন যে শুধু মুখ আর বুকের অর্ধাংশ টেবিলের ওপর দৃশ্যমান। বুকের কোনও আদল নেই, যেন দুটো মাংসের তাল এক করে রাখা। স্বপ্নেন্দুর মনে চট করে হেনা সেনের শরীর ভেসে উঠল। মিসেস বক্সী এবার একটা ফাইল খুললেন, ‘আমার কাছে ক্রমাগত কমপ্লেন আসছে। এই অফিসে এখন ঘুষের ফেস্টিভ্যাল চলছে।’
‘ফেস্টিভ্যাল?’
‘ইয়েস। প্রকাশ্যে যখন ঘুষ নেওয়া হচ্ছে তখন ফেস্টিভ্যাল ছাড়া আর কি বলব? ডি. ও. হয়ে আপনি সেসব খবর জানেন?’
‘অনুমান করতে পারি।’
‘কোনও স্টেপ নিয়েছেন?’
‘স্পেসিফিক কমপ্লেন না থাকলে স্টেপ নেওয়া মুশকিল।’
‘বাট আই ওয়াণ্ট টু স্টপ ইট। তোমরা চাই চাই বলে ইউনিয়ন করবে আবার ঘুষ ছাড়া কোনও কাজ করবে না, এটা হতে পারে না। কী ভাবে স্টপ করা যায়?’
‘এটা খুব জটিল ব্যাপার। এই অফিস ব্যবসায়ীদের জরুরি ব্যাপার নিয়ে কাজ করে। বিভিন্ন সেকশনে তাদের আসতে হয়। দ্রুত কাজ কিংবা কিছু বিপদমুক্ত হবার জন্য তারা পয়সা খরচ করে। কেরানিদের যেটা হাতে নেই তার জন্যে অফিসাররা আছেন। দশজন অফিসার। তাঁরা যেসব কেস নিয়ে ডিল করেন সেখানে মোটা টাকার ব্যাপার। বেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আছে এ ব্যাপারে। অফিসাররা কখনও কমপ্লেন করে না তার অধস্তন কেরানি ঘুষ নিচ্ছে। এটা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সবার ধারণা যে কোনও কাজ করলেই পার্টিরা টাকা দিতে বাধ্য। এমন কি তার রুটিন ডিউটি করলেও।’
স্বপ্নেন্দু ডি. ও। অফিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, মাইনেপত্র এবং রিপোর্টস সঠিক রাখার দায়িত্ব তার ওপর। পার্টিদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। সে লক্ষ্য করেছে হরিমাধব তার পিওন হওয়ায় খুব অখুশি। প্রায়ই সে অনুরোধ করে বদলির জন্য। তার সমান মাইনের অফিসাররা গাড়িতে অফিসে আসেন, প্লেন ছাড়া বেড়াতে যান না। মনে মনে বেশ ঈর্ষা বোধ করে স্বপ্নেন্দু। কিন্তু এসোব করা যায় কী করে?
‘বোবা হয়ে থাকবেন না। ব্যাচেলাররা যে এমন—!’ কাঁধ নাচালেন মিসেস বক্সী। ‘কিছু বলুন।’
‘দেখুন।’ একটু কাশল স্বপ্নেন্দু। ‘এটা খুব জটিল ব্যাপার। অভ্যেসটা নিচ থেকে ওপরে সর্বত্র। কাকে বাদ দিয়ে কাকে ধরবেন।’
‘ওপর মানে?’
‘আমি শুনেছি অফিসাররাও একই দোষী।’
‘দ্যাটস নট আওয়ার বিজনেস। ওদের জন্যে আরও ওপরতলায় লোক আছেন। কিন্তু দশপাঁচ একশ টাকার হরির লুট বন্ধ করা ডি. ও. হিসেবে আপনার কর্তব্য।’
‘আমার?’
‘হ্যাঁ। আপনি অফিস বস।’
‘বলুন, কী করতে হবে?’
‘আপনি ট্রান্সফার করুন। আজকেই একটা লিস্ট দিন আমাকে। একটা সেকশনে যে ছমাস আছে তাকে স্ট্যাটিস্টিক কিংবা এস্টাব্লিশমেণ্টে পাঠিয়ে দিন। আর নোটিস বোর্ড ঝুলিয়ে দিন কোনও পার্টি অফিসের ভেতর ঢুকতে পারবে না। তাদের যদি কোনও প্রয়োজন থাকে তাহলে রেসপেকটিভ অফিসারের সঙ্গে দেখা করবে। প্রথমে এটা করুন তারপর দেখা যাবে।’ মিসেস বক্সী আবার সিগারেট ধরালেন। স্বপ্নেন্দু তখনও ইতস্তত করছিল, ‘এ নিয়ে খুব ঝামেলা হবে।’
‘ঝামেলা? চাকরিতে ঢোকার সময় তাদের কি বলা হয়েছিল যে যত ইচ্ছে ঘুষ নিতে পারবে? তাছাড়া আপনি ব্যাচেলার মানুষ, আপনার ভয় কীসের? বোল্ড হন মশাই, চিরকাল মিনমিন করে গেলে কোনও লাভ হবে না।’
নিজের ঘরে ফিরে এল স্বপ্নেন্দু। ব্যবস্থাটা তার ভাল লাগছিল না। সে নিজে কখনও ঘুষ নেয়নি। হয়ত ঘুষ নেবার বড় সুযোগ তার আসে নি বলে নেয়নি কিংবা এখনও মনে কিছু রুচি এবং নীতিবোধ কটকট করে বলে নেওয়ার প্রবৃত্তি হয় নি। কিন্তু এই হুকুমটা কার্যকর করতে গেলে ভিমরুলের চাকে ঘা পড়বে। তাছাড়া কেরানিদের চোখ রাঙাব আর অফিসারদের আদর করব, এ কেমন কথা।
ঠিক তখনই টেলিফোনটা শব্দ করল। ওপাশে তিন নম্বর অ্যাসেসমেণ্ট অফিসার মুখার্জি, ‘সোম। বক্সীর বাক্সের চাবিকাঠি তোমার হাতে, আমাকে উদ্ধার করো ভাই।’
‘কী হয়েছে?’
‘একটা মোর দ্যান লাখ কেসে ওঁর অ্যাপ্রুভাল দরকার ছিল। ফাইলটা চেপে রেখেছেন। একবার বলেছিলাম, কোনও কাজ হয়নি। পার্টি বলল উনি পঞ্চাশ চেয়েছেন, আমি অ্যাসেসমেণ্ট অফিসার, কষ্ট করে মাছ জালে ঢোকালাম উনি তার ঝোল খাবেন। বোঝো?’
‘দেখি।’ বলে রিসিভার নামিয়ে রাখল স্বপ্নেন্দু। মিসেস বক্সীর বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে এ ধরনের অভিযোগ হাওয়ায় ভাসে। পাঁচশো হাজার নয়, হঠাৎ বিশ পঁচিশের কারবারী উনি। পঞ্চাশ এই প্রথম শুনল স্বপ্নেন্দু। এখন সেই মহিলা তাকে নির্দেশ দিচ্ছেন দশ টাকা বিশ টাকা যারা নেয় তাদের থামাতে হবে।
হরিমাধবকে হুকুম করল সে, ‘বড়বাবুকে পাঠিয়ে দাও।’
বড়বাবু চাকলাদার খুব ভাল মানুষ। সাতে-পাঁচে থাকেন না। আর মাত্র তিনমাস বাকি আছে অবসরের। স্বপ্নন্দুর ধারণা লোকটা সৎ। ঘরে ঢোকামাত্র সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি ঘুষ নেন?’
হাঁ হয়ে গেলেন চাকলাদার। তারপর কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ‘নিতাম কিন্তু এখন নিই না।’
‘কেন নিতেন, কেন নেন না?’
চাকলাদার নুইয়ে পড়লেন, ‘তখন অভাবের তাড়নায় না নিয়ে পারিনি। কিন্তু ভিক্ষে নিচ্ছি বলে ঘেন্না হয়। তাছাড়া আজ বাদে কাল চলে যাব, এখন আর নোংরা হওয়ার প্রবৃত্তি হয় না।’
স্বপ্নেন্দু লোকটিকে দেখল। মনে হল মিথ্যে বলছেন না। তারপর নিচু গলায় বলল, ‘এই অফিসের যে সমস্ত কেরানির ঘুষ নেয় তাদের ট্রন্সফার করতে হবে। ম্যাডামের অর্ডার। আপনি লিস্ট করুন।’
‘সে তো ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে।’
‘হোক।’
‘আর তিন মাস আছি। কেন আমাকে বিপদে ফেলছেন স্যার।’
‘কেউ জানবে না। খুব গোপনে করুন। অর্ডারটা আমি এখানে টাইপ করাব না। যান।’
চাকলাদার চলে যেতে স্বপ্নেন্দু চোখ বন্ধ করল আর সঙ্গে সঙ্গে হেনা সেনের শরীরটা ভেসে উঠল। সে বিয়ে-থা করেনি। মাত্র তিরিশ বছর বয়স। সরাসরি অফিসার হয়ে ঢুকেছে পরীক্ষা দিয়ে। সামনে ব্রাইট ক্যারিয়ার। কিন্তু হেনা সেন তাকে গুলিয়ে দিল। মহিলার মধ্যে অদ্ভুত মাদকতা আছে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে সে আবার হরিমাধবকে ডাকল, ‘শোন স্ট্যটিস্টিক থেকে মিস সেনকে ডেকে আনো।’
‘উনি এখন অফিসে নেই স্যার।’
‘নেই? তুমি জানলে কী করে?’
‘উনি যে এসেই ক্যাণ্টিনে যান বিশ্রাম করতে।’
স্বপ্নেন্দু অবাক হয়ে গেল। আচ্ছা ফাঁকিবাজ মহিলা তো! সে বিরক্ত গলায় বলল, ‘ক্যাণ্টিন তো এই বাড়িতেই। সেখান থেকে ডেকে নিয়ে এসো।’
হরিমাধব চলে যাওয়ার পর স্বপ্নেন্দুর মনে হল না ডাকলেই হত। হয়ত মহিলা অসুস্থ, বাইরে থেকে ঠাওর করা যায় না। তাছাড়া ওরকম সুন্দরী মহিলাদের একটু-আধটু সুবিধা দেওয়া দরকার। দশটা-পাঁচটা কলম পিষলে কি ওই শরীর থাকবে? কিন্তু সেই সঙ্গে স্বপ্নেন্দুর ভেতরটা খুব চঞ্চল হয়ে উঠল। সে চট করে চুলটা আঁচড়ে রুমালে মুখ ঘষে নিল। কাল থেকে দুটো রুমাল নিয়ে বেরোতে হবে। একটা খুব দ্রুত ময়লা হয়ে যায়।
আবার টেলিফোন বাজল। ওপাশে সুজিত। ফিল্মে অভিনয় করে বেশ পরিচিত হয়েছে। একসঙ্গে কলেজে পড়ত এবং এখনও যোগাযোগ আছে। সুজিত জিজ্ঞাসা করল, ‘কাল বিকেলে কী করছ?’
‘কিছুই না।’
‘চলে এসো। আমার বাড়িতে সন্ধে সাতটায়। ফিল্মের কিছু মানুষ আসবে। একটা গোপন খবর ঘোষণা করব।’
‘কী খবর?’
‘উঁহু এখন বলব না। ওটা সারপ্রাইজ থাক। এসো কিন্তু। শুধু বলছি আমি বিয়ে করছি। দারুণ, দারুণ এক মহিলাকে।’ কট করে লাইনটা কেটে দিল সুজিত। রিসিভারটার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন ঈর্ষাবোধ করল সে। এমন কিছু ভাল দেখতে নয় কিন্তু সুজিত আজ বিখ্যাত। প্রচুর টাকা পাচ্ছে এবং সেই সঙ্গে দারুণ মহিলাকে বিয়ে করছে। আর সে একটা ভাল স্টুডেণ্ট হয়েও কলা চুষছে। রাস্তাঘাটে কোনও মেয়ে তার দিকে তেমনভাবে তাকায় না। কলেজ লাইফে সুজিতের থেকে তার সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল।
এই সময় দরজায় শব্দ হতেই মুখ তুলে তাকাল স্বপ্নেন্দু। মনে হল দম বন্ধ হয়ে যাবে তার। হেনা সেনের মুখ থমথমে, ‘ডেকেছেন?’
উঠে দাঁড়াতে গিয়ে খেয়াল হল সে অফিসার। হাত বাড়িয়ে চেয়ারটা দেখিয়ে বলল, ‘বসুন। আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।’
হেনা সেন এগিয়ে এল রাজহাঁসের ভঙ্গিতে। ‘কী ব্যাপার?’
‘আগে বসুন, দাঁড়িয়ে কথা বলা শোভন নয়।’
ব্যাপারটা যেন হেনা সেনের মনঃপূত হচ্ছিল না। তবু চেয়ারখানা সামান্য টেনে নিয়ে থমথমে মুখে বসলেন। স্বপ্নেন্দু সেটা লক্ষ্য করল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘এই অফিসের পরিবেশ আপনার কেমন লাগছে?’
‘ভালই।’
‘কিন্তু আমার ওপরওয়ালা মনে করেন পরিবেশ আদৌ ভাল নয়। তিনি চান অবস্থার উন্নতি করতে। আপনি সেকশনে আসতে চান?’
‘সেকশনে? না না। ওখানে ঝামেলা। আমি বেশ আছি।’
‘কিন্তু মিসেস বক্সী আপনাকে সেকশনে পাঠাতে বলেছেন।’
এবার হাসলেন হেনা সেন, ‘উনি আমাকে সহ্য করতে পারেন না। আপনি নিশ্চয়ই কারণটা বুঝতে পারছেন। সেকশনে যাওয়ার যাদের ইণ্টারেস্ট আছে তাদের পাঠান। আমি চলি।’
‘একটু বসুন।’ স্বপ্নেন্দু খুব অসহায় বোধ করছিল, ‘একটা কথা, এই সব আলোচনার কথা অফিসে গিয়ে বলবেন না।’
‘কেন?’
‘এটা টপ সিক্রেট।’
‘তাহলে আমাকে জানালেন কেন?’
ঠোঁট কামড়াল স্বপ্নেন্দু, ‘আমার মনে হয়েছিল আপনাকে বিশ্বাস করা যায়।’
‘ধন্যবাদ।’ হেনা সেন সামান্য মাথা দুলিয়ে ঘর ছেড়ে যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ালেন, ‘আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাকে এক্সপ্লেন করতে বলবেন কেন আমি অফিসে এসেই ক্যাণ্টিনে যাই।’
‘আপনি জানেন আমি সেটা পারি না।’
‘আমি জানি?’
‘জানা উচিত।’
এবার হাসিটা মিষ্টি হল। তারপর বেরিয়ে গেলেন সেন। কয়েক মুহূর্ত বাদে স্বপ্নেন্দুর খেয়াল হল, একি করল সে। একজন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে চরম অন্যায় হয়ে গেল। শুধু একজন সুন্দরী মহিলার শরীর দেখে সে মাথা খারাপ করে ফেলল? এখন উনি যদি অফিসে বলে বেড়ান তাহলে ম্যাডাম তাকে চিবিয়ে খাবে। অথচ এখন আর কিছু করার নেই।
বিকেলে অফিসে হইচই পড়ে গেল। হেনা সেন নয়, কী করে যে খবর ফাঁস হয়ে গেছে তা কেউ জানে না। হয়ত হরিমাধব কিংবা বক্সীর বেয়ারা অথবা বড়বাবু, সোর্সটা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু অফিসের সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেল। ঝেঁটিয়ে ট্রান্সফার হচ্ছে এই খবরটা আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ল; বিকেল চারটেয় জানতে পারল স্বপ্নেন্দু। একজন ছাপ্পান্ন বছরের প্রৌঢ় এসে হাত জোড় করে দাঁড়ালেন, ‘স্যার, আমাকে ধনেপ্রাণে মারবেন না।’
‘কী হয়েছে।’
‘আমার তিনটে মেয়ে। সেকশন থেকে সরিয়ে দিলে ওদের বিয়ে দিতে পারব না। একদম ভরাডুবি হয়ে যাবে স্যার।’ কেঁদে ফেললেন ভদ্রলোক।
‘আপনি জানলেন কী করে?’ স্বপ্নেন্দু সোজা হয়ে বসল।
‘সবাই জানে স্যার।’
তারপর একটার পর একটা অনুরোধ। কারো মেয়ের বিয়ে হয় না, কারো সংসার চলবে না। অফিস থেকে চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে আসছিল। স্বপ্নেন্দু টেলিফোন করল মিসেস বক্সীকে। বেজে গেল টেলিফোন। হরিমাধব খোঁজ নিয়ে জানাল ম্যাডাম ঘণ্টাখানেক আগে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছেন।
স্বপ্নেন্দুর মাথায় কিছুতেই ঢুকছিল না কী করে খবরটা ফাঁস হয়ে গেল। সে চাকলাদারকে ডেকে পাঠাল, ‘আপনি স্টাফদের বলেছেন?’
‘না স্যার। তত শুনেছি ম্যাডাম নাকি ওঁর পিওনকে বলেছেন।’
‘ম্যাডাম?’ স্বপ্নেন্দু হাঁ হয়ে গেল। ঠিক সেই সময় দল বেঁধে স্টাফরা তার ঘরে প্রবেশ করল। একসঙ্গে চিৎকার চেঁচামেচি অভিযোগ এবং গালাগালের বন্যা বয়ে যেতে লাগল। তাকে ঘিরে অনেকগুলো উত্তেজিত মুখ। স্বপ্নেন্দু বলার চেষ্টা করল, ‘আপনারা আমার কাছে এসেছে কেন? মিসেস বক্সীর কাছে যান। তিনিই অল ইন অল।’
একজন বলল, ‘সে শালী পালিয়েছে।’
‘ঠিক আছে একজন বলুন। এনি অফ ইউ।’
‘শুনুন। অ্যাদ্দিন ধরে আমরা সেকশনে কাজ করছি, এখন এক কথায় সরাতে পারেন না। এতগুলো লোকের ভাতে হাত দেবার কোনও রাইট আপনার নেই।’
‘ভাতে হাত!’
‘নিশ্চয়ই।’
‘কিন্তু এটা তো বেআইনি।’
সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার উঠল অজস্র অশ্লীল শব্দ। একজন চেঁচিয়ে বলল, ‘অফিসাররা যখন মাল কামান তখন বুঝি আইন থাকে?’
এই যুক্তির কাছে নরম হতেই হয়। স্বপ্নেন্দু মিসেস বক্সীকে একথাই সকালে বলেছিল। সে বলল, ‘আমি বুঝতে পারছি। বিশ্বাস করুন আমি এসোব কিছুই জানি না। মিসেস বক্সী এলে আমি নিশ্চয়ই আলোচনা করব।’
‘আপনি জানেন না?’
‘না।’ স্বপ্নেন্দু স্রেফ অস্বীকার করল।
‘মিথ্যে কথা। তাহলে স্ট্যাটিস্টিক থেকে মিস সেনকে ডেকে পাঠালেন কেন? মিস সেনকে সেকশনে দিতে চান?’
‘মিস সেন?’ ধক্ করে উঠল স্বপ্নেন্দুর বুক। মহিলা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন নাকি? ওফ, কি বোকামিই না করেছিল সে। একটা মেয়েছেলের সুন্দর চেহারা দেখে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল!
‘কি, চুপ করে আছেন কেন?’
‘ওর সঙ্গে আমার কী কথা হয়েছে আপনারা জানেন?’ শেষ চেষ্টা করল সে। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার বাড়ল কেউ একজন হেনা সেনকে ডেকে আনতে। তারা সামনাসামনি ভজিয়ে নিতে চায়। স্বপ্নেন্দু ঘামতে লাগল এই লোকগুলোকে তার ক্ষিপ্ত নেকড়ের মত মনে হচ্ছিল। তার ঘরে হামলা হচ্ছে অথচ কোনও অফিসার এগিয়ে আসছেন না তাকে উদ্ধারের জন্যে।
কিছুক্ষণের মধ্যে মিস সেনের আবির্ভাব হল। ঘরে ঢুকে বললেন, ‘কী ব্যাপার? আমায় কেন?’ যেন তিনি কিছু জানেন না।
নেতা গোছের একজন প্রশ্ন করল, ‘মিস সেন, আজ সকালে উনি কি ট্রান্সফার পোস্টিং নিয়ে কিছু বলেছিলেন আপনাকে?’
ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন হেনা সেন। ‘হ্যাঁ।’
আর গলা শুকিয়ে গেল স্বপ্নেন্দুর। নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছে করছিল তার। সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনা বাড়ল মিথ্যুক লায়ার।
‘কী বলেছিলেন?’
‘আমি অফিসে এসে রেস্ট নিতে ক্যাণ্টিনে যাই বলে উনি আমাকে বলেছিলেন এটা নাকি অন্যায়। প্রয়োজন হলে আমাকে ট্রান্সফার করে দেবেন। আমার আবার একটু রেস্ট না নিলে চলে না।’ হেনা সেন হাসলেন।
আর স্বপ্নেন্দুর মনে হল সে গভীর কুয়োর তলা থেকে ভুস করে ওপরে উঠে এল। স্পষ্টতই আক্রমণকারীদের মুখে এখন হতাশা। কেউ কেউ হেনা সেনের দিকে অবিশ্বাসী চোখে তাকাচ্ছে। এবার হেনা সেন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমি জানতে পারি কি কেন এঁদের ট্রান্সফার করা হচ্ছে?’
‘আমি জানি না, মিসেস বক্সী বলতে পারবেন।’
‘এঁদের বিরুদ্ধে কী প্রমাণ আছে যে এরা পার্টির কাছে ঘুষ নেন? যদি না থাকে তাহলে এরকম অ্যাকশান নেওয়া মানে এঁদের অপমান করা। অনুমানের ভিত্তিতে আপনারা কিছুই করতে পারেন না।’
হেনা সেন হেসে হেসে কথাগুলো বলাতেই সোচ্চারে তাকে সমর্থন করল সবাই।
যাওয়ার আগে স্টাফরা বলে গেল যদি এইরকম অর্ডার বের হয় তাহলে কাল থেকে কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। ঘর ফাঁকা হয়ে গেল। রুমালে মুখ মুছল স্বপ্নেন্দু। খুব জোর বেঁচে গেল সে আজ। হেনা সেন তাকে বাঁচিয়ে দিল। মহিলা তাকে নাও বাঁচাতে পারতেন! সঙ্গে সঙ্গে আর একটা চিন্তা মাথায় আসা মাত্র উৎফুল্ল হল সে। মেয়েরা যাকে একটু নরম চোখে দ্যাখে, তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করে, কোথায় যেন পড়েছিল সে। এত ঝামেলার মধ্যেও এটুকু ভাবতে পেরে মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল তার। খুব ইচ্ছে করছিল হেনা সেনকে ডেকে কৃতজ্ঞতা জানায় কিন্তু সাহস হল না তার। সঙ্গে সঙ্গে স্টাফদের মনে অন্যরকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তবে মহিলা খুবই বুদ্ধিমতী। তাকেও যেমন বাঁচাল তেমনি স্টাফদেরও চটাল না। চমৎকার।
স্বপ্নেন্দু ঠিক করল মিসেস বক্সীর ওপর ব্যাপারটা ছেড়ে দেবে। তিনি যা করেন তাই হবে। সে আর এই ব্যাপারে থাকবে না। যদি মিসেস বক্সী চোখ রাঙান তাহলে হেড অফিসে বিস্তারিত জানাবে।
ছুটির পর বেরিয়ে এসে বাসস্ট্যাণ্ডে কিছুক্ষণ দাঁড়াল স্বপ্নেন্দু। এই সময়টায় তার কিছুই করার থাকে না। মা মারা যাওয়ার পর থেকে বাড়ির কোনও আকর্ষণ তার কাছে নেই। হাঁটতে হাঁটতে ধর্মতলায় চলে এল সে। আর তখনই আত্রেয়ীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। স্বপ্নেন্দু এড়াতে চাইছিল কিন্তু পারল না। আত্রেয়ী তাকে ডাকল, ‘কী ব্যাপার, কেমন আছ?’
স্বপ্নেন্দু মাথা নাড়লো, ‘ভাল। তুমি?’
‘আর থাকা। তুমি তো কোনও খোঁজখবর নাও না।’
‘কী হবে নিয়ে। তাছাড়া তোমার স্বামী তো সেটা পছন্দ করেন না।’
‘ওঃ স্বপ্নেন্দু! এই কথাটা শুনতে শুনতে আমি পাগল হয়ে গেলাম। আমার সব কাজেই যদি ওর মতামত নিতে হয় তাহলে—!’ বলতে বলতে কথা ঘোরালো সে, ‘কোথায় যাচ্ছ?’
‘কোথাও না। বেকার মানুষ।’
‘তুমি আবার বেকার। এখনও বান্ধবী পাওনি?’
‘সে কপাল কোথায়?’
‘চলো আমাদের ওখানে চলো।’
‘মাথা খারাপ। স্ত্রীর বন্ধুকে দেখলে কোনও স্বামী সুখী হয় না।’
‘আমি আর পারছি না স্বপ্নেন্দু। এই লোকটার সঙ্গে একসঙ্গে বাস করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
স্বপ্নেন্দু রাস্তাটার দিকে তাকাল। অজস্র মানুষ এই সন্ধেবেলায় যাওয়া আসা করছে। অথচ আত্রেয়ী এই পরিবেশকে ভুলে গিয়ে নিজের মনের কথা স্বচ্ছন্দে বলে যাচ্ছে। স্বপ্নেন্দু তবু বোঝাবার চেষ্টা করল, ‘এভাবে বলো না, তুমি নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছ। অতীতটাকে ভুলে যেও না।’
‘ভুল করেছিলাম।’ তারপরেই যেন খেয়াল হল আত্রেয়ীর, ‘কোথাও বসবে?’
‘তোমার দেরি হয়ে যাবে না?’
‘আই ডোণ্ট কেয়ার। তোমাকে এতদিন বাদে দেখলাম। তোমার অফিসের টেলিফোন নাম্বারটা যে কাগজে ছিল সেটাও ছিঁড়ে ফেলেছে, কী রকম ব্রুট!’
‘আজ নয় আত্রেয়ী। আমার মন ভাল নেই।’
‘একদিন কিন্তু আমার কাছে এলে তোমার মন ভাল হয়ে যেত।’
‘সে অনেক দিন আগের কথা। তখন আমরা ছাত্র—।’
‘তোমার নাম্বাটা দাও তাহলে।’
স্বপ্নেন্দু টেলিফোন নাম্বারটা বলতে আত্রেয়ী তিন চারবার নানান রকম করে মনে গেঁথে রাখল তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি এখনও সেই পুরোনো বাড়িতেই আছ?’
‘আর কোথায় যাব? মা চলে যাওয়ার পর আমি আগলাচ্ছি।’
হঠাৎ ব্যাগ খুলল আত্রেয়ী। তারপর কী ভেবে সেটা বন্ধ করে বলল, ‘তুমি হয়ত আমার কথা আজকাল আর ভাবো না কিন্তু আমার বড় মনে পড়ে তোমাকে। আমি ভুল করেছি স্বপ্নেন্দু, বিরাট ভুল।’
আত্রেয়ী চলে গেলে আরও আনমনা হয়ে গেল সে। ছাত্রজীবনে কি তার সঙ্গে আত্রেয়ীর প্রেম হয়েছিল? না, ঠিক প্রেম বলে না ওটাকে। তবে আত্রেয়ীর কাছে যেতে ভাল লাগত তার। আর আত্রেয়ীর নজর ছিল আরও ওপরের দিকে। ভাল চাকুরে, প্রচুর পয়সা এবং ক্ষমতাবান মানুষের জন্যে তার লোভ ছিল। তাই সেই বয়সে ওরকম একটা মানুষকে পেয়ে সে স্বচ্ছন্দে স্বপ্নেন্দুদের ভুলে যেতে পেরেছিল। কষ্ট হয়েছিল অবশ্যই কিন্তু সেটা ভুলে যেতে সময় লাগেনি। প্রেম হলে কি তা সম্ভব হত। শরীরে যৌবন নেই। সেই চাপল্য নেই, আকর্ষণ করার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। এই আত্রেয়ীর সঙ্গে নবীন প্রেম হয় না, পুরনো বন্ধুত্ব রাখা যায় মাত্র। কথাটা মনে হওয়ামাত্র হেনা সেনের শরীরটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে দম বন্ধ হয়ে গেল তার। হেনা সেনকে কৃতজ্ঞতা জানানো হল না। কাল এবং পরশু ছুটি। সোমবারে ঘরে ডেকে ওটা জানাতে গেলে হয়ত নানান কথা উঠবে। তাছাড়া সেদিন অফিসের আবহাওয়া কী রকম থাকবে তাও সে জানে না।
আত্রেয়ীর সঙ্গে দেখা না হলে হয়ত বুকের ভেতর হেনা সেনের জন্যে এতটা আনচান শুরু হত না। আত্রেয়ীর যন্ত্রণাটা যেন তার মনে ছুঁইয়ে চলে গেল। স্বপ্নেন্দুর মনে হল হেনা সেনের বাড়িতে গিয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এলে কেমন হয়? অফিস থেকে বের হবার আগে সে ওর ফাইল থেকে বাড়ির ঠিকানাটা জেনে এসেছে।
পরমুহূর্তেই চিন্তাটাকে বাতিল করল সে। হেনা সেনের বাড়িতে যাওয়া একজন অফিসারের পক্ষে সম্মানজনক হবে না। হেনা যদি বিরক্ত হয় তাহলে অফিসে ঢি ঢি পড়ে যাবে। স্টাফরা তো বটে মিসেস বক্সী খড়্গহস্ত হবে। তাছাড়া হয়ত গিয়ে দেখবে ওর কোনও সহকর্মী সেখানে বসে আছে। তাহলে? বেইজ্জতের একশেষ। না, এটা অত্যন্ত ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাবে।
এক কাপ চা খেয়ে হাঁটছিল স্বপ্নেন্দু। এই সময় একটা বাচ্চা ছেলে পেছনে লাগল। ধর্মতলায় এদের প্রায়ই চোখে পড়ে। একগাদা টাটকা ফুল নিয়ে এরা অনুনয় করে কিনতে। স্বপ্নেন্দু শুনেছে এই সব ফুলের অতীত নাকি ভাল নয়। কবরস্থান থেকে তুলে নিয়ে এসে নাকি বিক্রি করা হয়। তাছাড়া ফুল নিয়ে সে কী করবে? বাড়িতে যার ফুলদানি নেই তার ফুলের কী প্রয়োজন। ছেলেটাকে হটিয়ে দিলেও সে পিছু ছাড়ছিল না। ফুলগুলোর প্রশস্তি করতে করতে আকুতি জানাচ্ছিল কেনবার জন্যে। প্রায় বাধ্য হয়ে স্বপ্নেন্দু এবার ফুলগুলোর দিকে তাকাল। আর তখনই তার নজরে পড়ল একটা আধফোটা বড় রক্তগোলাপ কী রকম নরম সতেজ চেহারা নিয়ে তাকিয়ে আছে। পুরো ফোটেনি ফুলটা কিন্তু এমন ডাঁটো এবং উদ্ধত ভঙ্গি, পাপড়ির গায়ে জলের ফোঁটা যে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। সে ছেলেটাকে বলল, ‘ঐ ফুলটার দাম কত?’
‘আট আনা সাব।’ হাত বাড়িয়ে তুলে দিল সে গোলাপটিকে। লম্বা ডাঁটি এবং তাতে দুটো পাতা। দর করল না স্বপ্নেন্দু। দাম মিটিয়ে দিয়ে নাকের সামনে ধরতেই অদ্ভুত জোরালো অথচ মায়াবী গন্ধ পেল। এবং তখনই মনে হল এই গন্ধটা তার খুব চেনা। চোখ বন্ধ করতেই হেনার শরীর ভেসে উঠল। আজ সকালে লিফটে হেনা সেনের শরীর থেকে সে এই রকম গন্ধ পেয়েছিল। আদুরে চোখে ফুলটাকে দেখল স্বপ্নেন্দু আর তারপরেই মনে হল হেনা সেনের শরীরের সঙ্গেও এই ফুলের মিল আছে। এইরকম তাজা, উদ্ধত, অহঙ্কারী এবং মহিমাময়। শেষ শব্দটা ভাবতে পেরে খুব ভাল লাগল তার। মহিমাময়।
ফুলটার দিকে তাকিয়ে স্বপ্নেন্দুর দ্বিতীয়বার মনে হল তার উচিত একবার হেনা সেনের বাড়িতে যাওয়া। সে তো কখনও ফুল কেনেনি। কোনও ফুলওয়ালা তার পেছনে জোটেনি কোনদিন। আজ কেন হল?
আর ওই ছেলেটার কাছে এই ফুলটাই বা থাকবে কেন যা দেখলে হেনা সেনকে মনে পড়ায়! হেনা সেন থাকে ফুলবাগানের সরকারি ফ্ল্যাটে। তেমন বুঝলে একটা মিথ্যে ওজর দিতে অসুবিধে হবে না। তাছাড়া যে মেয়ে তাকে বাঁচাতে অতগুলো সহকর্মীর সামনে কথা সাজাল সে নিশ্চয় অফিসে গিয়ে নালিশ করবে না। এইসব ভেবে স্বপ্নেন্দু একটা ট্যাক্সি ধরল। পারতপক্ষে শেয়ারে ছাড়া সে ট্যাক্সিতে চড়ে না। কিন্তু আজ মনে হল এই ফুলটাকে নিয়ে বাসে ওঠা যায় না। ভেতরে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল সে। ঘাম জমছিল কপালে।
সরকারি ফ্ল্যাটের কাছে এসে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে স্বপ্নেন্দুর মনে হল এই লাল গোলাপটাকে হাতে ধরে পথ হাঁটা উচিত হবে না। এটাকে দেখলে মানুষের কৌতূহল হবেই। অথচ পকেটে রাখলে ফুলটা নষ্ট হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত সে রুমাল বের করে সযত্নে তাতে ফুলটাকে ঢেকে ঝুলিয়ে নিল এমন করে যে কেউ দেখলে চট করে বুঝতে পারবে না।
নম্বর খুঁজে খুঁজে ফ্ল্যাটটা পেতে মিনিট পনেরো লাগল। তিন তলায় দরজার গায়ে লেখা আছে মিস্টার এসো কে সেন। এই লোকটা কে হতে পারে? হেনার বাবা? মেয়ের অফিসার বাড়িতে এসেছেন শুনলে ভদ্রলোক কী মনে করবেন? কিন্তু এখন ফিরে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। একটু মরিয়া ভাব এসে গেলে স্বপ্নেন্দু কলিং বেলে আঙুল রাখল। আর আশ্চর্য, দরজা খুলল হেনা নিজে।
‘ওমা, আপনি?’ খুব অবাক গলায় প্রশ্ন করল হেনা।
স্বপ্নেন্দু দেখল লালশাড়ি লাল ব্লাউজে হেনাকে ঠিক রক্তগোলাপটার মত দেখাচ্ছে। অফিস থেকে ফিরে স্নান করেছে নিশ্চয়ই কারণ লাবণ্য ঢলঢল করছে সারা অঙ্গে। স্বপ্নেন্দু কোনরকমে বলতে পারল, ‘এলাম।’
‘হ্যাঁ আসুন।’ হেনা সরে দাঁড়াতে স্বপ্নেন্দু ঘরে ঢুকল। সুন্দর সাজানো আধুনিক ঘর। দরজাটা ভেজিয়ে হেনা জিজ্ঞসা করলেন, ‘কী ব্যাপার বলুন তো?’
স্বপ্নেন্দুর খেয়াল হল রুমালটার কথা। ওটা এখনও হাতে ঝোলানো। যতটা সম্ভব ওটাকে আড়াল করে সে কথা বলল, ‘আমি না এসে পারলাম না। আজ আপনি আমাকে অফিসে বাঁচিয়েছেন। আমি যে কী বলে আপনাকে–’
শব্দ করে হেসে উঠলেন হেনা সেন। তাঁর শরীরে পুরীর ঢেউগুলোকে চকিত দেখতে পেল স্বপ্নেন্দু। হেনা সেন হাসতে হাসতে বললেন, ‘বলিহারি আপনি! ওই জন্যে বাড়ি বয়ে ধন্যবাদ জানাতে এলেন! এখন যদি খবরটা অফিসে জানাজানি হয়ে যায়? আরে মুখটা অমন করেছেন কেন? বসুন বসুন।’
স্বপ্নেন্দু মাথা নাড়ল, ‘না বসব না। রাতও তো হল।’
‘রাত এমন কিছু হয়নি। দাঁড়ান, আমার মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।’ কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হেনা সেন ভেতরে চলে গেলেন। স্বপ্নেন্দু আড়ষ্ট হয়ে বসল। রুমালটাকে সে সন্তর্পণে সোফার ওপর রেখে দিল। তিনঘরের ফ্ল্যাট। অথচ অন্য মানুষের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে না।
একটু বাদেই এক প্রৌঢ়াকে নিয়ে হেনা সেন ফিরে এলেন, ‘আমার মা।’
স্বপ্নেন্দুর ইচ্ছে করছিল প্রণাম করতে কিন্তু সেটা বাড়াবাড়ি হবে মনে হওয়ায় নমস্কার করল। সে। মহিলা বললেন, ‘বসুন।’
‘আমাদের অফিসার! খুব জাঁদরেল লোক।’ হেনা সেন জানালেন। মহিলা বললেন, ‘আপনি কি এদিকেই থাকেন?’
‘না। মানে আমার এক বন্ধুর কাছে এসেছিলাম, ভাবলাম দেখা করে যাই।’
‘ওর পুরনো অফিসে পরিবেশ ভাল ছিল না। একজন তো খুব বিরক্ত করতেন। শেষ পর্যন্ত আমি তাকে নিষেধ করলাম বাড়িতে আসতে। আসলে বাবা, এখানে কোনও পুরুষ মানুষ যদি ঘন ঘন আসে তাহলে নানান কুকথা উঠবে। আমরা মায়ে মেয়েতে থাকি তো।’
‘সে তো নিশ্চয়ই!’ স্বপ্নেন্দু ঢোঁক গিলল।
‘ওর বাবা যা রেখে গিয়েছেন তাতে মেয়ের চাকরি করার দরকার হয় না। কিন্তু মেয়ে কথা শুনলে তো! এখন একটা ভাল ছেলে পেলে বেঁচে যাই।’
হেনা চাপা গলায় বললেন, ‘আঃ মা! তুমি আবার আরম্ভ করলে!’
প্রৌঢ়া স্বপ্নেন্দুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওই দ্যাখো, বলতেই আপত্তি। কিন্তু—!’
‘কোনও কিন্তু নয়। এখন ভেতরে গিয়ে রামের মাকে বল কফি করতে।’
‘কিন্তু স্বপ্নেন্দু উঠে দাঁড়াল, ‘মাফ করবেন! আমি কফি খাব না! মানে একটু আগে চা খেয়েছি তো!’
‘ও অন্য জায়গায় চা খেয়ে আমার কাছে এসেছেন?’
‘না। মানে, ঠিক আছে আর একদিন খাব।’
‘আর একদিন খাবেন মানে? শুনলেন না মা একটু আগে কি বলল। ঘনঘন এ বাড়িতে এলে পাঁচজনে কুকথা বলবে।’ হেনা সেন আবার হাসিতে ভেঙে পড়লেন। স্বপ্নেন্দু ঠোঁট কামড়াল! তাকে স্পষ্ট বলে দেওয়া হচ্ছে আর কখনও এই বাড়িতে এসো না!
প্রৌঢ়া অবশ্য বলে উঠলেন, ‘ছিঃ ওভাবে ঠাট্টা করতে হয়।’
‘আমি যে ঠাট্টা করলাম তা উনি বুঝতে পেরেছেন। সত্যি চা কফি খাবেন না?’
স্বপ্নেন্দু মাথা নাড়ল, ‘চলি আবার দেখা হবে।’
‘আপনার রুমাল পড়ে রইল ওখানে।’
স্বপ্নেন্দুর খেয়াল হল। সে কয়েক পা ফিরে এসে রুমালটাকে তুলে নিল। এতসব সত্ত্বেও তার খুব ইচ্ছে করছিল হেনা সেনের হাতে টাটকা লাল গোলাপটা তুলে দিতে। কিন্তু এইসব কথাবার্তা আর প্রৌঢ়া মহিলার সামনে সেটা দেয়া অসম্ভব। ওঁরা দরজা পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিলেন। সিঁড়িতে পা দেবার আগে স্বপ্নেন্দু শুনল হেনা বলছেন, ‘ঝামেলাটা নিজের কাঁধে না রেখে মিসেস বক্সীর ওপর চাপিয়ে দিন। আপনার কি দরকার যেচে অপ্রিয় হওয়ার।’
নির্জন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্বপ্নেন্দু টলমল হল। হেনা সেন তার সঙ্গে যতই রসিকতা করুক না কেন শেষ সময়ে যে কথাটা বলল তাতে স্পষ্ট বোঝা যায় ওর প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতি আছে। কোনও কোনও মানুষের একটা বাহ্যিক স্বভাব থাকে পরিহাস করার কিন্তু ভেতরের আন্তরিকতা যখন বেরিয়ে আসে তখন বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না। হেনা সেই রকমের মেয়ে।
বুঁদ হয়ে হাঁটছিল স্বপ্নেন্দু। লাল জামা লাল শাড়ি সাদা নিটোল ডানার মত কাঁধ থেকে হাত নেমে এসেছে যার সেই মেয়ে তার চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছিল। রুমালটাকে নাকের নিচে নিয়ে আসায় সে আবার হেনা সেনের শরীরের ঘ্রাণ আবুক নিতে পারল।
বাড়ি ফিরে স্বপ্নেন্দুর খেয়াল হল আজ রান্না-বান্না বন্ধ। ওর রাতদিনের কাজ করে যে লোকটা সে দেশে গেছে কার অসুখের খবর পেয়ে। সামনে দুদিন ছুটি বলে স্বপ্নেন্দু আপত্তি করেনি। সন্ধ্যেটা এমন ঘোরে কেটে গেল যে এসোব কথা মনেও আসেনি। এখন রাত্রে হরিমটর।
দরজা খুলে সে শোওয়ার ঘরে এল। একটা ফুলদানি নেই যেখানে গোলাপটাকে রাখা যায়। টেবিলে একটা সুন্দর কাচের বাটি ছিল, স্বপ্নেন্দু তার মধ্যে ফুলটাকে বসিয়ে দিল। একটুও টসকায়নি সেটা, তেমনি উদ্ধত এবং আদুরে। আর কি টকটকে লাল। কি খেয়াল হতে বাটিটাকে উল্টো করে বসিয়ে দিতে স্বপ্নেন্দু আবিষ্কার করল ফুলের রঙ কাচের আস্তরণ ভেদ করে বেরিয়ে আসছে। আরও রহস্যময় দেখাচ্ছে। সামান্য দূরে সরে কাঁচ চাপা ফুলটাকে দেখল সে। ঠিক মধ্যিখানে গর্বিত ভঙ্গিতে রয়েছে।
এক কাপ কফি আর কয়েকটা বিস্কুট খেয়ে শুয়ে পড়ল স্বপ্নেন্দু। আজ সারাদিন অনেক ঘটনা ঘটে গেল। চারদিকে শুধুই নোংরামো, একমাত্র ব্যতিক্রম হেনা সেন। কিন্তু তার কাছে আগের অফিসের কোনও অফিসার প্রায়ই যেত! লোকটাও কি হেনার প্রেমে পড়েছিল? মনে মনে খুব জেলাস হয়ে উঠল সে। হেনা লোকটাকে বাড়িতে এলাউ করত কেন? হেনারও কি দুর্বলতা ছিল? স্বপ্নেন্দুর অস্বস্তি শুরু হল। তার খেয়াল হল হেনা স্বইচ্ছায় ট্রান্সফার চেয়ে এই অফিসে এসেছে। দুর্বলতা থাকলে নিশ্চয়ই তা করত না।
কিন্তু অফিসের পরিবেশটা জঘন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর চেয়েও কোনও কলেজে মাস্টারি নিয়ে অনেক বেশি আরামে থাকা যেত। আসলে এখন মানুষের লোভের কোনও সীমানা নেই। চাই আরও চাই। যেমন আত্রেয়ী। একসময় যেটাকে সুখ বলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এখন সেটা থেকে মুক্ত হতে চাইছে। সে সুখের মালা যেন ফাঁস হয়ে বসেছে গলায়। আসলে সেখানেও একটা অতৃপ্তি, যা অন্য লোভ থেকে মনে জন্মেছে। স্বপ্নেন্দু শুয়ে শুয়ে হাসল। আজ পৃথিবীর সমস্ত মানুষ কোনও না কোনও লোভের শিকার। কাকে দোষ দেবে। এই নিয়ে মানিয়ে গুছিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিতে হবে। সে নিজেও তো লোভার্ত হয়ে হেনা সেনের বাড়িতে ছুটে গিয়েছিল। অথচ যাওয়ার আগে কতকগুলো বাহানা তৈরি করতে হয়েছিল নিজের কাছে কৈফিয়ত দিতে। নিশ্বাস ফেলেছিল মৃদু তালে স্বপ্নেন্দু। তার তিনতলার ঘরে অল্প অল্প হাওয়া আসছে। মাথার ওপর ফ্যানটা ঘুরছে না। কলকাতা শহর কখন যে বিদ্যুৎহীন হয়ে গেছে তা টের পায়নি। স্বপ্নেন্দুর চোখের সামনে লাল শাড়ি লাল জামা। শিশুর মত ঘুমিয়ে পড়ল তাই নিয়ে।