» » কেরী সাহেবের মুন্সী

বর্ণাকার

কেরী সাহেবের মুন্সী

‘কেরী সাহেবের মুন্সী’ একটি জীবনীভিত্তিক বাংলা উপন্যাস, এটি রচনা করেছেন প্রমথনাথ বিশী। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে, আশ্বিন, ১৩৬৫ বঙ্গাব্দে। বইটির মূল উপজীব্য উইলিয়াম কেরী ও রামরাম বসুর পারস্পরিক সম্পর্ক এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগের কলকাতা শহরের ইতিহাস ও ইংরেজ-বাঙালি সম্পর্কের জটিল সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। এই উপন্যাসটির জন্য তিনি ১৯৬০ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিলেন।

বর্তমান সংস্করণে ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’র শ্রাবণ ১৪১৪ বঙ্গাব্দ প্রকাশিত চতুর্বিংশ মুদ্রণের অনুসরণ করা হয়েছে; এই সংস্করণটি মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, ১০ শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট,  কলকাতা ৭০০ ০৭৩ হইতে এস. এন. রায় কর্তৃক প্রকাশিত ও অটোটাইপ, ১৫২ মানিকতলা মেন রোড, কলকাতা-৭০০ ০৫৪ হতে তপন সেন কর্তৃক মুদ্রিত। প্রচ্ছদপট এঁকেছিলেন আশু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং চয়নিকা প্রেস থেকে মুদ্রিত।

উৎসর্গ

শ্রীদেবেশচন্দ্র রায়

প্রীতিভাজনেষু

লেখকের বক্তব্য

বছর পনেরো আগে রামরাম বসুর জীবন নিয়ে কিছু একটা লিখবার ইচ্ছা হয়, তখন ধারণা ছিল না যে তা ঠিক কি আকার ধারণ করবে। তার পরে বিষয়ের মধ্যে প্রবেশ করে বিস্মিত হয়ে গেলাম। রামরাম বসু প্রসঙ্গে উইলিয়াম কেরীকে পেলাম। বুঝলাম যে যে-সব মহাপ্রাণ ইংরেজ এদেশে এসেছেন, উইলিয়াম কেরী তাঁদের অগ্রগণ্য। কেরীর ধর্মজীবন, ধর্মপ্রচারে আগ্রহ, বাংলা গদ্য সৃষ্টিতে নিষ্ঠা ও অধ্যবসায় অভিভূত করে দিল আমাকে। তখন ধীরে ধীরে কেরী ও রামরাম বসুকে অবলম্বন করে কাহিনীটি রূপ গ্রহণ করে উঠল।

এই কাহিনীকে পাঠক ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে গ্রহণ করবেন কিনা জানি না, করলে আমার আপত্তির কারণ নেই। ১৭৯৩ থেকে ১৮১৩ সালের ইতিহাস এর কাঠামো। জ্ঞানত কোথাও ইতিহাসের সত্য থেকে বিচ্যুত হইনি। কেবল একটি বিষয়ে কিছু স্বাধীনতা নিয়েছি, দ্বারকানাথ ঠাকুরের বয়স কিছু বাড়িয়ে দিয়েছি! আর কিছুই নয়, রবীন্দ্রনাথের পিতামহকে কাহিনীর মধ্যে আনবার লোভ সম্বরণ করতে পারি নি।

ইতিহাসের সত্য ও ইতিহাসের সম্ভাবনা ঐতিহাসিক উপন্যাসকারের উপাদান। ইতিহাসের সত্য অবিচল, তাকে বিকৃত করা চলে না। ইতিহাসের সম্ভাবনায় কিছু স্বাধীনতা আছে লেখকের। সত্যের অপব্যবহার করি নি, সম্ভাবনার যথাসাধ্য সদ্ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছি।

দুই শ্রেণীর নরনারীর চরিত্র আছে উপন্যাসখানায়, ঐতিহাসিক আর ইতিহাসের সম্ভাবনা-সঞ্জাত। কেরী, রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, টমাস, রামমোহন, রাধাকান্ত দেব প্রভৃতি ঐতিহাসিক চরিত্র। রেশমী, টুশকি, ফুলকি, জন স্মিথ, লিজা, মোতি রায় প্রভৃতি ইতিহাসের সম্ভাবনা-সঞ্জাত অর্থাৎ এসব নরনারী তৎকালে এইরকমটি হত বলে বিশ্বাস। এখানে যেমন কিছু স্বাধীনতা আছে, তেমনি ভুলের সম্ভাবনাও বর্তমান। ভুল না করে স্বাধীনতার সুযোগ গ্রহণে লেখকের ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে ক্ষমতা কতটা প্রকাশ পেয়েছে জানি না।

পাত্রপাত্রীর উক্তিকে লেখকের মন্তব্য বলে গ্রহণ করা উচিত নয়। সে-সব উক্তি পাত্রপাত্রীর চরিত্রের সীমানার মধ্যেই সত্য, তাদের সত্যের সাধারণ রূপ বলে গ্রহণ করলে লেখকের প্রতি অবিচার করা হয়। বলা বাহুল্য, কোন ধর্ম কোন সম্প্রদায় বা কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তিকে আঘাত দেওয়ার উদ্দেশ্য এ গ্রন্থের নয়। তার চেয়ে উচ্চতর আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে লেখক। একটা সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পর্বের কয়েকটি বিশেষ নরনারীর সুখদুঃখের লীলাকে অবলম্বন করে নির্বিশেষ মানবসমাজের সুখদুঃখের লীলাকে অঙ্কন লেখকের উদ্দেশ্য। সে উদ্দেশ্য সফল হয়েছে এমন দাবি করি না—কিন্তু উদ্দেশ্য ও ছাড়া আর কিছু নয়।

আরও একটা কথা বুঝলাম বিষয়ে প্রবেশ করে আর কাহিনীটা লিখতে গিয়ে— কলকাতা শহরের প্রাচীন অংশের প্রত্যেক পথঘাট, অট্টালিকা, উদ্যান, প্রত্যেক ইষ্টকখণ্ড বিচিত্র কাহিনীরসে অভিষিক্ত। এ শহরের একটি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আছে যা ভারতের প্রাচীন শহরগুলোর ব্যক্তিত্ব থেকে স্বতন্ত্র। ভারতের প্রাচীন ও নবীন যুগের সীমান্তে অবস্থিত এই শহর। এর অনেক ত্রুটি সত্ত্বেও না ভালবেসে পারা যায় না একে, কারণ এ আমার সমকালীন। সমকালীনতার দাবি এ শহরের সকলের প্রতি। ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’রও ঐ দাবি—তদধিক কোন ঐশ্বর্য এর আছে মনে হয় না। অলমিতি—

প্র.

৭ই মে, ১৯৫৮

সেকালের পথঘাটের বর্তমান নামধাম

 

সেকাল একাল
বেরিয়াল গ্রাউণ্ড রোড পার্ক স্ট্রীট।
এসপ্লানেড বর্তমান ইডেন গার্ডেন।
নঈ তলাও পার্ক স্ট্রীট ও চৌরঙ্গীর মোড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের পুকুর।
ঝাঁঝরি তলাও রোড কিড স্ট্রীট।
বিজিতলাও লোয়ার সারকুলার রোড ও চৌরঙ্গীর মোড়ের উত্তর-পশ্চিম কোণের পুকুর।
জানবাজার রোড সুরেন ব্যানার্জি রোড।
কসাইটোলা স্ট্রীট বেন্টিঙ্ক স্ট্রীট।
রোপওয়াক মিশন রো।
দি অ্যাভিনিউ বহুবাজার স্ট্রীট।
এসপ্লানেড রোড গঙ্গার ধার চাঁদপাল ঘাট থেকে শুরু হয়ে সোজা পূর্বদিকে চৌরঙ্গী রোড পর্যন্ত; বর্তমান রাজভবনের দক্ষিণ-পূর্ব ও পশ্চিমমুখী দুটি প্রধান ফটক পার হয়ে এসপ্লানেড ঈস্ট ও চৌরঙ্গীর সংযোগস্থল পর্যন্ত।
ট্যাঙ্ক স্কোয়ার লালদিঘি।
ওল্ড মিশন চার্চ লালবাজার স্ট্রীট ও মিশন নোর মোড়ের দক্ষিণে অবস্থিত।
সেন্ট জনস্ চার্চ কাউন্সিল হাউস স্ট্রীট ও হেস্টিংস স্টীটের মোড়ের উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত।
ওল্ড ফোর্ট বর্তমান পূর্ব রেলওয়ের প্রধান কার্যালয়,  কলকাতার কালেকটরেট ও জি পি ও-র উত্তর দিকের কিছু অংশ জুড়ে পুরাতন কেল্লা অবস্থিত ছিল।