নয়

এক সপ্তাহও অতিবাহিত হয় নাই, মেরি চার্লসকে হঠাৎ বলিল, ‘তুমি আমার একটা উপকার করিতে পারিবে?’ আজ মেরির চক্ষু দুটা কতকটা উন্মাদের মত চকচক করিতেছে।

চার্লস কহিল, ‘কি রকম উপকার?’

মেরি একটু থামিয়া বলিল, ‘তবে শোন, তোমাকে বুঝাইয়া বলি;—আমার বুকের মাঝখানে একটা ছোট্ট, অতি ক্ষুদ্র কাঁটা ফুটিয়াছে। বাহির হইতে দেখা যায় না, বড় ভিতরে প্রবেশ করিয়া সর্বদা খচখচ করিতেছে—এক বিন্দুও সুখ পাই না; তুমি তুলিয়া দিতে পারিবে?’

চার্লস ভাবিল কি রকম! বলিল, ‘কেমন করিয়া কবে ফুটিল?’

মেরি মুখ টিপিয়া ঈষৎ হাসিয়া বলিল, ‘তাও শুনিবে? শোন, কিন্তু বোধ হয় বুঝিতে পারিবে না। ছেলেবেলায় একটা গোলাপ ফুল লইয়া খেলা করিতাম, তাতে একটা কাঁটা ছিল—দেখিতে পাই নাই। তার পর মনে কোনদিন বুঝি ঘুমের ঘোরে বুকে চাপিয়া ধরিয়াছিলাম—কাঁটাটি ফুটিয়া গিয়াছে। ফুল শুকাইয়া ঝরিয়া গিয়াছে—এখন কাঁটাটি বাহির করিয়া ফেলিতে চাই, —তুমি পারিবে?’

চার্লস কিছুই বুঝিল না। মন-রাখাগোছ কহিল, ‘বোধ হয় পারিব; কিন্তু কাঁটা খুব ছোট ত?’

‘হ্যাঁ, খুব ছোট কিন্তু সাবধান, অনেকখানি বুকের রক্ত-মাংস না কাটিলে আর বাহির হইবে না। হয়ত বা প্রাণে বাঁচিব না—সাবধানে তুলিবে ত?

চার্লস ভয় পাইল। কহিল, ‘তবে ডাক্তার ডাকাও।’

মেরি হাসিল। বলিল, ‘ডাক্তার ডাকিতে লজ্জা বোধ হইবে—বুকের মাঝে কিনা—তাই!’

চার্লস চিন্তা করিয়া কহিল, ‘আমি বোধ হয় পারিব না।’

মেরি ভ্রূকুঞ্চিত করিল—‘যদি পারিবে না, তবে মনে মনে লুকাইয়া আমাকে কামনা কর কেন?’

চার্লস শুকাইয়া উঠিল। কিন্তু পরক্ষণেই এদিক-ওদিক চাহিয়া দেখিল ঘরে অপর কেহ নাই; একটু সাহস হইল, বলিল—‘তোমাকে দেবতাও কামনা করেন—আমি ত সামান্য মনুষ্যমাত্র!’

মেরি অন্যমনস্কভাবে কহিল, ‘কিন্তু একজন আমাকে কামনা করে না। সে বোধ হয় দেবতারও উচ্চে।’ তাহার পর তাহার অন্য ভাবোদয় হইল। অমনি কঠিন কটাক্ষে চার্লসের পানে চাহিয়া বলিল, ‘দেখ, সে কাঁটাটি যদি একবার হাতে পাই, তা হলে এমনি করিয়া পদাঘাত করি—একফোঁটা কাঁটা নিমেষে পরমাণু হইয়া যায়, কিন্তু হাতে পাই না,—বুকের ভিতর লুকাইয়া বসিয়া আছে!’

চার্লস বিস্মিত হইয়া চাহিয়া রহিল। মনে হইতেছে—বুঝি ঠিক কাঁটার কথা নহে, কিন্তু ভাল পরিষ্কারও হইতেছে না। সাতপাঁচ ভাবিয়া কহিল,’ডাক্তার দেখাইলে হানি কি?’

মেরি প্রথমে হাসিয়া ফেলিল কিন্তু পরক্ষণেই মলিন হইয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, ‘আমার যেমন পোড়া কপাল, তাই তোমাদের সঙ্গে কথা বলি—সোনার পাত্র ছাড়িয়া আমি মাটির পাত্র লইয়াছি। তৃপ্তি হইবে কেন?’

চার্লসের রাগ হইল কিন্তু ভয়ে ভয়ে চুপ করিয়া রহিল।

মেরি তাহা দেখিয়া মনে মনে হাসিল, মনে মনে কহিল, ‘এরা আমাকে কত ভয় করে।’

সেদিন সমস্ত দুপুরবেলা সে ঘরের কোণে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। রাত্রে শয্যার উপর জাগিয়া পড়িয়া রহিল। প্রভাতে কোচমানকে ডাকাইয়া বলিল, ‘গাড়ি সাজাও—মিঃ বাথের বাড়ি যাইব।’

মিঃ বাথ ক্যাপ্টান নোলের এটর্নি। মেরি দ্বারে গাড়ি দাঁড় করাইয়া ভিতরে প্রবেশ করিল। বৃদ্ধ বাথ একরাশি কাগজপত্র টেবিলে রাখিয়া কাজ করিতেছিল। মেরিকে সহসা অফিসে দেখিয়া অভিবাদন করিয়া উপবেশন করাইয়া বলিল, ‘এত সকালে?’

‘কাজ আছে। কর্নেল হ্যারিংটন আমার পিতার নিকট কত টাকা কর্জ লইয়াছিল?’

মিঃ বাথ খাতাপত্র দেখিয়া হিসাব করিয়া বলিল, ‘আট হাজার পাউণ্ড।’

‘বেশ! সুদে-আসলে আজ পর্যন্ত তাহা কত হয়, শীঘ্র হিসাব করিয়া দাও।’

সে হিসাব করিয়া বলিল, ‘আজ পর্যন্ত প্রায় বারো হাজার দুই শত পাউণ্ড হয়।’

মেরি দন্তে দন্ত টিপিয়া বলিল, ‘খুব ভাল, জোঁক যেমন রক্ত শুষিয়া লয়, তেমনি করিয়া হিসাব করিয়াছ ত?’

বৃদ্ধ ভয় পাইল—বলিল, ‘হাঁ, সেই মত!’

‘আজ হইতে সাত দিনের মধ্যে আমার এই টাকা চাই—বুঝিলে?’

বৃদ্ধ অবাক হইয়া গেল। ‘এ কি কথা? সাত দিনের মধ্যে এত টাকা কে দিবে?’

মেরি চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া বলিল, ‘তাহার পুত্র দিবে। না পারে—তাহার বাটী ঘর দ্বার সমস্ত বিক্রি করিয়া লইব।’

বৃদ্ধ ভাবিল, ভিতরে কিছু ঘটিয়াছে; তথাপি বলিল, ‘এই সেদিন পুস্তক বিক্রয় করিয়া আমার নিকট দু’ হাজার পাউণ্ড জমা দিয়া গিয়াছে। আর তাহার কিছু নাই। সেদিন বলিয়াছিল যে, সম্ভবতঃ আর দুই-তিন বৎসরের মধ্যে বাকি টাকা পরিশোধ করিবে। কিন্তু এত তাড়াহুড়া করিলে তাহার বাটী বিক্রয় ভিন্ন অন্য উপায় নাই।’

মেরি আগ্রহের সহিত বলিল, ‘বাটী বিক্রয় হইবে?’

‘বোধ হয়।’

‘হয় হউক—উত্তম কথা। আমার টাকা চাই। সাত দিনের মধ্যে—না হয় নালিশ করিও।’

বৃদ্ধ অনেক দেখিয়াছে কিন্তু এমনটি দেখে নাই। বলিল, ‘এত অল্প বয়সে তাহাকে পথের ভিখারী করিবে? কাহাকে দেশত্যাগী করা উচিত কি?’

মেরি চক্ষু রাঙ্গাইল। ‘টাকা তোমার নয়, আমার। আমি তাহাকে পদতলে টানিয়া লইতে চাই।’

শেষ কথাটা বৃদ্ধ ভাল শুনিতে পাইল না, বলিল, ‘কি করিতে চাও?’

‘কিছু না। শুধু টাকা চাই। আজ নোটিশ দাও—ঠিক সাত দিনের দিন।’