আট

আরও তিন দিন নিঃশব্দে অতিবাহিত হইয়া গেল। এইবার, এতদিন পরে লিওর চক্ষে খুব বড় দু’ ফোঁটা জল আসিয়া পড়িল। আজ মাসাধিক কাল হইল মেরি অল্পে অল্পে সরিয়া দাঁড়াইয়াছে, সামর্থ্যানুযায়ী অবহেলা তাচ্ছিল্য করিতে ত্রুটি করে নাই কিন্তু এত দিন পরে অবমাননা করিয়াছে। সে যে আত্মসম্মান তুচ্ছ করিয়া অনাহূত অতিথি হইতে গিয়াছিল এবং তাহার পরিবর্তে অবজ্ঞার মৌন জ্বালাটুকু লইয়া ফিরিয়া আসিয়াছে, এইটাই তাহাকে অধিক বিচলিত করিয়া ফেলিয়াছে। তিন দিন অতিবাহিত হইল, সে একবার আসিল না, একবার ডাকিল না, আর চোখের জলের অপরাধ কি? কিন্তু শুধু কি তাই? লিওর অন্তরের ভিতর হইতে একটা ধিক্কার উঠিয়াছে। পরে দুঃখ দিলে চোখে জল আসে, কিন্তু সেজন্য আপনাকে কেহ ধিক্কার দেয় না, বরং নিজেকে একটু উচ্চ স্থানে দাঁড় করাইয়া একটু সান্ত্বনা পাইবার চেষ্টা করে। অদৃষ্টকে দোষ দিয়া কর্মফলের নিন্দা করিয়া, পরের মন্দ চরিত্রকে গালি পাড়িয়া অনেকটা শান্ত হওয়া যায়; কিন্তু যাহার আপনাকে আপনি ধিক্কার দিতে ইচ্ছা হয়—তাহার দুঃখ রাখিবার স্থান নাই, তাহার সান্ত্বনা এ জগতে আছে কিনা বলিতে পারি না। লিওর একফোঁটা অশ্রু মেরির জন্য পড়িয়াছিল, কিন্তু শেষ ফোঁটাটি যখন চক্ষু ছাপাইয়া গণ্ড বাহিয়া বক্ষে আসিয়া পড়িল, তখন তাহার হৃদয়ের প্রতি গ্রন্থিগুলি শিথিল হইয়া যাইবার মত হইল। এ অশ্রু তাহার নিজের জন্য পড়িয়াছে।—সকলের এমন দুর্ভাগ্য ঘটে না, ঘটিলেও হয়ত বুঝিতে পারে না, কিন্তু যদি কখন কেহ বুঝিতে পারে, তাহা হইলে সে লিওর মত নিশ্চয়ই যুক্তকরে ঊর্ধ্বমুখে কহে, ‘ভগবান, এমন অশ্রুপাত কাহাকেও করাইও না।’

এক মাস হইতে লিওর অন্তরে সুখ নাই, কিন্তু সম্মান ছিল, আত্মগৌরব তাহাকে পর্বতের মত অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিল। কিন্তু আজ সে প্রথম দেখিয়াছে যে, তাহারই আত্মগৌরব তাহাকে প্রতারিত করিয়াছে, আত্মা বিদ্রোহী হইয়াছে, মন বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে। মেরিকে সে ভালবাসিত, কারণ মেরিও তাহাকে ভালবাসিত; এটা বেশ কথা; তার পর সে রাগ করিল, কথা না শুনিয়া অবাধ্য হইয়া পড়িল, আর তাহার ভালবাসা নাই—লিও মনে স্থির করিল সেও আর বাসিবে না, তবে একটা পদার্থকে এতদিন পরে বিনাশ করিতে হইলে ক্লেশ বোধ হয়, লিওরও ক্লেশ বোধ হইয়াছিল, কিন্তু সে যুক্তি ও বুদ্ধির দ্বারা নির্ণয় করিল যে, স্ত্রীচরিত্র সহজে বুঝা যায় না, মেরিকেও সে এজন্য বুঝিতে না পারিয়া ভুল করিয়া ফেলিয়াছিল, যাহা হউক এখন সংশোধন করিলেই হইবে।

সে আপনাকে শোধরাইয়া লইল, তবে মধ্যে মধ্যে দুঃখ হয়, মধ্যে মধ্যে হাসিও পায়, এমন হইয়াই থাকে, এজন্য কোন ক্ষতি নাই। সে আপনাকে সংযত করিয়া, জগতের যাবতীয় দুর্ভাবনা, দুঃখ, ক্লেশ দূর করিয়া দিয়া, পরম আনন্দে সমস্ত অন্তরাত্মা এই পুস্তকখানির উপর ন্যস্ত করিয়া হৃষ্টচিত্তে ‘ইভা’র চরিত্র গড়িতেছিল। লিখিয়া শেষ করিতে পারিতেছিল না—গুণের কথা লিখিতে বুঝি স্বর্গও ফুরাইয়া যাইবে, রূপের মাধুরী বর্ণনা করিতে বুঝি স্বয়ং সজীব প্রকৃতিদেবীকে টানিয়া আনিয়া ইভার চতুর্দিকে জড়াইয়া দিতে হইবে; তাহার হৃদয়ের প্রবৃত্তিগুলি আঁকিবার আনন্দে লিওর আহার-নিদ্রা ত্যাগ হইয়াছিল, এই এক মাস ধরিয়া দারুণ পরিশ্রমেও এক তিল ক্লান্তি বোধ করে নাই, তথাপি এ চিত্র শেষ হইতেছে না, মনে হয় যদি অব্যক্ত অজানিত দুটো কথা কেহ বলিয়া দিতে পারিত,—সে দেবী-হৃদয়ের গোটা দুই গুপ্ত কথা কিছুতেই বুদ্ধিতে আসিতেছিল না, তাহা যদি পরিষ্কৃত হইত তাহা হইলে, এ স্বর্গচিত্র কোন স্বর্গীয় দেবীর হস্তে পরমানন্দে সমর্পণ করিয়া লিও তাহার এ জীবনের সমস্ত বাসনা, সমস্ত আশা কাগজ কলম যাহা কিছু আছে সমস্তই উৎসর্গ করিয়া নিতান্ত নিশ্চিত মনে বাকি জীবনটা চুপ করিয়া বসিয়া কাটাইয়া দিতে পারিত। আজ প্রাতঃকাল হইতে লিও এই লিখিত চিত্রখানি ভাল করিয়া দেখিতেছিল; সহসা মনে হইল, লোকটিকে যেন সে কোথায় দেখিয়াছে, যেন এ দেবী-প্রতিমার সহিত কখন কোন স্বপ্নরাজ্যে দেখাশুনা হইয়াছিল, একটু বোধ হয় পরিচয় হইয়াছিল, কিন্তু সে আর নাই, দেখাশুনা হইলে হয়ত বা চিনিতে পারা যায় কিন্তু মুখখানি মনে পড়িতেছে না। প্রাতঃকাল হইতেই সে এ কথা ভাবিতেছিল।

এখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে, আকাশে চাঁদ উঠিয়াছে, বাগান ফুলের গন্ধে ভরিয়া উঠিয়াছে—লিও তাহার মধ্যে বসিয়া। দুই ফোঁটা অশ্রুর শেষ বিন্দুটি এখনও গণ্ড ছাড়ায় নাই—বুকের উপর হয়ত এইবারে পড়িবে। লিও ভূমিতলে লুটাইয়া পড়িয়া কাঁদিয়া বলিল, ‘ভগবান! এত পরিশ্রম করিয়া কি শেষে মেরির চিত্র অঙ্কিত করিয়াছি? দিবানিশির এই গভীর একান্ত চিন্তা, আকাঙ্ক্ষা, বাসনা, আনন্দ, আশা, ভরসা কি সব মেরির পদতলে লুটাইয়া দিয়াছি? কি করিতে কি করিয়াছি, ভগবান! লাঞ্ছিত, উৎপীড়িত, অবমানিত—আমাকে কি শেষে মেরির চিরদাস করিয়া দিয়াছ? হৃদয়, মন, চিন্তাশক্তি, কল্পনা—সমস্ত অযাচিত তাহাকে দিয়া আমি কি শূন্যগর্ভ জড় পুতুলের মত হইয়াছি? সে চাহে না, আমি চাই। সে পদদলিত করিয়া চলিয়া যায়, আমি ধূলার মত পদতল জড়াইয়া আছি।’ ছুটিয়া আসিয়া লিও গৃহের দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল।