উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন
হে মোর দুর্ভাগা দেশ! যাদের করেছ অপমান
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
রবীন্দ্রনাথ
আজ আমাদের এই নূতন করিয়া মহাজাগরণের দিনে আমাদের সেই শক্তিকে ভুলিলে চলিবে না – যাহাদের উপর আমাদের দশ আনা শক্তি নির্ভর করিতেছে, অথচ আমরা তাহাদিগকে উপেক্ষা করিয়া আসিতেছি। সে হইতেছে, আমাদের দেশের তথাকথিত ‘ছোটোলোক’ সম্প্রদায়। আমাদের আভিজাত্য-গর্বিত সম্প্রদায়ই এই হতভাগাদের এইরূপ নামকরণ করিয়াছেন। কিন্তু কোনো যন্ত্র দিয়া এই দুই শ্রেণির লোকের অন্তর যদি দেখিতে পার, তাহা হইলে দেখিবে, ওই তথাকথিত ‘ছোটোলোক’-এর অন্তর কাচের ন্যায় স্বচ্ছ, এবং ওই আভিজাত্যগর্বিত তোমাদের ‘ভদ্রলোকের’ অন্তর মসিময় অন্ধকার। এই ‘ছোটোলোক’ এমন স্বচ্ছ অন্তর, এমন সরল মুক্ত উদার প্রাণ লইয়াও যে কোনো কার্য করিতে পারিতেছে না, তাহার কারণ এই ভদ্র সম্প্রদায়ের অত্যাচার। সে-বেচারা জন্ম হইতে এই ঘৃণা, উপেক্ষা পাইয়া নিজেকে এত ছোটো মনে করে, সংকোচ জড়তা তাহার স্বভাবের সঙ্গে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়াইয়া যায় যে, সেও যে আমাদেরই মতো মানুষ – সেও যে সেই এক আল্লাহ্-এর সৃষ্টি, তাহারও যে মানুষ হইবার সমান অধিকার আছে, – তাহা সে একেবারে ভুলিয়া যায়। যদি কেউ এই উৎপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাচরণ করে, অমনই আমাদের ভদ্র সম্প্রদায় তাহার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করিয়া তাহাকে অজ্ঞান করিয়া ফেলে। এই হতভাগাদিগকে – আমাদের এই সত্যিকার মানুষদিগকে আমরা এই রকম অবহেলা করিয়া চলিয়াছি বলিয়াই আজ আমাদের এত অধঃপতন; তাই আমাদের দেশে জনশক্তি বা গণতন্ত্র গঠিত হইতে পারিতেছে না। হইবে কীরূপে? দেশের অধিবাসী লইয়াই তো দেশ এবং ব্যক্তির সমষ্টিই তো জাতি। আর সে দেশকে, সে জাতিকে যদি দেশের, জাতির সকলে বুঝিতে না পারে, তবে তাহার উন্নতির আশা করা আর আকাশে অট্টালিকা নির্মাণের চেষ্টা করা একই কথা। তোমাদের এই আভিজাত্যগর্বিত, ভণ্ড, মিথ্যুক, ভদ্র সম্প্রদায় দ্বারা – (যাহাদের অধিকাংশেরই দেশের, জাতির প্রতি সত্যিকার ভালোবাসা নাই) মনে কর কী দেশ-উদ্ধার হইবে, জাতিগঠন হইবে? তোমরা ভদ্র সম্প্রদায়, মানি, দেশের দুর্দশা, জাতির দুর্গতি বুঝ, লোককে বুঝাইতে পার এবং ওই দুর্ভাগ্যের কথা কহিয়া কাঁদাইতে পার, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নামিয়া কার্য করিবার শক্তি তোমাদের আছে কি? না, নাই। এ-কথা যে নিরেট সত্য, তাহা তোমরাই বুঝ। কাজেই তোমাদের এই দেশকে, জাতিকে উন্নত করিবার আশা ওই কথাতেই শেষ হইয়া যায়। কিন্তু যদি একবার আমাদের এই জনশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করিতে পার, তাহাদিগকেও মানুষ বলিয়া ভাই বলিয়া কোল দিবার তোমার উদারতা থাকে, তাহাদিগের শক্তির উন্মেষ করিতে পার, তাহা হইলে দেখিবে তুমি শত বৎসর ধরিয়া প্রাণপণে চেষ্টা সত্ত্বেও যে-কাজ করিতে পারিতেছ না, একদিনে সেই কাজ সম্পন্ন হইবে। একথা হয়তো তোমার বিশ্বাস হইবে না, কিন্তু এই সেদিনকার সত্যাগ্রহ, হরতালের কথা মনে কর দেখি, – একবার মহাত্মা গান্ধির কথা ভাবিয়া দেখো দেখি! তিনি আজ ভারতে কী অসাধ্য সাধন করিতে পারিয়াছেন।
তিনি যদি এমনই করিয়া প্রাণ খুলিয়া ইহাদের সহিত না মিশিতেন, ইহাদের সুখ-দুঃখের এমন করিয়া ভাগী না হইতেন, ইহাদিগকে যদি নিজের বুকের রক্ত দিয়া, তাহারা খাইতে পাইল না বলিয়া নিজেও তাহাদের সঙ্গে উপবাস করিয়া ইহাদিগকে নিতান্ত আপনার করিয়া না তুলিতেন, তাহা হইলে আজ তাঁহাকে কে মানিত? কে তাঁহার কথায় কর্ণপাত করিত? কে তাঁহার একটি ইঙ্গিতে এমন করিয়া বুক বাড়াইয়া মরিতে পারিত? তাঁহার আভিজাত্য-গৌরব নাই, পদ-গৌরবের অহংকার নাই, অনায়াসে প্রাণের মুক্ত উদারতা লইয়া তোমাদের ঘৃণ্য এই ‘ছোটোলোক’-কে বক্ষে ধরিয়া ভাই বলিয়া ডাকিয়াছেন, – সে-আহ্বানে জাতিভেদ নাই, ধর্মভেদ নাই, সমাজ ভেদ নাই, – সে যে ডাকার মতো ডাক, – তাই নিখিল ভারতবাসী, এই উপেক্ষিত হতভাগারা তাঁহার দিকে এত হাহা করিয়া ব্যগ্রবাহু মেলিয়া ছুটিয়াছে। হায়, তাহাদের যে আর কেহ কখনও এমন করিয়া এত বুকভরা স্নেহ দিয়া আহ্বান করেন নাই! এ মহা-আহ্বানে কী তাহারা সাড়া না দিয়া পারে? যদি পার, এমনি করিয়া ডাকো, এমনি করিয়া এই উপেক্ষিত শক্তির বোধন করো – দেখিবে ইহারাই দেশে যুগান্তর আনিবে, অসাধ্য সাধন করিবে। ইহাদিগকে উপেক্ষা করিবার, মানুষকে মানুষ হইয়া ঘৃণা করিবার তোমার কী অধিকার আছে? ইহা তো আত্মার ধর্ম নয়। তাহার আত্মা তোমার আত্মার মতোই ভাস্বর, এর একই মহা-আত্মার অংশ। তোমার জন্মগত অধিকারটাই কী এত বড়ো? তুমি যদি এই চণ্ডাল বংশে জন্মগ্রহণ করিতে, তাহা হইলে তোমার মতো ভদ্রলোকদের দেওয়া এই সব হতাদর উপেক্ষার আঘাত, বেদনার নির্মমতা একবার কল্পনা করিয়া দেখো দেখি, – ভাবিতে তোমার আত্মা কি শিহরিয়া উঠিবে না?
আমরা ভারতবাসীরাই শুধু আত্মার এত অবমাননা করিতে সাহস করি, আর তাই আমাদের শোচনীয় অধঃপতন, – তাই বিশ্বে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবার আমাদের স্থান নাই। এই আত্মার অপমানে, যে সেই অনাদি অনন্ত মহা-আত্মারই অপমান করা হয়। ভয়ে অঙ্গ শিহরিয়া উঠে না কি? খোদার সৃষ্ট – তাঁহার আনন্দের বিকাশস্বরূপ এই মানুষকে ঘৃণা করিবার অধিকার তোমায় কে দিয়াছে? তোমাকেই বা বড়ো হইবার অধিকার কে দিয়াছে, তুমি কীসের জন্য ভদ্র বলিয়া মনে কর? এসব যে তোমারই নিজের সৃষ্টি, – খোদার উপর খোদকারি। এ মহা-অপরাধের মহাশাস্তি হইতে তোমার রক্ষা নাই, – রক্ষা নাই। মানুষের প্রতি এই যে হিংসা, দ্বেষ, তোমার দেশের, গাঁয়ের প্রতিবেশী ভাইদের প্রতি এই যে অকারণ ঘৃণা, আক্রোশ, ইহাই তোমার মূর্খের বর্ণ কালো করিয়া দিয়াছে – তোমার চেহারায় কালি ছড়াইয়া দিয়াছে। মরিতে তো বসিয়াছ, – যদি এখনও এই মৃত হতভাগ্যদের হাত ধরিয়া না উঠিয়া একা উঠিতে যাও, তবে আরও মার খাইয়া মরিবে। কীসের পতিত ইহারা? ইহাদের প্রাণ যত উন্মুক্ত – ইহাদের অন্তর যেমন সরল, – তুমি কি সেরকম হইতে পার? হইতে পারে অশিক্ষিত সে, কিন্তু ইহার প্রাণ তোমার চেয়ে অনেক বড়ো, সে প্রাণে বিরাট বিপুল শক্তি-সিংহ সুপ্ত হইয়া রহিয়াছে, – যদি পার সেই শক্তিকে জাগাও।
আমাদের এই পতিত, চণ্ডাল, ছোটোলোক ভাইদের বুকে করিয়া তাহাদিগকে আপন করিয়া লইতে, তাহাদেরই মতো দীন বসন পরিয়া, তাহাদের প্রাণে তোমারও প্রাণ সংযোগ করিয়া উচ্চশিরে ভারতের বুকে আসিয়া দাঁড়াও, দেখিবে বিশ্ব তোমাকে নমস্কার করিবে। এসো, আমাদের উপেক্ষিত ভাইদের হাত ধরিয়া আজ ভারত-বেদির সামনে দাঁড়াইয়া বোধন-বাঁশিতে সুর দিই –
‘কীসে দুঃখ, কীসের দৈন্য,
কীসের লজ্জা, কীসের ক্লেশ!’