» » দ্বীপান্তরের বন্দিনী

দ্বীপান্তরের বন্দিনী

আসে নাই ফিরে ভারত-ভারতী?

মা-র কতদিন দ্বীপান্তর?

পুণ্য বেদির শূন্যে ধ্বনিল

ক্রন্দন—‘দেড় শত বছর।’…

সপ্ত সিন্ধু তেরো নদী পার

দ্বীপান্তরের আন্দামান,

রূপের কমল রূপার কাঠির

কঠিন স্পর্শে যেখানে ম্লান,

শতদল যেথা শতধা ভিন্ন

শস্ত্র-পাণির অস্ত্র-ঘায়,

মন্ত্রী যেখানে সান্ত্রি বসায়ে

বীনার তন্ত্রী কাটিছে হায়,

সেখান হতে কি বেতার-সেতারে

এসেছে মুক্ত-বন্ধ সুর?

মুক্ত কি আজ বন্দিনী বাণী?

ধ্বংস হল কি রক্ষ-পুর?

যক্ষপুরীর রৌপ্য-পঙ্কে

ফুটিল কি তবে রূপ-কমল?

কামান গোলার সীসা-স্তূপে কি

উঠেছে বাণীর শিশমহল?

শান্তি-শুচিতে শুভ্র হল কি

রক্ত সোঁদাল খুন-খারাব?

তবে এ কীসের আর্ত আরতি,

কিসের তরে এ শঙ্খারাব?…

সাত সমুদ্র তেরো নদী পার

দ্বীপান্তরের আন্দামান,

বাণী যেথা ঘানি টানে নিশিদিন,

বন্দী সত্য ভানিছে ধান,

জীবন-চুয়ানো সেই ঘানি হতে

আরতির তেল এনেছ কি?

হোমানলে দিতে বাণীর রক্ষী

বীর ছেলেদের চর্বি ঘি?

হায় শৌখিন পূজারি, বৃথাই

বেদির শঙ্খে দিতেছ ফুঁ,

পুণ্য বেদির শূন্য ভেদিয়া

ক্রন্দন উঠিতেছে শুধু!

পূজারি, কাহারে দাও অঞ্জলি?

মুক্ত ভারতী ভারতে কই?

আইন যেখানে ন্যায়ের শাসক,

সত্য বলিলে বন্দী হই,

অত্যাচারিত হইয়া যেখানে

বলিতে পারি না অত্যাচার,

যথা বন্দিনী সীতা সম বাণী

সহিছে বিচার-চেড়ীর মার,

বাণীর মুক্ত শতদল যথা

আখ্যা লভিল বিদ্রোহী,

পূজারি, সেখানে এসেছ কি তুমি

বাণী পূজা-উপচার বহি?

সিংহেরে ভয়ে রাখে পিঞ্জরে,

ব্যাঘ্রেরে হানে অগ্নি-শেল,

ব্যাঘ্রেরে হানে অগ্নি-শেল,

বাণীর কমল খাটিবে জেল!

তবে কি বিধির বেতার-মন্ত্র

বেজেছে বাণীর সেতারে আজ,

পদ্মে রেখেছে চরণ-পদ্ম

যুগান্তরের ধর্মরাজ?

তবে তাই হোক। ঢালো অঞ্জলি,

বাজাও পাঞ্চজন্য শাঁখ!

দ্বীপান্তরের ঘানিতে লেগেছে

যুগান্তরের ঘুর্ণিপাক!

হুগলি,

মাঘ, ১৩৩১