» » সাবধানী ঘণ্টা

বর্ণাকার

সাবধানী ঘণ্টা

রক্তে আমার লেগেছে আবার সর্বনাশের নেশা।

রুধির-নদীর পার হতে ঐ ডাকে বিপ্লব-হ্রেষা!

বন্ধু গো, সখা, আজি এই নব জয়-যাত্রার আগে

দ্বেষ-পঙ্কিল হিয়া হতে তব শ্বেত পঙ্কজ মাগে

বন্ধু তোমার; দাও দাদা দাও তব রূপ-মসি ছানি

অঞ্জলি ভরি শুধু কুৎসিত কদর্যতার গ্লানি!

তোমার নীচতা, ভীরুতা তোমার, তোমার মনের কালি

উদ্গারো সখা বন্ধুর শিরে; তব বুক হোক খালি!

সুদূর বন্ধু, দূষিত দৃষ্টি দূর করো, চাহো ফিরে,

শয়তানে আজ পেয়েছে তোমায়, সে যে পাঁক ঢালে শিরে!

চিরদিন তুমি যাহাদের মুখে মারিয়াছ ঘৃণা-ঢেলা,

যে ভোগানন্দ দাসেদেরে গালি হানিয়াছ দুই বেলা,

আজি তাহাদেরই বিনামার তলে আসিয়াছ তুমি নামি!

বাঁদরেরে তুমি ঘৃণা করে ভালবাসিয়াছ বাঁদরামি!

হে অস্ত্রগুরু! আজি মম বুকে বাজে শুধু এই ব্যথা,

পাণ্ডবে দিয়া জয়কেতু, হলে কুক্কুর-কুরু-নেতা!

ভোগ-নরকের নারকীয় দ্বারে হইয়াছ তুমি দ্বারী,

হারামানন্দে হেরেমে ঢুকেছ হায় হে ব্রহ্মচারী!

তোমার কৃষ্ণ রূপ-সরসীতে ফুটেছে কমল কত,

সে কমল ঘিরি নেচেছে মরাল কত সহস্র শত,–

কোথা সে দিঘীর উচ্ছল জল, কোথা সে কমল রাঙা,

হেরি শুধু কাদা, শুকায়েছে জল, সরসীর বাঁধ ভাঙা!

সেই কাদা মাখি চোখে মুখে তুমি সাজিয়াছ ছি ছি সং,

বাঁদর-নাচের ভালুক হয়েছ, হেসে মরি দেখে ঢং।

অন্ধকারের বিবর ছাড়িয়া বাহিরিয়া এস দাদা,

হেরো আরশিতে–বাঁদরের বেদে করেছে তোমায় খ্যাঁদা!

মিত্র সাজিয়া শত্রু তোমারে ফেলেছে নরকে টানি,

ঘৃণার তিলক পরাল তোমারে স্তাবকের শয়তানি!

যাহারা তোমারে বাসিয়াছে ভাল, করিয়াছে পূজা নিতি,

তাহাদের হানে অতি লজ্জার ব্যথা আজ তব স্মৃতি।

নপুংসক ঐ শিখণ্ডী আজ রথের সারথি তব,–

হানো বীর তব বিদ্রুপ-বাণ, সব বুক পেতে লব

ভীষ্মের সম; যদি তাহে শর-শয়নের বর লভি,

তুমি যত বল আমিই সে-রণে জিতিব অস্ত্র-কবি!

তুমি জান, তুমি সম্মুখ রণে পারিবে না পরাজিতে,

আমি তব কাল যশোরাহু সদা শঙ্কা তোমার চিতে,

রক্ত-অসির কৃষ্ণ মসির যে কোনো যুদ্ধে, ভাই,

তুমি নিজে জান তুমি অশক্ত, করিয়াছ শুরু তাই

চোরা-বাণ ছোঁড়া বেল্লিকপনা বিনামা আড়ালে থাকি

ন্যক্কার-আনা নপুংসকেরে রথ-সম্মুখে রাখি।

হেরো সখা আজ চারিদিক হতে ধিক্কার অবিরত

ছি ছি বিষ ঢালি জ্বালায় তোমার পুরানো প্রদাহ-ক্ষত!

আমারে যে সবে বাসিয়াছে ভাল, মোর অপরাধ নহে!

কালীয়-দমন উদিয়াছে মোর বেদনার কালীদহে–

তাহার দাহ তো তোমারে দহেনি, দহেছে যাদের মুখ

তাহারা নাচুক জ্বলুনির চোটে। তুমি পাও কোন সুখ?

দগ্ধ-মুখ সে রাম-সেনাদলে নাচিয়া হে সেনাপতি!

শিব সুন্দর সত্য তোমার লভিল একী এ গতি?

যদিই অসতী হয় বাণী মোর, কালের পরশুরাম

কঠোর কুঠারে নাশিবে তাহারে, তুমি কেন বদনাম

কিনিছ বন্ধু, কেন এত তব হিয়া দগদগি জ্বালা?–

হোলির রাজা কে সাজাল তোমারে পরায়ে বিনামা-মালা?

তোমার গোপন দুর্বলতারে, ছি ছি করে মসিময়

প্রকাশিলে, সখা, এইখানে তব অতি বড় পরাজয়।

শতদল-দলে তুমি যে মরাল শ্বেত-সায়রের জলে।

ওঠো সখা, বীর, ঈর্ষা-পঙ্ক-শয়ন ছাড়িয়া পুনঃ,

নিন্দার নহ, নান্দীর তুমি, উঠিতেছে বাণী শুন।

ওঠো সখা, ওঠো, লহো গো সালাম, বেঁধে দাও হাতে রাখি,

ঐ হেরো শিরে চক্কর মারে বিপ্লব-বাজপাখি!

অন্ধ হয়ো না, বেত্র ছাড়িয়া নেত্র মেলিয়া চাহো–

ঘনায় আকাশে অসন্তোষের নিদারুণ বারিবাহ।

দোতালায় বসি উতাল হয়ো না শুনি বিদ্রোহ-বাণী,

এ নহে কৌরব, এ কাঁদন উঠে নিখিল-মর্ম ছানি।

বিদ্রুপ করি উড়াইবে এই বিদ্রোহ-তেঁতো জ্বালা?

সুরের তোমরা কী করিবে তবু হবে কান ঝালাপালা

অসুরের ভীম অসি-ঝনঝনে, বড় অসোয়াস্তি-কর!

বন্ধু গো, এত ভয় কেন? আছে তোমার আকাশ-ঘর!

অর্গল এঁটে সেথা হতে তুমি দাও অনর্গল গালি,

গোপীনাথ মলো? সত্য কি? মাঝে মাঝে দেখো তুলি জালি!

বারীন ঘোষের দ্বীপান্তর আর মির্জাপুরের বোমা,

লাল বাংলার হুমকানি,–ছি ছি, এত অসত্য ওমা,

কেমন করে যে রটায় এ সব ঝুটা বিদ্রোহী দল!

সখী গো, আমায় ধরো ধরো! মাগো, কত জানে এরা ছল!

সই লো, আমার কাতুকুতু ভাব হয়েছে যে, ঢলে পড়ি!

আঁচলে জড়ায়ে পা চলে না গো, হাত হতে পড়ে ছড়ি!

শ্রমিকের গাঁতি, বিপ্লব-বোমা, আ ম’লো তোমরা মরো!

যত সব বাজে বাজখাঁই সুর, মেছুনি-বৃত্তি ধরো!

যারা করে বাজে সুখভোগ ত্যাগ, আর রাজরোষে মরে,

ঐ বোকাদের ইতর ভাষায় গালি দাও খুব করে।

এই ইতরামি, বাঁদরামি-আর্ট আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে

হন্যে কুকুর পেট পালো আর হাউ হাউ মরো কেঁদে?

এই নোংরামি করে দিনরাত বল আর্টের জয়!

আর্ট মানে শুধু বাঁদরামি আর মুখ ভ্যাংচানো নয়!

আপনার নাক কেটে দাদা এই পরের যাত্রা ভাঙা

ইহাই হইল আদর্শ আর্ট, নাকি-সুর, কান রাঙা!

আর্ট ও প্রেমের এই সব মেড়ো মাড়োয়ারি দলই জানে,

কোন বিদ্রোহ অসন্তোষের রেখা নাই কোনখানে!

সব ভুয়ো দাদা, ও-সবে দেশের কিছুই হইবে নাকো,

এমনই করিয়া জুতো খাও আর মলমল-মল মাখো!–

জ্ঞান-অঞ্জন-শলাকা তৈরি হতেছে এদের তরে,

দেখিবে এদের আর্টের আঁটুনি একদিনে গেছে ছড়ে!

বন্ধু গো! সখা! আঁখি খোলো, খোলো শ্রবণ হইতে তুলা,

ঐ হেরো পথে গুর্খা-সেপাই উড়াইয়া যায় ধুলা!

ঐ শোনো আজ ঘরে ঘরে কত উঠিতেছে হাহাকার,

ভূধর প্রমাণ উদরে তোমার এবার পড়িবে মার!

তোমার আর্টের বাঁশরির সুরে মুগ্ধ হবে না এরা,

প্রয়োজন-বাঁশে তোমার আর্টের আটশালা হবে ন্যাড়া!

প্রেমও আছে সখা, যুদ্ধও আছে, বিশ্ব এমনই ঠাঁই,

ভাল নাহি লাগে, ভাল ছেলে হয়ে ছেড়ে যাও, মানা নাই!

আমি বলি সখা, জেনে রেখো মনে কোন বাতায়ন-ফাঁকে

সজিনার ঠ্যাঙা সজনিরই মত হাতছানি দিয়ে ডাকে।

যত বিদ্রুপই করো সখা, তুমি জান এ সত্য-বাণী,

কারুর পা চেটে মরিব না; কোন প্রভু পেটে লাথি হানি

ফাটাবে না পিলে, মরিব যেদিন মরিব বীরের মত,

ধরা-মা’র বুকে আমার রক্ত রবে হয়ে শাশ্বত!

আমার মৃত্যু লিখিবে আমার জীবনের ইতিহাস!

ততদিন সখা সকলের সাথে করে নাও পরিহাস!

কলিকাতা

কার্তিক, ১৩৩২