ফণী-মনসা
‘ফণী-মনসা’ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মুতাবিক ১৯২৭ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রকাশক ছিলেন কবি নিজেই, যদিও ঠিকানা ছাপা হয়েছিল ‘বর্মণ পাবলিশিং হাউসের’, ১৯৩ কর্ণওয়ালিশ ষ্ট্রীট, কলিকাতা। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫৪, মূল্য পাঁচ সিকা।
‘সব্যসাচী’ ২৩শে পৌষ ১৩৩২ মুতাবিক ৭ই জানুয়ারি ১৯২৬ তারিখে ‘লাঙলে’ প্রকাশিত হয়েছিল।
‘দ্বীপান্তরের বন্দিনী’ ১৭ই মাঘ ১৩৩২ তারিখে ৫ম বর্ষের ১০ম সংখ্যক ‘বিজলী’তে ‘বন্দিনী’ শিরোনামে বের হয়েছিল।
‘আশীর্বাদ’ শামসুন নাহারের ‘পুণ্যময়ী’ পুস্তকের ‘প্রশস্তি’।
‘সাবধানী ঘণ্টা’ ১৩৩১ কার্তিকের কল্লোলে ‘সর্বনাশের ঘণ্টা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। এ সম্পর্কে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখিয়াছেন—
“মনে আছে এই কবিতা নজরুল কল্লোল আপিসে বসে লিখেছিল একবৈঠকে।”
[কল্লোল যুগ, ৮৯ পৃষ্ঠা]
‘শনিবারের চিঠি’তে ‘আমি ব্যাঙ’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে নজরুল ইসলাম তা মোহিতলাল মজুমদারের রচনা বলে মনে করেন। তাই প্রতিক্রিয়ায় ‘কল্লোল’ পত্রিকায় (কার্তিক ১৩৩১) তিনি লেখেন ‘সর্বনাশের ঘণ্টা’।
‘সর্বনাশের ঘণ্টা’ অনেক স্থানে পরিবর্তিত হয়ে গ্রন্থভুক্ত হয়েছে। মূল কবিতাটি নিম্নে সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হল।
সর্বনাশের ঘণ্টা
রক্তে আমার লেগেছে আবার সর্বনাশের নেশা।
রুধির-নদীর পার হতে ঐ ডাকে বিপ্লব-হ্রেষা।
হে দ্রোণাচার্য! আজি এই নব জয়যাত্রার আগে
দ্বেষ-পঙ্কিল হিয়া হতে তব শ্বেত পঙ্কজ মাগে
শিষ্য তোমার, দাও গুরু দাও তব রূপ-মসি ছানি’
অঞ্জলি ভরি শুধু কুৎসিত কদর্যতার গ্লানি।
তোমার নীচতা ভীরুতা তোমার, তোমার মনের কালি
উদ্গারো গুরু শিষ্যের শিরে, তব বুক হোক খালি।
বন্ধু গো! গুরু! দূষিত দৃষ্টি দূর করো, চাহ ফিরে,
শয়তানে আজ পেয়েছে তোমায়, সে যে পাঁক ঢালে শিরে!
চিরদিন তুমি যাহাদের মুখে মারিয়াছ ঘৃণা-ঢেলা,
যে ভোগানন্দ দাসেদের গালি হানিয়াছ দুই বেলা,
আজ তাহাদেরি বিনামার তলে আসিয়াছ তুমি নামি
বাঁদরেরে তুমি ঘৃণা করে ভালবাসিয়াছ বাঁদরামি।
হে অস্ত্রগুরু! আজি মম বুকে বাজে শুধু এই ব্যথা,
পাণ্ডবে দিয়া জয়-কেতু, হলে কুক্কুর-কুরু-নেতা।
ভোগ-নরকের নারকীর দ্বারে হইয়াছ তুমি দ্বারী
ব্রহ্ম-অস্ত্র ব্রহ্ম-দৈত্যে দিয়া, হে ব্রহ্মচারী!
তোমার কৃষ্ণ-রূপ-সরসীতে ফুটেছে কমল কত
সে কমল ঘিরি নেমেছে মরাল কত সহস্র শত।
কোথা সে দিঘীর উচ্ছল জল কোথা সে কমল রাঙা;
হেরি শুধু কাদা শুকায়েছে জল, সরসীর বাঁধ ভাঙা!
সেই কাদা মাখি চোখে-মুখে তুমি সাজিয়াছ ছি ছি সং,
বাঁদর-নাচের ভালুক হয়েছ; হেসে মরি দেখে ঢং!
অন্ধকারের বিবর ছাড়িয়া বাহিরিয়া এস গুরু,
হেরো দিবালোকে—বাঁদরের বেদে কেটেছে গুম্ফ ভুরু।
মিত্র সাজিয়া শত্রু তোমারে ফেলেছে নরকে টানি,
ঘৃণার তিলক পরাল তোমারে স্তাবকের শয়তানি।
যাহারা তোমারে বাসিয়াছে ভাল, করিয়াছে পূজা নিতি,
তাহাদের হানে অতি লজ্জার ব্যথা আজ তব স্মৃতি।
নপুংসক ঐ শিখণ্ডী আজ রথের সারথি তব—
হানো বীর তব বিদ্রূপ-বাণ, সব বুক পেতে লব
ভীষ্মের সম, যদি তাহে শর-শয়নের বর লভি;
তুমি যত বল, আমিই সে রণে জিতিব অস্ত্র-কবি!
তুমি জানো, তুমি সম্মুখ-রণে পারিবে না পরাজিতে,
আমি তব কাল যশোরাহু সদা শঙ্কা তোমার চিতে।
রক্ত অসির কৃষ্ণ মসির যে কোনো যুদ্ধে, গুরু,
তুমি নিজে জানো তুমি অশক্ত, তাই করিয়াছ শুরু
চোরা-বাণ ছোঁড়া বেল্লিকপনা বিনামা-আড়ালে থাকি,
ন্যক্কার-আনা নপুংসকেরে রথ-সম্মুখে রাখি।
হেরো গুরু আজ চারিদিকে হতে ধিক্কার অবিরত
ছি ছি বিষ ঢালি জ্বালায় তোমার পুরানো প্রদাহ-ক্ষত।
আমারে যে সবে বাসিয়াছে ভাল মোর অপরাধ নহে।
কালীয়-দমন উদিয়াছে মোর বেদনার কালিদহে।
তাহার সে দাহ তোমারে দহেনি, দহেছে যাদের মুখ
তাহারা নাচুক জ্বলুনির চোটে। তুমি পাও কোন্ সুখ
দগ্ধ-মুখ সে রাম-সেনাদলে নাচিয়া হে সেনাপতি!
শিব-সুন্দর-সত্য তোমার লভিল এ কি এ গতি?
যদিই অসতী হয় বাণী মোর, কালের পরশুরাম
কঠোর কুঠারে নাশিবে তাহারে, তুমি কেন বদনাম
কিনিতেছ গুরু! কেন এত তব হিয়া-দগ্দগি জ্বালা?
হোলির রাজা কে সাজাল তোমারে পরায়ে বিনামা-মালা?
তোমার গোপন দুর্বলতারে, ছি ছি করে মসীময়
প্রকাশিলে গুরু, এই খানে তব অতি বড় পরাজয়।
তুমি ভিড়িও না গো-ভাগাড়ে-পড়া চিল-শকুনের দলে,
শতদল-দলে তুমি যে মরাল শ্বেত-সায়রের জলে।
ওঠ গুরু, বীর, ঈর্ষা-পঙ্ক-শয়ন ছাড়িয়া পুন,
নিন্দার নহ, নান্দীর তুমি, উঠিতেছে বাণী শুন!
উঠ গুরু উঠ, লহ গো প্রণাম, বেঁধে দাও হাতে রাখি,
ঐ হেরো শিরে চক্কর মারে বিপ্লব-বাজপাখি।
অন্ধ হয়ো না, বেত্র ছাড়িয়া নেত্র মেলিয়া চাহ—
ঘনায় আকাশে অসন্তোষের বিদ্রোহ-বারিবাহ।
দোতালায় বসি উতলা হয়ো না শুনি বিদ্রোহ-বাণী,
এ নহে কবির, এ কাঁদন ওঠে নিখিল-মর্ম ছানি।
বিদ্রূপ করি উড়াইবে এই বিদ্রোহ-তেতো জ্বালা
সুরের তোমরা, কি করিবে তবু হবে কান ঝালাপালা
অসুরের ভীম অসি-ঝনঝনে, বড় অসোয়াস্তি-কর!
বন্ধু গো এত ভয় কেন? আছে তোমার আকাশ-ঘর!
অর্গল এঁটে সেথা হতে তুমি দাও অনর্গল গালি,
গোপীনাথ মলো? সত্য কি? মাঝে মাঝে দেখো তুলি জালি।
বারীন ঘোষের দ্বীপান্তর আর মির্জাপুরের বোমা,
লাল বাংলার হুমকানি,—ছি ছি এত অসত্য ও মা,
কেমন করে যে রটায় এ সব ঝুটা বিদ্রোহী দল!
সখা গো আমায় ধরো ধরো! মা গো, কত জানে এরা ছল!
সই লো আমার কাতুকুতু-ভাব হয়েছে যে, ঢলে পড়ি!
আঁচলে জড়ায়ে পা চলে না আর, হাত হতে পড়ে ছড়ি!
শ্রমিকের গাঁতি বিপ্লব-বোমা, আ ম’লো তোমরা মরো!
যত সব বাজে বাজখাঁই সুর, মেছুনি-বৃত্তি ধরো!
যারা করে বাজে দুখভোগ ত্যাগ, আর রাজরোষে মরে,
ঐ বোকাদের ইতর ভাষায় গালি দাও খুব করে।
এই ইতরামি বাঁদরামি-আর্ট আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে
হন্যে কুকুর পেট পালি আর হাউ হাউ মরি কেঁদে।
এই শয়তানি করে দিনরাত বলো আর্টের জয়!
আর্ট মানে শুধু বাঁদরামি আর মুখ-ভ্যাংচানো নয়!
আপনার নাক কেটে দাদা এই পরের যাত্রা ভাঙা,
ইহাই হইল আদর্শ আর্ট, নাকি-সুর, কান-রাঙা!
আর্ট ও প্রেমের এই সব মেড়ো মাড়োয়ারি দলই জানে,
কোনো বিদ্রোহ অসন্তোষের রেখা নাই কোনখানে!
সব ভুয়ো দাদা, ও-সবে দেশের কিছুই হইবে নাকো,
এমনই করিয়া জুতো খাও আর মলমল-মল মাখো!
জ্ঞান-অঞ্জন-শলাকা তৈরি হতেছে এদের তরে,
দেখিবে এদের আর্টের আঁটুনি একদিনে গেছে ছুঁড়ে!
বন্ধু গো! গুরু! আঁখি খোলো, খোলো শ্রবণ হইতে তুলা,
ঐ হেরো পথে গুর্খা-সেপাই উড়াইয়া যায় ধূলা!
ঐ শোনো আজ ঘরে ঘরে কত উঠিতেছে হাহাকার,
ভূধর প্রমাণ উদরে তোমার এবার পড়িবে মার!
তোমার আর্টের বাঁশরির সুরে মুগ্ধ হবে না এরা,
প্রয়োজন-বাঁশে তোমার আর্টের আর্টশালা হবে নেড়া!
প্রেমও আছে গুরু, যুদ্ধও আছে, বিশ্ব এমনই ঠাঁই,
ভাল নাহি লাগে, ভাল ছেলে হয়ে, ছেড়ে যাও, মানা নাই!
আমি বলি— গুরু, বলো তাহাদেরে কোন বাতায়ন-ফাঁকে
সজিনার ঠ্যাঙা সজনিরই মত হাতছানি দিয়ে ডাকে!
যত বিদ্রুপই করো গুরু, তুমি জান এ সত্য-বাণী,
কারুর পা চেটে মরিব না; কোনো প্রভু পেটে লাথি হানি
ফাটাবে না পিলে; মরিব যেদিন মরিব বীরের মত,
ধরা-মা’র বুকে আমার রক্ত রবে হয়ে শাশ্বত।
আমার মৃত্যু লিখিবে আমার জীবনের ইতিহাস—
ততদিন সখা সকলের সাথে করে নাও পরিহাস!
‘সর্বনাশের ঘণ্টা’ কবিতার উত্তরে পরলোকগত কবি মোহিতলাল মজুমদার ৮ই কার্তিক ১৩৩১ তারিখের সাপ্তাহিক ‘শনিবারে চিঠি’র বিশেষ বিদ্রোহ সংখ্যায় তার জবাব দেন ‘দ্রোণ-গুরু’ কবিতায়। নিম্নে কবিতাটি সম্পূর্ণ উদ্ধৃত হল—
দ্রোণ-গুরু
[কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধকালে দ্রোণাচার্য কুরু সেনাপতি পদে অভিষিক্ত হইলে, তিনি প্রাচীন ও অকর্মণ্য বলিয়া দ্রোহ-বিদ্বেষী কর্ণের বিদ্বেষ আরও বাড়িয়া যায়। এদিকে দ্রোণ-শিষ্য অর্জুনের কৃতিত্বও ক্রণের দুঃসহ হইয়া ওঠে। এই বিদ্বেষের কথা মহাভারতে উল্লিখিত আছে। কিন্তু নিম্নলিখিত ঘটনাটির কথা মূল মহাভারতে নাই। কর্ণাটদেশে প্রচলিত মহাভারতের তামিল-সংস্করণের একটি গাধা অবলম্বনে এই কবিতা রচিত হইয়াছে। দ্রোণাচার্যের মনে অর্জুনের প্রতি আন্তরিক স্নেহ নষ্ট করিবার জন্য, এবং তাঁহার উপর যাহাতে গুরুর নিদারুণ অভিশাপ বর্ষিত হয় এই উদ্দেশ্যে, অর্জুন কর্তৃক লিখিত বলিয়া একখানি গুরুদ্রোহসূচক কুৎসাপূর্ণ পত্র দ্রোণাচার্যের নিকট প্রেরিত হয়। বলা বাহুল্য, এই কৌশল সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হইয়াছিল।]
কি বলিস তুই অশ্বত্থামা! আমি মরে যাই লাজে!
আমি ব্রাহ্মণ, তবু বলিব না—ক্ষত্রিয়কুল-মাঝে
হেন কাপুরুষ আছে কোনো ঠাঁই—ভীরু, আত্মম্ভরি—
মিথ্যা দম্ভ গর্বের ভরে আপনারে বড় করি
আপনার পূজা ষোড়শোপচারে মাগে যে গুরুর কাছে!
অনুষ্ঠানের ত্রুটি পাছে হয়, সদা সেই ভয় আছে!—
তাহারি লাগিয়া আক্রোশ করি শিষ্য হইয়া বীর
বন্যবরাহ হনন করা সে ঘৃণ্য ব্যাধের তীর
চিৎকার সহ নিক্ষেপ করে বাতাসের সনে রণ—
বলে পাণ্ডব—কৌরব-গুরু আমি সে প্রিয়জন।
পাণ্ডব সেকি? কোন পাণ্ডব? কে বা সে ছন্নমতি?
আমার নিকটে অস্ত্রশিক্ষা!—হায় একি দুর্গতি!
বলে, সে পার্থ!—কৃষ্ণ-সারথী! নব-অবতার নর!
মহাবিপ্লব যুগান্তরের নবীন য]পদের সভাতলে,
মুগ্ধ হইল লক্ষ্যভেদের অপূর্ব কৌশলে;
যার বীরত্বে বিস্মিত নিজে শঙ্কর ত্রিপুরারি—
দানিল দিব্য পাশুপত যারে দানবদহনকারী,
যার প্রতিভায় ব্রাহ্মণ-দ্রোণ ব্রহ্মণ্যের চেয়ে
মানিয়াছে বড় ক্ষাত্র-মহিমা শিষ্য যাহারে পেয়ে,
—এই লিপি তার!—অশ্বত্থামা! হয়েছিস উন্মাদ?
কি কথা বলিস? কে শুনালে তোরে এ হেন মিথ্যাবাদ?
—অর্জুন?—আরে ছিছি, ছিছি ছিছি! তার হেন দুর্মতি!
তার মুখে হেন অনার্য-বীণা!—আপন গুরুর প্রতি,
মিথ্যা রটনা—এই অপবাদ মিথ্যার অভিনয়ে
পটু হবে সেই! অসি ছেড়ে শেষে মসির পাত্র লয়ে
—ছিটাইছে কালি, রণ-অঙ্গনে অঙ্গনা-রীতি ধরে!—
রমণীর মত বাতাসে ভেজায়ে কোন্দল শুরু করে!
বিরাটপুরীর অজ্ঞাতবাসে বৃহন্নলার কথা
মনে আছে বটে—অকীর্তিকর!—সেথাকার বাচালতা
পুরন্ধ্রীদের কুৎসা-কলহ, সেই নট-নটী লীলা
স্বভাব নষ্ট করেছিল বুঝি? আজো অন্তঃশীলা
নপুংসকের বিকৃত শোণিত কিণাঙ্ক-করমূলে
বহিছে নাড়িতে? হায়, হতভাগ্য এখনো যায়নি ভুলে।
গুরুনিন্দার পাতকের ভয় এতটুকু মনে নাই।
আজ তুমি বড়! গুরুমারা চোর! তুমি মহাবীর, তাই
এটা ক্ষুদ্র মশকের হুল সহিতে পারো না তুমি!
—অত্যাচারীর খড়্গ ভাঙিবে, রাখিবে ভারত-ভূমি!
হুলের আঘাতে, কুরুক্ষেত্রে ফেলে দিয়া গাণ্ডীব,
রথ হতে নামি মৃত্তিকা ’পরে মাথা ঠোকে ঢিব্ ঢিব্!
নারায়ণী-সেনা হাসিছে অদূরে, রঙ্গ দেখিছে তারা,
আমার মাথা যে হেঁট হয়ে যায়, পশ্চিমে ঐ কারা—
ফেরুপাল বুঝি—হর্ষিত চিতে চিৎকার করি ওঠে,
সূর্যের মুখে অস্তমলিন হাসি বুঝি ঐ ফোটে।
***
কেন তোর এই অধঃপতন বল্ দেখি, ফাল্গুনি!
এই বিদ্বেষ ঈর্ষার জ্বালা কার তরে বল্ শুনি?
আমি গুরু তোর, একা তোরি গুরু?—আর কেহ নাহি রবে?
আজিকার এই সমরাঙ্গনে যদি কেউ যশ লভে—
রণ-কৌশলে আর কেহ যদি আমারে প্রণাম করি
দূর হতে পায় আমারি শিক্ষা-সাধনার কারিগরি—
ধর্মক্ষেত্রে সে কি অধর্ম? তোমারি হইবে জয়?
তোমার দর্পে আর কেহ যদি হেসে কুটি-কুটি হয়,
সে কি তা মহা ধর্ম-দ্রোহ?—হয় যদি তাই হোক,
তার লাগি মোর অপরাধ কিবা—কেন তায় এত শোক!
আজ দেখিতেছি, একদিন সেই নিষাদের নন্দনে
করেছুনু ঘোর অবিচার আমি মমতা অন্ধ মনে।—
তোমারি লাগিয়া অঙ্গুলি তার চেয়েছিনু দক্ষিণা,
সে পাপের সাজা কেবা দিবে আর ক্রুর অর্জুন বিনা
আজ পুনারায় নবধানুকীর অঙ্গুলি কাটি লয়ে
পাঠাতাম যদি তোমার সকালে—হর্ষে ও বিস্ময়ে
গুরুদেব বলি কত বাখানিতে বৃদ্ধের বীরপনা!
সে আর হবে না আর করিব না ধর্মের বঞ্চনা।
এতকাল ধরি দিয়াছ যে গুরু-ভক্তির পরিচয়,
সেই ভাল ছিল, তার বেশি এ যে হয়ে গেল অতিশয়!
মনে ভেবে দেখো, কিবা মানে তার, কি বুঝিবে রাজগণ,—
ধিক্কারে আজ মুখরিত হল কুরুদের প্রাঙ্গণ।
***
না—না, না—না, না—না, একি এ প্রলাপ বকিতেছি বারবার!
অশ্বত্থামা! ফের পড়, লিপি,—হয়নি পরিষ্কার!
মোর প্রাণাধিক প্রিয়তম সেই কিরীটীর নহে লিপি,
এ লিখেছে কোন কুলশীলহীন পরের প্রসাদজীবী!
লেখার মাঝারে ওঠে না ফুটিয়া সেই মনোহর মুখ,
আজানু-দীর্ঘ সেই বাহু তার, বিরাট বিশাল বুক!
হ্রস্ব খর্ব এ কোন বামন উপানৎ পরি উঁচা
হইবারে চায়, চুরি করা চূড়া মাথায় বেঁধেছে ছুঁচা!
অর্জুন নিজে শ্যাম-কলেবর—কৃষ্ণের সখা সে যে!
সে কি ঘৃণা করে কৃষ্ণবরণ? বধূ কৃষ্ণার তেজে
বাহুতে বীর্য, বক্ষে জাগিল যৌবন-ব্যাকুলতা—
সে করেছে গ্লানি মসীরূপ বলি? সম্ভব নহে কথা!
এ কোন শবর কিরাতের গালি, অনার্য জাতি-চোর!
নকল কুলীন! বর্ণ-গর্বে কুৎসা রটায় মোর!
হয়েছে! হয়েছে! অশ্বত্থামা! জেনেছি এতক্ষণে—
বীরকুলগ্লানি সেই নিন্দুকে এবার পড়েছে মনে!
আমি ব্রাহ্মণ, চির-উজ্জ্বল ব্রাহ্মণ্যের শিখা
ললাটে আমার মিথ্যা-দহন জ্বলে যে সত্যটীকা।
রাজসভাতলে জনগণমাঝে করি না যে বিচরণ;
পথ-কুক্কুর নীচ-সহবাস ত্যাজিয়াছি প্রাণপণ।
তবু যে আমার ধনু নির্ঘোষে টঙ্কার-ঝঙ্গারে
নিজে গায়ত্রী-ছন্দ-জননী আসিয়া দাঁড়ান দ্বারে।
আমরা পর্ণ-কুটিরের তলে রাজার দুলাল বীর—
গড্ডলিকার দল নহে—আসি মাটিতে নোয়ায় শির!
আমি সাধিয়াছি আর্য-সাধনা-সনাতন সুন্দর!—
যে-মন্ত্র-বলে শাশ্বতীসমা সদ্গতি লভে নর!
ত্যাজি অনার্য-সৃষ্টপন্থা, অন্ত্যজ-অনাচার,
ক্ষত্রিয় সাজি ক্ষত্রিয়ে দিছি ব্রাহ্মণ-সংস্কার।
কর্ণপটহ বিদারণ করি, বিদারিয়া নভোতল।
পথে পথে ফিরি ইতরের সাথে করি নাই কোলাহল
যুগ-ধর্মের সুযোগ বুঝিয়া চির-সত্যের গ্লানি
করি নাই কভু,—যশোলিপ্সার—স্বার্থের আপসানি!
নিজ হৃদয়ের পুরীষ-পঙ্ক দুই হাতে ছড়াইয়া
যুগবাণী বলি, ধ্রুব-শাশ্বত পদতলে গুঁড়াইয়া,
যত মূর্খ ও ষণ্ডমার্কে ভক্তশিষ্য করি,
এই দেবতার দিবারে করিনি পিশাচের শর্বরী!
জানিস্ বৎস, কোন মহারথী—এ কোন নূতন গ্রহ,
মোর সাথে চির-শত্রুতা মানি, বিদ্বেষ দুঃসহ
পুষিয়াছে মনে?—বৈরী সে, যথা কৃষ্ণের শিশুপাল!—
সত্যের এই মিথ্যা-বৈরী যুগে যুগে চিরকাল?
আজ আসিয়াছে নূতন ছদ্মে শিষ্যের সাজ পরি—
গুরু-শিষ্যের ভক্তি ও স্নেহ কুৎসার লবে হরি!
চিনেছি তোমারে হে কপটচারী দাম্ভিক দুর্জন!
বক্ষের মণি অর্জুন নও—পাদুকার অর্জুন!
বীর সে পার্থ আর্ত হয় না স্বার্থের সঙ্কোচ,
—গুরুহত্যার পাতকের ভয়ে ললাটের স্বেদ মোছে!
ব্রজ-আঘাতে হয় না কাতর বীর সে সব্যসাচী—
তারে কাবু করে গোটা দুই তিন বাতাসের মশা-মাছি!
তাহারি কারণে উন্মাদ হয়ে করিবে সে গুরুদ্রোহ!
একি পাপ! একি অহংকারের নিদারুণ সম্মোহ!
সে কি পাণ্ডব! দ্রোণের শিষ্য ক্ষত্রিয়-চূড়ামণি!—
খুলে ফেল্ তোর ক্ষত্রিয়-বেশ, ওরে পাণ্ডব-শনি!
রাধেয় কর্ণ পরিচয় তোর। আর যাহা পরিচয়—
গুরু ভার্গবে প্রতারণা করি সেজেছিলি শ্রোত্রিয়!
সেই কীট তোরে ছাড়িল না আজও। সেদিন পড়িলি ধরা
দংশন সহি।—আজ বিপরীত—হলি যে অর্ধমরা!
জমদগ্নির অভিশাপ বহি পলায়ে আসিলি চোর!
জাতি আপনার লুকাতে নারিলি, লজ্জা নাহি যে তোর!
দ্রোণ-গুরু নয়, সার্থক তোর গুরু সে পরশুরাম—
বিস্ময় মানি দম্ভে তোমার—রেখেছ গুরুর নাম!
***
ওরে নির্ঘ্ণ! আপনি আপন বিষ্ঠার পর্বতে
চড়ি বসিয়াছ—মনে করিয়াছ আঁধারিবে হেন মতে
সবিতার মুখ! ঘোর যশো-রবি-রাহু হতে সাধ যায়!
আরে, আরে, তোর সম্পর্ধায় দেখি জোনাকিও লাজ পায়!
কেমনে আনিলি হেন কথা মুখে? যজ্ঞের হবিটুকু
সন্তর্পণে রাখিয়াছি ঢেকে, তাও হেরি চাকু-চুকু
করিয়া লেহন, সাধ যায়—সেথা উগারিতে একরাশি
অমেধ্য যে সব উদরে রাজিছে—কতকালকার বাসি,
চুরি করা যত গরহজমের!—পথে প্রান্তরে যার
সৌরভ পেয়ে এতদিন পরে ভরিয়াছে সংসার
লালা ও পঙ্কবিলাসীর দল—শবভুক নিশাচর,
শকুনি, গৃধিনী, শৃগালের পাল—রসনা-তৃপ্তিকর
পাইয়াছ ভোজ! ভাবিয়াছ বুঝি সেই রস উপাদেয়?
দেব-যজ্ঞের আহুতি সে ঘৃত সোমরস হবে হেয়?
উন্মাদ—তুই উন্মাদ! তাই পতনের কালে আজ
বিষ-বিদ্বেষ উথলি উঠেছে, নাই তোর ভয় লাজ!
আমারে করেছে কুরু-সেনাপতি কৌরব-নৃপমণি,
তাই হিংসায় পুরীষ-ভাণ্ডে মাছি ওঠে ভনভনি!
তাই তাড়াতাড়ি পার্থের নামে কুৎসার ছল ধরে
তারি নামে লিপি পাঠালি আমারে কুৎসিত গালি ভরে
আমি ব্রাহ্মণ, দিব্যচক্ষে দুর্গতি হেরি তোর—
অধঃপাতের দেরি নাই আর, ওরে হীন জাতি-চোর!
আমার গায়ে যে কুৎসার কালি ছড়াইলি দুই হাতে—
সব মিথ্যার শাস্তি হবে সে এক অভিসম্পাতে,
গুরু ভার্গব দিল যা তুহারে! ওরে মিথ্যার রাজা।
আত্মপূজার ভণ্ড পূজারী! যাত্রার বীর সাজা
ঘুচিবে তোমার, মহাবীর হওয়া মর্কট-সভাতলে!
দুর্দিনের এই মুখোশ-মহিমা তিতিবে অশ্রুজলে!
অভিশাপরূপী নিয়তি করিবে নিদারুণ পরিহাস
চরমক্ষণে মেদিনী করিবে রথের চক্র গ্রাস!
মিথ্যায় ভুলি যে মহামন্ত্র গুরু দিয়েছিল কানে,
বড় প্রয়োজনে পড়িবে না মনে, সে বিফল সন্ধানে
নিজেরি অস্ত্র নিজেরে হানিবে—শেষ হবে অভিনয়,
এতদিন যাহা নেহারি সকলে মেনেছিল বিস্ময়!
‘বিদায়-মাভৈ’ ১৩৩০ চৈত্রের ‘প্রবাসী’তে এবং ‘বাংলার মহাত্মা’ ১৩৩২ জ্যৈষ্ঠে ৫ম বর্ষের ২৬শ সংখ্যক ‘বিজলী’তে প্রকাশিত হয়েছিল।
‘অশ্বিনীকুমার’ ২১শে মাঘ ১৩৩২ মুতাবিক ৪ঠা জানুয়ারি ১৯২৬ তারিখে ‘লাঙল’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। রবিশালের কর্মযোগী অশ্বিনীকুমার দত্তের মৃত্যুতে এই শোক-কবিতা রচিত।
‘ইন্দু-প্রয়াণ’ কবিতাটির ২৪শ চরণ কবিপত্নী প্রমীলা নজরুল ইসলাম কর্তৃক প্রকাশিত সংস্করণে মুদ্রিত আছে এইরূপ—
এবারে হে কবি করিব পূর্ণ এ চির-কবি পুরে! …
এই পঙ্ক্তিটি প্রথম সংস্করণে ছিল এইরূপ—
এবার হে কবি করিব পূর্ণ ঐ চির-কবি পুরে! …
‘দিল-দরদী’ ১৩২৮ আশ্বিনের ‘মোসলেম-ভারতে’ প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে কবিতার শেষ দুই চরণ ছিল এরূপ—
বাদশা কবি! সালাম জানায় বুনো তোমার ছোট্ট ভাই!
কইতে গিয়ে অশ্রুতে মোর যায় ডুবে যায় সব কথাই।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ১০ই আষাঢ় মুতাবিক ১৯২২ খৃষ্টাব্দের ২৫শে জুন রাত্রি ২৷৷৹ (আড়াইটায়) দুরন্ত ব্রঙ্কাইটিস্ রোগে দেহত্যাগ করেন। তাঁর স্মরণে নজরুল ইসলাম ১৩২৯ শ্রাবণে দ্বিতীয় বর্ষ ৩৩শ সংখ্যক ‘বিজলী’তে লেখেন ‘সত্যেন্দ্র-প্রয়াণ’ কবিতা।
‘সত্য-কবি’ ভারতী পত্রিকায় ‘কবি সত্যেন্দ্র’ শিরোনামে এবং ‘সত্যন্দ্র-প্রয়াণ-গীতি’ মাসিক বসুমতীতে ‘প্রত্য-প্রয়াণ-গীতি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ‘ভারতী’ হতে ‘কবি সত্যেন্দ্র’ ১৩২৯ আষাঢ়ের ‘উপাসনা’য় উদ্ধৃত হয়েছিল।
‘অন্তর-ন্যাশনাল-সঙ্গীত’, ‘রক্ত-পতাকার গান’ ও ‘জাগর-তূর্য’ যথাক্রমে ১৩৩৪ সালের ৮ই বৈশাখ, ১৫ই বৈশাখ ও ২২শে বৈশাখ তারিখের ‘গণবাণী’তে প্রকাশিত হয়েছিল।
‘যুগের আলো’ ১৩৩৩ ফাল্গুনের ‘যুগের আলো’তে এবং ‘পথের দিশা’ ‘অগ্রদূত’-এ প্রকাশিত হয়েছিল।
‘যা শত্রু পরে পরে’ ১৩৩৩ আশ্বিনে বর্ধমানের ‘শক্তি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল; ‘শক্তি’ হতে ২৫শে আশ্বিন ১৩৩৩ তারিখে ‘গণবাণী’তে উদ্ধৃত হয়েছিল।