» » অশ্বিনীকুমার

অশ্বিনীকুমার

আজ যবে প্রভাতের নব যাত্রীদল

ডেকে গেল রাত্রিশেষে, ‘চল আগে চল’, –

‘চল আগে চল’ গাহে ঘুম-জাগা পাখি,

কুয়াশা-মশারি ঠেলে জাগে রক্ত-আঁখি

নবারুণ নব আশা। আজি এই সাথে,

এই নব জাগরণ-আনা নব প্রাতে

তোমারে স্মরিনু বীর প্রাতঃস্মরণীয়!

স্বর্গ হতে এ স্মরণ-প্রীতি অর্ঘ্য নিও!

নিও নিও সপ্তকোটি বাঙালির তব

অশ্রু-জলে স্মৃতি-পূজা অর্ঘ্য অভিনব!

আজও তারা ক্রীতদাস, আজও বদ্ধ-কর

শৃঙ্খল-বন্ধনে দেব! আজও পরস্পর

করে তারা হানাহানি, ঈর্ষা-অস্ত্রে যুঝি

ছিটায় মনের কালি-নিরস্ত্রের পুঁজি!

মন্দভাষ গাঢ় মসি দিব্য অস্ত্র তার!

‘দুই-সপ্ত কোটি ধৃত খর তরবার’

সে শুধু কেতাবি কথা, আজও সে স্বপন!

সপ্তকোটি তিক্ত জিহ্বা বিষ-রসায়ন

উদ্গারিছে বঙ্গে নিতি, দগ্ধ হল ভূমি!

বঙ্গে আজ পুষ্প নাই, বিষ লহো তুমি!

কে করিবে নমস্কার! হায় যুক্তকর

মুক্ত নাহি হল আজও! বন্ধন-জর্জর

এ কর পারে না দেব ছুঁইতে ললাট!

কে করিবে নমস্কার?

কে করিবে পাঠ

তোমার বন্দনা-গান? রসনা অসাড়!

কথা আছে বাণী নাই ছন্দে নাচে হাড়!

ভাষা আছে আশা নাই, নাই তাহে প্রাণ,

কে করিবে এই জাতিরে নবমন্ত্র দান!

অমৃতের পুত্র কবি অন্নের কাঙাল,

কবি আর ঋষি নয়, প্রাণের আকাল

করিয়াছে হেয় তারে! লেখনী ও কালি

যত না সৃজিছে কাব্য ততোধিক গালি!

কণ্ঠে যার ভাষা আছে অন্তরে সাহস,

সিংহের বিবরে আজ পড়ে সে অবশ!

গর্দান করিয়া উঁচু যে পারে গাহিতে

নব জীবনের গান, বন্ধন-রশিতে

চেপে আছে টুঁটি তার! জুলুম-জিঞ্জির

মাংস কেটে বসে আছে, হাড়ে খায় চিড়

আর্ত প্রতিধ্বনি তার! কোথা প্রতিকার!

যারা আছে—তারা কিছু না করে নাচার!

নেহারিব তোমারে যে শির উঁচু করি,

তাও নাহি পারি, দেব! আইনের ছড়ি

মারে এসে গুপ্ত চেড়ী। যাইবে কোথায়!

আমার চরণ নহে মম বশে, হায়!

এক ঘর ছাড়ি আর ঘরে যেতে নারি,

মর্দজাতি হয়ে আছে পর্দা-ঘেরা নারী!

এ লাঞ্ছনা, এ পীড়ন, এ আত্মকলহ,

আত্মসুখপরায়ণ পরাবৃত্তি মোহ–

তব বরে দূর হোক! এ জাতির ’পরে

হে যোগী, তোমার যেন আশীর্বাদ ঝরে!

যে-আত্মচেতনা-বলে যে আত্মবিশ্বাসে

যে-আত্মশ্রদ্ধার জোরে জীবন উচ্ছ্বাসে

উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে মরা জাতি বাঁচে,

যোগী, তব কাছে জাতি সেই শক্তি যাচে!

স্বর্গে নহে, আমাদের অতি কাছাকাছি

আছ তুমি হে তাপস, তাই মোরা যাচি

তব বর, শক্তি তব! জেনেছিলে তুমি

স্বর্গাদপি গরীয়সী এই বঙ্গভূমি!

দিলে ধর্ম, দিলে কর্ম, দিলে ধ্যান জ্ঞান,

তবু সাধ মিটিল না, দিলে বলিদান

আত্মারে জননি-পদে, হাঁকিলে, ‘মাভৈঃ!

ভয় নাই, নব দিনমণি ওঠে ওই!

ওরে জড়, ওঠ্ তোরা!’ জাগিল না কেউ,

তোমারে লইয়া গেল পারাপারী ঢেউ।

অগ্রে তুমি জেগেছিলে অগ্রজ শহীদ,

তুমি ঋষি, শুভ প্রাতে টুটেছিল নিদ,

তব পথে যাত্রী যারা রাত্রি-দিবা ধরি

ঘুমাল গভীর ঘুম, আজ তারা মরি

বেলাশেষে জাগিয়াছে! সম্মুখে সবার

অনন্ত তমিস্রাঘোর দুর্গম কান্তার!

পশ্চাতে ‘অতীত’ টানে জড় হিমালয়,

সংশয়ের ‘বর্তমান’ অগ্রে নাহি হয়,

তোমা-হারা দেখে তারা অন্ধ ‘ভবিষ্যৎ’,

যাত্রী ভীরু, রাত্রি গুরু, কে দেখাবে পথ!

হে প্রেমিক, তব প্রেম বরিষায় দেশে

এল ঢল বীরভূমি বরিশাল ভেসে।

সেই ঢল সেই জল বিষম তৃষায়

যাচিছে ঊষর বঙ্গ তব কাছে হায়!

পীড়িত এ বঙ্গ পথ চাহিছে তোমার,

অসুর নিধনে কবে আসিবে আবার!

হুগলি,

মাঘ, ১৩৩২