পঞ্চম অধ্যায় : শৈশব ও কৈশোর : ১৯৪৪-১৯৫৯

জন্মদিন

সরকারের নথি অনুসারে আমার জন্মদিন ২ আগস্ট, ১৯৪৪ সাল। আমার প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রত্যয়নপত্রে এই জন্মতারিখ লিপিবদ্ধ আছে। এই হিসাবের ভিত্তিতেই আমি সরকারি চাকরিতে যোগ দিই এবং এর ভিত্তিতে ৫৭ বছর বয়স পূর্তিতে আমি ২০০১ সালে ১ আগস্ট সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করি। কিন্তু আমার বাবা-মা সব সময়ই বলতেন যে এটি আমার জন্মতারিখ মোটেও নয়। মায়ের মতে শ্রাবণ মাসে আমার জন্ম হয়নি। আমার জন্ম হয়েছিল হাড়কাঁপানো শীতে। কাজেই কোনোমতেই আগস্ট মাসে আমার জন্ম হয়নি। তাহলে আমার জন্মদিন নিয়ে এমন অঘটন কেন ঘটল?

আমার মা বলতেন, কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন নবীনগর স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক বাবু বিহারীলাল চক্রবর্তী। তখন নাকি ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখে প্রবেশিকা পরীক্ষার্থীর সাড়ে ১৪ বছর বয়স না হলে সে বছর পরীক্ষা দেওয়া যেত না। অর্থাৎ আগস্টের পর কারও জন্ম হলে তাকে প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য আরও এক বছর বসে থাকতে হবে। প্রধান শিক্ষক বিধাতাকে অগ্রাহ্য করে কেরানি বাবুকে হুকুম দিলেন এর জন্মদিন ২ আগস্ট লিখে দাও। তাই আমার জন্মদিন ২ আগস্ট।

হিন্দুদের একটি সুবিধা আছে। বেশির ভাগ সচ্ছল হিন্দুই তাদের সন্তানদের কুষ্ঠি তৈরি করে। কুষ্ঠিতে সঠিক জন্মদিন লিপিবদ্ধ করা হয়। কিন্তু মুসলমানদের কোনো কুষ্ঠি নেই। তাই মুসলমানদের জন্মদিন অনেকাংশেই সঠিক হয় না।

তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বেশির ভাগ নিম্নমধ্যবিত্ত মুসলমান ঘরে জন্মদিন পালন করা হতো না। জন্মদিন নিয়ে তাই কোনো আগ্রহও ছিল না। তবে সম্প্রতি জন্মদিন নিয়ে অনেক ঘটা বেড়েছে। তাই আমার মেয়ে একদিন আমার মাকে পাকড়াও করে আমার সঠিক জন্মতারিখ বলার জন্য। আমার মা অনেক চিন্তা করে বলেন সে সময়ে প্রচণ্ড শীত ছিল, সম্ভবত সেটা ডিসেম্বরের শেষ দিক ছিল এবং খুব সম্ভব তারিখটা ছিল ২৫ ডিসেম্বর। আমার মেয়ে ২৫ ডিসেম্বর তারিখে আমার জন্মোৎসব পালনের ব্যবস্থা করে। কিন্তু আমি কোনোমতেই ২৫ ডিসেম্বরকে আমার জন্মদিন হিসেবে মানতে রাজি নই। ২৫ ডিসেম্বর আরও দুজন মহাপুরুষের জন্মতারিখ। যিশুখ্রিষ্টের জন্মতারিখ ২৫ ডিসেম্বর উদ্‌যাপন করা হয়ে থাকে। অথচ পণ্ডিতেরা বলছেন যিশুখ্রিষ্টের জন্ম ২৫ ডিসেম্বর হয়নি। যিশুর জন্মতারিখ নির্ণয়ে একটি বড় সমস্যা হলো যিশুর জন্মের পর প্রথম ৪০০ বছরে তাঁর জন্মদিন উদযাপিত হয়নি, কেননা রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিষ্টধর্ম বেআইনি ছিল। পণ্ডিতেরা বলছেন যে যিশুর সম্ভাব্য জন্মতারিখ হচ্ছে ২০ মে, ২১ মার্চ, ১৫ এপ্রিল, ২০ অথবা ২১ এপ্রিল। অর্থাৎ শীতকালে যিশুর জন্ম হয়নি। ২৫ ডিসেম্বর সূর্যদেবতার জন্মদিন। এই সূর্যদেবতার জন্মদিনকে যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন হিসেবে চালু করা হয়েছিল।[১]

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দাবি করতেন যে তাঁর জন্ম হয়েছে ১৮৭৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর। তাঁর জীবনীকার স্ট্যানলি ওয়ালপার্ট দেখিয়েছেন যে এই তথ্য সম্পূর্ণ ভুল। ১৮৮৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর জিন্নাহ করাচির মাদ্রাসাতুল ইসলামে ভর্তি হন। এই মাদ্রাসার নিবন্ধনের খাতা থেকে দেখা যায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভাইয়ের জন্মতারিখ হলো ২০ অক্টোবর ১৮৭৫। পরবর্তীকালে জিন্নাহ এ-সম্পর্কিত সব তথ্যই পরিবর্তন করলেন। মুহাম্মদ আলীর স্থলে লিখলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভাইকে ছোট করে লিখলেন জিন্নাহ। মাদ্রাসায় জিন্নার জন্মসাল ছিল ১৮৭৫। জিন্নাহ তা প্রায় ১৪ মাস কমিয়ে ১৮৭৬ সালে নিয়ে এলেন। জন্মতারিখ ২০ অক্টোবরের স্থলে ২৫ ডিসেম্বর নির্ধারণ করলেন।

২৫ ডিসেম্বর যিশুখ্রিষ্ট বা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর জন্মদিন ছিল না। ২৫ ডিসেম্বর আমার জন্মদিনও নয়। দুর্ভাগ্যবশত আমার জন্মতারিখ সম্পর্কে কোনো লিখিত প্রমাণ নেই। আমার পিতাও আমার জন্মতারিখ সঠিকভাবে স্মরণ করতে পারেননি। তবে আমার বাবা-মা এবং অন্য মুরব্বিরা আমার জন্ম সম্পর্কে দুটি বিষয়ে একমত ছিলেন। প্রথমত, আমার জন্ম হয়েছিল শীতকালে। তখন প্রচণ্ড শীত ছিল। দ্বিতীয়ত, আমার জন্ম হয়েছিল হজে আকবরির দিন। নবীনগরের কাজী সাহেব আমার জন্মের পর আজান দিয়েছিলেন এবং তিনিই হজে আকবরির স্মরণে আমার নাম আকবর আলি খান রাখার প্রস্তাব দেন।

হজে আকবরি প্রতিবছর পালিত হয় না, যে বছর হজের দিন শুক্রবার হয়, সেই হজ হজে আকবরির হজ হয়। হজে আকবরি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি সৌদি রাজপরিবারের অনুষ্ঠান। ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে সব হজই হলো হজে আকবরি বা বড় হজ। এছাড়া অনেক মুসলমান কাবা শরিফে ওমরা করেন। ওমরাকে ছোট হজ বলা হয়ে থাকে।

হজে আকবরির সূত্র ধরে আমার জন্মতারিখ সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি। সেসব তথ্য সারণি ৫.১-এ দেখা যাবে।

সারণি ৫.১

জিলহজ মাস সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য, ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দ

খ্রিষ্টাব্দ ১ জিলহজ ও বার আরাফাতের দিন এবং বার কোরবানির দিন এবং বার
১৯৪৩ ২৮ নভেম্বর, সোমবার ৭ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার ৮ ডিসেম্বর, বুধবার
১৯৪৪ ১৭ নভেম্বর, শুক্রবার ২৫ নভেম্বর, শনিবার ২৬ নভেম্বর, রোববার
১৯৪৫ ৬ নভেম্বর, মঙ্গলবার ১৪ নভেম্বর, বুধবার ১৫ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার

উৎস : https://www.al-habib.info/islamic-calendar/global-islamic-calendar year-1943-ce.htm

সারণি ৫.১ থেকে দেখা যাচ্ছে ১৯৪৩, ১৯৪৪ বা ১৯৪৫ সালে আরাফাতের দিন ছিল মঙ্গলবার, শনিবার ও বুধবার আর কোরবানির দিন ছিল যথাক্রমে বুধবার, রোববার ও বৃহস্পতিবার। দেখা যাচ্ছে ১৯৪৪ সালে ১৩৬৩ হিজরি জিলহজ মাসের প্রথম দিন শুক্রবার ছিল। খ্রিষ্টান পঞ্জিকাতে তারিখটি ছিল ১৭ নভেম্বর। ১৭ নভেম্বর তারিখ আমার জন্মদিন হয়ে থাকলে তা আমার বাবা-মা ও মুরব্বিদের বর্ণনার সঙ্গে একেবারে অভিন্ন। দিনটি ছিল নভেম্বরের শেষ দিকে। ওই সময়ে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে শীত পড়ে। হজে আকবরি ছিল রাজপরিবারের অনুষ্ঠান। হজে আকবরিতে সৌদি বাদশাহকে প্রত্যেক হাজিকে উপহার দিতে হতো। সৌদি বাদশাহ ইচ্ছা করলে ১ জিলহজ শুক্রবার হলে হজে আকবরি পালন করতে পারেন। তবে এটি হয়েছিল কি না, সে সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মনে হয় ২ আগস্ট বা ২৫ ডিসেম্বরের চেয়ে ১৭ নভেম্বর আমার জন্মদিন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে মোটামুটিভাবে আমার জন্ম ১৯৪৪ সালের নভেম্বর কিংবা ডিসেম্বর মাসে হয়েছে বলে মনে হয়।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. McGowan, Andrew, How December 25 became Christmas, 2009, www.Plaintruthmagazine. Blogspot. Com/2009/12