ভালো বইয়ের সন্ধান

আসলে আমার একই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে ভালো লাগত না। আমি নতুন নতুন বিষয় পড়তে চাইতাম। নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইতাম। আমি যে সময়ের ছাত্র, সে সময়ে নতুন বিষয় সম্পর্কে জানার সুযোগ ছিল সীমিত। আমাদের স্কুলে একটি পাঠাগার ছিল, যেখানে রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ইসলামের অনেক বই ছিল। ইংরেজি কিছু কবিতা ও উপন্যাসের বই ছিল, ইতিহাস সম্বন্ধে খোদা বক্স ও আমীর আলীর বই ছিল। স্কুল পাঠাগারে উপন্যাসও ছিল কিন্তু পাঠাগারের দায়িত্বে নিযুক্ত শিক্ষক আমাদের উপন্যাস এবং ছোটগল্পের বই পড়তে দিতে চাইতেন না। এর ফলে স্কুলের পাঠাগারে বই থাকা সত্ত্বেও আমরা যথেষ্ট বই পড়তে পারিনি। আমি তাই বইয়ের জন্য আরেকটি বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধান করি। তখন নবীনগর বাজারে দুটি বইয়ের দোকান ছিল। একটি দোকানে শুধু পাঠ্যপুস্তক বিক্রি হতো, আরেকটি দোকানে পাঠ্যপুস্তক ছাড়া অন্যান্য বইও বিক্রি হতো। দ্বিতীয় দোকানটির মালিক ছিলেন আলিয়াবাদ গ্রামের মঙ্গল মিয়া নামের এক ভদ্রলোক। এই দোকানের একজন অংশীদার ছিল আলিয়াবাদ গ্রামেরই লিল মিয়া নামের একজন তরুণ। তিনি আমার চেয়ে বয়সে চার-পাঁচ বছরের বড়। তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। স্কুল যখন বন্ধ থাকত, তখন এই বইয়ের দোকানে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের বই পড়তাম। তখন পর্যন্ত সব ক্লাসের জন্য সরকার প্রকাশিত একই পাঠ্যপুস্তক নির্ধারিত হয়নি। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের পাঠ্যপুস্তক পড়লেও অনেক বিষয় সম্বন্ধে ভালো ধারণা হতো।

এ সময় আমাদের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। বাবা ঢাকার নবাবের রিটেইনার হিসেবে বেতন পেতেন। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়াতে রিটেইনারের কাজ চলে যায়। নবীনগর কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির সম্পাদক হিসেবে মাসিক সম্মানী পেতেন। মুসলিম লীগ দলের হওয়াতে ১৯৫৪ সালের পর তাকে আর সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়নি। এর ফলে এই সূত্র থেকেও আয় বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া তিনি আদালতে মামলা পরিচালনা করে অর্থ উপার্জন করতেন। এই সময় সারা দেশে যথেষ্ট মুন্সেফ ছিল না। এর ফলে বেশির ভাগ সময়ই নবীনগর আদালতে কোনো মুন্সেফ থাকত না। তাই বাবার আয় অনেক কমে যায়। তবু বাবা আমাদের শিক্ষার জন্য কার্পণ্য করেননি। তিনি আজাদ পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। আজাদ পত্রিকা ঢাকায় প্রকাশের পরদিন সন্ধ্যার সময় নবীনগরে পৌঁছাত। সন্ধ্যার সময় পোস্ট অফিসে গেলে সেখান থেকে আজাদ পত্রিকা এনে ঢাকার এক দিন পর আমরা সেটা পড়তে পারতাম। যদি সন্ধ্যায় পোস্ট অফিস থেকে পত্রিকা সংগ্রহ না করা হতো, তাহলে তার পরের দিন অর্থাৎ ঢাকায় প্রকাশের দুদিন পর দৈনিক পত্রিকা পড়তে হতো। তাই প্রায়ই আমি সন্ধ্যার সময় পত্রিকার জন্য পোস্ট অফিসে যেতাম। আমার পিতা লাহোর থেকে প্রকাশিত ইসলামিক লিটারেচার নামে একটি সাময়িকীর গ্রাহক ছিলেন। আমি যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি, তখন আমার উৎসাহে আমরা মাসিক মোহাম্মদীর গ্রাহক হই। দুই বছর নিয়মিত মাসিক মোহাম্মদী পড়েছি।

নবীনগর স্কুলে তখন পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়ার জন্য ছাত্রদের মোটেও উৎসাহ দেওয়া হতো না। তবু যখন আমি ক্লাস নাইনে উঠি, তখন কিছু অতিরিক্ত বই সংগ্রহের প্রয়োজনবোধ করি। আমার মাকে এ কথা জানালে তিনি বই কেনার জন্য আমাকে ১০ টাকা দিতে রাজি হন। কিন্তু নতুন বই কিনলে চলবে না, পুরোনো বই কিনতে হবে।

তখন আমাদের অঞ্চলে পুরোনো বইয়ের একমাত্র বাজার ছিল শ্রীঘর হাটে। শ্রীঘর হাট নবীনগর থেকে প্রায় ৯ মাইল দূরে অবস্থিত এবং পায়ে হাঁটা ছাড়া যাতায়াতের আর কোনো উপায় ছিল না। একই দিনে সেখানে হেঁটে যাওয়া এবং আসা আমার মতো কিশোরের পক্ষে তখন বেশ শক্ত ছিল। মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে আমি শ্রীঘরের চার মাইল দূরে অবস্থিত শাহবাজপুর গ্রামে আমার ফুফুর বাড়িতে যাই। আমার সঙ্গে ছিল বাসার চাকর কাসেম। পরদিন সকালে ভালো করে নাশতা খেয়ে আমরা শ্রীঘর বাজারে যাই। মহিষ, গরু, ছাগল, হাঁস-মোরগের জন্য শ্রীঘর বাজার ছিল বিখ্যাত। যারাই এ ধরনের গৃহপালিত পশুপাখি কিনতে চাইত, তারাই শ্রীঘর বাজারে যেত। আরেকটি অংশে বই পাওয়া যেত। বইয়ের বাজার ছিল বিরাট। এই বইয়ের বাজার ঘুরে আমি পাঁচ-ছয়টি বই কিনেছিলাম। একটি বই ইতিহাসসংক্রান্ত, আরেকটি বই ভূগোলসংক্রান্ত। বাংলা রচনার এবং ইংরেজি রচনার দুটি বই ও ইংরেজি অনুবাদের একটি বই কিনি। রাতে ফিরে ফুফুর বাড়িতে থেকে পরদিন নবীনগরে ফিরে আসি।

ওই সময় আমার মা আমাকে বোঝান, আমাদের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে গেছে। তাই বৃত্তি না পেলে ওপরের ক্লাসে পড়া শক্ত হবে। বৃত্তি পেতে হলে কত ভালো করতে হবে এবং কত নম্বর পেতে হবে, সে সম্পর্কে আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তবে বাংলা সাহিত্য, ইতিহাস এবং ভূগোলে আমার গভীর আগ্রহ ছিল। আমি আশা করতাম এ তিনটি বিষয়ে আমি খুব ভালো নম্বর পাব। এ বিষয়গুলো সম্বন্ধে যখন যেখানে কোনো নতুন তথ্য পাওয়া যেত, আমি সেগুলো সংগ্রহ করে নোট লিখতাম। আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি, তখন একদিন নবীনগরের বড় বাজারে সাহাদের দোকানে কিছু একটা কিনতে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি তিন বছর আগে ইতিহাসের ম্যাট্রিক পরীক্ষার খাতা দিয়ে ঠোঙা বানানো হচ্ছে। আমি খাতাগুলো পড়ার চেষ্টা করলাম। দোকানদার বললেন যে এখানে দাঁড়িয়ে খাতা দেখলে তার বেচাকেনার অসুবিধা হবে। আমি তখন বেশি নম্বর পেয়েছে, তিন বছর আগের ইতিহাসের ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থীদের এ রকম প্রায় এক সের খাতা কিনে নিয়ে চলে আসি। এ খাতাগুলো পড়ে অনেক সুন্দর কোটেশন দেখতে পাই। আমি আমার ইতিহাসের নোটে এই কোটেশনগুলো ব্যবহার করি।

নবীনগর স্কুলের লেখাপড়া নিয়ে আমার মা যত চিন্তিত ছিলেন, তার চেয়ে বেশি চিন্তিত ছিলেন আমরা শহরে গিয়ে সেখানকার ছাত্রদের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারব কি না, তাই নিয়ে। এ ব্যাপারে আমার মা খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। সে জন্য প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে আমার মা আমাকে এবং আমার ছোট ভাই। জিয়াউদ্দিন খানকে বাসার চাকর কাসেমের সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে বেড়াতে পাঠাতেন। কোনো বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে আমরা উঠতাম আমার ছোট খালার বাড়ি, আবার কোনো বছর উঠতাম আমার ফুফাতো ভাই সমবায় বিভাগে কর্মরত সৈয়দ মোজাফফর আলীর বাসায়। প্রতিবারই আমরা রাতে সিনেমা দেখতে যেতাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিনেমা হলেই আমি প্রথম সুচিত্রা উত্তমের সাগরিকা, সবার ওপরে ইত্যাদি ছবি দেখি। ছবি দেখা ছাড়াও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমরা কৃষিশিল্প প্রদর্শনী দেখতে যেতাম। এভাবে আমার মা আমাদের শহরবাসের জন্য প্রস্তুত করেন।