পঞ্চাশের দশকের রাজনীতি

আমার কৈশোরের স্মৃতি দুই পর্যায়ের। প্রথমত, ওই সময়ে রাজনীতি নিয়ে। আমার কিছু স্মৃতি রয়েছে। দ্বিতীয়ত, স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি আমি কীভাবে বড় হয়ে উঠেছিলাম তার স্মৃতি রয়েছে। প্রথমে রাজনীতির স্মৃতি উল্লেখ করি। ১৯৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয়, তখন আমার বয়স সাড়ে আটের মতো। তখন স্কুলের ছাত্রদের মিছিল হয়েছিল, যা ঝাপসাভাবে মনে পড়ে। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে দেশে রাজনীতি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ওই সময়ে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। নবীনগরে আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন আবুল খায়ের রফিকুল হোসেন। তিনি প্রায়ই নবীনগর বাজারে অথবা নারায়ণপুর ঈদগাহে সভা করতেন। সেই সভায় তিনি নুরুল আমিন। সরকারের সব কুকীর্তি বর্ণনা করতেন। একবার তিনি নির্বাচনের প্রচারণার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নবীনগর নিয়ে যান। আমি সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে ডাকবাংলোতে ইজিচেয়ারে বসে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি। একবার মাওলানা ভাসানীকেও নবীনগর নিয়ে যাওয়া হয়। আমি স্কুলের মাঠে তার বক্তৃতা শুনেছি।

মুসলিম লীগের পক্ষ থেকেও প্রচারণার চেষ্টা করা হয়েছে। নবীনগরে প্রায়ই আসতেন দেবীদ্বারের এমপি ও নুরুল আমিন মন্ত্রিসভার সদস্য মফিজউদ্দিন আহমদ। এ ছাড়া একবার সি-প্লেনে করে নবীনগর এসেছিলেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন। আমার বাবা তখন নবীনগর মুসলিম লীগের সভাপতি। তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে নদী থেকে বিরাট একটি নৌকায় করে সংবর্ধনা দিয়ে নবীনগর নিয়ে আসেন। নবীনগরে যখনই কোনো মুসলিম লীগ নেতা আসতেন, তারা আমাদের বাসায়ই খাওয়াদাওয়া করতেন। তারপর তারা স্কুলের মাঠে জনসভা করতেন।

১৯৫৪ সালে নির্বাচনের সময় নবীনগর আসনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। নেজামে ইসলাম পার্টি তখন যুক্তফ্রন্টের একটি অঙ্গ দল ছিল। নেজামে ইসলাম পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুসলেহ উদ্দিন সাহেব নবীনগর আসনে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন চান। তাকে মনোনয়ন না দেওয়া হলে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত যুক্তফ্রন্ট তাকে মনোনয়ন দেয়। কিন্তু এই আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন আওয়ামী লীগের আবুল খায়ের রফিকুল হোসেন। তিনি তখন মাওলানা ভাসানীর স্বাক্ষর করা লিফলেট বাজারে ছাড়লেন যে এই কথা বলে যে রফিকুল হোসেনই হলেন যুক্তফ্রন্টের আসল প্রার্থী। সম্ভবত সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নামেও আরেকটি লিফলেট দেওয়া হয়। ওই সময় একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন আলমনগর গ্রামের আবুল হাসেম নামের একজন প্রধান শিক্ষক। তিনি তলোয়ার প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন এবং তার মিছিলে তিনি সব সময় তলোয়ার হাতে আগে আগে হাঁটতেন।

নির্বাচনে মুসলিম লীগ থেকে প্রার্থী ছিলেন আমার চাচা অর্থাৎ বাবার চাচাতো ভাই মুসলেহ উদ্দিন খাঁ। নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হলে দেখা গেল বিপুল ভোটে রফিকুল হোসেন জয়ী হয়েছেন এবং বাকি সব প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন।

নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলেও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকেরা যুক্তফ্রন্টের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি করে। কয় দিন পরপর কখনো শেরেবাংলার নেতৃত্বে, কখনো আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে, কখনো আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। আবু হোসেন। সরকারের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভায় নবীনগরের পার্শ্ববর্তী বাঞ্ছারামপুর

নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত সদস্য এ কে এম জহিরুল ইসলাম স্বাস্থ্যমন্ত্রী। পদে নিযুক্ত হন। তখন তিনি একবার নবীনগর এসেছিলেন। আমি তাঁর বক্তৃতা শুনতে যাই। তিনি খুব হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমে তার বক্তব্য পেশ করতেন। তাঁর ডাকনাম ছিল লিল মিয়া। তিনি তার বক্তৃতায় বলেন, ‘ভাইসব, আমার বাবা বলতেন খোদার লীলা কী বুঝব আমি আমার লিলার লীলাই বুঝি না। এই লিলাও কয়েক দিন আগে বুঝতে পারে নাই কী হয়েছে। গভর্নরের অফিস থেকে আমাকে রাতের বেলায় ফোন করল যে সকালে গভর্নর হাউসে যেতে হবে। সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার বাড়ির চারদিকে পুলিশ। আমি ভাবলাম না জানি কী মামলা বানিয়ে আমাকে ধরতে এসেছে। পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টরকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে? তিনি স্যালুট দিয়ে বললেন, ‘স্যার, আমরা আপনার খেদমত করতে এসেছি।’ তাঁর কথা শুনে আমার আক্কেলগুড়ুম। আমার এ সম্মান আমি আপনাদের জন্য পেয়েছি। এরপর থেকে আমি চব্বিশ ঘণ্টা আপনাদের জন্যই কাজ করছি।’

১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্রে তদানীন্তন পূর্ব। পাকিস্তানে রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন হয়। ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে স্পিকার হিসেবে কর্মরত ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে সংসদের অধিবেশনকক্ষে বিরোধী দলের সদস্যরা আক্রমণ করেন। এর ফলে। তিনি মারা যান। কেন্দ্রীয় সরকারের সৃষ্ট রাজনৈতিক ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয় পাকিস্তানের রাজনীতি। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয়।