দশম অধ্যায়
হবিগঞ্জে মহকুমা প্রশাসক
আমি হবিগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক হিসেবে ১৯৬৯ সালের ৩ ডিসেম্বর দায়িত্ব গ্রহণ করি। হবিগঞ্জ তখন ছিল সিলেট জেলার একটি মহকুমা। বাংলাপিডিয়া থেকে দেখা যায়, সিলেট জেলার একটি মহকুমা হিসেবে ১৮৭৪ সালে হবিগঞ্জ মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭৪ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত মহকুমা প্রশাসক পদে। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের এবং আসাম সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের পদায়ন করা হতো। যখনই আইসিএস অফিসার পাওয়া যেত না, তখন আসাম সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের মহকুমা প্রশাসক পদে নিয়োগ করা হতো। ১৯৪৭ সালের আগে সিলেট জেলার কর্মকর্তাদের সিলেট জেলার মহকুমা প্রশাসক পদে নিয়োগে কোনো বাধা ছিল না। এর ফলে বেশির ভাগ সময়ই সিলেট জেলার কর্মকর্তারাই মহকুমা প্রশাসক নিযুক্ত হতেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর একই জেলার কর্মকর্তাদের ওই জেলার মহকুমা প্রশাসক বা জেলা প্রশাসক নিয়োগ বন্ধ করা হয়। এর ফলে সিলেট জেলার জনগণের মধ্যে বাইরের জেলার মহকুমা প্রশাসক এবং জেলা প্রশাসকের নিয়োগ নিয়ে জনমনে অসন্তোষ দেখা দেয়। বহিরাগত প্রশাসকদের তারা ফরেনার’ বলে অভিহিত করত এবং অনেক ক্ষেত্রেই এদের পক্ষে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন। সংগ্রহ করা কষ্টকর হতো।
১৮৮৪ থেকে ১৯৪৭–এই ৬৩ বছর ধরে অনেক আইসিএস অফিসার হবিগঞ্জে মহকুমা প্রশাসক হিসেবে কাজ করেছেন। তবে তাদের মধ্যে একজন কর্মকর্তার নাম সত্তরের দশকেও জনমনে বেঁচে ছিল। এই নামটি হলো এম খুরশিদ। তিনি একজন পাঠান আইসিএস অফিসার ছিলেন। ১৯৪০-এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি হবিগঞ্জে মহকুমা প্রশাসক হিসেবে আসেন। ওই সময় বাংলা প্রদেশেও বেশ কয়েকজন মুসলমান কর্মকর্তা মুসলমান প্রজাদের স্বার্থরক্ষায় ও তাদের অঞ্চলের উন্নয়নে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে এন এম খান (নিয়াজ মোহাম্মদ খান) ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, আজিজ আহমদ চাঁদপুরে এবং এইচ এম ইছহাক সিরাজগঞ্জে জনপ্রিয় মহকুমা প্রশাসক হিসেবে আবির্ভূত হন। এম খুরশিদ হবিগঞ্জে মহকুমা প্রশাসক থাকাকালীন ফসল রক্ষার জন্য বাঁধ নির্মাণ করেছেন। তবে শুধু উন্নয়ন প্রকল্পের জন্যই তিনি জনপ্রিয় ছিলেন না, তার সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবও তাঁকে জনমনে বিশেষ আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। কিংবদন্তি সূত্রে জানা যায় যে একবার এক সচ্ছল কৃষক রাগের মাথায় তার ছোট ভাইকে খুন করে ফেলেন। পুলিশ আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করার আগেই আসামি খুরশিদের বাসভবনে এসে তার পায়ে ধরে বলে, রাগের মাথায় সে খুন করে ফেলেছে। খুরশিদ সাহেব যেন তাকে মাফ করে দেন। খুরশিদ সত্যি তাকে মাফ করে দেন। পুলিশকে তিনি কোনো ব্যবস্থা নিতে দেননি। অবশ্য তিনি ছোট ভাইয়ের ওয়ারিশদের অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। খুরশিদ পরে সিলেট জেলার ডেপুটি কমিশনার ছিলেন এবং পাকিস্তান সরকারের প্রতিরক্ষাসচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন। পাকিস্তান খুরশিদকে পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল। অবশ্য রাষ্ট্রদূত হিসেবে তাঁর সাফল্য ছিল সীমিত।
আগস্ট ১৯৪৭ থেকে ডিসেম্বর ১৯৭১-এই ২৪ বছর চার মাস সময়। পরিসরে প্রায় ২৮ জন কর্মকর্তা হবিগঞ্জে মহকুমা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া ১৩ জন কর্মকর্তা এসডিওর অনুপস্থিতিতে সাময়িক দায়িত্ব পালন করেছেন। সিএসপি কর্মকর্তারা এই মহকুমার দায়িত্বে ছিলেন ১১ বছর ১১ মাস। আর প্রাদেশিক সার্ভিসের কর্মকর্তারা ছিলেন ১২ বছর ৫ মাস। এর মধ্যে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা ছিলেন ৯ জন। এই ৯ জন সিএসপি কর্মকর্তা হলেন : ১৯৫২ ব্যাচের মফিজুর রহমান, ১৯৫৪ ব্যাচের জাফর ইকবাল, ১৯৫৬ ব্যাচের কাজী জালাল আহমদ, ১৯৫৬ ব্যাচের এম আই কে খলিল, ১৯৫৯ ব্যাচের শফিউল আলম, ১৯৬২ ব্যাচের এ কে এম শামসুল হক খান, ১৯৬৫ ব্যাচের ড. মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, ১৯৬৫ ব্যাচের ফরিদউদ্দিন আহমদ এবং ১৯৬৭ ব্যাচের আকবর আলি খান। শামসুল হক খান ছাড়া আর সব কর্মকর্তাই দেশে কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব পদে কাজ করেছেন। শামসুল হক খান ১৯৭১ সালে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক থাকাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে শাহাদতবরণ করেন।
হবিগঞ্জে জেলা প্রশাসক হিসেবে আমার নিয়োগাদেশ ১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাসের ২৩-২৪ তারিখের দিকে জারি করা হয়। ওই সময় হবিগঞ্জে মহকুমা প্রশাসক ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি সিএসপি অফিসার ফরিদউদ্দিন আহমদ। তাঁর পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়ার বিশেষ তাড়া ছিল, তাই ঢাকা থেকে আদেশ জারি হওয়ার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ডেপুটি কমিশনারকে অবিলম্বে তাঁর হাতে দায়িত্বভার তুলে দেওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করেন। সিলেটের ডেপুটি কমিশনার আমাকে রাজশাহীতে তারবার্তা পাঠান যে আমি যেন যোগদানের সময় না নিয়ে সরাসরি হবিগঞ্জে যোগ দিই। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বদলি হলে সরকারি কর্মচারীরা প্রচলিত নিয়মে যোগদানের সময় পেতেন। আমি রাজশাহী থেকে হবিগঞ্জ যাওয়ার আগে ঢাকায় আত্মীয়স্বজন এবং বাড়িতে মা-বাবার দোয়া নেওয়ার বাসনা করি। আমার পক্ষে তাই সিলেটের ডিসির নির্দেশিত তারিখে যোগ দেওয়া সম্ভব ছিল না। আমি তাই তাকে জানিয়ে দিই আমি ৩ ডিসেম্বর হবিগঞ্জে যোগ দেব।
আমি ১৯৬৯ সালের ২ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকা থেকে ট্রেনে হবিগঞ্জ রওনা। হই। ঢাকা থেকে আখাউড়া আসার পর সিলেটগামী কোচগুলোকে খুলে নতুন ট্রেনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। বিকেলের দিকে আখাউড়া থেকে আস্তে আস্তে মনতলা স্টেশনে পৌঁছাই। মনতলা ছিল হবিগঞ্জ মহকুমার অংশ। ট্রেনে। হবিগঞ্জ মহকুমায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ভূপ্রকৃতি ভিন্ন রূপ ধারণ করে। পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে ট্রেন চা-বাগান অঞ্চলে প্রবেশ করে। ছোটবেলা থেকে আমি চা খাই কিন্তু চা-বাগান এর আগে আমি কখনো দেখিনি। তেলিয়াপাড়া অঞ্চল দিয়ে ঢুকে শাহজীবাজার হয়ে শায়েস্তাগঞ্জে এসে ট্রেন থামে। শায়েস্তাগঞ্জ থেকে দুভাবে হবিগঞ্জ যাওয়া যেত। প্রথমত, সড়কপথে মোটরগাড়ি কিংবা স্কুটারযোগে হবিগঞ্জ যাওয়া যেত। দ্বিতীয়ত, রেলপথে হবিগঞ্জে যাওয়া যেত কিন্তু ট্রেনে যেতে হলে হবিগঞ্জগামী ট্রেনের জন্য শায়েস্তাগঞ্জে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। আমাকে শায়েস্তাগঞ্জ থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসডিওর জিপ পাঠানো হয়।
আমি জিপে করে রাতের বেলা হবিগঞ্জে এসডিওর বাসভবনে উপস্থিত হই। রাতেই ডেপুটি কমিশনারের বাসায় ফোন করি। আমাকে জানানো হয় ডেপুটি কমিশনার বর্তমানে সফরে আছেন এবং আগামীকাল সফর থেকে ফিরে এলে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন। ৩ ডিসেম্বর আমি দায়িত্বভার গ্রহণ করি। আমার প্রথম কাজ ছিল ট্রেজারির দায়িত্ব গ্রহণ। রাজশাহীতে ট্রেজারিতে প্রশিক্ষণের সময় বারবার এ কথা জোর দিয়ে শেখানো হয়েছে যে ট্রেজারির দায়িত্ব গ্রহণের সময় সবকিছু ভালোভাবে মিলিয়ে দেখে দায়িত্ব নিতে হবে। যদিও ট্রেজারির দায়িত্ব অনেক কমে গিয়েছিল; তবু আফিম থেকে বন্দুক, সোনার গয়না, স্ট্যাম্প ইত্যাদি অনেক কিছু ট্রেজারিতে থাকত। দু-তিনজন সহকারী কর্মকর্তা নিয়ে প্রায় সারা দিন ধরে সবকিছু মিলিয়ে আমি ট্রেজারির দায়িত্ব গ্রহণ করি।
ততক্ষণে অফিসের সময় শেষ হয়ে গেছে। ওই সময় ছিল রোজার মাস। আমি রোজা ছিলাম। বাসায় গিয়ে ইফতারের জন্য অপেক্ষা করছি। এমন সময় সিলেট থেকে ডেপুটি কমিশনারের টেলিফোন এল। তিনি বললেন, ‘তুমি এসে পড়েছ, খুব ভালো হয়েছে। এই মুহূর্তে তেলিয়াপাড়া ইপিআর ক্যাম্পে একটি বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে। গতকাল রাতে দুষ্কৃতকারীরা ওই ক্যাম্পে একজন পশ্চিম পাকিস্তানি বিডিআর সৈনিককে মেরে ফেলেছে। ইপিআর এতে খুব অসন্তুষ্ট এবং তারা প্রতিশোধ নিতে চায়। তারা আশপাশের গ্রামের লোকজনকে ঢালাওভাবে ধরতে চায় এবং কোনো বাধা এলে আগুন দিয়ে বসতি পুড়িয়ে দেওয়ার, প্রয়োজনে গুলি করার পরিকল্পনা করছে। তিনি জানালেন ইপিআরের লেফটেন্যান্ট কর্নেল কিছুক্ষণের মধ্যে তেলিয়াপাড়ার উদ্দেশে রওনা হবেন। ডিসি সাহেব আমাকে পরামর্শ দিলেন আমি যেন ইফতার করে সোজা তেলিয়াপাড়া ইপিআর ক্যাম্পে চলে যাই এবং সেখানে গিয়ে যাতে কোনো অপ্রীতিকর কিছু না ঘটে, সে ব্যবস্থা করি। আমি সঙ্গে সঙ্গে চুনারুঘাট থানার সার্কেল অফিসারকে ফোন করি এবং তাঁকে ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ওই এলাকার ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানকে তার অফিসে বসিয়ে রাখার জন্য অনুরোধ করি। আমি ইফতার শেষে চুনারুঘাট চলে যাই এবং সেখান থেকে সার্কেল অফিসার, ওসি এবং ইউনিয়ন কাউন্সিলের কর্মকর্তাসহ সরাসরি ইপিআর ক্যাম্পে যাই। আমি ইপিআর ক্যাম্পে যাওয়ার ঘণ্টা আধেকের মধ্যে ইপিআরের লেফটেন্যান্ট কর্নেল এক জিপভর্তি সৈন্যসহ আবির্ভূত হন। তিনি এসে এলাকার লোকদের খুব গালাগালি করেন। তিনি বলেন, এলাকার লোকজন অধিকাংশই স্মাগলার এবং ভারতের চর–এদের শাস্তি দিতে হবে। আমি বললাম, দোষীদের অবশ্যই শাস্তি দেওয়া হবে। তারপর সাক্ষ্য-প্রমাণ দেখতে চাইলাম। ইপিআরের বর্ণনা অনুসারে চার-পাঁচজন লোকের বিরুদ্ধে নালিশ ছিল। আমি লেফটেন্যান্ট কর্নেলকে বললাম যে এদের আমি অবশ্যই ধরব এবং আজই জেলে নিয়ে যাব। এই বলে আমি ওসিকে দুবৃত্তদের ধরার জন্য আদেশ দিলাম। ওসি এবং ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানকে বলা ছিল যে ইপিআর যাদের বিরুদ্ধে নালিশ করবে, তাদের সঙ্গে সঙ্গে অ্যারেস্ট করা হবে। তবে তাদের অ্যারেস্ট করে ইপিআরের হাতে দেওয়া হবে না। এদের পুলিশের হাতে দেওয়া হবে। পুলিশের ধৃত আসামি হলে এদের জামিন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা মহকুমা প্রশাসকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে অবিচারের সম্ভাবনা খুবই কম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আসামিদের ধরে আমি হবিগঞ্জ জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম। লেফটেন্যান্ট কর্নেলের কোনো নালিশের অবকাশই ছিল না। তিনি তা মেনে নিলেন এবং তিনি সিলেট ফিরে গেলেন। সব ঝামেলা মিটিয়ে রাত প্রায় দুইটার দিকে আমি হবিগঞ্জ পৌঁছাই এবং সাহরি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
পরদিন সকাল আটটার দিকে আমার ঘুম ভাঙে। নয়টার দিকে কাপড়চোপড় পরে অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হই, তখন একজন পিয়ন। এসে জানায়, চাকলাপঞ্জি চা-বাগানের ম্যানেজার আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য বসে আছেন। বাসার অফিসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ম্যানেজার এসে নিজের পরিচয় দিলেন এবং বললেন তাকে ২০ হাজার টাকার চেক দিতে হবে। আমি প্রশ্ন করলাম যে আমি কোথা থেকে চেক দেব? তিনি বললেন, স্যার, আপনি বোধ হয় জানার সময় পাননি হবিগঞ্জে তিনটি চা-বাগান শত্রু সম্পত্তি হিসেবে সরকার অধিগ্রহণ করেছে এবং হবিগঞ্জের মহকুমা প্রশাসককে এই শত্রু সম্পত্তির ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিযুক্ত করেছে। আপনার প্রথম কাজ হলো এই চা-বাগানগুলো চালু রাখা এবং এ চা-বাগানগুলোর শ্রমিকেরা যাতে তাদের মজুরি ও অন্যান্য পাওনা যথাসময়ে পায়, তা নিশ্চিত করা। কোনো অবস্থাতেই শ্রমিক অসন্তোষ হতে দেওয়া যাবে না। দ্বিতীয় দায়িত্ব হলো চা বাগানগুলো যাতে যথাযথভাবে পরিচালিত হয় এবং মুনাফা করতে পারে, তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
চুনারুঘাট থানার চাকলাপঞ্জি চা-বাগান ছাড়া আরও দুটি চা-বাগান শত্রু সম্পত্তি হিসেবে অধিগ্রহণ করা হয়। এদের একটি ছিল বাহুবল থানায় অবস্থিত বৃন্দাবন চা-বাগান। এই বাগানের যিনি ম্যানেজার ছিলেন, তাঁকে দিয়েই এই বাগান চালু রাখা হয়। মাধবপুর থানায় বৈকুণ্ঠপুর নামে আরেকটি চা-বাগান অধিগ্রহণ করা হয়। সেখানে কোনো নিয়মিত ম্যানেজার ছিল না। তাই প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা তোফায়েল আহমদ চৌধুরীকে এই বাগানের ম্যানেজার নিযুক্ত করা হয়। এই বাগানগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য আমি বাগানগুলো পরিদর্শনের কর্মসূচি গ্রহণ করি। মহকুমা প্রশাসকের অনেক দায়িত্বের সঙ্গে চা-বাগান পরিচালনার অতিরিক্ত দায়িত্ব আমাকে প্রায় ৯ মাস বহন করতে হয়। অনেক তদবিরের পর পাকিস্তান শত্রু সম্পত্তি বোর্ড এই বাগান পরিচালনার দায়িত্ব নেয়।
হবিগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক হিসেবে আমার স্মৃতি কালক্রম অনুসারে লিপিবদ্ধ করা যেতে পারে। তবে এ ধরনের আলোচনায় ঘটনার ওপরে বেশি জোর থাকে, বিশ্লেষণের পরিমাণ হয় কম। আমি মহকুমা প্রশাসক হিসেবে যা শিখেছি, তা বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। তাই আমি নিম্নলিখিত শিরোনামে আমার অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ করতে চাই–
(১) ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা (২) মহকুমা হাকিম এবং পুলিশের সম্পর্ক (৩) ভূমি রাজস্বব্যবস্থা। (৪) বুনিয়াদি গণতন্ত্রভিত্তিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা (৫) ত্রাণ কার্য (৬) মহকুমা প্রশাসন এবং শিক্ষাব্যবস্থা (৭) মিত্রপক্ষের গুলি
(১) ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা : ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার ওপরে কর্তৃত্ব ছিল মহকুমা হাকিমের ক্ষমতার প্রধান উৎস। তাই রাজশাহীতে প্রশিক্ষণের সময় আমি ফৌজদারি মামলা পরিচালনা সম্বন্ধে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিই। এ ছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধি আইনও ভালোভাবে পাঠ করি। তার ফলে ফৌজদারি আদালত পরিচালনার ক্ষেত্রে আমার কোনো দ্বিধা ছিল না। যেসব সিএসপি কর্মকর্তা ফৌজদারি বিচার সম্পর্কে ভালো করে প্রশিক্ষণ নেননি, তাঁদের পক্ষে আদালত পরিচালনা করা ছিল শক্ত। এঁরা আদালতে বসতে চাইতেন না এবং আদালতের কাজ প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের ছেড়ে দিতেন। এর ফলে মহকুমার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল অস্পষ্ট। এ ধরনের কর্মকর্তারা যখন বাধ্য হয়ে আদালতে বসতে হতো, তখন তারা আদেশ লেখার জন্য প্রধানত আদালতের পেশকারদের ওপর নির্ভর করতেন। অনেক মহকুমা হাকিম পেশকারদের ওপর এত নির্ভরশীল ছিলেন যে তাঁরা এজলাসে বসে বলতেন আমার পেশকার এত ভালো পরামর্শ দেয় যে ফৌজদারি কার্যবিধি আইন দেখারও কোনো প্রয়োজন মনে করি না। পেশকাররা হাকিমকে শুধু আইনগত পরামর্শই দিতেন না, তাঁরা ইংরেজ আইসিএস অফিসারদের বাংলা সাক্ষ্য-প্রমাণ ইংরেজি ভাষায় রূপান্তরে সহায়তা করতেন। এর ফলে ব্রিটিশ ভারতে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় অন্যতম নিয়ন্ত্রক হন পেশকার। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত বইয়ে এ রকম একজন দোর্দণ্ডপ্রতাপ পেশকারের কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন।
পেশকারেরা এজলাসে বসে ঘুষ নিত। তাদের দুষ্কর্ম বন্ধ করা অনেক সময় হাকিমদের ক্ষমতার বাইরে চলে যেত। আমার পিতা ছিলেন একজন আইনজীবী। তাঁর কাছে গল্প শুনেছি যে একবার একজন ব্রিটিশ আইসিএস অফিসার পেশকারের দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি আদেশ দেন আদালতে প্রবেশ করার সময় কোনো আমলা কোনো অর্থ নিয়ে আসতে পারবে না এবং যাওয়ার সময়ও তার পকেটে কোনো অর্থ থাকা চলবে না। যদি কোনো আমলা অর্থসহ আদালতে ধরা পড়ে, তাহলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হবে। এই আইসিএস অফিসারের এজলাসে বসেই পেশকার দুটি আধুলি ঘুষ নেয়। আধুলি দুটি মাটিতে পড়ে যায় এবং টুং করে আওয়াজ হয়। হাকিম টের পান যে ঘুষ বিনিময় হয়েছে। তিনি তৎক্ষণাৎ পুলিশ ডেকে আনেন এবং এই অর্থ উদ্ধার করে পেশকারকে গ্রেপ্তার করার জন্য আদেশ দেন। পুলিশ আধুলি দুটি তন্নতন্ন করে খোঁজে কিন্তু কোথাও আধুলি পাওয়া যায় না। ইতিমধ্যে পেশকার একটি ইস্তফাপত্র তৈরি করে হাকিমকে দেন। ইস্তফাপত্রে তিনি লেখেন যে গত দুই দশকের অধিক কাল ধরে তিনি সব হাকিমকে সন্তুষ্ট করে পদোন্নতি পেয়েছেন এবং রায় বাহাদুর উপাধির জন্য সুপারিশ পেয়েছেন। কেউ তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনেননি। অথচ প্রমাণ ছাড়া বর্তমান হাকিম তাকে জনসমক্ষে ঘুষখোর বলে। হেনস্তা করেছেন। এ অবস্থা তার পক্ষে মানা সম্ভব নয়, তাই তিনি পদত্যাগ করতে চান। হাকিম তখন পেশকার ছাড়া আর সবাইকে তার কক্ষের বাইরে চলে যেতে আদেশ দেন। এরপর তিনি পেশকারকে বলেন যে পেশকারের দুর্নীতি নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। তাঁর কৌতূহলের বিষয় হলো আধুলি দুটি কোথায় এবং কীভাবে উধাও হয়ে গেল। যদি পেশকার এই গোপন তথ্যটি তাঁকে জানান, তাহলে তিনি কখনো পেশকারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবেন না। পেশকার মহকুমা হাকিমের সামনে রাখা দোয়াত তুলে ধরেন। দেখা যায় দোয়াতের নিচে দুটি আধুলি। ম্যাজিস্ট্রেট যখন উত্তেজিত হয়ে পুলিশ ডাকছিলেন, সেই সময়ে পেশকার আধুলি দুটি ম্যাজিস্ট্রেটের দোয়াতের নিচে লুকিয়ে ফেলেন। এ ধরনের পেশকারদের শাস্তি দেওয়ার কোনো সহজ উপায় নেই।
আমি যখন মহকুমা হাকিমের দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন আমার আদালতের পেশকার ছিলেন একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তিনি অত্যন্ত যোগ্য ছিলেন। আমার পূর্ববর্তী এক মহকুমা হাকিম প্রকাশ্য আদালতে বলতেন যে তার মতো পেশকার থাকলে ফৌজদারি কার্যবিধিমালার দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। অবশ্য তাঁর সম্পর্কে নানা কানাঘুষা ছিল। পেশকারদের ঘুষের উৎস দুটি। একটি উৎস হলো ম্যাজিস্ট্রেট যে আদেশ দেন, সে আদেশের অনুলিপি অনেক ক্ষেত্রে আইনজীবীদের তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজন হয়। তখন ফটোকপির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাই পেশকারকে ঘুষ দিয়ে হাতে লেখা কপি সংগ্রহ করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। দ্বিতীয় উৎস হলো মক্কেলকে মামলায় জিতিয়ে দেওয়া। যেখানে হাকিম ঘুষ খায়, সেখানে পেশকার হাকিমের সঙ্গে মিলে মক্কেলদের কাছ থেকে টাকা খায়। তবে যেখানে হাকিম ঘুষখোর নয়, সেখানেও পেশকার টাকা খায়। সে মক্কেলদের বলে, যদি রায় তার অনুকূলে
যায়, তাহলে টাকা ফেরত দেওয়া হবে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় পেশকাররা আদালতের রায় কী হবে, সেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনুমান করতে পারতেন। সামান্যসংখ্যক মামলায় তাদের অনুমান ভুল হলে মক্কেলদের টাকা ফেরত দিয়ে দিলে আর কোনো সমস্যা হতো না। এ ধরনের ঘুষখোর পেশকাররাই বিচারব্যবস্থার ওপর জনমনে সম্পূর্ণ অনাস্থার সৃষ্টি করে। আমি জ্যেষ্ঠতম পেশকারের বদলে দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ পেশকারকে আমার আদালতে নিয়োগ দিই। সৌভাগ্যবশত রাজস্ব বিভাগের হেড অ্যাসিস্ট্যান্টের পদ খালি ছিল। এই পদে আমার পেশকারকে নিয়োগ করি। দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ পেশকার মনে করে যে তাকে ছাড়া তরুণ হাকিমের চলার কোনো উপায় নেই। সুতরাং সে প্রকাশ্যে ঘুষ খাওয়া শুরু করে। একদিন আমি এজলাসে থাকাকালীন সে একজন আইনজীবীর কাছ থেকে টাকা নেয়। আমি তৎক্ষণাৎ তাকে বদলি করি এবং তৃতীয় জ্যেষ্ঠ পেশকারকে আমার আদালতে নিয়োগ করি। মাসখানেক পরে এই তৃতীয় জ্যেষ্ঠ পেশকারও এজলাসে ঘুষ খায়। হবিগঞ্জে তখন আর কোনো পেশকার ছিল না যে মহকুমা হাকিমের পেশকারের কাজ চালাতে পারে। খাসকামরায় গিয়ে আমি পেশকারকে ডেকে পাঠাই। তাকে আমি বলি সে যে ঘুষ খায়, এ নিয়ে আমার মনে সন্দেহ নেই। তবে যদি আমার আদেশের অনুলিপি দেওয়ার জন্য অফিসের পর তাকে কাজ করতে হয়, তাহলে সে যদি মজুরি হিসেবে কিছু অর্থ গ্রহণ করে, সেটা আমি সহ্য করতে পারি; কিন্তু যদি আমার নাম ব্যবহার করে কোনো ঘুষ খাওয়া হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সে আমার পায়ে ধরে প্রতিশ্রুতি দেয় সে। কখনো আমার নাম ব্যবহার করে ঘুষ খাবে না। এ ধরনের অভিযোগ আমি হবিগঞ্জে থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে শুনতে পাইনি। দেশের সুবিচার নিশ্চিত করতে হলে শুধু বিচারব্যবস্থাকে নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বতন্ত্র করলেই হবে না, হাকিম-পেশকার ব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে।
হবিগঞ্জে ফৌজদারি আদালতে প্রধানত মোক্তাররা মামলা পরিচালনা করতেন। এখানে খুব অল্পসংখ্যক বিএল ডিগ্রিধারী উকিল মামলা করতেন। মহকুমা হাকিমের এখানে মোক্তারদের ভিড় লেগে থাকত প্রধানত আসামিদের জামিনের জন্য। মোক্তাররা বিচারকদের সন্তুষ্ট করতে চাইতেন, যাতে তার মক্কেলদের জন্য জামিন পেতে পারেন। হবিগঞ্জ শহরে কলকারখানা খুব একটা ছিল না। অথচ মহকুমায় প্রচুর অপরাধ সংঘটিত হতো। এ অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য যে আদালত, সে আদালতেই ভিড় হতো বেশি। তাই শহরের অধিকাংশ মানুষ ম্যাজিস্ট্রেটদের ব্যক্তিগত জীবন অত্যন্ত কঠোরভাবে নিরীক্ষণ করত।
বর্তমানকালের ম্যাজিস্ট্রেটদের তুলনায় ষাটের দশকের ম্যাজিস্ট্রেটরা জামিনের ব্যাপারে অনেক উদার ছিলেন। বর্তমানে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় পুলিশ যাদের গ্রেপ্তার করে, আদালতে পাঠায়, তাদের বেশির ভাগ ব্যক্তিকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। অথচ পাকিস্তান আমলে ম্যাজিস্ট্রেটরা ৫৪ ধারায় পাঠানো ব্যক্তিদের জামিন দিয়ে দিতেন, যদি না তার বিরুদ্ধে বিশেষ কোনো প্রমাণ পুলিশ দাখিল করতে পারত। আমার মনে আছে যে আমি হবিগঞ্জে ৫৪ ধারায় পুলিশ প্রেরিত ব্যক্তিদের একজন ব্যক্তি ছাড়া আর সবাইকে জামিন দিয়েছিলাম। একজন ব্যক্তি, যাকে জামিন দিইনি, সে ছিল আমার আত্মীয়। তার নাম শাহ আলম চৌধুরী। সে আমার মামা অলি আহমদ চৌধুরীর কনিষ্ঠ পুত্র। অর্থাভাবে তাকে মাদ্রাসায় পড়তে পাঠানো হয়; কিন্তু মাদ্রাসাশিক্ষা তাকে মোটেও আকৃষ্ট করেনি। সে প্রায়ই মাদ্রাসা থেকে পালাত এবং বিভিন্ন জায়গায় ছোটখাটো অপরাধ করত। ধরা পড়লে আমার মামা তাকে জামিনে ফেরত নিয়ে আসতেন। শাহ আলম যখন খবর পায় যে আমি হবিগঞ্জে মহকুমা প্রশাসক, তখন সে ট্রেনে করে হবিগঞ্জে আসে এবং ৫৪ ধারায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। আমি তাকে আদালতে দেখে চিনতে পারি এবং তাকে জেলে পাঠানোর আদেশ দিই। এই খবর আমার মামার কাছে পৌঁছায়। তিনি হবিগঞ্জে আসেন এবং খোঁজ নেন আমি কোন দিন সফরে যাব। তিনি সেই দিন আদালতে আমার সেকেন্ড অফিসারের কাছে শাহ আলমের জামিনের দরখাস্ত দেন এবং তার কাছে প্রতিশ্রুতি দেন যে আমি যত দিন হবিগঞ্জের এসডিও আছি, তত দিন তাকে কোনোমতেই হবিগঞ্জে আসতে দেওয়া হবে না। সেকেন্ড অফিসার জামিন দিয়ে দেন এবং পরদিন সকালে আমার কাছে সমস্ত ঘটনাটি বর্ণনা করেন। আমি তাকে নির্দেশ দিই যে। ভবিষ্যতে যদি সে কখনো হবিগঞ্জে আসে, তাহলে তার বিরুদ্ধে যেন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
মহকুমা প্রশাসকের পক্ষে খুব বেশিসংখ্যক ফৌজদারি মামলা নিষ্পন্ন করা সম্ভব হয় না। বেশির ভাগ মামলার বিচার করতেন প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা। এঁদের কেউ কেউ অত্যন্ত সৎ এবং যোগ্য ছিলেন। কিন্তু অনেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যেত। উপরন্তু অনেকেই ন্যায়বিচারের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের যে কঠোর পরিশ্রম করা প্রয়োজন, তা করতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। ম্যাজিস্ট্রেটদের কাজ তাই নিয়মিত পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। প্রতি তিন মাস অন্তর ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্ট মহকুমা হাকিমের পরিদর্শন করার বিধান রয়েছে। প্রথম পরিদর্শন রিপোর্ট বিস্তারিতভাবে করা হলে পরবর্তী পরিদর্শন রিপোর্টগুলো অধিকতর সহজ হয়। আমি প্রতি তিন মাস অন্তর প্রতিটি ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্ট পরিদর্শন করতাম।
হবিগঞ্জে এসডিও ছাড়া আরও তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। এর মধ্যে দুজন ছিলেন পূর্ণকালীন ম্যাজিস্ট্রেট এবং একজন ছিলেন সাম্মানিক ম্যাজিস্ট্রেট। পরবর্তীকালে এই সাম্মানিক ম্যাজিস্ট্রেটের জায়গায় একজন ল ইয়ার ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়। ল ইয়ার ম্যাজিস্ট্রেটরা শুধু বিচার করতেন, তাদের নির্বাহী দায়িত্ব দেওয়া হতো না। তবে হবিগঞ্জে অনিষ্পন্ন মামলার সংখ্যা এত বেশি ছিল যে এই তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে মহকুমা হাকিমের পক্ষে তা কমিয়ে আনা সম্ভব ছিল না। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এসডিওকে সহায়তা করার জন্য শিক্ষানবিশ কর্মকর্তাদের হবিগঞ্জে পাঠাতেন। আমার সময় দুজন শিক্ষানবিশ কর্মকর্তাকে হবিগঞ্জে পাঠানো হয়। সুষ্ঠু এবং দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির জন্য ম্যাজিস্ট্রেটদের কাজের তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন রয়েছে। পাকিস্তানে এসডিও এই তত্ত্বাবধায়কের কাজ করতেন। তবু মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব হয়নি। বর্তমানে এই দায়িত্ব বর্তেছে জেলা জজদের ওপর। তাঁদের নিজেদের এত মামলা সামলাতে হয় যে তাঁদের পক্ষে কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের সুষ্ঠু তদারক করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র করা সত্ত্বেও মামলা নিষ্পত্তি বাড়ছে না।
(২) মহকুমা হাকিম এবং পুলিশের সম্পর্ক : ব্রিটিশ ভারতে পুলিশ ব্যবস্থা গড়ে তোলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং মহকুমা হাকিমরা। দীর্ঘদিন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের পুলিশের ওপর কর্তৃত্ব ছিল প্রশ্নাতীত। তবে পুলিশের সম্প্রসারণ এবং আইপিএস কর্মকর্তাদের নিয়োগের ফলে পুলিশের ওপর ম্যাজিস্ট্রেটদের কর্তৃত্ব আস্তে আস্তে কমতে থাকে। যদিও ১৯৩৫ সালের পুলিশ। রেগুলেশনস অব বেঙ্গলে ম্যাজিস্ট্রেটদের পুলিশের ওপরে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ছিল, তবু বিভিন্ন নির্বাহী আদেশে এই ক্ষমতা পাকিস্তান আমলে অনেক কমে যায়। ১৯৬০-এর দশকে এই ক্ষমতা মূলত মহকুমা হাকিম এবং অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের থানা পরিদর্শন করার ক্ষমতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। সালাউদ্দিন আহমেদ যখন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন, তখন থানা পরিদর্শন সম্পর্কে একটি পরিদর্শন ম্যানুয়েল প্রকাশ করেন। এই ম্যানুয়েলে থানা পরিদর্শনে কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশ ছিল। আমি মহকুমা হাকিম থাকাকালীন আটটি থানা প্রতিবছর কমপক্ষে একবার পরিদর্শনের কর্মসূচি গ্রহণ করি। এই কর্মসূচি অনুসারে আমি প্রতিটি থানা পরিদর্শন করি।
ষাটের দশকে দারোগারা আপাতদৃষ্টে ম্যাজিস্ট্রেটদের অনুগত ছিলেন। প্রকাশ্যে তারা কখনো দ্বিমত পোষণ করতেন না। কিন্তু পুলিশের কাজ একমাত্র পুলিশই করতে পারে, আর কেউ নয়। কার্যত দারোগারা নিজেদের ইচ্ছেমতো কাজ করতেন এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা ম্যাজিস্ট্রেটদের আদেশের তোয়াক্কাই করতেন না। দারোগাদের সম্বন্ধে বলা হয়ে থাকে যে সবচেয়ে যোগ্য দারোগা তারাই, যারা দুই পক্ষ থেকেই ঘুষ খান এবং দুই পক্ষকেই সন্তুষ্ট রাখতে পারেন। ধরুন একটি মামলায় একজন ব্যক্তি খুন হলো। এই ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনের প্রত্যাশা খুনির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হবে। দারোগা নিহত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ঘুষ নিতেন এবং অতি দ্রুত চার্জশিট দাখিল করতেন। আসামিপক্ষের লোকজন মামলা থেকে খালাস চায়, তারা দারোগার সঙ্গে যোগাযোগ করে। দারোগা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির আত্মীয়দের কাছ থেকে যে ঘুষ নিয়েছেন, তার চেয়েও বেশি ঘুষ আসামির তদবিরকারীদের কাছে দাবি করেন। তারা বাধ্য হয়ে ঘুষ দেয়। এই ঘুষ পেয়ে সে যে চার্জশিট দাখিল করে, সেখানে অনেক ফাঁক রেখে দেয়। সব সাক্ষীর নাম উল্লেখ করে না, সব আলামত নথিভুক্ত করা হয় না। এর ফলে আদালতে মামলা উঠলে আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। দারোগা সব দোষ চাপিয়ে দেন বিচারকদের ওপর। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনকে সান্ত্বনা দেন যে তিনি চার্জশিট দেওয়া সত্ত্বেও ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে ছেড়ে দিয়ে অন্যায় কাজ করেছেন।
অন্যদিকে আসামিপক্ষের লোকজন দারোগার কাজে খুবই সন্তুষ্ট হন। আমি যখন থানা পরিদর্শনে যেতাম, তখন হবিগঞ্জের ম্যাজিস্ট্রেটরা যেসব ওয়ারেন্ট জারি করেছেন অথচ এক মাস সময় পার হওয়ার পরও যেসব ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, তাদের তালিকা নিয়ে যেতাম। তালিকা ধরে কোন কোন আসামির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করতাম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশ মিথ্যা কথা বলত। অল্প কিছু ক্ষেত্রে তারা আসামিকে ধরে দু-চার দিনের মধ্যে পাঠিয়ে দিত।
এ ছাড়া যেসব বন্দুকের লাইসেন্সের নবায়ন করা হতো না, সেগুলো চিহ্নিত করে দারোগাকে ব্যবস্থা নিতে বলা হতো। এই ক্ষেত্রে অবশ্য আদেশ যথাযথভাবে প্রতিপালিত হতো। মামলা-মোকদ্দমার বিষয় ছাড়া একটি বড় বিষয় ছিল আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ। এ ব্যাপারে পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে সহযোগিতা করত এবং ম্যাজিস্ট্রেটদের আদেশ মেনে চলত। বর্তমানে এ ব্যাপারেও পুলিশ এখন তাদের কর্মকর্তাদের বাইরে অন্য কারোর নিয়ন্ত্রণ মানে না। এর ফলে পুলিশি জুলুম সম্পর্কে অনেক নালিশ শোনা যায়।
(৩) ভূমি রাজস্বব্যবস্থা : ১৯৫৪ সালে জমিদারি ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার আগে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং মহকুমা হাকিম জমিদারদের মাধ্যমে খাজনা আদায় করতেন। জমিদারি প্রথা তুলে দেওয়ার পর প্রতিটি মহকুমার ভূমি রাজস্বব্যবস্থার প্রধান হন মহকুমা হাকিম। তাঁকে সহায়তা করার জন্য প্রতিটি সার্কেলে একজন ভূমি রাজস্বের সার্কেল অফিসার নিয়োগ করা হয়। ভূমি রাজস্বের আদায় সন্তোষজনক ছিল না। তবে হবিগঞ্জে অনেক চা-বাগান ছিল এবং চা-বাগান থেকে রাজস্ব যথাযথভাবে আদায় করা হতো। ভূমি রাজস্ব ছাড়া এই অফিসের আরও তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। প্রথমত, হবিগঞ্জ মহকুমায় অনেক জলাভূমি ছিল এবং এই জলাভূমিতে প্রচুর মাছ উৎপাদিত হতো। প্রতিটি বিল নিলামে দেওয়া হতো এবং নিলামে যিনি সর্বোচ্চ টাকা দিতেন, তিনি এক বছরের জন্য বিল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পেতেন। এই বিলের ডাক নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিযোগিতা হতো। কোথাও কোথাও বিলের মাছ ধরা নিয়ে মারামারি হতো। এর ফলে বড় বিলগুলোর নিলাম এসডিওকে পরিচালনা করতে হতো। দ্বিতীয়ত, হবিগঞ্জের পূর্বাঞ্চলে বনভূমি এবং চা বাগান অবস্থিত ছিল। সংরক্ষিত বনভূমি এবং চা-বাগানের সীমানা নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে মতবিরোধ ছিল। চা-বাগান এবং বনভূমি অঞ্চল ও এর বাইরে অন্যান্য অঞ্চলে সরকারের অনেক খাসজমি ছিল। সরকারের আদেশ ছিল খাসজমি ভূমিহীনদের কাছে ইজারা দিতে হবে। বাস্তবে অধিকাংশ খাসজমি গ্রামের প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিরা দখল করে রাখতেন। এর ফলে খাসজমি বিতরণে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
সার্কেল অফিসারের নিচে ছিল তহশিল অফিস। এই তহশিল অফিসে ভূমির সমস্ত রেকর্ড রাখা হতো এবং খাজনা আদায়সহ সব কাজই তহশিল অফিসের মাধ্যমে করতে হতো। সার্কেল অফিসারদের দায়িত্ব ছিল এসব তহশিল অফিস যাতে সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তা নিশ্চিত করা। তবে বেশির ভাগ সার্কেল অফিসারই ছিলেন বয়স্ক। তাঁরা এ কাজ সঠিকভাবে করতেন না। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে তহশিলদাররা ঠিক সময়ে অফিসে আসতেন না। আমার মনে আছে মাধবপুর থানায় একবার বেলা দুইটার সময় আমি একটি তহশিল অফিস পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখতে পাই তহশিল অফিস তালাবদ্ধ। আমি তৎক্ষণাৎ তহশিলদারকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করি। তবে সরকারি কার্যবিধি অনুসারে তদন্ত পরিচালনায় অনেক সময় লাগত। এর ফলে আমি এসডিও থাকাকালীন এই মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। ডিসির অফিসে কিন্তু মহকুমা পর্যায়ে কোনো কর্মকর্তার পদ ছিল না। হেড অ্যাসিস্ট্যান্টের সহায়তায় এসডিওকে সব কাজ করতে হতো।
(৪) বুনিয়াদি গণতন্ত্রভিত্তিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনাঃ ১৮৭০-এর দশকে বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা চালু করা হয়। স্থানীয় সরকারের তত্ত্বাবধান করতেন মহকুমা হাকিম এবং তাঁর অধীন সার্কেল অফিসার। ১৯৬০-এর দশকে আইয়ুব খান স্থানীয় সরকারকে বুনিয়াদি গণতন্ত্র নামকরণ করেন। বুনিয়াদি গণতন্ত্র ব্যবস্থায় দুটি নতুন উপাদান ছিল। প্রথমত, নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের সদস্যরা দেশে রাষ্ট্রপতি এবং কেন্দ্রীয় সংসদ ও প্রাদেশিক সংসদের সদস্যদের নির্বাচকমণ্ডলী হিসেবে গণ্য হন। তাই তাত্ত্বিকভাবে দেশের সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উৎস হয় ইউনিয়ন কাউন্সিলসমূহ। দ্বিতীয়ত, ইউনিয়ন কাউন্সিলের আর্থিক সামর্থ্য ছিল অত্যন্ত সীমিত। তাই তারা বিশেষ কোনো কাজকর্ম করতে পারত না। আইয়ুব খান পল্লি পূর্ত কর্মসূচি চালু করেন এবং পূর্ত কাজের জন্য জেলা কাউন্সিল, থানা কাউন্সিল এবং ইউনিয়ন কাউন্সিলকে স্বতন্ত্রভাবে অর্থ বরাদ্দ দেন। সরকারি অর্থের লোভে বেশির ভাগ ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যরা সরকারের সমর্থক হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে নির্বাচনে পাস করা অত্যন্ত সহজ হয়ে দাঁড়ায়।
বুনিয়াদি গণতন্ত্র ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগে স্থানীয় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা ছিল একটি বড় সমস্যা। সাধারণত এসডিওরা বন্দুকের লাইসেন্স নবায়ন এবং ট্রেড লাইসেন্স ও অন্যান্য লাইসেন্সের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে চাদা আদায় করতেন। এ ছাড়া বড়লোকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতেন। অনেক ক্ষেত্রে সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দলিল রেজিস্ট্রির ওপর চাঁদা তোলা হতো। এই ধরনের চাঁদার মাধ্যমে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা, বাঁধ নির্মাণ, রাস্তা নির্মাণ ইত্যাদি ভালো কাজ হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে জনমনে অসন্তোষ ছিল। ১৯৬৯ সালে সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের চাঁদা তুলতে নিষেধ করেন। আমি এই নিষেধ মেনে হবিগঞ্জে থাকাকালীন কোনো চাঁদা তুলিনি। হবিগঞ্জে আমি দুটি বিষয়ের ওপরে জোর দিয়েছিলাম। প্রথমত, হবিগঞ্জের হাওর এলাকায় অনেক নিচু জমি ছিল। এসব অঞ্চলে শীতকালে লো-লিফট পাম্প (Low lift pump) ব্যবহার করা গেলে বোরো ধান উৎপাদন করা সম্ভব ছিল। সরকার তাই বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের মাধ্যমে লো-লিফট পাম্প সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু এই পাম্প পরিচালনার জন্য কমপক্ষে ৫০ জন কৃষকের একটি গ্রুপ তৈরি করতে হতো। কাজেই শুধু পাম্প দেওয়াটাই যথেষ্ট ছিল না, গ্রুপ সৃষ্টি করতে হতো আগে। সমবায়, কৃষি বিভাগ, কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের কাজের সমন্বয় করতেন সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন)। আমি সার্কেল অফিসারদের জানিয়ে দিই, যিনি যত বেশি সেচযন্ত্র বসাতে পারবেন, তার মূল্যায়ন তত ভালো হবে। জেলা কৃষি উন্নয়ন কমিটি প্রতিটি উপজেলার প্রয়োজন বিবেচনা করে লো-লিফট পাম্প বরাদ্দ করতেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে উপজেলাসমূহ বরাদ্দ করা পাম্প ব্যবহার করতে পারত না। আমি সিলেটে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাই, হবিগঞ্জ মহকুমার বাইরে যদি কোনো মহকুমা হাকিম জানান যে তার জেলায় কোনো পাম্প ব্যবহার করা যাবে না, তবে তিনি সে পাম্প অতিরিক্ত বরাদ্দ হিসেবে হবিগঞ্জকে দিতে পারেন। হবিগঞ্জে এই পাম্প ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা হবে। আমি দুই বছর অন্যান্য মহকুমা থেকে প্রতিবছর প্রায় ১০০টি অব্যবহৃত পাম্পের বরাদ্দ পাই। সার্কেল অফিসার (উন্নয়নের সঙ্গে) ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ করে আমি এই পাম্পগুলো ব্যবহারের ব্যবস্থা করি। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আমার এই কাজের খুবই প্রশংসা করেন। দ্বিতীয়ত, রাস্তাঘাট, খাল, বিদ্যালয়, পাঠাগার ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মাণের। জন্য সরকারের কাছ থেকে প্রচুর বরাদ্দ পাওয়া যেত। এই বরাদ্দের টাকা সব সময়ে সঠিকভাবে ব্যয় করা হতো না। অনেক ক্ষেত্রে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের যোগসাজশে সার্কেল অফিসাররা অর্থ আত্মসাৎ করতেন। কাজেই এসব অবকাঠামো নির্মাণে নিবিড় তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে যেসব সার্কেল অফিসারের বদনাম ছিল, তাদের এলাকায় সব নির্মাণকাজ ঘন ঘন নিরীক্ষণ করতে হতো। এর ফলে কাজের মান হয়তো কিছুটা উন্নত করা গেছে কিন্তু দুর্নীতি একেবারে নির্মূল করা সম্ভব ছিল না। এ ধরনের দুর্নীতি ৫০ বছর পরও অব্যাহত রয়েছে।
(৫) ত্রাণকার্য : পাকিস্তান আমলে প্রাদেশিক সরকারে ত্রাণকাজের জন্য একজন রিলিফ কমিশনার ছিলেন। কিন্তু জেলা পর্যায়ে ত্রাণকাজের জন্য। কোনো ভিন্ন প্রশাসনিক কাঠামো ছিল না। সরকারের কোনো কাজের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রশাসনিক ব্যবস্থা না থাকলে সেই কাজের দায়িত্ব জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং মহকুমা হাকিমকে নিতে হতো। তাই হবিগঞ্জে ত্রাণকাজের দায়িত্ব ছিল। আমার ওপর। হবিগঞ্জ বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। হাওর এলাকায় প্রতিবছরই বর্ষাকালে বিশাল জলরাশি জমত। এ ছাড়া পূর্বাঞ্চলে খোয়াই, সুতাং, কলকলিয়া ইত্যাদি নামে কতগুলো পাহাড়ি নদী ছিল। বেশি বৃষ্টি হলে এই পাহাড়ি নদীগুলোতে বন্যা হতো। বিশেষ করে খোয়াই নদীতে প্রায়ই বন্যা হতো। খোয়াই নদীর দুপাশে বাঁধ ছিল কিন্তু বন্যায় এ বাঁধ ভেসে যেত। যেখানে বাঁধ ভেসে যেত, সেখানে গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে যেত এবং ফসল নষ্ট হতো। কাজেই গোটা বর্ষাকালে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসনকে খোয়াই নদীর বন্যার সমস্যা নিয়ে তটস্থ থাকতে হতো।
১৯৭০ সালের মে মাসে সুনামগঞ্জের কয়েকটি পাহাড়ি নদীতে ঢল নামে। সুনামগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক সরকারের কাছে ত্রাণ মঞ্জুরি প্রার্থনা করেন। সুনামগঞ্জকে ত্রাণ দেওয়া হয়। সুনামগঞ্জের পানি গড়িয়ে কিশোরগঞ্জে যায়। কিশোরগঞ্জ মহকুমা হাকিমও ত্রাণ দাবি করেন। সেখানেও ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিশোরগঞ্জের পানি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যায়। কিশোরগঞ্জের মহকুমা হাকিমের অনুকরণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা প্রশাসকও তাঁর মহকুমার জন্য ত্রাণ বরাদ্দ দাবি করেন। তাঁকেও ত্রাণ দেওয়া হয়। হবিগঞ্জের মধ্য দিয়েও বন্যার পানি প্রবাহিত হয়েছে, হবিগঞ্জ থেকে কোনো ত্রাণ না চাওয়ায় কোনো সাহায্যও দেওয়া হয়নি। হবিগঞ্জের ত্রাণ না চাওয়ার কারণ আমি। তৎকালীন রিলিফ কোডে লেখা ছিল যদি কোনো অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি না হয়, তাহলে সেখানে ত্রাণ বরাদ্দ চাওয়া সঠিক কাজ নয়। আমি হবিগঞ্জের বানিয়াচং এবং লাখাই থানায় স্পিডবোটে করে হাওর অঞ্চলে যাই। সেখানে সবাই বলে, যে পরিমাণ পানি বেড়েছে, তা প্রতিবছরই বর্ষার সময় বাড়ে। ত্রাণ দেওয়ার মতো কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেনি। আমার এ সিদ্ধান্তে হবিগঞ্জের রাজনীতিবিদেরা অসন্তুষ্ট হন। সমালোচনা করে তারা বলেন যে চাইলেই যেখানে সাহায্য পাওয়া যেত, সেখানে সাহায্য না নেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক নয়।
এরপর জুন মাসে একদিন রাতের বেলা হইচই শুনে আমার ঘুম ভেঙে যায়। খোঁজ নেওয়ার জন্য আমার বাংলোর বাইরে লোক পাঠাই এবং তাঁরা। এসে খবর দেন খোয়াই নদের বাঁধ ভেঙে গেছে। তবে শহরের দিকে বাধ ভাঙেনি। শহরের উল্টো দিকের বাঁধ ভেঙেছে। তাই সেখান থেকে আর্তজনতার চিৎকার ভেসে আসছে। আমি তৎক্ষণাৎ জিপ নিয়ে আমার বাসা থেকে বৃন্দাবন কলেজের অধ্যক্ষের বাসায় যাই এবং তাকে তুলে নিয়ে কলেজের হোস্টেলে যাই। হোস্টেলে ছাত্রদের ঘুম থেকে তুলে রিলিফ কাজে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। ছাত্ররা উৎসাহের সঙ্গে এগিয়ে আসে। আমি থানার দারোগাকে কতগুলো নৌকা সাময়িক ভিত্তিতে অধিগ্রহণের জন্য আদেশ দিই। দারোগা ত্রিশ-চল্লিশটি নৌকা হাজির করে। আমি চিড়া-মুড়ি এবং গুড় কেনার জন্য টাকা দিই। নাজির রাতের বেলা দোকানদারদের দোকান খুলতে বাধ্য করে এবং খাদ্যদ্রব্যসমূহ ক্রয় করে। চিড়া, মুড়ি এবং গুড় ছাত্রদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পাঠানো হয়। তাদের নির্দেশ দেওয়া হয় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের যেন নৌকায় করে উঁচু জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সকালের নাশতার জন্য চিড়া, মুড়ি এবং গুড় দেওয়া হয়। এভাবে সূর্য ওঠার আগেই ত্রাণকাজ শুরু হয়ে যায়।
পরদিন সকালে স্পিডবোটে করে আমি বন্যা-উপদ্রুত অঞ্চলে যাই এবং সেখানে প্রত্যেক পরিবারের জন্য গম বরাদ্দ করি। সরকারের সাধারণ নিয়ম হলো কোনো এলাকায় দুর্যোগ ঘটলে সেই এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের তালিকা তৈরি করবেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্য। এই তালিকা ইউনিয়ন ভিত্তিতে একত্র করে মহকুমা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়। তারপর মহকুমা প্রশাসন ত্রাণের পরিমাণ নির্ধারণ করেন। এতে কমপক্ষে সাত থেকে দশ দিন সময় লেগে যেত। এ ক্ষেত্রে যেহেতু বন্যার্তদের তালিকা তৈরির ভার ছাত্রদের হাতে দেওয়া হয়, সেহেতু ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তালিকা হয়ে যায়।
অন্যদিকে সরকারের সাধারণ নিয়মে সরকারের গুদাম থেকে ত্রাণের পণ্য ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যদের উঠিয়ে আনতে হতো। সব সময় এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ থাকত না। তাই ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যরা ত্রাণ বিতরণের আগে একটি অংশ যাতায়াতের খরচ বাবদ কেটে রাখতেন। বরাদ্দ করা পুরো ত্রাণ উপকারভোগীদের কাছে পৌঁছাত না। এই ক্ষেত্রে কিন্তু সম্পূর্ণ ত্রাণই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা পেয়ে যান। এর ফলে এলাকার জনগণ খুবই সন্তুষ্ট হন। এই বন্যার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন অ্যাডমিরাল আহসান। অ্যাডমিরাল সাহেব খোয়াই নদের বন্যা-উপদ্রুত অঞ্চল পরিদর্শনের জন্য এক প্রোগ্রাম করেন। এ খবর খবর শুনে সিলেট জেলার ডেপুটি কমিশনার তিন-চারটি স্পিডবোটসহ হবিগঞ্জে উপস্থিত হন। গভর্নর সাহেব হবিগঞ্জ শহরে এসে স্পিডবোটে ওঠেন। স্পিডবোটে করে তিনি শায়েস্তাগঞ্জ পর্যন্ত যান। পথে বিভিন্ন জায়গায় জনসমাবেশ ঘটে। গভর্নরের প্রশ্নের উত্তরে উপস্থিত জনগণ জানায় যে হবিগঞ্জে খোয়াই নদের বন্যার ক্ষেত্রে এ ধরনের ত্রাণ তৎপরতা অভূতপূর্ব। তারা গভর্নরকে বলেন, হবিগঞ্জের এসডিও যে দ্রুততার সঙ্গে এ কাজ সুষ্ঠুভাবে করেছেন, তা এর আগে কোনো দিনও হয়নি। তারা এসডিও জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দেয়। গভর্নর সাহেব এতে খুবই সন্তুষ্ট হন এবং আমাকে খুঁজে বের করে তার পাশে বসিয়ে লোকজনের দাবিদাওয়ার কথা শোনেন। এই ত্রাণকাজের সাফল্যের জন্য ডেপুটি কমিশনার সাহেব খুবই সন্তুষ্ট হন।
(৬) মহকুমা প্রশাসন এবং শিক্ষাব্যবস্থা : বাংলাদেশে মাঠপর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থা তদারকির জন্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিটি থানায় শিক্ষা বিভাগের অফিস রয়েছে। তেমনি মহকুমা ও জেলায়ও শিক্ষা অফিস ছিল। তবে এসব অফিস শুধু নৈমিত্তিক দায়িত্ব পালন করতে পারত। কোনো জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় এদের কোনো সামর্থ্য ছিল না। ষাটের দশকে সরকার পরিচালিত প্রবেশিকা এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ইন্টারমিডিয়েট এবং স্নাতক পরীক্ষায় ব্যাপক নকল শুরু হয়। শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের পরীক্ষা পরিচালনার ক্ষমতা ছিল না। পরীক্ষা পরিচালনা করত জেলা প্রশাসন। সৌভাগ্যবশত হবিগঞ্জে তখন পর্যন্ত গণহারে টোকাটুকি শুরু হয়নি। এ ছাড়া শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও দুর্নীতি হতো। সে জন্য সরকার মহকুমা প্রশাসকদের স্কুল কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনয়ন দিত। উপরন্তু অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হতো। এই কাজ সঠিকভাবে করা হয়েছে কি না, সেটা দেখার সামর্থ্যও শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের ছিল না। কাজেই শিক্ষা বিভাগের নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থাকা সত্ত্বেও শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা মহকুমা প্রশাসনের একটি দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। আমি যখন হবিগঞ্জের এসডিও, তখন হবিগঞ্জ মহকুমায় প্রায় ৪০টি স্কুল ছিল। এ স্কুলগুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। এসব স্কুল পরিদর্শন করাও সহজ ছিল না। অথচ প্রায় প্রতিটি স্কুলেরই কোনো না কোনো সমস্যা লেগে থাকত। এ বিষয়ে এসডিওকে সাহায্য করার জন্য কোনো অতিরিক্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারীও দেওয়া হয়নি। আমি যখন হবিগঞ্জে ছিলাম, তখন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার করিম ইকবাল হবিগঞ্জ সফরে এসেছিলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, মহকুমা প্রশাসক হিসেবে আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা কী? আমি তাকে উত্তরে বলেছিলাম যে বিধিবদ্ধ দায়িত্বের বাইরে অন্য বিভাগের অতিরিক্ত কাজই হলো সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা। এ প্রসঙ্গে শিক্ষা বিভাগের সমস্যাগুলো আমি তার কাছে তুলে ধরি এবং তিনি একমত হন। তিনি বলেন, এ সম্পর্কে তিনি চিফ সেক্রেটারির কাছে লিখবেন। বর্তমানে সরকার প্রতিটি জেলায় শিক্ষার জন্য একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের পদ সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এ সত্ত্বেও শিক্ষা সমস্যার উপযুক্ত সমাধান হয়েছে বলে মনে হয় না।
(৭) মিত্রপক্ষের গুলি : সরকারি কর্মকর্তারা বিধি মোতাবেক তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁরা ধরে নেন যে দায়িত্ব পালন করাই তাদের কাজ। দায়িত্ব পালনের ফলে যে লক্ষ্য অর্জনের কথা, সেটা হয়েছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব সরকারের কর্মকর্তাদের নয়। অথচ সরকারি কর্মকর্তারা যদি তাদের কাজের মূল্যায়ন নিজেরা করেন, তাহলে অনেক কিছু শিখতে পারেন। আমি যেখানেই কাজ করেছি, সেখানেই আমার কাজের প্রভাব সম্পর্কে প্রশ্ন করেছি। এবং প্রয়োজনীয় তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে নতুন জ্ঞান লাভ করেছি।
হবিগঞ্জে আমি যখন যাই, তখন মাঠপর্যায়ের প্রশাসনের স্লোগান ছিল উন্নয়নের জন্য কাজ করো, কিন্তু উন্নয়নের কাজের ফল সব সময় ভালো হয় না। অনেক সময়ে উন্নয়নের জন্য করা কাজ অনুন্নয়ন ঘটায়। এ বিষয়ে আমার মনে প্রথম সন্দেহ জন্মে হবিগঞ্জে মহকুমা হাকিম থাকাকালে। তখন হবিগঞ্জে ফৌজদারি আদালতে মামলার সংখ্যা বেড়ে চলছিল। এতে ডেপুটি কমিশনার এবং আমি উভয়ই উদ্বিগ্ন ছিলাম। তখন আদালতে মোটামুটি তিন ধরনের মামলা ছিল। প্রথমত, ব্যক্তি উদ্যোগে রুজু করা মামলা। দ্বিতীয়ত, জেনারেল রেজিস্ট্রার (জিআর) মামলা, যেখানে পুলিশের রুজু করা মামলার বিচার করা হতো। তৃতীয় ধরনের মামলা ছিল নন জেনারেল রেজিস্ট্রার বা বিবিধ প্রকৃতির মামলা। পরীক্ষা করে দেখা গেল, হবিগঞ্জে প্রায় ৫০০-এর মতো এ ধরনের মামলা রয়েছে। এই ৫০০ মামলার মধ্যে প্রায় ২০০ মামলা করা হয়েছে দুধে পানি মেশানোর জন্য। এই মামলাগুলো করা হয় পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স ১৯৫৯-এর অধীনে। দুধে পানি মেশানোর জন্য শাস্তির বিধান। পাকিস্তান পেনাল কোডে ২৭৩ ও ২৭৪ ধারাতেও রয়েছে। তবে পেনাল কোড অনুসারে দুধে পানি মেশালেই অপরাধ হবে না, দুধে ক্ষতিকর জিনিস মেশালে অপরাধ হবে। পেনাল কোডে দুধে পানি মেশানোর জন্য কোনো সর্বনিম্ন সাজা নির্ধারিত হয়নি। ম্যাজিস্ট্রেট সর্বাধিক ছয় মাসের জেল অথবা এক হাজার টাকা জরিমানা করতে পারবেন। কিন্তু সর্বনিম্ন কী সাজা ম্যাজিস্ট্রেট দেবেন, তা ম্যাজিস্ট্রেটের ওপর নির্ভর করত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট দোষী ব্যক্তিকে আধুলি বা এক টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দিতেন।
১৯৫৮ সালে যখন পাকিস্তানে সামরিক শাসন হয়, তখন দেশে দুধের অভাব থাকায় দুধে পানি মেশানো বেড়ে যায়। সামরিক কর্তৃপক্ষ এই সমস্যার একটি চিরস্থায়ী সমাধান চান। আইনজ্ঞরা পরামর্শ দিলেন বর্তমান আইনে দুধে পানি মেশালে খুবই নগণ্য শাস্তি হয়। এর ফলে মামলা করেও কোনো লাভ হয় না। এ ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন সাজা থাকা উচিত। তাই পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স ১৯৫৯ জারি করে বিধান করা হয় যে কেউ দুধে পানি মিশিয়েছে তা প্রমাণিত হলে তাকে কমপক্ষে ১৫০ টাকা জরিমানা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দুধে কোনো কিছু মেশালেই তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে; যে দ্রব্যটি মেশানো হবে, তার ক্ষতিকর হওয়ার প্রয়োজন নেই। দুধে যে কোনো কিছু মেশানো হলেই তা এই আইনের অধীনে অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।
হবিগঞ্জের আদালতে তখন দুধে পানি মেশানোর জন্য প্রায় ২০০টি মামলা অনিষ্পন্ন ছিল। দুধে পানি মেশানো হলে সেই দুধের একটি নমুনা শিশিতে ভরে মহাখালীতে রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হতো। এই নমুনা পরীক্ষা করে যদি রাসায়নিক পরীক্ষক প্রত্যয়ন করেন যে দুধে কোনো কিছু মেশানো হয়েছে, তাহলেই এ মামলার আসামির শাস্তি হবে। এই প্রেক্ষাপটে রাসায়নিক পরীক্ষকের বিরুদ্ধে দুই বছরের বেশি সময় ধরে নমুনা ফেলে রাখার অভিযোগ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নালিশ করি। অনেক চিঠি লেখালেখির পর হঠাৎ একদিন দেখতে পাই যে ৫০টি মামলার রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন এসেছে। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই প্রমাণিত হয়েছে যে দুধে পানি মেশানো হয়েছে। আমি আসামিদের তলব করি। আসামিরা আদালতে উপস্থিত হলে সরকারপক্ষের কোর্ট ইন্সপেক্টর আমাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে এ মামলাগুলো পেনাল কোডের অধীনে করা হয়নি। এ মামলাগুলো করা হয়েছে পিওর ফুড অর্ডিন্যান্সের অধীনে। সুতরাং তাদের প্রত্যেককে কমপক্ষে ১৫০ টাকা করে জরিমানা করতে হবে। ১৫০ টাকা জরিমানা অত্যন্ত বেশি ছিল। কারণ, ১৯৭০ সালে এই অঙ্ক পূর্ব পাকিস্তানে বার্ষিক মাথাপিছু আয়ের প্রায় ৪৬ শতাংশ ছিল। এ ধরনের জরিমানা দেওয়ার ক্ষমতা এদের অনেকেরই ছিল না।
আমি বললাম, যেহেতু আইনে সর্বনিম্ন জরিমানার বিধান আছে, সেহেতু ১৫০ টাকা জরিমানা করা ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। ৫০ জন দুধ বিক্রেতাকে ১৫০ টাকা করে জরিমানা করা হলো। মনে মনে ভাবলাম যে এর ফলে নিশ্চয়ই দুধ বিক্রেতারা সতর্ক হবে এবং দুধে পানি মেশানো কমে যাবে। সত্যি সত্যি এটা ঘটছে কি না, তা জানার জন্য আমার মনে কৌতূহল জাগে। আমি হবিগঞ্জ কলেজের একজন শিক্ষক এবং খাদ্য বিভাগের একজন। কর্মকর্তাকে বাজারে এর কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে, সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের অনুরোধ করি। তারা জানাল, এই জরিমানার পর পৌরসভার স্যানিটারি ডিপার্টমেন্টের কর্মচারীরা প্রত্যেক দুধ বিক্রেতার কাছ থেকে অতিরিক্ত ঘুষ দাবি। করছেন। তারা ভয় দেখাচ্ছেন যে ঘুষ না দিলে দুধের নমুনা পরীক্ষার জন্য। পাঠিয়ে দেবেন। তারা এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে একবার দুধে পানি আছে প্রমাণিত হলে পাগলা মহকুমা হাকিম তাদের ১৫০ টাকা জরিমানা করবেন। দুধ বিক্রেতারা দুধে পানি মেশাচ্ছিল। তাই তারা স্যানিটারি বিভাগের কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয় এবং ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য দুধের মধ্যে পানির পরিমাণ আরেকটু বাড়িয়ে দেয়। সর্বনিম্ন জরিমানা করে দুধে পানি মেশানো কমেনি, দুধে পানি মেশানো বেড়ে গেছে। দুধে পানি মেশানো কমাতে হলে দুধের উৎপাদন বাড়াতে হবে। দুধের উৎপাদন না বাড়লে খাঁটি দুধের দাম অনেক বেশি রাখতে হবে; অন্যথায় স্বল্প মূল্যে বাজারের চাহিদা মেটানো যাবে। সুতরাং আইন করে এই সমস্যার কোনো সমাধান করা সম্ভব ছিল না।
পরবর্তীকালে জেনেছি, এই ধরনের ব্যাপারকে ‘মিত্রপক্ষের গুলি’ বলা হয়ে থাকে। মিত্রপক্ষের গুলি’র ধারণাটির জনক হলেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। ‘মিত্রপক্ষের গুলি’র অর্থ হলো যে আক্রমণ শত্রুপক্ষের তরফ থেকে আসে না, মিত্ররাই নিজেদের মিত্রকে আক্রমণ করে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ইরাক অভিযানের সময় ইরাকি সৈন্যদের হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সৈন্য মারা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সব সৈন্য মারা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের গুলিতে, যারা মার্কিন সৈন্যদের ইরাকি সৈন্য বলে ভুল করে গুলি চালায়। আমি লক্ষ করি যে শুধু আইনের ক্ষেত্রেই মিত্রপক্ষের গুলি চলছে না; উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও প্রকট।
১৯৭০ সালের শেষ দিকে একদিন বিকেলবেলা আমি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে শায়েস্তাগঞ্জের নিকটস্থ একটি রাজস্ব অফিস পরিদর্শন করছিলাম। আমি যখন রাজস্ব অফিসের কাগজপত্র পরীক্ষা করছি, তখন দেখতে পেলাম একদল লোক অফিসের সামনে জড়ো হয়েছে। আমি অনুমান করলাম সম্ভবত রাজস্ব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নালিশ নিয়ে এরা এসেছে। পরিদর্শন শেষে আমি বেরিয়ে এলাম এবং উপস্থিত জনতাকে জিজ্ঞেস করলাম তারা কী চান? তাঁরা বললেন, ‘হুজুর, আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি একবার দেখে যান। আমি তাড়াতাড়ি হবিগঞ্জ ফিরে যেতে চাইছিলাম। তাই আমি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন এড়াতে চাইলাম। তবে তাদের অনুনয়-বিনয়ের ফলে আমি স্কুলটি দেখতে রাজি হলাম। রাজস্ব অফিস থেকে অল্প দূরেই ছিল স্কুলটি। সেখানে গিয়ে দেখতে পাই যে স্কুলের দালানের ছাদ ধসে গেছে।
গ্রামের মাতবরেরা উন্নয়নের কাহিনি আমাকে শোনাল। এ স্কুলে প্রায় ৫০ বছর ধরে এলাকার শিশুদের পড়াশোনা চলছিল। এলাকার লোকজন চাদা তুলে একটি টিনের ঘরে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করে। দুই বছর আগে শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা এলাকায় আসেন এবং গ্রামের লোকজনকে জানান যদি গ্রামের লোকজন নির্মাণ ব্যয়ের ২০ শতাংশ প্রদান করেন, তাহলে সরকার ৮০ শতাংশ ব্যয় বহন করবে। তারা গ্রামবাসীকে উপদেশ দিলেন যে টিনের ঘরটি বিক্রি করে দিলে এই ২০ শতাংশ অর্থ অনায়াসে পাওয়া যাবে। গ্রামের লোকেরা রাজি হলো, টিনের ঘরটি বিক্রি করে দেওয়া হলো। থানা শিক্ষা অফিসার দালান নির্মাণের জন্য একজন ঠিকাদার নিয়োগ করলেন। দালান নির্মাণের কাজ ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে সম্পন্ন হয়। সর্বশেষ পর্যায়ে ছাদ ঢালাই করা হয়। নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করায় ঢালাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছাদটি ধসে পড়ে। মহানুভব সরকার স্কুল নির্মাণের অর্থ বরাদ্দ করার আগে এখানে টিনের ঘরে একটি স্কুল ছিল; কিন্তু সরকারের বরাদ্দ ব্যয় করার পর এখন কোনো স্কুল নেই। প্রথম সমস্যা হলো কী জন্য তা ঘটেছে, তা নির্ণয় করা। দুর্নীতি দমন ব্যুরো নির্দেশ দিয়েছে যোগ্যতাসম্পন্ন প্রকৌশলীরা ধ্বংসস্তূপ পরীক্ষা করার আগে এখানে কোনো কাজ করা যাবে না। সাম্প্রতিক বন্যায় এ অঞ্চলে ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। স্কুলটি পুনর্নির্মাণের ব্যয় গ্রামবাসীর পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়, তারা এ সমস্যার সমাধান চায়। আমার কাছে এর কোনো সমাধান ছিল না। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম যে কমপক্ষে দু-তিন। বছরের আগে এ সমস্যার সমাধান হবে না। এই ঘটনার আগে আমি বিশ্বাস। করতাম যে সরকার থেকে সম্পদ বরাদ্দ করা সম্ভব হলেই শুধু আমলাতন্ত্রের উদ্যোগে উন্নয়নের বেশির ভাগ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু মাঠের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেল যে এটি সম্ভব নয়। সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখা যায় যে জনগণ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
এসব ঘটনা থেকে গণপ্রশাসনে ‘মিত্রপক্ষের গুলি সম্পর্কে আমি চিন্তাভাবনা শুরু করি। পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় সরকারে কাজ করার সময় এ ধরনের ঘটনা আরও অনেক দেখতে পাই। এসব ঘটনা শুধু বাংলাদেশেই ঘটেনি– ভারত, পাকিস্তান ও চীনে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। দীর্ঘ চার দশকের চিন্তাভাবনার পর আমি Friendly Fires, Humpty Dumpty Disorder; and Other Essays বইটি লিখি।
তবে আমি শুধু মিত্রপক্ষের গুলি’র তত্ত্বেই বিশ্বাস করি না, এই ধারণাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমি হবিগঞ্জে একটি বড় প্রকল্পের বিরোধিতা করি। খোয়াই নদের বন্যায় হবিগঞ্জের প্রশাসন ও জনগণ অতিষ্ঠ ছিল। তাই দীর্ঘদিন ধরে তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে একটি সুষ্ঠু প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আসছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ড খোয়াই নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি উপযুক্ত প্রকল্প প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি বিদেশি পরামর্শক কোম্পানিকে নিয়োগ করে। এই পরামর্শক কোম্পানি অভিমত প্রকাশ করে যে খোয়াই নদের পাশে সংকীর্ণ বাধ। দেওয়া হলে, তা দিয়ে বন্যার সময়ে পানি আটকে রাখা সম্ভব নয়। এসব বাঁধ দুর্বল এবং জনগণ বিভিন্ন কাজে এসব বাঁধ ব্যবহার করার ফলে অনেক স্থানেই এরা দুর্বল হয়ে পড়ে। কাজেই নদের তীর থেকে একটু দূরে শক্ত করে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। বাঁধের ভেতরে যেসব বাড়িঘর এবং জমি থাকবে, তাদের বন্যার ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যাবে না। কিন্তু বাঁধের বাইরে অবস্থিত কৃষিজমি এবং আবাদসমূহ বন্যার ক্ষতি থেকে মুক্ত থাকবে। এই বাঁধ নির্মাণ করার জন্য জমি হুকুম দখলের প্রয়োজন। জমি হুকুমদখলের কাজ করত জেলা প্রশাসন।
সিলেটের জমি হুকুমদখলের বিভাগ এ সম্পর্কে সমীক্ষার জন্য তাদের কর্মকর্তাদের পাঠান। কিন্তু এলাকার জনগণ এই কর্মকর্তাদের কাজে বাধা দেয়। তখন আমাকে এ অঞ্চলের জনগণের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সমস্যাটি সমাধানের জন্য অনুরোধ করা হয়। আমি তখন পরামর্শকদের রিপোর্ট পড়ি। এই রিপোর্ট পড়ে আমার মনে দুটি সন্দেহ জাগে। প্রথমত, পরামর্শক ধরে নিয়েছেন বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ভূমির কোনো সমস্যা নেই। অথচ এই অঞ্চল পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার একটি। কাজেই ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণ অবশ্যই হ্রাস করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিদেশি পরামর্শক প্রস্তাব করেন খোয়াই নদের পানি ব্যবহার করে এই অঞ্চলে সেচের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু শীতকালে যখন সেচের প্রয়োজন, তখন খোয়াই নদে খুবই অল্প পানি থাকে। এই পানি দিয়ে কোনোমতেই এই অঞ্চলে কৃষিতে সেচের ব্যবস্থা সম্ভব নয়। জনসাধারণের সঙ্গে সভা করে আমি সিদ্ধান্ত নিই যে এ প্রকল্প সংশোধন করতে হবে, অন্যথায় এর বাস্তবায়ন মানুষের জন্য দুর্দশা ডেকে আনবে। পরবর্তীকালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য জনসাধারণের সঙ্গে আলোচনা করতে যান। আমি জনগণের দাবি তুলে ধরি। অনেক তর্কবিতর্কের পর তিনি প্রকল্পটি সংশোধন করতে এবং ছোট করতে রাজি হন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশে খোয়াই বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সমস্যার সমাধান হয়নি। অনেক চাষের জমি অকৃষিকাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং সরকারের বিরাট বিনিয়োগের কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। তাই প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পেই ‘মিত্রপক্ষের গুলি’র সম্ভাবনা সম্পর্কে সজাগ থাকার প্রয়োজন রয়েছে। প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে প্রণয়ন না করা হলে, বাস্তবায়ন না করা হলে এবং বাস্তবায়নের পর পরিচালনা না করা হলে প্রকল্প কখনোই টেকসই হবে না।