ষষ্ঠ অধ্যায়
কলেজজীবন : ১৯৫৯-১৯৬১

ঢাকা কলেজ

প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করার পর উচ্চমাধ্যমিক পড়ার জন্য নবীনগরের বাইরে যেতে হয়। নবীনগরে তখন কোনো কলেজ ছিল না। এ সময়ে কলেজে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে আমাকে সহায়তা করেন সনাতনদা। সনাতন সাহা আমার বড় চাচা ফজলে আলী খাঁর মুহুরি ছিলেন। পরে তিনি সমবায় বিভাগে কাজ করেন। বড় চাচা নবীনগর সমবায় ব্যাংকের সম্পাদক ছিলেন। বড় চাচা মারা যাওয়ার পর আমার বাবা সমবায় ব্যাংকের সম্পাদক হন। সনাতনদা বাবার সঙ্গেও কাজ করেন এবং তারপর সমবায় বিভাগে পদোন্নতি পেয়ে নবীনগরের বাইরে চলে যান। কিন্তু সনাতনদা আমৃত্যু আমাদের পরিবারের সব সদস্যের খোঁজখবর নিতেন এবং সবাইকে তাঁর ক্ষমতার মধ্যে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। আমরা যেসব আত্মীয়স্বজনকে চিনতাম না, সনাতনদা তাঁদেরও চিনতেন এবং তাঁদের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতেন। শুধু আমাদের পরিবারেরই নয়, সমবায় বিভাগের উধ্বর্তন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও তার গভীর সম্পর্ক ছিল। সনাতনদা যখন সমবায় বিভাগের থানা পর্যায়ের কর্মকর্তা, তখন সমবায় বিভাগের সারা প্রদেশের নিবন্ধক ছিলেন সলিমুল্লাহ ফাহমি নামের একজন জ্যেষ্ঠ সিএসএস কর্মকর্তা। তার গুণাবলির পরিচয় পেয়ে সলিমুল্লাহ ফাহমি অনেক বিষয়ে তার ওপরে নির্ভরশীল হয়ে ওঠেন। আমরা যে রকম তাঁকে সনাতনদা বলে ডাকতাম, তেমনি সলিমুল্লাহ ফাহমির ছেলেমেয়েরাও তাঁকে সনাতনদা বলে ডাকতেন।

সৌভাগ্যবশত আমার প্রবেশিকা পরীক্ষা যখন শেষ হয়, তখন ঢাকায়। আমার চাচাতো ভাইদের আর্থিক সচ্ছলতা আসে। শকুদা তখন মেজর হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছেন এবং খুলনায় একটি জুট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ করছিলেন। আরেক চাচাতো ভাই মন্টুদা (মোস্তাফিজুর রহমান খান) তখন ঢাকার এডিশনাল এসপি। মিল ব্যারাকে থাকতেন এবং তার আম্মা তার সঙ্গে থাকতেন। তাঁর ছোট ভাই শহীদদা (আমান উল্লাহ খান) এসো (Esso) নামক একটি তেল কোম্পানির কোভিন্যানটেড অফিসার হিসেবে কাজ করতেন এবং বকশীবাজারে সস্ত্রীক সংসার পেতে বাস করতেন। সবচেয়ে ছোট ভাই ঝুনুদা (আহসান উল্লাহ খান) তখন বিলাত যাওয়ার বৃত্তি পেয়ে গেছেন এবং বিলাত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বড় ভাই শকুদা ছাড়া আর চার ভাই দ্বিতীয় ভাই আনুদার সঙ্গে জয়কালী মন্দিরে এক বাড়িতে থাকতেন। প্রত্যেক ভাই আলাদা হয়ে যাওয়ার পর আনুদা জয়কালী মন্দিরের বাড়ি ছেড়ে এলিফ্যান্ট রোডের রওশন মঞ্জিল নামে একটি একতলা বাড়িতে চলে আসেন। এই একতলা বাড়িতে একটি শোবার কক্ষ আর একটি ড্রয়িংরুম ছিল। শোবার কক্ষে আনুদা, ভাবি ও তাদের একমাত্র ছেলে লুডু থাকত আর ড্রয়িংরুমে আমি থাকতাম। রান্নাঘরের পাশে একটু জায়গা ছিল, যেখানে আমার পড়ার টেবিল এবং বইপত্র রাখা হতো। সনাতনদা-ও তখন অবসর গ্রহণ করে আনুদার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আনুদা তখন গণস্বাস্থ্য বিভাগে নলকূপের ‘বাকেট’ (Bucket) সরবরাহ করতেন। এই বাকেট সরবরাহ করার জন্য আনুদার বাসা থেকে সামান্য দূরে একটি টিনের ঘরে বাকেট কারখানা স্থাপন করা হয়। সনাতনদা সেই কারখানাতেই থাকতেন। তবে আমরা সবাই একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করতাম।

প্রবেশিকা পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর সনাতনদা আমাকে ঢাকায় আনুদার বাসায় নিয়ে যান। এলিফ্যান্ট রোডের কাছেই ছিল ঢাকা কলেজ এবং কলেজ হিসেবে সেটি তখন সারা পূর্ব পাকিস্তানে সুপ্রতিষ্ঠিত। তখন ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়া সহজ ছিল। বিজ্ঞান বিভাগে যারা প্রথম শ্রেণিতে প্রবেশিকা পাস করত, তাদের ভর্তি ছিল নিশ্চিত। কলা এবং বাণিজ্য বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বে যারা নম্বর পেত, তাদের সহজেই ভর্তি করা হতো। নবীনগর স্কুল থেকে আমার সঙ্গে দ্বিতীয় বিভাগে পাস করে আমার বন্ধু মোজাম্মেল হক। সে-ও ঢাকা কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হয়।

আমার মা আমার কলা বিভাগে পড়ার সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যেন আমি বিজ্ঞান পড়ে হয় প্রকৌশল, নয় চিকিৎসাবিদ্যায় ডিগ্রি লাভ করি। কিন্তু কলা বিষয় পড়ার জন্য আমার আগ্রহের ফলে তিনি শেষ পর্যন্ত তাঁর আপত্তি প্রত্যাহার করেন। তখন কলা বিভাগের ১০টি পত্র ছিল বাধ্যতামূলক। দুটি পত্র বাধ্যতামূলক বাংলা, দুটি পত্র বাধ্যতামূলক ইংরেজি। ছাত্ররা পছন্দমতো তিনটি বিষয় বেছে নিত। আমি বেছে নিয়েছিলাম তর্কশাস্ত্র বা লজিক, ইতিহাস, পৌরনীতি এবং অর্থনীতি। আরেকটি বিষয় বাধ্যতামূলক ছিল না, তবে ওই বিষয়ে যে নম্বর পাওয়া যেত, তা থেকে ৬০ নম্বর বাদ দিয়ে বাকি নম্বর মোটের সঙ্গে যোগ করা হতো। এর ফলে যারা বাধ্যতামূলক বিষয়ে প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির নম্বর পেত না, তারা এ অতিরিক্ত নম্বর যোগ করে উচ্চতর শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে পারত। অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে আমি বেছে নিই বাংলা সাহিত্য।