ঢাকা কলেজের শিক্ষকমণ্ডলী

১৯৫৯ সালে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন এম ইউ আহমদ বা মোফাসসল উদ্দিন আহমদ। তিনি একজন মনস্তত্ত্ববিদ ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এমএ পাস করার পর তিনি টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনস্তত্ত্ব বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এ ছাড়া পাগলদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারেও তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি অবসর সময়ে পাগলদের চিকিৎসা করতেন। তিনি Hypnosis বা সম্মোহন করতে পারতেন। ঢাকা কলেজে নতুন ক্যাম্পাসে তখনো অধ্যক্ষের বাড়ি নির্মাণ করা হয়নি। তাই তিনি মূল ভবনে শিক্ষকদের কমন রুমের পাশে তিনটি রুম নিয়ে থাকতেন। কলেজের উপাধ্যক্ষ ছিলেন শফিকুর রহমান। তিনি একজন অর্থনীতিবিদ ছিলেন। পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্পর্কে তার একটি বই বিএ ক্লাসের ছেলেরা পড়ত। তিনি ক্লাসে পড়াতেন না। প্রশাসনের কাজকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন।

ঢাকা কলেজে তখন বাংলা বিভাগ খুবই শক্তিশালী ছিল। বিভাগীয় প্রধান ছিলেন সৈয়দ হিসামুদ্দিন আহমদ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাস করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি বগুড়া কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি খুবই হাস্যরসিক ছিলেন, রসাত্মক গল্প বলে ক্লাসের সবার কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। নিজামউদ্দিন আহমদ পড়াতেন বাংলা কথাসাহিত্য। পড়াতেন ভালো, তবে গাম্ভীর্যের জন্য জনপ্রিয় ছিলেন না। এই সময়ে ঢাকা কলেজে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বদলি হয়ে আসেন শওকত ওসমান। শওকত ওসমান আমাদের শরৎচন্দ্রের দত্তা পড়াতেন। বাংলা সাহিত্য কোর্সে তিনি আবুল ফজলের চৌচির পড়াতেন। শওকত ওসমান বইগুলোর কোনোটিই ভালো করে পড়াতেন না। বইগুলোর সামাজিক বিশ্লেষণ করতেন। এর ফলে সবাই তার বক্তৃতায় উপকৃত হতো না। তবে আমার কাছে তার পড়ানো ভালো লাগত। কবিতা পড়াতেন আবদার রশীদ। তিনি ছন্দ খুব ভালো বুঝতেন। আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার কয়েক মাস পরে বাংলা বিভাগে যোগ দেন অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকী। অধ্যাপক আশরাফ সিদ্দিকী আমাকে মানসী কাব্যগ্রন্থ পড়ান। তিনি অত্যন্ত চমৎকার শিক্ষক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের খণ্ড ও অখণ্ড সৌন্দর্যের ধারণা নিয়ে তিনি ‘সুরদাসের প্রার্থনা’, ‘অনন্ত প্রেম’ এবং ‘মেঘদূত’ কবিতা সম্পর্কে যা বলেছিলেন, তা আজও আমার মনে আছে। আশরাফ সিদ্দিকীর কাছে পড়ার ফলেই আমি রবীন্দ্রসাহিত্যে আরও অনুরক্ত হয়ে পড়ি। ওই সময়ে ঢাকা কলেজে বাংলা বিভাগের প্রথম মহিলা শিক্ষক রওশন আরা রহমান যোগদান করেন। তাঁর কাছে আমি বাংলা টিউটোরিয়াল করেছি।

তর্কশাস্ত্র আমাদের পড়াতেন দুজন শিক্ষক। আবদুল ওহাব পড়াতেন অবরোহ তর্কশাস্ত্র (deductive logic) এবং আবদুল মান্নান পড়াতেন আরোহ তর্কশাস্ত্র (inductive logic)। দুজনই ভালো পড়াতেন, তর্কশাস্ত্রের অনেকগুলো পদ্ধতি যে অন্যান্য শাস্ত্রেও ব্যবহৃত হতো, তাই এ শাস্ত্র পড়ে আমি আনন্দ পাই। আইএ পরীক্ষার ফলও ভালো হয়েছিল। আমি ৮৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে তর্কশাস্ত্রে ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইএ পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাই।

ইতিহাস বিভাগে দুজন শিক্ষক ছিলেন। একজনের নাম নুরুল করিম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে এমএ পাস করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পান। কিন্তু তখন সরকারি কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেয়ে বেতনের হার ছিল বেশি। তাই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে সরকারি কলেজে চলে আসেন। ইতিহাসের অনেক বই তাঁর মুখস্থ ছিল। কোরআন তিলাওয়াতের মতো ক্লাসে গলগল করে তিনি এসব বই থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরে পড়াতেন। তিনি ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা ছাড়াও ঢাকা কলেজের দক্ষিণ ছাত্রাবাসের দায়িত্বে ছিলেন। অনেক ছাত্র যথাসময়ে হোস্টেলের টাকা শোধ করত না। এতে তার প্রায়ই অসুবিধা হতো। সে জন্য যখনই কোনো ছাত্রের সঙ্গে তার দেখা হতো (তা কলেজের ভেতরেই হোক বা নিউমার্কেটে হোক), প্রথমেই তিনি প্রশ্ন করতেন, ‘তোমার বাবা কেমন আছেন? বেশির ভাগ ছাত্রের বাবাই তার ছাত্র ছিলেন। ছাত্র উত্তর দিত, বাবা ভালো আছেন। তারপরে বলতেন, পড়াশোনা ঠিকমতো করো, পড়াশোনায় কিন্তু ফাঁকি দিলে চলবে না। তারপর যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করতেন, বাবা, হোস্টেল ডিউজ ক্লিয়ার আছে তো?’ এ হোস্টেল ডিউজের প্রশ্নে ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের এক সহপাঠী বলেছিল, ‘স্যার, নিউমার্কেটেও কি হোস্টেল ডিউজের প্রশ্ন করতে হয়? অধ্যাপক মাহবুবুল করিম আমাদের প্রাচীন সভ্যতা’ পড়াতেন। প্রাচীন নামসমূহ তিনি অদ্ভুত ভঙ্গিতে উচ্চারণ করতেন। এ ব্যাপারে অনেকে তাঁকে পেছন থেকে ভেংচাত। পরবর্তীকালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং বাংলাদেশে প্রায় পনেরো বছরের বেশি সময় সরকারি মহাফেজখানার পরিচালক ছিলেন।

পৌরনীতিতে আমাদের দুজন শিক্ষক ছিলেন। সৈয়দ আহমদ বেশ ভালো পড়াতেন। পরবর্তীকালে তিনি সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। আরেকজন শিক্ষক ছিলেন সালেহ আহমদ। তিনি জোরে পড়াতে পারতেন না, এর ফলে কোনো কোনো সময় ছাত্ররা তার ক্লাসে গন্ডগোল করত। অর্থনীতির দুজন শিক্ষক ছিলেন। গোলাম রহমান ছিলেন মেধাবী ছাত্র এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে ইপিসিএসে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু চাকরির কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তাই তিনি প্রশাসন থেকে শিক্ষকতায় চলে আসেন। দৃষ্টিশক্তির অসুবিধা সত্ত্বেও তিনি প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে আসতেন এবং এর ফলে তার পড়াতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। আরেকজন অর্থনীতির শিক্ষক ছিলেন বরিশালের ইমদাদুল হক। মজুমদার। তিনি পরবর্তীকালে বিএম কলেজে অনেক দিন অধ্যক্ষ পদে কাজ করেছেন। তিনি ইংরেজি ইফ শব্দটি উচ্চারণ করতে পারতেন না। তিনি ইফকে বলতেন এফ। ছাত্ররা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত।

ইংরেজি বিভাগে বেশ কয়েকজন অধ্যাপক ছিলেন। সর্বজ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ছিলেন আবু রুশদ মতিন উদ্দিন আহমদ। তিনি বাংলায় বেশ কিছু উপন্যাস লিখেছেন। আমাদের তিনি ইংরেজি কবিতা পড়াতেন। বিশেষ করে ‘The Rhyme of the Ancient Mariner’ নামে কবিতাটি আমাদের অনেক যত্ন নিয়ে পড়িয়েছেন। ইংরেজির আরেকজন শিক্ষক ছিলেন সৈয়দ রফিকউদ্দিন আহমদ। তাঁর ইংরেজি উচ্চারণে কিছুটা জড়তা ছিল। এ নিয়ে ছাত্ররা হাসাহাসি করত। আরেকজন উর্দুভাষী ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। তিনি মোটামুটি ভালোই পড়াতেন, তবে তাকে নিয়ে ১৯৬০ সালের আইএ পরীক্ষায় একটি বড় কেলেঙ্কারি ঘটে। ১৯৬০ সালে তার ছেলে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষা দেয়। সেই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাধ্যতামূলক ইংরেজিতে আইএ পরীক্ষার প্রশ্নকর্তা ছিলেন তিনি। তার ছেলের কাছে তিনি প্রশ্ন ফাঁস করে দিয়েছেন–এ রকম একটি গুজব ছিল। কোনো কোনো ছাত্র তাঁর ছেলের সঙ্গে সুসম্পর্ক করে প্রশ্ন ফাঁস করে দেয় বলে বাজারে গুজব রটে যায়। এই গুজব যখন কর্তৃপক্ষের নজরে আসে, তখন তারা ঢাকা কলেজের সমস্ত ইংরেজির খাতা একজন বিশেষ পরীক্ষককে পরীক্ষা করতে দেন। তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয় যেন খাতাগুলোকে সর্বোচ্চ মানের দিক থেকে বিচার করা হয়। ঢাকা কলেজ থেকে সে বছর প্রায় দেড় শ ছাত্র আইএ, আইএসসি এবং আইকম পরীক্ষা দেয়। তার মধ্যে মাত্র ১০ জন ইংরেজিতে পাস করে। আর বাকি সবাই অল্প নম্বরের জন্য ফেল করে। যারা সর্বমোট দ্বিতীয় শ্রেণির নম্বর পেয়েছে, তাদের মোট নম্বর থেকে নম্বর কেটে ইংরেজিতে তাদের পাস করিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তারা পরীক্ষায় যে স্থান পাওয়ার কথা সে স্থান পায়নি। আমাদের আগের বছর রাশেদ খান মেনন ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষা দিয়েছিলেন। সর্বমোট নম্বরের ভিত্তিতে তিনি আইএ পরীক্ষাতে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। কিন্তু ২ নম্বরের জন্য ইংরেজিতে তিনি ফেল করাতে তাঁকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাস ঘোষণা করা হয় এবং চতুর্থ স্থান তাঁকে দেওয়া হয়নি।

ঢাকা কলেজে তিনজন তরুণ ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন। মাসুদ আহমদ দুই বছর চাকরি করে পরবর্তীকালে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে যোগ দেন। এনামুল করিম, তিনিও পিএফএসের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন কিন্তু চোখের ত্রুটির জন্য তাঁকে পিএফএসে নেওয়া হয়নি। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। রুহুল আমিন মজুমদার নামের আরেকজন ইংরেজির শিক্ষক পুলিশ সার্ভিস অব পাকিস্তানে যোগ দেন। পরে পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি বাংলাদেশ টোব্যাকোতে ব্যবস্থাপক পদে যোগ দিয়ে দীর্ঘদিন ওই প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।