পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কার্যক্রম

ঢাকা কলেজে লেখাপড়া ছাড়াও আমি বিভিন্ন কো-কারিকুলার বা পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার পরই সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় আমি বিতর্ক, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, গল্প বলা ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় প্রথম অথবা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করি। এতে ক্লাসের ছাত্রদের মধ্যে আমার পরিচিতি বেড়ে যায়।

ঢাকা কলেজে ১৯৫৯ সালে আইয়ুব খানের বুনিয়াদি গণতন্ত্রের অনুসরণে কলেজ ইউনিয়নে বুনিয়াদি গণতন্ত্র প্রবর্তন করা হয়। এই ব্যবস্থায় প্রত্যেক ক্লাস থেকে কয়েকজন প্রতিনিধি নির্বাচন করা হতো এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কলেজ ইউনিয়নের বিভিন্ন পদে নির্বাচন করতেন। আমি অতি সহজেই আইএ ক্লাসের প্রতিনিধি নির্বাচিত হই। দ্বিতীয় পর্যায়ে আমি সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদকের জন্য নির্বাচনে অংশ নিই। এখানেও আমি নির্বাচিত হই। এই সময়ে আমার সঙ্গে পরিচয় হয় জমির আলীর সঙ্গে। জমির আলী একজন এনএসএর নেতা ছিলেন এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তান মুসলিম লীগের সদস্য হয়েছিলেন। কলেজের সংসদের মধ্যে জমির আলীর সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তাঁর সমর্থন নিয়ে আমি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করি। তখন কলেজে আমি দুটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করি। একটি অনুষ্ঠান ছিল মিলাদ মাহফিল, আরেকটি অনুষ্ঠান ছিল আল্লামা ইকবালের মৃত্যুবার্ষিকী। মিলাদ মাহফিলে প্রখ্যাত পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে নিমন্ত্রণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আমি অধ্যক্ষের চিঠি নিয়ে ড. শহীদুল্লাহর পুরান ঢাকার বাসায় দেখা করতে যাই। দরজার ঘণ্টা বাজালে ড. শহীদুল্লাহ নিজেই বেরিয়ে আসেন। তাকে ঢাকা কলেজে মিলাদ মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলে তিনি রাজি হন। তবে একটি শর্ত প্রদান করেন। তিনি বলেন যে তিনি বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দেন কিন্তু ছাত্ররা সেই বক্তৃতা কিছুই মনে রাখতে পারে না। তাই তিনি কিছু সহি হাদিসের বাংলা অনুবাদ করেছেন। এই অনুবাদগুলো ছাত্রদের মধ্যে যদি বিতরণ করা হয়, তাহলেই তিনি যাবেন। তবে এ হাদিসগুলোর অনুবাদ তিনি নিজেই ছাপিয়েছেন এবং প্রতিটি বইয়ের হাদিয়া হলো আট আনা। সুতরাং তাঁকে ৫০টি হাদিসের বই কিনে ২৫ টাকা দিতে হবে। তখন সাংস্কৃতিক সপ্তাহ চলছিল এবং আমাদের প্রচুর বই কেনার বাজেট ছিল। আমি হিসাব করে দেখলাম ৫০টি পুরস্কারের সঙ্গে একটি করে তার অনূদিত হাদিসের বই দিয়ে দিলে কোনো অসুবিধা হবে না। তাই আমি রাজি হয়ে গেলাম। মিলাদের নির্ধারিত দিনে আমার এক বন্ধুকে তাকে ঢাকা কলেজে নিয়ে আসার জন্য পাঠাই। তিনি যথাসময়ে আসেন। তার বক্তব্যে তিনি ধর্মকর্মের চেয়ে ছাত্রদের আধুনিক জীবনযাত্রার তীব্র সমালোচনা করেন। বিশেষ করে টেডি প্যান্ট পরা ছাত্রদের কঠোর ভাষায় গালিগালাজ করেন।

পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা ইকবাল সম্পর্কে অনুষ্ঠানে কিছু বলার জন্য প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দচন্দ্র দেবকে। তিনি তখন জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট। তার বাড়িতে তাঁকে নিমন্ত্রণপত্র দেওয়া হলে তিনি সেটা গ্রহণ করেন। তবে আমরা যখন ফিরে আসছিলাম, তখন আমাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে তার বাড়ির আশপাশে যেসব ঝোঁপঝাড় রয়েছে, সেসব জায়গায় পাকিস্তানি গোয়েন্দায় ভরে আছে। তিনি আমাদের পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বলেন। পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তিনি শাহাদতবরণ করেন।

জমির আলী ঢাকা কলেজে আইএসসিতে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু সে রাজনীতিতে এত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে যায় যে লেখাপড়া কিছুই করেনি। এর ফলে পরীক্ষা দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সে আমার কাছে পরামর্শ চায়। আমি তাকে বলি রাজনীতি করতে হলে তার পক্ষে আইএসসি পড়া সম্ভব নয়। সুতরাং তাকে আইএ পড়তে হবে। আইএ পড়তে হলে সে যত শীঘ্র সম্ভব অন্য কলেজে আইএ দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হলে এক বছর পরই পরীক্ষা দিতে পারবে। আমি তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হতে পরামর্শ দিই। আমার পরামর্শ অনুসারে সে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে পরের বছর প্রথম বিভাগে আইএ পাস করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়।

ঢাকা কলেজ ইউনিয়নের মন্ত্রিসভার আরেকজন সদস্য ছিলেন খন্দকার শহিদুর রব। ঢাকা কলেজে যখন রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী অনুষ্ঠিত হয়, তখন দুই কবির গান নির্বাচন এবং উপস্থাপনের জন্য বক্তব্য রচনা করি আমি ও শহিদুর রব। আমি নজরুলগীতি সম্পর্কে লিখি এবং রবীন্দ্রসংগীত সম্বন্ধে লেখেন শহিদুর রব। বর্তমানে শহিদুর রব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থপতি হিসেবে কাজ করছেন।