ত্রয়োদশ অধ্যায়
কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধ

মধ্য জুলাই ১৯৭১-ডিসেম্বর ১৯৭১

কলকাতায় একনাগাড়ে ছিলাম প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস। বদলি হয়ে জুলাইয়ের মাঝামাঝি যখন কলকাতায় এলাম, তখন অনেক মুক্তিযোদ্ধাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। অনেকেই আশা করেছিলেন যে বর্ষাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে দুটি কারণে টিকতে পারবে না। প্রথমত, পাকিস্তানি সেনারা সাঁতার জানে না। সুতরাং, বর্ষাকালে বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চল পানিতে ডুবে গেলে তারা চলাফেরা করতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা জলাভূমিতেই বড় হয়েছে। সুতরাং এখানে লুকিয়ে থেকে তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অনায়াসে আক্রমণ করতে পারবে। বাস্তবে দেখা গেল বর্ষাকালে পাকিস্তান। সেনাবাহিনী আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। যন্ত্রচালিত নৌযান দিয়ে তারা পুরো। দেশ পাহারা দিচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। ফলে এই সময় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন চিন্তাভাবনা শুরু হয়।

আবাস

কলকাতায় আমি এসে উঠি আমার চাচাতো বোন হেনা বুজির ৪ নম্বর পার্ক সার্কাস অ্যাভিনিউয়ে সোহরাওয়ার্দী ভবনে। দেশ বিভাগের আগে এই ভবনে থাকতেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সোহরাওয়ার্দী। তাঁর একমাত্র সন্তান ছিলেন আইসিএস কর্মকর্তা ইকরাম উল্লাহর পত্নী শায়েস্তা ইকরাম উল্লাহ। তার মৃত্যুর পর শায়েস্তা ইকরাম উল্লাহ বাড়িটির মালিক হন। পাকিস্তান সরকার তার কাছ থেকে বাড়িটি ভাড়া নিয়ে একজন প্রথম সচিব ও একজন তৃতীয় সচিবকে দুটি ফ্ল্যাটে থাকার ব্যবস্থা করেছে। ওপরের ফ্ল্যাটে থাকতেন। কলকাতা পাকিস্তান দূতাবাসের প্রথম সচিব রফিকুল ইসলাম চৌধুরী। নিচের তলায় থাকতেন আমাদের ব্যাচমেট পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা আনোয়ারুল করিম চৌধুরী। আনোয়ারুল করিম চৌধুরীর বাড়ি আমরা আসার আগেই শরণার্থীশিবিরে পরিণত হয়েছে। দোতলায় আর আই চৌধুরীর বাড়িতে চারটি কামরা ছিল। একটি কামরায় থাকতেন আর আই চৌধুরী এবং তার পরিবারের ছেলেমেয়েরা। আর দুটি কামরায় থাকতেন মিসেস চৌধুরীর বন্ধু সাজেদা চৌধুরী, তাঁর স্বামী পুত্র-কন্যা ও ভাইসহ। কামরার বাইরে বারান্দায়ও অনেককে শুতে হতো। আরেকটি কামরা হেনা বুজি ভেবেছিলেন আমাকে ও কামাল সিদ্দিকীকে থাকতে দেবেন। কিন্তু খসরুজ্জামান চৌধুরী তার স্ত্রী ও শ্যালককে নিয়ে আসার পর কামরাটি তাঁকে দিয়ে দেওয়া হয়। আর যে দুটি কামরা ছিল, তার একটি কামরা ছিল স্টোর রুম। যেখানে সব জঞ্জাল রাখা হতো। আর ছাদের ওপরে একটি রুমে চাকররা থাকত। খন্দকার আসাদুজ্জামান এসে তার। পরিবারসহ চাকরদের কক্ষে থাকা শুরু করেন। ওপরে টিন দিয়ে তিনি। কক্ষটিকে একটু সম্প্রসারিত করেন। এই কক্ষটি ছিল অসম্ভব গরম।

স্টোর রুমটির ছাদ ছিল নিচু। সেখানে কোনো ফ্যান লাগানো সম্ভব ছিল না। কক্ষটির পরিসরও ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ। দুটি চৌকি সেখানে ঢোকানো সম্ভব হয়েছিল। আর ছিল একটি চেয়ার, আর একটি স্ট্যান্ড ফ্যান লাগানো হয়েছিল। রুমটি এত গরম ছিল যে স্ট্যান্ড ফ্যানের বাতাসে মোটেও ঠান্ডা হতো না। আমি যখন কলকাতায় আসি, তখন শ্রাবণের শেষ দিক। ভাদ্র মাসে গরম সবচেয়ে বেশি হয়। ওই সময়টায় রাত তিন-চারটা পর্যন্ত ওই কক্ষে ঘুমানো অসম্ভব ছিল। আমি এবং কামাল সিদ্দিকী রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে ১০টার দিকে রুমে ঢুকতাম। সবাই মনে করত আমরা ঘুমাতে গেছি। আসলে ঘণ্টাখানেক গল্পসল্প করে আমরা কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতাম। পার্ক সার্কাসের এই বাড়িতে পাকিস্তানি রাজাকাররা হামলা করতে পারে–এই ভয়ে সন্ধ্যার দিকে গেটে তালা লাগিয়ে দেওয়া হতো। কামালের পিঠে চড়ে প্রতি রাতে আমি গেট টপকাতাম। কামাল এরপর নিজে গেট টপকাত। এরপর আমরা চলে যেতাম রাস্তার অপর পাড়ে, যেখানে পার্ক সার্কাসের ময়দান অবস্থিত। এই ময়দানে শারদীয় মেলা হতো। মেলার অধিকাংশ দোকান সারা রাত খোলা থাকত। মেলায় ক্রেতারা রাত তিন-চারটা পর্যন্ত বিভিন্ন দোকানে এসে জিনিস কিনতেন। আমরা মেলায় হাঁটতাম, খিদে পেলে ফুচকা খেতাম। অনেক সময় শীতল পানীয় দিয়ে তৃষ্ণা মেটাতাম।

কামাল সিদ্দিকীর সঙ্গে আমার পরিচয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে গভর্নর মোনায়েম খানের ওপর যে হামলা হয়, কামাল সিদ্দিকী তার আসামি ছিলেন। তিনি পুলিশের হুলিয়া থেকে বাঁচার জন্য তখন সলিমুল্লাহ হলে মান্নান ভূঁইয়ার রুমে আশ্রয় নেন। তবে তার সঙ্গে তখনো আমার বন্ধুত্ব হয়নি। তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় কলকাতায়। এসে। পাশাপাশি দুই চৌকিতে ঘুমাতে গিয়ে। বেশির ভাগ বিষয়েই আমরা একমত ছিলাম। তবে কোনো কোনো বিষয়ে মতভেদও ছিল। মতভেদ এই বন্ধুত্বকে কখনো শিথিল করেনি। আমার সব বিপদ-আপদে আমাকে রক্ষা করার জন্য সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কামাল সিদ্দিকী। সারা জীবন তিনি আমার উপকারই করেছেন, আমি অতি অল্প প্রতিদানই দিতে পেরেছি। তাঁর কাছে আমার ঋণের শেষ নেই।

আহার

সোহরাওয়ার্দী অ্যাভিনিউয়ে হেনা বুজি বিনে পয়সায় আমাদের আহারের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার বাড়িতে তখন প্রায় ১৭-১৮ জন প্রতি বেলায় খাবার খেত। প্রত্যেক বেলায় খাবারের মেনু ছিল অভিন্ন। প্রতি বেলায় থাকত ভাত, গরুর মাংস, সবজি এবং ডাল। আমরা রাতের বেলা সাধারণত বাসাতেই খেতাম কিন্তু দিনের বেলায় অফিস অঞ্চলে খেয়ে নিতাম। তখন কলকাতায় খাবার ছিল অত্যন্ত সস্তা। দুটি শিক কাবাব, দুটি নান ও এক কাপ চা খেতে কলকাতার ফুটপাতে ১৪ আনা খরচ পড়ত। যেদিন কাবাব খেতে ইচ্ছে করত না, সেদিন রাস্তার আশপাশের রেস্টুরেন্ট থেকে তামিলনাড়ুর খাদ্য দোসা অথবা স্যান্ডউইচ খেতাম। রাতে খাবার একঘেয়ে লাগলে কখনো কখনো আমরা পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় খেতে যেতাম। সেখানে বিরিয়ানি খাওয়া হতো, সঙ্গে সঙ্গে গানও শোনা যেত। আগস্ট মাসের পর কামাল সিদ্দিকীর আর্থিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। কামাল সিদ্দিকীর বড় ভাই মহসিন সিদ্দিকী তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াশিংটন ডিসিতে প্রকৌশলশাস্ত্রে ডক্টরেট করছিলেন। দেশে থাকতে দুই ভাইয়ের সম্পর্ক মোটেও ভালো ছিল না। কামাল সিদ্দিকী ছিলেন পিকিংপন্থী, মহসিন সিদ্দিকী ছিলেন মস্কোপন্থী। তাই দুই ভাইয়ের মধ্যে ঠোকাঠুকি লেগেই ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মহসিন সিদ্দিকী তার ছোট ভাইয়ের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি এটাসেটা (odd jobs) করে ওয়াশিংটনে অতিরিক্ত অর্থ অর্জন করেন এবং কামাল সিদ্দিকীকে ডলার পাঠান। সেই অর্থ কামাল সিদ্দিকী তার দুর্গত বন্ধুদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। কোনো কোনো দিন সে অর্থ দিয়ে তিনি আমাদের খাওয়াতেন। এবং সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন। কলকাতায় থাকতে আমরা বার চারেক সিনেমা দেখতে গিয়েছি। তবে কলকাতায় বাংলাদেশের সব শরণার্থীর জীবন একই ধরনের ছিল না। যারা দেশ থেকে টাকা লুটপাট করে নিয়ে এসেছিল, তাদের অনেকে কলকাতায় চূড়ান্ত বিলাসিতা করেছে। বগুড়ার ট্রেজারি থেকে লুট করা অর্থ নিয়ে এসে একজন অভিনেতা কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেলের বার’ একদিন সম্পূর্ণরূপে নিজের জন্য ভাড়া করেছিলেন। তিনি মুম্বাইয়ে গিয়ে বিলাসবহুল হোটেলে রাত কাটিয়েছেন। এ ধরনের অতি অল্পসংখ্যক বাংলাদেশি শরণার্থী সব শরণার্থী সম্পর্কে অনেকের মনে কলঙ্কিত ধারণার জন্ম দেন।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ

আমাকে আগরতলা থেকে কলকাতায় বদলি করা হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব হিসেবে। তৌফিক ইমামকে প্রথমে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব। নিযুক্ত করা হয়। তিনি তার পরিবারের স্থানান্তরের জন্য আগরতলায় ফিরে যান। তাঁর ফিরে আসার আগপর্যন্ত মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তিনি আমাকে দায়িত্ব দেন। মন্ত্রিপরিষদ সভার জন্য কিছু কার্যপত্রও তৈরি করা হয়। সভার সময় নির্ধারণ করা হয় রাত ১০টায়। আমি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির কক্ষে অনুমতি নিয়ে ঢুকি। কিন্তু মন্ত্রিসভার সদস্যরা সভার কার্যপত্রে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। তাঁরা প্রত্যেকে বিভিন্ন সাংসদের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। রাত যখন ১২টা বাজে, তখনো তাঁদের আলোচনা চলছে। একসময় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাদের এই সভা আরও কয়েক ঘণ্টা চলবে। এগুলো সম্পর্কে সিদ্ধান্ত রেকর্ড করার প্রয়োজন নেই। সুতরাং আপনি বাড়ি চলে যান।

আমি বাড়ি ফিরে আসি। এর পরের সপ্তাহেই তৌফিক ইমাম সাহেব ফিরে আসেন এবং তিনি মন্ত্রিপরিষদ সভার সিদ্ধান্ত রেকর্ড করা শুরু করেন। কোনো কোনো দিন রাত তিন-চারটা পর্যন্ত এই সভা অনুষ্ঠিত হতো। তৌফিক ইমাম সাহেব পুরো সময় সভায় থাকতেন এবং তা রেকর্ড করতেন। জুলাই ১৯৭১ এর প্রথম দিকে ১৯৫৯ ব্যাচের সিএসপি এবং সিলেটের ডেপুটি কমিশনার আবদুস সামাদ সাহেব কলকাতায় উপস্থিত হন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় স্থাপনের আগে প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত সব কাজকর্ম করা হতো সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীর দপ্তর থেকে। কিন্তু মন্ত্রিসভা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে প্রতিরক্ষার সব কাজ সর্বাধিনায়কের দপ্তর থেকে করা সম্ভব নয়। সে জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজন রয়েছে। তবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব পদের জন্য যথেষ্ট জ্যেষ্ঠ কোনো কর্মকর্তা পাওয়া যাচ্ছিল না। ১০ জুলাই ১৯৭১ সালে আবদুস সামাদকে প্রতিরক্ষাসচিব নিযুক্ত করা হয়। তাঁর মন্ত্রণালয়ে দুটি উপসচিবের পদ ছিল। একটি পদের জন্য তিনি আমাকে চান, অন্য পদের জন্য সিলেটের বন সংরক্ষক এস এ ইমামকে চান। তাঁর অনুরোধে আমাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপসচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের জন্য বিশেষ সেল স্থাপন করা হয়। এই সেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. বেলায়েত হোসেন ও সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জাহিদ, সাংবাদিক আল-মুজাহিদী ও নজরুল ইসলামকে বিভিন্ন দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অফিসের স্থান নির্ধারণ করা হয় ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের টিনশেডের একটি কক্ষে। সেখানে আমাদের প্রত্যেককে একটি টেবিল ও একটি চেয়ার দেওয়া হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকর্তার জন্য একটি টাইপরাইটার ও একজন টাইপিস্ট দেওয়া হয়।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে পুরোপুরি কাজ শুরু করে এবং ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুজিবনগরে কাজ করে। প্রায় সাড়ে তিন মাস আমি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছি। এই সময় আমি মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগ যেসব উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে, সে সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। ভারতে যেসব নিয়মিত বাহিনী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করছিল, তাদের খাওয়াদাওয়া, অস্ত্রশস্ত্র এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে দেওয়া হতো। কিন্তু বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে প্রায় সর্বত্রই অনেক মুক্তিযোদ্ধা দায়িত্ব পালন করতেন। এঁদের খাওয়াদাওয়া, অস্ত্রশস্ত্র–এগুলো ভারতীয় সরকার সব সময় দিত না। এঁদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেওয়া ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্ব।

এখানে দুটি ঘটনার উল্লেখ করি। একটি ঘটনা হলো অক্টোবর মাসে মাঠপর্যায় থেকে খবর আসে, বিভিন্ন স্থানে অনিয়মিত বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের রাতে ঘুমানোর জন্য প্রয়োজনীয় কম্বল নেই। মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো পাঁচ হাজার কম্বল এসব বাহিনীর কাছে পাঠানো হবে। এ নির্দেশ যখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে আসে, তখন প্রতিরক্ষাসচিব আমাকে ডেকে বললেন, ‘পাঁচ হাজার কম্বল কিনে মেঘালয়ের তুরাতে পাঠিয়ে দাও। আমি বললাম, ‘কোনো টেন্ডার নেই, কোনো এস্টিমেট নেই, কীভাবে আমি পাঁচ হাজার কম্বল কিনব?’ প্রতিরক্ষাসচিব বললেন, ‘এটা যুদ্ধাবস্থা। এখানে কোনো টেন্ডার লাগে না। তুমি লোকজনকে জিজ্ঞেস করে হিসাব করো পাঁচ হাজার কম্বলের দাম কত হতে পারে। সে টাকার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে হাতে হাতে রিকুইজিশন নিয়ে যাও।’ রিকুইজিশন নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে গেলে আমাকে টাকা দিয়ে দেওয়া হয়। সেই টাকা নিয়ে কয়েকজন বন্ধুবান্ধবসহ বড় বাজারে যাই এবং কম্বল দেখে পছন্দ হলে কোথাও পাঁচ শ কম্বল, কোথাও সাত শ কম্বল–এ রকম করে কম্বল কিনতে কিনতে পাঁচ হাজার কম্বল কিনে এগুলোকে থিয়েটার রোডের অফিসে আনার ব্যবস্থা করি। অন্যদিকে ফোর্ট উইলিয়ামে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ছিলেন। আমি তাকে বলি যে কম্বলগুলো মেঘালয়ের তুরাতে পাঠাতে হবে। সে বলল, তুমি কম্বলগুলো গাড়িতে ভরে সরাসরি ফোর্ট উইলিয়ামে নিয়ে আসো। সেখানে আমি তার কাছে কম্বল হস্তান্তর করি। এই সময় ভারতীয় লেফটেন্যান্ট কর্নেল আমাকে চা খেতে দেন। চা খেতে খেতে তিনি বলেন, তোমরা বাঙালিরা পশ্চিম পাঞ্জাবিদের আক্রমণ ঠিকই প্রতিহত করছ। কিন্তু আমরা পূর্ব পাঞ্জাবের লোকেরা পশ্চিম পাঞ্জাবিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। বাঙালিদের রক্ষা করার জন্য পাঞ্জাবিরা পাঞ্জাবিদের মারছে। এ কাজ কতটুকু সঠিক তা জানি না।

তেমনি আরেকটি ঘটনা ঘটে প্রতিরক্ষাসচিব যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে এসে আমাকে একটি আদেশ দেন। সেই আদেশে তিনি লেখেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মাঠে অনেক ভালো যুদ্ধ করছে। কিন্তু এই যুদ্ধ সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ বাংলাদেশ বেতারে প্রচার করা সম্ভব হচ্ছে না। যদি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে উঁচু মানের টেপ রেকর্ডার পাঠানো যায়, তাহলে সেনাবাহিনীর যুদ্ধের অনেক বাস্তব বিবরণ তুলে ধরা সম্ভব হবে। আমাকে অবিলম্বে ২০টি টেপ রেকর্ডার কিনে শিলিগুড়িতে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়। আমি কম্বলের পদ্ধতি অনুসরণ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করি। চৌরঙ্গিতে গিয়ে টেপ রেকর্ডারের দোকান থেকে উন্নত মানের টেপ রেকর্ডার কিনে থিয়েটার রোডে নিয়ে আসি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সেই টেপ রেকর্ডারগুলো শিলিগুড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই টেপ রেকর্ডারগুলোও কতটুকু কাজে লেগেছে, তা জানি না। তবে আমরা আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছি।

প্রায় ৫০ বছর পর সেই স্মৃতি রোমন্থন করলে আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন জাগে। ৫০ বছর আগে বিনা টেন্ডারে অনেক কারিগরি তথ্য না জেনেও যে সিদ্ধান্ত দ্রুততার সঙ্গে নিতে পেরেছি, আজকে ৫০ বছর পরে আমরা কি একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারব? অবিশ্বাস, হিংসা-বিদ্বেষ আজকের আমলাতন্ত্রকে অনেক খাটো ও খর্ব করে দিয়েছে।

এ সময়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আরও দুটি কাজ করে। প্রথমত, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে প্রথম ব্যাচে ১০০ জন অফিসার প্রশিক্ষণের জন্য নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই শিক্ষানবিশ অফিসারদের বাছাই করার দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রতিরক্ষাসচিব আবদুস সামাদকে। তিনি বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত আঞ্চলিক অফিসগুলোতে যান এবং সেখানে সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রার্থী নির্বাচন করেন। বিভিন্ন সময় তিনি তাঁর কনিষ্ঠ সহকর্মীদের তার বোর্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেন। সাতক্ষীরা সীমান্তে টাকি শহরে যে ইন্টারভিউ হয়েছিল, তাতে আমি সদস্য হিসেবে কাজ করেছি। দুই মাসের মধ্যে এই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়। তাই প্রতিরক্ষাসচিব অনেক সময়ই কলকাতায় থাকতে পারতেন না।

আরেকটি বিষয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়। পাকিস্তান সমর্থকদের ভয় পাওয়ানোর জন্য এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে দুই-তিন মাস সময়ে এ ক্ষেত্রে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।