কলকাতায় জীবন

১৯৭১ সালে কলকাতা নগরী ছিল বাঙালির সাহিত্য-শিল্প এবং সংস্কৃতির পীঠস্থান। আমি যখন কলকাতায় যাই, তখন আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে কলকাতার ৯০ শতাংশ লোক বাঙালি। কলকাতায় আসার পর দেখলাম এ ধারণা ভুল। কলকাতার কেন্দ্রস্থলে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ লোক হিন্দি ভাষাভাষী। কলকাতা ময়দান থেকে শুরু করে পার্ক সার্কাস ও গড়িয়ারহাট পর্যন্ত বাংলার কোনো অস্তিত্বই ছিল না। সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকার। শারদীয় পূজার সংখ্যা বের হয়। একদিন বিকেলে আমি হাঁটতে যাচ্ছিলাম, তখন। হেনা বুজি আমাকে বললেন কয়েকটি পূজার সংখ্যা কিনে নিয়ে আয় তো। আমি পার্ক সার্কাস থেকে রওনা হলাম। রাস্তায় নামতেই অনেক বইয়ের দোকান। দোকানে ঢুকে দেখি শুধু ইংরেজি এবং হিন্দি বই আছে; কোনো বাংলা বই নেই। পার্ক সার্কাস থেকে তিন মাইল হেঁটে একটিও বাংলা বইয়ের দোকান পাইনি। শেষে আমি নিউমার্কেট যাই এবং নিউমার্কেটে গিয়ে নিউমার্কেটের পেছনের অংশে বাংলা বইয়ের দোকান এবং পূজাসংখ্যা পাই।

কলকাতায় বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধারা শুধু তাদের নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করতেন কিন্তু বাইরের লোকদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল ক্ষীণ। বাংলা ভাষাভাষী হিন্দুদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু বাংলা বা উর্দু ভাষাভাষী মুসলমানদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ছিল অত্যন্ত শক্ত। কলকাতার প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলমান ছিল পাকিস্তানের সমর্থক। হয় তাদের পরিবারের কাউকে ইতিমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে সম্পূর্ণ পরিবারের অভিবাসনের ব্যবস্থা করতে পাঠানো হয়েছে অথবা পুরো পরিবার কীভাবে পাকিস্তানে অভিবাসন করা যায়, সে সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা করছে। মুসলমানদের মধ্যে শতকরা ১০ ভাগ ছিল শিক্ষিত এবং সংস্কৃতমনা। শুধু এরাই মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য বুঝত। ড. ফারুক আজিজ খান মুজিবনগরে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব ছিলেন। স্প্রিং ১৯৭১ গ্রন্থে তিনি তাঁর সে সময়কার স্মৃতি লিপিবদ্ধ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন।

Unfortunately, the Indian Muslims were totally against Bangladesh. They used to hold religious functions and meetings in which they made use of every opportunity to criticise us and accuse India for working against Pakistan. The attitude of the West Bengal Muslims was so bad that the Government of India had to take precaution against communal riots breaking out. Fleeing Bengalis in distress were very badly treated even by their relatives on the Indian side of the border, some were not given even temporary shelter for a few days.[১]

মুক্তিযোদ্ধা ওয়ালিউল ইসলামও এ সম্পর্কে তার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথায় লিখেছেন :

লক্ষ্ণৌর সাপ্তাহিকী সিদকি ই জাদিদ-এর বিদগ্ধ সম্পাদক মাওলানা আবদুল মজিদ দরিয়াবাদী ১৯৭১ সালের ১১ জুন লিখেছেন, পাকিস্তানের ইসলামাবাদ কোন আলোচনা দাবী করে না; তবে সে দেশের সরকার মুসলিম সরকার; ঐ সরকারের বিরোধিতা ক্ষমা করা যায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভের পর তিনি লিখলেন, আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার ন্যায় পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র। যারা এর বিরোধিতা করেছে তাদেরকে নিন্দা করতে হবে। এটা শরিয়া তথ্য; এদেরকে মুক্তিফৌজ বা স্বাধীনতা সংগ্রামি তকমা দিয়ে ছাড় দেয়া যাবে না।[২]

যাহোক, ঈদের দিন আমি ঈদের নামাজ পড়তে মসজিদে গেলাম। বড় কোনো মসজিদের বৃহৎ জামাতে যোগ দিইনি; লোয়ার সার্কুলার রোডের পাশে একটি ছোট্ট জীর্ণ মসজিদে নামাজ আদায় করেছিলাম। অথচ তখন কোনো কোনো উর্দু (মুসলিম) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল যে ৩৫০-এর অধিকসংখ্যক মুসলিম কলকাতার বাংলাদেশ মিশনে কাজ করছিলেন; তাঁরা ভারতীয় মুসলমানদের বেদরদি মনোভাবের জন্য নিজেরা স্বতন্ত্র জামাতে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করেছেন। কিন্তু এমন কোনো জামাতের তথ্য আমার জানা নেই। আমি মিশনের খুব কাছেই থাকতাম। আর কলকাতার বাংলাদেশ মিশনে ১০০ জনের কমসংখ্যক লোক কাজ করতেন; ৩৬০+ নয়। যুদ্ধকালে এ তথ্যের বহুল প্রচার ঘটে।

তবে আমাদের জীবন একেবারে নিরানন্দ ছিল না। আমরা অনেক আড্ডা দিতাম। সে সময়ে কিছু সামাজিক ঘটনাও ঘটে। এ ধরনের একটি ঘটনা ছিল রফিকুল ইসলাম চৌধুরীর বড় মেয়ে নিম্মির সঙ্গে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা ক্যাপ্টেন ডালিমের বিয়ে। এই বিয়ের একটি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন ফারুক আজিজ খান। তিনি লিখেছেন :

While the task of organizing the liberation forces and making preparations for waging a decisive war against the Pakistan army was weighing heavy on the minds of many who had to share this responsibility, unexpected things, although would be considered rather usual under normal situations, also happened. One morning I found the prime minister in totally off-mood as if he hadn’t had much sleep in the night. For him it was quite usual to continue working late in the night on one thing or the other. But that morning I thought some thing more unusual had happened. Gathering courage I asked him if any thing had gone wrong. ‘Wrong?’, he snapped, ‘don’t you know anything?’ ‘No, sir’, I said nervously. I thought the Pakistan air force must have bombed somewhere or the army shelled some place or some thing really serious had happened about which I had no knowledge. ‘You seem to be out of touch with what is going on around you’, and then after a little pause he said, ‘Capt. Dalim has married the daughter of Mr. Rafiq Chowhury against the wishes of the family and I had to convince the father of the bride to accept the situation. I spent almost the whole night trying to convince Rafiq bhai who happens to be a relative of mine to accept the situation with grace. Now, tell me, am I to fight a war or act as a marriage broker?’. I could understand his sentiments and his difficulties. Both Mr. Rafiq Chowdhury who was a first secretary in the Bangladesh High Commission and Capt. Shariful Huq Dalim (who became famous on August 15, 1975) were very important persons in the government structure and that made the issue very sensitive. But human beings are human beings no matter where they were. One can not part with his feelings and sentiments just because he is in distress. In Vietnam for years the people survived under heavy American bombing and shelling and they had to live in trenches and yet they married, they raised families and they had moments of joy. We also had to have our lighter moments and the burden we were carrying in our minds was becoming somewhat bearable with every passing day. We were slowly getting used to the hardships and the uncertainties that lay ahead of all of us.’[৩]

আগস্ট ১৯৭১ সালে নিম্মি-ডালিমের বিয়ে উপলক্ষে সবাই খুশি। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে ক্যাপ্টেন ডালিম মৌলভীবাজার ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে গেলেন। একদিন তিনি মর্টার যাতে সঠিকভাবে নিক্ষেপ করা হয়, তার নির্দেশনা। দেওয়ার জন্য একটি উঁচু গাছে উঠে সেখান থেকে যারা মর্টার ছুড়ছিল, তাদের। নির্দেশ দিচ্ছিলেন। এক রাজাকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে এ তথ্য জানিয়ে দেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সরাসরি ডালিমকে গুলি করে। গুলি লেগে তার ডান হাত মারাত্মকভাবে জখম হয়। এ হাত আর কখনো ভালো হয়নি। হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে ক্যাপ্টেন ডালিম আবার কলকাতায় ফিরে আসলেন। এভাবেই। হাসি-কান্নার মধ্য দিয়ে আমাদের সবার জীবন চলছিল।

দিল্লি-আজমির ভ্রমণ

আগস্ট ১৯৭১ সালের শেষ দিকে হেনা বুজির একমাত্র ছেলে বাপ্পীর কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ কোর্সে ভর্তির সুযোগ হয়। কানাডাতে তার সব খরচের দায়িত্ব নেন রফিকুল ইসলাম চৌধুরীর ছোট ভাই ড. চৌধুরী, যিনি তখন মন্ট্রিয়লে একজন বিশিষ্ট হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। কানাডায় যাওয়ার জন্য নয়াদিল্লির কানাডিয়ান হাইকমিশনে বাপ্পীকে ইন্টারভিউ দিতে হবে। তাই তার নয়াদিল্লি যাওয়া প্রয়োজন। ভারতে তখন অনেক মুসলমান পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করছে। এদের কেউ টের পেলে বাপ্পীকে ছিনতাই করতে পারে। তাই সিদ্ধান্ত হয় যে বাপ্পীকে একা নয়াদিল্লি যেতে দেওয়া ঠিক হবে না। বাপ্পীর সঙ্গে আমিও যাব। আমি এক সপ্তাহের ছুটি নিলাম। আমি এবং বাপ্পী রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লি রওনা হই। রাজধানী এক্সপ্রেস একটি বিলাসবহুল ট্রেন ছিল। এই ট্রেনের সুযোগ-সুবিধা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশন কনট প্লেসে হোটেল ‘জনপথ’ নামে একটি হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে। হোটেলটিতে এয়ারকন্ডিশনের ব্যবস্থা ছিল। তাই কোনো অসুবিধা হয়নি। বাপ্পীর সঙ্গে আমি বাংলাদেশ দূতাবাসে যাই। নয়াদিল্লিস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি কে এম সাহাবুদ্দিন ও প্রেস কাউন্সিলর আমজাদ হোসেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন দিয়ে বেরিয়ে আসেন। নয়াদিল্লিতে একটি বাড়ি ভাড়া করে সেখানে সাহাবুদ্দিন বাংলাদেশের দূতাবাস খোলেন। আমরা যখন দিল্লিতে ছিলাম, তখন প্রতিদিনই দূতাবাসে যেতাম। একদিন বিকেলবেলা দূতাবাসে বসে আছি, তখন দেখতে পেলাম যে একজন। বাঙালি ভদ্রলোক ও একজন বাঙালি ভদ্রমহিলা সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য এসেছেন। তারা সাহাবুদ্দিনের কক্ষে এলে তাদের পরিচয় দিয়ে বললেন। যে ভদ্রলোক হচ্ছেন ছোট ভাই, যিনি মধ্যপ্রদেশে একটি কারখানার জেনারেল ম্যানেজার আর মহিলাটি হচ্ছেন তার দিদি, যার স্বামী রাজস্থানে অধ্যাপনা করেন। গত প্রায় ১০-১২ বছর ধরে ভাই-বোনের কোনো দেখা হয়নি। এই ভাই-বোনের বাড়ি ছিল বরিশালে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তাঁরা ভারতে চলে আসেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাই ভাই-বোন খুবই উৎফুল্ল হন। তারা ঠিক করেন যে তারা একসঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাসে। আসবেন। তাঁরা দিল্লিতে একত্র হয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে এসেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সমর্থন জানানোর জন্য এবং তারা দুজন ১০ হাজার টাকা বাংলাদেশ দূতাবাসকে দান করেন। তারা বলছিলেন যে তারা বরিশালে ফিরে যেতে চান না কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ সফল হলে বরিশালে সবাই সুখে শান্তিতে থাকতে পারবে–এটিই হবে তাঁদের জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

বাপ্পীর ভিসার কাজ শেষ হলে আমরা প্রথমে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার জিয়ারত করতে যাই। মাজারের পরিবেশ ছিল অত্যন্ত নোংরা এবং মাজারে ঢোকার পথে অসংখ্য কুষ্ঠরোগী ভিক্ষা করছিল। নিজামউদ্দিন। আউলিয়ার মাজারে ঢুকতে গিয়ে মোটেই শান্তি পাচ্ছিলাম না। তবে ঢোকার পর মনে হলো যে এই মাজারে শাহজাহানের কন্যা জাহানারার মাজারও অবস্থিত। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করায় মাজারের বাইরে তারা একটি কবর দেখিয়ে বলেন এটি জাহানারার কবর। কবরে একটি প্রস্তরস্তম্ভে ফারসিতে কী যেন লেখা আছে। পড়তে পারিনি। তবে বাঙালি কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কল্যাণে আমরা এর মর্মার্থ জানি, ‘গরিব ঘরে দীপ জ্বেলো না ফুল দিয়ো না কেউ ভুলে, শ্যামা পোকায় না পুড়ে পাখ, দাগ না পায় বুলবুলে। এরপর আমরা আজমির শরিফে মঈনুদ্দীন চিশতির মাজার জিয়ারত করতে রওনা হই। রাত ১০টার দিকে আমরা ট্রেনে আজমিরের উদ্দেশে যাত্রা করি। সারা রাত ট্রেনে ভ্রমণ করে পরদিন সকালে আমরা আজমির শরিফে যাই। রাত তিনটার দিকে লোকজনের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়। লোকজনের চিৎকারের কারণ হলো যে তখন বাইরে মরুভূমিতে অসংখ্য ময়ূর দেখা যাচ্ছিল। আমরা। সবাই ময়ূর দেখে উত্তেজিত। একটু পরপর ময়ূরের ঝক দেখা যাচ্ছিল। আমরা মরুভূমিতে ময়ূরের সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়ে যাই। আজমির শরিফে মাজার ছিল অনেক পরিচ্ছন্ন। সেখানে মাজার জিয়ারত করে আমরা দিল্লি হয়ে কলকাতায় ফিরে আসি।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. Faruq Aziz Khan, Spring 1971, 1993 (Published by the writer), P-156
  2. ওয়ালিউল ইসলাম, একাত্তরের ইতিকথা, (প্রকাশিতব্য), পৃষ্ঠা-১৯৯
  3. Faruq Aziz Khan, Op.Cit, 1993, P-156-157