মুজিবনগর সরকারের বিবর্তন

মুজিবনগর সরকার প্রথমে শুরু হয়েছিল একটি ছোট সরকার হিসেবে। মন্ত্রিপরিষদে মাত্র পাঁচজন সদস্য ছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, এম মনসুর আলী ছিলেন অর্থমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমদ ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং কামারুজ্জামান ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু মন্ত্রীদের কাজও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। ১৯৭১ সালের ২০ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংগঠন এবং কার্যাবলির ওপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ একটি প্রতিবেদন পেশ করে। এই প্রতিবেদন থেকে বাংলাদেশ সরকারের গঠন সম্পর্কে একটি চিত্র পাওয়া যায়।

  1. প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়
  2. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
  3. অর্থ ও শিল্প বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
  4. মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়
  5. সাধারণ প্রশাসন বিভাগ
  6. স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়
  7. তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়
  8. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
  9. ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়
  10. সংসদবিষয়ক বিভাগ
  11. কৃষি বিভাগ
  12. প্রকৌশল বিভাগ[১]

মন্ত্রণালয়ের বাইরে আরও কয়েকটি সংস্থা ছিল, যারা সরাসরি মন্ত্রিপরিষদের কর্তৃত্বাধীনে কাজ করত। যেমন :

  1. পরিকল্পনা কমিশন
  2. শিল্প ও বাণিজ্য বোর্ড
  3. নিয়ন্ত্রণ বোর্ড, যুব ও অভ্যর্থনা শিবির
  4. ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি
  5. শরণার্থী কল্যাণ বোর্ড।[২]

এ ছাড়া ১৫টি সংগঠন বাংলাদেশ সরকারের সমর্থনে কাজ করছিল। এই সংগঠনগুলো নিম্নরূপ :

  1. যুব নিয়ন্ত্রণ পরিষদ ও প্রশিক্ষণ বোর্ড
  2. বাংলাদেশ হাসপাতাল
  3. স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
  4. জয় বাংলা পত্রিকা।
  5. বাংলাদেশ বুলেটিন
  6. বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী সংগঠন
  7. বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি
  8. স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল
  9. বঙ্গবন্ধু শিল্পী গোষ্ঠী
  10. বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী গোষ্ঠী
  11. বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি
  12. বাংলাদেশ সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী পরিষদ।
  13. নিউইয়র্ক বাংলাদেশ লীগ
  14. বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি, লন্ডন
  15. লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্টসিয়া।

এ তালিকার বাইরে একটি ডাক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ বিভাগ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ডাকটিকিট বিক্রির ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীতে তিন ধরনের সদস্য ছিল। এক ধরনের সদস্য ছিল নিয়মিত বাহিনীর সদস্য। এরা পাকিস্তান বাহিনীর বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের বাঙালি সদস্যদের নিয়ে গঠিত ছিল। মুক্তিবাহিনীকে ১১টি সেক্টরে মোতায়েন করা হয়। তিনজন বিশিষ্ট সেনা অফিসারের আদ্যক্ষর দিয়ে অতিরিক্ত বাহিনীর নামকরণ করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের নামে করা হয়েছিল জেড ফোর্স, খালেদ মোশাররফের নামে করা হয়েছিল কে ফোর্স এবং সফিউল্লাহর নামে করা হয়েছিল এস ফোর্স। এ ছাড়া আর দুই ধরনের বাহিনী ছিল। ছাত্র-তরুণ অসামরিক ব্যক্তি সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ যারা রাজনৈতিকভাবে শেখ মনি, সিরাজুল আলম খান এবং তোফায়েল আহমেদের অনুগত ছিলেন, তাঁরা ‘মুজিব বাহিনী’ বা ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’ নামে পরিচিত ছিলেন। এ ছাড়া নৌকমান্ডো এবং নৌবাহিনীর লোকজনও মুক্তিফৌজে ছিল। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অফিসার ও সৈনিকেরা বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গড়ে তোলেন। সব নিয়মিত বাহিনী মিলে কমপক্ষে ২৫ হাজার সৈনিক ছিল।

এই নিয়মিত বাহিনীর বাইরে ছিল যুব ক্যাম্প। সারা দেশে সীমান্ত ঘিরে ভারতের অভ্যন্তরে ১০০টি ইয়ুথ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিটি ইয়ুথ ক্যাম্পের ধারণক্ষমতা ছিল ১ হাজার। সুতরাং ইয়ুথ ক্যাম্পে প্রায় ১ লাখ তরুণকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল। এই ইয়ুথ ক্যাম্পগুলোর পরিচালনার দায়িত্বে ছিল প্রফেসর ইউসুফ আলীর নেতৃত্বে একটি বোর্ড। প্রতিটি ইয়ুথ ক্যাম্পে কমপক্ষে একজন জাতীয় পরিষদ সদস্য ও একজন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য যুক্ত থাকতেন। ইয়ুথ ক্যাম্পকে সমর্থন করার জন্য প্রতিটি ক্যাম্পে অসামরিক কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়।

১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই বাংলাদেশে নিম্নলিখিত প্রশাসনিক জোন প্রতিষ্ঠা করা হয় :

(১) দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল (১), সদর দপ্তর : সাবরুম

(ক) চট্টগ্রাম (খ) পার্বত্য চট্টগ্রাম (গ) নোয়াখালী জেলার ফেনী মহকুমা

(২) দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল (২), সদর দপ্তর : আগরতলা

(ক) ঢাকা (খ) কুমিল্লা (গ) ফেনী মহকুমা ব্যতীত নোয়াখালী জেলা

(৩) পূর্ব অঞ্চল, সদর দপ্তর : ধর্মনগর।

(ক) হবিগঞ্জ (খ) সিলেট জেলার মৌলভীবাজার মহকুমা

(৪) দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল (১), সদর দপ্তর : ডাউঁকি

(ক) সদর (খ) সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমা

(৫) দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল (২), সদর দপ্তর : তুরা

(ক) ময়মনসিংহ (খ) টাঙ্গাইল

(৬) উত্তর অঞ্চল (১), সদর দপ্তর : কোচবিহার

(ক) রংপুর

(৭) পশ্চিম অঞ্চল (১), সদর দপ্তর : বালুরঘাট

(ক) দিনাজপুর, (খ) বগুড়া, (গ) রাজশাহী

(৮) দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল, সদর দপ্তর : কৃষ্ণনগর

(ক) পাবনা, (খ) কুষ্টিয়া, (গ) ফরিদপুর, (ঘ) যশোর

(৯) দক্ষিণ অঞ্চল, সদর দপ্তর : বারাসাত

(ক) বরিশাল (খ) পটুয়াখালী, (গ) খুলনা[৩]

প্রতিটি অঞ্চলে সব জাতীয় পরিষদ সদস্য ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে একটি আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়। প্রতিটি আঞ্চলিক পরিষদে একজন জাতীয় পরিষদ সদস্যকে সভাপতি করা হয়। আঞ্চলিক পরিষদের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য আঞ্চলিক প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। আঞ্চলিক প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে সহায়তা করার জন্য নিম্নলিখিত সাতটি কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি করা হয় :

  1. আঞ্চলিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা
  2. আঞ্চলিক শিক্ষা কর্মকর্তা
  3. আঞ্চলিক ত্রাণ কর্মকর্তা
  4. আঞ্চলিক প্রকৌশলী
  5. আঞ্চলিক পুলিশ কর্মকর্তা
  6. আঞ্চলিক তথ্য কর্মকর্তা
  7. আঞ্চলিক হিসাব কর্মকর্তা।

সরকারের নতুন পদ সৃষ্টি ২০ অক্টোবরের পর শেষ হয়ে যায়নি। ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকারের মহাসচিব বা সেক্রেটারি জেনারেলের পদ সৃষ্টি করা হয়। এর আগে এম নুরুল কাদের সেক্রেটারি, জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন পদে নিযুক্ত ছিলেন। অনেক সময় তিনি সেক্রেটারির পরে ‘কমা না দিয়ে সেক্রেটারি জেনারেলের পরে কমা’ ব্যবহার করতেন, যাতে অনেকের মনে হতো এম নুরুল কাদেরই বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। আসলে নুরুল কাদের কখনো সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন না, তার পদমর্যাদা ছিল সচিবের। ১২ ডিসেম্বর সেক্রেটারি জেনারেল পদে নিয়োগ দেওয়া হয় আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলার আসামি এবং ১৯৪৯ ব্যাচের সিএসপি অফিসার রুহুল কুদ্সকে।

মুজিবনগর সরকারে অন্তর্দ্বন্দ্ব

মুজিবনগর সরকার যতই বড় হতে থাকে, ততই তার মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত সরকার দুটি হুমকির সম্মুখীন হয়। প্রথমত, আওয়ামী লীগের তরুণ ছাত্রনেতারা যুদ্ধের জন্য কোনো সরকারের প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন। তাঁদের মতে, যুদ্ধের জন্য বিপ্লবী কমান্ড প্রতিষ্ঠা করাই যথেষ্ট। এই কমান্ড বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কাজ করবে। এই মতের প্রবক্তা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ এবং অন্যান্য ছাত্রনেতা। তারা ভয় প্রকাশ করেন যে তাঁদের হাতে নেতৃত্ব না থাকলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব উৎখাত হতে পারে। ভারত সরকার আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা মেনে নেয়। তাই বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর বাইরে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সেস’ (BLF) নামে একটি স্বতন্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা হয়। এই বাহিনীর সংগঠকেরা তাঁদের বাহিনীকে ‘মুজিব বাহিনী বলতেন। মুজিব বাহিনী’ নাম নিয়ে তাঁরা নিজেদের মুক্তিবাহিনীর বাইরের শক্তি বলে পরিচয় দিতেন। আওয়ামী লীগের প্রতি অতি বিশ্বস্ত ১০ হাজার ছাত্রকে এই বাহিনীতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এঁদের প্রশিক্ষণ হয় ভারতের দেরাদুনের অদূরে চাকরাতা প্রশিক্ষণঘাটিতে। মেজর জেনারেল এস এস ওবানকে এ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।[৪] তিনি মুজিব বাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দেন এবং পাকিস্তান বাহিনীকে আক্রমণ করার জন্য এঁদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও দেওয়া হয়। তাজউদ্দীন আহমদ এবং জেনারেল ওসমানী এঁদের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডে আনার পক্ষপাতী ছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই প্রস্তাব অনুমোদন করলেও ‘মুজিব বাহিনী’র সংগঠকদের বিরোধিতার কারণে এ প্রস্তাব কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে পরস্পরকে সব সময় সহযোগিতা করেনি। অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেদের মধ্যে লড়াই করেছে।

দ্বিতীয় দ্বন্দ্ব দেখা দেয় মুজিবনগর সরকার এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সাংসদদের মাধ্যমে। প্রতিবিপ্লবীদের নেতৃত্বে ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। তাঁকে সহায়তা করছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং জহিরুল কাইয়ুম। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে যে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সব সংসদ সদস্য রয়েছেন, সেটা প্রমাণ করার প্রয়োজন ছিল। তাই ভারত সরকারের সহায়তায় শিলিগুড়ির জঙ্গল অঞ্চলে ৫ জুলাই তারিখে আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ভারত সরকারের সমর্থন নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত সরকারকে আওয়ামী লীগ সাংসদেরা সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন দেয়।

শিলিগুড়ি সম্মেলনের পর মুজিবনগর সরকারের প্রতি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ দূর হয় কিন্তু ভেতরে-ভেতরে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। এ ষড়যন্ত্রের নেতা ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। তাঁকে সহায়তা করেন কুমিল্লার আওয়ামী লীগ নেতা জহিরুল কাইয়ুম এবং পররাষ্ট্রসচিব মাহবুবুল আলম চাষী (যাকে মার্কিন সরকারের কাছে পাকিস্তানের দেশরক্ষার গোপনীয় বিষয়াদি পাচার করার অভিযোগে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়)। তাজউদ্দীন আহমদ এবং ভারত সরকার প্রথম থেকেই খন্দকার মোশতাককে সন্দেহ করত। তাজউদ্দীন আহমদ খন্দকার মোশতাকের একান্ত সচিব হিসেবে কামাল সিদ্দিকীকে নিয়োগ করেন। নিয়োগের আগে তিনি খন্দকার মোশতাকের সন্দেহজনক আচরণ সম্পর্কে কামাল সিদ্দিকীকে জানান এবং খন্দকার মোশতাকের সব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাঁকে সরাসরি অবহিত রাখার জন্য কামাল সিদ্দিকীকে নির্দেশ দেন। কামাল সিদ্দিকী খোন্দকার মোশতাকের টেলিফোনের নিচে কয়েকটি অচেনা কাগজে টেলিফোন নম্বর দেখতে পান। টেলিফোন নম্বরগুলোকে কপি করে তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে দেন। তাজউদ্দীন আহমদ পরে কামাল সিদ্দিকীকে জানান যে টেলিফোন নম্বরগুলো কলকাতার আমেরিকান কনস্যুলেট জেনারেলের অফিসের। ভারতীয়দের তদন্তে আরও জানা যায় খন্দকার মোশতাকের পক্ষে জহিরুল কাইয়ুম মার্কিন দূতাবাসে দেখা করতে যান।

১৯৭১ সালের আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের যে সভা অনুষ্ঠিত হবে, সে সভার জন্য বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মনোনয়ন দেওয়া হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন। তাঁর সঙ্গে তার একান্ত সচিব কামাল সিদ্দিকী যাবেন কাগজপত্র নিয়ে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তার একান্ত সচিবের বিশ্বসভায় অংশগ্রহণের উপযুক্ত কাপড়চোপড়ের জন্য দেড় হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। কামাল সিদ্দিকী এ টাকা তুলে তার মন্ত্রীর জন্য পোশাক তৈরি করার ব্যবস্থা করেন এবং নিজে একটি স্যুট ও একজোড়া জুতা কেনেন। তারপর হঠাৎ খন্দকার মোশতাকের নিউইয়র্ক সফর বাতিল করা হয়। জানা যায়, ভারত সরকার টের পেয়েছিল খোন্দকার মোশতাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছেন। তাঁর শর্ত ছিল পাকিস্তান যদি শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেয়, তাহলে শেখ মুজিব এসে যুদ্ধ বন্ধ করে দেবেন এবং এক পাকিস্তানের কাঠামোতে সাংবিধানিক সমস্যার সমাধান করবেন। ভারত সরকার তাই খন্দকার মোশতাককে দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট দিতে অস্বীকার করেন। কামাল সিদ্দিকীরও দেশের বাইরে যাওয়া হয়নি। শীতের সময়ে মাঝেমধ্যে বাইরে গেলে আমি কামাল সিদ্দিকীর কাছ থেকে নিউইয়র্কে যাওয়ার জন্য তৈরি করা তার কোটটি ধার করতাম।

মোশতাকের সমর্থকেরা যে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতা চেষ্টা করছে, তা মোশতাকের অন্য সহকর্মীদের আচরণ থেকেও বোঝা যাচ্ছিল। তাহেরউদ্দীন ঠাকুর ছিলেন সরাইল থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য। তিনি খন্দকার মোশতাকের অনেক কাছের লোক ছিলেন। আমি কলকাতায় যোগ দেওয়ার পর একদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাই। সেখানে তাহেরউদ্দীন ঠাকুরের সঙ্গে আমার দেখা হয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতে করতে একপর্যায়ে তাহেরউদ্দীন। ঠাকুর আমাকে বলেন, এসডিও সাহেব, আপনারা কেন এই রাজনৈতিক বিষয়ে জড়ালেন সেটা বুঝতে পারছি না। আমরা রাজনীতিবিদেরা অনেক বিষয়ে ঝগড়া করি আবার সেসব বিষয় নিয়ে আপসও করি। আমাদের জন্য কিছুই বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু আপনাদের আইনের ভিত্তিতে প্রশাসন চালাতে হয়। একবার যদি আইন ভাঙেন, তাহলে আপনাদের অবশ্যই শাস্তি হবে। সুতরাং যদি দেখা যায় কিছুদিন পর আপস করে আমরা ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরে গেছি, তখন কিন্তু আপনারা ফিরে যেতে পারবেন না। আপনাদের বিচার হবে।

তার এই বক্তব্য আমি সঙ্গে সঙ্গে কামাল সিদ্দিকীকে জানাই। আমরা দুজনে খসরুজ্জামান চৌধুরী, সাদাত হোসেনসহ অন্যান্য কনিষ্ঠ সহকর্মীর সঙ্গে আলোচনা করি এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাই শুধু দেশের স্বার্থেই নয়, আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অপরিহার্য বলে। সুতরাং যারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, তাদের সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই আপস করা যাবে না।

তবে মুক্তিবাহিনী এবং মুজিব বাহিনীর মধ্যে সব ক্ষেত্রে সংঘর্ষ এড়ানো যায়নি। মুজিব বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের আদৌ কোনো পাত্তা দিতেন না। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেয়। মুজিব বাহিনীর সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী–কারও আদেশই মানতেন না। তারা শুধু শেখ মনি ও কয়েকজন ছাত্রনেতার আদেশ মানতেন। এই দ্বন্দ্ব মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় নিরসন করা যায়নি। ভারত সরকার এ ব্যাপারে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। অন্তর্দ্বন্দ্ব মুক্তিবাহিনীর ভেতরেও ছিল। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে জেড ফোর্স, সফিউল্লাহর নেতৃত্বে এস ফোর্স এবং খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে কে ফোর্সের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ছিল। এই দ্বন্দ্ব মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিরসন। করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশে হানাহানির মাধ্যমে এই অন্তর্দ্বন্দ্বের নিরসন হয়।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

  1. এইচ টি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, ২০০৪ (ঢাকা : আগামী প্রকাশনী), পৃষ্ঠা-৬৫-৬৬।
  2. এইচ টি ইমাম। ২০০৪। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-১৫২
  3. এইচ টি ইমাম। ২০০৪। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৫১৯-৫২৪।
  4. এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান, এস আর মীর্জা, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন, ২০০৯ (ঢাকা : প্রথমা প্রকাশন), পৃষ্ঠা-১২৬